মনিনিকার একদিন প্রতিদিন

সজল কুমার মাইতি
অণুগল্প
Bengali
মনিনিকার একদিন প্রতিদিন

সকাল সকাল ওঠা মনিনিকার বরাবরের অভ্যেস। সকালে এক বড় কাপে অর্গ্যানিক গ্রিন টি নিয়ে সোফায় বসে। সঙ্গে দুটো কুকিজ। চা খেতে খেতে পেপার পড়াটা ও তার বহুদিনের অভ্যেস। এখন কিছুদিন হল একটা ঘুঘু ঠিক এইসময় সামনের বারান্দায় থেকে থেকে ডাকতে থাকে। সামনের বারান্দায় বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছের টব বসিয়েছে মনিনিকা। নিয়মিত এগুলোর যত্ন নেয়। কি নেই এখানে ! বিভিন্ন ভ্যারাইটির জবা, বেল, মরু গোলাপ বা অ্যাডেনিয়াম, জুঁই, অপরাজিতা, পাতাবাহার আর ও অনেক কিছু। পেছনের বারান্দায় ক্যাক্টাস ও কিছু অর্কিড ও মাধবীলতা।
মনিনিকার চন্দননগরের এই দুরুমের ফ্ল্যাটের পেছনের বারান্দা দিয়ে গঙ্গা দেখা যায়। কুলু কুলু বিরামহহীন সে বয়ে যায়। মাঝে মধ্যে এখান থেকে গঙ্গার কুলু কুলু বয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে মনি ( মা বাবার আদরের ডাকনাম ) উদাস হয়ে যায়। তখন তার দেশের বাড়ির কথা মনে পড়ে। জেঠু, জেঠিমা, মা বাবার কথা মনে পড়ে। ছোটবেলার বহু স্মৃতি ও। আসলে এই ফ্ল্যাটে সে একাই থাকে। তার ই কেনা।
তা এই মনিনিকা এক অনূর্ধ তিরিশের যুবতী, পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চি লম্বা, তন্বী সুন্দরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ন পদক ও পিএইচডির অধিকারী। এক নামী কলেজের ক্ম্পারেটিভ লিটারেচারের অধ্যাপিকা। অল্প কয়েক বছরের চাকরি জীবনে মনি ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। লেখার হাত ও চমৎকার, সাবলীল। অন্তরের ভাষা যেন কলম মাধ্যমে প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠক শুরু করলে শেষ না করে থামতে পারে না। সংস্কৃতি জগতে ও স্বচ্ছন্দ বিচরন তার। নাটক, কবিতা ও গান প্রিয় বিষয়।
তা এ হেন আধুনিকা রান্না করতে ও ভালবাসে। সহকর্মীদের কত সময় যে কত পদ রান্না করে খাইয়েছে তার হিসেব রাখা নেই। একা একা রান্না করতে করতে মনি নিজের মনে গান করতে থাকে। কখনও সে গান ইংরেজি, তো কখনও হিন্দি। তবে বেশিরভাগ সময় সে বাংলা গান ই করতে ভালবাসে। গানের মাঝে কখন যে রান্না হয়ে যায় তা বোঝা যায় না। রান্নার হাতটা ও চমৎকার। দই পোনা থেকে হরিয়ালী চিকেন। সবই মনির হাতের যাদুতে সুস্বাদু হয়ে ওঠে।
উদাস চোখে মনিনিকা আজ বারান্দা থেকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দেখছে। জোয়ারের জলে গঙ্গা এখন ভরাযৌবনবতী বেগবতী। একটা ছোট্ট জেলে ডিঙি তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে নদীতে জাল ফেলতে ফেলতে। ধীরে ধীরে ডিঙি চোখের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। সব যেন ধোঁয়াশা এখন। মনি নিজের ভবিষ্যতকে ও যেন এই ধোঁয়াশার মতো দেখতে থাকে। তার চার সন্তানের চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। অশান্ত মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ছিয়াশি বছরের জেঠু, আশি বছরের জেঠিমা, সাতাত্তর বছরের বাবা ও সত্তর বছরের মা। এই বৃদ্ধ চার সন্তানের নিত্য নৈমিত্তিক চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য সব ব্যবস্থা তাকেই করতে হয়। এই সবের মাঝে নিজেকে নিয়ে চিন্তার সুযোগ বা অবসর কোনোটাই কখনও হয় নি মনির। চোখের দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যাওয়া ঐ জেলে ডিঙির মতো নিজের ভবিষ্যতের ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। সবকিছুই ঝাপসা হয়ে যায়।

সজল কুমার মাইতি, পিএইচডি। লেখক ও অধ্যাপক। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের কলকাতায়। তিনি মূলত গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে থাকেন। লেখালিখি শখের হলেও পেশাগত জীবনে তিনি ভারতের সরকারি কলেজ 'হুগলী মহসীন কলেজ'--এর বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। এর...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..