মনসুর আজিজ এর গুচ্ছকবিতা

মনসুর আজিজ
কবিতা
Bengali
মনসুর আজিজ এর গুচ্ছকবিতা

দরিদ্রের আত্মরক্ষার অস্ত্র

দরিদ্র চিরকাল দাঁড়কাক হয়েই বেঁচে থাকে
বৃষ্টিতে ভিজে কারো মাচার ভেজা বাঁশের খুঁটিতে খুঁজে নেয় আশ্রয়
কখনো চড়–ইয়ের মতো ঠাঁই নেয় কারো ঘরের কোণে
হাড় জিরজিরে বৃদ্ধ মহিষ যেন বয়ে যায় মনিবের বোঝা
দরিদ্রের কোনো আত্মরক্ষার অস্ত্র নেই; কিংবা আক্রমণের
না অঙ্গ, না প্রত্যঙ্গÑ যা দেখে ভয় পাবে
মনিব বা মানুষ, শোষক বা শাসক
চোখ তুলে ফ্যাল ফ্যাল করে কারো দিকে চাইলেও তর্জনি নাচায় সবাই
এক্ষুনি যেন দুচোখের মণি বের করে লটকনের মতো চুষে খাবে
অথচ একটি নিম্প্রাণ সূঁচ দরিদ্রের চেয়ে কতোটা শক্তিমান
অগ্রভাগ সামনে বাড়ালেও ভয়ে জড়োসড়ো সাহসী পুরুষÑ

দরিদ্র চিরকাল বনসাই হয়ে থাকে
বৃক্ষের ছায়ায় খোঁজে রোদের আলিঙ্গণ
অথবা পরগাছার মতো বৃক্ষ বা দেয়ালের মধ্যে খুঁজে নেয় এতোটুকু আশ্রয়
একটি ঘাসের ডগার চেয়েও মূল্যহীন তার জীবন

দরিদ্র তবু স্বপ্ন দেখেÑ
লাল পিঁপড়া হয়ে কামড় দিবে শোষকের গালে
শাসকের ক্ষমতার গদিতে…

 

মানুষখানা

হৃদয় মরু হয়ে গেলে বিবেকের ভূমিতে জন্ম নেয় না বৃক্ষ
বেঁচে থাকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজন বোঝে যাযাবর
বেদেনীর কাছে যেমন প্রয়োজন নদীর
যোদ্ধার জন্য তেমনি প্রয়োজন শত্রু ও তলোয়ার…

তারা কী কখনো আলোকিত করে পৃথিবী?
নাকি পথিকের দিশা হয়ে অনিমিখ জ¦লে থাকে
নিঃসীম অন্ধকারের ভিতরই হয় জীবনের অঙ্কুরোদগম
দীপ্তিময় প্রেমের পরাগায়ন
কয়েদির বুকের গহনেও জ¦লে ওঠে প্রেমের আগুন
একটি আপন পৃথিবী নির্মাণের স্বপ্ন
লোহার শিকল পারে না স্বপ্নকে বেঁধে নিতে

কতোগুলো বাদুর ডানা ঝাপটায় আদালতে, চুষে খায় মানুষের রস
কালো আলখাল্লায় পূর্ণ করে পশুত্বের কলস
চোখের পলকে রায় লেখে দাঁতাল শকুন
শরীরের মাংস খাবলে নিয়ে জমা করে এজলাসে
মাংসাসী পাখিদের দল উড়ে উড়ে গান গায় আদালত অঙ্গণে
প্রিজন ভ্যানে জমা হয় মানব পশু
জেলারের প্লেটে তুলে দেয় কয়েদি
শাকের আঁটির মতো বেচা হয় মানুষখানায়

থকথকে ঘায়ের ভিতর মাছি ওড়ে
আমদানির মানুষ যেন সারি সারি কুরবানির পশু
জেল পুলিশ বুকের ব্যাজ থেকে খুলে ফেলে ‘মানবতা’
কুড়মুড় করে চিবিয়ে খায় কয়েদির হাড়
নিদানে স্বজন কেহ নাই
উচ্ছিষ্ট রুটির জন্য হামলে পড়ে মানুষ
জেলখানা যেন যুদ্ধ-পীড়িত দেশের অচেনা এক উদ্বাস্তু শিবির।

কতোগুলো ধূর্ত শালিক খুটে খায় কয়েদির চোখের মণি
ভয়ার্ত চোখের প্রিজমে ভেসে ওঠে ভালোবাসার দুটি হাত
প্রিয়তার প্রতীক্ষার অগোছালো কিছু স্মৃতি
আত্মজের নরম হাতছানি…

 

কতিপয় শেয়ালের মজমা

কবির অবয়ব,
মূর্ত রঙে
বিমূর্ত প্রতীকে
চেয়ে থাকে;
চোখের প্রিজমে খেলা করে নতুন উপমার পোনা
উঁকি দেয় প্রতীক
নিশুতি রাতের বাঁশঝাঁড়ে
পাখাঝাড়ে বিরহী ডাহুক
কতিপয় শেয়ালের মজমা বসে খামারের পাশে
গুণ-ভাগ মিলে না;
পৃথিবীর তাবৎ খাবারেও মিটে না তাদের তৃপ্তি

ফুলবনে বসে আছে চিত্রকর
আঁকে না পাপড়ি, প্রজাপতি, বুনোপাখিদের ঝাঁক
তুলির নির্মম আঁচড়ে এঁকে চলে কুমিরের ছবি,
ড্রাগন-নখরে মানবশিশু…

খাদ্যের জাহাজ ভিড়বে বলে সমুদ্র তীরে জড়ো হয় প্রাণীকুল;
হাড়-জিরজিরে শিশু, প্রতীক্ষারত নরনারী
চারপেয়ে, দুপেয়ে…
ক্ষুধার রাজ্যে অবশেষে নেমে আসে ত্রাণের কৌটা
পেটে তার জমা আছে আগুনের গোলা…

আলোর গোলক

রোদের চুম্বনে শিশির মিশে গেলে দেখি
শালিকেরা ধানকাটা মাঠে খুঁটে খায় শস্যের দানা
কার্তিকের রোদে চিকচিক করে উড়াল ডানা
মাখন লোদের হাত তোমার উঠোনে মাখে নতুন প্রলেপ
টানটান ঘরের পিড়ায় আঙুলের ছাপচিত্র
মাচা জুড়ে শিমের আগাগুলো লকলকে সাপের মতোই উদ্ধত
রোদের চুম্বনে কিষানির রাঙাগাল রক্তিম হয়ে ওঠে
কে বলবেÑ এই নরম পালকে
নিঃসীম রাতে লেগেছে উন্মত্ত শিকারির ছড়ড়া
তার থেকে জন্ম নিয়েছে পুলকের শিশিরবিন্দু
রোদকলার কারিকুরি ছড়িয়েছে হীরের দ্যুতি…

আমাকে স্পর্শ করো তামাটে শরীর হবে আলোর গোলক।

 

তামাদি যুগের রেখায়

খড়ের গম্বুজ দেখে উঠোনে শালিকেরা নাচে উল্লাসে
আশা বাঁধে মনে, খুঁটে খাবে দানা খড়ের ভাঁজে ভাঁজে
হায়! ধারালো শালিকের ঠোঁট পায়নি ধানের আভাষ
কৃষক মাড়ায়নি ধান শ্রমিকের পায়ে
সভ্যতার মেশিনে ঢুকে গেছে সব
শালিক ছানা চিউ চিউ ডাকছে গাছের কোটরে
দুধের সদাগর মেশিনে ভরে নেয় গাভির ওলান
বাছুর পায় না মায়ের স্পর্শ
গো-মাতার মন হাহাকার করে সেমিপাকা খামারে
ষাড়ের সাথে হয় না আর মাঠ জুড়ে গাভির রমণ
পুরুষও হয়েছে ক্লীব
দিন যায় রাত আসে; হাসে না নারীর মন
প্রবলবর্ষণকালে নেমে আসে বার্ধক্যের জরা
ছটফট পাখিমন খড়ের গম্বুজ দেখে
উল্লসিত হয় না আর তামাদি যুগের রেখায়।

সুখ স্বপ্নের নর্তকী

রাজনীতি পানকৌড়ির মতো সেলাই করে জলের শরীর
ডুব দেয় সুযোগ বুঝে; আবার ভেসে ওঠে
রাজনীতিক সার্কাসের ডলফিন
খেলে যায় ক্ষমতা ও অর্থের লোভে
মাথা বিগড়ে গেলে হাতির শুঁড়ে ছিটকে পড়ে দূরে
দলছুট হরিণেরা বাঘের আহার হয় অবশেষে
রাজনীতি বাজিকরের হাতের ডুগডুগি
বাজালেই জুটে যায় নির্বোধ দর্শকের দল
তারপর চটুল কথায় মোহগ্রস্থ হয়ে ঘরে ফিরে সর্বশান্ত হয়ে
অতল পকেটে জমা হয় যাদুর টাকা
ঝুমুর নাচের তালে তালে সুখস্বপ্নে শ্রমজীবী
মুগ্ধতার রাত্রি উদযাপন করে নর্তকীর কোমড় জড়িয়ে
মাতাল জুয়াড়ি বউ বেচতেই জানে অবশেষে
জনগণ ও রাজনীতির কাছে বিক্রি করে তার বিবেক
উত্তরপ্রজন্মের কাছে মিরাসের অবশিষ্ট থাকে না কিছুই!

প্রকৃতির ঋণ

ঘুমহীন পাখি একলা কী করে রয়
মানুষের মনে কেবল শঙ্কা ভয়
পাখি সুখি হয় নিঝঝুম রাত পেলে
মানুষের সুখ কোলাহল কাছে এলে।

মানব স্বার্থ বজায় রাখে যে পাখি জাতি চিরদিন
নির্মূল করে তাদের আবাস বাড়ায় মানুষ ঋণ
বৃক্ষের সুর মাঝরাতে বাজে পাখির নিরব গানে
মানুষ কেবল বৃক্ষের বুকে কঠিন আঘাত হানে।

মাটির বক্ষে পদছাপ কতো ইতিহাস হয়ে আছে
কখনো ভেবেছি কিছু ঋণ তবু রয়েছে মাটির কাছে?
ইতিহাস তবু শত্রু-মিত্র চেনায় আঙুল দিয়ে
বিরূপ হয় না মাটির হৃদয় পাপের হিসাব নিয়ে।

প্রখর তাপেও বৃক্ষ কেবল বুলায় মায়ার পাতা
আমরা কেবল সারাক্ষণ করি পূর্ণ পাপের খাতা।

জগৎ লুকালো মুখ

পুজারি তোমার দুয়ার কেনো গো খোলা
চোখ নাক মুখ দেখি কেনো ফোলাফোলা
ভাবো যাকে তুমি ভগবান সম সেইজন নরপশু
হোক না সেজন ভট্টাচার্য, চৌধুরী-রায়-বসু।

কামের খায়েসে বিবেক মরেছে যার
সেজন করেছে জগৎকে ছারখার
হরিণির বুকে কৃপাণের ফলা গেঁথে
নরপশুগুলো উল্লাসে ওঠে মেতে।

থরথর দেহ কেঁপে ওঠে যেন ঝড়
বৃক্ষ শাখাও ভেঙে পড়ে মর্মর
বনের পশুরা অবাক তাকিয়ে রয়
বিবেক মরেছে; মূল্যবোধের ক্ষয়?

পুজারি তোমার নিথর দেহের মাঝে
জগৎ লুকালো মুখটি কেবল লাজে।

 

রাতের নাগিনী

রাতের নাগিনী বিষ ঢেলে দেয় মনে
বিষের দহনে কাতরাই ক্ষণে ক্ষণে
বিষ গিলে গিলে হেমলক হয়ে গেলে
নাগিন রাতও আপন মনেই খেলে।

রাতের সুতোয় বিষফুলে মালা গেঁথে
পরাও আবার কুহকীর কতো ছলে
আঁধার চিরে কি সম্ভোগে তার কিছু
গড়িয়ে পড়েছে কামনার নোনা জলে?

উন্মুল মন ভোরের বাতাসে উড়ে
ছুঁয়ে যায় কতো প্রজাপতিদের পাখা
চপল মেয়ের চতুর হাসির রেখা
যায় কি কখনো আঁচলে লুকানো রাখা?

রাতের নাগিনী ফুল হয়ে ভোরে ফোটে
মুগ্ধতা মেখে গোপনেই জেগে ওঠে।

রূপের কারুকাজ

বৃক্ষসারি হাত বাড়ালো বলে
বিদায় দিলাম নগর-জনপদ
সবুজ মাঠও ডাকছে ইশারায়
সাজিয়ে রেখে রূপ অরূপের পদ।

এই নগরের বন্দিশালার পাখি
ছটফটিয়ে উড়াল দিতে শেখে
পাহাড় বলে বিরিক্ষি সংসারে
একলা একা মনের কথা লেখে।

আলোর রেখা পাতার পরে ঝুঁকে
আঁকছে দেখো অস্থায়ী সব ছবি
রঙের লেখা সন্ধ্যাকাশের যেন
অবুঝ মনে আঁকা সে দুর্লভই।

এই অরূপের এমন খেলায় মেতে
উঠছি আমি নগর ছেড়ে আজ
একলা আকাশ বনের ভিতর দেখি
খেলছে কতো রূপের কারুকাজ।

মনসুর আজিজ। কবি। জন্ম ১৯৭৪ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার হাইমচরে। বর্তমান নিবাস ঢাকার মিরপুরে। পড়াশুনো করেছেন ব্যবস্থাপনায় স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর। এরপর এমবিএ। লেখালেখির শুরু ১৯৮৭ সালে স্কুলে পড়াকালীন সময়ে। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ছড়া, গান, গল্প,...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..