প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
আজ একটু আগে ভূমিকম্প হয়ে গেলো।
রুমানা প্রতিদিনের মতো খাটে আধশোয়া হয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলো তখন। দুপুরের এই সময়টায় তার বিশেষ কাজ থাকে না , এটা তার বিশ্রামের সময় । ছেলে দীপ্ত ‘ র স্কুল ছুটি হয় একটায় । ওকে স্কুল থেকে এনে , খাইয়ে – দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলে আগামী দুই ঘন্টা রুমানা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে । আজ অবশ্য ছুটির দিন , দীপ্তর স্কুল ছিল না । দীপ্ত সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠায় দুপুরে কিছুতেই ঘুমাতে চাইল না । রুমানার পায়ের কাছে বিছানায় বসে মোবাইলে গেইম খেলছিল সে । হঠাৎ বিছানাটা দুলে ওঠায় বিরক্ত হয় রুমানা । ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ না তুলে বলে ,
– আহা , দীপ্ত ! খাট নড়াস না। চুপ করে বোস ।
তারপরও খাট নড়তে থাকায় রুমানা ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে দীপ্ত ‘র দিকে তাকায় । উদ্দেশ্য , ধমকানো । কিন্তু তাকিয়ে দেখে দীপ্ত বিছানার ওপর আসন গেড়ে শান্ত হয়েই বসে রয়েছে । শুধু চোখ দুটি বিস্ময়ে , ভয়ে বড় বড় হয়ে আছে তার । রুমানা তাকাতেই একটা লাফ দেয় দীপ্ত , চিৎকার করে ওঠে ,
– মা ! ভূমিকম্প হচ্ছে ! ভূমিকম্প হচ্ছে !
লাফ দিয়ে ওঠে রুমানা । মাটিতে পা দিতেই হালকা দুলুনি টের পায় ও । ছেলের হাত ধরে টানে , নীচে নামতে হবে । কিন্তু দীপ্ত মাটিতে নামতেই দুলুনি থেমে গেলো । তবু গেটে তালা চাবি দিয়ে দীপ্ত ‘র হাত ধরে দোতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নামে রুমানা । একবার ভূমিকম্প হওয়ার পর পরই আর একবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে , এটাকে আফটার শক বলে । পত্রিকায় পড়েছে রুমানা । রুমানা যখন দীপ্ত ‘র মতো ছোট ছিলো , ক্লাস থ্রি -ফোরে পড়তো তখন পর্যন্ত ভূমিকম্প কি ও জানতোই না । অথচ আজকাল প্রত্যেক বছরই কয়েকবার করে ভূমিকম্প হচ্ছে । তাই ভূমিকম্প নিয়ে জন সচেতনতা চালানোর চেষ্টা করছে বিভিন্ন মহল । গতবার ভূমিকম্প হওয়ার পর ওদের পাড়ায় ” অনির্বাণ যুব সঙ্গ ” লিফলেট পর্যন্ত বিলিয়েছে , ভূমিকম্প হলে কি কি করণীয় , তার ওপর ।
রুমানা যখন দীপ্ত কে নিয়ে নিচে নেমে এলো তখন আশেপাশের অনেক বাড়ী থেকেই লোকজন নীচে নেমে পড়েছে । বেশ একটা জটলা তৈরী হয়েছে বাড়ীর সামনের খোলা জায়গাটায় । ছুটির দিন বলে অধিকাংশ মানুষই বাসায় ছিল আজ । সবার চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা । শুধু যারা ভূমিকম্প হওয়ার সময় পোশাক আশাকে অপ্রস্তুত ছিল , ভয়ে দৌড়ে নেমে এসেছে , তারা লজ্জিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে । মুখোমুখি পাঁচতলা বাড়িটির চারতলায় থাকেন রহমান সাহেব । সবসময় কেতাদুরস্ত সাজ পোশাকে থাকতে পছন্দ করেন তিনি । যতবার রহমান সাহেবের সাথে দেখা হয়েছে রুমানার , সে তীব্র পারফিউমের গন্ধ পেয়েছে । সেই রহমান সাহেব এখন একটি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে , গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন । ভদ্রলোক বোধহয় বাথরুমে ছিলেন । মুখের দাড়ি অর্ধেক সেভ করা হয়েছে , বাকি অংশ এখনো সফেদ ফেনায় ঢাকা । রুমানার সাথে চোখাচোখি হতেই রহমান সাহেব লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে তাদের গেটের ভিতর ঢুকে গেলেন ।
শিল্পী: রিয়া দাস
কেউ একজন মোবাইলে ব্রেকিং নিউজ চেক করে বললো ,
– ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ইন্ডিয়া । সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে । অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে ।
অল্পবয়সী একটা ছেলে বললো ,
– ভূমিকম্প হইল ইন্ডিয়াতে আর ঝাঁকুনি খাইলাম আমরা । এর থেকেই বুঝা যায় সরকার দেশ ইন্ডিয়ারে দিয়া দিছে !
আরেকজন বললো ,
– ভূমিকম্পের মতো খারাপ জিনিস ইন্ডিয়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত চলে এলো , কেউ আটকাতে পারলো না , দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ !
রুমানার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন পাশের বাসার মৌটুসির দাদি । ষাটোর্ধ বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে বললেন ,
– আজকালকার ছেলেপুলেদের জানে কি কোন ভয় -ডর নেই , এতোবড় বিপদ থেকে বাঁচলি , কোথায় আল্লাহ্ – খোদার নাম করবি , তা না সব রসিকতা করছে দেখো !
তারপর রুমানার হাত ধরে বললেন ,
– তা মা , তোমার স্বামী কোথায় এখন ? সিলেটে ?
– জ্বী খালাম্মা ।
– তার খবর নিয়েছো ?
– না খালাম্মা , তাড়াহুড়োয় মোবাইল ফেলে রেখে চলে এসেছি ।
– যাও , যাও ! তার একটা খোঁজ নাও আগে ।
রুমানা গলা উঁচু করে দীপ্তকে ডাকে ,
– দীপ্ত ! এসো , ওপরে যাচ্ছি ।
– তুমি যাও মা ! আমি ঝালমুড়ি খেয়ে আসছি ।
রুমানা তাকিয়ে দেখে ওদের একতলার ভাড়াটে সুশান্ত দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত ‘র পাশে । সেই হয়তো কিনে দিয়ে থাকবে দীপ্তকে ঝালমুড়ি । সত্যি মানুষ পারেও । জটলা দেখে কোত্থেকে একটা ঝালমুড়ি ওয়ালা এসে জুটেছে । আর সবাই বেশ কিনে কিনে খাচ্ছে , গল্প করছে । অথচ একটু আগেও সবাই মৃত্যু ভয়ে দৌড়ে নিচে নেমেছিল । এখন আবার মৃত্যুকে ভুলে জীবন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ।
রুমানা ওপরে এসে মোবাইল চেক করে দেখে টুয়েলভ মিসড কল । এর মধ্যে পাঁচটা ওর বর অরুপের । বাকিগুলি ওর মা , বড় ভাই অনান্য আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবের । ভূমিকম্প হলে সবাই নিয়ম করে রুমানাকে ফোন করে । কারণ রুমানা যে বাড়িটায় থাকে , তা বহু পুরানো বাড়ি । বাড়িটাতে থাকার সত্যিই ঝুঁকি আছে । যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে । রুমানার তো ঝড় হলেই ভয় লাগে যে বাড়ী না পরে যায় !
রুমানা প্রথম অরুপকে ফোন করে । একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে অরুপের উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায় ,
– তোমরা ঠিক আছো তো ? আশ্চর্য ! ফোন ধরছিলে না কেনো ?
– সব ঠিক আছে , চিন্তা করো না । আমি ফোন ভুল করে ফেলে রেখে নীচে চলে গেছিলাম । তুমি ঠিক আছো তো ? তোমাদের ওদিককার খবর কি ?
– আমি ঠিকই আছি । এদিকেও ভূমিকম্প হয়েছে । ক্ষয়ক্ষতির কোন খবর অবশ্য পাওয়া যায়নি । শোন , ফোন সবসময় কাছে রাখবে । ওইরকম একটা বাড়ীতে তোমরা থাকো , আমার খুব দুশ্চিন্তা হয় ।
– আমার শাড়ীর কি পকেট আছে , যে ফোন সবসময় কাছে রাখবো ? তুমি বরং নতুন বাড়ীর খোঁজ করো । আমি এই বাড়ীতে আর কিছুতেই থাকবো না ।
– হুম , আমিও তাই ভাবছি । ডেভেলপারদের সাথে কথা যখন ফাইনাল হবে , হোক । আমি তার আগেই এই বাড়ী ছেড়ে দেবো । তুমি তোমার পছন্দ মতো বাড়ি খোঁজ করা শুরু করো । আমি এবার ছুটিতে এসেই শিফট করতে চাই ।
– যাক তোমার সুমতি হয়েছে । খামাখা এই পৈত্রিক বাড়ীর মায়া ধরে রাখলে জানের মায়া ছাড়তে হতো ।
অরুপ একমাস পর পর সাত দিনের ছুটিতে বাড়ী আসে । এখনো আসার দিন পনের বাকি আছে । রুমানার ভাগ্য ভালো সে এরমধ্যেই পছন্দমতো একটি বাড়ী পেয়ে গেলো । খুঁজে দিলো সুশান্ত । ছেলেটি করিৎকর্মা আর রুমানাকে সাহায্যও করে বেশ । গ্যাসের বিলের বই শেষ তো গ্যাসের অফিসে গিয়ে নতুন বই এনে দেয়া , ইলেকট্রিক বিলের মিটার রিডিংএ ভুল হলে অফিসে গিয়ে কমপ্লেইন করা , এসব কাজে সবসময় সে হাসিমুখে এগিয়ে আসে । তা না হলে একা একা সব কিছু সামলানো মুশকিল হয়ে যেত রুমানার পক্ষে ।
নতুন বাড়ী এ্যাডভান্স করা হয়ে গেলে রুমানা সুশান্তকে বলল ,
– তুমিও এই বাড়ী ছেড়ে দাও । তিনতলার কাওসার সাহেবরা সামনের মাসে চলে যাবেন বলেছেন । বাড়িটি সত্যি খুব ঝুঁকি পূর্ণ । মিউনিসিপাল্টি হয়তো খুব শীঘ্রই ভাঙ্গার নির্দেশ দেবে ।
সুশান্ত হেসে বলেছিলো ,
– এত সস্তায় আর কোথায় বাড়ী পাবো বলেন ? আমি স্টুডেন্ট মানুষ , ছোট একটা চাকরি করি । মা কে নিয়ে মেসে তো উঠতে পারবো না । তবে মা ভূমিকম্পে ভয় পেয়ে দেশে চলে যেতে চাইছেন । উনি চলে গেলে মেসে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করবো ।
অরুপ আসলো মাসের এক তারিখে । ওরা ঠিক করলো পাঁচ তারিখ থেকে মালপত্র নেয়া শুরু করবে । তিনতলার কাওসার সাহেবরা দুই তারিখেই উঠে গেছেন । সুশান্তের মা গ্রামে মেয়ের বাড়ী চলে যাওয়ায় , সুশান্ত এখন মেস খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
কিন্তু পাঁচ তারিখ পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে পারলো না রুমানা আর অরুপ । সেদিন সকালে দীপ্তকে স্কুলে দিতে গিয়েছিলো অরুপ । ছুটিতে বাড়ী আসলে রুমানার এই দায়িত্বটা সে পালন করতে বাধ্য হয় , কারণ দীপ্ত এই কয়দিন বাবাকে ছাড়া কিছুতেই স্কুলে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে দেয় ।
সকাল আটটায় বাসায় ফিরে আবার একদফা ঘুমাবার আয়োজন করছিলো অরুপ । রুমানা এসে বললো ,
– নাস্তা খেয়ে তারপর ঘুমাও ।
ওরা নাস্তা খেতে ডাইনিং রুমে ঢুকেছিলো মাত্র । ঠিক তখনই মনে হলো পুরো বাড়ীটা দোলনা হয়ে গেলো , তাল সামলাতে না পেরে রুমানা মাটিতে পড়ে যেতেই অরুপ চিৎকার করলো ,
– ভূমিকম্প হচ্ছে রুমানা । তাড়াতাড়ি চলো , নীচে নামতে হবে ।
রুমানা উঠে দাঁড়ায় তারপর পড়িমড়ি অরুপের সাথে ছোটে বাইরে যাওয়ার গেটের দিকে । কিন্তু গেটের সামনে আসতেই ওপর থেকে সিলিং এর একটা বড়সড় টুকরা খসে পড়ে গেটের সামনে । অরুপ আর রুমানা লাফ দিয়ে পিছনে সরে আসে । তারা স্পষ্ট টের পায় তাদের বাড়ীটি ক্রমে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে । আর একটি বড় টুকরা সিলিং থেকে গেটের সামনে পড়তেই বাইরে যাওয়ার রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো।
অরুপ বললো ,
– তাড়াতাড়ি ডাইনিং টেবিলের নিচে চলো , কুইক ।
রুমানা আর অরুপ আবার ডাইনিং রুমে দৌড়ে ফিরে এসে ওদের উঁচু ডাইনিং টেবিলটার নীচে ঢুকে পড়লো ।
রুমানা কাঁদতে কাঁদতে বললো ,
– আমার দীপ্ত ! আমার দীপ্ত কি করছে এখন ! আমি দীপ্ত ‘র কাছে যাবো ।
অরুপ কিছু বলার আগেই বাড়ীটা আর একটু কাত হয়ে গেলো । ওরা ঢালু ফ্লোরের কারণে পিছলে চলে এলো ঘরের কোণায় । ডাইনিং টেবিলটাও ওদের অনুসরণ করে সাথে সাথে নেমে আসছিলো । অরুপ আর রুমানা গড়িয়ে সরে যেতেই টেবিলটা সশব্দে এসে দেয়ালে ধাক্কা খায় । ডাইনিং রুমের আরো যা টুকটাক জিনিস পত্র ছিলো তা গতকালই শিফটিং এর জন্য সরিয়ে পাশের বড় হল রুমটাতে নিয়ে রাখা হয়েছে , তাই এখন এই ঘরটা প্রায় ফাঁকা । হঠাৎ কাঁচা ভাঙ্গার তীব্র ঝন ঝন শব্দে সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে রুমানা আর অরুপ । সিলিং এর ঝাড়বাতিটি ভেঙ্গে পড়েছে নীচে । কাঁচের টুকরাগুলি ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে । কিছু এসে লাগলো ওদের মুখে চোখে । মিনিট দুয়েক পর ভাংচুরের শব্দ একটু কমে এলে ওরা শুনতে পেলো বাইরে থেকে বহু মানুষের হৈচৈ ভেসে আসছে । মোবাইলের একটা রিংটোনও আশেপাশে বাজছে কোথাও । হঠাৎ অরুপ অনুভব করে ওর নিজের মোবাইলটাই বাজছে প্যান্টের পকেটে । সাত রাজার ধন পাওয়ার মতো খুশী হয়ে ওঠে ও ,
– মোবাইলের নেটওয়ার্ক আছে রুমানা !
– এতো বড় ভূমিকম্পে সেটা কিভাবে সম্ভব ? তুমি ফোনটা ধরো ।
– হ্যালো ! কে সুশান্ত ? তুমি তাড়াতাড়ি আমাদের বের করার ব্যাবস্থা করো । আমরা দরজা বন্ধ হয়ে ভিতরে আটকা পড়েছি । যে কোন সময় সম্পূর্ণ সিলিং ভেঙ্গে আমাদের ওপর পড়বে । তুমি ফায়ার সার্ভিস আর যেখানে যেখানে খবর দেয়ার দরকার দাও ।
রুমানা বলে,
– তুমি স্পিকার অন করো আমি কথা বলবো ।
অরুপ স্পিকার অন করতেই রুমানা সুশান্তের গলা শুনতে পায় ,
– অরুপ দা , আপনি একদম চিন্তা করবেন না । এলাকার সব মানুষ আছে , তারা আপনাদের সাহায্য করবে । আমি সব জায়গায় খবর দেয়া শুরু করেছি । ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এখনি এসে পড়বে । ভূমিকম্প তেমন জোড়ালো ছিলো না । শুধু আপনাদের বাড়িটিই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে । আর সব ঠিক আছে ।
রুমানা বলে ,
– সুশান্ত ! দীপ্ত স্কুলে আছে । ওর খোঁজ নাও । তুমি বাইরে ছিলে নাকি ?
– হ্যাঁ , আমি বাইরে থাকায় বেঁচে গেছি । দীপ্তকে নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না । আমি দেখে রাখবো ।
জানালার কাছ থেকে সিলিং ভেঙ্গে আরও কিছু ইট বালু খসে পড়ে । ওরা আবার ডাইনিং টেবিলের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে আশ্রয় নেয় । তিনতলার ছাদ এর মধ্যেই ধসে পড়তে শুরু করেছে সেইসাথে বাড়ীটাও খুব আস্তে আস্তে আরও ঢালু হয়ে পড়ছে বলে ওদের মনে হলো । হঠাৎ রুমানা লক্ষ্য করলো ওদের ফ্লোরেও ফাটল দেখা যাচ্ছে । এবার কি তবে ওদের ফ্লোর ধসে পড়বে ? ভাবতে না ভাবতেই ফ্লোরের একটি অংশ নীচে খুলে পড়লো । ওই জায়গাটায় এখন লোহার রড বের হয়ে আছে ।
রুমানা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ,
অরুপ আর রুমানা যত দোয়া – দরুদ জানে তার সবগুলি পড়া শুরু করে । এমন সময় অরুপ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কাউকে একটা ফোন করে । রুমানা শুনতে পায় অরুপ বলছে ,
– হ্যালো নিপা ! খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোন । আমার হাতে সময় খুব কম । আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি । আমাদের বাড়ীটি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে আর আমি আটকা পড়েছি তার ভিতরে । যদি আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মৃত্যু হয় তবে তোমাকে আমার কিছু কথা বলা খুব জরুরি ।
আহা , সোনা বৌ আমার , কাঁদে না । তুমি আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন । তোমার নামে আমি ব্যাংকে কিছু টাকা রেখেছি । এছাড়া আমার সিলেটে কেনা জমিটার নমিনী করা আছে তোমাকে । আমার মৃত্যুর পর তুমি আমার বন্ধু এডভোকেট সৈকতের সাথে যোগাযোগ করবে । ও তোমাকে সব রকম সাহায্য করবে । শুধু একটা অনুরোধ , তুমি আমার ছেলে দীপ্তকে দেখে রেখো । তুমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী , সেই হিসেবে তুমি তো ওর মা – ই হও ।
রুমানা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না । অরুপ এসব কি বলছে ! মৃত্যু ভয়ে তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো !
বাড়ীটার ভিত নড়ে গেছে । তার মৃদু দুলুনি থামছে না । অরুপ সাবধানে রুমানার কাছে সরে আসে । রুমানার হাত ধরে বলে ,
– আমাকে মাফ করে দাও । তোমাকে না জানিয়ে সিলেটে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলাম আমি । তার মানে এই নয় যে তোমার আর দীপ্ত’র প্রতি আমার ভালোবাসা শেষ হয়ে গিয়েছিলো । আমি সবসময় তোমাদের একইরকম ভালোবেসে গেছি । শুধু দুই বছর আগে তোমাদের মতো আর একটি মানুষ যুক্ত হয়েছিলো আমার জীবনে , ওর নাম নিপা । ও খুব ভালো মেয়ে । নিপার কাছে দীপ্ত খুব ভালো থাকবে , তুমি চিন্তা করো না ।
রুমানার অরুপের কোন কথাই বিশ্বাস হচ্ছিলো না । মনে হচ্ছিল , ও ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে । একটু পরেই ওর ঘুম ভেঙ্গে যাবে সেই সাথে দুঃস্বপ্নও ভাঙ্গবে । রুমানা তাই ফ্যালফ্যাল করে অরুপের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করে । কিন্তু হাত পাশে রাখতেই ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের টুকরায় যখন ওর হাত কেটে গল গল করে তাজা রক্ত বের হয়ে আসে তখন রুমানা ভীষণভাবে উপলব্ধি করে , এটি বাস্তব , দুঃস্বপ্ন নয় ।
রুমানার মনে পড়ে সুশান্তের সাথে তার নিজের পরকীয়া সম্পর্কের জন্য সে কতদিন কতো অনুতাপ করেছে মনে মনে । অথচ সেটার কোন দরকারই ছিল না । অরুপও ওর সাথে প্রতারনা করেছে । রুমানাকে ঠকিয়ে শুধু প্রেম নয় , গোপনে সে বিয়ে করেছে আর একটি মেয়েকে , তার জন্য টাকা -পয়সা সম্পত্তির ব্যাবস্থা করেছে ।
হঠা ৎ উন্মাদিনীর মতো সে অরুপের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেয় । ফোন করে সুশান্তকে । অরুপ কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে ,
– সুশান্ত আমি তোমাকে ভালোবাসি । অনেক ভালোবাসি । তুমি আমাকে বহুবার পালিয়ে যেতে বলেছো, আমি রাজী হয়নি। তুমি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো , আমি তোমার সব প্রস্তাবে রাজী হবো । আমি তোমার , আমি শুধুমাত্র তোমার …!
অরুপ হতভম্ভ হয়ে নিজের বউ এর মুখে অন্য পুরুষের জন্য আকুলতা শোনে । রুমানা তবে তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সুশান্তের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলো । অথচ ও কতোদিন নিপাকে বিয়ে করার জন্য অনুতাপে দগ্ধ হয়েছে , চোখ তুলে রুমানার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি । রুমানার যে কোন চাহিদা তাই বিনাবাক্য ব্যায়ে পূরণ করেছে সে ।
প্রচণ্ড ক্ষোভে জ্বলে ওঠে অরুপ । ক্ষমাহীন আক্রোশে রুমানার গলা টিপে ধরে দুই হাতে । রুমানা চিৎ হয়ে পড়ে যায় । রুমানার বুকের ওপর উঠে বসে এবার অরুপ । অরুপের রাগ , ক্ষোভ , এই মুহূর্তের অসহায়ত্ব ,সমস্ত কিছু প্রচন্ড শক্তি হয়ে রুমানার গলায় চেপে বসে । রুমানা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে । ঠিক সেই মুহূর্তে সিলিং এর একটি অংশ ভেঙ্গে অরুপের ওপর পড়ে ।
উদ্ধার কর্মীরা যখন ওদের উদ্ধার করে তখন ওরা পরস্পর আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে মৃত পড়ে ছিল ।
সেই যুগল বন্দী লাশ দেখে সবাই বলাবলি করলো – আহা ! ওদের কি গভীর প্রেম ছিল ! নইলে ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে এভাবে কয়জন আর মরতে পারে ?
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..