ভ্রমণবৃত্ত

অভীককুমার দে
ভ্রমণ
Bengali
ভ্রমণবৃত্ত

এত অসুখ নিয়ে হাসি মুখে তাকাতে দেখি মা ও আকাশকে। মা নিজেও একটি আকাশ। এই দুটি আকাশের শারীরিক কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয় না। কষ্টকে আড়াল করে কষ্টের আড়াল থেকেই আলো ছড়িয়ে দেয়। শুধু বুকের ভেতর যন্ত্রনা হলে ঐ দুটি মুখে আঁধার নেমে আসে।
আজ প্রথমবার উড়োজাহাজে চড়ার সুযোগ পেয়েছেন। একদিকে অসুস্থ শরীর, অন্যদিকে জীবনের একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এই দুই মানসিক সংঘর্ষের প্রতিফলিত যন্ত্রনায় মাকে যেমন আহত দেখছি, এমন আগে কখনোই দেখিনি। দুটি আকাশ একে অপরকে দেখছে। দুটি অসুস্থ আকাশ এবং আমার শহর থেকে তামিলনাড়ুর উড়োপথে। নীরব দর্শক আমি বন্দরের অপেক্ষায় সময় গুনে চলেছি।

হ্যালো, আপনি মিঠুন বণিক বলছেন?

— হ্যাঁ, বলুন।

আপনার পরিচিত কারোর গাড়ি আছে এয়ারপোর্টে?

— কখন আসবেন?

এয়ারপোর্টেই আছি। চেন্নাই।

— ওঠার সময় বললে ভালো হতো। তবুও দেখছি। থাকলে কল করবো।

আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি।

প্রস্থান পথ ধরে বেরিয়ে আসার আগেই আবার ফোন বেজে উঠল।

— হ্যাল, নিঙ্গে এঙ্গে ইরিকিংলা? না ভেলিয়ে ইরিকে।

কুছ্ সামঝা নেহি। আপ কওন?

— আমকো মিইটুননেএ বেজাআ। গাড়ি লেকে আয়া জি। মিইটুন ম্যরা দোস্ত হে জি।

তিন নম্বর গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। এখানে বেশ গরম। মনে হয় আটত্রিশ ডিগ্রির কম হবে না। যদিও আমার রাজ্য তখনও পুরোপুরি শীতের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বসন্তের ঘরে চোরা আনাগোনা লেগেই আছে। হঠাৎ করে ঋতুকে অন্যভাবে অনুভব করতে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছি। বেলা চারটা গড়িয়ে গেলেও দুপুরের ঝাঁঝালো আভা রয়ে গেছে। একটু পরেই ফোনে জেনে নেওয়া নম্বরের গাড়িটি সামনে এসে থামলো। উঠে পড়লাম এবং চেনা দেশের অচেনা পথে দুটি চোখ শিকারী হয়ে উঠেছিল।

সন্ধ্যা সাতটা পনেরো। আমাদের গাড়িটি ত্রিপুরেশ্বরী লজের সামনে থামলো। লজের বারান্দায় কজন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে আমার বন্ধু প্রদ্যোত চৌধুরীকেও দেখতে পেলাম। চোখেমুখে কৌতূহল। দেখছি, দেখছে। জাতের আদল ভেসে উঠছে প্রতিটি মুখে। গেটের একপাশে জ্বলজ্বল করছে ‘বাঙালি লজ’।

গাড়ি থেকে নামার পর একজন এগিয়ে এসে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম উনি বিকাশ দেবনাথ। ত্রিপুরারই ছেলে। বছর সাতেক ধরে ভেলোরেই আছেন। লজের দেখাশোনা করেন। আমার বিলোনিয়ার বন্ধু অর্জন দেবনাথের সম্পর্কে মামা হন। আমিও তাই মামা বলেই সম্বোধন করলাম।

ইতিমধ্যে থাকার রুম ঠিকঠাক করে দিলেন। রুমে বিছানার পাশাপাশি রান্নার সরঞ্জামও মোটামুটি সব রাখা আছে আগে থেকেই। একটু পরে একটি গ্যাস স্টোভ এনে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সামনের দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা সেরে রাতের খাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। বাড়ি থেকে বেরুবার পর সারাদিন শরীরের উপর বেশ ধকল গেছে। গাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল বলে মা পা নাড়তে পারছে না। বারকয়েক বমিও হয়েছিল। এই মুহূর্তে মা খুব ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাকে শুতে দিয়ে নিজেই রান্না করতে বসেছি। রান্না শেষ হবার পর মাকে ডাকলাম। খেয়ে বিছানায় পিঠ লাগাতেই ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এলো।

জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঘরের ভেতরে আসতেই ঘুম ভেঙে গেছে। আজ তেমন কোনো কাজ নেই। চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভেলোরকে জানতে ও বুঝতে। পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা এই শহরে নিজেকে মিশিয়ে নেবার নেশায় মনের কোথাও জোয়ার উঠেছে। এই জোয়ার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল অনেক কিছু। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলোর জেলার একটি শহর ভেলোর। জেলার সদর দপ্তর এটি।এই শহর রাজধানী চেন্নাই থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে। শহরটির মোট আয়তন ৮৭.৯১৫ বর্গ কিলোমাটার।

ভেলোরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৮৫৭ সালে যে সিপাহ হয়েছিল তারও প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে ভেলোর বিদ্রোহ হয়েছিল। ১৮০৬ সালের ১০ জুলাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন ভারতীয় সিপাহিরা।ভেলোর শহরে সংঘটিত এই বিদ্রোহ একটি পুরো দিন চলেছিল।

ফলাফলস্বরূপ ইংরেজদের দখলে চলে যাওয়া ভেলোর দুর্গটি পুনরায় দখল করে বিদ্রোহীরা। তাছাড়া ২০০ জন ব্রিটিশ সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। আর্কট থেকে নিয়ে আসা ঘোড়া ও আর্টিলারি বাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহটিকে জব্দ করে ব্রিটিশ বাহিনী এবং প্রায় ১০০ জন বিদ্রোহীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সিপাহিদের এটি ছিল সর্বপ্রথম বৃহত্তম বিদ্রোহ।

ভেলোর পূর্ব ঘাট পর্বত থেকে উৎপন্ন পালার নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ভেলোর শহর। সমুদ্র সমতল থেকে ২১৬ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই
শহর। চারদিকে প্রায় নেড়া পাথুরে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে তামিলনাড়ু রাজ্যের নবম বৃহত্তম এই শহরে দক্ষিণের মানুষের সাথে প্রতিদিন মিশে যায় দেশের বিভিন্ন রাজ্যের অচেনা মানুষের স্রোত। এই স্রোত ২০১১ সালের আদম শুমারি অনুয়ায়ি ৪,৮৬,৯৬০ জন স্থানীয় মানুষের জীবিকার বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কেননা, ফোর্ট সিটি বা দূর্গের শহর হিসাবে পরিচিত এই শহর চিকিৎসার ক্ষেত্রে জগৎ বিখ্যাত। প্রায় বারো হাজার রোগী প্রতিদিন শুধুমাত্র সিএমসি তেই চিকিৎসা করাতে আসে। তাছাড়াও রয়েছে নারায়ণী হাসপাতাল। রোগীদের থাকা খাওয়া, যাতায়াত, প্রয়োজনীয় সামগ্রী এই সব কিছুকে ভিত্তি করে স্থানীয় মানুষেরা খুঁজে পেয়েছে নিজেদের জীবন যাপনের কর্মসূত্র। এছাড়া ভেলোর শহর চর্ম শিল্পের জন্য বিখ্যাত। শহরে চর্মজাত দ্রব্যের এক বিরাট শিল্প গড়ে উঠেছে। এখান থেকে চর্মজাত দ্রব্য দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ও বিদেশে রপ্তানি করা হয়।

সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার পর লজে ফিরে আসি। একটু পরে ত্রিপুরা থেকে মনোজ দেববর্মাও এসে পৌঁছে গেছেন। তিনি কলকাতা বিমানবন্দরে থাকাকালীন সময়েই ফোনে জানতে পারি স্ত্রীকে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে আসছেন। উনাকে সিএমসি’র কাছে একটি হোটেলে পৌঁছে দিলাম। সেখান থেকে রুমে ফিরে এসে মাকে ডাকলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়েই মা’র সাথে আলাপ হলো এ সব কিছু নিয়ে। বাবা, ভাই আর বোনের সাথেও কথা বলে নিলাম। তারপর রান্না করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে।

সারারাত পাখা চলার পরও সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি পুরো শরীর ভিজে গেছে। অস্বস্তি লাগছে খুব। উঠে মুখ ধোয়া, স্নান সবকিছু একসাথে সেরে নিলাম। আজ মাকে ডাক্তার দেখানোর সময় ধার্য আছে। বারোটার আগেই হাসপাতালে যেতে হবে। রান্না পর্ব শেষ করে মা ছেলে একসাথে খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। হাসপাতালের নিয়মকানুনের সাথে একেবারেই অপরিচিত আমরা। তবুও সেই স্রোতে গা ভাসাতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। এমআরও থেকে টোকেন নিয়েছি। তাতে সময় ও সিরিয়াল নম্বর লেখা আছে। অপেক্ষা করছি ছয়শ এ এর ওয়েটিং রুমে। কিছুক্ষণ পর ডিজিটালি ডিসপ্লে হলো নম্বর। ডাক্তারের রুমে ঢুকলাম। ভাঙা ভাঙা আধা বাংলায় প্রশ্ন করছেন ডাক্তারবাবু। অনেক খুটিনাটি বিষয় জেনে নিয়ে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দিলেন। সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাৎকারের জন্য চৌদ্দ তারিখ ধার্য করে দিয়ে বললেন যতটা সম্ভব টেস্টগুলো আজকেই যেন সেরে নেওয়া হয়। মা’র খুব ভয় হচ্ছে মুখ দেখেই বোঝা যায়। যদিও মুখে কিছু বলছেন না। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়ে টেস্টগুলো করাতে হলো। সবগুলো টেস্ট শেষ করে যখন লজে ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই।

বারো তেরো দুদিন খেয়ে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। ভাবলাম এভাবে সময় নষ্ট করে কাজ নেই। বরং এক দুটো জায়গা ঘুরে আসা যায়। এখানে খুব গরম বলে বাতের ব্যথা তেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। মাও তাই আপত্তি করছেন না। যেই ভাবা সেই কাজ। পাশের রুমের রাজু ও তার মা সহ দুপুরের পর বেরিয়ে পরলাম আমরা। রাজু মানে রাজু মজুমদার। দক্ষিণ ত্রিপুরার চন্দ্রপুরের ছেলে। অল্প বয়স। ভেলোরে অনেকবার এসেছে। থেকেও গেছে অনেকদিন করে। ভালো তামিল বলতে পারে। হৃদরোগে আক্রান্ত মাকে নিয়ে এসেছে চিকিৎসা করানোর জন্য। খুব মিশুক ছেলে। দু একদিনেই বেশ মিশে গেছে। ওরা সাথে যাবে জেনে ভালো লাগছে। সংখ্যায় ভারি হলে ঘুরতে বেশ লাগবে।

একটি অটো রিক্সা থামিয়ে রাজু জিজ্ঞেস করলো–

গোল্ডেন টেম্পল পরিংলা?

— আমা।

নিঙ্গে আপ এন্ড ডাউনলে এওয়েলো বেনু?

— মুনুউতি আম্বুরুবা।

অটোতে বসে পড়লাম আমরা চারজন। রাজু ছাড়া বাকি কেউই তামিল ভাষা বুঝি না। আরও অনেক কথা হলো ওদের। আমরা তিনজন ওদের মুখের দিকে চেয়ে আছি। মনে হচ্ছে, কেমন নিঃশব্দ ছেয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতর। অনুভূতিরা দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকেই পর করে দিচ্ছে আমার কাছে। কটা শব্দ আমাকে মানুষের ভালোবাসা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারিনি। ভেলোর থেকে ৮.৯ কিলোমিটার দূরে থিরুমালিকিকোডি অথবা মালাকোডি গ্রামের সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রীপুরম আধ্যাত্মিক উদ্যানের অভ্যন্তরে সোনালী মন্দিরটি রাস্তা থেকে চোখে পড়ে না। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ দোকানিদের চোখে ক্রেতা খোঁজ।

প্রধান দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছি। আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও অঘোষিত কিছু নিয়মের মধ্যে যেন ডুবিয়ে দিচ্ছে কেউ। লোহার জালে ঘেরা নারী পুরুষের পৃথক রাস্তা। ভেলোর স্বর্ণ মন্দির দর্শন করতে গেলে মা- ছেলে, ভাই- বোন, স্বামী- স্ত্রী, অথবা কোনও সম্পর্কই গভীর নয়। ধর্মের জালে লোহার প্রতিবন্ধকতা। পৃথক পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে নারী আর পুরুষ। জালের মাঝ রাস্তায় সিকিউরিটি গার্ড তন্নতন্ন করে খুঁজলেন শরীর। তারপর মোবাইলটা রেখে একটি পাঁচ টাকার টোকেন ধরিয়ে দিলেন। পথের শেষে কতগুলো জালের কক্ষ এবং সামনের দরজা খোলার অপেক্ষায় মানুষগুলো ছটফট করে। এক সময় নিয়তির জনঢল এগিয়ে যায় পথের নির্দেশে। টালির ছাউনির নিচে লুকিয়ে আছে তারকাপথ। তারকাপথের মোট দৈর্ঘ্য ১.৮ কিলোমিটার। মাঝে স্বর্ণ মন্দির। শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ স্বর্ণ মন্দিরটি একটি তারকা আকৃতির পথের ঠিক কেন্দ্রেই নির্মিত হয়েছে। যাতে মন্দিরটি প্রকৃতি থেকে অনেক ইতিবাচক শক্তি শোষণ করতে পারে। এটি তারকা আকৃতির পথের বেষ্টনীর ভেতর বলে একে শ্রীচক্র ও বলে। একশ একর জমির উপর এক হাজার পাঁচশ কেজি বিশুদ্ধ সোনা দিয়ে তৈরি হয়েছে এই মন্দিরের মুকুট।

ভারতীয় নির্মাণের নিরিখে বিশ্লেষণ করলে বলতেই হয় এই মন্দিরের মুকুটের নকসা জটিল নকসাগুলির মধ্যে একটি। স্বর্ণ ও রূপার জটিল শিল্পকর্মে বিস্ময়কর এই মুকুটটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০০৭ সালের ২৪ আগস্ট।

এই মুকুটটিকে ভিমানাম বা অর্ধ মন্দাপাম ও বলা হয়। স্থাপত্য ইতিহাসের বৃহত্তম মন্দির বলে বিবেচিত এই মন্দিরের গঠন ও অবস্থান দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, ভক্তদের শান্তি ও বিশ্রামের দিক বিবেচনা করেই তৈরি করা হয়েছে। এখানকার মানুষ বিশ্বাস করেন যে, এই তারকা-আকৃতির পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভক্তরা ন্যায়বিচার ও সত্যের বার্তাগুলি পড়ার জন্য আশীর্বাদ পেয়েছেন যা তাদেরকে শক্তিশালী ও সর্বোচ্চ প্রাণী রূপে রূপান্তরিত করার অনুমতি দেয়।

মন্দির থেকে প্রস্থানের পথ ধরে যতই এগিয়ে যাচ্ছি মনে হচ্ছে, মোবাইলটা সঙ্গে থাকলে মনের উপর চাপ কম পড়তো। তাছাড়া স্মৃতির চাপে স্মৃতি চাপা পড়লে বন্ধুর মতই টেনে বার করে ছবিতেই দেখাতো সুখের ছবি। যতই মোবাইল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই দূরে সরে যাচ্ছিল স্বর্ণ মুকুট।

দুই. 

আজ খুব সকালেই ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা ছিল। রাজু বললো এতো গরম মাথায় নিয়ে বেরুলে ঘুরে দেখার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে, বরং বিকেলে বেরোনোটাই ঠিক হবে। আমিও আর দ্বিমত করলাম না। দুপুরের খাবার খেয়ে একটি অটোরিক্সা নিয়ে শহরের অলিগলি ধরে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেছি ভেলোর পোর্ট।

দুর্গের মূল ফটকের বাইরে থেকে হেঁটে যেতেই বেশ ভালো লাগছে। রোদের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। দুদিকের খোলা মাঠে কিছু মানুষ দলবদ্ধভাবে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দুর্গকে ঘিরে রেখেছে জলাশয়। যতই ভেতরে ঢুকছি শহরে থেকেও কেমন হারিয়ে যাচ্ছি ইতিহাসের কোলে। বিশাল পাথরের বাড়ি আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন কালের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলীর দিকে। যতই দেখছি ততই হারিয়ে যাচ্ছি। পাথরের গায়ে হাত রেখে অনুভব করতে ইচ্ছে করছে স্পন্দন। মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘোড়ায় চড়ে কোনো এক রাজা বা সৈনিক বেরিয়ে আসবে। মুখোমুখি হবো ওদের।

পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি জলবেষ্টিত বিশাল প্রাচীরের দিকে। ইতিহাস প্রেমিক মানুষগুলো এদিক ওদিক ঘুরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে আর আঙুল দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ করছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে। প্রাচীরের উপর উঠে পরলাম আমি আর রাজু। মা আর মাসিমা নিচ থেকেই দেখছে। উপর থেকে চতুর্দিক বেশ ভালোই দেখা যায়। জলাশয়ের কাছাকাছি দুর্গের দেয়ালে দুর্গ রক্ষীদের নমুনা মুর্তি দাঁড়িয়ে আছে। দুর্গ থেকে গভীর খাদযুক্ত এই জলাশয়ের জল তেমন পরিস্কার নয়। এখান থেকে পাহাড়টিকে দেখলে মনে হয় ভেলোর শহরকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ভেতরে কিছু মন্দির আর কিছু মানুষ ঝুপড়ি বেঁধে জীবন কাটাচ্ছে।

খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম, ১৩৩ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে বিস্তৃত এই দুর্গটি। এক সময় দুর্গের বাইরে এই ময়লা জলে ও জলের আশেপাশে প্রায় ১০,০০০ কুমিরের বাড়ি ছিল। বাইরে থেকে কেউ হামলা চালানোর সাহস করলে কুমিরগুলোকে অতিক্রম করা কষ্টকর ছিল। ভেলোর শহরের বুকে অবস্থিত এই দুর্গ সামরিক স্থাপত্যের একটি সূক্ষ্ম উদাহরণ বলা চলে।

শিলালিপি অনুসারে, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধিনায়ক ১৬ শতকের মাঝামাঝি এই দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার এ’রকমও আলোচিত হয় যে, ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সদাশিব রায়ের অধীনে উপমহাদেশীয় উপপত্নী চিলা বোমি রেড্ডি ও থিম্মা রেড্ডি নায়েকের জন্য ভেলোর দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। ৫,৩৮,২৩১.৯০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই দুর্গের ভেতর একটি মন্দির, একটি মসজিদ এবং একটি গির্জা রয়েছে। হিন্দুদের দ্বারা সম্মানিত এই মন্দিরে প্রশংসনীয় ভাস্কর্য শিল্প চোখে পড়ে, যা যাদুবিদ্যা নৃবিজ্ঞান, বোটানি, ভূতত্ত্ব, সংখ্যাসূচক, প্রাক ইতিহাস, এবং প্রাণিবিদ্যার নানান চিত্র প্রদর্শন করছে। এই মন্দিরটি শ্রী জলকন্দেশ্বর মন্দির নামেই পরিচিত। গির্জাটিকে সেন্ট জনস চার্চ বলা হয়। ১৮৪৬ সালে নির্মিত এটি ভেলোরের প্রাচীনতম গির্জা।

ইতিহাস বলছে, বিজয়নগর শাসনকারী রাজবংশের শেষ ব্যক্তি আরভিদাস ১৭ শতকের মাঝামাঝি ভেলোরের বিজাপুর সুলতানের কাছে পরাজিত হন। বিজাপুরের সুলতানরাও এখানে বেশিদিন স্থায়িত্ব জমাতে পারেনি। মাত্র কয়েক দশক শাসন করার পর এই দুর্গ মারাঠা শাসকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। মারাঠাদের শাসনকালেই দুর্গটিকে আর বেশি মজবুত করা হয়। ১৭ শতকের বেশ কিছু বছর দুর্গটি মারাঠাদের দখলে থাকলেও ১৮ শতকের শুরুতেই মুগলরা ভেলোর থেকে মারাঠাদের নির্মূল করে। ১৮ শতকের প্রথম কয়েক দশক অতিক্রান্ত হবার পর ব্রিটিশরা ভেলোর দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৭৯৯ সালে টিপু শ্রীরঙ্গপটনামে টিপু সুলতানের পতন ঘটার পর তার পরিবার পরিজনদের বন্দী করে এই দুর্গে নিয়ে আসা হয় এবং আটকে রাখা হয়।

ফিরে আসার সময় সেই সময়ের অনুভূতিগুলো আমাকে এই সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে কেমন যেন আপত্তি করছে। বারবার মনে হচ্ছে, সেকালের একেকটি রাজবংশের প্রতিটি প্রজন্মের রাজারা রাজ্য, প্রজা আর সম্পত্তি রক্ষার্থে কিভাবে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। তাই তাঁরা রাজা ছিলেন। শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অথচ আমাদের সময়কালে প্রজা রক্ষার জন্য সঠিক কেউ জন্মগ্রহণ করেন না, যাকে গণতান্ত্রিক দেশেও রাজার মতোই সম্মানে অধিষ্ঠিত করা যায়।

নোট: *হ্যাল, নিঙ্গে এঙ্গে ইরিকিংলা? না ভেলিয়ে ইরিকে। (হ্যালো, আপনি এখন কোথায় আছেন? আমি বাইরে আছি।)
* গোল্ডেন টেম্পল পরিংলা? ( স্বর্ণ মন্দির যাবেন?)
* — আমা। (হ্যাঁ)
*নিঙ্গে আপ এন্ড ডাউনলে এওয়েলো বেনু? ( আসা যাওয়ায় কত টাকা লাগবে?)
* — মুনুউতি আম্বুরুবা। ( সাড়ে তিনশ টাকা।)

অভীককুমার দে। জন্ম ভারতের ত্রিপুরায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..