ভালোবাসলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে মন

ওয়াহেদ সবুজ
গল্প, পডকাস্ট
Bengali
ভালোবাসলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে মন

ভালোবাসলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে মন!

ডায়েরির পাতায় সবার উপরে এই বাক্যটি লিখলো অয়ন৷

রবিবারের রাতটা তার কাটতেই চায় না, বিশাল মরুর বুকে অসহায় একলা পথিক পথের মতো না ফুরোনো সময়ের গল্প হয়ে ওঠে রবিবারের রাতগুলো! রবিবারের রাতগুলো, তা সে পূর্ণিমাই হোক বা অমাবস্যা, এক নিদারুণ অস্থিরতার নাম৷

আজকে ডায়েরির পাতায় এই একটি বাক্য লেখার পরে কলম আর এগোচ্ছে না; এগোচ্ছে না মানে তুমুল কলমকম্পন হচ্ছে, বুকের মধ্যে ঢুপঢাপ যেন ডিনামাইট ফাটছে, নিঃশ্বাসের গতি ছাড়িয়ে যাচ্ছে আলোর গতিকে৷ আজকের রাতটা মনে হচ্ছে নির্ঘুম কাটবে৷ এমনিতেও গত কয়েক সপ্তাহে নির্ঘুম কাটানো রাতের সংখ্যাটা আশঙ্কাজনক; বিশেষ করে রবিবারের রাতগুলো৷

ডায়েরির লেখাটার দিকে পুনরায় তাকালো সে— ভালোবাসলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে মন৷

গল্পটির অডিও শুনতে পাবেন এখানে –

একাকি পথ ধরে সে হাঁটছে; তার হাতে একটা ছেঁড়া পৃষ্ঠা৷ দুর্বোধ্য কোনো ভাষায় কিছু একটা লেখা আছে তাতে৷ পথটা বড্ড সরু, বারবার ঝুল খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে, কয়েক মুহূর্ত থেমে নিজেকে ব্যালান্স করে আবার চলতে শুরু করে৷ পাশাপাশি দুটো রাস্তা, একই রকম, বড্ড চিকন, একই সমান্তরালে চলে গেছে দূরে৷ মাঝখানে অসংখ্য সাঁকো পথ দুটোকে যুক্ত করে রেখেছে; কিন্তু সে সাঁকো পার হওয়া বড্ড দুঃসাধ্য!

অয়নের হাতে একটি কাগজের টুকরো যাতে কিছু একটা লেখা, দুর্বোধ্য কোনো ভাষায়, অচেনা অপরিচিত বর্ণে৷ হঠাৎ সে তাকিয়ে দেখে, পাশের পথটিতেও কেউ একজন হাঁটছে, খুব ধীরে শরীর দুলিয়ে বেশ আয়েশ করে হাঁটছে; কোনো তাড়া নেই, নিশ্চিন্ত সুখী সে চলন৷ অয়ন হাঁটছে দ্রুতগতিতে, প্রচণ্ড বেগে; তারপরেও কোনোভাবেই পাশেরজনের পাশাপাশি পৌঁছতে পারছে না৷ হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো সে; অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে এক রকম ছুটছে৷ পথ দুটো এঁকেবেঁকে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে; যখনই কোনো বাঁক চোখে পড়ছে, মনে হচ্ছে, একটু পরেই হয়তো দেখা যাবে পথ দুটো পরস্পরের সাথে মিলে গেছে৷ এই মিলে যাওয়াটা খুব খুব প্রয়োজন; অয়নকে জানতেই হবে কেন সে অপরজনের বরাবর পৌঁছতে পারছে না?
সামনেই একটি দারুণ বাঁক দেখা যাচ্ছে; পাগলের মতো ছুটতে থাকে সে, দৌড়ে নয়, হেঁটেই৷ ওই তো, কাছেই; পথ প্রায় শেষ! আরেকটু কষ্ট, আরেকটু চেষ্টা, আরেকটু গতি; এরপরেই মিলে যাবে পথ! শরীরের ঘামে ভিজে যাচ্ছে সব— সে পথ, সাঁকো, মাটি; ধীরে ধীরে সে ঘামে লবণাক্ত সমুদ্র হয়ে উঠছে দুটো পথের নিচে মৃত্তিকার শরীর৷ এই তো, চলে এসেছে সময়; কয়েক মুহূর্ত পরেই মুক্তি!

পথের বাঁকটি পেরোতেই ঘুম ভেঙে গেল অয়নের৷ সারা শরীর ঘামে ভেজা, মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে পূর্ণ গতিতে! তার হাতের মধ্যে ডায়েরিটা ধরা, তর্জনি ঢুকে আছে ডায়েরির ভেতরে; আঙুল রাখা সে পৃষ্ঠাটি খুলে দেখে, সেখানে লেখা— ভালোবাসলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে মন৷

আজ রাতে আর ঘুম হবে না৷ কম্পিউটারে আস্তে করে গান ছেড়ে দিল— “তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে ভাঙলো কাঁচের আয়না৷” কিছুক্ষণ পরেই আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করবে৷ জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে; আকাশের দিকে চোখ, কোনো এক অস্পৃশ্যকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট সে চোখে, আর বুকের ভেতর ছোট ছোট দ্রুতগতির ধুকপুক! হঠাৎই আকাশের অন্ধকার বুকে ভেসে ওঠে দুটো চোখ; সে চোখে হাসি, সুনির্মল হাসি! কার চোখ?

২.

মহিমান্বিত সোমবারের সকাল, স্নিগ্ধ সূর্যমাখা প্রশান্ত সকাল৷ জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নরম আলো এসে পড়েছে কম্পিউটারের মনিটরে; তার পর্দায় মহান কবি রবীন্দ্রনাথের ছবি, স্পিকারে বাজছে “হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া…”৷ সোমবারের প্রভাতগুলো যে পথে চেয়ে শুরু হয়, সে পথ থামে ইশানার চোখতারায় গিয়ে৷ প্রতি সোমবার বিকেলে সাড়ে তিনটা থেকে চারটার মধ্যে ইশানার সাথে দেখা হয় তার৷ দেখাটা যে দৈবভাবে ঈশ্বরের ইশারায় হয়, তা না; ঘড়িতে যখন তিনটা পনেরো, তখন থেকে কড়া রৌদ্রে কপাল ঘামিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে কলেজ-গেটের পাশে৷ ইশানা চলে আসে সাড়ে তিনটা থেকে পৌনে চারটার মধ্যেই; না, নিশ্চয়ই অয়নের সাথে দেখা করার জন্য নয়৷ প্রতি সোমবার বিকেলে সাপ্তাহিক আড্ডা বসে ওদের, কলেজের বকুল গাছটির তলায়; সে আড্ডাকে ওরা ভদ্র ভাষায় ‘গ্রুপ স্টাডি’ বলে থাকে৷

অয়ন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছেলে; এখন পর্যন্ত সে একবারের জন্যও ইশানার দিকে সরাসরি চোখ তুলে তাকাতে পারেনি, যদিও তাকালেও কোনো সমস্যা হবার কথা নয়; কারণ সে যেখানে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ইশানাকে দেখে, সেখান থেকে অন্তত গজ বিশেকের দূরত্ব রেখে ইশানার রিকশা তার সামনে দিয়ে গিয়ে কলেজের গেইটে থামে৷ এরপর যতটা সময় ইশানা সেখানে থাকে, সে পুরোটা সময় একই রকম দূরত্ব বজায় রেখে ইশানার আশপাশেই অবস্থান করে৷ অবাক ব্যাপার, এত দূর থেকেও অয়ন ইশানার হাসি দেখতে পায়; ঠিকই ধরেছেন, এই দূরত্ব থেকে হাসি দেখা যেতেই পারে, এতে অবাক হবার কী আছে? আছে; অবাক হবার ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা কল্পনা করছি ইশানার ঠোঁটের হাসি, কিন্তু অয়ন দেখছে তার চোখের হাসি৷ আমাদের অয়ন যে মেয়েটার প্রতি মানসিকভাবে এত এত দুর্বল, এর প্রধান কারণ হচ্ছে তার চোখের হাসি! অয়নের মতে, পৃথিবীর সকল মানুষ হাসে ঠোঁটে; একমাত্র ইশানাই আছে যার হাসিতে ঠোঁট যতটা, তারচেয়ে অনেক বেশি হাসে তার চোখ৷ তার চোখে-ঠোঁটে যে হাসিটা তৈরি হয়, তার সৃষ্টি পৃথিবীতে নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে!

ইশানা এমন একটি মেয়ে, এ পৃথিবীর সকল পুরুষ তার প্রেমে পড়তে চাইবে৷ সুতীক্ষ্ণ চোখ, অনতিলম্ব কপাল, মসৃণ স্নিগ্ধ চুল কাঁধ বেয়ে নেমে গেছে কোমর পর্যন্ত; সে হাসলে ঝংকার ওঠে বাতাসে, কণ্ঠে মিশে থাকে সহস্র কোকিল; উজ্জ্বল শ্যামবর্ণে পরাজিত হয় গোধূলির দুধে-আলতা আকাশ, দু-ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়ে চাঁদের জোছনা৷

শুধু রূপে নয়, গুণেও তার বয়সী আর সবাইকে অনায়াসেই পেছনে ফেলে দেয় ইশানা৷ নাচে পাভলোভা, গানে তানসেনের সুর, আবৃত্তিতে সাফোর ঝংকার৷ সব মিলিয়ে, অয়নের মতে পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্যতম নারীটি হচ্ছে ইশানা৷

অয়নের এই ঘুরঘুর প্রবণতা মাত্র কয়েক সপ্তাহের ঘটনা৷ তবে গত দুদিন ধরে তার মাথায় যে ধরনের ভয়ানক চিন্তাভাবনা বীজ থেকে বৃক্ষ হয়েছে, তাতে করে আজকেই আর কিছু সময়ের মধ্যেই এ  ঘটনা ‘ইতিহাস’ এ রূপ নেয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে৷

পথের দিকে চেয়ে চেয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা দুঃসাহসিক এবং দারুণ অপ্রত্যাশিত প্রকৃতিবিরুদ্ধ ভাবনাগুলোকে শান দিতে দিতেই পুরো মহাবিশ্ব এলোমেলো করে দিয়ে ইশানার আগমন! সাথে সাথে কেঁপে উঠলো অয়নের চোখ-ঠোঁট, শিহরণ খেলে গেল সমস্ত শরীরে! অসহনীয় উত্তেজনা! ইশানাকে দেখার উত্তেজনা, না-কি স্বভাববিরুদ্ধ অপ্রিয় কিছু ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনার উত্তেজনা?

৩.

প্রতিবার ইশানা সামনে দিয়ে চলে যাবার পর অয়নের খুব খারাপ লাগে, আফসোস হয়৷ আফসোস এ কারণে যে সে কখনোই ইশানার দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারে না; এক অসংজ্ঞায়িত সংকোচ মনের ভেতর কাজ করে সব সময়৷ কিন্তু ইশানা চলে যাবার পরমুহূর্তে তার মনে হয় সে অনেক বড় একটা কিছু মিস করে ফেলেছে; মনে হয়, যদি পরবর্তী সাক্ষাতের আগেই তার মৃত্যু হয়? ইশানাকে মন ভরে দেখার আগেই সে মরে যাবে? বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না, মাথার মধ্যে তুমুল গতিতে চিন্তাগুলো ঘোরপাক খেতে থাকে, যন্ত্রণা আরম্ভ হয়ে যায়!

তবে, আজ আফসোসের জায়গাটা সে আর রাখবে না৷ আজ প্রাণ খুলে ইশানাকে দেখবে, প্রচণ্ড নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকবে— ইশানার চোখের দিকে, নাকের দিকে, ঠোঁটের দিকে৷ আজ সে নিজে কিছুটা এগিয়ে যাবে, ইশানাকেও কিছুটা এগিয়ে আসতে প্ররোচিত করবে; সম্ভব হলে এক মুহূর্ত ছুঁয়ে দেবে ইশানার হাত! এতে যদি সে কিছু রাগ করে তো করুক, যদি উত্তেজিত হয়ে ওঠে তো উঠুক; আজ কোনো কিছুর পরোয়া নয়৷ আজ একটিই মন্ত্র সে জপে চলেছে সারাদিন—

ঘৃণা-লজ্জা-ভয় যাহার আছে, তাহার কভু প্রেম নাহি হয়!

ইশানা যদিও নিজেকে বোকাসোকা হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যেহেতু সে মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সে তার আশপাশে অয়নের অবস্থানের ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই লক্ষ করছে৷ এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তার বন্ধুরাও ব্যাপারটি সম্পর্কে জানতে পেরে গেছে, সেখানে সংবাদবাহক হিসেবে কাজ করেছে ইশানা নিজেই৷ সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সে বেশ উপভোগ করছে! উপভোগ করলেও অয়নের বিষয়ে তার অবস্থানটা আসলে কী সেটা ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না৷

অয়ন বসে আছে মাঠের এক কোণে ঘাসের উপর স্যান্ডেল পেতে৷ অদূরেই ইশানা তার বন্ধুবান্ধবসহ; আকাশ-পাতাল দুলিয়ে আড্ডা-হাসাহাসি৷ এই সেই হাসি, যে হাসি কানে এলেই বুকের মধ্যে প্রচণ্ড গতিতে শ্বাসপ্রশ্বাস ওঠানামা করে, এক সময় মনে হয় হৃদপিণ্ডটা বুকের খাঁচা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসবে৷ আপাতত অয়ন বুকের উপর তার নিজের হাতটা চেপে ধরে হৃদপিণ্ডটাকে সামলে নিলো; কিছুক্ষণের মধ্যেই যেটা ঘটবে, সেটা ভেবে তার বুকের ভেতরে ধুকপুকটা পুনরায় বৃদ্ধি পেতে থাকলো— ভালোবাসলেই বুকের ভেতর ধুকপুক করে মন৷

চারটা বেজে পঁয়তাল্লিশ৷ আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না; ইশানা বের হয়ে যাবে, একবার তাকে চলে যেতে দিলে আবারো এক সপ্তাহের প্রতীক্ষা; না, প্রতীক্ষা নয়, অপেক্ষা৷ সে উঠে দাঁড়ালো; দু-পা এগিয়েই কী মনে হলো তিন পা পিছিয়ে এলো৷ হাতঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে হৃদস্পন্দন! এ কী, এই বিকেল বেলা খোলা আকাশের নিচে হাতঘড়িটার টিক টিক শব্দও স্পষ্ট তার কানে আসছে; কয়েক মুহূর্ত চোখ দুটো বন্ধ করলো, মনটাকে কিছুটা স্থির করে নেয়া প্রয়োজন৷ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ খুলেই— সে কী, চারিদিকে এত অন্ধকার কেন! সে তো দাঁড়িয়ে ছিলো কলেজ-মাঠের এক কোণে, এখানে তার নিজের ঘরে নিজের বিছানায় কীভাবে এলো! কিছুই মাথায় ঢুকছে না, দম বন্ধ লাগছে; বিকেলে কলেজ-মাঠে কী ঘটেছিল— সেটা ভাবতে ভাবতে অয়ন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল৷ আপাতত তাকে ঘুমোতে হবে৷

গত মধ্যরাতে অয়ন জানতে পেরেছে যে, বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশের দিকে তিনটা ছেলে তাঁকে অর্ধচেতন অবস্থায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে৷ এ কথা শুনে লজ্জায়-অপমানবোধে সে প্রায় মাটির সাথে মিশে যায়; ভাবে, ইশানা ব্যাপারটা দেখে ফেলেনি তো? যদি ইশানা পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে থাকে, তাহলে কী লজ্জাতেই না তাকে পড়তে হবে! এই ভেবে ভেবে এপাশ-ওপাশ করেই বাকি রাতটা কেটে গেছে৷

আগে তো শুধু ইশানাকে দেখলে বুকের মধ্যে ঢুপঢাপ শুরু হয়ে যেত; ইদানিং যেটা হয়েছে, তাকে ভাবলে বা চোখের কোণে তার ছবিটা কোনোভাবে ভেসে উঠলেও বুকের ভেতর বৃষ্টিফোঁটার মতোন কামানগোলা বর্ষিত হয় তুমুল গতিতে৷ এ কথা শোনার পর অয়নের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি তাকে বলেছে, “ওসব প্রেম-ট্রেম কিছু না, তুই কোনো ভালো হার্ট স্পেশালিস্টের সাথে কনসাল্ট কর; আমার বিশ্বাস তোর হার্টের সমস্যা আছে৷” এতটা কঠিন রসিকতা শুনেও অয়নের কিছুমাত্রও খারাপ লাগেনি; লাগেনি, কারণ কথা সত্য৷ হার্টের সমস্যাই তো, নির্ঘাত হার্টের রোগ; রোগের নাম ইশানা! চিকিৎসা প্রয়োজন; অতিদ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, হার্টের রোগটাকে হার্টের শক্তিতে পরিণত করে তুলতে হবে৷ কিন্তু তার জন্য নিশ্চয়ই আরো একটা সপ্তাহ অপেক্ষা করা চলবে না৷ যে কোনোভাবেই হোক, বুধবারে ইশানাকে হাজির করতেই হবে— এই কলেজ-মাঠেই, এই পরিচিত ঘাসের উপরে দাঁড়িয়েই, পুকুরপাড়ের বকুল গাছটিকে হতবাক করে দিয়ে সে অসাধ্য সাধন করে ফেলবে৷

৪.

পরদিন, অর্থাৎ বুধবার; ঠিক সাড়ে তিনটায় ইশানার রিকশা এসে থামলো কলেজের মূল ফটকের সামনে৷ বুধবারে ইশানার কলেজে আসাটা কীভাবে সম্ভব করা হলো, সে ঘটনা আমরা যথাসময়ে জানতে পারবো৷ প্রতিবারের মতো এবারেও দূর থেকে অয়ন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে নিল ইশানার খোলা চুলের ওড়াউড়ি৷ যে সিদ্ধান্তটি সে নিয়েছে, সেটি অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত— সন্দেহ নেই; কারণ কাজটি করার পরে মাঝামাঝি অবস্থানের আর কোনো সুযোগ থাকবে না, হয় সারাজীবনের জন্য সে ইশানার হাত দুটো ধরে রাখার অধিকার লাভ করবে, অথবা সব হারিয়ে কাঙাল হবে৷ তবু, ডুবে-ভেসে খাবি খাওয়ার চাইতে এটা ঢের ভালো; যেটাই ঘটুক, অন্তত কোনো দ্বিধা নিয়ে তো বাঁচতে হবে না৷

ইশানা গেইটের ভেতরে ঢোকামাত্রই অয়ন এগোতে শুরু করলো; উত্তেজনায় তার পা কাঁপছে ঝড়ের কবলে পড়া গাছপাতার কম্পনগতির চাইতেও অধিক গতিতে, মনে হচ্ছে কেউ যেন মাটির দিকে তার পা দুটো টেনে ধরতে চেষ্টা করছে৷ তবু সে থামলো না, এক মুহূর্তের জন্যও না; একদিন আগেই ঘটে যাওয়া ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সে চায় না৷

অয়ন এই মুহূর্তে ইশানার সামনে, মাত্র দশ-বারো ফুটের দূরত্বে৷ ইশানার চোখের মণিতে অয়নের চোখের ছবি ভেসে উঠেছে৷ চোখে চোখে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্রই ইশানা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে৷ অয়ন এগোতে থাকে; তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে, পৃথিবীর সমস্ত আওয়াজ ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে, গাছের পাতাগুলো সব একে একে স্থিরমূর্তি হয়ে যাচ্ছে! ইশানার সামনে এক হাত জায়গার ব্যবধানে দাঁড়িয়ে দুবার ঢোক গিলে ফেললো অয়ন, শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেও ঠোঁট দুটোকে সে আলাদা করতে পারছে না৷

খাতার এ পর্যন্ত এসে লেখাটি শেষ হয়ে গেছে৷ বড্ড অস্থির লাগছে শিহাবের; দ্রুতগতিতে সে খাতার সাদা পৃষ্ঠাগুলো একের পর এক উল্টাতে থাকলো৷ লেখকের নাম খাতার উপরেই পাওয়া গেছে— সাবাব ওয়াদুদ৷

খাতাটি সে পেয়েছে পুরাতন খবরের কাগজ বিক্রি করার সময়, কাগজওয়ালার চটের বস্তার ভেতর থেকে৷ খাতাটি বেশ পুরোনো, পৃষ্ঠাগুলো জীর্ণপ্রায়৷ লাল মলাটে বাঁধানো খাতাটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে শিহাব একেবারে শেষের পৃষ্ঠায় গিয়ে থামলো৷ সেখানে লেখা কয়েকটি বাক্যে তার দৃষ্টি আটকে গেল—

“মঙ্গলবার, রাত ১১টা বেজে ৯ মিনিট৷৷

ঐশীকে সাধারণত সোমবারগুলোতেই কলেজে পাওয়া যায়৷ গ্রুপ স্টাডির বাহানায় বন্ধুদের সাথে কিছুটা হ্যাংআউট হয়ে যায় তার৷ ভার্সিটিতে আসা-যাওয়ার বাইরে কেবল এই একটা দিনেই ঐশী বাসা থেকে বেরোয়৷ তার বাড়ির পেছন থেকে অনেক কসরত করে সজোরে দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে তাকে দেখতে হয় রোজ; বাড়ির সুবিশাল ছাদে aখোলা হাওয়ায় গাছপালার আদর শরীরে মেখে প্রায় বিকেলেই সে হাঁটাহাঁটি করে, আকাশে পাখির ওড়াউড়ি দেখে৷ সব মিলিয়ে, সোমবারের বিকেলটা ছাড়া অন্য দিন অন্য সময়ে তাকে কাছ থেকে দেখতে পাওয়ার সুযোগ পাই না ৷ অনেক কষ্টে ঐশীর হাতে একটি চিঠি পৌঁছানো গেছে আজ৷ চিঠিটা পড়ে সে সত্যিই কাল কলেজে আসবে কি না জানি না; যদি আসে, তাহলে কাল রাতেই গল্পের শেষটা লেখা হবে!”

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..