করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়া থেকে তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্ব দিকে যাত্রা করে, দুই বছরে সিন্ধু উপত্যকায় পৌঁছে তার বিজয়রথ থামিয়েছিল। স্বপ্নে থাকলেও বাস্তবে তার বিশ্বজয় সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমাদের করোনা ভাইরাস, অর্থাৎ কোভিড-১৯ মাত্র তিন মাসে চীন থেকে উল্টোদিকে, পশ্চিমে যাত্রা করে এরই মধ্যে সারা বিশ্ব কব্জা করে নিয়েছে। আজ পর্যন্ত মারা পড়েছে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ। আলেকজান্ডারের ছিল সুবিশাল সৈন্যবাহিনী।আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনা, ইলেকট্রন মাইক্রোসকোপ ছাড়া যাকে চোখে দেখা যায় না, যুদ্ধযাত্রা করেছে নিঃসঙ্গ একাকী। আলেকজান্ডারের যা কিছু অর্জন সবই স্থলে। করোনা জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বগামী।
আমাদের, মানুষদের জ্ঞাতি ভাই যেমন শিম্পাঞ্জি, বনোবো, কোভিড-১৯ এর জ্ঞাতি ভাই হচ্ছে SARS, MERS ইত্যাদী। আরো একটু পেছনে গেলে দেখি পোলিও(১৯০৮), ইনফ্লুয়েনজা (১৯১৮), ইয়েলো ফিভার(১৯২৭), এনসেফেলাইটিস(১৯৩০), ডেঙ্গু(১৯৪৩), হাম(১৯৫৪), হেপাটাইটিস(১৯৬৩), এবোলা(১৯৭৬), এইচআইভি( ১৯৮৩) এবং আরো কিছু ভাইরাস মিলে অতীতে বিভিন্ন সময়ে অগুনতি মানুষের মৃত্যুর কারন হয়েছে। প্রাণ সংহারী, দ্রুত বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা সম্পন্ন ভাইরাসকে আমাদের আপাতঃচিন্তায় এক ভয়ংকর প্রাণঘাতী জীবাণু হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতির আরো আরো উপকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীর মত ভাইরাসও আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশের জন্য অপরিহার্য। এমনকি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই ভাইরাসের কারনেই পৃথিবীতে আমাদের মানব জন্ম।বিশেষ এক ধরনের ভাইরাসের কর্মকান্ডের ফলেই পৃথিবীতে আমাদের পদচারনা সম্ভব হয়েছে। সেই রোমাঞ্চকর গল্পে যাবার আগে ভাইরাসের জাত-বংশ পরিচয়টা জেনে নিলে একটু সুবিধে হবে।
‘ডিম আগে না মুরগী আগে’র মত গভীর দার্শনিক প্রশ্নের মত ব্যাকটেরিয়া আগে না ভাইরাস আগে, এই প্রশ্নও বিবর্তন বিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম করেছে।মানুষ ও বানর দুইয়েরই উৎপত্তি যেমন একই পূর্বপূরুষ থেকে, এতদিন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের উৎপত্তিও একক সুপ্রাচীন কোষীয় জীবন থেকে-এমনটিই ধারনা করা হচ্ছিল।কিন্তু সে ধারনা এখন পাল্টে যেতে বসেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একেবারে গোড়ার দিকে একটি জীব কোষ এবং একটি ভাইরাসের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। খুবই সরল সহজ গঠনের কারনে একসময় ধারনা করা হোত ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার আগে এসেছে। কিন্তু না, উদ্ভবের পর দুজনের দুটি পথ দুদিকে বেকে গিয়ে ব্যাকটেরিয়ার গঠন ক্রমেই জটিলতর আর ভাইরাসের গঠন ক্রমেই সহজতর হয়েছে।জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য উড়োজাহাজ থেকে যেমন করে জিনিসপত্র ফেলে দেয়া হয় ( যাকে বলে Jettison), ঠিক তেমন করে চতুর ভাইরাস পরাশ্রয়ী হয়ে অপরের দেহকোষে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা এবং বংশ বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়েজনীয় ক’টি RNA, DNA ছাড়া বাকী সব কোষীয় কলকাঠি বিবর্তনের ধারায় পরিত্যাগ করেছে। পৃথিবীতে সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে জীবনের শুরু হয়। আর এখন থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন বছর আগে পরিব্যপ্তির ( Mutation ) মাধ্যমে বিবর্তিত হতে হতে ভাইরাস এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছায় যখন থেকে তাকে ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় আলাদা করে চেনা সম্ভব হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভাইরাস কি জীব না জড় ? জড় থেকে জীবকে আলাদা করে চেনার জন্য যে যে শর্তগুলো পূরন করতে হয় তার কিছু কিছু যদিও ভাইরাসের আছে, সবগুলো নেই। ভাইরাসের কোন কোষপ্রাচীর বা কোষীয় গঠন শৈলী নেই, বিপাক ক্রিয়া নেই, নিজে নিজে বিভাজন বা প্রজনন করতে পারে না।দেখেশুনে বিজ্ঞানীগন (Virologists) ভাইরাসকে না-জীব-না-জড় বিবেচনা করে বিভিন্ন অভিধায় ব্যক্ত করেন যেমন, ‘Form of life, organic structures that interact with living organism, Organism at the edge of life,Self assembling organic molecules ইত্যাদি। আকারে কিছুটা বড় এক ধরনের ভাইরাস আছে যাদের বলা হয় ‘Mimivirus’. এরা জীব ও জড়র মধ্যবর্তী ‘Missing link’ এর মত। এ যেন ‘জীবন মরনের সীমানায়’ দাঁড়ানো প্রাণী জগতের এক সেতুবন্ধ! ভাইরাসের কথা গভীর ভাবে চিন্তা করলে মনে হয়, জীব ও জড়র মধ্যে কোন স্পষ্ট সীমারেখা নেই- জড় থেকে জীবে এ যেন এক প্রবহমান স্রোতধারা।যে নামেই ডাকা হোক, যে সংজ্ঞাই আরোপ করা হোক, বাস্তবতা এই যে, অহেরাত্র আমরা বিভিন্ন রকম ভাইরাসের মহাসমুদ্রে ডুবে আছি।
জীব জগতের অন্যান্য প্রজাতির মত সেই আদিকাল থেকেই ভাইরাসও পরিব্যপ্ত (Mutation) হয়েই চলেছে। লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন ঘটতে অন্যান্য প্রজাতির যেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর লেগে যায়, সেখানে ভাইরাসের পরিব্যপ্তি ঘটে কয়েক মাস এমনকি কয়েক সপ্তাহর মধ্যে। যে কারনে প্রতি বছরই যেমন নতুন করে ইনফ্লুয়েন্জা ভ্যাকসিন নিতে হয়। বলা হয়, ভাইরাস হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে সফল জীব-কণা। এমন কোন জীব প্রজাতি পৃথিবীতে নেই যার দেহে ভাইরাস বাসা বাঁধেনি। ভাইরাস আছে মাটিতে, সমুদ্রে, আকাশে ও মেঘের কোলে, প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত। ভাইরাস আছে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে ও বহিরাবরনে প্রতিরক্ষা প্রলেপনের মত।
২০১৩ সালে কেপলার স্পেস মিশনের তথ্য বলছে, আমাদের ছায়াপথের (Milky way) বাসযোগ্য (Habitable zone ) অঞ্চলগুলোতে পৃথিবী আকারের প্রায় ৪০ বিলিয়ন গ্রহ রয়েছে। ভাইরাসের জীবনচিত্র আর এই আবিস্কার মিলে গ্রহান্তরে প্রাণের সম্ভাবনা, তা যত আদি ও অসংগঠিতই হোক না কেন, কল্পনা থেকে বাস্তবতার আরো কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে।
জীব বিবর্তনের ধারাটিকে সহজে চিত্রের মাধ্যমে বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানীরা যে জীবন-বৃক্ষের (Tree of life) সাহায্য নেন তাতে জগতের সব প্রাণীকে দেখানো গেলেও গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত কোথাও ভাইরাসকে বসানো যায় না। কারন, জীব কোষকে জীবনের একক ধরে নিয়েই Tree of life এর কল্পনা করা হয়েছে। অথচ, ভাইরাসের কোন কোষই নেই, আছে শুধু পাতলা আমিষের (Protein) এক আবরন (Capsid). ভাইরাসকে তাই জীব হিসেবে স্বীকার করলেও বলা হচ্ছে অকোষীয় জীবন বা Non cellular life. অতএব, ইদানীং ভাইরাসের জন্য তাই CEO(Capsid encoding organisms) নামে স্বতন্ত্র ডোমেইনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। জীব প্রজাতির প্রাচুর্যের জগতে ভাইরাসের স্থানিক পরিচয় নির্দিষ্ট করা না গেলেও এটা নিঃশ্চিত যে ভাইরাসের অস্তিত্ব সুপ্রাচীন, পৃথিবীতে প্রান সৃষ্টির সময় থেকেই।
আসল কথায় আসি। আজ থেকে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর উত্তর গেলার্ধে লেজ বিহীন ইঁদুর জাতীয় স্তন্যপায়ী এক প্রাণী (Shrew) ভাইরাসে আক্রান্ত হোল। পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে ভাইরাসটি (Retrovirus) পরিপোষক প্রাণীর দেহ আশ্রয় করে পরিব্যপ্তীর (Mutation) মাধ্যমে Syncytin নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরী করে ফেললো যা গর্ভফুল (Placenta বা অমরা) কে জরায়ুর সাথে আটকে রাখতে পারে। শুরু হোল Placental mammal বা অমরাশ্রয়ী স্তন্যপায়ী জীব প্রজাতির পথ চলা, যার ধারাবাহিকতায় অন্যান্য সমসাময়িক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত আমরা মানুষেরাও পৃথিবীতে আসার পথ খুঁজে পেয়েছি। ভাইরাসটি ঐ সময়ে Shrew র শরীরে সংক্রমন না ঘটালে দুটি পরবর্তী সম্ভাবনার সুযোগ ছিল- পৃথিবীতে Great Apes এবং মানুষের (Homo sapiens) ধারাটির উৎপত্তিই না হওয়া অথবা হলেও, ডিম ফুটে এপস্ এবং মানুষ বের হওয়া- যেমন করে কিছু ডিম-পাড়া অথচ স্তন্যপায়ী প্রজাতি ( যেমন, Platypus, echidna) বংশবৃদ্ধি করে থাকে।
মানুষের উৎপত্তির পেছনে ভাইরাসের ভুমিকা ছাড়াও বিগত সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর ধরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিবর্তনের ধাপে ধাপে ভাইরাস অসংখ্য প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছে বলে ভাইরাসকে বলা হয় Driver of evolution. আমাদের, মানুষের Genome এর ৫-৮% ই হচ্ছে ভাইরাসের (Retrovirus) ডিএনএ, যা প্রাচীন কাল থেকে অন্যান্য জীব প্রজাতি থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণীর বংশ পরম্পরায় আমাদের রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে। ভাইরাস আমাদের জন্ম-সাথী!
আমাদের স্বার্থে, বহুবিধ লক্ষ্যে ও কাজে ভাইরাসকে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। এদের সরল সহজ গঠন কিন্তু শক্তিশালী কার্যপদ্ধতির কারনে একে আমরা জীব বিজ্ঞানের গবেষনায় ব্যবহার করছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে সংক্রমন প্রতিরোধে, ভ্যাকসিন তৈরীতে, ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায়, জিন থেরাপিতে এবং কৃষি সহ আরো বিভিন্ন কাজেও ভাইরাসের বহুল ব্যবহার হচ্ছে।
এ পর্যন্ত আবিস্কৃত পাঁচ হাজারেরও বেশী ভাইরাস প্রজাতির মধ্যে অতি অল্প সংখ্যকই মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ভাইরাস প্রজাতিগুলোর রয়েছে নিজস্ব পরিপোষক বা Host. কোন কারনে নতুন কোন host এর দেহে যদি তা ঢুকে পড়ে তবে তা হয়ে উঠতে পারে ক্ষতিকারক। ধারনা করা হচ্ছে, COVID-19 বাদুড় থেকে অন্তর্বর্তী হোষ্ট ‘Pangolin’ এর মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। জানা মতে COVID-19 হচ্ছে মানুষের দেহে সংক্রমন ঘটাতে সক্ষম ৭ম ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার PHEIC ( Public Health Emergncy of International Concern ) এ বছরের জানুয়ারীর ২০ তারিখে কোভিড-১৯ সংক্রমনকে প্যানডেমিক ঘোষনা করার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষ কোভিড-১৯ সংক্রমনের শিকার হয়েছে। সত্যি ভয়ংকর!
COVID-19 এর তান্ডবের কারনে ভাইরাসকে আমরা আমাদের প্রতিপক্ষ, শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে লড়তে শুরু করেছি। বেঁচে থাকতে হলে তা আমাদের করতেই হবে। কিন্তু, লক্ষ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর জীব বৈচিত্রের বিবর্তনের অনুঘটক ভাইরাসকে ভয় করলেও অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। দৃশ্যমান অন্যসব জীব-প্রজাতির মত অদৃশ্য এই ভাইরাসকেও তার মত করে তার নিজস্ব বলয়ে নির্ঝন্ঝাটে বেঁচে থাকতে দিতে হবে।
তাকে নিয়ে জীবানু অস্ত্র ও যুদ্ধের খেলা খেলে সময় ও শক্তি ক্ষয় না করে আমাদের উচিত পৃথিবীর সব জীব বৈচিত্রকে রক্ষা করার কাজে মনযোগ দেয়া। শেষমেষ, সবাইকে নিয়েই তো আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে! We, humans are not free-living creatures after all.
তথ্য সূত্র: Smithsonian museum.org, nature.org, earth.com
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..