পাগল
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
সোমা আমার বন্ধু প্লাস কলিগ। আমাদের বিয়ে হয় মোটামুটি একই বছরে। চাকুরীতেও ঢুকি এক সাথে।সোমা বিয়ের পরপরই দুই টা সন্তান নিয়ে নিয়েছে । তার দুইটোই ছেলে । আমি ভেবে অবাক হতাম সবে মাত্র চাকুরীতে ঢুকেছে এরই মধ্যে দুইটা সন্তান। সে কি করে সংসার চাকরী সামল দেবে ! ? আমি তখন একটা মেয়ে নিয়েই হিমশিম খাচ্ছিলাম । মনে মনে বর কে গালমন্দ করতাম , আরে ?বাবা বিয়ে যখন হয়েছে বাচ্চাকাচচা ও নিশ্চই হবে। এত তাড়া কিসের। না সবাই মিলে জোর জবরদস্তি বাচ্চা ধরিয়ে দিল।সোমাকে দেখে রাগ হত । বলতাম তুই? কি পাগল হয়ে গেলি? আমরা না বড় জব করব। অনেক বড় পজিশনে যাবো? দুই বন্ধু মিলে দেশ বিদেশ ঘুরব? এসব কি শুরু করলি ? সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে উল্টা পরামর্শ দিয়ে বলত আমার আম্মার শরীরে শক্তি থাক?তে থাকতেই আমি যেন যে আরো কয়টা বাচ্ছা নিয়ে নেই । আমার আম্মা কোলেপিঠে করে বড় করে ফেলবেন। আমার কোন ঝামেলা হবে না।
আজ আমার বন্ধুর জীবনের কথা বলব। তাই একটু শুরু থেকে বলছি। আমি সোমা দুজনেই ব্যাংক কেবল জয়েন করেছি । সোমার ছেলেদের তার শাশুড়ি দেখে রাখেন , আর আমার টা কে আমার আম্মা। স্বামী সন্তান সংসার এইসবে আমাদের দুজনের কারুরই নজর নেই। দুজনেই প্রচণ্ড কাজ পাগল। বাঙ্কের চাকরী সকাল নয়টায় ঢুকি রাত নয় টা বের হই ।একটা শেষ করে আরেকটা কাজ শেখার জন্য সিনিয়র দের পিছে লেগে থাকতাম। সবসময় হাসি মুখে ভাব নিতাম । ভাবখানা এমন ছিল , স্যার রাত যতই হোক কোন সমস্যা নাই ।মা আছেন ,আমি কাজ শেষ করেই বের হবো । এই ভাবেই আমি সোমা রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত কাজ করি । ইচ্ছা একটাই ঘরের সমস্যা দেখালে যদি বস বেজার হন ! আইবিএ থেকে এমবিএ পাশ করা কম বয়সী ছেলেরা তখন ব্যাঙ্কে জয়েন করছে । আমাদের ঘর সংসারের প্যানপ্যানানি সেখানে বড্ড বেমানান । আর ভয় ছিল কাজ করতে এসে ঘর সংসারের ঝামেলা শুনে ভালো পোস্ট হাত ছাড়া হবার । এমনিতেই চাকরি বাজারে মেয়েদের নামে হাজারো ইস্যু । কোন ইম্পরট্যান্ট পোস্ট খালি হলেই সেসব ছেলে কলিগরা সহজেই পেয়ে যায়। কাজেই কোনও ভাবেই ঘরের কথা অফিসে আনা যাবে না । সেই ভাবেই কাজ করেছি ।
ঘরে ছোট দুধের বাচ্চারেখে বুকের দুধ খাওনো নিয়ে আমাদের সে কি সমস্যা ! মনে পড়লে এখনো চোখে পানি চলে আসে।আমি বলছি ১৯৯৭ সালের কথা । তখন সবে সাউথইস্ট ব্যাংক চট্রগ্রাম এ চালু হয়েছে । সোমা বুদ্ধি দিলো বুকের ভিতরে তোয়ালে দিয়া রাখতে তাহলে বুকের দুধ ঝরতে থাকলেও মানুষ ভিজা জামা দেখতে পাবে না । তাই করতাম বাচ্চার কাঁথা ব্লউজের ভিতরে ঢুকিয়ে অফিসে কাজ করতে থাকলাম । আমি জানি নতুন মায়েদের এই বুকের দুধ ঝরার গল্প আমার মতো অনেক মায়েদের । তা নিয়ে সিনিয়র জুনিওর পুরুষ কলিগদের কত হাসি ঠাট্টা শুনতে হত ! সেসব নিয়ে অন্য কোন সময় লিখব।
এসব কেন বলছি ? একটু সময় ও ধৈর্য দিয়ে পুরা লিখাটা না পড়লে অজানা থাকবে আমাদের প্রভাস জীবনের অনেক অজানা কথা । ছদ্বনাম ব্যবহার করেছি। ভাবছি আমি আজ কোন কিছুই লোকাবো না । লুকালে সমাজের কাছে দায় থেকে যাবে । যে সন্তান কে আমরা এত কষ্ট করে বড় করেছি বিশ্বের উন্নত দেশে এসে সেই সন্তানেরা বেশিরভাগই আর আমাদের থাকছে না । না ভাববেন না সকলেই নেশা করে ঘর ছাড়ে । এর বাইরেও কিছু প্রাকিতিক কারনে বর্তমান বাঙালী পরিবারগুলো তাদের সন্তান হারিয়ে ফেলছেন । সোমার বড় ছেলে সিয়াম সমকামি । আসুন বিস্তারিত সোমার ছেলে সিয়ামের ঘর ছাড়ার কারন জানি।
জুন মাস কে সারা বিশ্ব প্রাইড মাস বলে মেনে আসছে ১৯৯৯ সাল থেকে । আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন জুন মাস টি লেসবিয়ান, সমকামী, উভকামী, ট্রানসজেনডার ,
রূপান্তরকামী, কুইর, ইন্টারসেক্স এবং বিভিন্ন যৌনতা এবং অন্যান্য লিঙ্গের ব্যক্তিদের (এলজিবিটিকিউ+) দ্বারা সমাজে অবদানকে সম্মান জানাতে জুন মাস কে প্রাইড মাস হিসাবে স্বীকৃত দেয়া হয়।
সমকামিতা যার ইংরেজী প্ৰতিশব্দ Homosexuality গ্ৰীক শব্দ ‘Homo’ । বাতিক্রমি যৌন চাহিদা সম্পন্ন মানুষ সব সমাজে সব সময় ছিল । ভবিষ্যৎ তে ও এর ব্যতিক্ৰম হবে না । তবে আধুনিক বিশ্বে এখন সব কিছু খুব বেশী পরিমানে ওপেন বলে আমরা এদের কে এখন সহজেই দেখতে পাই । তারা ও অনেক টা ওপেনলিই চলাফেরা করেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশিরাও এখন খোলাখুলিভাবেই নিজ লিঙ্গের মানুষকে যৌনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছে।বর্তমান সময়ে আপনি ভাবতে পারেন ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। কিন্তু বিষয়টা কি এত সহজ? না একদমই সহজ না । এই একটি কারনে সোমার জীবন পাল্টে গিয়েছে ।তার দুঃখের ছটা আমার ভেতরেও ছুঁয়ে গিয়েছে ।
সোমা এই দেশে এসে কেপিটেল ওয়ান ব্যংকে কাজ নিয়েছে। ধিরে ধিরে বড় হতে থাকলে ছেলের মধ্যে আচরণ গত পরিবর্তন দেখা দেয়।আর তখন থেকেই সোমার কাজে মনোযোগ কমে যায় । যে মেয়ে রাত দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে ব্যাংকের কাজ শিখেছে সেই কিনা এদেশে এসে কাজে অমনোযোগী হয়ে উঠল।অফিসে একের পর এক ভুল করতে থাকল। এক সময় তাকে ডিপরেশন এর রোগি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ফায়ার করা হয়।
অবাক লাগে এই জব চলে যাওয়ায় পর সে মোটেও দুঃখিত বোধ করে না । আমার কাজ পাগল স্মার্ট বন্ধু এখন শুধু ছেলে কে কাছে চায়।তবে সিয়াম যখন কাছে ছিলো ঘরে থাকত সেই দিন গুলিতে স্বামী স্ত্রী মিলে ছেলের সাথে অনেক অন্যায় করেছে।তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে যা আমি ছেলের মুখে শুনেছি।
এখানে বলে রাখি আমি আমেরিকায় আসবার আগেই সোমা তার স্বামী দুই ছেলে কে নিয়ে এদেশে পাড়i দেয় । সে তার দুই ছেলে নিয়ে ব্রুকলিনে বাসা নিয়ে উটেছে ।এখনো সেখানেই থাকছে । ছেলে দুটা মিডল স্কুলে উঠতেই বড় ছেলেটার আচরণ গত সমস্যা তার নজরে আসে । সে দেখতে সুন্দর শ্যমলা । সব সময়ই হাসি মুখে থাকা ছেলে টা দিন দিন কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যেতে থাকল । কোনও কারন ছাড়াই বড় ছেলে সিয়াম ছোট ভাই কিম্বা পরিচিত বন্ধু বান্ধব সবার ছেলে বাচ্চাদের একারনেই জড়িয়ে ধরতে যায়। কখনো চুমু খেতে দেখা যায়।সিয়ামে অন্য ছেলে বাচ্চার প্রতি অতিরিক্ত মাখামাখি তার চোখে পরে। বাসায় ছেলে নিয়ে কোন মেহমান আসালে তাকে যেতে দিতে চাইত না। মেহমান চলে গেলে মনমরা হয়ে বসে থাকে।সোমার দেখতে ভালো লাগে না। ছেলে যখন সেভেন গ্রেডে একদিন ক্লাস টিচার ডেকে নিয়ে এমন কিছু কথা বলছে যা শুনে সোমা আর তার স্বামীর খুবই মন খারাপ হয়েছে। দুজনেই ভিষন রকম অপমান বোধ নিয়ে ছেলে কে ডাক্তার দেখাতে শুরু করে। ডাক্তার শিউর হয়ে কিছু বলে না । শুরুতে বলেছে পিঠাপিটি দুই ভাই বলে হয়ত তার ছেলেদের প্রতি টান টা বেশি। এখনো তাকে তেমন করে গে বা সমকামী ভাববার সময় আসে নি।তারপরও সোমার বর ছোটো ছেলে কে বড় টার কাছ থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করেছে । এতে বড় ছেলে আরও বেশী মন খারাপ করে পডশুনা বন্ধ করে দেয়। মা বাবার বাড়াবাড়ি কারনে ছোটো ছেলে বড় ভাই কে ভাইকে ভয় পেতে শুরও করে । দুই ভাইয়ের স্বাভাবিক মেলামেশার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় ।
সোমা আর তার বর সিয়াম কে কড়া শাসন আর নিয়ম কানুনে ফেলে অনেকটাই ঘরবন্দি করে রাখে। আর এভাবেই তাদের ঘরের সুস্হ স্বাভাবিক সম্পর্ক একে একে নষ্ট হতে শুরু করে ।এরপর একদিন সেই মহেন্দ্রখন এসেই যায়।সোমার বড় ছেলে সিয়াম নিজেকে সমকামী বলে মা বাবা কে পরিস্কার জানিয়ে দিল ।শুধু জানান দিয়েই শেষ হয়নি ,হাইস্কুল শেষ হতেই সিয়াম পারিবারিক সকল অনুশাসনের নিয়ম ভংগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ঘর থেকে বের হয়েই থেমে থাকে নাই সিয়াম তাদের এলজিবিটি গ্রুপের সাথে মিশে গিয়েছে ।সে আর পরিবার জানাশুনা এমন কি পরিচিত দের সাথে দেখা করে না । আমাদের সিয়াম এখন তার নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত । সিয়াম জানে এশিয়ান পরিবার তার মত সন্তানদের অনেক কষ্ট দেয় । সে তার মত ছেলে মেয়েদের পরিবার থেকে বের করে আনতে কাজ শুরু করেছে । বিশেষ করে বাংলাদেশী সমকামী সন্তান দের পরিবারের সাথে মানিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হয় ।সিয়াম তাদের কে সাহায্য করতে গে অ্যাপ খুলেছে যার নাম “say gay “
মানুষের জীবনের বাঁকে বাঁকে রঙ বদল হয় । কারো বেশী কারো কম । আজ মধ্য বয়সে দ্বার প্রান্তে আমারা দু বন্ধু ।ক্যারিয়ার ফ্যাশান স্মার্টনেস সবই শেষ। সন্তানদের নিয়েই এখন আমাদের সুখ, দুঃখও তাদের কে ঘিরে । এদেশের বেস্ত জীবনের গেঁড়াকলে পরে এক শহরে থেকে ও জরুরী পরয়োজন ছাডা আমাদের মাঝে তেমন একটা কথাবারতা হয় না । আমি মাঝে সাজে টেক্সট দেই সোমা যখন মন চায় উত্তর দেয় , লিখে ভালো আছি । ছোট্ট জবাব দেয়া মানে হল আর বেশী কিছু জানতে না চাওয়া । আমি কোনোদিন নিজ থেকে কথা বাড়াই না ।
এই কথা না বলা সোমা একদিন কল করে তার বাসায় জরুরী তলব করে । জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে সন্তানের সব কথা শেয়ার করে। তার বর আর ছোট ছেলেটার চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। তাদের তিনজনকেই জড়িয়ে ধরি।এ কি শুনলাম ! তাদের কান্নার পার্টনার হওয়া ছাডা আমিই বা কি করতে পারি।
সমকামিতা এমন
কাহিনী বইপত্রে নাটক সিনামায় অনেক শুনেছি । এই দেশে অহরহ এমন যুগল দেখা যায় । কখনই তাদের দিকে ভালো করে তাকাই না । সোমার ছেলের কথা শুনার পর থেকে আমার প্রচণ্ড মন খারাপ । গে হয়েছে তো কি হয়েছে বাসা থেকে চলে যাবে কেন !? সোমা চায় আমি যেন বুজিয়ে শুনিয়ে তার ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনি । তার বিশ্বাস আমি তা পারব ? সেদিন তাদের কষটের চেহেরা দেখে আমার মনে হয়েছে এটা তেমন ব্যপার না। আশবাস দিলাম
ছেলে কে ঘরে ফিরিয়ে আনতে সব রকম চেষ্টা চালাবো । তার কদিন পর
আমি সিয়াম কে কল দেই এবং সিয়াম ফোন ধরে । আমার মনে সাহস পাই ।
-হ্যালো অ্যান্টি । মা বলেছে তুমি কল দিতে পারো ।
-আব্বু আমাকে চিনতে পারার জন্য ধন্যবাদ । কেমন আছো ?
-খুব ভালো আছি । মা বলেছে তুমি নাকি আমার সাথে দেখা করতে চাও?
-কথা বলতে চাই ,দেখা করতে চাই ।
তোমার মা খুব হয়ে গিয়েছে । তার জব চলে গেছে ।
-আমি জানি ।তুমি কখন আসতে চাও?
-তুমি যখন সময় দিবে তখনই আসব।চলো একদিন তোমার মা বাবা সহ কোথাও খেতে যাই ।
সে সোজা উত্তর দিয়ে বলে ওদের কারো সাথে দেখা করবে না ।সে আমার সাথে দেখা করবে তবে শর্ত হল তার মা বাবা কেউ আমার সাথে থাকতে পারবে না । আমি আর কথা বাড়ালাম না ।
-আববু তাহলে কোথায় দেখা করতে আসব ?কিছুটা অবাধ্য হয়ে জানতে চাইলাম তোমার মা কে নিয়ে আসি ? প্লিজ । আবারো জানিয়ে দিলো মা থাকলে সে আমার সাথে ও দেখা করবে না।
-ঠিক আছে আমি একাই আসব।
-আমাদের একটা প্যারেড আছে তুমি সেখানে আসো । সেখানে আমার মত আরো অনেক কে দেখতে পাবে। তারপর মা কে তুমি সব বুঝায়ে বলবে।
আমাদের মাঝে কথা হচ্ছিলো বাংলা ইংরেজির মিশেল ।
-আচ্ছা ঠিক আছে । তবে প্যারেডে কেন ? ! কোথায় হবে? এদেশে বেডে উঠা সন্তান বেশি প্রশ্ন করা পছন্দ করে না।তবুও এক সাথে অনেক কিছু জানার আগ্রহ তৈরী হয়ে গেল। কিছুটা কৌশলি কথা বলা শুরু করি।
-আন্টি আমাদের প্যারেড । অনেক জায়গায় হয় ।তুমি যেহেতু পথ চেনো না , অন্য জায়গায় হারিয়ে যাবে তুমি বরং জ্যকসন হাইটের প্যারেড এ আসো ।
-আমাদের প্যারেডে মানে কি?
-আন্টি প্রাইড প্যারেড ।
কথার মাঝে অল্প সময়ের ভুলে গেছিলাম সিয়াম গে ।সিয়াম মনে রেখেছে আমি তেমন একটা পথ ঘাট চিনি না । কথা বলছে অনেক নরম গলায় । আমার মন ভালো হয়ে গেল।কথা দিলাম আমাদের প্রাইড প্যারেড দেখা হবে।
সোমা কে জানালাম তুই গেলে সিয়াম দেখা করবে না । সে মন খারাপ করলেও আমাকে যেতে অনুরোধ করল। এই প্রথম আমি কোন LGBT প্যারেডে যাচ্ছি সেই উত্তেজেনায় বলা যায় সারা রাত নির্ঘুম কাটালাম ।আগে দূর থেকে দেখেছি । কখনো কাছে ভিড়ি নাই । এখানে বলে রাখি নিজেকে যতই উদারমনা ভাবি না কেন সমকামী দের এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারি না । তাদের দেখলে চোখ সরিয়ে ফেলি । যাই হোক যথা সময়ে চলে গেলাম প্যারেড সাইডে । রেইনবো রঙ্গা নানা বয়সী মানুষ জড়ো হয়েছে । বয়স্ক মানুষের চেয়ে তরুণদের প্রাধান্য বেশি। শহরের সবাই জানে জুন মাস কে LGBT মাস বলে । সিটি থেকে প্রাইড প্যারেডের কিছু নির্দিষ্ট রোড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।সাধারণ মানুষের অনেকেই কিছুটা সাবধানে তাদের প্যারেড এডিয়ে চলতে লক্ষ করি । আবার অনেকেই দাঁড়িয়ে তামশা দেখার মত করে ভিডিও করছেন । জুন মাস জুড়েই তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে থাকে। রঙধনু রঙের ব্যনার ,ফেস্টুন ,বেলুন ,ছাতা ,টি শার্ট , কাঁধের ঝুলানো ব্যগ,কফি মগ সবই বিশেষ রঙের। হাই বলিউম মিউজিক বাজিয়ে তারা পথে পথে হাঁটছে । গে লেসবিয়ান কাপলরা নানা ঢঙে সবার সাথে ছবির পোজ দিতে দেখা যায় । প্যারেডে যারা অংশ নিয়েছে তাদের সবারই সব কিছুতেই কেমন যেন উদ্যত আচরণ । অনেকটা যেন জোরপূর্বক অধিকার আদায়ের চেষ্টা । দুনিয়াকে পাত্তা না দেয়ার ভাব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।আমার কাছে এসব বাড়াবারি মনে হলেও তাদের জন্য সবই স্বাভাবিক । তাদের পোষা কুকুর বিড়ালের গায়ে ও রঙধনু সাজ।সেখানে নানা বয়সি মানুষ তবে সংখ্যায় তরুন প্রজন্মই বেশি নজরে পরে।এদের হাতে রঙধনু রঙ না থাকলে সহজে আলাদা করা যায় না।কারন ওরা কোন জন্তু জানোয়ার না ওরা আমাদেরই সন্তান ।
ভীড ঠেলে দৌডে এসে একজন আন্টি বলে জড়িয়ে ধরল ।সাথে শ্যমলা রঙা টকবগে উটতি বয়সি আরেকটি তরুন নাম মেরিট। হাসিখুশি প্রানবন্ত সিয়ামের বয়স এখন ঊনিশ ।আমাকে মেরিট কে তার ফিঁয়াসে বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বাঁধ না মানা বয়সি দুজন উটতি বয়সি ছেলে আমার দুই পাশে দুই হাত ধরে আছে।আমরা পেরেডে হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছি। মেরিট বাংলা না বুঝায় সিয়ামের সাথে কথা বলতে বেশ সুবিধাই হয়েছে ।
-বাসা ছেডে চলে এলে কেন?
-মা বাবা খুব মানষিক কষ্ট দেয়।ওরা দুজনেই শিক্ষিত হয়েও আমাকে বার বার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।তারা চায় আমি যেন বদলে যাই। কিন্ত আমি জানি না কেমন করে বদলে যেতে হয়।ঘরে ভীষন একা লাগে তাই বের হয়ে গিয়েছি।
-কলেজে পড়তে হবে না !? যদি পড়াশুনা না করো তাহলে একা একা থাকবে কেমন করে , খাবেই বা কি ?
-আমি আর একা নই আন্টি ।আমার পার্টনার আছে ,ক্লাব আছে । আমার পার্টনার জব করে । আমরা বিয়ে করব ।আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি ।
-এই যে এত মানুষ এরা সবাই তোমার মত? আমি আর কি বলব কথা খুঁজে পাই না ।
-এদের সন্ধান কিভাবে পেলে?
হাই স্কুল জীবন শুরুর পর ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন LGBT কমিউনিটির সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়৷ এদের বাইরে অন্য কাউকে সে বিষয়টি জানানোর কথা ভাবতে পারে না ।সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে এমন কি বাবা মা’র ভয়েও মন মরা থাকতে থাকতে একদিন চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।সে দীর্ঘদিনের পরিচিত একজনকে বিষয় টি জানিয়েছিল পরে সেই ব্যক্তি তাঁকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কষ্ট দেয়।তাই ইন্টারনেটে সে তার পার্টনার খুঁজে নিয়ে এদের সংগটনে যোগ দেয়।
সিয়াম আমাকে প্যারেডে বেশি দুর হাঁটতে দেয় না । এর মাঝে সে তার অন্য বন্ধু দের সাথে আমাকে তার আন্টি বলে পরিচয় করিয়ে দেয় ।প্যরেড শেষে পরিস্কার বাংলা ভাষায় সে জানিয়ে দেয় আর কোনদিন বাসায় ফিরবে না। সোমার আনান আজ সত্যি বড় হয়ে গিয়েছে । সোমার জন্য আমার কান্না পায়।
সেদিন পেরেডে রাইসা (ছদ্মনাম )নামে আরেকজন বাংলাদেশি মেয়ের সাথে পরিচয় হয় ।সে ও বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে ।তাদের বলেছি তুমি ও সিয়ামের সাথে আরেকদিন দেখা করতে চাই , কথা বলতে চাই ।তোমাদের কথা পত্রিকায় লিখতে চাই যাতে আমাদের কমিউনিটির পরিবারগুলো তোমাদের প্রতি সদয় হয় ।সমকামিতার কারনে সিয়ামের মত অন্যদের যেন ঘর ছাডা হতে না হয় তার জন্য আমি তোমাদের সাথে কাজ করতে চাই
তারা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল তারপর আমাকে এস্টোরিয়ার একটি গে ক্লাবের ঠিকানা ধরিয়ে দিল। বিকাল পাঁচটার পর তারা সেখানে থাকবে।
তাদের দেয়া সময় মত ২৯-১২ ২৩ এভিনিউ এস্টোরিয়ায় চলে আসি । এটি একটি সমকামি বার কাম রেস্টুরেন্ট । ঢুকেই পরিবেশ দেখে আপনি খুব সহজেই বুঝে ফেলবেন এখানের আগত অথিতি রা দেখতে আপনার মত হলেও এদের জীবন জগত ভিন্ন ।যেমনই হোক আমি আজ ওদের সাথে কথা বলতে এসেছি।আগে কখনো দেখিনি বলে আমার অবাক হওয়া ব্যপার টা নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখি।সিয়ামের আরো বন্ধুরা এসে আমার সাথে দেখা করে ।তাদের কথা শুনতে এসেছি বলায় সবাই আমাকে ধন্যবাদ ও কৃতঙতা জানায়।আক্ষেপ করে তাদের সম্পর্কে জানার পর সাধারন মানুষ তাদের সাথে মিশতে চায় না। তাই তারা সারা দুনিয়ায় তাদের আলাদা জগত গড়ে তুলতে চায়।
ওদের সাথে কথা বলে যতটুকু জেনেছি তাদের এক একজনের গল্প আলাদা হলেও মূল বিষয়টা একই ।তাদের ভাষ্য হল কৈশোরে সমবয়সীরা যখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, আমরা তখন সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হই, বিষয়টি নিয়ে পরিবার ও নিজের মধ্যেই এক ধরনের হীনন্মন্যতা তৈরি করে৷ এরপর শুরু হয় পারিবারিক চাপ৷এই কারণে অনেকেই পরিবার ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে ।
সিয়াম ও তার বন্ধুরা বলে , যখন মনে হলো আর সহ্য করতে পারছি না, তখন আলাদা হয়ে যাই৷ রাইসা বলে বাঙালী সমাজে মেয়েদের সমস্যা এমনিতেই বেশি, লেসবিয়ান হলে তো কথাই নেই ।আরো বেশি যন্ত্রনা ভুগতে হয়৷ তাঁদের কর্মশালায় যোগ দেয়া এক নারী সমকামীর সন্তান ও রয়েছে৷ তিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন সংসার ত্যাগ করে কোনো নারীর হাত ধরে চলে যাবেন৷ সে লেসবিয়ান জেনেও পরিবার থেকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে৷ যার কারনে তার মত অনেকেই প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বলে জানায় । মাঝে মাঝে লুকিয়ে সে এই ক্লাবে আসে। এখানে আসলে তার বান্ধবীর সাথে দেখা হয় দুজনে চুটিয়ে প্রেম করে ভরপুর আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরে যায় স্বামী সংসার করতে।
উদ্দেশ্য যেহেতু সিয়ামের সাথে কথা বলা তাই তাকে নিয়ে আলাদা হয়ে পাশাপাশি বসি ।সিয়াম ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে বলতে থাকে।সে যখন বুঝতে শুরু করে তখন লুকিয়ে অনেক কাঁদত আর ভাবত , আমি এমন কেন ? আমার ছেলেদের কেন ভালো লাগে? বড় হওয়ার পর নেট ঘেটে বুঝলাম যে, শুধু আমি না, আমার মতো আরো অনেকেই আছে এই বিশ্বে৷তখন থেকে মনে সাহস আসতে শুরু করে।আর তখন থেকেই মা বাবার অত্যাচার ও সমানে বাড়তে থাকে ।
সিয়ামের মত রাইসা ও বলে সমকামী হওয়ার কারণে অনেক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় তার মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেয়াটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ সে বলে আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে আমি বোঝাতে পারি না যে, আমি আর আট-দশটা মানুষের মতো না৷ আমি মেয়ে হলেও নিজেকে ছেলে ভাবি৷ এদেশে আছি বলে পোশাক নিয়ে তেমন সমস্যা হয় নি । থ্রিপিস বা শাড়ি পরতে হবে বলে দেশীয় অনুষ্টানে যাই না । কোথাও যাই না বলে আমাকে সবাই এমন কি বাবা মা ও জিজ্ঞাসা করে, এমন কেন তুমি?’ আমার কাছে তার কোনো উত্তর নেই৷
সিয়াম আমাকে তার মা কে বোঝাতে বলে । সে বলতে থাকে মা আমাকে জন্ম দিয়ে নিজেকে অপরাধী ভাবে, পাপী মনে করে । মা কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিযে, আমি স্বাভাবিক মানুষ৷
এদেশ সমকামিদের সব কিছুতে সমান অধিকার দিয়েছে। রাষ্ট তাদের বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে ।২০০১ সালে নেদারল্যান্ড প্রথম সমলিঙ্গের বিয়েকে আইনগত বৈধতা দিয়েছে ।তারপরও গোটা বিশ্বে যৌনজীবনের ভিন্নতা ও লৈঙ্গিক পরিচিতির জন্য কিছু মানুষকে বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে।
২০০১ সালে নেদারল্যান্ড প্রথম সমলিঙ্গের বিয়েকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার পর তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছে আরও দশটি জাতি।
সোমা ও তার বর কে অনেক বোঝানোর পর ও তারা ছেলের সাথে স্বাভাবিক আচরন করে না ।আইনের কথা বাদ দিলেও, সমকামীদের ব্যাপারে বাস্তবে খোদ পরিবার থেকেই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় ।সোমা ও তার বর শিক্ষিত মা বাবা হয়েও তারা দুজনে আমেরিকার মত জায়গায় থেকে ছেলে কে মারধর করেছে। মা ছেলের সম্পর্ক এখনা নাই বললেই চলে ।
তারা তাকে মানষিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছে ।সিয়ামের মনে ক্ষোভ বাসায় তাদের দুই ভাইয়ের অসুখ হলেও তাকে কখনোই তারা রেগুলার ডাক্তার দেখায় নি। ছেলের অভিযোগ সে নিজ ঘরেই স্বাস্থ্যসেবা ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।সমকামি বলে সে পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পায় না।তাই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
সমকামী এবং উভকামী প্রবৃত্তি কোনো ব্যাধি নয়। সমকামী বা উভকামী হওয়াটা সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর। এটা কোনোপ্রকার অসুস্থতা নয় এবং তাই এ জন্য চিকিৎসারও দরকার নেই। আজ পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা দিযে এটা প্রমাণ করা যায়নি যে, থেরাপির সাহায্যে যৌনপ্রবৃত্তি পরিবর্তনের বিষয়টি নিরাপদ বা কার্যকর।উপরন্তু, এসব চিকিৎসার প্রয়াস সমকামীদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো আরও জোরদার করে এবং তাদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন বর্ণবাদ ও লিঙ্গবৈষম্য সমর্থন করা যায় না, তেমনি সমকামীদের প্রতি বৈষম্যের অবকাশ নেই। সমকামী বা উভকামী মানুষদের হয়রানি করা, তাদের অধিকার ও মর্যাদা অস্বীকার করা অথবা আইনের কাছে অভিযুক্ত করা ইত্যাদি কোনো ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো অনৈতিক ও অমানবিক।
সোমা আমাকে পাঠায় ছেলে কে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনতে ,তারা উলটা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের দলে নিয়ে আসে।সোমাকেও বোঝাতে ব্যর্থ হই সিয়াম একটা স্বাভাবিক বাচ্চা তার অধিকার আছে নিজের মত বাচঁবার ।আমি মাঝে মাঝেই চেষ্টা করি ২৯ ১২ ২৩ অ্যাভেন্যু তে ঢু মারতে। তাদের সাথে গল্প হয় । সিয়াম আর মেরিটের কোভিড হল। আমি দেখা করতে গিয়েছি দেখা দেখা করেনি নি। শুধু কেঁদেছে । মনে হল মা’র জন্য মন খারাপ কিনতু সোমা দেখা করতে চেয়ে ও পারে নি।
সোমার সাথে ছেলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হলে ও সিয়াম আমাকে মায়ার জালে আটকে রেখেছে। মেরিট ইতিমধ্যেই মম ডাকা শুরু করেছে।আমার দুটোই মেয়ে এখন দুটো ছেলে যোগ হয়েছে। বোঝাতে পারব না ওদের সাথে কেমন অদ্ভুত ঘোর লাগা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।জয় হোক ভালোবাসার।
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
পাঠকদের প্রায় জনেই হয়ত জানেন, সমকাম কি ? সমকামী কারা ? সমকামীর প্রকারভেদ, কেন…..