মচ্ছব

অন্তরা দাঁ
মুক্তগদ্য
Bengali
মচ্ছব

জষ্টিমাসের অমাবস্যে। সেইদিন অধিবাস। পরের দিন থেকে ঠাকুরের পুজো আরম্ভ।রাধামাধবের বিগ্রহ বানের জলে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে তৈরী।বছরকয়েক আগে মন্দিরে চুরি হবার পর নবকলেবর হবার কতা ছিল। তা সে নাকি বিস্তর হ্যাপা, তাই এই নতুন রঙ চাপানো হয়েছে। নীলরঙ শ্যামের পাশে রাই, চাঁপাফুলের মত গা’ তার। জমি-জমা বিশেষ নাই, ক’ঘর যজমান। তবে কিনা গোঁসাই-গোবিন্দ গাঁ,পুজো-পাব্বন দোল-মচ্ছব লেগেই আছে।

তিনধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে সাতপুরুষের মন্দির। সামনে আটচালা, সেখানেই ওই চারদিন ধরে নাম-গান হয়। সংকীর্তন হয় শ্রীখোল বাজিয়ে। কপালে রসকলি, গলায় তুলসীকাঠের মালা, চুলপাড় ফিনফিনে সাদা ধুতি পরে বোষ্টমরা সব নৌকাবিলাসের গান ধরে, একজন মাথা নীচু করে মন্দিরা বাজায়, মূল গায়েনের সাথে দোয়ার দেয় সাঙ্গপাঙ্গরা। মাথায় চূড়ো করে চুল বেঁধে মিঠে-বোষ্টুমি, তার মাখন-মাখন হাত পা, নরুণপাড় ঘিয়ে-রং ধুতি পরে একতারা নিয়ে ঘুরে ঘুরে গান গায়, আহা! কি সুন্দরই যে লাগে তাকে। মন্দিরের গর্ভগৃহের পিছনে ভোগের ঘর, প্যাঁচানো বারান্দা চলে গেছে দরদালান বরাবর। একটুখানি বাঁধানো চাতাল, পুরনো পাতকুয়ো একখানা, চটা-ওঠা উঠোনে ঘাস আর আগাছার চাটাই পাতা। কুয়োর পাশে একটুখানি চলকেওঠা জল পায় বলে ক’টা সন্ধ্যামণির চারা বেড়ে উঠেছে লকলক করে, শ্বেতপুন্যে আর ঢোলকলমীর জংলার ভেতর।

চারদিন ধরে চলে এসব।আগে খুব জাঁক ছিল। আশেপাশের দু’দশটা গাঁয়ের নোক জড়ো হতো। সে অনেককাল আগের কতা, তখন রাস্তা পাকা হয়নি, কারেন্ট আসেনি গাঁয়ে। চারদিন ধরে যেন জজ্ঞি হতো। এখন সব শরিকে শরিকে মোকদ্দমা জমি-সম্পত্তি পাঁচভূতে খাচ্ছে। কুঞ্জভঙ্গের দিন মালসা-ভোগটুকু হয়। পাতপেড়ে খাওয়ার দিন আর নেই। তবু ওই বাড়ি বাড়ি কুটুমজন আসে দুচারখানা, মেলা বসে, যাত্রা-নাটক হয়। আগে তো ফি-বছর ফাংশন হতো,কত গুণীজন আসতো কলকেতা থেকে, ছোটবড় কতরকম চোঙ, ম্যারাপ বেঁধে হ্যাজাক জ্বালানো হতো, নাচাগানা কত কি! সে দিনও নেই সে জৌলুষও নেই। জমিদারবাড়ির মেয়েবউরা সব দলবেঁধে কীর্তন শুনতে আসতো, মোষের গাড়িতে চেপে সাঁঝবেলায় ওই হোথা পশ্চিমপাড়া থেকে। মেলায় কাঠের নাগরদোলা, রঙিন জিবেগজা, পাঁপড়,জিলিপি, প্যাঁপোর-পোঁ বাঁশি, বেলুনের বাঁদর, তারপর ওই ‘ফটাস-জল’ ‘টরে-টক্কা’র বায়না তো আছেই। তখন তো কতায় কতায় এত ছবি তোলার চল ছিলনি, ওই বিয়ে-থা হলে সাদাকালো ফটো দুচারখানা, তাও সে ফটোবাবু এসে তুলে দিলে তবে আর বাড়ির কেউ ম’লে, শ্মশানযাত্রার ছবি আর আলতামাখা পায়ের ছাপের কাগজটুকু নিয়ে যেত ফটোবাবু। তা’ মেলায় একখান স্টুডিও আসতো। টিপিনের পয়সা জমিয়ে ছেলেছোকরাগুলো নুকিয়ে নুকিয়ে ছবি তুলতো সেখেনে,কায়দা করে, বায়োস্কোপের নায়কদের মতো। ফিরতে করতে সেই দশটা এগারোটা বাজতো। পাড়াগাঁয়ে সেই জোনাক-জ্বলা গা ছমছম অন্ধকারে, মাঠ পেরিয়ে ঘরে আসা, গাড়ির পিছনে ঝুলতো সবজে হ্যারিকেন।

দেউড়িতে তখনো বড়কত্তা জেগে

“হারাণ এলি নাকি রে? “

“এজ্ঞে বাবুমশায় ” ।

গাড়োয়ান ছাড়াও দুখানা কিষেন থাকতো সঙ্গে। ছেলেমেয়েরা তখন ছইয়ের ভেতর ঘুমিয়ে কাদা। সোহাগী গিন্নিমায়ের সদ্যকেনা চুড়ি, ফিতে,শৌখিন দরকারী-অদরকারী জিনিষে মশগুল হয়ে থাকতো জষ্টিমাসের তারায় ভরা রাত।

তবু, বছরকার সাধ, ছেলেপুলেরা বায়না করে, হয় সবকিছুই নমো নমো করে। ভিয়েন তো বসে না আর আগের মতন ওই দোকানের খাজা-গজা কিনে আনা, আগের মত সোয়াদও নেই তাতে। এখনকার ছেলেপুলেরা ওসব শালপাতায় মোড়া চপ-ফুলুরি, মন্ডা-মেঠাই খেতে চায় না, এখন সব রেস্টুরেন্টের চল হয়েছে গো, কিসব বাহারের নাম, চিকেনরোল- মোমো- পাপড়িচাট,বাপের জম্মে খাইনি বাপু! লাল-শালুতে মোড়া কুলপিও আর নেই,ছাতাওয়ালা আইস্ক্রিমের রমরমা এখন।

সারাবছর নুকিয়ে চিঠি-লেখা মানুষটার সাথে দেখা হত একবার এই মেলা-মচ্ছবে। বাড়ির লোকের চোখ এড়িয়ে হাতের ফাঁকে গুঁজে দিত একছড়া পুঁতির মালা, একশিশি সুগন্ধ-আতর। সেসব দিনে তো আমাদের বাড়ির বাইরে বেরোনোর যো ছিল না পাল-পাব্বন ছাড়া, তাকেই দুচোখ খুঁজতো ভীড়ের মাঝে, আবডালটুকুও সইতো না।

মেলা-ফেরত রাতে দোতলার ঘরে বিছানা পাততে গিয়ে, শিবতলার দিকে চোখ যেত, ভাঙা মেলা, মানুষজন ঘরমুখো, যত্রতত্র এঁটো শালপাতা, ইতস্তত কয়েকটা নেড়ি কুকুর। দীর্ঘদেহী মানুষটি হয়তো তখনও তাকিয়ে আছে দোতলার ঘরটির দিকে,ধুতির খুঁটে মুছে নিচ্ছে কপালের ঘাম। একমাথা ঝাঁকড়া চুলে গাঁয়ের মেলার লালধুলো। একটা একটা করে আলো নিভে আসে দেউড়ির। জোনাক ওড়ে,তালগাছের মাথায় তখন পেঁচাদের অধিবেশন। উড়ে উড়ে, চীৎকার করে ওরা প্রেম করে,ভালোবাসে। ওদের সবটাই স্বকীয়া। পরকীয়া নেই। প্রেমও বদলে যাচ্ছে কত!

রাধামাধব! রাধামাধব!

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ