করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
বাউলেরা বাংলার দার্শনিক, পাশ্চাত্যে দার্শনিকেরা যুক্তি দিয়ে যেসব বলে গেছেন বাউল গানে আমরা সেরকম একই কথা ও ভাবের সন্ধান পাই। পাশ্চাত্য দর্শনের গুরু সক্রেটিসের অমর বাণী, ‘নিজেকে জানো’ আর বাউলের দেহতত্ত্বের মধ্যে মিল সচেতন পাঠক মাত্রেরই দৃষ্টিগোচর হবে। যা নেই দেহ ভান্ডে, তা নেই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে। তাই সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ করতে হলে এ দেহের মাঝেই খুঁজতে হবে। লালনের ভাষায়,
“দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা।।
ডুবলে পরে রতন পাবি ভাসলে পরে পাবি না
দেহের মাঝে বাড়ি আছে
সেই বাড়ীতে চোর লেগেছে
ছয় জনাতে সিঁদ কাটিছে,
চুরি করে একজনা।।
এই দেহের মাঝে নদী আছে
সেই নদীতে নৌকা চলছে
ছয় জনাতে গুণ টানিছে,
হাল ধরেছে একজনা।।
দেহের মধ্যে বাগান আছে
নানা জাতির ফুল ফুটেছে
ফুলের সৌরভে জগত্ মেতেছে
কেবল লালনের প্রাণ মাতাল না।।”
বাউল মনে করে দেহের ভেতরে অর্থাৎ আমাদের চেতনার মাঝেই পরম সত্য লুকিয়ে আছে, সেটাকে খুঁজে বের করতে হবে। বাহিরে সত্য খুঁজে লাভ নেই, তাতে কেবল ধাঁধায় পড়তে হয়। ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা এবং আমাদের চিন্তার ক্যাটেগরিক্যাল কাঠামো দিয়ে সত্যকে জানা অসম্ভব। আমাদের সত্ত্বা যেহেতু দেহের কাঠামোতে আবদ্ধ তখন সত্যকে জানতে হলে এ দেহটাকে আগে জানতে হবে। মানব দেহ প্রকৃতির সবচেয়ে জটিল গ্যাজেট এবং সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। একে সঠিকভাবে পরিচালনা এবং তার নাড়ী-নক্ষত্র সম্বন্ধে একটা ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং না থাকলে সকল বাহ্যিক জ্ঞান বৃথা, কারন যার কাছের জিনিসটাই জানা হল না সে দূরের বিষয় নিয়ে কথা বলে কিভাবে। নিজেকেই যার জানা হল না, সে কিভাবে পরকে নিয়ে মন্তব্য করে? কিন্তু এ কাছের মানুষকে চেনাটা সহজ কাজ নয়। ষড়রিপুর জাল দিয়ে তাকে ঘেরা আছে, তারা সহজে জানতে দিবে না। তাই জানার জন্য প্রথম ধাপ হল এতে ডুব দেয়া। কাছের মানুষ, অন্তর্যামী, অন্তরঙ্গকে ডাকার জন্য দূরে কোথাও যাবার বা হই-হট্টগোল করার দরকার নেই। লালনের ভাষায়, ‘কাছের মানুষ ডাকছ কেন শোর করে?’
“ কাছের মানুষ ডাকছ কেন শোর করে।।
তুই যেখানে সেও সেখানে, খুঁজে বেড়াও কারেরে।।বিজলী চটকের ন্যায়, থেকে ঝলক দেয়, রংমহাল ঘরে,
তাঁর পাশাপাশি অহোনিশি, থাকতে দিশে হয় নারে।।হাতের কাছে যারে পাও, ঢাকা দিল্লী খুঁজতে যাও,
কোন অনুসারে, এমনও কি বুদ্ধিনাশা, তুই হলি সংসারে রে।।ঘরের মধ্যে ঘরখানা, খোঁজরে মন সেই খানা কে বিরাজ করে,
সিরাজ সাঁই কয়, দেখরে লালন, সে কিরূপ তুই কিরূপ রে।।”
এক হতেই দুইয়ের সৃষ্টি। নবী ইব্রাহিমের অনুসারী সব ধর্মেরও মূলকথা এই ‘তাওহীদ’ বা একত্ববাদ। আত্মানং সিদ্ধি, নিজেকে জানার মধ্যেই রয়েছে সাধনা, সিদ্ধি। একটা প্রচলিত আরবী কথা আছে, ‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’, ‘Whosoever knows himself knows his Lord’ । অর্থাৎ, যে তার নিজেকে জেনেছে সে তার রবকে জেনেছে।
সূফী মনসুর হাল্লাজ বললে গেছেন, ‘আনাল হক’, আমিই হক বা খোদা। তার সমকালীণ মানুষের অজ্ঞতার কারনে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়, অথচ বৈদিক ঋষিরা কত আগে এসব বলে গেছেন।
দুনিয়ার প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদ। চার বেদে চারটি বাক্য আছে যেগুলো মহাবাক্য নামে পরিচিত। এ মহাবাক্যগুলোতে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলা আছে।
# ঋকবেদ এ আছে-
প্রজ্ঞানাম ব্রহ্মা – ব্রহ্মজ্ঞানই ব্রহ্মা, অর্থাৎ, ব্রহ্মের জ্ঞান থেকে ব্রহ্মকে আলাদা করা যায় না।
# অথর্ববেদ মতে-
অয়মাত্মা ব্রহ্মা – আত্মাই ব্রহ্ম ; আমার আত্মার সাথে পরমাত্মা সম্পর্কিত।
# সামবেদে আছে ঋষি উদ্দালকের ছেলে শ্বেতকেতু বাবার কাছে প্রশ্ন করে, বাবা ঈশ্বর কী রকম, তাঁর স্বরূপ কী? জবাবে ঋষি উদ্দালক মহাবাক্যটি বলেন-
তত্ ত্বম আসি- তুমিই সে ।
# যযুরবেদ অনুসারে-
অহম ব্রহ্মাস্মি – আমিই ব্রহ্মা, অর্থাৎ অহম বা ‘আমি’ রুপে যে কর্তাসত্ত্বা বিরাজ করে তিনিই ব্রহ্মা।
মধ্যযুগের অন্যতম সূফি সাধক ফরিদ উদ্দীন আত্তার (১১৪৫-১২২১ খ্রিঃ) তার বিখ্যাত “মানতিকে তাইয়ার” বা “পাখির সমাবেশ” বইয়ে একই কথা প্রচার করেছেন। তার কাব্য মাওলানা রূমি সহ অনেক সূফি কবিদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিল। বইয়ের কাহিনী খুব সংক্ষেপে এমন-
একবার পাখিদের সম্মেলনে একট গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা হল।দুনিয়াতে নগর ভিত্তিক সভ্যতার পতনের পর থেকে দেখা গেছে সব জনগোষ্ঠির একজন করে রাজা আছে, কিন্তু পাখিদের কোন রাজা নেই। তাই নানান আলাপ-আলোচনার পরে পাখিরা সব একমত হল যে তাদেরও একজন রাজা বা নেতা দরকার।
এমন সময় সমস্যার সমাধান করতে হুদহুদ (hoopoe) নামের পাখি এগিয়ে এল। হুদহুদ পাখিদের মধ্যে জ্ঞানী, কোরাণে এ পাখির উল্লেখ আছে, সে সোলেমান রাজার পয়গাম নিয়ে শিবার রাণি বিলকিসের সাথে দেখা করতে যায়।তো হুদহুদ পাখিদের বলে, “প্রিয় পাখিরা, আমি জানি কে আমাদের রাজা হবার উপযুক্ত। তার নাম সিমুর্গ, আমি তার অবস্থান সম্পর্কে জানি, ককেসাস পর্বতের (কুহে কাফ) অপর পাশে সে বাস করে। সে আমাদের খুব কাছেই বাস করে, কিন্তু আমরা তার কাছ থেকে অনেক দূরে। তার কাছে যাবার পথে অনেক বাধা-বিপত্তি। লক্ষ লক্ষ পাখি তার সন্ধান চায়, তাকে একবার দেখতে চায়, কিন্তু তার কাছে পৌঁছাবার পথ জানে না।আমি জানি কিন্তু একা তার সন্ধানে যাবার মত শক্তি আমার নেই। যদি তোমরা সবাই আমার সাথে যেতে চাও তবে আমি তোমাদের সেখানে পৌঁছতে সহায়তা করতে পারি। এর জন্য দরকার শারীরিক-মানসিক শক্তি, দৃঢ় চেতনা এমনকী এ পথে জীবন বিপন্ন হতে পারে। আমরা যদি একবারও তাকে দেখতে পাই সেটা একটা চরম পাওয়া হবে। আর যদি আমরা তাকে দেখার, জানার কোন চেষ্টা না করি, এবং তাকে দেখতে ব্যর্থ হই, তাহলে এ জীবনে আর কাজ কী।”
যাই হোক পাখীরা হুদহুদ পাখীর নেতৃত্বে সিমূর্গের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, পথিমধ্যে অনেক পাখী মারা যায় এবং শেষ পর্যন্ত অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পাখীরা অর্ধমৃত অবস্থায় সিমুর্গ নামক পাখীর কাছে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারে আসলে সিমুর্গ বলে কোন পাখী নেই। সিমুর্গকে দেখার জন্য তাদেরকে নিকটস্থ একটা জলাশয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতিরূপ দেখতে বলা হয়।
একই রকম আরেক গলপে আছে একবার এক সাধক অনেক সাধ্য-সাধনা করে প্রেমাস্পদের ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছায়। তারপরে দরজায় টোকা দিলে ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে, কে ? তখন সাধক বলে, আমি। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা খোলে না, সাধক বিফল মনোরথ হয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তার এতদিনের সাধনা কোন কাজে আসল না, এখন শেষ মাথায় এসে ব্যর্থ হতে হল। আরো কিছুকাল পরে সাধক আবার এসে তার প্রেমাস্পদের দরজায় টোকা দেয়। এবারও ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে, কে? এবারে সাধু জবাব দেয়, তুমি। তখন সাথে সাথে দরজায় খুলে যায়। কারন সে ঘরে দুজনের জায়গা নেই, তাই প্রথমবার দরজা খোলেনি। এবার যেহেতু সাধু নিজেকে তুমি বলে পরিচয় দিয়েছে তখন দরজা খুলে গেছে।
মধ্যযুগের আরেক বাঙালী কবি চন্ডীদাস বলে গেছেন, ‘শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাউলও মানুষকে ভজে, মানুষের মাঝে সে অধরা মানুষকে খুঁজে। মানুষের সেবা, ভজনেই নিজের মুক্তি আছে বলে মনে করে।
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।
এই মানুষে মানুষ গাথা
গাছে যেমন আলকলতা।
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
জাতে ত্বরবি।। ”
বাংলার অন্যতম প্রধান পুরুষ, বাংলা নব-জাগরণের পথিকৃত নদীয়ার শ্রীচৈতন্য এসে বেদ,পূরাণ, জাত-পাত সব বাতিল করে দিয়ে বললেন, ‘বেদের জটিল উপাসনার কোন দরকার নাই শুধু তাঁর নাম নিলেই হবে’। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলায় লালন ফকির বলেন, ‘আল্লা, আদম, আর মোহাম্মদ, এ তিনজনায় নাই ভেদাভেদ’, ‘খোদা রয় আদমে মিশে’।
‘সে কি অন্যতত্ত্ব মানে, মানুষতত্ত্ব সত্য হয় যার মনে’।
যে মানুষকে চিনতে পেরেছে, আত্ততত্ত্বের ভেদ জেনেছে তার কাছে অন্য কোন তত্ত্ব পাত্তা পাবে না। নিজেকে জানতে পারলেই তবে সাধন সম্পূর্ণ হয়। আধুনিক দর্শনের ‘হার্ড প্রবলেম অফ কনশাসনেস’ এর জবাবও এতে মিলে।
“আমি কে জানলে সাধন সিদ্ধ হয়।
আমি কী তাই জানলে সাধন সিদ্ধ হয় ।
আমি কথার অর্থ ভারি আমাতে আর আমি নাই ।।অনন্ত শহর বাজারে
আমি আমি শব্দ করে
আমার আমি চিনতে নারে
বেদ পড়ি পাগলের প্রায় ।। ”
এই বাংলায় আরেক কবি হাসন রাজা বলেন,
“হাসন রাজায় কয়, আমি কেউ নই রে, আমি কেউ নয়
অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়।”
আত্মপোলব্ধির পরে কবি নিজেকে আর বিশ্ব চরাচর থেকে আলাদা করে ভাবতে পারে না। কবির অন্তিম উপলব্ধি হয় যে কানাইকে সে আদাড়ে-বাদাড়ে খুঁজে বেড়িয়েছে যে কৃষ্ণ আসলে কবি নিজেই।
“হাসন রাজায় জিজ্ঞাস করে কানাই বা কোনজন
ভাবনা-চিন্তা কইরা দেখি কানাই যে হাসন।”
আমাদের সময়ে এসে লেখক, দার্শনিক জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি বলেন, ” I was an atheist, until I realized I am God”। ঠিক একই উপলব্ধি না হলেও যুগে, যুগে নানা দেশের সূফি, সাধক, লেখক, দার্শনিকেরা একই কথা বলে গেছেন। আপনার মাঝে আপনাকে, বিশ্বজগতকে খুঁজে পেতে হবে। The truth is not out there, সত্য বলে কিছু থাকলে তা মানুষের মধ্যেই আছে। মাইক্রকসমের মাঝেই ম্যাক্রকসমের রহস্য লুকায়িত আছে। সত্যের সন্ধানে রত হলে এটা না জেনে আমাদের নিস্তার নেই। বাউলের কঠোর উচ্চারণ, আমি সত্য না হলে গুরু সত্য হতে পারে না। ‘স্বরূপে রুপ আছে গিলটি করা’, আমার মাঝ দিয়েই জগতকে দেখতে হবে।
“ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না বুঝে বাহিরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।।
আমি সত্য না হইলে
হয় গুরু সত্য কোন কাজে
আমি যেরূপ দেখ না সেরূপ দীন দয়াময়।।
আত্মরূপে সেই অ-ধর
সঙ্গী অংশে কলা তার
ভেদ না জেনে বনে বনে ফিরিলে কি হয়।।
আপনার আপনি না চিনে
ঘুরবি কত ভুবনে
লালন বলে, অন্তিম কালে নাই রে উপায়।।”
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..