মজুর

জাকির বিশ্বাস
গল্প
মজুর

লিকিলিকে ছেলেটি ঢাকার এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশনে নামতেই অন্ধকার নেমে আসে চারপাশে। বাড়ী থেকে যখন বের হয় তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। হাতে ময়লা চিটচিটে ইঁদুরে কাটা  ব্যাগ, কাঁধে ঝুলিয়ে যখন হাটছিল তখন অনেকটা সাহেবী ভাব এসে যাচ্ছিল।

উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করলে মনে হয় আজ শহরের কোনো কলেজে অনার্স পড়তে পারতো। যদিও নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হতো। বাবা কৃষি কাজ করে আর কত দুরই বা পড়াবে! তার ওপর ছাত্র হিসেবে ভাল না। এক বুক আশা নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। প্ল্যাটফরমে এত মানুষের ভীড়-ভাট্টা দেখে নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে আশাগুলিকে দেখে নেয়।

পাশের গ্রামের দেলু ভাই আব্বাকে নাকি খবর দিছে রঞ্জুকে পাঠায় দিতে কারখানায়। হেলপার লাগবে। দেলু ভাইয়ের পুরা নাম, দেলোয়ার হোসেন। আব্বা ঠিকানা হাতে ধরায়ে দিছে। সংগে মোবাইল থাকলে আর কাগজে লিখতে হতো না। বলেছে এয়ারপোর্ট স্টেশনে নেমেই মোবাইলের দোকান থেকে দেলুকে ফোন দিতে।

রঞ্জু ইচ্ছে করলেই তার বাপের সাথে কৃষি কাজে যোগ দিতে পারত। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার কৃষি কাজ ভাল লাগে না। লোকে আড়ালে চাষা ভুষা বলে গাইল দেয়। দেলু ভাই নাকি ফার্নিচারের কারখানায় কাজ করে! আব্বা তো প্রথমে শুনেই অবাক। ফার্নিচারের আবার কোম্পানি হয়। সে তো আমাদের রহিম শেখরে ডাক দিলিই বানায় দেয়, তার জন্যে আবার কোম্পানি দেয়া লাগে নাকি। আরো কাঠের বিকল্প হিসেবে কী কী যেন বানায়। আবার কাঠের স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য কী করে! বলে, কাঠ লাইফ গ্যারান্টি, ঘুণে ধরবে না।

বাপের কৃষি কাজে সারা বছর ধরে যে ফসল ফলে তা বিক্রি করে সংসার ঠিকমতো চলে না। যা বিক্রি হয় তাতে লাভ হয় পাইকারদের। দেলু ভাইকে বলে রেখেছিল রঞ্জু ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে বসে আছে। তোমার কারখানায় যদি একটা কাজ জোটে তাহলে খবর দিতে।

প্ল্যাটফরমের কলাপসিবল গেট দিয়ে বের হতে না হতেই নিজের ভেতরের অন্ধকার আর বাইরের অন্ধকার মিলেমিশে এক হয়ে যেতে লাগে। খুব অসহায় অসহায় লাগে। সামনে তাকিয়ে দেখে প্রচুর মানুষ আর প্রচন্ড শব্দে চারপাশ দুলছে। শব্দের কারনে নিজের অসহায় বোধ আরো গভীর হতে থাকে। হঠাৎ করেই আব্বার কথা মনে পড়ে, ” দেলুক মোবাইল করিস”। প্যান্টের বাম পকেটে হাত দিতেই উঠে আসে কাগজে লেখা মোবাইল নাম্বার। আশে পাশের মোবাইল দোকান খুঁজতে থাকে, একটু দূরে কড়ই গাছের নীচে এক দোকানে ” ফোনে কথা বলা যায়” লেখা দেখেই ঢুকে পড়ে।

ওভারব্রীজটা পার হতেই নজরে আসে, রাস্তায় কোনো বাস নেই। পাশ থেকে গুঞ্জন ওঠে, “টঙ্গীর গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে, ওভারটাইমের টাকা দেয় নাই, আরো কী কী সব দাবি। আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত সব আটকানো”। রঞ্জু কাওকে ডেকে যে জিজ্ঞেস করবে তার উপায় নেই। অনেকেই হেটে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত যাচ্ছে।“শালা ছোটলোকের দল, আর কাম পায়নি, মালিকের সাথে লাগতি গেছে”।রঞ্জু হাটা শুরু করতেই শুনতে পায়।প্রথমে তাকে আব্দুল্লাহপুর যেতে হবে, তারপর সরকার মার্কেট।হাটতে হাটতেই “ছোটলোক” শব্দটা রঞ্জুর মাথায় জেঁকে বসে স্মৃতির হাপর টান দেয়। ভরা সন্ধ্যায় একদিন আব্বা বাইরে থেকে রাগ করে বাড়ীর ভেতর ঢুকেই চ্যাঁচ্যাঁতে থাকে, “নতুন রূপপুরের সালাম মন্ডল, ছোটলোকের বাচ্চা বুলি গাইল দেয়, আমরা চাষা ভুষার কাম কইরি বুলি কী আমাদের কোনো মান ইজ্জত নাই, আরে তুরা যে খাবার খাইস তা আমরা না ফলালি কী পাতিস?” এই ছোটলোক তকমাটা পিঠে মনে হয় সাইনবোর্ডের মতো বিধে আছে। রঞ্জুর তাই ভয় করে,ভয়ের ডালপালা ছড়াতে থাকে।ভাবে, বাপের কাজ আর যে কাজে যাচ্ছে- এর মধ্যে আসলে কোন তফাৎ আছে নাই।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..