করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ
বিষয়সুচি:
(ক) ঋগ্বেদ পাঠ : আমার অভিজ্ঞতা
(খ) জ্ঞানতত্ত্ব ও রাজনীতি
(ক) পুনরায় ঋগ্বেদ
(খ) সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের স্থান
(গ) প্রাচীন ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক
(ঘ) সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতা এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের রূপ
(ঙ) সভ্যতার অনুরূপতা এবং ঐক্যের মূল শক্তি
(চ) বস্তু-নির্ভর ইতিহাস পাঠের সমস্যা
========================
(ক) ঋগ্বেদ পাঠ : আমার অভিজ্ঞতা
ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠের সমস্যা বলতে গিয়ে আমার নিজ অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাসের আদিপর্বকে বুঝতে চেয়ে আমি আজ থেকে ঊনত্রিশ-ত্রিশ বৎসর পূর্বে প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি। কারণ সাধারণভাবে এটাই সর্বজনগ্রাহ্য যে, এটি উপমহাদেশের প্রাচীনতম গ্রন্থ, যা ধর্মীয় গ্রন্থ হবার কারণে লিপিবদ্ধ হবার পর থেকে আজ অবধি বোধগম্য এবং অবিকৃত ও অপরিবর্তিত রূপে বিদ্যমান রয়েছে। তারও পূর্বেকার সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় আমাদের নিকট ঋগ্বেদই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম একমাত্র লিখিত দলিল হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
সম্পূর্ণ গ্রন্থটি প্রণালীবদ্ধভাবে পড়বার পূর্বে আমার জানা ছিল যে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহিরাগত হানাদার, যাযাবর, পশুপালক ও বর্বর বা অসভ্য ‘আর্য’ (সংস্কৃত উচ্চারণ আরিয়) নামে কথিত জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশের পর এখানকার স্থানীয় ‘অনার্য’ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জয়লাভের জন্য দেবতাদের নিকট প্রার্থনা হিসাবে যে সকল মন্ত্র রচনা করে মূলত সেগুলির সংকলিত রূপ হচ্ছে ঋগ্বেদ। আমি আরও জানতাম যে, এই বহিরাগত আর্যরা ছিল দীর্ঘদেহী এবং শ্বেতকায় কিংবা ফর্সা রঙের। আমার এটাও জানা ছিল যে, এই বহিরাগত যুদ্ধজয়ী আর্যরা এই উপমহাদেশে তাদের যে বৈদিক ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে আসে তারই ধারাবাহিকতা বা উত্তরাধিকার হচ্ছে উপমহাদেশের বিদ্যমান অধিকাংশ প্রধান ভাষা, সংস্কৃতি এবং বিশেষত হিন্দু ধর্ম। বস্তুত আর্যরা যে বহিরাগত ও বহিরাক্রমণকারী এবং ঋগ্বেদ যে এই বহিরাগত ও বহিরাক্রমণকারীদের দ্বারা রচিত ধর্মগ্রন্থ এটা আমার নিকট ছিল একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য। এর বাইরে আর কোনও ব্যাখ্যা বা বক্তব্য সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। কারণ পণ্ডিতদের দ্বারা প্রচারিত এই একটি মতই আমি এতকাল পড়ে এবং শুনে এসেছিলাম। স্বাভাবিকভাবে সূর্য যেমন পূর্ব দিকে উদিত হয় এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তেমনইভাবে ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বা অভ্রান্ত জেনে আমি ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি। এবং পড়তে গিয়ে আমি স্তম্ভিত হই। সত্যি কথা বলতে কি আমি পণ্ডিতদের ভ্রান্তি অনুভব করে হতভম্ব হই। গ্রন্থের শুরু থেকেই মন্ত্র রচয়িতাদের আমার সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী ছাড়া আর কিছুই মনে হল না। ক্রমে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হল যে, এটা আর দশটা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনে লিখিত একটা ধর্মগ্রন্থ মাত্র, যার সঙ্গে বৈদেশিক পশুচারী এবং যাযাবর আক্রমণকারীদের কোনও সম্পর্কই নাই। তখন আমার মনে প্রশ্ন এল, এতকাল ধরে এত পণ্ডিত যারা ঋগ্বেদ পড়ে এর অর্থ এবং ব্যাখ্যা করেছেন তারা সবাই ভুল, আর আমি একা সঠিক, এটা কী করে সম্ভব হতে পারে?
ঋগ্বেদ দশ মণ্ডলে বিভক্ত। কিন্তু প্রথম মণ্ডল পড়বার পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম যে, সবাই ভুল আর আমি একাই ঠিক। এরপর সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব, পারসী ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাসহ আরও কিছু গ্রন্থ অধ্যয়নের পর ১৯৯০ সালে লিখি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ নামে একটি গ্রন্থ। এরপর গ্রন্থটি নিয়ে দুই বঙ্গেই কিছু ঘোরাঘুরি করে বুঝলাম যে, আমার কাছে যেটা নেহায়েৎ কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তত সহজ নয়।
এরপর শামসুল আলম চঞ্চল আমার সঙ্গে যুক্ত হন। তার ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের উপর প্রচুর অধ্যয়ন। আমার সঙ্গে আলোচনা এবং ঋগ্বেদ পাঠের পর তিনিও আমার সঙ্গে একমত হন। এরপর আমরা দুইজনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগাযোগসহ বেশ কিছু কাজ করি। শামসুল আলম চঞ্চল আমাদের উভয়র ধারণা The Indus Civilization and the Aryans নামে একটি ইংরাজী প্রবন্ধে লিখে ১৯৯৩ সালে পৃথিবীর কয়েকজন পণ্ডিতের নিকট পাঠান। প্রবন্ধের একটা কপি পাঠের পর সিন্ধু সভ্যতার উপর বর্তমান পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল ১৯৯৪ সালে তার এক সংক্ষিপ্ত চিঠিতে আমাদের ধারণার প্রতি তার জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করে সেটা যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশের তাগিদ দেন।*
——————-
*চিঠিটির অনুলিপি লেখার শেষে সংযুক্ত করা হয়েছে।
——————-
এটা ছিল আমাদের জন্য বিপুল অনুপ্রেরণা সঞ্চারী ঘটনা। সত্যি কথা বলতে কি এ ধরনের সমর্থন এবং প্রেরণা আমরা আর কোনও পণ্ডিতের নিকট থেকেই পাই নাই। যাইহোক, মোগলের সমর্থন এবং প্রবন্ধটি প্রকাশের তাগিদের পর প্রবন্ধটিকে আরও কিছু সমৃদ্ধ করে আমরা উভয়ে ১৯৯৫ সালে ইংরাজীতে The Aryans and the Indus Civilization নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি। এছাড়া ২০০৩ সালে বাংলায় ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি। আমার ১৯৯০ সালে লিখা কিন্তু অপ্রকাশিত রয়ে যাওয়া ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’-এর বেশ কিছু অংশ আমি এই প্রকাশিত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করি।
আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নাই যে, মোগলের সমর্থন এবং প্রেরণা না পেলে আমরা আমাদের উদ্যমকে কতটা রক্ষা করতে পারতাম সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। এই চিঠির প্রেরণা আমাদেরকে দুইটি গ্রন্থ লিখায় বিপুল উৎসাহ যুগিয়েছে। মোগলের এই সমর্থন লাভের পর ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত The Aryans and the Indus Civilization ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বহু সংখ্যক পণ্ডিতের নিকট পাঠাই এবং এর ভিত্তিতে মত বিনিময়ের চেষ্টা করি।
যত সহজে এবং যত সংক্ষেপে আমি এখানে আমাদের এই কর্মপ্রয়াসের বয়ান দিলাম ব্যপারটা মোটেই তত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত কোনটাই নয়। চঞ্চল এবং আমার এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানতে হয়েছে। বিশেষ করে আমার নিজের কথা বলতে পারি। ঋগ্বেদ পাঠের পর আমার শুধু বারবার একটা কথা মনে হত যারা ঋগ্বেদ পাঠ করে এর ব্যাখ্যা করেছেন তারা কী করে এত বড় ভুল করতে পারেন? সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে তার কোনও মানে নাই। সেটা সম্ভবও নয়। সুতরাং ঋগ্বেদ না পড়ে বেদ-পণ্ডিতদের লেখা পড়ে যেমন এক সময় আমি মনে করতাম ঋগ্বেদ বহিরাগত পশুচারী ও বর্বর মানুষদের রচনা তেমন অন্য যারা নিজেরা ঋগ্বেদ না পড়ে বেদ-পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আর্যদের বহিরাগত আক্রমণকারী মনে করেছেন তাদেরকে আমি দায়ী করব না। কিন্তু যে বেদ-পণ্ডিতরা ঋগ্বেদ পড়ে তার এমন অর্থ করেছেন তাদের বুদ্ধিমত্তা বা প্রজ্ঞার প্রতি আর যা-ই হোক শ্রদ্ধা থাকবার কারণ নাই।
যারা ঋগ্বেদ পড়েছেন তারা জানবেন ঋগ্বেদ কীভাবে একটা সভ্য সমাজের চিত্র অঙ্কন করে। যেহেতু বিভিন্ন লেখায় শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে যৌথভাবে এবং এককভাবেও এ বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি সেহেতু এখানে আর এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। তবু এটুকু বলি যে, ঋগ্বেদের ঋষিদের বর্ণিত তাদের নিজেদের প্রাচীর ঘেরা নগর বা পুর, জলসেচ-নির্ভর ও লাঙ্গল দ্বারা কৃষি, বিশাল বিশাল ভবন, পাকা বাসগৃহ, বস্ত্রবয়ন, সমুদ্র-বাণিজ্য ও সামুদ্রিক জাহাজ, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ধারণা ইত্যাদির বিবরণ মোটেই পশুপালন নির্ভর যাযাবর সমাজের চিত্র দেয় না। বহিরাক্রমণকারীদের চিত্র দেওয়া তো দূরের কথা। কিছু গরু বা গবাদি পশুর বিবরণ মানে কি কৃষি ছিল না? যেন পশু কিংবা গরুর কথা থাকলেই ধরে নিতে হবে সেখানে কৃষি ছিল না! কৃষিজীবীরা যেন গবাদি পশু পালন করে না! গরুর আর সব ব্যবহার যেমন গাড়ী টানা ইত্যাদির কথা বাদ দেওয়া যাক, লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের জন্যও তো সে যুগে গরুর ব্যবহার হতে পারত। যেহেতু ঋগ্বেদে প্রচুর গরুর উল্লেখ আছে সেহেতু ঋগ্বেদ রচয়িতারা পশুচারী যাযাবর ছিল এমন সিদ্ধান্ত টানাটা হাস্যকর হয় নাকি? অথচ সভ্য এবং স্থিতিশীল নাগরিক ও কৃষি জীবনের যে সব বিবরণ সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সেগুলি এই সব পণ্ডিতের চোখ এড়িয়ে গেল! যেমন এড়িয়ে গেল ঋষিদের বহুবার সপ্তসিন্ধু অঞ্চলকে নিজেদের বাসভূমি হিসাবে উল্লেখের বিষয়টি।
যাইহোক, আমার হতভম্ব হবার আরও বাকী ছিল। সেটুকু পূর্ণ হল উপমহাদেশীয় এবং বিশেষত ইউরোপীয় পণ্ডিতদেরকে ঋগ্বেদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা জানাতে গিয়ে। আমার একটা ধারণা ছিল যে, পণ্ডিতরা সাধারণত জ্ঞানের সন্ধানী হওয়ায় সত্যান্বেষী হন। সুতরাং তাদেরকে যদি ঋগ্বেদের সহজ সত্যটা ধরিয়ে দিই তবে তারা সেটাকে অন্তত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
ইউরোপ থেকে সাধারণভাবে কোন উত্তর পাই নাই। ২/৪ জন আমাদের ইংরাজী গ্রন্থ পাবার পর প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত গেলেও বাকীরা কোনও উত্তর দিবারও প্রয়োজন মনে করেন নাই। একজন খুব নামী আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ আমাদের গ্রন্থ থেকে যে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন এ কথা জানিয়ে তার সৌজন্যমূলক উত্তরটি দেওয়ার কষ্টটুকু করেন। তবে আমরা দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের নিকট বক্তব্য প্রদানে লেগে থেকেছি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন চঞ্চল। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে আমরা দুইজন যৌথভাবে Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval নামে একটা লেখা লিখি। এর ভিত্তিতে আমরা পুনরায় নূতন করে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের সঙ্গে মত বিনিময়ের চেষ্টা করি। তারও আগে ২০১২ সালে চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে Rediscovering Indus Civilization and Aryans: Journey to Our Renaissance নামে ইংরাজীতে একটি প্রবন্ধ লিখে ভারতসহ কয়েকটি দেশের পণ্ডিতদের নিকট প্রেরণ করি। এটির বাংলা ‘নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যজন: আমাদের নবজাগৃতির উদ্বোধন’ ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের ১৯ জুলাইতে প্রকাশিত হয়। এ সকল চেষ্টা থেকে নূতন করে আরও কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।
এখন সিন্ধু সভ্যতার অনেক আবিষ্কার হয়েছে। ইতিমধ্যে এই সব আবিষ্কারের ফলে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে নাকচও হয়ে গেছে। কিন্তু এতদিনে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকান পণ্ডিতদের মনে হল শুধু সাহিত্যের বিচারে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা চলে না। অর্থাৎ ঋগ্বেদ যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি সে কথা মানতে এখনও তাদের আপত্তি। এখন তাদের কেউ কেউ বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিকরা ঋগ্বেদকে গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত নন। তাদের মতে এটা একটা ধর্মীয় সাহিত্য যার ঐতিহাসিক মূল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। অর্থাৎ তাদের মতে সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার হবার পূর্ব পর্যন্ত আমরা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
এই পণ্ডিতরা কিন্তু এই বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্ব দিতে চান না যে, সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারেরও অনেক কাল পূর্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় এবং বিশেষত ব্রিটিশ পণ্ডিতরা ঋগ্বেদ যে ভারতবর্ষে বহিরাগত যাযাবর আর্যদের দ্বারা লিখিত ধর্মগ্রন্থ সেই মর্মে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তখন কিন্তু কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণেরই প্রয়োজন হয় নাই। আমি আমার ইতিপূর্বেকার বিভিন্ন লেখায় এর পিছনে ক্রিয়াশীল সাম্রা্জ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছি। সুতরাং এ বিষয়ে নূতন করে আলোচনা করে এখানে আমি অযথা সময় নষ্ট করতে চাই না। এ বিষয়ে আমার কিছু বিস্তারিত আলোচনার জন্য আগ্রহী পাঠক ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’ পাঠ করতে পারেন। অল্প কিছুদিন আগে আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতা ও আর্য সম্পর্কে পুনর্মূল্যায়ন: সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজন কেন?’ নামক একটি ছোট প্রবন্ধেও আমি সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্যের বিষয় উল্লেখ করেছি।
অভিজ্ঞতা থেকে আমাদেরকে এই নির্দয় সত্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে যে, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী জ্ঞান, বিশেষত যে জ্ঞান মানুষের সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে, তা রাজনীতির বাইরে যেতে পারে না। বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কথা খুব খাটে। মনে রাখতে হবে যত বড় বড় পণ্ডিত অথবা জ্ঞানী হোক তারাও আর দশটা মানুষের মত রক্তমাংসের শরীর বিশিষ্ট মানুষ। প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে থেকে যারা জ্ঞান চর্চা করে তাদের তো খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হয়, চাকুরীতে পদোন্নতি, খ্যাতি এবং নানান ধরনের পুরস্কারের লোভ তো তাদেরও থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের অথবা রাষ্ট্রকে যারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সমর্থন অথবা পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য। সুতরাং জ্ঞানী বা বুদ্ধিচর্চা যারা করেন তাদের জ্ঞান বা বুদ্ধিচর্চাও সাধারণভাবে রাজনীতির অধীনস্থ। ব্রিটিশরা দুইশত বৎসর ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল। এই শাসনকে রক্ষা এবং দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য যা যা করা দরকার তারা মনে করেছিল তা তা-ই তারা যে করার চেষ্টা করেছিল সেটাই কি একান্ত স্বাভাবিক নয়? সুতরাং ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটা মিথ্যা বয়ান তাদের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল। যাদেরকে আমরা সত্যান্বেষী জ্ঞানসাধক মনে করি সেইসব জ্ঞানী পণ্ডিত হয়েছিল তাদের এই মিথ্যা বয়ান তৈরীর জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। আর সুপ্রতিষ্ঠিতদের দ্বারা একবার বয়ান তৈরী হলে সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কে? ইউরোপীয়রা? তাদের কী ঠ্যাকা পড়েছে? বরং তারাই তো এই বয়ান তৈরী করেছে। যাদের দাঁড়াবার কথা ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত সেই ভারতীয় পণ্ডিতরা তাদের ব্রিটিশ প্রভু-পণ্ডিতদের দ্বারা প্রবর্তিত ঋগ্বেদ ব্যাখ্যা এবং ইতিহাস পাঠের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? আর একবার একটা বিষয় বা ধারণাকে উপর থেকে চাপিয়ে দিতে পারলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দুঃসাধ্য হয়। আরও বিশেষত যদি ধারণাটা উপনিবেশিক কালে উপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপরেও স্বামী বিবেকানন্দের মত খুবই মুষ্টিমেয় ২/৪ জন পণ্ডিত ব্যক্তি ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথা বলবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের কথা কে শুনবে, কে লিখবে? ফলে জানবেই বা কে? এমনকি ১৯৯০ সালের আগে আমি নিজেও জানতাম না যে, এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে আর কোনও মত আছে। এটা জেনেছিলাম ঋগ্বেদ পাঠের পর আমার নূতন জিজ্ঞাসা নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে। তখন কে, এম, মুন্সী নামে একজন পণ্ডিতের কথাও জানতে পারি যিনি আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার কারণে তীব্রভাবে সমালোচিত হন। আমি যতদূর মনে করতে পারি পরবর্তী কালে তিনি তার মত প্রত্যাহার করে উপনিবেশিক ইতিহাস পাঠকে গ্রহণ করে নেন।
যাইহোক, আমার মতো সাধারণ ইতিহাস পাঠকদের এই সব পণ্ডিতের ভিন্ন মত জানবার কোনও কারণ ছিল না। কারণ এসব কথা ইতিহাস গ্রন্থে আলোচিত হত না। প্রকৃতপক্ষে সামান্য কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মীয় পণ্ডিত আর্যদেরকে উপমহাদেশের স্থানীয় অধিবাসী মনে করতেন। তাদের যুক্তির উৎস ছিল ঋগ্বেদসহ বিভিন্ন বেদ এবং প্রাচীন ভারতীয় অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যেমন তাদের উপনিবেশবাদী দৃষ্টি থেকে ঋগ্বেদকে ব্যাখ্যা কিংবা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের বয়ান নির্মাণ করেছিলেন তেমন এরা তাদের হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টি থেকে আর্য প্রশ্ন এবং ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ধর্মবিশ্বাস দিয়ে তো কোনও কিছুর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা চলে না। ফলে তারা ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ইতিহাস পাঠকে নাকচ করে ইতিহাসের পাল্টা পাঠ দানে অক্ষম ছিলেন।
অনেক কাল ধরে সিন্ধু সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ ঋগ্বেদের ব্যাখ্যাসহ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের ইউরোপীয় তথা উপনিবেশিক বয়ানকে হতভম্বকর অবস্থায় নিক্ষেপ করার পর সম্প্রতি বেশ কিছুদিন থেকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী পণ্ডিতরা নূতনভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদী বয়ান দিতে শুরু করেছেন। এখন তারা জোরালো ভাষায় ঋগ্বেদ যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি এবং আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতারই অধিবাসী সে কথা বলছেন। কিন্তু ঋগ্বেদের একটা বস্তুনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা তারা দিতে পারছেন না বলে তাদের ব্যাখ্যায় প্রভূত গোঁজামিল বা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের বয়ান উপনিবেশিক বয়ানকে যথাযথভাবে খণ্ডন করতে পারছে না। এটা ঠিক যে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণতত্ত্বের দাঁড়াবার কোনও জায়গাই আর রাখে নাই। কিন্তু সেটুকুই তো সুদীর্ঘ কাল ধরে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্বকে খণ্ডন করার জন্য যথেষ্ট নয় যদি সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদের সম্পর্ককে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না যায়। যে কোনও পূর্বনির্ধারিত ধারণা যদি দৃষ্টি এবং বিচার-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে থাকে তাহলে কোনও কিছুরই বাস্তবসম্মত কিংবা বিজ্ঞানস্মত ব্যাখ্যা কীভাবে সম্ভব? ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠের মত হিন্দুত্ববাদী পাঠের সমস্যাটাও এই জায়গায়। এখন আমি হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস পাঠের সমস্যাটা ঠিক কোথায় সেটাকে খুব সংক্ষেপে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করব।
তবে এই পর্বের আলোচনা শেষ করার পূর্বে আমি এ কথা বলতে চাই যে, ঋগ্বেদের প্রসঙ্গ দিয়ে এই আলোচনা শুরু করলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, উপনিবেশিক বয়ান শুধু ঋগ্বেদ কিংবা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্বাভাবিকভাবে উপনিবেশিক আধিপত্যের কালে পাশ্চাত্য বিশেষত ব্রিটিশ প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতরা যখন ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজের বিভিন্ন বয়ান নির্মাণ করেছে তখন তাদের চেতনায় কম আর বেশী ক্রিয়াশীল থেকেছে উপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষার প্রেরণা অথবা উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী। অনেক সময় ভলোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই কোনও বিষয় নিয়ে ঢালাও মন্তব্যের ব্যাপার তো আছেই। যেহেতু তারা তখন প্রভু সেহেতু তারা যেটা বলে বা লিখে সেটাই তৎক্ষণাৎ ভারতীয় প্রজাদের নিকট মহামূল্যবান বয়ানে পরিণত হয়। তখন সেই বয়ানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে কিংবা পাল্টা বয়ান দেয় এমন সাধ্য কার? ব্রিটিশ রাজনৈতিক আধিপত্য শেষ হয়েছে তো কী হয়েছে? দাসত্বের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং বিশেষত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক বা গবেষকদের ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজ বিষয়ক যে কোনও বয়ানকে খুবই সতর্কতার সাথে এবং সন্দেহযুক্ত মন নিয়ে পাঠ করা উচিত। এ সম্পর্কে আমি নির্দিষ্টভাবে আরও বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ পূর্বক আলোচনা করতে পারতাম। যেমন বাংলার ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্রিটিশ লেখকদের ঢালাও মন্তব্য কীভাবে আমাদের ইতিহাসের ভ্রান্ত পাঠ নির্মাণ করেছে সে বিষয়ে আলোচনা করা যায়। তবে আলোচনাকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে সেসব প্রসঙ্গে এখানে যাব না। সম্ভব হলে বারান্তরে এসব বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠের মত হিন্দুত্ববাদী পাঠেরও মূল ভিত্তি হচ্ছে ঋগ্বেদ। সিন্ধু সভ্যতার উপর ব্যাপক খননকাজের পর এখন প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে বহিরাগত আর্য আক্রমণতত্ত্ব নাকচ হয়ে যাবার পর আর্য বা যে নাম দেওয়া যাক ঋগ্বেদ রচয়িতাদের মূলভূমি বা আবাসভূমি হিসাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে সিন্ধু সভ্যতা উপস্থিত হয়। এখন প্রশ্ন যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি যদি ঋগ্বেদ হয়ে থাকে তাহলে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তার মিল কতটুকু বা সম্পর্ক কী ধরনের?
হিন্দুত্ববাদীরা এই প্রশ্নের উত্তরে যে কথা বলতে চান সেটা হচ্ছে উন্নত নগর সভ্যতা হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার শুরুর সময় কিংবা পূর্ব থেকেই বৈদিক ঋষিরা যে সকল মন্ত্র রচনা করেন সেগুলির সমাহারে যেমন ঋগ্বেদ ধর্মগ্রন্থ হিসাবে প্রবর্তিত হয় তেমন এই সকল মন্ত্রের প্রেরণায় সিন্ধু সভ্যতা নির্মিত হয় কিংবা ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ধরনের ব্যাখ্যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে বৈদিক ঋষিরা ছিলেন সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের মূল নায়ক কিংবা এই সভ্যতার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী।
আলোচনা সহজ ও সংক্ষিপ্ত করার জন্য এখন আমি ভারতের বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত ভগবান সিংয়ের লিখা The Vedic Harappans-এর প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করতে পারি (Bhagwan Singh, The Vedic Harappans, Aditya Prakashan, New Delhi, First Published: 1995)। স্বাভাবিক গ্রন্থের দ্বিগুণ আয়তনবিশিষ্ট ৪৯৩ পৃষ্ঠার এই বিরাট গ্রন্থটি ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে একটি অসাধারণ গ্রন্থ। লেখক ভাষাতাত্ত্বিক এবং অন্যান্য বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে ঋগ্বেদ যে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযুক্ত সেটা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন।
এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু লেখক যখন সিন্ধু সভ্যতার নির্দিষ্ট কালপর্বের সঙ্গে ঋগ্বেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে তাকে ঢালাওভাবে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযুক্ত করেন তখন কতকগুলি বিষয়ের ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। যেমন ঋগ্বেদের যুদ্ধগুলির বর্ণনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? কিংবা ঋগ্বেদের কেন্দ্রীয় বিষয় যেখানে যুদ্ধ সেখানে সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ বিকাশ ও বিস্তার প্রক্রিয়াকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে ঋগ্বেদের এই ব্যাখ্যা দিয়ে? এমন আরও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় ঋগ্বেদের এ ধরনের ব্যাখ্যা থেকে।
আসলে হিন্দুত্ববাদী পাঠ দিয়ে ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যকার সম্পর্কের সঠিক রূপ অনুসন্ধানের পরিবর্তে ঋগ্বেদকে ঢালাও বা অনির্দিষ্টভাবে সিন্ধু সভ্যতার উপর আরোপ করে বৈদিক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়। অন্তরালে থাকে বৈদিক ধর্মের ধারাবাহিকতা হিসাবে বর্তমান হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। এই কারণে যখন সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে সভ্যতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া হিসাবে বৈদিক ধর্মীয় আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করা হয় তখন হিন্দুত্ববাদীরা আর সেটাকে গ্রহণ করতে পারেন না।
ভগবান সিং-এর সঙ্গেও আমাদের মতপার্থক্য ঘটে এই জায়গায়। তার The Vedic Harappans প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। আমাদের ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization-ও প্রকাশিত হয় একই বৎসর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে। উভয় গ্রন্থে আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী এ কথা বলা হলেও ঋগ্বেদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় আমাদের মতপার্থক্য খুব বড় হয়ে দেখা দেয়। আমরা অর্থাৎ চঞ্চল এবং আমি সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময়ে সিন্ধু সভ্যতায় প্রচলিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হিসাবে বৈদিক আন্দোলনকে বিচার করেছি। যেহেতু এ বিষয়ে আমার একক বা আমাদের উভয়ের অন্যান্য লেখায় আলোচনা করেছি সুতরাং আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজনে এখানে এটুকু বলি যে, সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল আধুনিক কালের মতো জলকপাট ও বাঁধযুক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর। ঋগ্বেদের বিবরণ এবং সিন্ধু সভ্যতার বিশাল অঞ্চলব্যাপী সমৃদ্ধি, জনকল্যাণমূলক আয়োজন এবং শান্তিনির্ভরতার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং সেই সঙ্গে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে আমরা খাদ্যোৎপাদনের প্রয়োজনে সেখানে সকল নদীর উপর এমন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপকে দেখতে পেয়েছি। তবে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির উপর এ ধরনের হস্তক্ষেপের পরিণতিতে নদীখাতে পলি সঞ্চয়, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদির ফলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সরস্বতী ছিল সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নদী। নদীর জলধারা জলকপাটযুক্ত বাঁধ দ্বারা রুদ্ধ হবার পর এক সময় তার গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং পরিণতিতে মূল নদীর মৃত্যু ঘটে। বিরাট অঞ্চলব্যাপী বহুসংখ্যক নদীর গতিধারায় আপতিত এ ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের ফলে ব্যাপক অঞ্চলব্যাপী জনজীবনে যে বিপর্যয় ঘটে তাতে করে জনগণের একাংশ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান দাবী করে। কিন্তু ইতিমধ্যে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সিন্ধু সভ্যতার ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
অন্যদিকে, পুরাতন ধর্ম ছিল সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সিন্ধু সভ্যতা যে মূলত অহিংসা-নির্ভর তথা যুদ্ধ বিমুখ একটা সভ্যতা ছিল সকল প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার সে বিষয়টিকে নিশ্চিত করেছে। সুতরাং এমন একটা সভ্যতার ধর্ম যে অহিংসার সহায়ক বা সমর্থক হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে গেলে যারা তখনও এই ব্যবস্থার পক্ষে ছিল তাদের সঙ্গে সহিংস সংঘাত ঘটাতে হয়। ঋগ্বেদ পাঠ থেকে আমরা অনুমান করি, রাষ্ট্র তথা শাসক শ্রেণীর মধ্যেও নদীনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বিরোধ ঘটে। তবে আমাদের অনুমান যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণীর প্রধান অংশ ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সংরক্ষণের পক্ষপাতী। যাইহোক, একটা পর্যায়ে বিরোধ সশস্ত্র বা সহিংস সংঘাতে রূপ নেওয়ার দিকে গেল। কিন্তু বিদ্যমান ধর্ম থাকলে যুদ্ধ কিংবা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের সপক্ষে ধর্মীয় অনুমোদন লাভ সম্ভব না।
সুতরাং জনসখ্যার যে অংশ এই ব্যবস্থার অবসান চাচ্ছিল তাদের জন্য বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতার পুরোহিত শ্রেণীর একাংশ এই সংস্কারের কাজ করে। এভাবে বৈদিক ধর্মের উত্থান ঘটে। এই ধর্মসংস্কারের প্রক্রিয়ায় যে সকল মন্ত্র রচিত হয় সেগুলির সমষ্টি হচ্ছে ঋগ্বেদ। এই ধর্মসংস্কার একটি গৃহযু্দ্ধের দিকে সমাজ এবং সভ্যতাকে নিয়ে যায়। বৈদিক বিদ্রোহ ও যুদ্ধের পরিণতিতে পতনোন্মুখ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা পতনোন্মুখ এই সভ্যতার পতনকেও ত্বরান্বিত করে। এই হচ্ছে আমাদের ব্যাখ্যা।
আর এই জায়গায় ভগবান সিংয়ের আপত্তি। কারণ আমাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণের কৃতিত্ব বৈদিক ঋষিদের উপর অর্পিত না হয়ে তার ধ্বংস ত্বরান্বিত করার দায় তাদের উপর অর্পিত হয়। তবে ভগবান সিং আমাদের ব্যাখ্যাকে এভাবে দেখেন যে, আমরা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্যও বৈদিক আন্দোলন বা ঋষিদেরকে দায়ী করেছি। আমাদের গ্রন্থের প্রেক্ষিতে তিনি তার এই আপত্তির কথা জানালে আমরা তাকে এ কথা বলি যে, আমরা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্য বৈদিক আন্দোলনকে দায়ী করি নাই। তবে সভ্যতার পতনোন্মুখ অবস্থায় তার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন করে বৈদিক ঋষিরা সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।*
————————–
*ভগবান সিং এবং আমাদের মধ্যে কয়েকটি পত্রবিনিময় হয়। এগুলির মধ্যে তার এবং আমার দুইটি পত্রবিনিময়ের অনুলিপির জন্য দেখুন এখানে:
————————–
যাইহোক, সিংয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের সিদ্ধান্ত বিরোধাত্মক। তার ব্যাখ্যা থেকে এই দাঁড়ায় যে, বৈদিক ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের সঙ্গে আদি থেকে সমাপ্তির পর্যায় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট। তিনি প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের জন্যও বৈদিক ঋষিদের ভূমিকা দেখতে পান। আর আমরা বলছি বৈদিক শক্তি এবং ঋষিরা তার ধ্বংস বা পতন ত্বরান্বিতকারী। তিনি সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। আর আমরা বলছি মানুষ নির্মিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্কট ও ব্যর্থতার কারণে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে, যাকে ত্বরান্বিত এবং চূড়ান্ত রূপ দান করে বৈদিক আন্দোলন এবং যুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে ভগবান সিংয়ের লিখা গ্রন্থের The Vedic Harappans অর্থাৎ ‘বৈদিক হরপ্পানগণ’ নামকরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্কট। তিনি হরপ্পান তথা সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদেরকে বৈদিক ধর্মাবলম্বী হিসাব দেখতে চাচ্ছেন। তাতে এই দাঁড়ায় যে, বৈদিকরাই সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা। বস্তুত এখানেই হচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গীগত সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা। অন্য সব দিক বাদ দিলেও সিন্ধু সভ্যতার যুদ্ধ-বিমুখ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির সঙ্গে ঋগ্বেদের যুদ্ধ নির্ভরতাকে মিলানো যাবে কী করে? ঋগ্বেদকে সিন্ধু সভ্যতার একটা নির্দিষ্ট কালপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে না পারলে কীভাবে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদের যৌক্তিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব?
বিশাল পাণ্ডিত্যের জন্য আমি প্রয়াত ভগবান সিংকে খুবই শ্রদ্ধা করি। ২০০০ সালে দিল্লীতে তার বাসগৃহে তার সঙ্গে চঞ্চলের দীর্ঘ আলোচনাও হয়েছিল। তার সঙ্গে আমাদের উভয়ের পত্র বিনিময় এবং চঞ্চলের কাছ থেকে শুনে তাকে আমার অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি মনে হয়েছিল। সুতরাং তার সঙ্গে বিরোধের জায়গাটাকে এখানে আনতে চাচ্ছিলাম না। তা সত্ত্বেও এখানে ভগবান সিং-এর দৃষ্টান্ত দিলাম হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সমস্যাটা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরবার জন্য। ব্যক্তিগত বিশ্বাসে তিনি যেমনই হোন তার এই দৃষ্টিভঙ্গীকে হিন্দুত্ববাদী বলা ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নাই। হিন্দুত্ববাদীরা সাধারণত এ ধরনের বক্তব্য দেন। তারা সাধারণত এটা বলতে পছন্দ করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার জন্ম থেকেই বৈদিক ঋষিদের কম-বেশী নায়কোচিত ভূমিকা রয়েছে এই সভ্যতার নির্মাণ ও বিকাশে। বস্তুত এই দৃষ্টিভঙ্গীর পিছনে যেটা কাজ করে সেটা হচ্ছে ধর্মগ্রন্থ হোক আর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হোক সবকিছুর মধ্য থেকে ছাড়া ছাড়াভাবে উপকরণ সংগ্রহ করে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান তৈরীর আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠের মতো এটাও আমাদেরকে আর এক ভ্রান্তির মধ্যে নেয়।
(ক) পুনরায় ঋগ্বেদ
এই পর্বের আলোচনাও ঋগ্বেদ দিয়েই শুরু করি। আমাদের হিসাব অনুযায়ী এটা সিন্ধু সভ্যতার সূচনার সময় থেকে রচিত নয়, বরং তার সমাপ্তির সময়কার সৃষ্টি। সিন্ধু সভ্যতার সীমিত সংখ্যক লিপি যেটুকু পাওয়া গেছে তার পাঠোদ্ধার হয় নাই। ফলে সিন্ধু সভ্যতার সময় নির্ধারণের জন্য এখন আমাদেরকে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তা দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত বা নগর পর্যায় হিসাবে যেটাকে ধরা হয় সেটার সূচনার সময় নির্ধারিত হয়েছে মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২,৬০০ কাল থেকে। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় এটাকে পরিণত হরপ্পান বা হরপ্পান সভ্যতা হিসাবেও বলা হয়। আর এই নগর সভ্যতার অবসান হয় মোটামুটি ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। তবে নগর সভ্যতা যেমন হঠাৎ করে শুরু হয় নাই, বরং তার একটা দীর্ঘকাল স্থায়ী পূর্বপ্রস্তুতির পর্যায় চলছিল তেমন নগর সভ্যতার ধ্বংস বা অবসানও হঠাৎ করে ঘটে নাই। বরং একটা দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমশ নগরগুলি পরিত্যক্ত হতে থাকে, জনবসতি এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হতে থাকে, নদীগুলির গতিপথও এলোমেলো হতে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নদী সরস্বতী নদীর ক্রমশ মৃত্যুবরণ। এভাবে সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের সূচনা কাল যদি এখন থেকে সাড়ে পাঁচ বা ছয় হাজার বছর সময়ের আগে ধরা যায় তবে তার পরিসমাপ্তি ঘটতেও একটা দীর্ঘ সময় লাগে। সেটার সময় মূলত ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ হলেও চূড়ান্তভাবে সিন্ধু সভ্যতার অবসান হয় খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১,৫০০ থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১,০০০ পর্যন্ত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিন্ধু সভ্যতার এই তিন পর্যায়কে আদি হরপ্পান (Early Harappan), পরিণত হরপ্পান (Mature Harappan) এবং বিদায়ী হরপ্পান (Late Harappan) এভাবে ভাগ করেন। কার্বন ডেটিং হিসাব অনুযায়ী খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২,৬০০ থেকে শুরু হয়ে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১,৯০০ পর্যন্ত স্থায়ী কালপর্বই হচ্ছে পরিণত হরপ্পান বা সিন্ধুর নগর সভ্যতার প্রকৃত কালপর্ব।
সুতরাং ঋগ্বেদকে যদি সভ্যতার সঙ্কটের সময়ে রচিত ধরা যায় তবে আমরা অনুমান করতে পারি যে, ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আরও কিছু আগে পুরাতন ধর্ম সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে ঋগ্বেদের মন্ত্র রচনা শুরু হয়েছিল। ঋগ্বেদের আরও প্রাচীনত্বের প্রমাণ স্বরূপ অনেক হিন্দুত্ববাদী পণ্ডিত সরস্বতী নদীর স্তুতিতে রচিত মন্ত্রের উল্লেখ করেন। বস্তুত সরস্বতী নদীকে যে মহিমা ঋগ্বেদকে দেওয়া হয়েছে সিন্ধু বা আর কোনও নদীকে সেই মহিমা দেওয়া হয় নাই। ঋগ্বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে ‘পবিত্রা, অন্নযুক্তযজ্ঞবিশিষ্টা ও যজ্ঞফলরূপধনদাত্রী সরস্বতী’ (১/৩/১০), ‘শুচি’ (১/১৪২/৯), ‘নদীগণের মধ্যে শুদ্ধা’ (৭/৯৫/২)। অথচ সরস্বতী ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের অনেক আগে থেকেই স্রোত হারিয়ে মরে যেতে শুরু করে। তার একটা ধারা পশ্চিমে সিন্ধু নদীতে অপর একটি ধারা পূর্বে যমুনা নদীতে মিলিত হয়। এর ফলে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
সুতরাং প্রশ্ন আসে যে, ঋগ্বেদ যদি সভ্যতার ক্ষয়ের সময় একটা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রচিত হয় তবে সেখানে স্রোতস্বিনী সরস্বতী নদীর স্তুতিতে মন্ত্র পাই কীভাবে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে যেহেতু ঋগ্বেদ ধর্মসংস্কারের ফসল সুতরাং বৈদিক সংস্কারকরা তাদের নিজেদের সংস্কারকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়োজনে পুরাতন অনেক মন্ত্রকে গ্রহণ বা রক্ষা করেছে। এ বিষয়ে আমাদের গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আলোচনা করেছি। পৃথিবীর সকল ধর্মীয় আন্দোলনে নানান রূপে পূর্বতন বা আদি ধর্মের বহু উপাদানকে গ্রহণ বা রক্ষা করতে দেখা যায়। সুতরাং ঋগ্বেদকেও দেখতে হবে সেভাবে। তা না হলে ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে নানান গোঁজামিল দিতে হয়। ঋগ্বেদে বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থান বর্ণনা থেকে কালপর্ব নিয়ে যে সকল বিতর্ক আছে সেগুলিরও সহজ উত্তর এই ব্যাখ্যা থেকে আমরা পেতে পারি। দীর্ঘ কাল ধরে একটা সভ্যতার যেসব স্মৃতি মানুষ ধর্মীয়ভাবে হোক আর যেভাবে হোক ধারণ করেছিল ঋগ্বেদেও স্বাভাবিকভাবে সেগুলির অনেক কিছুরই ছায়াপাত হয়েছিল।
এর আগে আমি বলেছি যে ঋগ্বেদের যুদ্ধ-নির্ভরতাকে সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ রূপের সঙ্গে মিলানো যায় না। এই রকম যুদ্ধংদেহী ঋষিদের বা বৈদিক শক্তির পক্ষে বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সিন্ধু সভ্যতার মতো মূলত অহিংস একটা সভ্যতাকে কীভাবে নির্মাণ করা সম্ভব? কাণ্ডজ্ঞান কী বলে? তাহলে ঋগ্বেদে যু্দ্ধের এত বিবরণ, যুদ্ধজয়ের জন্য দেবতাদের নিকট এত আকুতি — এগুলি কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও ঋগ্বেদেই আছে।
বৃত্র-বিরোধী বৈদিক আন্দোলনের উদ্ভব ও ইন্দ্রের উথান সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবার জন্য ঋগ্বেদের একজন প্রসিদ্ধ ঋষি বিশ্বামিত্রের রচিত পুরো সূক্তটি উদ্ধৃত করা যাক :
‘১। হে ইন্দ্র! বৃত্র বিনাশকর বললাভের জন্য ও শত্রু সেনার অভিভবের জন্য তোমাকে প্রবর্তিত করছি। ২। হে শতক্রতু! স্তোতাগণ তোমার মন চক্ষু প্রীত করে আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করুক। ৩। হে শতক্রতু! আমরা গর্বিত শত্রুদের অভিভবকর যুদ্ধে সমস্ত স্তুতি দ্বারা তোমার নাম কীর্তন করব। ৪। ইন্দ্র সকলের স্তুতিযোগ্য, অপরিমিত তেজবিশিষ্ট এবং মনুষ্যদের স্বামী, আমরা তার স্তুতি করছি। ৫। হে ইন্দ্র! বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য এবং যুদ্ধে ধন লাভের জন্য বহু লোকের আহূত ইন্দ্রকে আহ্বান করছি। ৬। হে শতক্রতু! তুমি যুদ্ধে শত্রুদের অভিভবকারী হও, বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য আমরা তোমাকে প্রার্থনা করছি। ৭। হে ইন্দ্র! যারা ধনে, যুদ্ধে, বীরসমূহে ও বলে আমাদের অভিমানী শত্রু তাদের পরাজিত কর। ৮। হে শতক্রতু! আমাদের আশ্রয় দানের জন্য অতিশয় বলবান, দীপ্তিযুক্ত, স্বপ্ন নিবারক সোম পান কর। ৯। হে শতক্রতু! পঞ্চজনে যে সকল ইন্দ্রিয় আছে, আমি সেগুলি তোমারই বলে জানি। ১০। হে ইন্দ্র! প্রভূত অন্ন তোমার নিকট গমন করুক, শত্রুদের দুর্ধর্ষ ধন আমাদের প্রদান কর। আমরা তোমার উৎকৃষ্ট বল বর্ধিত করব। ১১। হে শক্র! নিকট অথবা দূর দেশ হতে আমাদের অভিমুখে এস। হে বজ্রবান ইন্দ্র! তোমার যে উৎকৃষ্ট স্থান আছে সেখান হতে এ যজ্ঞে এস।’ (৩ মণ্ডল, ৩৭ সূক্ত)*
——————-
* ঋগ্বেদ সংহিতা (প্রথম খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮৭
——————-
যারা ঋগ্বেদ পাঠ করেছেন তারা সবাই জানেন যে, যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্র হচ্ছে প্রধান বৈদিক দেবতা। সুতরাং ঋগ্বেদে তার মর্যাদা সর্বোচ্চ। হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন এমন সবাই ঋষিদের মধ্যে বিশ্বামিত্রের মর্যাদা সম্পর্কেও জ্ঞাত। এখন সেই ঋষি স্পষ্টভাবে বলছেন কেন দেবতা ইন্দ্রের পূজা প্রবর্তন করা হয়েছে। সেই কারণ হচ্ছে বৃত্র বধ করা। সুতরাং সমগ্র বৈদিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রণোদনা আমাদের নিকট ঋষি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করলেন। অর্থাৎ বৃত্র বধের উদ্দেশ্যেই মূলত যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রের পূজা প্রবর্তন। এক অর্থে ঋগ্বেদ যেন ইন্দ্র আর বৃত্রের মধ্যকার সংঘাত এবং অবশেষে পরাক্রান্ত বৃত্র সংহারের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রের গৌরব কীর্তনে রচিত এক মহাকাব্য। মহাকাব্যে যেমন মূল নায়ক এবং খল নায়কের বাইরেও আরও অনেক চরিত্র থাকে, থাকে আরও অনেক কাহিনীর বর্ণনা তেমন ঋগ্বেদেও আছে আরও অনেক দেবতা ও দানবের আখ্যান, দেবতাদেরও কারও উন্নয়ন এবং কারও অবনমন এবং ইন্দ্র ও বৃত্র কিংবা দেবতাদের বিষয় ছাড়াও আরও বহু বিষয় নিয়ে রচিত মন্ত্র। তবে মনে রাখতে হবে দেবতা ইন্দ্র এবং তার শত্রু বৃত্র বধই হচ্ছে ঋগ্বেদের মূল ভরকেন্দ্র যাকে কেন্দ্র করে বৈদিক বিশ্ব আবর্তিত।
সুতরাং বৃত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারলেই ঋগ্বেদের রহস্যের দরজা খুলে যায়। এ বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’সহ আমাদের বিভিন্ন লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করায় এখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। এখানে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলি যে, বৃত্র হচ্ছে নদীতে দেওয়া জলকপাট বা sluice-gate যুক্ত বাঁধ। সিন্ধু সভ্যতায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অস্তিত্বের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। জনসমর্থন লাভের প্রয়োজনে একটা পর্যায়ে জলকপাট ও নদী রোধক বাঁধকে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে আজ আমরা ধারণা করি। ফলে বাঁধ বা জলকপাটকে দৈব রূপ দেওয়া হয়েছিল অর্থাৎ বাঁধের দেবতাও ছিল।
একটা সময়ে যখন নদীনিয়ন্ত্রণের এই কৃত্রিম ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে তখন এক বিরাট জনগোষ্ঠী যে এই ব্যবস্থার চূড়ান্ত অবসান চেয়েছিল সেটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ধর্মের অংশ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হলে তাদের জন্য একটা পাল্টা ধর্ম প্রবর্তনের জন্য পুরাতন ধর্মের সংস্কার ছিল অপরিহার্য। এভাবে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত পুরাতন দেবতাদের কাউকে অবনমিত এবং কাউকে দানবে পরিণত করে পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে তার বদলে একটা নূতন ধর্ম প্রবর্তন করা হল। এভাবে বাঁধের দেবতাকে বৃত্র হিসাবে উল্লেখ করে তাকে সংহার তথা ধ্বংসের লক্ষ্যে একটা নূতন আন্দোলন গড়ে তোলা হল। সুতরাং বৈদিক পক্ষের প্রধান দেবতা যেমন যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্র তেমন বৈদিক পক্ষের প্রধান শত্রু হচ্ছে বৃত্র, যাকে ঋগ্বেদে কখনও ‘দেব’ (হে ইন্দ্র! যখন সেই এক দেব বৃত্র তোমার বজ্রের প্রতি আঘাত করেছিল : ১/৩২/১২) বলা হলেও তাকে দানবের জায়গায় অবনমিত করা হয়েছে।
ঋগ্বেদের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্কের প্রশ্নে অনেকের একটা আপত্তি হল এই যে ঋগ্বেদে যেভাবে যুদ্ধ এবং ‘পুর’ বা নগর ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরা হয় প্রত্নতত্ত্ব তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ উপস্থিত করে না। এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল বৈদিক আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য মানুষ হত্যা বা নগর ধ্বংস নয়, বরং বৃত্র হত্যা তথা বাঁধ ধ্বংস বা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস। মনে রাখতে হবে একই সমাজের একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যকার একটা গৃহযুদ্ধের চিত্র আমরা ঋগ্বেদ থেকে পাই যেখানে প্রধান লক্ষ্য মোটেই প্রতিপক্ষের নগর ধ্বংস বা লোকহত্যা নয়, বরং জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ ধ্বংসের মাধ্যমে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। সুতরাং শত্রু সৈন্য হত্যা বা নগর ধ্বংসের যে চিত্র আমরা পাই সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীকী মাত্র। আর মনে রাখতে হবে সিন্ধু সভ্যতার সুদীর্ঘ কালব্যাপী মূলত অহিংস সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগণের নিকট একটা ছোট যুদ্ধ, রক্তপাত এবং ধ্বংসও বিরাট রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে। এর প্রকাশ যে আমরা ঋগ্বেদে পাই সেটা মনে করার কারণ আছে।
সবচেয়ে বড় কথা ঋগ্বেদের বিভিন্ন শব্দের এখন যে অর্থ করা হয় সেগুলি যে সম্পূর্ণ সঠিক তার কী মানে আছে? ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। যেমন ‘অয়স’ শব্দের অর্থ এখন লৌহ করা হলেও ঋগ্বেদের কালে অগ্নিদগ্ধ করে যে কোনও কঠিন বস্তুকে বুঝাতে অয়স শব্দের ব্যবহার হত। এই কারণে অয়স নির্মিত নগর (ঋগ্বেদ : ৭/৩/৭) বলতে লৌহ দ্বারা নির্মিত নগর নয়, বরং পাকা ইটে তৈরী নগরকে বুঝতে হবে। একই ভাবে অয়স নির্মিত ‘উজ্জ্বল কলস’ (ঋগ্বেদ : ৫/৩০/১৫) বলতে তামা বা ব্রোঞ্জ নির্মিত কলস বুঝতে হবে। সুতরাং ‘পুর’ বললেই আমরা সর্বদা নগর বুঝব কেন? প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মিশেল ড্যানিনো তার এক বক্তৃতায় ‘পুর’কে যে কোনও ধরনের বসতিও বলতে চেয়েছেন:
https://www.youtube.com/watch?v=QBCmXr8_V28
সুতরাং ঋগ্বেদে যখন ইন্দ্রকে পুরন্দর বলা হয় তখন সেটার অর্থ বসতি বিনাশকারীও হতে পারে।
যাইহোক, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা ইতিমধ্যে ভেঙ্গে পড়তে থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে টিকেছিল তার ধ্বংস সাধনের পর ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার অবশিষ্টটুকুরও ধ্বংস হতে খুব বেশী সময় লাগে নাই। মনে রাখতে হবে বিশেষ করে জলকপাট রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারলে জলকপাট ধ্বংস করা খুব সহজ কাজ হয়ে পড়ে। আর জলকপাট ধ্বংস হলে নদীনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম জলসেচ ব্যবস্থা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়ে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলসেচ না থাকায় যখন গ্রাম, নগর বা বসতিসমূহ ক্রমান্বয়ে পরিত্যক্ত হয়েছে তখন সভ্যতা এমনিতেই ক্রমশ পরিত্যক্ত এবং ধ্বংস হয়েছে। এর জন্য আলাদাভাবে ধ্বংসকার্য চালাবার প্রয়োজন হয় নাই। আমাদের নিকট এটাই হচ্ছে প্রত্নতত্ত্বের বিচারে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসে যুদ্ধের ভূমিকা সেভাবে না থাকবার মূল কারণ।
সুতরাং প্রকৃত অর্থে যুদ্ধও নয়, প্রাকৃতিক বা জলবায়ুগত পরিবর্তনও নয়, বরং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া হিসাবে তার বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ ও তার ধ্বংসসাধন সিন্ধু সভ্যতার চূড়ান্ত ধ্বংসের মূল কারণ। এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, যদি পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন সিন্ধু সভ্যতার কৃষির বিপর্যয় তথা খাদ্যোৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংসের কারণ হত তবে ধর্মসংস্কারের মাধ্যমে বৈদিক আন্দোলন সংগঠন ও যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনই হত না। ফলে ঋগ্বেদ রচনাও হত না। কারণ মানুষ রচিত কোনও কৃত্রিম ব্যবস্থা না থাকায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ থেকে একটা ধর্মসংস্কারেরও প্রয়োজন বোধ জন্মাতে পারত না। মানুষের হস্তক্ষেপে একটা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার পর যখন তার ইতিবাচক ভূমিকা হারিয়ে সেটা মানুষের জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল তখন যারা পাল্টা হস্তক্ষেপ দ্বারা এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে অতীতের বন্ধনমুক্ত জলপ্রবাহের স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে চেয়েছিল ঋগ্বেদ হল তাদের স্বপ্নগাথা।
সুতরাং সভ্যতার মানদণ্ডে ঋগ্বেদ হচ্ছে পশ্চাদমুখী যাত্রা; এটা সভ্যতার ক্রিয়া নয়, বরং প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি হল বৈদিক বিজয় পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে ধর্মের শক্তির ক্রমিক শক্তিবৃদ্ধি। অথচ সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি আমাদের সামনে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র উপস্থিত করে।
সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম কিংবা পুরোহিত শ্রেণীর গৌণ দশার জন্য ঋগ্বেদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। সমগ্র ঋগ্বেদ বহু বিষয়েই একটা সভ্য সমাজের বিশদ চিত্র উপস্থিত করে। অথচ সেখানে রাজনৈতিক বিষয়াদি কিংবা রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়াদির উল্লেখ প্রায় নাই বললেই চলে। এটা আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে, যে ঐতিহ্যিক পুরোহিত শ্রেণী থেকে বৈদিক পুরোহিত বা ঋষিদের আগমন সেই পুরাতন পুরোহিত শ্রেণীরও রাষ্ট্রশাসনে কোনও ভূমিকা ছিল না। বৈদিক ঋষিরা সনাতন পুরোহিত শ্রেণী থেকে আসায় তাদের রাজনীতি বা রাষ্ট্রশাসনের বিষয়াদি নিয়ে এই ধরনের নীরবতা। অথচ তারা একটা যুদ্ধকে বৈধতা দানের জন্য ধর্মসংস্কার করছেন, যুদ্ধের মতো ঘোরতর রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করছেন। যুদ্ধকে সমর বিজ্ঞানে অনেকেই রাজনীতির সম্প্রসারণ বা সশস্ত্র রাজনীতিও বলেন। সেই যুদ্ধের সপক্ষে যারা মন্ত্র রচনা করে যু্দ্ধের জন্য সামাজিক মনস্তত্ত্ব তৈরী করছেন তারা রাষ্ট্রশাসন সম্পর্কে যখন কোনও কিছু বলেন না তখন ধরে নিতে হবে ঐতিহ্যিকভাবে এটা তাদের অধিকার বহির্ভূত বিষয়। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসনের সঙ্গে সেখানকার পুরোহিত শ্রেণীর কোনও সম্পর্কই ছিল না। এটা তাদের অভিজ্ঞতা এবং এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তাদের থেকে আসা বৈদিক ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র সম্পর্কে কথা প্রায় বলেনই নাই। ঋগ্বেদে সমিতি, সভা, পঞ্চজন ইত্যাদির উল্লেখ আমাদেরকে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনও স্পষ্ট চিত্র দেয় না।
সুতরাং আমরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসনের ধর্মমুক্ত রূপ সম্পর্কে একটা চিত্র কল্পনা করতে পারি। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমরা সেক্যুলার শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকার সপক্ষে আমাদের অনুমানের কথা বলেছি। সেখানে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্বও দেখতে পেয়েছি। চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ বা রচনাগুলিতে এ বিষয়ে অনেক কথা বলেছি। বিশেষত আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’-এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাসমুক্ত একটা সভ্যতার চিত্র অধিকতর স্পষ্ট করে আঁকতে চেয়েছি। চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে সাম্প্রতিক লিখা Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval-এও বিষয়গুলিকে আলোচনায় এনেছি। তবে সিন্ধু সভ্যতার ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ পর্যবেক্ষণ এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনুধ্যান আমাকে এ সিদ্ধান্তে নিয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার গৌরবদীপ্ত কালে রাজতন্ত্রের যেমন কোনও জায়গা ছিল না তেমন সভ্যতার মূলধারায় অলোকবাদী ধর্মেরও জায়গা ছিল না।
বস্তুত প্রত্নতত্ত্ব থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার কোনও পর্যায়েই রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। বহসংখ্যক প্রত্নতত্ত্ববিদ সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনাদি থেকে এ বিষয়ে মোটামুটি একমত। অনুমান করি ভারতবর্ষে পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে বিশেষত বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের সময়ে শাক্য, বিদেহ, ভাগ্য, মল্ল (রাজধানী পব), মল্ল (রাজধানী কুশিনারা) মল্ল, লিচ্ছবি (রাজধানী বৈশালী) ইত্যাদি যে সকল প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানতে পারি সেগুলি সবই সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থার একটা ধারাবাহিক রূপ। আর্যরা যেমন বহিরাগত নয় তেমন এই সকল প্রজাতন্ত্রও বহিরাগতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। অর্থাৎ ঐতিহাসিক কালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং প্রজাতন্ত্রসমূহ সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার।
সিন্ধু সভ্যতায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্বের সম্ভাবনা বা বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে করব না। এটার খুব একটা প্রয়োজনও নাই। যারা সিন্ধু সভ্যতার বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, আশা করি তারা এ বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক বা পণ্ডিতদের অভিমত জানেন। সমগ্র সিন্ধু সভ্যতায় ক্ষমতা কিংবা সম্পদের অতিকেন্দ্রীভবনের কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। নগরগুলিতে বাসগৃহের সুষম বিন্যাস একটি লক্ষ্যণীয় দিক। রাজপ্রাসাদ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কোনও ভবনও সমগ্র সিন্ধু সভ্যতা জুড়ে কোথায়ও পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতা স্পষ্টতই যে ধরনেরই হোক একটা গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চিত্র উপস্থিত করে। সুতরাং আমাদের সামনে সিন্ধু সভ্যতা এমন এক প্রাচীন সভ্যতার চিত্র আঁকে যেখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বংশানুক্রমিক রাজা বা সম্রাট ছিল না। পরবর্তী ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে রাজতন্ত্রের যে বিকাশ এবং বিস্তারই ঘটুক এটা স্পষ্ট যে সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল রাজ-শাসনহীন। অর্থাৎ অন্যান্য সভ্যতায় যা-ই থাকুক ভারতবর্ষের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পর্যায়ে রাষ্ট্রশাসনে স্বৈরতন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের কোনও স্থান ছিল না। অন্তত প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যপ্রমাণকে মানতে হলে আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তই টানতে হবে।
পরের পর্ব: ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ (পর্ব – ২) দেখুন এখানে:
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..