প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
সেদিন খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল ।
এমনিতে আমি লেট রাইজার কিন্তু সেদিন ঘুম ভেঙেছিলো বেশ ভোরেই ।
চোখ খুলেই বিছানার লাগোয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম । দেখলাম সূর্যদেব তখনও ধ্যানমগ্ন, প্রশান্তিতে অর্ধ নিমীলিত নয়ন । এক নমনীয়তা ছড়িয়ে তার দ্যুতিতে । তখনও উজ্জ্বলতা ধারন করেননি ।
আসলে ঘুম ভাঙার একটা কারণ ছিল । একটা কাহিনী …
জানিনা স্বপ্ন কিনা ! কিন্তু একটা লেখার ভাবনা নিয়েই ঘুমটা ভেঙে গেল ।
এরকম হয় আমার মাঝে মাঝেই । ঘুমের ঘোরে লেখা মাথায় আসে…. অথবা স্বপ্নে । ঘুমভাঙা লেখারা ভারি সুন্দর হয়। সুন্দর … পবিত্র… নিষ্কলুষ ।
অনেকটা অস্পর্শ্যা কিশোরী কন্যার মতো… মালিন্য হীন ।
তাই ঘুম ভেঙেই মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠলো । তাড়াতাড়ি উঠে ভাবনা বা স্বপ্নটা মনে থাকতে থাকতেই লিখতে বসে গেলাম । এই সময় লিখতে ভীষণ ভালো লাগে, অদ্ভুত একটা প্রশান্তি থাকে এইসময় প্রকৃতিতে । সৌম্য ঋষির মতো সমাহিত হয়ে থাকে চারিদিক । পাখির মিষ্টি ডাক … শিশিরে ভেজা ঘাসের থেকে উঠে আসা বনজ সোঁদা গন্ধ, পুব আকাশে লজ্জাবনতা নব বধূর গালের মতো লালিমা, পাতলা ওড়নার মতো ছেয়ে থাকা কুয়াশার স্বচ্ছ চাদরে জড়ানো পৃথিবী । পরিবেশে কলুষতা নেই , নির্জন , শান্ত প্রকৃতি।
আসলে আমার বেহিসাবী জীবন। ভোর দেখার সৌভাগ্য বিশেষ হয়না বলেই হয়তো এত বেশি ভালো লাগে! স্বপ্ন স্বপ্ন একটা অনুভূতি হয় ।
অন্যান্য বেশির ভাগ দিন গুলো চলে ছকে বাঁধা রোজ নামচায় । ঘুমভাঙা আলস্য গায়ে জড়িয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলসেমি কে মুহূর্তে বিদায় করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু হয় নিত্য কাজ । নিত্য কাজ তো নয় যেন জীবন যুদ্ধ, আরেকটু এগিয়ে গেলে গৃহযুদ্ধ ও বলা যায় । চরকির মতো সাঁই সাঁই করে ঘুরতে থাকি সারা বাড়ি ময় । চা… , ব্রেকফাস্ট …, স্কুলের টিফিন…, অফিসের ভাত… সে এক দুরূহ অপরিপাটি জীবনের ট্রেলার ; শেষ হয় যতক্ষণে ততক্ষণে আর না থাকে ভোর ,আর না থাকে ভোর দেখার মন।
কিন্তু কোন কোন দিন হয় ব্যতিক্রমী । সেদিন গুলো যেন একঝাঁক বকের মধ্যে থেকে দলছুট হয়ে যাওয়া একাকী বকের মতো । যে তীব্র গতিতে ধাওয়া করে দলের পিছনে , তবু তার মধ্যেই অবকাশে পাওয়া বাড়তি সময়ের উড়ানটাকে ডানায় ভরে নেয় প্রাণ ভরে।
এদিনটাও আমার কাছে সেরকম অবকাশে পাওয়া সুখের উড়ান।
লিখতে শুরু করলাম… অবিরত…।
অবিরত কারণ ভাবনা গুলো ছিলো অনর্গল । তারা গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছিল পূর্ব নির্ধারিত ভাবে , সেই ঘুমঘোরে তৈরি হওয়া ভাবনা রাশি থেকে । অথবা, স্বপ্নে দেখা কাহিনী রূপ পাচ্ছিল। কিছু আলঙ্কারিক সজ্জায় সেজে উঠছিল তারা ।
এই রকম খুব কম সময়ই হয় । কোন একটা বিশেষ মুহূর্তের মতো । কী বলবো একে ? মাহেন্দ্র ক্ষণ ? অথবা ব্রাহ্ম মুহূর্ত ? জানি না! তবে এটুকু জানি এ সময়ের লেখা গুলো খুব সুন্দর হয়। একদম আমার মনের মতো। পরে এগুলো নিয়ে আর কোন কাটা ছেঁড়া করতে হয় না । যদিও আমার নিজের অধিকাংশ লেখাই আমার মনঃপূত হয় না, মনে হয় অনেক খামতি রয়ে গেল , আরো ভালো হতে পারতো । তাদের বারে বারে শোধন করি, শাসন করি ।
আসলে প্রতিটা লেখাই আমার সন্তানের মতো , তারা আমার হৃদয়ে জন্ম নেয় । কিন্তু একাধিক সন্তানের মধ্যে সবাই যেমন সু-সন্তান হয়ে ওঠেনা , কেউ কেউ হয় , এও তেমনি । তবে আমি দুই এর প্রতিই সমান যত্নশীল হই । তবে মুশকিল ও আছে কিছু । এইভাবে হঠাৎ আসা লেখারা হঠাৎই চলেও যায় । এ যেন ক্ষণিকের অতিথি । এইভাবেই বহু লেখা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে আমার । পরে যেন আর কিছুতেই সুর মিলতে চায় না । যতই চেষ্টা করি ততই বেসুরে বাজে । তখন হাল ছেড়ে দিয়ে অসম্পূর্ণই রেখে দিই তাদের । প্রতীক্ষা করি আবার কোনো এক মাহেন্দ্র ক্ষণের । যখন ঠিক ঠিক সুর লাগবে , আবার আমার স্বপ্নরা জাগবে।
ততদিন অবাধ্য সন্তানের মতো একগুঁয়ে জেদ নিয়ে বসে থাকে তারাও আমার খাতার পাতায় পাতায়..
সেদিন তাই একটা মূহুর্তকেও অপচয় হতে দিতে চাইছিলাম না । যেন আমি কোন পরীক্ষা দিতে বসেছি , নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সমাপ্ত করতে হবে আমার কাজ । নাহলে অসমাপ্ত প্রশ্ন পত্র জমা দিয়ে আসতে হবে ।
আর.. জানা প্রশ্নের উত্তর সময়াভাবে ছেড়ে আসার মতো… তারপর এক ভয়ঙ্কর অস্বস্তিতে কাটবে আমার দিন । অসহায়ভাবে দেখব কিচ্ছু করার নেই আমার … । কী এক অস্থিরতা তখন মগজে ঘুণ পোকার মতো কামড়াতে থাকে; কড়ড়্… কড়ড়্…
সেদিন দ্রুত হাত চালাচ্ছিলাম এই ভেবে যে -ভোরের নরম আলো থাকতে থাকতে যদি সম্পূর্ণ করতে পারি আমার রচনা । কারণ , জানি — রোদের তাপ বাড়লে, প্রকৃতি তার নমনীয়তা হারালেই আমার স্বপ্নরাও মিলিয়ে যেতে থাকবে একটু একটু কর । এ যেন সেই রাতপরীদের মতো । আলো ফোটার আগেই যারা হুড়মুড়িয়ে পালায় যে অবস্থায় থাকে সেই অবস্থাতেই। অথবা যেন জলের মতো যা প্রতি মুহূর্তে লীন হতে থাকে । বাস্প হয়ে উবে যায় । তারপর… আবার অপেক্ষা ।
মস্তিষ্কে ঘুণ পোকার আক্রমণ কে বড় ভয় লাগে আমার ।
সব কাজের মাঝে মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে তারা ।
এমন একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়…
যেন কোন একটা কথাবলতে গিয়ে ভুলে যাওয়ার মতো অস্বস্তি … এই ভাবলাম বলব, কিন্তু বলতে গিয়ে আর মনে পড়ছে না, কী নিদারুণ অস্বস্তি …
অথবা বলা যায় মায়ের উৎকন্ঠা র মত , যখন নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পরও সন্তান বাড়ি না ফেরে …. সেই পরিমাণ উকন্ঠা বুকে চেপে বসে থাকে ।
আমি জানতাম, আর একটু পরেই বাড়ির বাকি সবাই জেগে উঠবে, ডাক পড়বে আমার নিত্য কাজে । তখন আবার অন্য আমি , অন্ন- র তোড়জোড় । সুইচ অফ করতে হবে লেখক সত্তার ।
তাই সেদিন আমি ভোরের গন্ধটুকু নিয়ে রাখছিলাম অন্তরে । আর সৃষ্টি করছিলাম শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে এক মায়াজাল। সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিলাম সাহিত্যের দুয়ারে একটা সূক্ষাতিসূক্ষ আল্পনা ।
সেদিন সৃষ্টি করছিলাম আমার ভালোবাসার এক শব্দচিত্র যা আমার লেখক সত্বাকে তৃপ্তি দিচ্ছিলো । আমি নিজেকে একটা কিছুর স্রষ্টা ভাবছিলাম ।
‘স্রষ্টা’… এ এক আদিমতম চাওয়া মানুষের ; পাওয়াও… । প্রতিটি মানুষই স্রষ্টা হতে চায় , সৃষ্টি করতে চায় তার প্রতিচ্ছবি । তা সে রক্তমাংসের প্রতিরূপ হোক বা কাল্পনিক অথবা আবেগের ।
আমিও তাই আমার সমস্ত আবেগ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে , সৃষ্টি করছিলাম … তৃপ্ত হচ্ছিলাম … পরিপূর্ণতা পাচ্ছিল আমার স্বপ্নরূপ। এ এক অদ্ভুত মাদকতা, এক অনাবিল শান্তির অনুভূতি । যা হয়তো প্রতিটা মানুষই খুঁজে বেড়ায় । এ খোঁজ পূর্ণতার … পরিতৃপ্তির। কিন্তু সবাই খুঁজে পায়না সব সময় । পায় না কারণ – মানুষ প্রকৃতির অংশ হলেও প্রকৃতিকেই বোঝে না । বোঝে না নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় জরুরি । প্রভাতে যেমন সন্ধ্যারতির জাঁকজমক হয় না তেমনি সন্ধ্যা আরতির সময় প্রভাতী প্রার্থনার সমাহিত শান্ত ভাব অনুপস্থিত থাকে ।
হয়তো আমি লিখতে চাই বলে এ অনুভূতি আমার অন্তরকে যেভাবে আলোড়িত করছে অন্যদের হয়তো তা করে না, যারা লেখেন না তারা হয়তো বুঝবেই না লেখার আকুতি কি … কী তার তীব্রতা .. কতটা উন্মাদনা থাকে সে চাওয়ার মধ্যে !!
যেমন কৃষকের উৎকন্ঠা থাকে বীজ বপনের পর… অনুকূল পরিবেশে র জন্য, যেমন উৎকন্ঠা থাকে অনির্দিষ্ট স্ট্রাইক চলা কারখানার শ্রমিক এর , যেভাবে উৎকন্ঠিত থাকে গৃহকর্ত্রী বাড়ির কোন একজনও সময়ে বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত .. এ ও সেরকম একটা উৎকন্ঠিত ভালোবাসা নিজের সৃষ্টির প্রতি ।
আর সবকিছুই আবর্তিত হয় একটা নির্দিষ্ট সময়ের অঙ্গুলি হেলনে ।
কী অপূর্ব শান্তি আছে দিন শুরুর মুহূর্তে ! এই সময় জগৎ মমতাময়ী মা এর মতো হয়ে থাকে । যেন দুহাত বাড়িয়ে টেনে নিতে চায় কোলে , যেন সব কষ্ট মুছে দিতে পারে স্নিগ্ধ আঁচলে । মায়ের স্নেহে পরিপূর্ণ ভোরের আকাশ । মায়ের কপালের সিন্দুর বিন্দু র মতো জ্বলজ্বলে অথচ কমনীয় সূর্য পূব আকাশের কপাল রক্তিমাভায় গৌরবান্বিত করে রেখেছে । আমার মনে হচ্ছিল যেন মায়ের স-প্রসন্ন, প্রশ্রয়ের আশীর্বাদ আমাকে জড়িয়ে রেখেছে ।
আমি ডুবিয়ে দিলাম নিজেকে সৃষ্টির সুখে । ঘুণ পোকার কর্কশ শব্দের ভয় কে উপেক্ষা করে ।
এই ভোরে সৃষ্টি হলো আমার রচনা, আমার সন্তানের মতো… তার সাথে এলো আনন্দ, সৃষ্টির উল্লাস !
সৃষ্ট হলাম আমি , স্রষ্টা ও হলাম ।।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..