ভ্রমরের ভ্রমণ বিভ্রান্তি: ফিরে যাও চাকা

নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়
ভ্রমণ
ভ্রমরের ভ্রমণ বিভ্রান্তি: ফিরে যাও চাকা

আমেরিকার সানফ্রানসিসকোয় এসে উঠেছি ব্রান্নান স্ট্রীটে, জায়গাটা সমুদ্র তীর। ঠিক একেবারে ঠা ঠা নয়। অ্যালকাট্রাজ আইল্যাণ্ড, ট্রেজার আইল্যাণ্ড, নামক দ্বীপগুলো অতিকায় চেহারা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবর্তী জল সীমানায়। জলকে তারাই শান্ত রেখেছে বড়ো ঢেউ দিয়ে পাড় আছড়ে ফেনা তোলা থেকে। সমুদ্রের কারণেই আস্তানা এলাকার নাম বে সাইড ভিলেজ। পাশে জল বরাবর দামী বাইণ্ডিংয়ের মতো এঁটে দেওয়া পর পর জেটি সমেত চওড়া চাতাল ফুটপাত। সেই ফুটপাতে ওঠার আগে, পেরিয়ে যাওয়ার ঝাঁ চকচকে রাস্তাটার নাম এম্বারক্যাডারো। যার ওপর এদিক ওদিক যাবার দুপাশে দুই দুই চার লেনের রাস্তা। আর মাঝখান দিয়ে যাওয়া এক জোড়া ট্রেন লাইন। সেই লাইন দিয়ে যাওয়া ট্রেনগুলি কলকাতার ট্রামের বড়জোর দেড়গুণ। এছাড়া রাস্তাগুলির দুপ্রান্তে আছে সবুজ রঙ বাড়তি বাইক লেন।

হ্যাঁ ইউরোপের মতো এখানেও প্রচুর সাইকেল চর্চা। কম বয়সে জেনেছিলাম চীনদেশের সাইকেল প্রীতির কথা। ইউরোপে বেড়াতে গিয়ে সচক্ষে দেখেছিলাম ইউরোপিয়ানদের সাইকেল-প্রেম। দামী মোটরগাড়ির মাথায়, পিছনে, সাইকেল বয়ে বেড়াবার জন্যে সসম্মান সাইকেল ক্যারিয়ার। রাস্তায় সাইকেলের ছবি আঁকা বাইক-লেন। বাইক-লেনের আলাদা ট্রাফিক কনট্রোল। তাদের জন্যে পৃথকভাবে লাল-সবুজ আলোর জ্বলে ওঠা নিভে যাওয়া।

ক্লাস সিক্সে সাইকেল আঁকড়ে হাফ প্যাডেল মেরে আসানসোল চষে বেড়ানো ছেলেটার চোখ গোল্লা হয়ে গেছিল। সাইকেল ছাড়া গাড়ি নেই যে দেশের অধিকাংশ লোকের, সেই দেশ সাইকেলকে এতো সম্মান ভালোবাসা দূরের কথা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছু করেছে বলে তার মনে পড়ে না। এমনকি ‘বলে গেছে মহাকবি মাইকেল / যেওনা যেওনা সেথা যেথা চলে সাইকেল,’ বলে পদ্য লেখার মধ্যেও সাইকেলকে গৌরব প্রদান না করার ইতিহাস। বেশি সাইকেল চালালে হাইড্রোসিল হয়ে যেতে পারে বলে ভয়ও দেখানো হয়েছে একসময় এন্তার।

তো ইউরোপের আমস্টারডামের মতো সাইকেল আরোহীদের জন্য আলাদা সিগনাল না থাকলেও, সেইরকমটাই সাইকেল প্রেম এই আমেরিকায়, এই সানফ্রানসিসকোতে। সেই মর্যাদা সেই প্রেম ভালোবাসা। মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার চাকা। কবি বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’-র প্রেম প্রতীক ‘চাকা’। শুধু বিশাল দামী মোটরগাড়ির নয়, সবরকম, বিশেষকরে সাইকেলের চাকার প্রতি এই ধনী দেশগুলোর প্রেমকে অভিবাদন জানাতেই হয়। অধিকতর যেটা দেখার সেটা রাস্তায় রাস্তায় সাইকেল ভাড়ার ব্যবস্থা। ভাড়া দেওয়া নেওয়ার জন্য কোন মানুষ থাকে না সেখানে। সবই হচ্ছে রাস্তায় খুঁটি পুঁতে, তার ডগায় মিটারযন্ত্র বসিয়ে। কার্ড ঢোকাও নাম্বার কি-বোর্ড টেপো। কড়ার অনুযায়ী টাকা ট্রান্সফার হয়ে যাবে তোমার থেকে তাদের ঝুলিতে। তারপর সাইকেল নিয়ে গিয়ে চালাও, যেখানে অনুরূপ সাইকেল স্ট্যাণ্ড আছে ছেড়ে যাও, সেখান থেকে আবার যার প্রয়োজন কার্ড ঢুকিয়ে নিয়ে নাও কেউ। এটুকু বুঝে উঠতে পারলুম, আবার অনেকটাই অবোঝা থেকে গেল।

সাইকেল এবং আরোহী বৈচিত্র্য দেখে দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুটপাতে পদচারণা আমাদের। আর সাইকেলও যে কত রকমের, সরু চাকা, মোটরসাইকেলের মতো মোটা চাকা, গিয়ার লাগানো না-লাগানো, গিয়ারেরও বহুবৈচিত্র্য, বৈচিত্র্য হ্যাণ্ডেলের, সিটের, গয়নার মত লাগানো ঝিকমিক করে জ্বলা-নেভা ফ্রন্ট লাইটের, ব্যাক লাইটের। বিভিন্ন উচ্চতার বিভিন্ন রকম সাইকেল। ইজিচেয়ারে পিঠের হেলান দিয়ে বসে চালানোর সাইকেলও দেখা যায়। আরোহী বৈচিত্র্য প্রসঙ্গ থাক এখানে।

কিন্তু সাইকেল ছাপিয়ে সানফ্রানসিসকোর ফুটপাত এবং বে সাইডের সাইকেল-বে দখল করে আছে আরো দু-একটি যান। সেই চাকাগুলি একটু প্রেমহীন, আর তাদের নিয়েই কথা। তার মধ্যে পড়ে স্কেটবোর্ড, ই-স্কেটবোর্ড, ইলেক্ট্রিক স্কুটার বা মোটরাইজড স্কুটার। সানফ্রানসিসকো বেশ বিব্রত তাদের নিয়ে, কারণ সংবাদপত্রে দোষারোপ করে বলা হচ্ছে ইলেকট্রিক স্কুটার টেক ওভার, বা ইনভেসন অফ সানফ্রানসিসকো। ছোট্ট ছোট্ট দুটি চাকা, অথবা চার চাকার ওপর হাত দেড়েকের এক ফালি ই-স্কেটবোর্ড, যার ওপর দুটি পা আগে পিছু লম্বালম্বি রাখা যায় মাত্র। মাঝখানে একটি মাত্র চাকা রেখে দু-পাশে পা রেখে যাওয়া, এমন এক-চাকা ই-বোর্ডও প্রচুর। ফালি বোর্ডের সামনের অংশে কখনো কোমর উঁচু খুঁটির ওপর হ্যাণ্ডেল। আর হাতে রিমোট কন্ট্রোল।

এমবারক্যাডারো স্কোয়ার আর জেটি এলাকার চত্বরে চত্বরে একটু বখা বেকার টাইপের ছেলেরা ইলেকট্রিক বিহীন স্কেটবোর্ড নিয়ে সবসময় খড় খড় খড় খড় তার ওপর দুপায়ে খাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। হেঁটে যাওয়া পথচারীদের আশপাশ দিয়ে সাঁই সাঁই বাঁই বাঁই তাদের যাওয়া আসা। আর সবসময় কেরামতি দেখানো। স্কেটবোর্ড চালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা ওঠা। দেড় ফুট আড়াই ফুট উঁচু জায়গা পেলেই স্কেটবোর্ড সমেত লাফিয়ে উঠবার চেষ্টা। আর স্কেটবোর্ড, সে তো আর পায়ের সাথে সুতোদড়ি দিয়ে বাঁধা বা স্করু দিয়ে আঁটা নেই! সে সর্বদাই চালকের পায়ের থেকে আলাদা হয়ে যেতে চায়। আর চালক চায় তাকে পায়ে আঠার মতো লাগিয়ে রাখতে। আজ্ঞা পালন করাতে। সরু রেলিং-এর ওপর দিয়ে তাকে পিঠে নিয়ে স্কেটবোর্ড মসৃণ নেমে আসবে, উঠে যাবে। ঢালু চড়াই উতরাই গুরগুরিয়ে পেরিয়ে যাবে। অনন্ত সময় ধরে চালকের চাওয়া আর বাহনের না চাওয়া খটাখটির নাম স্কেটবোর্ডিং গেমস। বোর্ড লাফিয়ে পালায়, ছিটকে ওঠে, দূরে গিয়ে পড়ে। আর চালকেরা বারবার তাকে পদানত পদাঘাত করেই যায়। কি ধাতু দিয়ে তৈরি কে জানে একটি বোর্ডকেও ভাঙতে দেখিনি। ভেঙে যাবার মতো কঠিন শব্দ শুধু। ওই বোর্ড ছিটকে চালকের পায়ে লাগলে হাড্ডির ব্যথা বছর খানেক থাকবে নির্ঘাৎ। গায়ের পাশ দিয়ে গেলে পথচারীরা শুধু শব্দ আতঙ্কের শিকার হয়, তাদের গায়ে লাগার চান্স কম। কিন্তু যারা স্কেটবোর্ড নিয়ে কেরামতি দেখাচ্ছে তাদেরই গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঠোকা লাগার, রেলিং থেকে হড়কে হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু যৌবন জলতরঙ্গ, আবার যদি বাউণ্ডুলে প্রকৃতির হয়, কোন দেশেই কেউ রুধিতে পারে না। শ্রেণি চরিত্রের সঙ্গে চাকা চরিত্র পালটে যায়। অফিসের বা অন্যান্য সিরিয়াস কাজে যাওয়া বাবু বিবিরা স্পোর্টসে নয়, ধান্দায় যাতায়াত করেন। তাদের সফিসটিকেটেড উপস্থিতি দেখা যায় ই-স্কেটবোর্ডে, মোটরাইজড স্কুটারে। এগুলি ঘণ্টায় সাতাশ মাইল পর্যন্ত গতিবেগ তুলতে পারে।

সানফ্রানসিসকোর বে-সাইড ফুটপাতচারীদের আতঙ্কিত করে সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে বইকি। জীবনে এমন আরোহী, এমন চক্রযান না দেখা বাঙালি হাঁ করে দেখতে থাকে। মুগ্ধতায় তাহার দৃষ্টি পরিপূর্ণ, বিবশ হয়ে যায়। আহা এরকম একটি দেশ, এরকম রিমোটকন্ট্রোলে দাঁড়িয়ে ছুটে চলা একটি চক্রযান যদি তার থাকতো! এরকম পুলিশ না থাকা যন্ত্রের সাহায্যে ট্রাফিক কন্ট্রোল, ফোর স্টপ দেওয়া চৌরাস্তার চৌমাথা নির্দেশ,যেখানে কার নিজেই থামবে ভিন্নমুখী আগে আসা গাড়িকে আগে যেতে দেবে, এরকম হর্নের শব্দবিহীন রাজপথ, যদি তাদের নগরে শহরে থাকতো! বাঙালির দেশে হর্ন দেবার জন্যে হাত নিশপিশ। ট্রাফিক জ্যাম হলে অসংখ্য হর্নের গগনভেদী আর্তনাদ। বাঙালি ইউরোপে দেখেছে আমেরিকাতেও দেখলো, কেউ কোন সেরকম মাত্রার গর্হিত ড্রাইভিং করলে তবেই পিছনের গাড়ির হর্ন দেওয়া, মানে কড়া ডোজের বকুনি দেওয়া। পিছনের গাড়ির হর্ন শোনাকে অপমান জ্ঞান করা হয় আমেরিকায়। সেইজন্য সহজে হর্ন বাজে না যানবহুল রাস্তায়। নিঃশব্দ পিঁপড়ের সারির মতো দামী বিলাসবহুল মোটর যানের চলাচল। আহা! কী সুশৃঙ্খল দেশ। এইরকমই ভাবছিল সে বাঙালি, একদিন স্কেটবোর্ডের চারণ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। তখনই নিজের দেশের আধা-শহরের ডেসিবেল না মানা বিসর্জন মিছিলের কান ফাটানো পেল্লাই এক ডজন বক্সের বাজনা। যেন তেমনই মদমত্ত বখাটে ছোঁড়াদের কারবার। এই ডিসিপ্লিনড ড্রাইভিং, এই ট্রাফিক পুলিশবিহীন, হর্নহীন রাস্তায়, একমাত্র দানবীয় ব্যতিক্রম, মেইন রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ গাঁক গাঁক করে যাওয়া ওই বৃহতাকার মোটরবাইকগুলি। কালো কালো অদভুত বিশালাকৃতি তাদের। দুপাশে বড়ো বড়ো বিভিন্নাকৃতি বাক্স আঁটা। দামে মোটরকারের সমতুল্য। যে ডিজাইন আমাদের দেশে দেখা যায় না, সেই তাদের গৌর নিতাইয়ের মতো অধিকাংশ দুহাত তোলা হ্যাণ্ডেল। আরোহীরা সম্ভবত সাইলেন্সর পাইপ খুলে রাখে। এরকম এক-একটি মোটরসাইকেল, সানফ্রানসিসকোর অন্যান্য ডিসিপ্লিনের সঙ্গে এক্কেবারে বেমানান, এক-একটি শব্দ দানব। ভট ভট ভট ভট চরম উচ্চতায় দু-চাকা মোটরসাইকেলের যান্ত্রিক আওয়াজের সাথে বক্স নিঃসৃত একই উঁচু মাত্রার হার্ডকোর রক মিউজিকের পিলে চমকানো সংমিশ্রণ ঘুরপাক খায়। বিশাল আকাশ ছোঁয়া হাইরাইজের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে। সচকিত করে আতঙ্ক মাখিয়ে চলে যায়, চার লেন রাস্তার চার চাকা, দশ চাকা, ট্রেন আরোহীদের, ফুটপাতে পথচারীদের। এটা খুবই বেআইনি বলে মনে হয় আমার। এই সুশৃঙ্খল পথব্যবস্থার সাথে একেবারে খাপ খায় না, মানায় না। পুলিশ প্রশাসন এটাকে প্রশ্রয় দেয় কী করে, বা মানিয়ে নেয় কী করে, নাগরিকরা কী আমাদের দেশের মতোই এই ব্যাপারে অসহায় নীরব দর্শক!! আমার আমেরিকা দর্শনে অন্যান্য অনেক অবাক হবার সাথে এই ব্যাপারেও ভেবে অবাক হই।

নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়। কবি ও গীতিকার। কলকাতা, ভারতে বসবাস। কবি তাঁর পরিচয় প্রকাশে অনাগ্রহী। তারপরও অংশুমালীর পাঠকদের কাছে সংক্ষেপে তাঁর পরিচিতি দেয়ার চেষ্টা। পাঁচটি উপন্যাস এবং শতাধিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে। মুলত লিটল ম্যাগাজিনের সাথেই তিনি যুক্ত। এছাড়া তাঁর নিজের বাঁধা গান গাওয়া দীর্ঘ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..