ভোরাই

শ্বেতা সরকার
ছোটগল্প
Bengali
ভোরাই

আভা এক দৌড়ে বড়ো মাঠটার বাঁদিকে চলে গেলো। বাঁদিক থেকে আবার কোনাকুনি ডান দিকে দৌড় দিলো।অ্যাত্তোবড়ো একটা মাঠ কখনো দেখেনি আভা। তাই এদিক ওদিক দৌড়তে দৌড়তে হাঁফিয়ে উঠলো। দুর থেকে তাকে দেখছিলো ঠাম। ওই পশ্চিমদিকের যে রাস্তাটা দিয়ে আভা এই মাঠে এলো ওখানে রয়েছে অ্যাসবেসটসের চাল দেওয়া একটা বড়ো ক্লাবঘর। ক্লাবঘরের চারপাশে চাল নামানো চওড়া দাওয়া। চারধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওই দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসেছেন আভার ঠাম ঊষারণী। দূর থেকে তিনি নাতনীর কাণ্ড দেখছেন আর হাসছেন। আভা খানিকটা দম নিয়ে ছুটে মাঠের ওপ্রান্তে যায়, একটা বিশাল বড়ো বটগাছ। এই প্রথম আভা বটগাছ দেখলো। এ্যত্তো মোটা গুঁড়ির চারপাশ থেকে চুলের মতো অনেক ঝুরি নেমে এসেছে। গাছের ডাল থেকেও অনেক ঝুরি ঝুলে আছে। কয়েকটা ঝুরি মাটিতে গেঁথে মোটা থামের মতো হয়ে গেছে। আভার হঠাৎ মনে পড়লো ঠাম বলেছিলো, ছোট বেলায় এই ঝুরি ধরে দোল খেতো। আভা একটা ঝুরি ধরে ঝুলে পড়লো। প্রথমে একটু বেকায়দায় পড়লেও কয়েকবার চেষ্টা করতেই দোল খাওয়া শুরু করলো। কি মজা! হাতে একটু ব্যাথা করলেও দারুন মজা। পেন্ডুলামের মতো এদিক ওদিক দুলে যাচ্ছে সে। দূর থেকে নাতনীর এইসব কাণ্ড দেখতে দেখতে ঊষারাণীর চোখের সামনে ভেসে উঠল শৈশবের সোনালী দিনগুলো। মনে হলো চোখে রুমাল বেঁধে তিনি হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছেন আর মিতা মামন বনশ্রী তুলি সীমা…সবাই তাঁর চারপাশে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, “কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ।”

শুভময় মন্দিরের বাঁধানো সিঁড়িতে বসেছিলেন। ভোরে উঠে স্নান সেরে চা আর জলখাবার খেয়ে বাজারে যাওয়া তাঁর পুরনো অভ্যাস। স্ত্রী অঞ্জলি গত হওয়ার পরেও স্বভাব বদলাননি। ছেলে আর বৌমা বারণ করলে বলেন,

” বাবারে,‌ সারাদিন ঘরে বসে বসে সময় কাটেনা, ভালোও লাগে না। একটু এদিক ওদিক গেলে মনটা ভালো থাকে রে বাবা। এখনো তো দিব্যি হাঁটতে পারি, টুকটুক করে দুটো সব্জি মাছ আনতে কোন কষ্ট হয় না রে।”

ছেলে সপ্তক আর বৌমা ঈশা অবশেষে বাবার কথা মেনে নিয়েছে। মা গত হওয়ার পরে বাবা যে সত্যিই খুব একা হয়ে পড়েছেন এটা তারা দু’জনেই বোঝে। সকালে উঠে কোনরকমে স্নান খাওয়া সেরে সপ্তক অফিসে বেরিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে সেই সাড়ে আটটা -নটা। ওদিকে ঘরের কাজ সেরে দুপুর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ঈশাও একটা পার্টটাইম কাজ করে। নাতি নাতনী আসতে এখনও দেরি আছে। এই ব্যাপারে ঈশার একটু শারীরিক সমস্যা আছে যার চিকিৎসা চলছে। তবে তা নিয়ে শুভময় অথবা সপ্তক কারোর কোন মাথাব্যথা নেই। ঈশা ভারি ভালো মেয়ে। চেনা পরিচিত সবাই তাকে খুবই ভালোবাসে। কিন্তু শুভময়ের সময় কাটেনা। বন্ধু স্থানীয় যাঁরা তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছেলে মেয়ের কর্মস্থলে চলে গিয়েছেন। বাকি ছিলেন তুহিন প্রতুল আর তিনি নিজে। তুহিন গত বছর সব মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছেন, প্রতুল প্রায় শয্যাশায়ী। শুভময় মাঝে মাঝেই যান প্রতুলের কাছে, বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসেন। কিন্তু বাকি দিনগুলো গয়ংগচ্ছ, চলছে তো চলছেই। তাই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান, বাজার হাট করেন, দুপুরে খাওয়া সেরে মন্দিরে এসে বসেন। মন্দিরের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে চূর্ণী নদী। জলের ঢেউ, বটগাছে পাখিদের কিচিরমিচির মন ভালো করে দেয়। একটু দূরেই খেয়া ঘাটে লোক জমে, মানুষ সাইকেল গরু ছাগল নৌকায় চড়ে এপার ওপার যাওয়া আসা করে। ছোট বেলায় চূর্ণীর ভয়াল রূপ দেখেছিলেন। ফি বছর বন্যায় ঘর বাড়ি ভাসতো। এখন সভ্যতার জঞ্জালে চূর্ণী মজা খাল। বিকেল হলেই পাখিদের সাথে সাথে বাচ্চাদের কিচির মিচিরে বটতলা আর মাঠ ভরে ওঠে। ওদের দেখতে দেখতে শুভময় ফিরে যান শৈশবে, কত মুখ ভেসে ওঠে। তারপর সন্ধ্যায় মন্দিরের আরতি দেখে বাড়িতে ফিরে আসেন। আজও দুপুরে খাওয়ার পর মন্দিরের চাতালে এসে শীতের মিঠে রোদে গা সেঁকে নিচ্ছেন। হঠাৎ বটতলায় শুকনো পাতার আওয়াজে ফিরে তাকালেন। ভীষন চমকে উঠলেন শুভময়! এটা কে? সত্যি দেখছেন নাকি স্বপ্ন? সেই চোখ সেই মুখ সেই একই রকম ছোট্টটি, সেই শ্যামলা রোগা গড়ন। দুপুরের রোদে আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন না তো? স্পষ্ট নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পেলেন শুভময়। কতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন জানেন না। চমক ভাঙলো মেয়েটির চিৎকারে।

“ঠাম ও ঠাম,‌ দেখো দেখো কেমন দোল খাচ্ছি।”

উঠে দাঁড়ালেন শুভময়। ভিতরের কাঁপুনিটা টের পেলেন। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে মেয়েটির ঠামকে দেখার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন। কিছুটা এগোতেই পরিষ্কার দেখতে পেলেন শ্যাওলা সাদায় ছাপা শাড়ি পরা ঊষারাণী ক্লাবের দাওয়াতে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। এতোগুলো বছর পরেও তাঁকে চিনতে এতটুকু অসুবিধা হলো না। বুকের ভিতরে সযত্নে ফুটে থাকা রক্ত গোলাপের নরম ছোঁয়ায় ভরে উঠলো শুভময়ের মন।

ঊষারাণী নাতনীর কাণ্ড দেখে ভীষন খুশিতে হাসতে হাসতে পা দোলাচ্ছিলেন। এখান থেকে বটগাছের পাশে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে না। মন্দিরের পাশে চূর্ণী নদী। ঊষা ভাবলেন একটু পরে মন্দিরের চাতালে গিয়ে বসবেন, তারপর সন্ধ্যা আরতি দেখে ফিরবেন। বিকেলের দিকে মন্দিরের চাতালে কত চেনা মানুষের সাথে দেখা হয়। ঊষা যখনই বাপের বাড়িতে আসেন তখনই বিকেলে মন্দিরের চাতালে এসে বসেন। বাপের বাড়ি বলতে এখন তিন ভাই, ভাইদের বৌ আর তাদের ছেলে বৌমাদের সংসার। একই উঠোনের তিন দিকে তিন ভাইয়ের আলাদা আলাদা বাড়ি। তবে ভাব ভালোবাসাটা ভালোই আছে। আগে ঊষা এক দু’বছর পর পরই এখানে আসতেন। ছেলে বৌমা কে নিয়েও এসেছেন। এই বারেই প্রায় বছর নয় পরে এলেন। আসলে আট বছরের নাতনীটিকে নিয়ে খুব বেশি বেরোনো হয়নি। মাঝে ছেলে কিংশুক চাকরীতে বদলী হয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। বৌমা স্নিগ্ধা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। ঘরে কাজের মেয়ে আয়া রাঁধুনী সব মজুত থাকলেও নাতনীটাকে দেখে শুনে রাখার দায়িত্ব ঊষারাণী নিজের ওপরেই রেখেছিলেন। কিংশুক বছর দেড়েক আগে ঘরের কাছে বদলী হয়ে আসার পরে এখানে আসার জন্য বার কয়েক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কিংশুক আর স্নিগ্ধা কিছুতেই একসাথে ছুটি পাচ্ছিলো না। শেষে স্নিগ্ধাই বললো,

” শোনো, তোমরা তিনজন মিলে ঘুরে এসো। আমার যখন সময় হবে তখন না হয় আমি আবার যাবো।”

তাই প্রায় ন’বছর পরে ভাইদের বাড়িতে এসেছেন ঊষা। সাথে আট বছরের নাতনী আর ছেলে কিংশুক। এতোগুলো বছর পরে পুরোনো মানুষদের সাথে দেখা হওয়ার মজাটাই আলাদা। ঊষারাণী এই সব ভাবতে ভাবতে দেখলেন বটগাছের পাশ দিয়ে মানে মন্দিরের দিক থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো মাঠের মধ্যে। উনি কে! শুভদা না! প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পরেও শুভদাকে চিনতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তাঁর। আশ্চর্য হয়ে ঊষা দেখলেন শুভদা তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। শিরশিরে অনুভূতিটা টের পেলেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন ঊষা তারপর নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে, তিনি বুঝতে পারলেন শুভদা তাঁর দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে আসছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুভময় এসে দাঁড়ালেন ঊষার সামনে। বিয়াল্লিশ বছর পর দুজনে এভাবে মুখোমুখি দাঁড়ালেন। নিরবতা ভাঙলেন ঊষাই।

“কেমন আছো? ভাই বলেছিলো তোমরা এখানে ফিরে এসেছো। কিন্তু আমি প্রায় ন’বছর পরে এখানে এলাম।”

“আমরা বছর সাতেক হলো এখানে এসেছি রে ভোরাই, তোর দেখা পাইনি । তবে তোর বাড়ির লোকজনের কাছে তোর সব খবর পেয়েছি।”

‘ভোরাই’, কতদিন পরে শুভদা এই নামে ডাকলো। কেন জানিনা ঊষার খুব কান্না পেলো। মনে হলো শুভদার বুকে মাথা রেখে হাপুস কান্না কাঁদেন। সংসার জীবনে তিনি মোটেই অসুখী ছিলেন না। স্বামী অজিতেশ ভীষন ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রতি কোন অভিযোগ নেই ঊষার। তবুও কোন এক গহীন কোণে ‘শুভদা’ নামটা আজও যত্নে রাখা ছিলো।

“ঠাম ও ঠাম,‌‌ এই দাদুনটা কে? তোমার বয় ফ্রেন্ড?”

স্মৃতির অতলে ডুবে গিয়েছিলেন শুভময় এবং ঊষা। কখন আভা এসে দাঁড়িয়েছে দুজনের কেউই খেয়াল করেননি। এখানে এসে থেকেই ঠাম্মার চেনা পরিচিতদের সাথে আলাপ করে চলেছে আভা। কত্তো নতুন লোকের সাথে চেনা হচ্ছে। কিন্তু এতক্ষণ তো সব ঠামের বান্ধবী ছিলো। এই দাদুটা নিশ্চই ঠামের বন্ধু। আভার এমন সহজ প্রশ্নে চমকে উঠলেন দুজনে। তারপর হাঃ হাঃ হাঃ করে হাসিতে ফেটে পড়লেন শুভময়। তারপর আভাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাথা নিচু করে বললেন,

“হ্যাঁ গো দিদুভাই, তুমি একদম ঠিক বলেছো। তোমার ঠাম আমার গার্লফ্রেন্ড হাঃ হাঃ হাঃ।”

ততক্ষণে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছেন ঊষারাণী।

“তুমি ওকে আর উসকিও না শুভদা, কোথায় কি সব বলে বসবে।”

তারপর আভার দিকে তাকিয়ে ঊষা বললেন,

“ছি সোনা মা, এরম বলতে নেই ভাই।”

“কেউ কিছু বললে কোন কিছু হওয়ার দিন তুই আর আমি দুইজনেই পেরিয়ে এসেছি রে ভোরাই। তবে তুই কিন্তু এখনো একই রকম মিষ্টি আছিস,‌ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”

ঊষা রানী তখন শ্যামলা তোবরানো গালেও রাঙা আপেল হয়ে গেছেন। হাসি থামিয়ে শুভময় বললেন,

“এখন চল, আমার বাড়িতে চল, একেবারে রাতের খাবার খেয়ে ফিরবি।”

“সে না হয় গেলাম কিন্তু রাতের খাবার… ছেলে এসেছে যে।”

ঠামের কথা শুনে আভা বলে উঠলো,

“তাতে কি হয়েছে ঠাম,‌ বাবাকে ফোন করে দিলেই তো হলো। দাও দাও তোমার ফোন টা দাও তো। আমি বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি।”

শুভময় সাথে সাথেই বলে উঠলেন,

“সেই ভালো দিদুন, তুমি বরং তোমার বাবাকে ফোন করে বলে দাও যে আজ শুভ দাদুর বাড়িতে নেমতন্ন। তাড়াতাড়ি চলে আসে যেন।”

ঘন্টা দুয়েক পরে শুভময়ের বাড়িতে জমিয়ে আসর বসেছে। সপ্তক আজ হঠাৎ করেই হাফ ডে পেয়েছিলো তাই তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে এসেছে‌। বাড়িতে অতিথি এসেছে শুনে ঈশাও কাজ ম্যানেজ করে চলে এসেছে। কিংশুক আর সপ্তক দুজনেই খুব মিশুকে তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভাব হয়ে গেলো। কিংশুক একটু বড়ো বলে সপ্তক তাকে দাদা সম্মোধন করছে।

” ইশ্ বৌদিকে দেখা হলোনা, তোমাদের কথা এতো শুনেছি বাবার কাছে, খুব ইচ্ছে ছিলো তোমাদের সাথে আলাপ করার। এখানে এসে তোমরা বাদে সবার সাথেই দেখা হয়েছে। আমরা এখানে আসার পরে তোমরা আর আসোনি যে।”

“আরে ভাই আমারও তো একই ইচ্ছে ছিলো, ছোট থেকেই এখানে এলে তোমরা বাদে মায়ের পরিচিত সবার সাথে দেখা হতো। প্রতিবারই এই রাস্তা দিয়ে যখন যেতাম, মা এই বাড়ির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতো, “এটা শুভদাদের বাড়ি।” কিন্তু বাড়িতে তোমারা থাকতে না।”

“হ্যাঁ গো, দাদু মারা যাওয়ার পরে দিদাকে নিয়ে পুনেতে চলে আসে বাবা। এই বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলো। এমনকি আমার বিয়ের সময়ও এখানে আসিনি আমরা। কোলকাতায় লজ ভাড়া নিয়ে বিয়েটা হয়েছিল।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, মামাবাড়িতে শুনেছি ওই শিবেন বাগদি নাকি তোমাদের বাড়িটা দেখাশোনা করতো। তা রিটায়ারমেন্টের পরেই বুঝি মেসোমশায়ের ফিরে আসার ইচ্ছে হলো।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, রিটায়ার হওয়ার পরেই বাবা বলতে শুরু করে, সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মা কে নিয়ে একাই চলে আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু মা তো কাউকে কোন সময় দিলোনা। রাতে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলো, কিছুই করতে পারলাম না আমরা। তারপর বাবাকে আর একা এখানে আসতে দিইনি। এদিকে কাজের চেষ্টা করতে থাকি। শেষে এই অফারটা পেয়ে সব শুদ্ধ এখানে চলে এলাম।”

“খুব ভালো করেছো, এখানে পুরোনো মানুষদের সাথে কথা বলে মেসোমশাই খুব ভালো থাকবেন।”

“সেই জন্যই তো অফিস থেকে দুরে হলেও কোলকাতা শিফট করছি না।”

“ও তাই? হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার অফিসতো আমাদের ওদিকেই, তাহলে এবার মাঝে মাঝে সময় করে আমাদের বাড়িতে চলে এসো। অফিস ছুটি না নিলেও চলবে। তুমি তো আমাদের ওখান থেকেই অফিসে যেতে পারবে।”

ওদিকে ঈশা রান্নায় ব্যাস্ত। তার সাথে হাত লাগিয়েছেন ঊষারাণীও। ঈশার বারণ শোনেননি। হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছেন যতোটা পারেন। তার সাথে চলছে গল্প।

“তুমি একদম স্নিগ্ধার মতোই মিষ্টি। এবার ছুটি পেলে আমাদের বাড়িতে এসো। খুব মজা হবে।”

“নিশ্চয়ই যাবো মাসিমনি। তুমিও খুব সুন্দর, যেমন শুনেছি তার থেকেও বেশী।”

ঊষা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,

“শুনেছো মানে? কি শুনেছো?”

“তুমি রাগ করবে না তো?”

“ও মা, রাগ করবো কেন? কি শুনেছো?”

“তেমন কিছু নয় গো, আসলে বাবা মা তো শশুর শাশুড়ীর মতো ব্যবহার করেনি কখনো, বন্ধুর মতো মিশতো।”

“বৌদিকে দেখিনি তবে শুভদা খুব মিশুকে মজার মানুষ তা জানি। সপ্তকও সেরকমই হয়েছে দেখছি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবা প্রায়ই তোমার কথা মাকে বলতো, মানে তোমার কথা বলে মাকে ক্ষেপাতো আর কি।”

“সে কী! কী বলতো গো!”

“বলতো তুমি কি সুন্দর দেখতে, পড়াশোনায় কত ভালো, তোমার কত বুদ্ধি এই সব। আর বলতো… এই যাহ্, আরে তোমার গান তো শোনা হলোনা, রান্নাটা হয়ে গেলে কিন্তু তোমার গান শুনবো।”

ঊষারাণী ততক্ষণে লজ্জায় অধোবদন হয়ে গেছেন। কী সব কাণ্ড করেছে শুভদা, কোন মানে হয়? তবে অন্যরকম একটা ভালো লাগাও জড়িয়ে ধরছে তাঁকে। কোন রকমে নিজেকে কথা জুগিয়ে বললেন,

“সে না হয় গান শোনাবো। কিন্তু শুভদা এই সব বলতো বৌদিকে, এটা কিন্তু খুব অন্যায় করতো, খুব খারাপ।”

ঊষারাণীর গাল দুটো টিপে ঈশা বলে উঠলো,

“ওমা, খারাপ কেন গো? মা তো শুনে খুব মজা পেত আর মুখ টিপে টিপে হাসতো। তারপর সুর করে বলতো… থাক থাক, একবারও তো দেখা পেলাম না, দেখা পেলে বুঝতাম কত রূপ আর কত গুণ যে আজও ভুলতে পারোনি।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ঈশা, মাসিমণিকে লজ্জা পেতে দেখে বেশ মজা পেলো। তার বিয়ের পর থেকেই এই মহিলাকে নিয়ে বাবা আর মায়ের মধ্যে কপট খুনসুটি দেখে এসেছে সে। তাই ঊষারাণীকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“হি-হি-হি লজ্জা পেলে তোমাকে আরও মিষ্টি লাগে, একদম রসোগোল্লা বুঝলে। এতো লজ্জা পেওনা, বাপি আবার প্রেমে পড়ে যাবে কিন্তু, হা-হা-হা-হা।”

মাসিমণিকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে ঈশা। লাজুক কণ্ঠে ঊষা বলেন,

“ধুর পাগলী, তুইও খুব মিষ্টি মেয়ে, এইটুকু সময়ের মধ্যে কেমন মিশে গেলি।”

ওদিকে শুভময়ের খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে আভা। তার কত কথা। শুভময়ও মন দিয়ে শুনে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আভার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

“জানো দাদুন, আমাদের বাড়িতেও এই রকম একটা বইয়ের আলমারি আছে। ঠাম পড়ে, মা আর বাবাই ও পড়ে ছুটির দিনে।।”

“তুমি পড়োনা?”

“আমি টিনটিন পড়ি, সুকুমার রায়ের ছড়া পড়ি।”

“তুমি গান করোনা? ঠামের সাথে?”

“করি তো, পড়া হয়ে গেলে রাতে যখন সময় হয় তখন গান করি। তোমাদের একটা ঘর স্কাই কালার একটা ঘর অফ হোয়াইট, আর ওই ঘরটা গ্রীন। দাদুন জানোতো, আমাদের একটা পার্পেল কালারের ঘর আছে আর ওই গ্রীন কালারটাও আছে।”

“আচ্ছা,‌ তাই নাকি? তোমার স্কুলে কটা বন্ধু দিদুন?”

“আমার তো সবাই বন্ধু, আমি তো সবার সাথেই খেলি। জানোতো, পাড়াতেও আমার কত্তো বন্ধু আছে। আমাদের ফ্ল্যাটটার নিচে স্লীপ আছে দোলনা আছে আর মেরি গো রাউন্ডও আছে।”

“বাহ্ খুব ভালো তো, তোমরা খেলতে পারো। অনেকে তো খেলার জায়গাই পায়না।”

“তোমারা ছোটবেলায় কী কী খেলা খেলতে গো? ঠাম বলেছে ঠাম ছোটবেলায় কানামাছি কিতকিত রুমাল চোর এলাটিং বেলাটিং আরও কত কী খেলতো। তুমিও খেলতে ঠামের সাথে?”

শুভময় মৃদু হাসলেন তারপর বললেন,

“যখন তোমার মতো ছোট ছিলাম তখন সবাই একসাথে ডাংগুলি কবাডি চোর পুলিশ খেলতাম তো, তারপর যখন বড়ো হলাম তখন আমরা ফুটবল ক্রিকেট খেলতাম আর তোমার ঠাম মেয়েদের দলে খেলতো।”

“তাহলে ঠাম তোমার গার্লফ্রেন্ড হলো কী করে? ওই যে ওই‌ যে, ঠাম যখন মেয়েদের দলে খেলতো তখন? সিনেমার মতো?”

হেসে ফেলেন শুভময়। তারপর আভার মাথায় হাত রেখে উদাস হয়ে বলেন,

“হ্যাঁ গো দিদুন, সিনেমার মতো।”

এক মুহুর্ত ভাবেন শুভময়। ছবির মতো সব মনে পড়ে যায়। আভার থুতনিটা একটু নেড়ে দিয়ে বললেন,

“বুঝলে দিদুন, খেলতে খেলতে বলটা একদিন চলে গেল ওই যে যেখানে তোমার ঠাম বন্ধুদের নিয়ে বসে ছিলো সেইখানে। প্রায়ই তো বল গড়িয়ে চলে যেত এদিক ওদিক। কখনো কখনো এর তার উঠোনে গিয়েও পড়তো, বকাও খেতাম। তো, সেদিন তোমার ঠাম বলটা দিতে এলো। আমি হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখলাম তোমার ঠাম একটা লাল রঙের চুড়িদার পরে ঠিক সিনেমার হিরোইনের মতো দাঁড়িয়ে আছে, লুকোচুরি খেলা পুঁচকে মেয়েটা কখন বড়ো হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।”

আভা গালে হাত দিয়ে শুভময়ের কথা শুনছিলো। এবার দাঁত বের করে হেসে উঠলো।

“হি হি হি, দাদুন, তুমি বুঝি ঠামকে তখনই হিরোদের মতো হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করেছিলে?”

আবার হেসে উঠলেন শুভময়। তারপর বললেন,

“না গো দিদুন, সেই সময় আমরা অতোটা স্বাধীন ছিলাম না গো। ওই স্কুলে যাওয়া আসার পথে, খেলার মাঠে আর কখনো কখনো তোমার ঠামের বাড়িতে গেলে আমাদের দেখা হতো। দুজন দুজনের চোখ দেখে মনের ভাব বুঝতে পারতাম, বুঝতে পারতাম যে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।”

” তাহলে ভোরাই বলে ডাকলে কবে? ঠামের নাম তো ঊষা।”

চমকে উঠলেন শুভময়। শিশুকে ভোলানো মোটেই সহজ নয়।তাই কিছুটা সতর্ক হয়ে জবাব দিলেন,

“ওহ্ ওই নামটা? ওটা তো একদিন সকালে তোমার ঠামকে দেখে বলেছিলাম। ওই যে একদিন পুজোর সময় সকাল বেলা তোমার ঠাম শিউলি তলায় ফুল কুড়োচ্ছিলো, তাই দেখে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলেছিলাম, “তোর নাম ভোরাই।” কেন দিদুন, নামটা তোমার পছন্দ নয়?”

“পছন্দ তো, কিন্তু তাপ্পর কী হলো? ওই সিনেমার মতো কোন ভিলেন এলো বুঝি? আর তুমি লড়াই করে পারলেনা?”

আভার কথা তিনি শুনতে পেলেন না শুভময়।
শিউলি ঝরা ভোরের এক নরম স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন ভোরে ঊষার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না শুভময়। লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে পুজোর ফুল তুলছিলেন ঊষারাণী। কপালে ঘামে লেপ্টে ছিল চুল। আশেপাশে কেউ নেই দেখে শুভময় ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলতো হাতে ঊষার কপালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এই ভোরাই, তোর নাম ভোরাই।”

শুভময়কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আভা তাকে ঝাঁকুনি দিলো,

“দাদুন ও দাদুন,‌‌ বলোনা, তুমি কি ভিলেনের সাথে লড়াই করে হেরে গিয়েছিলে?”

“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, না গো দিদুন তা নয়, আসলে পাশ করেই চাকরির সন্ধানে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলাম, তিন চার মাস পর পর বাড়িতে আসতাম। এই ভাবেই একবার বাড়িতে ফিরে শুনলাম ভোরাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে তোমার দাদুর সাথে। তখন তো আর তোমাদের মতো হোয়াটসঅ্যাপ ছিলো না দিদুভাই, আর বাড়ির বড়োদের মুখের ওপর কোন কথা বলাও যেতনা, তাই তাঁরা যা ঠিক করেছিলেন তাই হয়েছিল।”

কথাটা শেষ করে শুকনো হাসলেন শুভময়। তারপর বললেন,

“ওসব ভেবে কি লাভ বলো দিদুন, এতোদিন পর তোমাদের দেখা পেলাম এটাই আনন্দের, তাই না? আর আমার এই মিষ্টি দিদুনটাকে পেলাম এটা তো আরও আনন্দের।”

আভা দাঁত বের করে হাসলো। অমনি শুভময় বললেন,

” এই তো, দেখি দেখি আমার মিষ্টি দিদুনের সাথে একটা সেলফি তুলি।”

“দাঁড়াও দাঁড়াও, ওফ্ তুমি কিচ্ছু জানোনা,‌ আঙ্গুলটাকে এরকম করে ইও ইও করো, নাও এবার ছবি তোলো, স্মাইল করো হি হি হি।”

খচাত খচাত করে অনেক গুলো ছবি তোলা হয়ে গেলো। সেদিনের পরবর্তী মুহূর্তগুলোও ছবির মতোই সুন্দর হয়ে উঠলো। রান্না শেষ হলে সবাই মিলে গল্প হৈ হৈ আর ঊষারাণীর সুরেলা কন্ঠ মুগ্ধ হয়ে শুনলো সবাই। আভাও ঠামের সাথে গান শোনালো। সে তো খুব খুশি একটা দাদুন পেয়ে। পরের চার দিন খুব আনন্দে কাটালো সে। সারাক্ষণ ঠাম আর দাদুনকে বগলদাবা করে ঘুরে বেড়ালো আভা। নদীর ধারে, ইঁটভাটায়, খেয়া পার হয়ে ওপারের হাটে, তাঁতকলে, বুড়োশিব তলায় তিনজনে মিলে আনন্দে ঘুরলো। আভার বকবকানি আর দুষ্টুমিতে ষাটোর্ধ দুটি মানুষ যেন কৈশোরে এসে পৌঁছেছেন, তাঁরা ছুঁয়ে যাচ্ছেন সোনালী স্মৃতি। এই পড়ন্ত বেলায় এসে গমরাঙা আলোয় তাঁরা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছেন মুগ্ধ বিস্ময়ে।

দেখতে দেখতে ফিরে যাওয়ার দিন চলে এলো। এই কদিনে সপ্তক আর কিংশুকের বন্ধুত্বও বেশ জমে উঠেছে। প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরে ঘন্টাখানেক দুজনের আড্ডা চলেছে। আজ দুপুরে কিংশুকরা চলে যাবে শুনে সপ্তক অফিস ছুটি নিয়েছে। জলখাবার খেয়ে ওরা দুজন হাঁটাহাঁটি করতে বেরোলো। কিংশুক বললো,

” এবারের মতো আমরা চললাম। এবার আমাদের বাড়িতে কবে যাবে বলো। ছুটির বাহানা করতে পারবে না, ছুটি না নিলেও তোমার চলবে। চলে এসো, কদিন বেশ ভালোই কাটবে। এই কদিন কিভাবে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না।”

“নিশ্চয়ই যাবো, বৌদির হাতের রান্না মিস করা খুব বোকামি হবে।”

“হা হা হা ঠিক ঠিক, সত্যিই স্নিগ্ধার জোরাজুরিতে ভাগ্যিস এলাম তাই তোমাদের সাথে আলাপ হলো।”

কথা বলতে বলতে দুজনেই বড়ো মাঠটার পাশে ক্লাবঘরের সামনে এসে পৌঁছালো। তারপর মন্দিরের দিক এগোতেই ওরা শুভময় ঊষারাণী আর আভাকে দেখতে পেলো। ওরা তিনজন মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছেন। শুভময়ের এক হাত ধরে আভা তিড়িং তিড়িং লাফাতে লাফাতে আসছে। শুভময়ের অন্য হাতের কনুই চেপে ধরে ঊষা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। এই দৃশ্য দেখে সপ্তক আর কিংশুক দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর নীরবতা ভেঙে কিংশুক বললো,

” ভাই, তোমার অফিস তো আমাদের বাড়ির থেকে কাছেই। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে কয়েকটা ফ্ল্যাট খালি আছে, আমি বরং তোমার জন্য ভাড়া দেখছি, এখন এখানে আসতে কারোর কোন আপত্তি হবে বলে মনে হয়না।”

কথা বলতে বলতে সপ্তকের কাঁধে হাত রাখলো কিংশুক। সপ্তক দুহাত দিয়ে কিংশুকের হাতটা চেপে ধরলো,

“সেই ভালো দাদা, দিনের শেষে এসে মানুষ দুটো একটু পাশাপাশি থাকুক, নিজেদের অনুভূতি গুলো একটু ভাগাভাগি করে নিক।”

“একদম তাই রে ভাই, শুভস্য শীঘ্রম।”

দুজনেই প্রানখুলে হেসে উঠলো। উত্তুরে দামাল হাওয়া হুড়মুড়িয়ে কিছু শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে গেলো। শিরশিরে শীতে জীর্ণ স্মৃতি ঝরিয়ে দিয়ে একলা ন্যাড়া গাছও দাঁড়িয়ে থাকে বসন্তের অপেক্ষায়। রাত্রির অপেক্ষা শেষে শোনা যায় ভোরাইয়ের সুর।

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ