ভাঙ্গা দেউলের ধূলায়

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
গল্প
ভাঙ্গা দেউলের ধূলায়

‘রাতের অনেকগুলি রূপ আছে, জান ভাইপো। প্রথম রাত্রি হল ধূসরবর্ণা। ক্রমে রাত্রির রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথম রাত্রিকাল পর্যন্ত তিনি দোষারূপিনী, মধ্যরাত্রে তমস্বিনী; আর শেষরাত হল অব্যক্তবর্ণা। এই যে ধূসরবর্ণা রাত, এই সময়েই শ্যাবী আসে। এই যে তুমি অহোরাত্র এই ঘরে পড়ে আছ শ্যাবীকে এক ঝলক দেখবে বলে, জেনো, শ্যাবী যেমন তার রূপের খাতিরে তোমায় রাতের পর রাত জাগিয়ে রাখে, তেমনি জাগরিত রাখে কাউকে ধনের জন্য, কাউকে অন্নের জন্য, কাউকে আবার অভীষ্টলাভের জন্য।’

কথাগুলো বলে লক্ষ্মী কাঁড়ার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ছাড়া কোন বলকার্য করা সম্ভব নয়—তাই, আকাশকে সকল বলকার্য সাধনের জন্য নিযুক্ত রেখে লক্ষ্মী কাঁড়ার ইন্দ্রর জমি দেখভাল করে। কাজ সাঙ্গ হলে সমগ্র কৃষিক্ষেত্র পরিভ্রমণ করে। আর তখন সে খড়ের ঘরে উবু হয়ে বসে থাকে যুবক ইন্দ্র কৃষ্ণসুন্দরী শ্যাবীর আশায়। কিন্তু তাকে নিয়ে অসুবিধে একটাই। সে আসে মধ্য রাত্রে।

আসলে যেই সে তাকে রাত্রের মধ্যে আবছা দেখা, এবং লক্ষ্মী কাঁড়ারের মুখে তার কাহিনি শুনে ইন্দ্রর হয়েছে কী, শ্যাবীর নিমিত্তে সে মরিয়া। আর সে যত মরিয়া হয়ে উঠেছে, নিদারুণ হয়ে উঠেছে, লক্ষ্মী কাঁড়ার তাকে তত শুনিয়েছে শ্যাবীর কথা। রাত্রির আগমণে জনপদসমূহ নিস্তব্ধ, পক্ষীসকল নিদ্রাতুর; পথচারীরা ক্লান্ত-অবসন্ন। রাত্রি তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘুম উড়ে যায় ইন্দ্রের। সেই নারী থাকে মাঠের শেষ প্রান্তে; সাত আটটি দূরে দূরে ঘর, ফাঁকা ফাঁকা উঠোন, মধ্যে বৃক্ষ নিয়ে সেই গ্রাম রচিত। গ্রামের মাথায় চাঁদ ওঠে। রাত নামে রাতচরা পক্ষীকূলের ডানায় ভর করে। তখন এই গ্রামের মেয়েরা রাত্রির বিভিন্ন যামে তারা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে, কেবলমাত্র নিম্নাঙ্গটুকু আবৃত্ত করে চলে আসে পাকা ফসলের ক্ষেতে; দু’একজন, দলবেঁধে; তারা অন্যের জমি থেকে এইভাবে পাকা ফসল আত্মসাৎ করে।

একবার তাকে প্রায় হস্তগত করে ফেলেছিল ইন্দ্র; তখনই দেখেছিল শ্যাবীর মন পাগলকরা রূপ। কালো শরীরের মোহিনী মায়া; যেন সেই কালোর আলোয় তার দু’চোখ ধাঁধিয়ে গেল। হিতাহিত ঞ্জানশূণ্য সে নারীটিকে দু’হাত মেলে জড়িয়ে ধরতে যাবে, তখন মেয়েটি বলে ওঠে, ‘দাঁড়াও!’

ইন্দ্র হাত গুটিয়ে নেয়। মেয়েটি আঙ্গুল তুলে বলে, ‘বল দেখি, পৃথিবী—।’

ইন্দ্র মন্ত্রমুগ্ধের মত মেয়েটির কথা বলার কায়দা দেখে। শ্যাবী বলে, ‘এবার তাহলে বল, অন্তরীক্ষ—।’

ইন্দ্র দেখে তার ঠোঁট নাড়া, অঙ্গুলির বিভঙ্গ।  নারী বলে, ‘নাও, এবার তবে উচ্চারণ কর দেখি, দ্যুলোক—।’

ইন্দ্র তার নাভি থেকে উচ্চারণ করে, ‘ওম্!’

অমনি শ্যাবী সরে যেতে থাকে তার সামনে থেকে। তারপর কত চেষ্টা করে, কিন্তু শ্যাবীর নাগাল ইন্দ্র পায়না কিছুতেই। সে স্বগোক্তির মতন বলে ওঠে, ‘হে শ্যাবী, কি নিষ্ঠুর তোমার চিত্ত! এত শীঘ্র চলে যেও না—।’

বলে ইন্দ্র চোখ খুলে দেখে সামনে প্রস্ফুটিত স্নিগ্ধ সূর্য। এই ভোরের আলো কী মনোমুগ্ধকর। কতকাল ধরে তিনি উদিত হচ্ছেন, কেই বা তা বলতে পারে! আলোকের স্পর্শে ধূলি-বনস্পতি-নদীর জল—সব যেন মধুময় হয়ে ওঠে। ইন্দ্র বোঝে, শ্যাবী নামক পাকা ফসলের চোরকে ধরে রাখার বদলে, তাকে শাস্তি প্রদানের বদলে, তার স্তব করে ফেলেছে। তাই কোন পরিকল্পনাই কাজ করে না শ্যাবীকে ধরার জন্য। প্রতি নিয়ত মেয়েটি তার পাড়ার অন্যদের সঙ্গে এসে বা কখন একাকী পাকা ফসলের খেতে হানা দেয়; রাত্রির নানা যামে, তাকে ধরা সত্যি মুসকিল। অনেক ভাবনার পর ইন্দ্র দেখেছে, তাকে ধরা তখনি সম্ভব যদি সে সূর্যরশ্মি একটু একটু করে জমিয়ে রাখতে পারে মাঠের কোনায় কোনায়। কিন্তু তা কিরূপে সম্ভব? তাই সে পুনরায় স্মরণাপন্ন হয় লক্ষ্মী কাঁড়ারের। লক্ষ্মী কাঁড়ার বলে, ‘অনেকক্ষেত্রে এটাও দেখা গেছে যে, সেই জমানো সূর্যালোক চুরি হয়ে গেছে।’

‘কারা করে!’

‘কারা আবার, ইঁদুরেরা।’

‘ইঁদুর!’

‘মাঠের ভেতর প্রচুর ইঁদুরের বাস, সে তুমি জানো ভাইপো। মাঠ, তার আশপাশের বন, জলা, জঙ্গল সব ইঁদুরে পরিপূর্ণ। আর আমরা যখন ক্ষেত্র চাষের নিমিত্তে জলপূণ করি, সেই সব ইঁদুরেরা বিপদে পড়ে। তারা চলে যায় মাঠের ওদিকে; চলে যাবার সময় তারা সেই রৌদ্রালোক চুরি করে নিয়ে যায়। সূর্যালোক তারা সঞ্চিত রাখে ওখানের গর্তে। কিন্তু এজন্য তুমি কখনোও ভেব না ওদের পাড়ায় পা রাখবে। তাহলে কিন্তু সমূহ বিপদ। একেই ওরা কেবলমাত্র নিন্মাঙ্গ আবৃত করে ফসলের জমিতে নামে চৌর্যবৃত্তির জন্য; তুমি যদি তাকে ধর তাহলে ফেঁসে যাবে শ্লীলতাহানির দায়ে; আর ওদের পাড়ায় গেলে তো আর কথায় নেই। কাউকে যদি তারা একবার বাগে পায়, তাকে কি না কি বিপদে ফেলবে তার আর ঠিক কি!’

ইন্দ্র, এই যে রাতের পর রাত একাকি সে মাঠ পরিভ্রমণ করে, তা শ্যাবীর নিমিত্তেই। তার চোখে নিদ্রা নেই। লক্ষ্মী কাঁড়ার যা দেখতে পায়, বুঝতে পারে, তার পক্ষে তা কেন সম্ভব হয় না? ভাবতে ভাবতে ইন্দ্রের মনে হয়, লক্ষ্মী কাঁড়ারের নিজস্ব একটা আকাশ আছে। তাই সে আকাশকে বলকার্য সাধণের দায়িত্ব দিতে পারে। অন্তরীক্ষ থেকে যে আকাশ নেমে আসে লক্ষ্মী কাঁড়ারের জন্য; তার আলোতেই কী সে দেখেছিল শ্যাবীকে? অভূতপূর্ব এক নারী, যার শরীরে যৌবনের পল্লব; তাকে, পুর্ণবার দেখার নেশায়, সেই যে মাঠে স্থিতু হল ইন্দ্র; তার আর ঘরে ফেরার নাম নেই। তাই, ওই বাউড়িপাড়া ভ্রমণের কথায় প্রাঞ্জ, পরাবিদ্যা-অপরবিদ্যা ঞ্জান থাকা লক্ষ্মী কাঁড়ার তার কথায় উদ্বিগ্ন হবে এ আর বেশি কথা কী! কিন্তু ইন্দ্র যাবেই। কেবল চুরি যাওয়া অগ্নি টুকরোর খোঁজে নয়, সে যাবে চুরি যাওয়া সমস্ত ফসলের হিসেব নিতে। সে যাবে শ্যাবীর কাছে। তখন লক্ষ্মী কাঁড়ার বলে, তাহলে তোমাকে দ্যৌ এর মুখোমুখি হতে হবে।

‘কে দ্যৌ?’

‘ওদের ঈশ্বর। ইঁদুরেরা যখন জলের কারণে ওদের পাড়ায় আশ্রয় নেয়, নজরানা হিসেবে দেয় ওই সূর্যালোক। আমি একবারই সেখানে গেছি; যুবক বয়স, কিছুই দেখিনি; কেবল এক পতঙ্গ ছাড়া। তার কোন উত্থান নেই, পতন নেই; কখনও কাছে, কখনও দূরে; সে একত্রে অনেক বস্ত্র পরিধান করচ্ছে, আবার খুলে ফেলছে; বৃক্ষেরা সব স্থান বদল করছে, মাছেরা লাফিয়ে উঠছে; ও বড় মায়ার জায়গা ভাইপো, যেও না। আর যদি একান্তই যাবে বলে মনস্থির কর, নিয়ে যেও এক পাত্র সোমরস।’

‘সোমরস!’

‘দুই টুকরো পাথরের মাঝে সোমলতা ঘষে তুমি সোমরস তীব্র করে প্রস্তুত কোরো। তাতে মেশাও ক্ষীর ও দুগ্ধ। সেখানে গিয়ে দেখবে চারিদিক ফাঁকায় এক বৃক্ষ আছে। সে এক পর্ণমোচী বৃক্ষ। সেখানে সোমকলস রেখে তুমি জোরে জোরে তিনবার উচ্চারণ করবে—এ সোমরস তোমারই জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, হে ঈশ্বর; সোম পান কর—।’ একান্ত মনে, অমায়িকভাবে, প্রীতিযুক্ত অন্তঃকরণে তুমি যদি এই স্তব করতে পার, দ্যৌ এসে তোমার হস্ত ধারণ করবেন। তুমি কখনও ওম্ বলেছ?’

‘বলেছি।’

‘তবে তো তোমার মন দ্যৌ-এর প্রতি উন্মুখ হয়ে গেছে। তুমি যখন ঐ উত্তরভূমিতে পৌঁছবে, কানে আসবে দ্রুতগামী অশ্বের খুরের শব্দ। জানবে তোমার সামনে দ্যৌ এসে দাঁড়ালেন। তাঁর পিছনে বিস্তির্ণ ভূমিতে দেখবে যবের চাষ। যব দিয়ে ওরা ক্ষুধা নিবৃত্তি করে।’

সব সতর্কবাণী ভুলে একদিন ইন্দ্র পা রাখল সেই উত্তরভূমিতে। বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে গিয়ে সে দেখে সেখানে কোন বৃক্ষ নেই কুটির নেই। একটি নদী আছে। তাতে সাতটি প্রবাহ। এক প্রৌঢ তার দিকে এগিয়ে এল। সে তার নাম বলল, শষু। সে করজোড়ে ইন্দ্রকে বলল, ‘হে মহান! আমার গাভী বৃদ্ধা হয়েছে। তাকে পুনরায় দুগ্ধবতী করে দিন।’

ইন্দ্র তাকে বলে, ‘এদিকে কোথায় সোমলতার চাষ হয়?’

লোকটা লাল দাঁত বের করে হেসে বলে, ‘বুঝেছি, আপনি এসেছেন পোস্তর কারণে। আমি আগে যবের চাষ করতাম। এখন ছেড়ে দিয়েছি। যবে আর আগের মত লাভ নেই। তাই পোস্তচাষ ধরেছি। আপনি কি সোম পান করতে চান প্রভু?’

‘আপনি জানেন, আমি কে?’

‘আপনি সৎ, অহিংসিত সোমপানকারী ও সকলের নেতা।’

‘আর দ্যৌ?’

‘কিছুদিন আগে তাঁর মন্দির ভাঙ্গা পড়েছে।’

‘ভাঙ্গা হল কেন?’

কিছু বলতে গিয়েও লোকটা চুপ করে গেল। বলল, ‘আমি কিছু জানি না।’

ইন্দ্র তাকিয়ে দেখল লোকটির পিছনে আরও তিনজন মানুষ চুপচাপ এসে দাঁড়িয়ে পরেছে। তারা যথাক্রমে যদু, কণ্ব ও তুর্বসু। ইন্দ্রর চারপাশে বেগবান চারটি কালো ঘোড়া পাক খায়। যেন তারা বারো সিসি বাইক। ইন্দ্র চুপ করে যায়।

তার বলে, ‘তুমি এখানে কেন এসেছ?’

শষু বলে, ‘উনি সোমলতার শিকড় চান। চাষ করবেন।’

‘তুমি ভাল করে জিগাসা কর খুড়ো। যদি মিথ্যে বলে, তার পরিণতি ভাল হবে না। আমরা কিন্তু তোমাকেও ছাড়ব না।’

ইন্দ্র বলল, ‘আমি কিছু বীজ এনেছি। ধান্যের বীজ। তোমরা এর চাষ শুরু কর। দেখবে ফসল অনেক হবে।’

তারা বললে, ‘না। ওতে পয়সা নেই। পয়সা আছে পোস্ত চাষে। তুমি ফিরে যাও।’

লোক তিনটি যেমন আচমকা এসেছিল, দুরন্ত কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে চলে গেল তেমনই। শষু হালকা চালে বলল, ‘আপনি ভয় পাবেন না। সারা পৃথিবীতে ওরা নেশার বস্তু যোগান দেয়। ওরা আপনাকে বহিরাগত ভেবেছে। তাই চমকাতে এসেছে। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। দ্যৌ এর ভাঙ্গা মন্দির আপনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।’

‘কিন্তু আমি সে কারণে আসিনি।’

‘তবে?’

‘আমি এসেছি শ্যাবীর জন্য।’

‘শ্যাবী! তার কথা কে বললে আপনাকে?’

‘লক্ষ্মী কাঁড়ার। শ্যাবী আমার জমি থেকে ধানশীষ তুলে নেয়। আমার পাকা ফসল লুট হয়ে যাচ্ছে।’

‘দেখুন হে মহান, কিছু মনে করবেন না। আমাদের এখানে যবের চাষ হয়। যবই আমাদের প্রধাণ খাদ্য। আমরা যখন এখানে বাস করতে আসি, তখন প্রথম যে কালো মানুষ আমাদের কাছে আসে, সে লক্ষ্মী কাঁড়ার। ওর কাছেই আমরা প্রথম ধান্যের কথা শুনি। শুনেছি সে ফসলের স্বাদ অপূর্ব! সহজ পাচ্য এবং সহজেই তার দ্বারা নানান খাদ্যবস্তু প্রস্তুত করা যায়। আমরা ধান্যের চাষ জানি না। পাকা ধান্যের লোভে আপনার জমিতে হানা দেয় বারবার। তার সঙ্গে আমাদের কন্যা ঊষার প্রণয় শুরু হয়। তাদেরই কন্যা শ্যাবী। লক্ষ্মী কাঁড়ার যখন এখান থেকে চলে যায়, সে ঊষাকে নিয়ে চলে যেতে  চেয়েছিল। আমরা রাজি হইনি। তাই ঊষা দিনে যায়। রাতের আগে ফিরে আসে। আমাদের যে অসুবিধা ছিল, রাত হলেই খুব অন্ধকার হয়ে যায়। তাই ঊষার কথা মত লক্ষ্মী কাঁড়ার মাঠের মাঝে টুকরো টুকরো সূর্যালোক জমাতে শুরু করে, সেগুলি বয়ে নিয়ে আসত ইঁদুরেরা।’

‘শ্যাবীকে কোথায় পাব?’

‘ঐ যে দূরে পর্ণমোচী বৃক্ষ দেখছেন, সেখানেই।’

ইন্দ্র আর সময় নষ্ট করে না। সে হাঁটতে থাকে। নদীর স্রোত দূরে সরে যাচ্ছে। বাতাসে নানা গন্ধ, নানা পতঙ্গের ওড়াউড়ি। ইঁদুরেরা মুখে করে তুলে আনছে ধান্যশীষ। শ্যাবী তাকে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে পাবে, যদি কোনদিন আসতে পার আমাদের পাড়ায়। এর বাইরে আর কোন পথ নেই। আসার সময় বীজ এনো।’

‘ধান্যবীজ?’

‘আমি তোমার বীজ গর্ভে ধারণ করতে চাই।’

কোথায় সেই পর্ণমোচী বৃক্ষ, কোথায় শ্যাবী! চারিদিক খাঁ খাঁ ঊষর প্রান্তর। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যায়। ইন্দ্রে মনে হয়, একটুও বারিধারা নেই। আকাশের ওই মেঘগুলিকে ফাটিয়ে যদি জল বের করে আনা যেত। ক্লান্ত অবসন্ন ইন্দ্রর নাভি থেকে একটিই শব্দ উঠে এল, ‘ওম্!’

তখনি সেই ঊষর প্রান্তর ফেটে মাটির দিকে মাথা তুলল এক পর্ণমোচী বৃক্ষ। তার পিছনে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে এক ভাঙ্গাচোরা মন্দির। সে ওম্ উচ্চারণ করে, কতশত ইঁদুর, পতঙ্গ নেমে আসে পৃথিবীতে। যেন মাটি ফুঁড়ে আসে তারা। আকাশ থেকে আসে। তারা বলে, ‘এই স্থানের নাম দ্যুলোক। তুমি এখানে কি চাও?’

ইন্দ্র বলে,’আমি শ্যাবীকে চাই।’

‘কেন?’

‘আমি রাতে ঘুমুতে পারি না। সে আমার ঘুম ফিরিয়ে দিক।’

‘তার খবর আমরা কেউ জানি না। সে খবর তোমাকে একমাত্র দিতে পারেন দেবতা দ্যৌ।’

‘তিনি তো মৃত!’

‘না। তিনি বেসবাস পাল্টেছেন। নাম পাল্টেছেন। রাজার ভয়ে দেবত্ব ছেড়ে সাধারণ মানুষ হয়ে সাধারণের মধ্যে বাস করছেন। তাঁর মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে। মন্দির ভঙ্গকারীদের উল্লাস চাপা দেবার জন্য রাজা প্রাণপণ করছেন। কিন্তু আমরা যারা মাটির ভেতর থাকি, মাটির ভেতর দিয়েই চলাচল করি, আমরাই মুখে মুখে সে খবর প্রচার করি। কিন্তু সে মুখও আটকে দেওয়া হয়।’

‘দ্যৌ-কে আমি কিভাবে পাব?’

‘তাঁর সঙ্গেই তো এতক্ষণ তুমি আলাপ করে এলে।’

‘দ্যৌ? কই তিনি!’

‘যে প্রৌঢর সঙ্গে তুমি এতক্ষণ ছিলে, তিনিই দ্যৌ।’

‘ও!’

‘তুমি কি তাঁকে এককলস পীতবর্ণ সোম দাওনি?’

‘আমার সঙ্গে তা ছিল না। উনি বলেছেন, এখন জমিতে পোস্তচাষ হয়। বলেছেন, সোম গচ্ছিত আছে শ্যাবীর নাভিমন্ডলে।’

‘তবে নাও ইন্দ্র, এই সোম তুমি পান কর; সোম তোমার সখা— । এই সোমরাশি ঋজুগামিনী সপ্তনদীর ধারা থেকে সংগৃহীত।’

তারা একত্রে ‘উহগান’ করতে করতে এককলস সোম নামিয়ে রাখে ইন্দ্রের সম্মুখে। উহগানের মাধ্যমে বলেঃ হে ইন্দ্র, আমাদের জন্য ধন ও বল আহরণ কর। আনো শত্রুজিত বীরদের। অন্নবলের অধিকারী তোমাকে স্তব করি। আমরা তোমার স্তব করি, আমরা যেন তোমার নিজস্ব প্রভূত ধনের একাংশ পাই।

পথশ্রমে ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত ইন্দ্র নিমেষেই সোম গলাধঃকরণ করে। ওহ, কী অপূর্ব স্বাদ! অতি সুস্বাদু, অতি সুগন্ধময়। তার দু’চোখে নেমে আসতে থাকে ঘুম। আহা, কতদিন ঘুমায়নি সে; কতঘুম জমে আছে দু’চোখে। পর্ণমোচী বৃক্ষের নিচে, মন্দিরের ধূলায় ইন্দ্র শয়ণ করে। বাতাসে ভেসে আসে শ্যাবীর কন্ঠস্বর। ফিসফিস করে বলে, ‘বীজ এনেছ?’

‘এনেছি।’

‘তুমি ঘুম থেকে উঠলেই আমরা মিলন সম্পন্ন করব।’

ইন্দ্র ঘুমাতুর চোখে বলল, তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায়?

‘দ্যৌ-এর ভাঙ্গা মন্দিরে।’

‘কেন ভাঙ্গা হল মন্দির?’

‘কারণ দেবতার চেয়ে রাজা বড়। আকাশসম রাজার ক্ষমতা—আমরাই দিয়েছি। তুলনায় দেবতা ক্ষমতাহীন, রাজার উপর নির্ভরশীল।’

‘দেবতা তবে মৃত। দেবতার কি জন্ম হয় না?’

‘হয় ইন্দ্র, হয়। আমরাই পারি। আমাদের মিলনে যে মুহূর্তগুলির উদ্ভব হবে, তা জুড়ে জুড়ে আসবে নতুন সময়। তখন ধান্যর চাষ করব আমরা। তার স্বাদ নিতে আবার জন্মাবেন ঈশ্বর। আমরা তাঁকে ক্ষমতা দেব।’

‘তিনিও কী একক হয়ে উঠবেন?’

‘তিনি কখনও একক হবেন না, এই বিশ্বাস আমাদের রাখতেই হবে, ইন্দ্র।’

শ্যাবীর আশ্বাসবাণী শুনে ইন্দ্র মাথায় একটি খড়ের আঁটি টেনে কুঁড়ের মধ্যে পরম আবেশে পাশ ফিরে শোয়।

————————

ঋণ: বেদ (১-৫) – হরফ প্রকাশিত।

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। গল্পকার। লেখকের দেশ-ভারতবর্ষ। জন্ম ১৯৭৬ সালে, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার ছোটচৌঘরা গ্রামে। পড়াশুনো- বাংলা সাহিত্যে এম এ। জীবিকা- চাকুরি। প্রকাশিত বই- একটি। 'মশাট ইস্টিশনের মার্টিন রেল' (১৫টি গল্পের একটি সংকলন)।  প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা দুইশত। পশ্চিমবঙ্গের নানা পত্র পত্রিকায়...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..