প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
বৈকুণ্ঠপুর গাঁয়ের বুক চিরে নিরন্তর বয়ে যায় নিহাস শঙ্খ নদীটা। বাস্তুসাপের মতো এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে পশ্চিম থেকে পুবে গিয়ে নদীটা হঠাৎ বাঁক খায়। নদীর শান্ত জলের ধারায় আগের মতো সেই আর অবাধ্য ঘূর্ণি নেই। তবে ভরা বরষায় নাগের মতো ফণা তুলে ছোবল দিতে চায় কখনও কখনও। মাঝে মাঝে যৌবন চাগাড় দিয়ে উঠলে উন্মত্ত হয়ে দুই পাশের ঢালু পাড়ে তার জানানও দেয়। এ যেন রাগ ভৈরবী। আষাঢ় আকাশের রুদ্রবীণার প্রলয় আহ্বানের সাথে পাল্লা দিয়ে শঙ্খও মেতে ওঠে প্রমত্ত ঢেউয়ের তালে তালে। দিনে দিনে নদীটার গতর শুকিয়েছে অনেক। আগের মতো এখন আর ভয়াল মূর্তি ধারণ করে ভোগবতী হয় না। যৌবন শেষ হওয়া জীর্ণ শীর্ণ অনাহারক্লিষ্ট নারীর হতশ্রী চেহারার মতো কোনোরকম বুক চিতিয়ে নির্বিকার শুয়ে আছে যেন।
মরা গাঙের কাছে বাঁক খাওয়া নদীটা যেখানে ডহরা জমির জন্ম দিয়েছে সেখানে কয়েক ঘর কুমার পরিবারের বসত, বাকী পুরোটাই মালোপাড়া। কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা দক্ষিণ তীরের মালো বসতিতে সহায় সম্বল বলতে যা বুঝায় তা পিতৃপুরুষের ঐ সামান্য ভিটাটুকুন। জমি-জিরাত মাঠে বিশেষ কিছু নেই। পশ্চিম হতে পুবে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই বালির চরা আর ফাঁকে ফাঁকে মুগ, কলাই ও বাদামের শস্যসবুজ বিচরণ। সেখানে গাংশালিকের পায়ে পায়ে ধূলি উড়ে। আর ডানার ফুরফুরে ঝাপটায় কাউনের দানা থেকে ঝুনঝুন করে শব্দ বাজে।
মালো বসতির বিচ্ছিন্ন পতিত মানুষগুলো শঙ্খ নদীকে আপন করে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে। নদীটাই যে তাদের জীবন সংগ্রামের প্রধান অবলম্বন। এই নদীতে তাদের জীবন-যাপন, বসতি আর মরণ। নদীকে কেন্দ্র করেই তাদের নিত্যদিনের হাসি-কান্না, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন খেলা ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম। শঙ্খই যেন আজ তাদের নৈমিত্তিক ভোগবিলাসের জীয়নকাঠি। তাই ভালোবাসা ও মায়ার এক অমোঘ আবর্তনে তারা বার বার ফিরে আসে শঙ্খেরই মায়াতীরে।
সম্ভোগের দুরন্ত বাসনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষগুলোর নদীভোগের সাথে জীবন উপভোগের মচ্ছব চলে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নদীটাকে আঁকড়ে ধরে যেমন নিত্য ভোগের মহড়া চলে, তেমনি জৈবিক তাড়নায় আনন্দ উপভোগের বিরামহীন পালাও চলে নদীবর্তী বসতে সঙ্গোপনে।
নদীটা তাই আজও শেষ যৌবনের সবটুকু রূপ, রস আর স্নেহ দিয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করে চলেছে জীবনের টানাপড়েনে ক্লান্ত হয়ে পড়া অসহায়, দুর্বল এই মালো সন্তানগুলোকে। প্রবল মায়ায় আগলে রেখেছে জল আর জালের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মালো পরিবারগুলোকে। এটা মায়ার চেয়ে বেশি মোহ নাকি নেশার চেয়েও বেশি ভালোবাসার উন্মত্ততা তা কেবল নদীটাই জানে।
অনেকদিন পর গাঁয়ের মালোপাড়াকে ঘিরে ঘন হয়ে অন্ধকার নেমেছে। রাতের কালো গিলাফের বুকে জুনিপোকার বাতিগুলো জ্বলছিল যেন জরীন দানার মতো। নদীর দুই ঢালু পাড়ের গর্তগুলোতে হাঁকডাক সেরে চরের শিয়ালগুলো আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। শিয়ালকাঁটার বুনো ঝাড় আর মেটে রাস্তার দু’পাশের ভাঁট ফুল, আকন্দের ঝোপের আড়াল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁর ডাক এখনও নিশ্চেতন হয়নি। সাঁঝ মিলিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ আগে। তাই চরের বুকে নেমে এসেছে এক নিথর নীরবতা।
নদীর দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে মালোপাড়ার ঘরগুলো আস্তে আস্তে তাই জেগে উঠতে শুরু করে। পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে না উঠলেও একটি দুটি করে পিলসুজে বাতিগুলো জ্বলে উঠছিল মিটমিটে তারার মতো। সাঁঝবাতির আলোগুলো রাতের কালো মখমলের গায়ে যেন এক একটা জ্বলজ্বলে মুক্তাদানা। টিমটিম করে জ্বলে উঠে আপন মনে সাজিয়ে দিচ্ছিল রাতের এই মালোপাড়াকে।
রাত যত গভীর হতে থাকে মালোপাড়া যেন তার আপন খোলস ছেড়ে জেগে উঠতে থাকে। চারদিকে এক ধরনের ব্যস্ততা শুরু হয়। সেই ব্যস্ততায় মিশে থাকে পরিশ্রমী মালো সন্তানের ঘামে ভেজা শরীর ও রূপালি মাছের আঁশটে গন্ধ। চলতে থাকে মাছ ধরার আগাম প্রস্তুতি। কেউ হাতে নেয় খালুই আর জাল। ওদিকে কারওবা সঙ্গী হয় কোচ, পলো, চাঁই, টেটা এমন আরও কত কী! আগের রাতের ধর্মজালের ফাঁদে ধরা পড়া টাকি, বাইম, খলসে, পুঁটি আর বেতরঙ্গির লোভে কোনো কোনো মালো গিন্নীও পিছু নেয় বাড়ির কর্তার। এ নেশা বড্ড নেশা। যা তাদের রক্তে-ঘামে মিশে থাকে অবিচ্ছেদ্যভাবে।
আজকাল নদীর অনেক জায়গায় চরা পড়েছে। শৈবালদাম আর ঠোয়াশলতার জলজ জালে স্রোতেও তেমন দম নেই। নদীর মাঝখানেও আট দশ হাতের বেশি জল নেই। তাই সুখেন মাঝি প্রায়ই নৌকা বায় একেবারে উজানে, মরা গাঙ ছেড়ে ভবানন্দপুর গাঁয়ের দিকে। হরিদাস, জগদীশসহ সকলে মাছ ধরে এখানেই।
বৈকুণ্ঠপুর গাঁয়ে বড় হাট বসে না। তাই ভবানন্দপুরের শনি-মঙ্গলের বড় হাটই তাদের একমাত্র ভরসা। আজ সোমবারের রাত, তার উপর আশ্বিনী পূর্ণিমা গেল দুই তিথি আগে। তাই সুখেনসহ মালোপাড়ার সবার রূপালি জলের ঢেউয়ে নেচে নেচে জোছনার চাঁদি আলোয় মাছ ধরার আনন্দটাই অন্যরকম। পূর্ণিমার টানে নদীতে যৌবন ফিরে আসে, নদীর অতল থেকে জলের জোয়ারে জালের ফাঁদে ধরা দেয় মাছ। মুখের হাসির সাথে চোখও চকচক করে ওঠে মালোদের। এই ভোগের শেষ হয় না। যুগ যুগ ধরেও যেন নিঃশেষ হয় না শঙ্খ।
শিল্পী: রিয়া দাস
২.
মালো সর্দার দেবচরণ বউ সুশীলাকে নিয়ে ঘর বাঁধে শঙ্খতীরে পূর্বপুরুষের ভিটায়। কার্তিকের এক সকালে মেয়ে দামিনীকে জন্ম দিয়ে বউটা মরে গেল। তারপর থেকে দামিনীকে নিয়েই তার সংসার। শুনেছে তার বড় ঠাকুরদা প্রথম এখানে এসে বসত গাড়ে নদী ভাঙনে ভিটা মাটি সব হারিয়ে। আশপড়শির ঘরগুলোতে সাঁঝবাতির যে টিমটিম আলো জ্বলছে সবই তার বাবা ঠাকুরদার উত্তরাধিকার।
মালোপাড়ার সবাই দেবচরণকে খুব মান্যি করে। এখানেই বাস করে তার আজন্ম সহচর বাল্যসখা হরিদাস, সুখেন মাঝি, পরিতোষ হালদার আর জগদীশের মতো নিত্যদিনের মুখগুলো। এদের প্রতি রক্তের টান যেমন আছে তেমনি আছে দূর সম্পর্কের কুটুম্বিতা। আরও আছে একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা।
দেবচরণ তাই অদৃশ্য এক মায়ার টানে প্রচণ্ড নির্ভরশীল এদের উপর। শরীরে বল কমে আসছে, দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসে মাঝে মাঝে। মেয়ে দামিনী প্রধান অবলম্বন হলেও জগদীশকে নিয়ে ভরসা করে সে। মনের অজান্তে এক টুকরা আশ্রয় খুঁজে পায় সে নিজের জন্য, দামিনীর জন্য আরও বেশি।
শরীরে কয়দিন ধরে জুত না পাওয়ায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ঘরের দাওয়ায় একা বসে থাকে দেবচরণ মালো। খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঝাপসা চোখে আকাশের পানে চায়। মনের গোপন গর্ভ হাতড়ে খুঁজে আনে যৌবনের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। শঙ্খ নদীর উদ্দামতার সেইসব পুরানো কথা মনে করে নিজেই বিস্মিত হয়।
ঢেউয়ের ঘূর্ণি আর বাতাসের অনুকূলে নৌকা চালিয়ে মাছ ধরার সে কী প্রচণ্ড নেশা ছিল তার। মাছ ধরে ধরে হাঁপিয়ে উঠলে কুপির আগুন জ্বালিয়ে জলটুঙির মাচানে শুয়ে নিত ক্ষণিকের বিশ্রাম। তারপর আবার সারারাত জেগে জাল নিয়ে ঝুপঝাপ জলের মধ্যে বিচরণ, ঢেউয়ের সাথে খেলা। ঠিকমতো আলো ফোটার আগে খালুই ভরা মাছ নিয়ে ভোরে বাড়ির পথ ধরা। ভবানন্দপুরের হাটে মাছ বেচে সংসারের টুকিটাকিসহ নানান সওদাপাতি নিয়ে তবেই বাড়ি ফেরা। এই তো ছিল তার জীবনের চক্র। অথচ আজ সবই বিস্মরণ লাগে তার। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কেমন যেন ঘোর লেগে আসে। আকাশের তারাগুলো আরও দূরে সরে গেলে বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে দামিনীকে খোঁজে সে।
দামিনী, আছসরে মা! কয়ডা মুড়ি আর এক ঘটি জল নিয়া আয় তো এদিকে।
দামিনী ঘর থেকেই জবাব দিয়ে দরজার ঝাঁপ সরিয়ে দেবচরণের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে এক থালা মুড়ি ও এক ঘটি জল। কোমরে শাড়ির আঁচলখানা গুঁজে নিয়ে এগিয়ে দেয় বাবার সামনে।
এই লও বাপজান। তোমার কি শরীল খারাপ লাগে? আইজ মাছ ধরতে যাবা না?
শরীলে তেমন বল পাইনারে মা।
আইজ আর জাল নিয়া নদীত যাওয়ার কাম নাই। একটু বিরাম দাও।
শুকনো মুড়ি আর গলায় ঢক করে জল ঢেলে দিয়ে দেবচরণ একদৃষ্টে দামিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, মেয়েটা তার কী সুন্দর হইছে! দেখতে দেখতে কেমন ডাঙ্গর হইছে। কোত্থেকে পাইল এমন মায়াকাড়া চেহারা?
কী দেখ বাপজান?
তোরে দেখি; তুই ঠিক তোর মার মতো হইছস। তোর মার চেহারাটা ঝাপসা হইলেই তোর দিকে চাই।
দামিনী বাবার কথা ঠিক বুঝতে পারে না। শুধু এটুকু জানে যে তার মা সুশীলার মতোই দেখতে হয়েছে সে। দামিনীর বয়স ষোল পেরিয়ে সতের ছুঁই ছুঁই। এখন আশ্বিন মাস। গেল কার্তিকে ষোল পেরিয়ে যাবার পর থেকে দামিনী হঠাৎ করেই যেন তরতর করে বড় হয়ে উঠেছে। শ্যামা মেয়ে। কাজলা গায়ের রঙ। ডাগর চোখ দু’খানা একেবারে সুশীলার মতো পটলচেরা। পূজার সময়ে ভালো করে সাজলে দেবীর মতো মনে হয় তাকে। কালো বেণী দুলিয়ে যখন এ পাড়া ও পাড়া ছুটে বেড়ায় মনে হয় যেন সুশীলাই দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
দেবচরণ এলোমেলো ভাবে আর চিন্তার নদীতে জাল ফেলে কত কী যে হাতড়ে বেড়াতে চায়। দামিনীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার দৃষ্টিসীমা থির হয় থম ধরে থাকা আকাশটার দিকে। স্বপ্নেরা পাতাল গঙ্গায় জাল ফেলতে থাকে অনবরত। জলের প্রতিটা কণা সেঁচে জলকন্যাদের খুঁজে আনতে চায়। নির্মোহ কল্পনায় বাঁধাহীন কাদা উঠায় এক সময় চিন্তার সফেদ ডানা সে গুটিয়ে নিয়ে আসে। তার অর্ধ চেতন ভাবনা সম্বিৎ ফিরে পায়। আশ্বিন শেষের বাউরি বাতাস খণ্ড খণ্ড সে স্বপ্নগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় অনেক অনেক দূরে; একেবারে নদীর ওপারে ভবানন্দপুর গাঁয়ের দিকে।
৩.
সুখেন মাঝি, হরিদাস, জগদীশসহ কয়েকজন কুপি হাতে দেবচরণের উঠানে এসে দাঁড়ায়। জগদীশের সচেতন দৃষ্টি দেবী দর্শনে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
দেবু বাড়িত আছ? আকাশের ভাও সুবিধার না। বেশি দেরি হইলে আইজ আর মাছ পামু না। খালুই আর জাল লইয়া তাড়াতাড়ি বাইরে আস।
হরিদাসের গলা শুনে দামিনী ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বলে,
হরিকাকা, বাপজানের শরীলডা বেশি ভালা না। তাই আর মাছ ধরতে লওয়ার কাম নাই।
হরিদাস এই কথা শুনে ঘরের ঝাঁপ ঠেলে দেবচরণকে দেখতে ভেতরে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ থেকে আবার বের হয়ে আসে। ততক্ষণে সুখেন মাঝি উঠান ছেড়ে এগিয়ে গেলেও জগদীশ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে দামিনীর দিকে। দেবীদর্শনে দুজনের পূর্বরাগ ঘটে। কিন্তু, মিলনের সাধ অপূর্ণই রয়ে যায় তার।
জগদীশ দামিনীর জন্য ভালোবাসার ভেট রেখে যায় ক্ষণিকের উপস্থিতি দিয়ে। দূর থেকেই সে খেয়াল করে, দামিনীর চোখের চাহনি কেমন যেন শান্ত। আনমনা মনে হয় দামিনীকে। সেই গভীর চোখের স্থির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জগদীশের মনে কাঁপন ধরায়। কথা না বাড়িয়ে সুখেনের পিছু নেয় সে।
হরিদাস আর দেবচরণ দু’জনে হরিহর আত্মা, একসাথেই চলন-বলন। মাছ ধরতে যাওয়া, ডিঙি বাওয়া, হাটের বিকিকিনি সেরে বাড়ি ফেরা এভাবে জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গ হরিদাসকে ঘিরেই ছিল একসময়। হরিদাসের তাই মাছ ধরার নেশা উবে যায়। সে বাড়ির পথ ধরলে সুখেন মাঝি আর জগদীশ দু’জন মিলে মাছ ধরার জাল, খালুই, ঝাঁপি, হারিকেন নিয়ে ধীরে ধীরে পা চালায় শঙ্খের তীরে। ঘন ঝোপের আড়াল থেকে জুনিপোকার বাতি পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় একেবারে গাঙপাড়ের কাছে। যেখানে হিজল, করচ, যজ্ঞডুমুর আর বিলাতী গাবের গাছের ফাঁকে প্রকাণ্ড মান্দার গাছটা দৈত্যের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।
পাড়ের কাছে বাঁধা ডিঙি নৌকার আগা-গলুইএ ঝিম মেরে বসে থাকে জগদীশ। মনটা পড়ে থাকে দামিনীর কাছে, দামিনীর ছোট্ট এক রত্তি বুকের কাছে। বুকের সেই ধুকপুকানি নৌকায় বসেও সে শুনতে পায়। চোখের সে ভাষা দূর থেকেও তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়। নদীর বুকে লগি ঠেলে নৌকা টেনে নিয়ে জগদীশকে জিজ্ঞাসা করে সুখেন,
তোর আবার কী হইছেরে জগা?
কই, কিছু হয় নাই তো কাকা।
থম ধইরা রইলি যে।
এমনেই কাকা। দেবু কাকারে দেইখা মনডা একটু খারাপ করল; তাই।
আসলেই জগা। দামিনী ছাড়া দেবুর আর কেউ নাইরে। তার জ্ঞাতি গুষ্টি সবই কেমুন জানি পর হইয়া গেল।
হ। আমিও তাই দেবু কাকার কথা ভাবি।
কাকা না ছাই। তুই যে কার কথা ভাবস আমি জানি। তুই কিছু না কইলেও আমি সব টের পাইরে জগা। আমি জানি দামিনীর লগে তোর একটা ভাব আছে। দেবুও তাই চায়। তার মত আছে।
কাকা, ভগবানই জানে সব।
ভগবান সব জানলেও রাতের আবছা আলোয় জগদীশের মুখ লাল হয়ে আসে। কথার জড়তায় তা স্পষ্ট হয় আরও। জগদীশের মুখের এ পরিবর্তন সুখেন মাঝি ঠিকই বুঝে নেয় চাঁদি আলোর জোয়ারে। ঝিঁঝিঁর ডাক, দাঁড় টানার শব্দ আর সেই সাথে জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ ছাড়া চারদিক সুনসান হয়ে আসে।
একসময় সুখেন মাঝি আর জগদীশ নৌকা বেয়ে গাঙের হাঁটুজল ঠেলে ঠেলে একেবারে শঙ্খের পেটের ভেতর চলে যায়। যেখানে জলের ঘূর্ণি ফণা তুলে আবার গোত্যা খেয়ে অলস হয়ে ওঠে। মাছ ধরার দুর্নিবার নেশায় সুখেন যখন লগি ঠেলে, দাঁড় বেয়ে তখন শঙ্খের বুক অবিরাম ছেনে যায় জগদীশ। তাদের নিত্যদিনের বোঝাপড়াটা চমৎকার।
উত্তাল ঢেউয়ের ঝাপটায় সুখেন মাঝি শক্ত হাতে লগি ধরে থাকে। ওদিকে ঝুপ করে জলে জাল ফেলার শব্দ হয় জগদীশের। খেপলা জালের ফাঁদে আটকা পড়া মাছগুলো উঠে আসে তাদের সুনিপুণ কৌশলে। মাছ ধরাই যে তাদের নেশা, জীবন-জীবিকা। তাই জল আর জালের সাথে কবে থেকে যে তাদের নাড়ির টান তা কোথাও লেখাজোখা থাকে না। এটা সুখেন মাঝি ও জগদীশের মতো অন্যান্যদের কাছেও অজানা। দুজনে অবিরত মাছ ধরে ভরে ফেলে ডিঙি নৌকার পুরা খোলটা।
ঝড়ের মরশুম নয়, তারপরও একটা গুমোট ভাব বিরাজ করতে থাকে। থেকে থেকে আশ্বিনের দমকা হাওয়া বয়। নদীর উত্তরে কিছুটা উজানে এখানে ওখানে ধর্মজালের ফাঁদ পাতা ছিল আগে থেকেই। মাছ পড়েছে কিনা দেখার জন্য অনুবাতে নৌকা ঠেলে সুখেন। বাতাসের তোড়ে ডিঙি নৌকাটা দুলে ওঠে। তাই পাড়ের একদিকে ভিড়িয়ে কুপি জ্বেলে সুখেন আর জগদীশ অপেক্ষা করে বাঁশের মাচানে। সারা রাতের মাছ ধরার ক্লান্তিতে সুখেনের ঝিমুনি চলে আসে। আর ওদিকে বাতাসের ঝাপটা কমার অপেক্ষায় আধশোয়া হয়ে বসে থাকে জগদীশ।
৪.
জগদীশের বয়স আর কতইবা হবে? দুই যুগ কাল বয়স হয়েছে তার। তামাটে রঙের পেটানো শরীরটা অন্য আট দশটা ছেলের মধ্যে তাকে আলাদা করে। ঠিক যেন বেহেশতের গিলমান।
কর্মঠ ও সুঠাম দেহের চামড়ার নিচে রক্তের তেজী বান ডেকে যায়। মাচানে ঠেস দিয়ে লুঙ্গির কাছা কোমরের কাছে গুঁজে আনে সে। গলা থেকে গামছা খুলে ঝাঁকড়া চুলের মাথায় পেঁচিয়ে নেয়। উদাম শরীরের চওড়া বুকের ছাতিতে আশ্বিনের হাওয়া ভরে নেয় ইচ্ছামতো। পাশাল কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম চাঁদের আলোয় পষ্ট দেখা যায়। এমন ডবকা বয়সে মাঝে মাঝেই তাই চঞ্চল হয়ে ওঠে জগদীশ। তারুণ্যের উদ্দামতায় অজানা উত্তেজনা ভর করে শরীরে, মনে।
আগে মাঝে মাঝে তাই দেবু কাকার খোঁজ নেয়ার ছলে সে দামিনীর কাছে ছুটে যেত। দেবু কাকাকে সে ভীষণ মান্যি করে। দামিনীর প্রতি টান অনুভব করে তার চেয়েও বেশি। যে টান ভালো লাগার চেয়েও প্রবল, প্রগাঢ়। শুধু এটুকু বোঝে তার হঠাৎ পেয়ে বসা শূন্যতার মাঝে দামিনী এক চিলতে আশ্রয় হয়ে জেগে থাকে। বাবার মতোই দেবু কাকার প্রতি অকারণ ভক্তির এ উৎস যে দামিনী তা সকলেই জানে।
দেবচরণের হঠাৎ অসুস্থতায় বিচলিত বোধ করে জগদীশ। আজ তাই তার ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। অন্য যে কোনো দিনের চেয়েও মাছ ধরার নেশা পেয়ে বসে তাকে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি সব কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায় তার।
শেষ রাতের দিকেও মাঝে মাঝে জাল ফেলার ব্যস্ত শব্দ শোনা যায়। মাছ ধরার নেশা নাকি দামিনীর প্রতি ভালো লাগার প্রচণ্ড ঘোর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই ভোরের বাতাসে। মাচানে শুয়ে সুখেন কাকনিদ্রায় মগ্ন হয়। তবে সেই ঘুমের ঘোরেও জগদীশের সারারাত জেগে জাল ফেলার শব্দ শুনে সুখেন। ঘুমের ঘোরেও যেন জগদীশের গলা থেকে আবেগী সুরে গান শুনতে পায় সে।
মনের মানুষ চেনা বড় দায়
ঘরের মানুষ পর হইয়া যায়
কাছে থাইকাও দূর হইয়া যায়
পষ্ট ছবি ঝাপসা হয়রে মনেরই আয়নায়।
ভোরের কিছু আগে কপট আলোর রেখা কেবল মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। আকাশ যখন ফর্সা হতে থাকে ততক্ষণে জগদীশের ঝাঁপিগুলো রূপালি মাছের সমাহারে ভরে যায়। কী সুন্দর দেখতে! শীতল বাতাসে বুকভরে সে মাছের আঁশটে গন্ধ নেবার চেষ্টা করে। ক্ষুধা-ক্লান্তিতে মাথাটা শূন্য মনে হলেও অন্যরকম প্রশান্তি আসে তার।
গামছায় বেঁধে নিয়ে আসা রাতের ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাতের সাথে নুন ও জল মাখিয়ে গোটা দুই পোড়া লঙ্কা ভালোমতো কচলে নেয় সে। তারপর পরম যত্নে শেষ গ্রাসটুকু পেটের কোণায় জামিন দিয়ে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে নেয় জগদীশ। শরীরখানা চাঙ্গা হলেই দামিনীর মায়াবী মুখশ্রী কল্পনা করে সে। আর তখনই সারা রাত্রির সব ক্লান্তি এক নিমিষে দূর হয়ে যায় তার। দেবীর মতো মুখখানা জগদীশের মনের আয়নায় বিম্বিত হয় বিদ্যুৎ চমকের মতো। আশ্বিনের এক পশলা বৃষ্টির মতোই সেই মুখখানা তার মনে অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়।
৫.
মালোপাড়া আজ জেগে উঠেছে নতুন করে। থরে থরে আলোর বাতিতে সেজেছে পাড়ার বসতগুলো। শ্যামা পূজার সাধ্যমতো আয়োজন চলছে পাড়ার প্রতিটি ঘরে। গভীর রাতে আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যাবে সব।
শ্মশানঘাটের পাশে পরিতোষ হালদারের বাড়ি লাগোয়া শতবর্ষী কালী মন্দির। যুগ যুগ ধরে বাবা ঠাকুরদার পূর্বসূরিগণ এখানেই সাজিয়েছেন পূজার নৈবেদ্য, দিয়েছেন ভোগ। শ্যামা দেবী সন্তুষ্ট চিত্তে নিয়েছেন সেই পূজার উপাচার। দু’হাত ভরে মালো সন্তানদের দিয়েছেনও অনেক।
পরিতোষ হালদারের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক বদলেছে। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন হওয়ায় এখন আর সে মাছ ধরে না। পূজার দিনগুলোতে মালোপাড়ার সবাইকে নেমন্তন্ন করে সে। সন্তুষ্ট চিত্তে সকলেই তার আতিথ্য গ্রহণ করে। স্ত্রী মালতী গত হয়েছে অনেক আগে। জগদীশও তার নিজের ছেলে নয়। তবে সন্তানের মতোই আদরে বড় করেছে তাকে। জগদীশকে নিয়েই তার এখন একার সংসার।
পূজার আয়োজনের মধ্যে প্রচণ্ড ব্যস্ততা থাকলেও জগদীশের যেন সময় কাটে না। দিন রাতের আবর্তে সে শুধু ভাবে শ্যামা পূজা শেষেই যে দামিনীর সাথে তার আশীর্বাদ। সময় আর বেশি বাকী নেই। ভগবানকে সাক্ষী করে সাত পাকে বাঁধা পড়বে দুজনে। সেই ঘোরে দামিনীর নেশায় বুঁদ হয়ে জগদীশের মনে আশার রজত রেখা ফুটে ওঠে। আনন্দে তার হৃদয় দর্পণ শত সহস্র টুকরা হয়ে ভেঙে পড়ে। কিন্তু, প্রতিটা খণ্ডে দামিনীর উজ্জ্বল মুখের প্রতিবিম্বই আশা ভরসার মূর্ত প্রতীক হয়ে ভেসে ওঠে।
শ্যামা পূজার আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাত আরও গভীর হতে থাকে। ঢাক-ঢোলের বাদ্যে মালোপাড়ার শান্ত রাত মুখরিত হয়। মুখরিত হয় চকমকি আশার গানে। স্বপ্নমগন মালো সন্তানদের মনে নতুন করে জীবন উপভোগের সুর বেজে ওঠে আরেকবার।
রাতের দ্বিতীয় যামে দেবীর মতো সেজে পূজার ডালা আর ভোগ সাজিয়ে মন্দিরে হাজির হয় দামিনী। আবারও দেবীদর্শন হয় জগদীশের। এই শ্যামা দেবী যে তার একান্ত নিজের, অনেক দিনের আরাধ্য। পূজা শেষে মালোপাড়ার সকলে শ্মশানঘাটের কাছে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের নিচে জড়ো হয় আলোর ফানুস উড়ানোর জন্য। সেখানে থাকে না শুধু দামিনী ও জগদীশ।
জগদীশের কাছে মগ্নস্বপ্নের ফানুস হয়ে অবশেষে ধরা দেয় দামিনী। তার চকমকি আশায় বিম্বিত হয় শুধু দামিনীর নাম। স্বপ্নবন্দি, আশাবন্দি এক মানুষ সে। তাই জগদীশ সকলের অগোচরে দামিনীকে নিয়ে চলে আসে পূজার ঘর ছেড়ে একেবারে অন্দরে। দেবীকে নিয়ে আসে অন্তরের একান্ত সান্নিধ্যে।
হাজার আলোর ফানুস তাদের স্পর্শ করে না। তাদের গভীর নিশ্বাসের আওয়াজ পূজারীদের আনন্দ উল্লাসের মাঝে হারিয়েও যায় না। ঘরময় ছড়িয়ে থাকে শ্যামা রঙের নিকষ অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেও অদ্ভুত এক দ্যুতি ছড়িয়ে আবির্ভূত হয় দেবীরূপী দামিনী। আলোকপিয়াসী কাঁচপোকাদের মতো নিজেদেরকে বিসর্জনে তারা উৎসুক হয়ে ওঠে।
জগদীশ দেবীর পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য আর ভোগ সাজিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। নানা উপঢৌকন সাজিয়ে নিজেকে সমর্পণের প্রস্তুতি নেয়। স্মিত হেসে দেবী পূজা আয়োজনের সকল খেলা দেখে। তারপর বিনা দ্বিধায় সেই ভোগ গ্রহণ করে পূজারীকে ধন্য করতে চায়। অতিকায় অশ্বত্থ গাছটা দূর থেকে উঁকি দিয়ে দিনান্তের এই ভোগের পালা দেখে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..