মণিকার মন

মৃদুল শ্রীমানী
ছোটগল্প
Bengali
মণিকার মন

 

মণিকাকে আমি রণিতা বলে ডাকতাম। কেন না, প্রায়ই সে তার বরের সাথে ধুম ধাড়াক্কা লড়াই করত। না, লড়াই বলাটা ঠিক হবে না। মণিকা প্রায়ই হাত চালাতো আর স্নেহাশিস মার খেতো। বরকে মণিকা ভয় দেখাতো গায়ে কেরোসিন ঢেলে সোজা থানায় চলে যাব। বলব গায়ে আগুন দিচ্ছিলে, আমি পালিয়ে এসেছি। স্নেহাশিস জানতো বিয়ের সাত বছরের মধ্যে বউ অপঘাতে মরলে ভারতীয় আইন স্বামীকে ভীষণ সন্দেহ করে। সেই ভয়ে সে চুপচাপ বউয়ের তাড়না সহ্য করত। মণিকা স্নেহাশিসকে দাবিয়ে রাখতে বরের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আনত। স্নেহাশিস কাজ করত একটা অসরকারী সেবা সংস্থায়। সেখানে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ। স্নেহাশিসের উপর ওয়ালাটি ছিল এক সুশ্রী তরুণী। নাম তার রুমা। সে খুব চমৎকার পড়াশুনা করা ডিগ্রি ডিপ্লোমা ওয়ালা মেয়ে। ঝকঝকে ইংরেজি সর্বদা রুমার ঠোঁটে। মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারের কাজ করতে প্রায়ই তাদের গ্রামে যেতে হত। সংস্থার চার চাকা ওয়ালা গাড়ি থাকলেও গ্রামে গাড়ি চলা পথের অভাবের জন্য বাইক নিয়ে যেতে হত। গাড়ি নিয়ে সর্বদা চললে মানুষের সাথে মেশাও শক্ত হয়। তাই রুমা বাইকে সওয়ার হয়ে গ্রামে গ্রামান্তরে যেত। সে বাইক প্রায়শঃ চালাতো স্নেহাশিস।

এই নিয়ে হত সমস্যা। অফিসে যে উচ্চ মাধ্যমিক ফেল করা স্নেহাশিস চাকর বাকরের পর্যায়ে কাজ করে, সেটা তার সুপুরুষ চেহারা দেখলে বোঝা যেত না। মাইনের অঙ্ক শুনলে নিশ্চিতরূপে বোঝা যেত। মণিকা নিজে গ্রাজুয়েট বলে নিজেকে রুমার সমকক্ষ ভাবত। আর বাইক চড়ে তারা দুটিতে গ্রামে যায় শুনলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যেত। বাইক চালাতে থাকা পুরুষ, আর পাইলন রাইডার হিসেবে সুশ্রী মেয়ে তাকে ছোট বেলা থেকে বার বার দেখা জনপ্রিয় সিনেমাটির কথা মনে করাতো, আর সে ক্ষেপে যেত।

যেদিন স্নেহাশিসের জামায় এক আধটা লম্বা চুল খুঁজে পাওয়া যেত, সেদিন ওদের বাড়িতে একেবারে দক্ষযজ্ঞ লাগতো। অথচ এই মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ফেল স্নেহাশিসকে পাবার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বান্ধবীর বাড়িতে উঠেছিল মণিকা। বাবার দেওয়া নামটা অবধি ফেলে দিয়েছিল সে মেয়ে। নিজেই নিজের নাম রেখেছিল বৃষ্টি। শান্ত হলে সে সব গল্প করত হেসে হেসে। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করেছিলেন? মণিকা হেসে বলত রেজিস্ট্রিটাই করা হয়ে ওঠে নি। আসলে একমাসের নোটিশ দিতে হয় তো। আমাদের অত সময় ছিল না। এই মেয়ে যে কি করে ভালবাসার বিয়ে ভুলে বরের সাথে কাক চিল তাড়ানো ঝগড়া করে, আমার মাথায় ঢুকত না। তাদের রাগারাগির মধ্যেই আমি গিয়ে বকা দিতাম রণিতা, হচ্ছে টা কি? সে মেয়ে রেগে গেলে গায়ে কি পোশাক আছে, কতটুকু আছে, খেয়াল রাখতে পারত না। কলেজে পড়তে এন সিসি করার সময় ব্যায়ামে সাঁতারে মণিকা ফার্স্ট হত। সেই হাত চালানোর দক্ষতা বরের উপর প্রয়োগের অভ্যাস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মণিকার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে খেতে কোনোমতে মাথা আর মুখ বাঁচাত ছেলেটা। ওদের দু দুটো কচি ছেলে মাকে মা কালি সেজে রণং দেহি মূর্তিতে লাফাতে দেখে চিল চিৎকার করে কাঁদত। বাচ্চাদের কান্না শুনে আমি থাকতে পারতাম না। ওদের ঘরে ঢোকার আগে কয়েকবার গলাখাঁকারী দিতাম। তখন মণিকা বেশবাস ঠিক করে নিত। অফিসে পৌঁছায় নি কেন বলে রুমার ফোন এলে স্নেহাশিস ভয়ে তুলতে চাইত না। রুমা ছিল আমার পূর্ব পরিচিত। আমি তাকে সব খুলে বললাম। স্নেহাশিস রুমার কাছে কাজ ছেড়ে দিল লজ্জায়। রুমাও মণিকার উপর বিরক্ত হল। সে তখনও কুমারী মেয়ে। কাজের স্বার্থে স্নেহাশিসের সাথে সম্পর্ক। তার বেশি কিছু নয়। এই ঘটনা শুনে রুমা যথেষ্ট লজ্জাও পেল। কিন্তু বিপদে পড়ল স্নেহাশিস। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারের কাজটা সে বেশ পছন্দ করত। কিন্তু নতুন জায়গায় সেলসের কাজে তার পুরোনো অভিজ্ঞতা কিছুই কাজে লাগত না। কমিশন জুটত না। মাল বেচতে পারলে তবে না কমিশন? বাড়িভাড়ার টাকাটাও জোটানো কঠিন হয়ে পড়লে মণিকা ছেলে দুটোকে নিয়ে উঠলো বাপের বাড়িতে। স্নেহাশিস মুখ নিচু করে ফিরে গেল তার গ্রামের বাড়িতে।

স্নেহাশিসের তাতেও নিষ্কৃতি ছিল না। তার মা বৃদ্ধা হয়েছিলেন। সংসারের ভার বৌদির হাতে। স্নেহাশিস তাঁদের কাছেই আশ্রয় নিতে লজ্জা পেল না। তার সাত বছর বয়সে অনেক বড় দাদার বিয়ে হয়ে বৌদি এসেছিলেন। ছোটো দেওরটিকে তিনি স্নান করানো খাওয়ানো সকল কিছুর ভার নিয়েছিলেন। দুপুর বেলা প্রাইমারি স্কুল থেকে ফিরে বৌদির কাছেই ঘুমাতো বালকটি। পোশাক বদলানোও বৌদির হাতে। স্নেহাশিস বলত, বৌদির কাছে আমার কিছুমাত্র লজ্জাসংকোচ ছিল না। সেই বৌদিকেও সন্দেহ করত মণিকা। বলত, সে ছেলেবেলায় যা করেছ করেছ। তা বলে এখন? স্নেহাশিস কাঁদো কাঁদো মুখে বলত, বৌদি আমার মায়ের মতো। মণিকা মুখ ভেঙিয়ে দেবর শব্দের কদর্থ করত।

কচি কচি বাচ্চা দুটির জন্য স্নেহাশিসের বুক টনটন করত। নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে দেরি হত না। কখনো বেভুল হয়ে বেখেয়ালে কোথায় চলে যেত। থানা পুলিশ করে, রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বরকে ঠিক খুঁজে বের করত মণিকা। তারপর আবার যে কে সেই। অনেক তিক্ততার পর স্নেহাশিস বৌদির সাথে কিছুমাত্র সম্পর্ক রাখবে না, কালি ঠাকুরের পা ছুঁয়ে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে মণিকা তাকে ঘরে নিল।

মনিকাকে বোঝাতাম সর্বদা স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া ঝাঁটি করলে শিশুদের মনের গঠন ভালো হবে না। সে বলত, আমি একটা চাকরি পেয়ে নিই, তার পর একটা চমৎকার বাড়ি করব। সেখানে আপনার জন্যও একটা ঘর থাকবে। আমি বলতাম, আগে তো চাকরি পান। চাকরির প্রশ্নে সে মেয়ের নজর ছিল খুব উঁচুতে। সে আই পি এস হবার স্বপ্ন দেখতে ভালবাসত। নিজেকে সে কিরণ বেদী ভাবত। আমি বললাম, বয়সটা কিন্তু থেমে থাকছে না। দ্রুত কাজ শুরু করুন। যে কোনো একটা সরকারি স্থায়ী চাকরি হোক আপনার। সে মেয়ে ঠোঁট উল্টে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকত।

মণিকা একদিন বলল, সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কি ব্যবস্থা?

মণিকা বললো মাধ্যমিক থেকে শুরু করে গ্রাজুয়েশন অবধি সবকয়টা পরীক্ষার দু নম্বরি সার্টিফিকেট বের করে এনেছি। তাতে আমার বয়স দশ বছর করে কমিয়ে নিয়েছি। এই বলে, সে মেয়ে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল।

আমি তার হাসি দেখে শিউরে উঠলাম।

মৃদুল শ্রীমানী। কবি। জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। প্রকাশিত বই: 'জমি জরিপ,  কি দেখে জমি বাড়ি কিনবেন,  ফ্ল্যাট ও বাড়ি,  তথ্য জানার অধিকার', 'মানুষের বাঁচার অধিকার সংক্রান্ত- মেয়েদের আইন', 'সে একটি পল্লবিত...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ