প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নীল আকাশ ছাদ। সবুজ ঘাস কার্পেট। ম্যাপল পাতার দেশ কানাডায় হেমন্ত রঙ বৃক্ষ শাখা-প্রশাখায়। পাতাগুলো সবুজ ছেড়ে কাঁচা হলুদ, কমলা, লাল রঙ ধরেছে ধীরে ধীরে। প্রকৃতির বৃক্ষ সন্তানেরা রঙ মেখে হোলি খেলায় মত্ত। সিঁদুর রঙা ম্যাপল পাতা উদ্ভাসিত প্রকৃতি মায়ের রূপ, সম্মোহিত করে মানুষের অন্তর। এডওয়ার্ড গার্ডেনের বেঞ্চিতে নিশ্চুপ বসে জুলিয়েট ও তাপস। নিকট দূরত্বে মাটিকে আপন করে বসে চা পান করে ব্রায়ান-রোজ দম্পতি। তাদের ঘিরে ছুটে বেড়ায় এক জোড়া নিস্পাপ শিশু। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা। পাখির মতোই তাদের মুখের বুলি, অস্পষ্ট; তবুও দানা বাঁধা মিষ্টি গুড় যেন। “মামী…মামী…ড্যাডী…ড্যাডী…সি বাতার ফ্লাই(বাটার ফ্লাই)। আই ওয়ানত তু (ওয়ান্ট টু) ক্যাচ ইত (ইট)।”
বাতাসে দুলতে দুলতে লাল ম্যাপল পাতা এসে পড়ে জুলিয়েটের চুলে। চুল থেকে হাতে তুলে নেয় সে পাতা। গন্ধ শোঁকে। ফিসফিস করে বলে, “রঙ ধরেছিস শরীর জুড়ে, অথচ তোর অন্তরটা শুকনো খড়খড়ে। শেষ পর্যন্ত ঝরেই পড়তে হলো ঠিক আমার রেণুর মতো?” তাপস নিজের মুঠোয় তুলে নেয় জুলিয়েটের হাত। তার কণ্ঠ ধরে আসে সান্ত্বনার বাণীতে, আমাদের সবুজ রঙের বেণু আছে তো। এবারও ক্রিস্টমাসের ছুটিতে আসবে সে। বলেছে, আমাদের নিয়ে ঘুরতে যাবে আইল্যান্ডে।
না, তপু। আমি আইল্যান্ডে যাব না। এবার বেণু এলে, ওকে আমি বাংলাদেশে নিয়ে যাব, যেখানে তুমি আমাকে বিয়ের পর প্রথম নিয়ে গিয়েছিলে। পুরো তিন মাস ছিলাম আমরা সেখানে। তোমার মনে আছে? সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছিলে আমাকে। পাহাড়, নদী, বন, হাওড়, সমুদ্র, হ্রদ এমন কি গ্রামের কুঁড়েঘরের জীবনও উপলব্ধি করেছিলাম একরাত শচীন মাঝির বাড়িতে। সুন্দরবন পৌঁছেই আমি এত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে পুরো দলকেই ফিরে আসতে হয়েছিল শহরে। ডাক্তার আমাকে দেখে বলেছিল, “ভয়ের কিছু নেই। তুমি অন্তঃসত্ত্বা।” তবুও ওইদিনই তুমি ঢাকা রওয়ানা হলে। ঢাকা পৌঁছেও ক্ষান্ত হয়নি তোমার অস্থিরতা। দ্রুত লন্ডন ফেরার উদ্দেশ্যে এয়ারলাইন্সে ফোন শুরু করলে। আমি কিন্তু আরও কিছুদিন থাকতে চেয়েছিলাম মায়ের কাছে। মায়ের ভালোবাসা ছিল আমার কাছে হাওয়াই মিঠাই এর মতো; গোলাপি, তুলোর মতো নরম ও মিষ্টি। কিন্তু, মা ভয় পেতেন আমার অদ্ভুত আবদারগুলো। তাঁরই বা দোষ কীসের? শচীন মাঝির বাড়িতে থাকার আমার আবদারকে গ্রামসুদ্ধ মানুষ কেমন বড়লোকের ন্যাকামি বলে আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠী উদ্ধার করেছিল। ভাগ্যিস তখনও বাংলা ভাষা তেমন রপ্তে ছিল না আমার। সবার কান কথা ও অপমানের ব্যথায় মা কেমন বেগুণি বর্ণ ধারণ করেছিলেন! ভাষার কারণে আমাকে কিছু বলতে পারতেন না, তবে তাঁর নয়নতারায় প্রস্ফুটিত হতো তাঁর ব্যর্থতা, সমাজের কাছে জবাবদিহিতার ভয়। তুমি ডাক্তারের কথা বলে আমাকে নিয়ে গেলে লন্ডন। আমরা লন্ডন ফিরে আসার দুই বছরের মধ্যেই মা মারা গেলেন অজানা কোন এক রোগে। ততক্ষণে রেণু ও বেণু এলো আমাদের জীবনে। তারপর আর বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি আমার। এবার বেণুকে নিয়ে মায়ের কবর দেখে আসব।
যাবে। অবশ্যই যাবে বাংলাদেশে। আমারও আজকাল খুব মায়ের কথা মনে পড়ে। হঠাৎ হঠাৎ মায়ের শরীরের কাঁচা মাটির গন্ধ নাকে এসে লাগে। চমকে উঠি। চারদিক তাকিয়ে দেখি, ইট-পাথরের পাকা রাস্তা, অট্টালিকা।
তপু, দেখো তো বাচ্চা দু’টো ঠিক আছে তো? বেঞ্চের নিচে ওরা কী করছে? কোনো শব্দ নেই কেন? ওদের মা-বাবাও নিশ্চুপ।
ওরা ঠিক আছে। ওরা ওদের বাবা-মা’র সাথে লুকোচুরি খেলছে। ওদের বাবা-মা’র চোখ বন্ধ। আর ওরা আমাদের বেঞ্চের ঠিক পিছনে, দু’হাতে চোখ ঢেকে মাটিতে শুয়ে রয়েছে।
ঠিক আমাদের রেণু, বেণু’র মতো যেন এক জোড়া আদুরে খরগোশ ছানা! –তাই না?
হ্যাঁ। ওরাও রেণু, বেণুর মতো যমজ বোন মনে হচ্ছে। মাথায় দু’টো করে ঝুঁটি বাঁধা। দেখতেও বেশ আদুরে। ওদের মধ্যে শৈশবের চঞ্চলতা পুরোপুরি বিদ্যমান।
অজানা চলিষ্ণু সুবাস। কাছাকাছি কোনো পুরুষের উপস্থিতি নিশ্চিত হয় জুলিয়েট। পেছনে ফিরে তাকায় সে। নিচু কণ্ঠে বলে, ওদের সামনে যাবেন না প্লিজ। ওদের জয়ের আনন্দটা নষ্ট করে দেবেন না যেন।
জুলিয়েটের কথাগুলো অস্পষ্ট। তা’ বুঝতে পারে না ব্রায়ান। সে নিজের চোখ বন্ধ করে সন্তানদের খোঁজার অভিনয় করে। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা তাদের বাবাকে জড়িয়ে ধরে, খিলখিল শৈশব আনন্দ ছড়িয়ে দেয় মুক্ত বাতাসে। রাঙিন বাগান আরও রঙিন হয়, বাগানের সৌন্দর্য পৌঁছে যায় শেষ মাত্রায়।
রোজ এসে পাশে দাঁড়ায়। শিশুদের উদ্দেশ্যে বলে, “ওয়াও! আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ, বোথ অফ ইউ। ড্যাডি কুডন’ট ফাইন্ড ইউ। ইউ ফাউন্ড ড্যাডি। গেইম ওভার। নাউ উই নিড টু গো হোম। ড্যাডী হ্যাজ ওয়ার্ক, মামী হ্যাজ ওয়ার্ক। লেটস্ গো।”
ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানা অস্পষ্ট করে বলে, “ইয়েয়…লেতস (লেটস) গোওওওওওওও…।”
দুই
টরন্টো শহরের প্রাণকেন্দ্র ডাউনটাউন। সিক্স টুয়েন্টি চার্চ স্ট্রীটের ওপর ও’নোয়্র রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে অভ্যর্থনা ডেস্কে বুকিং নিশ্চিত করে খাবার অর্ডায় দেয় ব্রায়ান ও রোজ দম্পতি। আঠারো শতাংশ বকশিশসহ অগ্রিম বিল পরিশোধ করে তারা অপেক্ষা করে ওয়েটারের জন্য। ওয়েটার হবে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সে তাদের নিয়ে যাবে এক নিরালোক ঘরে। সেখানে বসে তারা রাতের খাবার খাবে। সহকর্মী ও বন্ধুদের গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্ধকারে খাবার খেতে এবারই তারা প্রথম এসেছে এই রেস্তোরাঁয়। অনুভুতি তাদের আজ অন্য রকম। অপেক্ষার সময়টা তারা ঘুরে ঘুরে দেয়ালের ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা ইংরেজি অক্ষরগুলো পর্যবেক্ষণ করে। ছয় বিন্দুতে লেখা অক্ষরগুলো দেখে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী’র তৃতীয় ও একমাত্র চোখ অন্তরদৃষ্টির প্রখরতা অনুমান করতে চেষ্টা করে ব্রায়ান। রোজ মুঠোফোন বের করে দু’টো ছবি তুলে নেয়। ইতোমধ্যে কালো চশমা পরিহিত একজন নারী এসে দাঁড়ায় আঁধার কামরার দ্বারে। “টেবিল নাম্বার ফিফটিন” উচ্চারণ করে তাদের স্বাগত জানায়, “ওয়েলকাম টু ও’নোয়্র রেষ্টুরেন্ট”। নিজের পরিচয় দেয়, “আই অ্যাম জুলিয়েট। আই উইল বি টেইকিং কেয়ার অফ ইউ দিস ইভনিং।” সে মিষ্টি হাসিতে নিজের কাঁধে রোজের হাত রেখে ঠিক তার পেছনে ব্রায়ানকে একইভাবে দাঁড়িয়ে তাকে অনুসরণ করার অনুরোধ করে।
এক কদম পার হতেই ভিন্ন এক পৃথিবী। ভিন্ন অনুভুতি কাজ করে রোজ ও ব্রায়ানের মধ্যে। রোজ শক্ত করে ধরে জুলিয়েটকে। জুলিয়েট খুব মোলায়েম কণ্ঠে বলে, “ডোন’ট ওয়ারি। দেয়ার ইস নাথিং টু বি ওয়ারি। আই অ্যাম উইথ ইউ। জাস্ট ফলো মি, প্লিজ।” বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সে একটি কাঠের চেয়ার রোজকে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “দিস ইজ ইউর চেয়ার, প্লিজ বি সিটেট।” পিছনে এসে খুব যত্নে ব্রায়ানকেও ধরিয়ে দেয় টেবিলের অন্যপ্রান্তের আরেকটি চেয়ার। তারপর নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করে, “উড ইউ লাইক সামথিং টু ড্রিংক?”
ড্রিংকস্? ডিডন’ট উই অর্ডার অ্যাট ফ্রন্ট ডেস্ক? – প্রশ্ন করে রোজ।
ইয়েস্, ম্যাম। ইউ অর্ডারড টু কোর্স ডিনার, মেইন ডিস এন্ড ডিজার্ট। ইট ইউল টেইক টুয়েন্টি টু টুয়েন্টি ফাইভ মিনিটস টু সার্ভ ইউর ফুড। ইন দ্যা মিনটাইম, ডু ইউ লাইক অ্যানিথিং টু ড্রিংক?”
ব্রায়ান কিছু একটা চিন্তা করে বলে, “উই প্লেসড অর্ডার আন্ড পেইড অলরেডি। ক্যান উই অ্যাড অ্যানিথিং এলস ইন দ্যাট অর্ডার নাউ?
“ইয়েস, ইউ ক্যান। দেয়ার সুড নট বি অ্যানি প্রবলেম। এক্সটা বিল ইউ ক্যান পে আফটার ডিনার।” বলে জুলিয়েট।
ব্রায়ান তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, সাদা ওয়াইন চলবে না-কি?
ইতোমধ্যে রোজ টেবিল স্পর্শ করে, টেবিলে রেখে দেয়া রুপালি চামচ-কাটার স্থান নির্ণয় করে। তবুও ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্রায়েনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে বলে, আমার অন্য পানীয় দরকার না হলেও জীবন বাঁচাতে যে পানি এখন অতি জরুরি, তা’তে কোনো সন্দহ নেই।
ব্রায়ান হাসে। দেখা যায় না তার মুচকি হাসি। তবে অনুমান করা যায় তার কথায়, “টু হোয়াইট ওয়াইন প্লিজ।”
জুলিয়েট মিষ্টি করে তাদের ধন্যবাদ দেয়, “থ্যাঙ্ক ইউ”। তাদের ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে আবার মনে করিয়ে দিয়ে যায়, “ফর অ্যানি নিড, ইউ ক্যান কল মাই নেইম অর টেবিল নাম্বার ফিফটিন”।
রোজের ইচ্ছে করে ব্রায়ানকে ছুঁতে। কিন্তু টেবিলের প্রশস্ততা অনুমান করতে পারছিল না সে। আবার টেবিলের ওপর দিয়ে গ্লাস, প্লেট ডিঙিয়ে কীভাবে তাকে স্পর্শ করবে, ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছিল না সেটাও। আজ তাদের অষ্টম বিবাহ বার্ষিকী। গত সাত বছর এই দিনে ব্রায়ান তাকে মোমবাতির কোমল আলোয় রাতের খাবার খেতে নিয়ে গিয়েছে, চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলেছে, সেই প্রথম ডেটিং এর মতো হাত স্পর্শ করে হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে নতুন করে, নতুনভাবে আরও একবার। আজ ব্রায়ান তাকে অবাক করে দিতে এমন এক স্থানে ডেটিং এ এনেছে যে সে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সবকিছু। সে পা বাড়িয়ে টেবিল মেপে দেখার চেষ্টা করে। তার পা স্পর্শ করে ব্রায়ানের পা। কিন্তু, ব্রায়ানের মনে হানা দেয় শঙ্কা। দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে। রোজকে ডাকে, রোজ, তুমি এতো চুপ কেন? অন্ধকারে কথা বলতে হয়। কথা বললে ভয় কেটে যায়। শুনতে পাচ্ছো না, রেস্তোরাঁয় বসেও মানুষ কেমন উচ্চস্বরে কথা বলছে।
রোজ মুচকি হাসে। কিন্তু ব্রায়ান তা দেখতে পায় না। সে আবার ডাকে, রোজ, তুমি ঠিক আছো তো? কথা বলছ না যে? তোমাকে এখানে এনেছি বলে অভিমান করনি তো আবার? দেখো, সহকর্মীরা বলল, ওরা ভ্যালেন্টাইনে ওদের প্রেমিকাদের নিয়ে এখানে এসেছিল একাধিক বার। ভাবলাম, আমরাও না হয় একবার আমাদের বিশেষ দিনটিতে পরস্পর অনুভব করি কেবল অন্তর দৃষ্টিতে।
এবার অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে দেয় রোজ। শূন্যতায় ভরে যায় তার মুঠো। স্পষ্ট উচ্চারিত হয় তার কণ্ঠ। তুমি কত দূর? তোমাকে ছুঁতে পাই না কেন? অন্তরদৃষ্টিতে অনুভব করতে এখানে এসেছি আমরা। অথচ, আমি হাসছি, তুমি তা দেখতে পাওনি, অনুভবও করেছ কিনা সন্দেহ। অনুভব করলে নিশ্চয়ই আমার অভিমানের প্রশ্ন হতো না। আমি মনে করি, এখানে আসার পূর্বে যেটা মানুষের দরকার, সেটা হচ্ছে মানুষের অন্তর দৃষ্টির পরিচর্যা। আমরা যারা চোখে দেখে কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য উপভোগ করি, কথায় কথায় ভালোবাসার কথা বলি, প্রেমের অভিনয় করি, তাদের জন্য এই অনুভবটা অত সহজ নয় রে। বলতে পারো কিছুটা কঠিনও বটে। অনুভবের জন্য কখনো শুনতে হয়, কখনো গন্ধ নিতে হয়। তখন যদি কর্ণ ও নাসিকা ইন্দ্রিয় সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে নীরবতার সাথে সখ্যতা করতে হয়। আমার ধারণা, নীরবতা কখনো ভেঙ্গে দেয় না মনোবল। বরং তা মনের শক্তি যোগায়।
এত কঠিন কথা বলছ কেন, রোজ? আমি কিছু ভুল বললাম বুঝি?
না, তুমি ভুল বলোনি কিছুই। তোমার অনুভব, তোমার মনের কথাগুলোই তুমি কণ্ঠে ধারণ করেছ মাত্র, যেমন আমিও করছি। ব্রায়ান, হতে পারে আমাদের কথা বলার ধরণ ভিন্ন, হতে পারে কঠিন বাস্তবতার চাপে আমরা কখনো খণ্ড-বিখণ্ড। তারপরও কিন্তু আমরা অনুভব করি পরস্পরের হৃদকম্পন।
এই তো আমার হাত, তুমি হাত বাড়ালেই ধরতে পাবে। অনুভব করতে পারবে আমার হৃদকম্পন।
রোজ হাত বাড়িয়ে দেয় শূন্যে। ধীরগতিতে এদিক সেদিক করে ব্রায়ানের হাত ধরে। খুব মিষ্টি করে বলে, ভয়ে এমন গুটিয়ে গেলে হয়? আমি তো তোমার সামনেই আছি। উচ্চস্বরে কথা বলে ভয় দূর করা যায় বৈকি। তবে অনুভব করা যায় না কিছুই। তাই অমন করে বলছিলাম আর কি।
ভয় তো একটু পেয়েছিলাম বটে। তখন আমার পায়ে কিছু একটা লেগেছিল। বিড়াল, কুকুর না তো আবার?
কী আবোল-তাবোল ভেবে বসে আছো তুমি? এটা সুপরিচিত এক রেস্তরাঁ। এখানে বিড়াল, কুকুর আসবে কী করে? ওটা ছিল আমার পা। তা স্পর্শ করতেই বাচ্চাদের মতো যখন তুমি দ্রুত গুটিয়ে নিয়েছিলে তোমার পা, তখনই আমি ধরে ফেলেছি যে তুমি ভয় পাচ্ছো। আর সেই জন্যই আমার খুব হাসি পাচ্ছে।
ভয় তো পেতেই পারি একটু। তা’তে হাসি পাওয়ার কী হলো? বলতে বলতে ব্রায়ানও হাসে। নিজেকে উজার করে দিতে চায়। তবুও বুক কাঁপে আড়ালে।
তখনই জুলিয়েট ওয়াইন নিয়ে প্রবেশ করে। জুলিয়েট ও ব্রায়ানের হাতে ওয়াইনের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে, এনজয়।
জুলিয়েটকে ধন্যবাদ জানায় তারা। জুলিয়েট “ওয়েলকাম” বলে তাদের ধন্যবাদ গ্রহণ করে চলে যায়।
ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ব্রায়ান ও রোজ একত্রে উচ্চারণ করে, বাহ্! বেশ মিষ্টি তো!
রোজের মাথায় দুষ্টুমি ভর করে। সে ব্রায়ানকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা, বলোতো আমি এখন কী করছি?
তুমি এখন আমাকে ভেংচি কাটছো, রোজ। যেমন ভেংচিটি তুমি কেটেছিলে, প্রথমবার ওয়ান্ডারল্যান্ডের রোলার কোষ্টার থেকে নেমে। ভয়কে জয় করার পর আনন্দের ভেংচি।
ব্রায়ান, তুমি ঠিক ধরেছ। তোমার অন্তর দৃষ্টি তবে কাজ করছে বেশ। এবার আমার বলার পালা। আমি বলি, তুমি এখন কী করছ? ওয়াইন তো জলের মতো ঢকঢক গিলে ফেললে। তবুও তোমার এক হাতে ওয়াইনের গ্লাস, টেবিলে রাখার সাহস পাচ্ছো না। ভাবছ, কোথায় রাখবে? যদি পড়ে যায়! তোমার মন কিছুটা ব্যাকুল। অন্য হাতে তুমি কান চুলকাচ্ছো আর ভাবছ, বিশ-পঁচিশ মিনিট এত দীর্ঘ কেন? মুঠোফোনের কারণে ঘড়ি পরা বন্ধ হয়েছে তোমার, এখন মুঠোফোন ব্যবহার করে সময়ও দেখতে পাচ্ছো না বলে বিরক্তও লাগছে কিছুটা।
আচ্ছা! তুমি কি আমার খারাপ বিষয়গুলোই লক্ষ করো কেবল? আমার বুঝি ভালো কিছু নেই?
ভালো থাকবে না কেন? অবশ্যই তুমি একজন ভালো মনের মানুষ। এই মুহূর্তে তুমি যা করছ, ভাবছ, তা বললাম। এরমধ্যে খারাপের কী হলো? অপেক্ষা বিষয়টা তোমার জন্য সর্বদাই এক প্রকার কঠিন কাজ। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই অপেক্ষা কঠিন বিষয়। আমার নিজের ক্ষেত্রেও। তবে চেষ্টা করি, অপেক্ষাকালে অপেক্ষাকে ভুলে থাকতে।
ইতোমধ্যে খাবার নিয়ে পৌঁছে যায় জুলিয়েট। সে রোজের ঠিক সামনে প্লেট রেখে বলে, “পেস্টো চিকেন ব্রেস্ট উইথ পটেটো এণ্ড বেজিটেবলস”। ব্রায়ানের সামনে প্লেট রেখে বলে, “স্রীম্প রিসোটো উইথ মাশরুম এন্ড গার্লিক”। “সেফ অলরেডি কাট ইউর ফুড, সো ইউ ক্যান ইট ইজিলি। ওয়াটার গ্লাস অন ইউর টপ রাইট কর্ণার।”
রোজ ধন্যবাদ দেয় জুলিয়েটকে। ব্রায়ান নির্বাক। জুলিয়েট বলে, “এনজয় ইউর ফুড।”
চামচের টুকটাক শব্দ ভেসে আসে পাশের টেবিলগুলো থেকে। কাঁটা চামচ দিয়ে খাবার তুলে নিতে কষ্ট হয় ব্রায়েনের, প্রতিবারই হাত দিয়ে খাবার ধরতে হচ্ছে তার। সে ন্যাপকিনে হাত মুছে হাত দিয়েই খেতে শুরু করে। রোজ শুরুতেই চামচ পাশে রেখে দেয়। খেতে খেতে রোজ প্রশ্ন করে, কিছু উপলব্ধি করতে পারছ, ব্রায়ান?
হুম, আমরা কত ভাগ্যবান! আমাদের জীবনটা কত রঙিন! শৈল্পিকতায় লেপেপুঁছে রেখেছি আমাদের জীবনের প্রতিটি অলিগলি। তা আমরা অনুভব করি কতটুকুই বা? আজ অন্ধকারে কাঁটা-চামচ রেখে কেমন করে হাত দিয়ে খেয়ে নিচ্ছি খাবার। একবারও মনে হচ্ছে না, কেউ আমাকে হাত দিয়ে খেতে দেখছে। অবিশ্বাসও জন্ম নেয়নি মনে। একবারও মন প্রশ্ন করেনি, অন্যের কেটে দেয়া খাবারটা ঠিক আছে তো? নোংরা হাতে ধরেনি তো?
ঠিক তাই, ব্রায়ান। দেখো, আমরা মাত্র এক ঘণ্টার জন্য ইচ্ছাকৃত পরনির্ভরশীল, তবুও আমাদের মনের ভাবনাগুলো পাল্টে যাচ্ছে পলে পলে। বিশ্বাস করতে পারছি অন্যকে। আমাদের পরস্পর আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার।
ইতোমধ্যে আরও একবার এসে খবর নিয়ে যায় জুলিয়েট, “ইজ এভরিথিং ওকে?” ক্রেতা সেবায় অবহেলা নেই তার কোনো। প্রথম থেকে প্রতিটি কাজ সে করছে সযত্নে। ব্যবহৃত প্লেটগুলোও নিয়ে যায় নিঃশব্দে।
রোজ ও ব্রায়ান খাবারের প্রশংসা করে। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা’র কথা আলোচনা করে।
চীজ কেক নিয়ে আসে জুলিয়েট। বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানায় তাদের, “হ্যাপি অ্যানিভার্সারি টু বোথ অফ ইউ”। মোমবাতি বিহীন ছোট্ট এক টুকরো কেক রাখে তাদের দু’জনের সামনে। রোজকে বাটার নাইফ ধরিয়ে দিয়ে বলে, “টেবিল ইজ ক্লিয়ার। ইফ ইউ ওয়ান্ট ইউ বোথ ক্যান কাট দা কেক টুগেদার”। তারপর “এনজয়” বলে চলে যায় সে।
রোজ ও ব্রায়ান কেক কাটে। খেয়ে নেয় পরম যত্নে। নিশ্চুপ অনুভব করে আঁধার। জীবনে এই প্রথম তারা অনুভব করে জুলিয়েট ও জুলিয়েটের মতো লক্ষ লক্ষ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অনুভূতি, অন্তরদৃষ্টির প্রখরতা, মানসিক শক্তি ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা।
তারা ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে জুলিয়েট তাদের পুনরায় একই পদ্ধতিতে অন্ধকার ঘরের পথ ধরে বাইরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আলোর নৈকট্য, তাদের চোখে ধাক্কা লাগে যেন। মাত্র দেড় ঘণ্টা, অথচ তাদের মন জানালার প্রশস্ততা বেড়ে যায় বেশ। সামান্য কৃত্রিম আলোও অধিক মনে হয় তখন।
পরস্পর ধন্যবাদ ও শুভ রাত্রি বলে বিদায় নেয়া তারা। জুলিয়েট ফিরে যায় তার কাজে।
তিন
টরন্টো হারবার ফ্রন্টে বসন্তের শুরু থেকে হেমন্তের শেষ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের ভিড় খুব স্বাভাবিক এক ব্যাপার। কত সৌখিন নৌকা থাকে ঘাটে বাঁধা! বৃহৎ অন্টারিও লেকের বুকের ওপর নৌকাগুলো চলাচলও করে যখন-তখন, যেথা-সেথা। ওয়াটার ট্যাক্সিওয়ালা দর হাঁকে চড়া, সৌখিন মানুষ তবুও খুশি মনে উঠে বসে, অন্টারিও লেকের নীল জলে ভেসে ভেসে সবুজ গাছ-গাছালিতে ঘেরা ইট-পাথরে তৈরি সুন্দর শহর দেখে, কিংবা চলে যায় কোনো দ্বীপে।
হারবার ফ্রন্ট টরন্টোর প্রাণও বটে। নানান দেশের, নানার বর্ণের পর্যকটদের আনাগোনা আছে বেশ ওখানে। আজ সকাল থেকে নানান দেশের, নানান ভাষার লেখক ও পাঠকের ঢল নেমেছে সেখানে। সেপ্টেম্বর মাসের সহনীয় উষ্ণতায় প্রতিবারের মতো আজ টরন্টোর হারবার ফ্রন্টে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী বইমেলা “ওয়ার্ড অন দ্য স্ট্রিট”। চিনিগুঁড়ো রোদ ঝলমল দিনে নানামুখী সেমিনার, নাটক, বই আলোচনা চলছে একের পর এক। হ্রাসকৃত মূল্যে বই ক্রয় করে পাঠকেরা। তাদের কেহ লেখকের সান্নিধ্য চায়, কিংবা মূল্যবান অটোগ্রাফ।
ব্রায়ান, রোজ দম্পতি হারবার ফ্রন্ট ঘুরতে এসেছে তাদের যমজ সন্তানদের নিয়ে। তারা জানতো না বইমেলার খবর। এখানে পৌঁছে নাটক, পদ্য পাঠ, বইয়ের আলোচনা দেখে অবাক হয় রোজ।
সে নড়ে না এক বিন্দুও। এক দশক পর সে নিজেকে খুঁজে পায় যেন। বাংলাদেশে কতবার যে বইমেলায় গিয়েছে সে! ভরা তারুণ্যে উচ্চশিক্ষার লোভে বিদেশ এসে বিদ্বান হয়েছে বটে। তবে, প্রবাস জীবনের কঠিন বাস্তবতার চাপে নিজের পছন্দগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে লাঙল চাষের এক অসহায় বলদ যেন সে এখন। ব্রায়ানও ভালো একজন পাঠক ছিল একসময়। তবে সংসারের চাপে অনেকদিন তারও কোনো নতুন বই পড়া হয়ে ওঠেনি। আজ সেও উপভোগ করে আলোচনাগুলো। ঘুরে ঘুরে দু’টো বই ক্রয় করে। ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানা খুব সুখী শিশু। কোনো কিছুতেই বিরক্ত নেই তাদের। তারাও মা-বাবার সাথে স্থির থাকে। মাঝে ফুডকার্ট থেকে তাদের হটডগ কিনে দেয়া হয়, তারা তা’ খুশি মনে খেয়ে কুটুসকাটুস গল্প করে, খেলা করে নিজেদের মতো।
সামান্য দূরে আরও এক শিশু। সেও তার পিতামাতার সাথে ঘুরতে এসেছে। স্ট্রলারে বসে পা দোলাতে দোলাতে সে চীজ খায় কুটুস-কুটুস। গোটা কয়েক সাদা সিগাল ওত পেতে ঘোরঘুরি করে তার চারপাশ। সিগালের নজর সংক্রমিত হয় ব্রীয়ানার চোখে। তার দৃষ্টি স্থির থাকে শিশুটির হাতে। এটা ব্রীয়ানার খুব বাজে একটা অভ্যাস, অন্যের হাতে কিছু দেখলে সেটা তারও চাই, হোক তা খাদ্য, কিংবা খেলনা। ব্রায়ান ও রোজ ব্রীয়ানার এই দাবিকে একপ্রকার সমস্যা মনে করে। তারা তড়িঘড়ি করে তার অযৌক্তিক দাবি না মিটিয়ে বরং ভিন্নভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করে সর্বদা। ব্রায়ান ব্রীয়ানাকে বলার চেষ্টা করে যে আমরা ঘুরতে এসেছি, এখন ঘুরব; চীজ তুমি বাড়ি গিয়ে খাবে। কিন্তু বায়নাটা তার আগুনের মতো বাড়তেই থাকে, চীজ তার চাই-ই-চাই। এখনই চাই। কান্না শুরু করে দেয় সে। বিরক্ত হয়ে রোজ চলতে শুরু করে। রীহ্য়ানা পথ আগলে দাঁড়ায় এবং বলে, “হোয়াই ডু ইউ ক্রাই ব্রীয়ানা? উই উইল হ্যাভ চীজ অ্যাট ডিনার। ডোন’ট ইউ রিমেমবার? উই ডু নট নিড টু ক্রাই ফর অ্যানিথিং বিফোর আসকিং মামী। প্লীজ ডু নট ক্রাই।”
রীহ্য়ানার জন্য মায়া হয় রোজ ও ব্রায়ানের। রোজ ভাবে, ব্রীয়ানার জন্য রীহ্য়ানার আনন্দটুকু নষ্ট করে দেয়া ঠিক হবে না। সে ব্রায়ানের চোখে চোখ রাখে। পরস্পর পড়তে চেষ্টা করে চোখের ভাষা। দু’জনেই থেমে যায়। ব্রায়ান ব্রীয়ানাকে তুলে নেয় নিজের কাঁধে। তাকে কাঁধে বসিয়ে সে হেঁটে যায় অন্যদিক। রীহ্য়ানাকে নিয়ে সবুজ ঘাসে বসে রোজ। অন্টারিও লেকের ভেজা হাওয়া স্নেহ বিলিয়ে দেয় রোজের অস্থির মনে। তৃপ্তির ছায়া পড়ে তার দৃষ্টিতে।
রোজের দৃষ্টি পড়ে বেশ দূরে বসে থাকা এক দম্পতির প্রতি। চেনা ও অচেনায় দোদুল্যমান তার মন। স্মৃতির পাতা চষে বেড়ায় সে ক্রমান্বয়ে। একপর্যায়ে সে রীহ্য়ানার হাত ধরে হেঁটে যায় তাদের কাছাকাছি। কিন্তু তার মন সিদ্ধান্ত দেয় না কোনো। আবার সামান্য দূরত্বে বসে। কিন্তু দম্পতির মনোযোগ সম্পূর্ণ মঞ্চের লেখকের প্রতি। রোজ ভাবে, জুলিয়েট? হ্যাঁ, জুলিয়েট-ই-তো। কালো চশমাও আছে তার চোখে। তার সাথের লোকটিকে তাপস মজুমদার বলে মনে হচ্ছে। সে এখানে জুলিয়েটের সাথে কীভাবে? তাপস মজুমদার তো ইউরোপে থাকে। মায়ের পিসতুতো জ্যাঠাতো দাদা সে। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ইউরোপ গিয়ে বিয়ে করে বাড়ি এনেছিল এক সুন্দরী ইউরোপিয়ান নারী। সেই ছোটবেলায় একবার দেখার সুযোগ হয়েছিল তাকে সচোখে, তারপর ছবি দেখেছি দু-একবার হয়তো। কিন্তু তার স্ত্রী তো অন্ধ ছিল না। মা বলতেন, তার ছিল টসটসে লিচুর মতন এক জোড়া চোখ, যেখানে প্রস্ফুটিত হতো তার সরলতা। ঠাকুরমার মৃত্যুর পর তাপস মামা একবার দেশে গেলেও তার স্ত্রী আর দেশে যায়নি কখনো। তাপস মামা কানাডা এসেছে –এমন তো শুনিনি কখনো। তবে কি বেড়াতে এসেছে? আর জুলিয়েটকে তো সেদিন রেস্তোরাঁয় দেখে এলাম কাজ করতে। হয়তো জুলিয়েট তার বন্ধু এবং সে তার বন্ধুর কাছে এসেছে বেড়াতে। নয়তো বৈধ কাগজ গ্রহণের পর প্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে নতুন করে জীবন শুরু করেছে। স্বার্থ সর্ব্দাই আগুন, জ্বলে পুড়ে ছাই করে দেয় পরিবেশ। কেমন যেন ভাবনাগুলো সেদ্ধ গোল-আলুর মতো নুন-তেল-পেঁয়াজ-লংকায় মাখামাখি করে ভর্তা হয়ে যাচ্ছে রোজের মাথায়।
ব্রায়ান ও ব্রীয়ানার উপস্থিতিতে রোজ ফিরে আসে বাস্তবে। রীহ্য়ানা ব্রীয়ানাকে পেয়ে খুশিতে আলিঙ্গন করে, খিলখিল হাসে। অনেকেই তাকিয়ে তাদের আনন্দ দেখে। তাপসও তাকায় তাদের দিকে। ইতোমধ্যে, ব্রায়ানের দৃষ্টি পৌঁছে যায় জুলিয়েটের কালো চশমা পর্যন্ত। তার মন তখনও চেনা ও অচেনায় দ্বিধাগ্রস্ত। সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সে রোজকে জিজ্ঞেস করে, চিনেছ? আমার মনে হয় সেদিন রেস্তোরাঁয় উনিই আমাদের খাবার সার্ভ করেছিল।
হুম! পৃথিবী গোল, ব্রায়ান। আমরা একই বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকি বারংবার। সুতরাং একই মানুষের সাথে বারবার দেখা হওয়া তো স্বাভাবিক। আবার এও সত্যি, আমরা পরস্পর কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্তও। তুমি জেনে আশ্চর্য হবে যে জুলিয়েটের হাত ধরে বসে থাকা লোকটি সম্পর্কে আমার মামা। জুলিয়েট তার বর্তমান স্ত্রী কি-না, জানি না। তবে তার একজোড়া কন্যা সন্তান আছে আমাদের মতো।
তোমার মামা এখানে থাকে, আগে তো কখনো বলোনি।
বলিনি এইজন্য যে আমি জানতাম যে সে ইউরোপ থাকে। তার মায়ের মৃত্যুর পর সে অবশ্য দেশের সাথে যোগাযোগ রাখেনি আর। তারপর, সে আমার আপন মামা নয়, দূর সম্পর্কের মামা।
হ্যাঁ। আমারও এক মামা আছে, যে ইতালি গিয়ে আমাদের কারো সাথে আর যোগাযোগ করেনি। জানি না সে বেঁচে আছে না, মারা গেছে।
মানুষের জীবন তো এমনই, কখনো সংসার নামের নির্ধারিত কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান গ্রহ ও উপগ্রহের মতো, আবার কখনো লাইনচ্যুত রেল-বগির মতো সংযোগের অভাবে বিধ্বস্ত। তবুও জীবন থেমে থাকে না মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। টিপটিপ করে হলেও তা জ্বলে আঁধার রাতের জোনাকি পোকার মতো। তারপরও প্রতিটি জীবনের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে।
ব্রায়ান ও রোজ নজর কেড়ে নেয় তাপসের। সে বারবার ঘুরে দেখে তাদের। কিছু একটা বলে জুলিয়েটকে। লেখকের বক্তব্য শেষ হতেই রোজ উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে হেঁটে তাপসের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “ইফ ইউ ডোন’ট মাইন্ড, ক্যান আই আসক্ অ্যা কোস্শেন?”
– ইয়েস। ইউ ক্যান।
– আর ইউ তাপস মজুমদার?
– ইয়েস, আই অ্যাম। ডু আই নো ইউ?
তাপস ও রোজের কথোপকথনে যুক্ত হয় জুলিয়েট। শান্ত কণ্ঠে তাপসকে উদ্দেশ্য করে বলে, হানি, ইট সিমস্ সি ওয়াজ ইন আওয়ার রেস্টুরেন্ট ফিউ উইকস ব্যাক। উই মেট দেম ওয়ানস ইন এডওয়ার্ড গার্ডেন টুহ্। ডু ইউ রিমেমবার? দেয়ার ওয়ার অ্যা টুইন, হু ওয়ার প্লেইং বিহাইন্ড আওয়ার বেঞ্চ। আই থিংক ইট ওয়াজ লাস্ট ফল।” রোজ হা করে তাকিয়ে থাকে জুলিয়েটের দিক। ভাষা হারিয়ে ফেলে কিছুক্ষণের জন্য। সুযোগে জুলিয়েট তাকে প্রশ্ন করে,”হাউ আর ইউ, ম্যাম? হাউ ইজ ইওর হাসবেন্ড?”
আই অ্যাম ফাইন। বাট, হাউ ডীড ইউ নো মি? ইফ আই অ্যাম নট রঙ, ইউ ক্যান’ট সি অ্যানিথিং, রাইট?
ইয়েস, ইউ আর রাইট। আই ক্যান’ট সি, বাট আই ক্যান ফিল, আই ক্যান স্মেল, আই ক্যান রিমেমবার ভয়েস।
সরি, ম্যাম। আই ডিডন’ট ওয়ান্ট টু হার্ট ইউ অ্যাট অল। নাইস টু সি ইউ অ্যাগেইন। আই থিংক, তাপস মজুমদার ইজ মাই আঙ্কেল।
খুব আশ্চর্য হয় তারা দু’জনেই। তাপস প্রশ্ন করে, অ্যাম আই ইওর আঙ্কেল? হাউ?
আমি কীর্তিপাশার গৌরব মণ্ডল ও ললিতা মণ্ডলের মেয়ে রোজ মণ্ডল।
তুমি ললিতা’র মেয়ে? দেখো তো। পৃথিবী কত ছোট। জুলিয়েট, আমাদের ললিতা’র মেয়ে ও। তুমি ওদের বাড়িতে বেড়িয়েছ। মনে আছে? ললিতা তোমাকে শাড়ি, শাখা-সিঁদুর পরিয়ে ছবি তুলেছিল। উলু ধ্বনি শিখিয়েছিল। আমরা যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন ও বেশ ছোট ছিল। ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াত এঘর-ওঘর।
হ্যাঁ, খুব মনে আছে মায়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানো আদুরে শিশুটিকে। যা মায়া ছিল ওর কথায়। আর থাকবেই বা না কেন? ললিতা’রও কি মায়া কম ছিল না-কি? কত আদর-যত্ন করেছিল, আমাকে একটা স্বর্ণের মালা উপহার দিয়েছিল। আচ্ছা, ললিতা এখন কেমন আছে?
মা, ভালো আছেন। তবে, বয়সের চাপ পড়েছে তাঁর শরীরে। ভাবছি, এখানে নিয়ে আসবো তাঁকে। আচ্ছা, আমার মনে হয় আমরা অন্যদের বিরক্তের কারণ হচ্ছি। একটু দূরে বসে না হয় কথা বলি। আমার সাথে আবার আমার আণ্ডাবাচ্চাসহ পুরো পরিবার আছে। ওরা একটু বাদেই হই-চই শুরু করে দেবে।
হ্যাঁ, তাই তো। ওদের ডাকো। চলো, পেছনে গিয়ে বসি। -বলে তাপস।
রোজের ইশারায় ব্রায়ান মেয়েদের নিয়ে এগিয়ে আসে। তারা মঞ্চ থেকে বেশ পেছনে গিয়ে বসে। পরস্পর পরিচয় করিয়ে দেয়। তাপস ও জুলিয়েটকে দেখিয়ে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানাকে বলা হয় যে এরা হচ্ছে তোমার দিদিভাই ও দিদিমণি। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা লাজুক চোখে তাকিয়ে দেখে তাদের। জুলিয়েট হাত বাড়িয়ে দেয়, আলিঙ্গন করে তাদের। তাপস, রোজ, ব্রায়ান হারিয়ে যায় বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার কীর্তিপাশা নামের ছোট্ট এক শহরের অলিগলিতে। তাদের আলোচনায় বারবার উচ্চারিত হয় জমিদার বাড়ি, শিব মন্দির, দুর্গামন্দির, কলমিকন্দ নবীন চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়, প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গাবখান নদীর নাম। আবার কখনো নৌকা ঘাট, শচীন মাঝি, পণ্ডিত মশায়, গৌরব মণ্ডল, তপন মজুমদার, ললিতা দি, শচীন মাঝি, অনেক মানুষ ও স্থানের নাম।
জুলিয়েট ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানাকে আলিঙ্গন করে আপন করে নেয়। তাদের সাথে গল্প শুরু করে দেয় এমনভাবে, যেন তারা তার রেণু, বেণু। সে তাদের রেণু, বেণু’র শৈশবের গল্প শোনায়। রেণু, ভাত-মাছ-ডাল খেতে পছন্দ করত, আর বেণু বার্গার, হটডগ, পাসতা। বেণু বাইরে বেড়াতে পছন্দ করত, কিন্তু রেণু ঘরে বসে টেলিভিশন দেখতে। হঠাৎ একদিন রেণু বলল, “মা, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। আমি ডাইনোসর দেখব।” আমরা তো সবাই অবাক। ডাইনোসর পাবো কোথায়? তোমাদের দিদিভাই বুদ্ধি করে আমাদের নিয়ে গেলো জাদুঘরে। সেখানে ডাইনোসরের কংকাল দেখে রেণু শুরু করল কান্না। সে কি কঠিন কান্না, মাটিতে বসে পা ছুড়ে কান্না, ডাইনোসর কেন হাঁটে না? ওর কান্না শুনে সিকিউরিটি এলো। সব শুনে সে হেসেই পাগল। তোমার দিদিভাই আবার বুদ্ধি আঁটল, আমাদের নিয়ে গেলো থিয়েটারে, সেখানে ডাইনোসর দেখাচ্ছিল তখন। অন্ধকারে বড় পর্দায় ডাইনোসরের গর্জন শুনে আবার শুরু হয় তার কান্না, এবার চোখ বন্ধ করে কান্না। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসে সে বলল, “আমি আর ডাইনোসর দেখব না। ওরা পচা, ভয় দেখায়।”
অপলক চোখে হাঁ করে জুলিয়েটের গল্প শোনে রেণু ও বেণু।
চার
বড়দিনের ছুটির আমেজ ঘরে ঘরে। উৎসবমুখর টরন্টো শহর। এক সপ্তাহ পূর্বের পতিত তুষার মাটিতে জমে শ্বেত সাধ্বী রূপ ধরেছে। শহরের উচ্চতম টাওয়ার, সিএন টাওয়ার লাল-সবুজ রঙ জড়িয়েছে শরীরে। প্রতীকী সান্টাক্লজ, রেইন-ডিয়ার, এলফসহ নানান ধরণের দেবদূত ও রঙিন আলোয় সাজানো হয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্র ন্যাথান ফিলিপস স্কোয়ার, ডানডাস স্কোয়ারসহ প্রসিদ্ধস্থানগুলো। শহরের অলিগলি, বাড়ির আঙিনা ও প্রবেশ পথগুলোও সেজেছে আলোয় আলোয়। সহস্রাধিক মানুষের আনাগোনা শহরের বুক চিরে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত। ক্রিস্টমাস ইভ্। কিশোর-কিশোরীরা দল বেঁধে খোলা আকাশের তলে ন্যাথান-ফিলিপস স্কোয়ারের আইস স্কেটিং রিঙ্কে স্কেইটিং করে। ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানাও এসেছে তাদের পিতামাতার সাথে। তারা স্কেটিং করতে শেখেনি এখনও। রোজ তাদের হাত ধরে স্কেটিং রিঙ্কের পাশ দিয়ে হাঁটে। টুপি, স্কার্ফ ও জ্যাকেট প্যাচিয়ে তারা পেঙ্গুইন আদলে চলে এক-দুই-এক ধীর তালে। তাদের মতো শতশত মানুষ এসেছে বেড়াতে। তারা ঘুরে ঘুরে আলোকসজ্জা উপভোগ করে, ছবি তোলে। সাঁট-সাঁট শব্দে ব্রায়ানও ক্যামেরা বন্দি করে রাখে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানার শৈশব, তাদের বিশেষ একটি দিন।
হিমেল হাওয়ার বেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে দ্রুত। তুষার ঝড় শুরু হবে যে কোনো মুহূর্তে। আবহাওয়া সাংবাদিকেরা এক সপ্তাহ ধরে ঝড়ের পূর্বাভাস দিতে দিতে গলা শুকিয়ে কাষ্ঠ করে ফেলেছে, তবুও শহরে উপচে পড়া ভিড়। রোজ বাড়ি ফেরার প্রস্তাব দেয়, “ঝড়টা মনে হয় এসেই গেলো শেষ পর্যন্ত। চলো, এবার না হয় বাড়ি ফেরা যাক।” ব্রায়ান রোজের প্রস্তাবে রাজি হয়ে চলতে শুরু করে গাড়ি অভিমুখে। তাদের গাড়ি বেশ দূরে পার্ক করা। মিহি বরফকুচির ঝাপটা এসে লাগে সবার চোখেমুখে। ব্রীয়ানা চোখ মুছে বারবার। রীহ্য়ানা স্থির দাঁড়িয়ে পড়ে।
ব্রায়ান দ্রুত পায়ে চলে। রোজ সন্তানদের নিয়ে অপেক্ষা করে চৌরাস্তার মোড়ে লাইটপোস্টের নিচে। মানুষ চলছে দলে দলে। আনন্দ তাদের চলনে, বলনে। সাদা ক্রিস্টমাস কামনা করে সকলে। সুতরাং তুষার ঝড়ের আগমনে একটু বেশি-ই খুশি হয় তারা, যেমন হংসকুল খুশি হয় জল ও জলাশয় পেলে।
হঠাৎ গাড়ির ব্রেকের কঠিন শব্দ, ক্রশশশ…শ। লাল রঙের টয়োটা করোলা ঝাঁকুনি খেয়ে থামে। রক্ষে পায়নি তার সম্মুখের কালো হোন্ডা সিভিক। লাল করোলা ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে কালো সিভিকের বাম্পার। কালো সিভিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কোমড়ে ঝুলন্ত বাম্পার নিয়েই নব্বুই ডিগ্রী কোণে ধাক্কা দেয় উল্টোপাশের এক জীপকে। জীপ থেমে যায়। তবে তার শক্ত দেহে ধাক্কা খেয়ে কালো সিভিকের পেট বেঁকে যায়। প্যা-পু, প্যা-পু করতে করতে ছুটে আসে পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ট্রাক। স্থির হয়ে যায় গাড়ি চলাচল।
রোজ ফোন করে ব্রায়ানকে। ব্রায়ান অর্ধ পথে আটকে পড়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে ব্রায়ান গাড়িতে অপেক্ষা করবে এবং তারা হেঁটে যাবে গাড়ি পর্যন্ত। রোজ ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানাকে শক্ত করে ধরে আবার পেঙ্গুইনের মতো এক-দুই-এক তালে চলতে শুরু করে। পথে পুরাতন সিটি হলের সম্মুখের সাজিয়ে রাখা সান্টাক্লজ দেখে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা থামে। সান্টাক্লজের কাছে যেতে চায় তারা, “মামী, ডীড ইউ সি সান্টাক্লজ? হি ইউল গীভ টয়েস। ক্যান উই গো টু হিম? প্লিজ। প্লিজ মামা।”
রোজ তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলে, নট নাউ, সুইট হার্টস। ড্যাডী ইস ওয়েটিং ফর আজ। সান্টাক্লজ উইল কাম টুমরো অ্যাট দিদিভাই, দিদিমণি’স হাউজ।
তারা আবার চলতে শুরু করে। গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে সময় নেয় দ্বিগুণ। তবুও তো নিরাপদে পৌঁছেছে, মনে মনে সন্তুষ্টি আদায় করে রোজ। কন্যাদের কারসিটে বসিয়ে রোজ ঘুরে এসে নিজের সীটে বসে, সিটবেল্ট বেঁধে রেডিও এএম সিক্সএইটি(৬৮০) নিউজ চ্যালেন চালু করে। হাইওয়েতে এক শিকল দুর্ঘটনায় একাধিক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাইওয়ে বন্ধ। খবর শুনে অস্থির লাগে রোজ ও ব্রায়ানের। শহরের সরু ব্যস্ততম সড়ক ধরেই তারা বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পিপীলিকা গতিতে চলে তাদের গাড়ি। রেডিওতে বেজে ওঠে, “জিংগেল বেল, জিংগেল বেল…. জিংগেল অল দি ওয়ে”। অস্পষ্ট উচ্চারণে কণ্ঠ মিলায় ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা।
ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা সুর করে গাইতে থাকে নিজেদের মতো আরও কিছু গানের কলি,”ওয়ান লিটল, টু লিটল, থ্রী লিটল এলফ, ফোর লিটল, ফাইভ লিটল, সিক্স লিটল এলফ…”। রোজ কণ্ঠ মিলায় তাদের সাথে। ব্রায়ান লুকিংগ্লাসে কন্যাদের আনন্দ দেখে এবং সাবধানে গাড়ি চালাতে থাকে। রাস্তার পাশের ঢালুতে দু’টো গাড়ি পড়ে আছে। চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়েছে তো আর উঠতে পারছে না। হঠাৎ তার মনে হলো, অনাকাঙ্ক্ষিত একধাপ আঁধার নেমে এলো পথে। হ্যাঁ, এলাকার বিদ্যুৎ চলে গেছে। তবুও সাদা তুষারে বেশ আলোকিত শহর। সাবধানতা বেড়ে যায় ব্রায়ানের আরও। চুপচাপ গাড়ি চালায় সে। ব্রায়ানের ভালো এক অভ্যাস, বিপদে নিজে আতঙ্কিত হয় না, অন্যকেও আতঙ্কিত করে না। খবরে শহরের অনেক স্থানের বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কথা জানায়। সকলকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে দু’একদিন লেগে যেতে পারে। রোজের শঙ্কিত কণ্ঠ মনের কথাগুলো উচ্চারণ করে ক্রমান্বয়ে, আমাদের বাড়িতেও আবার বিদ্যুৎ যায়নি তো? বাসায় মাত্র দু’টো মোমবাতি আছে। বিদ্যুৎ গেলে তো চুলা, ফ্রীজ সব অচল। আমরা খাবার গরম করব কী করে? আচ্ছা, ফার্নেস বন্ধ হয়ে যাবে না তো আবার আগের মতো? ফার্নেস বন্ধ হয়ে গেলে পুরো বাড়ি ঠান্ডা হয়ে থাকবে যে। এই শীতে হিটার ছাড়া থাকা যাবে না তো।
“উই হ্যাভ ব্লাংকেট, মাম্মা।” পেছনে থেকে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা বলে। এতক্ষণে ব্রায়ান কথা বলে, দেখো, শিশুরাও তোমার থেকে একধাপ এগিয়ে চিন্তা করে।
কী? ওরা বড় হওয়ার আগেই কি তুমি দল পাকাতে শুরু করলে? ভালো হলো না কিন্তু একদম, ব্রায়ান। একদিনেই তো জীবন শেষ হবে না, দিন আরো আছে সামনে। দেখব তখন।
ভয় দেখাচ্ছো? লাভ নেই তেমন। বাচ্চারা স্বচ্ছ, ওরা খুব বেশি নিরপেক্ষ হয়। ওরা নিশ্চিত সত্যের পক্ষে থাকবে। আর আমি তো সত্য ছাড়া অন্য কোনো পক্ষ-ই করি না। এইদিন আর সেইদিনের পার্থক্য তেমন হবে না, রোজ।
“মাম্মা, আই অ্যাম হাঙ্গরি”-বলে ব্রীয়ানা। “মি টুহ্” –যুক্ত হয় রীহ্য়ানা। অধিকাংশ সময় অভিন্ন শব্দ উচ্চারণে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা একত্রে কথা বলে। এমন কি অনালোচিত কোনো বিষয়ও হঠাৎ করে তারা একত্রে উচ্চারণ করে। তখন রোজ ও ব্রায়ান খুব আশ্চর্য হয়। ভাবে, এ কী করে সম্ভব? একত্রে দু’জন মানুষের একই বিষয় নিয়ে ভাবনা এবং অভিন্ন শব্দবিন্যাসে মনের ভাব প্রকাশ করাকে আধ্যাত্মিক কিছু মনে করে রোজ। ব্রায়ান অবশ্য ওদের যমজ জীবনের যুক্তিতে আটকে থাকে। আবার এও দেখা যায়, কখনো তাদের একজন কিছু বলে ফেললে, অন্যজন সাথে সাথে তাকে সমর্থন করে। ব্রায়ান অবশ্য এটাকে ভিন্নভাবে ব্যাখা করে বলে, যমজরা পরস্পর দলকানা সমর্থক হতেই পারে।
পৌঁছে যায় তারা নিজেদের বাড়ি। তুষার স্তুপ ড্রাইভওয়ে। সেখানে গাড়ি নিতে পারে না ব্রায়ান। রাস্তায় গাড়ি রেখে দ্রুত পরিস্কার করে নেয় ড্রাইভওয়ে। গাড়ি রেখে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে তারা। বিদ্যুৎ নেই। সুবাসিত মোমবাতি জ্বালিয়ে রোজ মুখ ভার করে বসে সোফায়। ব্রায়ান পাশে বসে তার কপালে চুমু খায় এবং বলে, আঁধারেরও সৌন্দর্য আছে, ভিন্ন এক সৌন্দর্য, অন্যকে উজ্জ্বল করার সৌন্দর্য। ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ গেছে, চলে আসবে দ্রুত। রোজ ও ব্রায়ানকে ঘিরে বসে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা। শিশুকণ্ঠে তারা উচ্চারণ করে, “হোয়াই আর ইউ স্যাড মামী? স্নো ইজ বিউটিফুল। টুমরো উই উইল মেইক স্নোম্যান।” রোজ তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করে এবং বলে, ইয়েস, টুমরো উই উইল মেইক স্নোম্যান অ্যাট দিদিমণি, দিদিভাই’স হাউজ। নাউ লেটস হ্যাভ ডিনার।
রাতের খাবার শেষে ব্রায়ান জানালার কার্টেন সরিয়ে দিতে দিতে বলে, বাইরের তুষার শুভ্রতায় হোক না হয় আজ আমাদের রাত্রিযাপন। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা সোফায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তুষারপাত দেখতে দেখতে গায়, “ইট’স স্নোইং! ইট’স স্নোইং! উই ক্যান’ট বিলিভ আওয়ার আইস! ইট’স স্নোইং! ইট’স স্নোইং! হোয়াট অ্যা হিউজ সারপ্রাইজ! লাভলি স্নোফ্লেইক ফলিংডাউন…পাইলিং আপ অন দ্যা গ্রাউন্ড! ইট’স স্নোইং! ইট’স স্নোইং! হীপ হীপ হুররে!
পাঁচ
কাঁচা হলুদ মেখে ভোরের সোনালি সূর্য উঁকি দেয় জানালায়। শুরু হয় নতুন একটি দিন। ব্রায়ান ও রোজ তৈরি হয়ে নেয় অফিসের জন্য। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানাও প্রস্তুত তাদের ব্যাকপ্যাক, লাঞ্চ ব্যাগ নিয়ে স্কুলের জন্য। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী তারা। স্কুল তাদের খুব প্রিয়। জানার ও শেখার আগ্রহ তাদের প্রচণ্ড। টেলিভিশনে আবহাওয়ার খবর বলে, বাইরে ঋণাত্মক কুড়ি ডিগ্রী সেলিসিয়াস। ব্রায়ান ভালো করে বাচ্চাদের টুপি, মাফলার, হাতমোজা পরিয়ে দেয়। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে রোজের। তাপসের ফোন। বাচ্চাদের মতো হাউ—মাউ করে কাঁদছে সে অন্যপাশে।
“হ্যালো। হ্যালো, মামা। কী হয়েছে তোমার?” জিজ্ঞেস করে রোজ। কিন্তু কান্না থামে না তাপসের। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কেবল বলে, জুলিয়েট।
– জুলিয়েট! কী হয়েছে তার? কোথায় এখন তোমরা?
– হাসপাতাল।
– কোন হাসপাতাল?
– টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল।
“আমি এক্ষুণি আসছি।” বলে ফোন রেখে দেয় রোজ।
ব্রায়ান জানতে চায় বিস্তারিত। রোজ অনুমান করে বলে, জুলিয়েটের কিছু একটা হয়েছে। মামা তো শুধু বলল, জুলিয়েট। টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল। বেচারা কথাই তো বলতে পারছে না। আমাকে টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে নামিয়ে তুমি কাজে যেও। অফিসে ফোন করে বলে দাও যে তোমার দেরি হবে আজ।
রোজ জুতা পরে বের হতে হতে ব্রায়ান গাড়ি চালু করে গরম করে নেয় দুই মিনিট। সবাই গাড়িতে বসে। ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট হ্যাপেন্ড টু দিদিমণি?” রোজ শুধু বলে, ডোন্ট নো। ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানা অনুমান করে বলে, “মে বি শী হ্যাড টুহ্ মাচ আইসক্রিম। ফিভার, রানিং নোস, সোর থ্রোট।” ব্রায়ান লুকিং গ্লাসে দেখে মেয়েদের দুষ্ট চেহারা কেমন মলিনতায় ভরা। ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানাকে স্কুলে নামিয়ে দেয় রোজ। তারা তার মা’কে আলিঙ্গন করে বলে, “উই লাভ ইউ, মামী।” রোজ তাদের “আই লাভ ইউ টুহ্।” বলে বিদায় নেয়।
গাড়িতে বসে প্রথমেই রোজ অফিসের বসকে টেক্সট করে জানিয়ে দেয় যে সে আজ অফিসে আসছে না। তারপর সে ভাবতে থাকে তার শৈশব, মাতাপিতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, এমন কি কীর্তিপাশার কথা। অস্পষ্ট হলেও মনে আছে জুলিয়েটকে প্রথম দেখার স্মৃতি। জুলিয়েট এক বক্স চকোলেট দিয়েছিল আমাকে। মা জুলিয়েটকে খুব আদর করতেন। আর তারা আমাকে। মামা যতদিন দেশে ছিল, প্রায় প্রতিদিন আমাকে চকোলেট দিত। আমার জন্য সুন্দর দু’টো ফ্রক কিনে এনেছিল ঢাকা থেকে। বাবার অনুপস্থিতিতে মামা লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের সাথে গল্প করত প্রায় প্রতিদিন। জুলিয়েট সেখানে থাকত না তখন। বড় হয়ে জেনেছি, তাপস মামার সাথে মায়ের গভীর সম্পর্কের কথা, যা মা কিংবা তাপস মামা কাউকে বলেনি কখনো। তবে ঠাকুরমা একদিন আমাকে বলেছিল গল্পের ছলে মাত্র। উচ্চশিক্ষার বাহানায় তাপস মামা দেশ ছেড়েছিল আমার মায়ের কারণে। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল বলে। ঠাকুরমা মনে করতেন, মামা জুলিয়েটকে দেশে নিয়েছিল মা’কে দেখাতে, প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু আমাকে দেখে মামা একদম পাল্টে গিয়েছিল। তবে কি…আমি …?
ব্রায়ান গাড়ি পার্ক করে হাসপাতালের ঠিক সামনে। রোজ দরজা খুলতে খুলতে বলে, তোমার অনেক দেরি হয়ে গেলো, ব্রায়ান। আমার জন্য আবার তাড়াহুড়ো করে যেন অফিসের কাজ ফেলে এসো না। ফেরার সময় আমি টিটিসি নিয়ে যাব। ডে-কেয়ার থেকে বাচ্চাদের আমি তুলে নেব আজ। জুলিয়েটের অবস্থা দেখে তোমাকে ফোন করব।
তুমি ভেতরে গিয়ে জুলিয়েট কোন ওয়ার্ডে আছে জেনে আমাকে ফোন করে জানাও। আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি। এতদূর পর্যন্ত যখন এসেছি, একবার দেখে যাই তাকে। অফিসে আরেকটু দেরি হলে অসুবিধা হবে না তেমন। আমি অফিসে ফোন করে দেবো।
“আচ্ছা।” বলে রোজ দ্রুত হাসপাতালে প্রবেশ করে। তাপসকে ফোন করে। তাপস ফোন তোলে না। ইনফরমেশন ডেস্কে জুলিয়েটের নাম দিয়ে খোঁজে। পায় না। ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে ইমার্জেন্সিতে খবর নিয়ে দেখার অনুরোধ করে রোজকে। রোজ ইমার্জেন্সি রুমে প্রবেশ করে। প্রায় সবগুলো চেয়ারেই মানুষ। কেহ রোগী, কেহ রোগীর সাথী। খুঁজে পায় না সে তার তাপস মামাকে। ইমার্জেন্সির ইনফরমেশন ডেস্কে দাঁড়াতেই তার চোখ পড়ে ভেতরের এক রুমে, সেখানে বসে আছে তার মামা, তাপস। মাথায় হাত দিয়ে গভীর কিছু একটা ভাবছে। রোজকে দেখে সে চমকে ওঠে। রোজ তার কাছে যায়, তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা বিলিয়ে দেয়। পর্দার আড়ালে বিছানায় শুয়ে রয়েছে জুলিয়েট। তার মুখে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইন। মাথার ওপর ঝুলে থাকা মনিটরে আঁকাবাঁকা দাগ ওঠানামা করে। রোজ জুলিয়েটের পা স্পর্শ করে। জুলিয়েট পায়ের আঙ্গুল নাড়ে। রোজ টেক্সট করে ব্রায়ানকে।
তাপসের চোখে জল। অস্পষ্ট করে বলে, ভোরবেলা স্ট্রোক করেছে। এম্বুলেন্সে করে এসেছি। ডাক্তার বলেছে অপারেশন লাগবে। যে ডাক্তার অপারেশন করবে সে অন্য আরেকটা অপারেশনে এখন।
ব্রায়ান এসে পৌঁছে। অবস্থা দেখে সে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। একটু বাইরে গিয়ে বসে। রোজ তাকে অনুসরণ করে। ইতোমধ্যে নার্স ও ডাক্তার আসে। ডাক্তার তাপসের সাথে কথা বলে, অপারেশনের জন্য গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে দেয়। নার্সের সহায়তায় ওয়ার্ডম্যান তাকে অপারেশনের জন্য নিয়ে চলে। পেছনে পেছনে তাপস, রোজ ও ব্রায়ান। নির্ধারিত স্থানে থেমে যায় তারা, ভেতরে নিয়ে যায় কেবল জুলিয়েটকে।
রুমের এক কোণে চেয়ারে বসে তারা। অস্থির তাপস। কিছুক্ষণ পর পর সে উঠে দাঁড়ায়, হাঁটে, বসে। ব্রায়ান পানি এনে দেয় তাকে। রোজের হাত ধরে তাপস বলে, গত তিন-চারদিন জুলিয়েট তোমার আর ললিতার কথা বলছিল খুব। তোমার কাছে বাংলাদেশের বইমেলার গল্প শুনে তার মাসব্যাপী বইমেলা দেখার ইচ্ছা জেগেছে। কাল বলল, এবার ফেব্রুয়ারিতে সে বাংলাদেশে যাবে। ঢাকায় ললিতার বাসায় থাকবে। প্রতিদিন একবার করে বইমেলায় যাবে। গ্রামে যাবে শুধু মায়ের কবর দেখতে। গতকাল বেণুকে ফোন করে বলেছে, লন্ডন থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার টিকিট কিনতে।
– মামা, তুমি কি বেণুকে জানিয়েছো?
– না। ওকে জানালে ও পাগল হয়ে যাবে। রেণুর মৃত্যুর পর বেণুটা বড় একা হয়ে গেছে রে।
– যমজ বোনের সম্পর্ক বুঝতে পারি, মামা। আমাদের ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানার সম্পর্ক নিয়ে আমি প্রায়ই গবেষণা করি। মাঝেমাঝে রোজের সাথেও আলাপ করি যমজ সম্পর্ক নিয়ে।
– মামা, বেণুর কষ্ট হলেও ওকে জানানো প্রয়োজন। বড় হয়েছে সে এখন।
– হুম। অপারেশন থেকে জুলিয়েট বের হোক আগে।
দূর থেকে দু’জন নার্সকে দ্রুত পায়ে চলে যেতে দেখা যায়। বুক কেঁপে ওঠে তাপসের। উঠে দাঁড়ায় সে। দরজার কাছাকাছি হাঁটাহাঁটি করে। প্রায় ছয় ঘণ্টা অপারেশনের পর একজন নার্স ও একজন ওয়ার্ডম্যান জুলিয়েটকে নিয়ে যায় আইসিইউ রিকভারি রুমে। ডাক্তার তাপসকে জানায় যে অপারেশন সফল হয়েছে তবে রোগীর রিকভার হতে অনেক সময় নেবে। আইসিইউ রুমে কেবলমাত্র একজন যেতে পারবে একবার একনজর দেখে আসতে।
সন্ধ্যা নেমে এলে রোজ ও ব্রায়ান চলে যায় সন্তানদের কাছে। তারা ব্যর্থ হয় তাপসকে সাথে করে নিয়ে যেতে। তাপস হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করে। তবে, ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয় বাড়ি।
ঘরে ফিরে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে তাপস। রেফ্রিজারেটর খুলে খাবার নেয় প্লেটে। মাইক্রোওভেনে খাবার গরম করে খেতে বসে। কষ্ট হয় তার খেতে। ক্লান্ত শরীর বিলিয়ে দেয় বিছানায়। ঘুম আসে না তার। মনটা খুব চঞ্চল। চোখ বন্ধ করে স্মৃতির হাটবাজারে ঘুরে ঘুরেও অন্তর তার ক্লান্ত হয় না একটুও, বরং ওইসব দিনগুলোই আজ পরম সঙ্গী হয় তার। শান্ত হয়ে পড়ে তখন, যখন দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে।
সেদিন ছিল গ্রীস্মের রৌদ্রোজ্জ্বল এক ছুটির দিন। প্রতি সপ্তাহান্তের মতো সকালের নাস্তা শেষ করেই কিছু খাবার, পিকনিক ব্লাংকেট, চেয়ার ও সাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম দূর পথে। অজানা হালকা জনবসতির সবুজ গাছগাছালি ঘেরা ছোট্ট শহর জুলিয়েটের ও আমার খুব পছন্দ। আমাদের যমজ সন্তান রেণু, বেণুও শান্ত পরিবেশ পছন্দ করত। ওরা যেখানেই যেত সঙ্গে করে সাইকেল নিয়ে যেত। ওদের সঙ্গে আমাদেরও সাইকেল নিতে হতো। তবে অধিকাংশ সময় জুলিয়েট ওদের সাথে সাইকেল চালাতো। আমি চুপচাপ বসে বই পড়তাম কিংবা ছবি আঁকতাম। সেদিনও বৃহৎ বৃক্ষ ছায়ায় আমাকে রেখে জুলিয়েট কন্যাদের নিয়ে সাইকেল চালাতে গিয়েছিল। আমি বসে বসে ছবি আঁকছিলাম আনমনে। কখন যে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়েছিল টের পায়নি। বিকেলের শান্ত হাওয়ায় হাঁটতে এসেছিল স্থানীয় লোকজন। আমার খুব নিকটেই বসেছিল দু’জন বৃদ্ধ। তারা আড়চোখে আমার ছবি আঁকা দেখছিল ও গল্প করছিল। গল্পের বিষয় ছিল সড়ক দুর্ঘটনা। আমার কানে ভেসে এসেছিল ব্রিটিশ উচ্চারণে তাদের কথোপকথন, “প্যাথেটিক! ফিল সো সরি ফর দ্যা ফ্যামিলি। মে বি দে কেইম ফ্রম ডিফারেন্ট টাউন। উই ডিডন’ট সি দেম বিফোর।”
চারদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খুঁজছিলাম আমি। দু’জন বৃদ্ধকে দেখে ভেবেছিলাম, ওনারা আমার মনোযোগ নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এত কাছে এসে বসেছে কেন? জুলিয়েট, রেণু, বেণু এখনও ফিরে আসেনি? এমন তো কখনো করে না ওরা। প্রতি বিশ-ত্রিশ মিনিট পর পর ওরা ঘুরে আসে, জুস, স্যান্ডউইচ, চিপস খায়; কিছুক্ষণ বকবক করে আমার মনোযোগ নষ্ট করে আবার ফিরে যায়। খুব দূরে গেলেও এক ঘণ্টা ওদের সময় বাঁধা। আজ এখানকার সুপার মার্কেট খুঁজে আইসক্রিম কিনে আনার কথা বলছিল, হয়তো সুপার মার্কেট-ই খুঁজে পাচ্ছে না।
একটু বিরক্ত হয়েই তখন ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে চেয়ারে বসলাম। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধদের উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলাম, ক্যান আই আস্ক এ কোসশেন?
– ইয়েস। হাউ ক্যান উই হেল্প ইউ?
– ডু ইউ নো, হাউ ফার ইজ সুপার মার্কেট?
– নট ফার। জাস্ট টু ব্লকস্ ফ্রম দ্যাট চার্চ।
– থ্যাঙ্ক ইউ।
– ইউ ওয়েল কাম। বিউটিফুল পেইনটিং।
– থ্যাংকস।
– আই ডিডন’ট সি ইউ বিফোর। ডীড ইউ মুভ হিয়ার রেসেনটলি?
– নো। আই অ্যাম ভিজিটর। কেইম টু এনজয় বিউটি অফ মাদার ন্যাচার। মাই ওয়াইফ এন্ড টুইন ডটর্স ওয়েন্ট ফর বাইকিং।
– ডু ইউ নো, দেয়ার ওয়াজ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট?
– হোয়ার?
– ফ্রন্ট অফ সুপার মার্কেট।
বৃদ্ধদের দেয়া তথ্যে দিশেহারা হয়ে পড়লাম আমি। সমস্তকিছু রেখেই হাঁটতে শুরু করলাম। বৃদ্ধদের একজন কণ্ঠ শান্ত করে পেছন থেকে বলল, এ্যাম্বুলেন্স টুক থ্রি বাইকারস টু দ্যা হসপিটাল, মাদার এন্ড টু চিলড্রেন। ইউ বেটার চেক ইউথ হসপিটাল। ইট সিমস্……
আমি দিশেহারা হয়ে গাড়িতে ছুটলাম। বৃদ্ধদের একজন উঠে এসে হাসপাতালের ঠিকানা বলে গেলো। হাসপাতাল পৌঁছে জানতে পারলাম, বেণু ভালো আছে, কেবল হাত-পা কেটেছে; জুলিয়েটের দু’টো চোখই ক্ষত হয়েছে, অপারেশন লাগবে, তবে এখনই অপারেশন করা যাবে না; রেণুটা আকাশের তারা হয়ে গেছে।
ছয়
টরন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্টের তিন নাম্বার প্লাটফর্ম। উসখুস মনে রোজের কফি পান যেন অলস ছন্দ ও তালের নাচন। ফ্লাইটের অপেক্ষায় মন্থর গতিতে কফি পানের বিরতিতে বিরতিতে আগমন সময়সূচি বার্তা পর্দায় চোখ বুলায় রোজ। এয়ার কানাডার নির্দিষ্ট ফ্লাইটের ত্রিশ মিনিট বিলম্বিত সময়সূচি দিয়ে তার অপেক্ষা শুরু হলেও ক্রমেই তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অতিক্রম করে পুরো একঘণ্টা বিলম্ব হওয়ার পরও আরো কুড়ি মিনিট বিলম্ব হবে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পর্দা পরিবর্তন হচ্ছে, সময়সূচি বদলাচ্ছে। গত একঘণ্টায় ব্রায়ান তাকে ফোন করেছে অন্তত পাঁচবার। প্রতিবার প্রায় একই প্রশ্ন, “প্লেন আসতে আর কতক্ষণ? লন্ডনের অন্যান্য ফ্লাইটগুলোও কি বিলম্বিত? ফ্লাইট কি লন্ডন থেকেই ছাড়তে দেরি করেছে?” ইত্যাদি। রোজ ব্রায়ানকে অতিরিক্ত চিন্তা করতে নিষেধ করে এবং কাজে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফোন রেখে দেয়।
রোজের মন উড়ে চলে তার শৈশব, কৈশোরের কাঁচা-সোনার দিনগুলো। কেমন খাঁটি মেটে এক গন্ধ ছিল সেখানে, সবুজ বনবাদাড়ে লতিয়ে লতিয়ে বেড়ে চলায় সজীবতাও ছিল টসটসে। বিশুদ্ধ আনন্দ ছিল জীবনের পরতে পরতে। মায়ের ভালোবাসা, বাবার কড়া শাসন, ঠাকুরমা’র মুঠো মুঠো দুষ্টুমি, মাসি-পিসিদের প্রাণখোলা গল্প, মামা-কাকাদের নিঃস্বার্থ আদর সোহাগ। বন্ধুরাও ছিল ভীষণ মুক্তমনের। বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পিসিদের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়ায় ছিল অদ্ভুত এক ধরণের আনন্দ। মাসিদের সাথে মেলায় গিয়ে লাইন ধরে বায়স্কোপ দেখার অভিজ্ঞতা তো ভোলার নয়। পূজোর ছুটিতে আমাদের বাড়িটি হয়ে যেত সংস্কৃতি অনুশীলন কেন্দ্র। ঠাকুরমা হতেন বিচারক। পিসিমা তার কলেজের বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির বৈঠকখানায় সঙ্গীত চর্চা করত, আর খোলা ছাঁদে ছোট কাকু তাদের দলের সদস্যদের নিয়ে নাটকের মহড়া। ঠাকুরমা সুযোগ করে বলে যেতেন, “ওরে দলীয় সংগীত যত সহজ মনে করেছিস, তত সহজ কিন্তু না। পরস্পর গলা না মিলালে মনে হয় হ-য-র-ল-ব! একা গান করতে হারমোনিয়াম আর তলবার প্রতি নজর রাখলেই চলে। দলীয় সঙ্গীতে বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি পরস্পরের গলা ও সুরের প্রতিও নজর দিতে হয়।” ঠাকুরমা’র এমন মন্তব্যে ছোট কাকুর বন্ধুরা খুব মজা পেত, খটখট করে হাসত। ঠাকুরমা তাদের হাসির মাঝে ফোকলা দাঁতে এক ঝলক কুটিল-হাসি দিয়ে বলতেন, “ওহে বোকার দল, এমন খটখট না হেসে, নিজেদের চরকায় ডালডা মাখ। অভিনয় আর ডায়লগে মিল না থাকলে কৃত্রিম মনে হয় সব।” বাবা বাড়িতে প্রবেশ করেই বলত, “কইরে সবাই? রোজ, ললিতা, তোমরা সব গেলে কোথায়?” আমি দৌড়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়ালেই বাবা খুব মিষ্টি করে বলত, “এক ঘটি জল নিয়ে আয়রে, মা। তোর মাকে বল যে পূজো মণ্ডপে কাজ করতে দেরি হয়ে যাবে আজও, পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবক রাতে আহার করবে আমাদের বাড়িতে।” আমি অমনি এক দৌড়ে গিয়ে মাকে বলতাম, “মা, বাবা বলেছে পাঁচজন বড় কুটুম আজ রাতে খাবে। ভালোমন্দ রান্না করো। এর আগে বাবা এক ঘটি জল চেয়েছে।” মাকে খবরটা পৌঁছে দেয়া পর্যন্তই ছিল আমার দায়িত্ব। তারপর মা সামলে নিত নিজের মতো করে। যখনই মা মোয়া ও জল নিয়ে বাবার কাছে যেত। বাবার থেকে সঠিক তথ্য পেয়ে আমাকে খুঁজত দু’জনেই, “মিথ্যে বলে কই পালালো বাঁদরটা?” অকারণে স্বেচ্চাসেবকদের বাড়ির বড় কুটুম বলায় কতবার যে কানমলা খেতে হয়েছে, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। ব্রায়ানকে বিয়ে করার পর পূজো ও বড়দিন দু’টোই আমার উৎসব। তারপরও দেশ থেকে বহুদূরে আপনজন বিহীন উৎসবগুলো খুব পানসে মনে হয়। মা আছেন বাবার স্মৃতি নিয়ে তাঁর ভাইবোন, দেবর-ননদ ও তাদের সন্তানদের নিয়ে বেশ। ঢাকার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর নাকি দম বন্ধ হয়ে যায়, সেজন্য সেটা তালাবদ্ধ রেখে প্রায়ই থাকেন গ্রামের বাড়ি। সেই পুরানো পদ্ধতিতে সকাল বিকাল এখনও বাড়িতে কত মানুষের যাতায়াত! সকলেই মাকে খুব সম্মান করেন। তারা সম্মান করেন পরিবারের প্রতি মায়ের ত্যাগ স্বীকারকে, তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসাকে। যখন দেশে যাই বিদেশে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু ব্রায়ানের কথা ভেবে ফিরে আসতে হয়। তবে, তাপস মামা ও জুলিয়েটের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর খুব ভালো কেটেছিল গত পাঁচটা বছর। মনে হতো, জীবন পরিক্রমায় পুরানো দিনগুলো ফিরে এসেছে আমার কাছে। ব্রীয়ান ও রীহ্য়ানা তাদের দিদিভাই ও দিদিমণিকে নিয়ে কেমন পাল্টে গিয়েছিল, তৈরি করে নিয়েছিল এক জাদুর পৃথিবী। এক বছর পূর্বে অর্ধ-প্যারালাইজড জুলিয়েটকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে দেখে ভয়ে মামা জীবন দিয়ে পালাল। বেণু তার মাকে নিয়ে গেলো লন্ডন নিজের কাছে। অবশ্য জুলিয়েটের মাতৃভূমিও তো ইউরোপ। সেখানে রেণু আছে। সুতরাং ঝামেলা ছাড়াই সে খুশি মনে চলে গেলো। যাওয়ার সময় অবশ্য জুলিয়েট আমার কানে মুখ লাগিয়ে অস্পষ্ট করে বলেছিল, “তোমার তো ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানা ও ব্রায়ান আছে। বেণুটা বড্ড একা।”
আগমন-সময়সূচি বার্তা পর্দায় চোখ পড়তেই চমকে ওঠে রোজ। ফ্লাইট অবতরণ করেছে তাও প্রায় পাঁচ মিনিট। রোজ, কফি কাপ ফেলে মন্থর গতিতে হেঁটে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায়। একজন, দু’জন করে বেশ কয়েকজন যাত্রী বেরিয়ে এসেছে ইমিগ্রেশন শেষে ধীরে ধীরে। রোজের চোখ অনড়, হৃদয় ব্যাকুল, ভাবনা অসীম। দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গেটের বাইরে আসে বেণু। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব তার, দূরের কাছের সকল মানুষই তার কাছে মূল্যবান। সে রোজকে জড়িয়ে ধরে, ঠকঠক হৃদস্পন্দন জানিয়ে দেয় তার ভিতরের আবহাওয়া বার্তা, চোখ মুছতে মুছতে বলে, খুব দেরি হয়ে গেলো। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো তোমাকে।”
“দেরি তো আর তুমি ইচ্ছে করোনি। ফ্লাইট বিলম্ব হলে তোমার কী-ই-বা করার আছে? নিরাপদে এসে পৌঁছেছ, এটাও কি আর কম প্রাপ্তি? অনেক ধকল গেছে নিশ্চয়ই। এবার চলো বাড়িতে।” বলতে বলতে বেণুর হাতের রোলিং সুটকেস ধরে নিজের দিকে নেয় রোজ।
বেণু সুটকেস নিজের হাতেই রেখে সম্মুখে পা বাড়িয়ে বলে, হুম! ইঞ্জিনের কি এক সমস্যা দেখা দিয়েছিল বিমান উড্ডয়নের ঠিক আগ মুহুর্তে। জানালা দিয়ে দেখছিলাম টেকনিশিয়ান এলো, তারপর একটু একটু করে বেশ দেরি হয়ে গেলো। তখন তোমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলে ভালো হতো। আচ্ছা, টুনটুনি দু’টো কেমন আছে?
-ভালো আছে ওরা। আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ওদের এক ক্লাসমেটের আজ জন্মদিন। ক্লাসে পার্টি করবে বলব।
-এক বছরে নিশ্চয়ই বড় হয়ে গেছে। দুষ্টুমিও কমেছে হয়তো?
– দুষ্টুমির কথা বলো না। দিনদিন আরও দুষ্টু হচ্ছে দু’টোই। একজন অন্যায় কিছু করলে, দু’জনে মিলে সেটা ন্যায় বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করে আজকাল।
– হা হা হা। রেণু আর আমিও কিন্তু একই কাজ করতাম। আমাদের আচরণে বাবা মাঝেমাঝে রেগে যেত, আর মা হাসত।
– ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানাকেও খুব আদর করত জুলিয়েট। সে শক্ত এক সম্পর্ক গড়েছিল ওদের সাথে। ওরা জুলিয়েটের প্রতিটি কথা শুনত এক বাক্যে।
– মা ছিল এমনই একজন সেঁতু বন্ধনে পাকা মিস্ত্রী।
– তুমিও কি কম?
পার্কিং লটের এসে চাবি চেপে গাড়ি খোঁজে রোজ। টুকটুক শব্দ শুনে এগিয়ে যায় গাড়িতে। সুটকেস রেখে গাড়িতে বসে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় পার্কিং লট থেকে। হাইওয়ে ফোর-ও-ওয়ান ধরে দ্রুত গতিতে তারা চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
স্কুল থেকে ফিরেই ব্রীয়ানা, রীহ্য়ানা জড়িয়ে ধরে বেণুকে, যেন আপনজন ফিরে এসেছে বহুদিন বাদে। বেণুও তার সুটকেস খুলে তাদের জন্য বয়ে আনা চকোলেট, পুতুল বের দেয়। তাদের সাথে গল্প করে, তাদের প্রিয় দিদিমণির গল্প, দিদিভাইয়ের গল্প। যেন শেষ হতে চায় না তাদের ভালোবাসায় নির্মিত দিনগুলোর গল্প। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে ব্রায়ান। সেও যোগ হয় তাদের গল্পে। ব্রায়ান যোগ হওয়ায় পাল্টে যায় তাদের গল্পের অলিগলি।
রাত প্রায় এগারোটা। ঘুমিয়ে পড়েছে ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানা। লিভিং রুমের সোফায় বসে রোজ ও ব্রায়ান টেলিভিশন দেখছে। হাতে হলুদ খাম নিয়ে তাদের সাথে যোগ হয় বেণু। সে খামটি রোজের হাতে দেয়। প্রশ্নবোধক চাহনিতে রোজ তাকিয়ে থাকে বেণুর দিকে। বেণু বলে, “খুলে দেখো।” রোজ খাম খুলে দু’টো ভাঁজ করা কাগজ পায়। একটি চিঠি। অন্যটি উইল। চোখ মোছে, বিষম খায় রোজ। প্রথমে সে চিঠি খুলে পড়ে,
প্রিয় রোজ,
আজকাল প্রায়ই স্বপ্নে আসে তপু। আমাকে ডাকে। পারলে সে এক্ষুণি নিয়ে যায় নিজের কাছে। আমিও প্রস্তুত। জানি না কখন তপু নিয়ে যাবে আমাকে তার কাছে। তাই লিখে রাখছি চিঠিটি। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, তোমাকে ফোন করে বলতে পারিনি কিংবা নিজের হাতে লিখতে পারিনি বলে। ব্রায়াল পদ্ধতিতে লিখলে তোমার পড়তে অসুবিধা হবে বিধায় আমার অনুরোধে বেণু হাতে লিখে দিয়েছে চিঠিটি।
এক সন্তান হারানো বেদনা কিছুটা হলেও কমেছে তোমাকে পাওয়ার পর থেকে। তপুকে আমি প্রাণ খুলে পূনরায় হাসতে শুনেছিলাম ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানার সান্নিধ্যে। আদরণীয় রোজ আমার খুব নিকটতম হয়েছিল সেদিন, যেদিন তোমার পুরাতন অ্যালবামে তোমার মায়ের ভরা তারুণ্যের ছবি দেখে তপু বিরতিহীন স্মৃতিচারণ করছিল, তার চোখ দু’টো কেমন জ্বলজ্বল করছিল তা দেখতে পাইনি ঠিক, তবে অনুমান করতে পারছিলাম সম্পূর্ণ। সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম আমি তপুর অতীত। খুব ইচ্ছে ছিল ললিতার সাথে কিছুদিন কাটাবার, পারিনি। এমন কি তপুকেও পাঠাতে পারিনি আমি, ওটা আমার জীবনের চরম ব্যর্থতা। তপুর মৃত্যুর পর লতিতাকে ফোন করেছিলাম, তপুর হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলাম আমি, লতিতা শুধু কেঁদেছিল, কিছুই বলতে পারেনি সে আমাকে কিংবা তোমাকে। আমি তার কষ্টের প্রতিটি অণু-পরমাণু অনুভব করতে পারি। আমার বিশ্বাস তুমিও পারবে।
ঈশ্বর রেণুকে নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের জীবনে। বেণু তার বড় বোন পেয়েছে। সত্য মুখোমুখির ভয়ে তপু পালালেও আমি পালাতে পারি না। তাই হয়তো ঈশ্বর আমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। তুমি তপুর একজন উত্তরাধিকারী। আমার উইলে আমি তোমার প্রাপ্যটা উল্লেখ করেছি। সম্ভব হলে, ক্ষমা করে দিও তোমার জন্মদাতা পিতা, মাতা ও আমাকে। বেণুটা নিষ্পাপ। ওর কোনো অপরাধ নেই আমাদের আলুথালু জীবন গাঁথনিতে। ওকে দূরে সরিয়ে দিও না কোনোদিন।
ব্রায়ান, ব্রীয়ানা ও রীহ্য়ানাকে আমার স্নেহ দিও।
ইতি,
জুলিয়েট
মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোজ। ব্রায়ান চিঠিটা নিজের হাতে নেয়, পড়ে। নীরব বেণু। হঠাৎ বাঁধভাঙা কান্না বেরিয়ে আসে রোজের কণ্ঠ ফেটে, সত্যটা কেমন পাথরের থেকেও কঠিন ও ভারী। বুকের মধ্যে পড়তেই কেমন চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে অন্তর। বেণু, আমার অবোলা মাকে ক্ষমা করিস বোন আমার।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..