মন মজালে ওরে বাউলা গান (পর্ব – ১)

নাজিম উদ্দিন
প্রবন্ধ, সঙ্গীত
মন মজালে ওরে বাউলা গান (পর্ব – ১)

বাউল গান বাংলার এক অপূর্ব সম্পদ। বাংলাদেশ জ্ঞানীর আঁতুড়, এখানে অনেক মনীষী, সাধু, সন্ন্যাসী জন্মেছেন এবং বাউলেরা বাংলার দার্শনিক। বাংলাদেশে একাডেমিক দর্শনের চর্চা নাই বললেই চলে যে কারনে আরজ আলী মাতুব্বরের মত অর্ধশিক্ষিত, ক্ষুব্ধ মানুষের রচনা বাংলাদেশে দার্শনিক রচনার আখ্যা পায়। এটা আমাদের ইংরেজি শিক্ষিত দর্শনের অধ্যাপকদের ব্যর্থতা যে তারা গত দুশো বছরে বাংলায় কোন দর্শন, দার্শনিক ভাষা তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু বাংলার বাউল-ফকির-কর্তাভজা ইত্যাদি নানা সম্প্রদায়ের অবদানের কারনে বৃহত্তর সমাজে একাডেমিক দর্শনের অভাব বোধ হয়নি। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির মাঝে একাডেমিক দর্শনের আবেদনের কোন জায়গাও ছিল না।

বাংলার বাউল-ফকিরেরা আমাদের দার্শনিক। তারা তাদের গানের মাধ্যমে, জীবন চর্চার মধ্য দিয়ে দার্শনিক প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন, দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। একদিক দিয়ে আমরা সৌভাগ্যবান যে একাডেমিক শুষ্ক দর্শনের বদলে আমরা বাউলদের জীবন্ত দর্শন পেয়েছি, অধ্যাপকের মত পান্ডিত্য না করে তারা জীবন এবং চর্চার মাধ্যমে তাদের দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেছেন। সত্য এমনই, নিজের জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠা/রচনা না করলে সেটা অন্য কারো সত্য হতে পারে কিন্তু দার্শনিক বা বক্তার জন্য সত্য নয়। কবিগুরু বলেছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, আর সব সত্য নহে’। বাউল দর্শন তেমনি এক জীবন্ত দর্শন।
ভারতীয় দর্শনের চর্চায় ধর্ম, আধ্যাত্মবাদ গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য দর্শনে যুক্তি থেকে যেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয় সেখানে ভারতবর্ষে ধর্মীয় আবহ, ধর্মীয় অবস্থান থেকে দর্শনের চর্চা শুরু হয়। তাই ভারতে দর্শনের ভিত্তি হলো ধর্ম, অপরদিকে ইওরোপের দর্শনের ভিত্তি যুক্তি। ভারতীয়রা ধর্ম ব্যবহার করে সেই প্রাচীনকালে দর্শনে যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে মাত্র দুশো বছর আগে ইওরোপীয়ান দর্শন (কান্ট, শোপেনহাওয়ার) ভারতীয় দর্শনের নাগাল পায়। এবং তারপরেই পাশ্চাত্য দর্শনে আমূল পরিবর্তন আসে। পাশ্চাত্য দর্শন সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই ভারতীয় উপনিষদ রচনা শুরু হয়েছিল। গ্রিক দর্শন যখন তৈরি হচ্ছিল ততদিনে ভারতীয় হিন্দু এবং বৌদ্ধ দর্শন এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রাজত্ব করছে। বর্তমান সময়ের দর্শনের ঐতিহাসিক Bryan Magee’র মতে-

“Eastern philosophy appears to have been metaphysically more profound and philosophically more advanced than western philosophy until the Kantian revolution”

বাউল-ফকিরের গানেও সেই চেষ্টা দেখা যায়। বাউল দর্শন সনাতন ধর্ম, মুসলমান ধর্ম, সাথে বাংলার তন্ত্র, লৌকিক আচার আর ভক্তি মিলে বাংলার অদ্ভূত এক মানবতাবাদী দর্শন। বাউল গানে ষড়দর্শন থেকে শুরু করে কৃষ্ণতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, সাঁইতত্ত্ব যেমন দেখা যায় তেমনি নবীতত্ত্ব, রাসুলতত্ত্ব, প্রেমভাবের সাথে তান্ত্রিক প্রণালির সম্মিলন দেখা যায়। বাউল বলতে একক কোন সম্প্রদায়কে নির্দিষ্ট করা যায় না। নানা মত, পথ ও তত্ত্বের অনুসারী সাধক যারা সত্যের অনুসন্ধ্যান করেছেন এবং তাদের উপলব্ধিকে গানের ভাষায় প্রকাশ করেছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে তারা মোটাদাগে ‘বাউল’, আর তাদের গানই বাউল গান, ‘ফোক’ গান। এসব নিয়ে পন্ডিতদের মাঝে অনেক বিতর্ক আছে, সেগুলো কথা বলার মত যোগ্যতা বা ধৈর্য্য কোনটাই আমার নেই তাই আমরা সেদিকে যাব না। আমার কাছে সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারন মূল বিষয় বা ‘এসেন্স’ ধরতে পারলেই হল। চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে অনেক ফারাক বের হবে, সেসব পন্ডিতের কাজ। ‘ডেভিল লাইজ ইন দ্য ডিটেইলস’। তাছাড়া ফকির লালন বলেছেন, ‘সংক্ষেপে সব জানিতে হয়’। তাদের কাজ মানে বাউল গানে এসব জীবন শিল্পী, দার্শনিকেরা তাদের সিগনেচার রেখে গেছেন। তবে দীক্ষা না নিয়ে আজকের আধুনিক শিক্ষিত মানুষ হয়ে সান্ধ্যভাষা ভেদ করে যতটুকু বুঝতে পারি সেটাই আমাদের পাওনা।

ভক্তিঃ
বাউল গানে ভক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভক্তিতে মুক্তি মিলে। ভক্ত মানে যে জ্ঞানের অনুসন্ধান করে। গুরু বা মুর্শিদের প্রতি ভক্তি না থাকলে বাউল তরিকায় দাখিল হওয়া যায় না। গীতায় যে কয়টা যোগের কথা বলা আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভক্তিযোগ। এ যোগ সবার জন্য কাজ করে। অন্যান্য যোগ যেমন কর্মযোগ বা জ্ঞানযোগ খুব কঠিন, সেসব পথে মুক্তির বদলে আরো বন্ধনে জড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। জ্ঞানযোগ সবচেয়ে কঠিন কিন্তু এ পথে মুক্তি আসে তাড়াতাড়ি। অপরদিকে ভক্তির জন্য দরকার শিশুর মত সহজ সরল বিশ্বাস, আধুনিক যুগের কূটিলতার কারনে তেমন বিশ্বাস সকলের হয় না। বাংলাদেশ যেহেতু জ্ঞানীর দেশ, এরা শুধু ভক্তি নিয়ে পড়ে থাকবে না, তাই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য বাঙালির জ্ঞান-ভক্তি যোগের নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
এ ‘ভক্তের দ্বারে বান্ধা আছেন সাঁই’, ভক্ত নাই তো ভগবান নাই। যেমন গুরু মেলে ঢের কিন্তু উপযুক্ত শিষ্য মেলেনা, তেমন শিষ্য না পেলে গুরুর গুরুত্ব থাকে না, পরম্পরাও বিনষ্ট হয়। গুরু যদি হন ভবতরী, তবে শিষ্য তাঁর কান্ডারী। এ ভক্তিভাব শ্রদ্ধারও অতিরিক্ত, ঠিক শ্রদ্ধায় একে পুরোটা ধরা যায় না।

গীতার মতে

“যোগিনামপি সর্ব্বেষাং মদ্‌তেনান্তরাত্মনা।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ ||” ৬।৪৭

অর্থাৎ “যে আমাতে আসক্তমনা হইয়া শ্রদ্ধাপূর্ব্বক আমাকে ভজনা করে, আমার মতে যোগযুক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে সে-ই শ্রেষ্ঠ।”

ভক্তিরও আবার নানান রুপ আছে—-

রাজাভাবঃ সান্তভাব, নির্বিকার, সাধু-সন্ন্যাসীদের জীবনে সান্তভাবের প্রাধান্য দেখা যায়।

প্রভূ বা স্বামীভাবঃ দাস্যভাব , সকল আল্লার বান্দার দাস্যভাব, মুসলমানরা নিজেদের আল্লার দাস ভাবে। ভগবান রামচন্দ্রের দাস যেমন হনুমান। প্রভূর প্রকারভেদ হিসেবে কখনও যীশুর জন্য তিনি হন পিতা, আবার পূজারী হিন্দু তাঁকে দেখে সর্বজয়া, মঙ্গলকারিণি, দূর্গতিনাশিনী জগজ্জননী মায়ের রুপে। আবার গোপীদের জন্য তিনি হন পতি/স্বামী।

“কোন প্রেমের প্রেমিকা ফাতেমা, করেন সাঁইকে পতিভাবনা।”– লালন

“ক্ষুদ্র আমাদের ’পরে করিয়ো না রোষ–
স্নেহবাক্যে বলো, পিতা, কী করেছি দোষ!”

“আমরা যে শিশু অতি, অতিক্ষুদ্র মন–
পদে পদে হয়, পিতা, চরণস্খলন॥” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাধক রামপ্রসাদ, শ্রীরামকৃষ্ণের কালীভক্তি, মাতৃরুপে ঈশ্বারাধনার অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ।

সখাভাবঃ সখ্যভাব , আল্লাহর সখা যেমন হজরত মোহাম্মদ (সাঃ), শ্রীকৃষ্ণের সখা অর্জুন, শ্রীদাম। অনেক সাধক ঈশ্বরকে নিজের বন্ধু বা সখা ভাবেন। বাউলদের মধ্যে সখাভাব দেখা যায়। অনেক গানেই বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত।

বাৎসল্যভাবঃ ঈশ্বরের প্রতি বাৎসল্যভাব, যেমন মা যশোদা কৃষ্ণের প্রতি। হিন্দুধর্মে অনেক উপাসক ঈশ্বরকে পূত্রভেবে আরাধনা করেন। খ্রিস্টধর্মে বড়দিনের সময় বালক যীশুকে স্মরণ করে উৎসব করা হয়।

মধুরভাবঃ মধুর ভাব হলো ঈশ্বরকে প্রিয়তম ভাবা, আশেক বা ভক্ত তখন মাশুক বা প্রেমাস্পদের জন্য সর্বস্ব সমর্পণ করেন। মধুরভাব সবচেয়ে গভীর ভাব, এ ভাবে একই সাথে সখা প্রীতি, দয়া ইত্যাদির সম্মিলন দেখা যায়, রাধার যেমন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি। রাধা বলতে গেলে বাংলার সৃষ্টি। রাধার আরেক অর্থ, যে আরাধনা করে। রাধা-কৃষ্ণের তত্ত্বে সাংখ্য দর্শনের পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বের প্রভাব আছে। সৃষ্ট জগত এবং তার অধীন সকল কিছুই প্রকৃতি বা রাধা। আর যে সত্ত্বা এ সকল কিছুর মূলে তিনি অধরা, পুরুষ, কর্তা সত্ত্বা। এজন্যে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাউলেরা রাধা ভাব ধরে, রাধা সত্ত্বা নিয়ে গান করে। পুরুষ হয়ে নারীসত্তার গান গেয়ে সৃষ্টির আড়ালে যে পুরুষাকার তার কাছে ধরা দিতে চান। “বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের”, আমরা সবাই রাইয়ের অংশ, অধরা পুরুষ, ‘মনের মানুষ’কে ধরা বাউলের সাধনা। বাংলার যত বৈষ্ণব, বাউল সবাই মধুর ভাবের চর্চা করেন। নারীর মধুরভাবে ভালবাসা, আত্মসমর্পণ পূর্ণাঙ্গ হয়।

‘আমরা বন্ধুয়া বিহনে গো সহেনা পরানে গো
একেলা ঘরে রইতে পারি না’।।

‘কেন পীরিতি বাড়াইলিরে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি’।
‘তোমরা কুন্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।’
— বাউল শাহ আব্দুল করিম

বাংলার বাউল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমপর্বের প্রায় সব গানই মধুর ভাবের গান।

” ওলো রেখে দে সখী, রেখে দে, মিছে কথা ভালোবাসা ।
…… ……… পরান সঁপিতে প্রাণের সাধন,
লহো-লহো বলে পরে আরাধন– পরের চরণে আশা ॥”

” আমি কেবল তোমার দাসী ।
কেমন করে আনব মুখে ‘তোমায় ভালোবাসি’ ॥”

” বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে,
বনফুলের বিনোদমালা দেব গলে ॥
সিংহাসনে বসাইতে হৃদয়খানি দেব পেতে,
অভিষেক করব তোমায় আঁখিজলে ॥”

” এখনো তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছি–
মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি ॥
শুনেছি মুরতি কালো, তারে না দেখাই ভালো ।
সখী, বলো আমি জল আনিতে যমুনায় যাব কি ॥”

ভক্ত আর ভক্তি নিয়ে ফকির লালনের গান
“ভক্তের দ্বারে বান্ধা আছেন সাঁই
হিন্দু কি যবন কোন তফাত নাই।“

বাউল গানে নামতত্ত্বঃ
নাম আর নামীর সম্পর্ক দর্শনের একটা জটিল সমস্যা। জ্ঞান, জ্ঞানের প্রক্রিয়া আর জ্ঞানীকে (knower, known and knowing) যেমন আলাদা করা যায় না তেমনি নর্তকীর থেকে তার নাচকে আলাদা করা যায় না। সত্য তখনই ধরা দেয় যখন ‘ড্যান্সার এন্ড ড্যান্স বিকামস ওয়ান’। কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস এর ভাষায়, ‘How can we know the dancer from the dance?’
বাউল এ নাম, রূপ এবং নামের আড়ালে কে তার সন্ধান করে-

কোন নামে ডাকিলে তারে হৃদাকাশে উদয় হবে
আপনা আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে
আরবী ভাষায় বলে আল্লা, ফারসীতে কয় খোদা-তাআলা
গড বলেছে যীশুর চ্যালা, ভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে
আপনা আপনি ফানা হলে সেভাব জানা যাবে । ।

মনেরও ভাব প্রকাশিতে ভাষার উদয় এ জগতে
মনাতীত অধরে চিনতে ভাষাবাক্য নাহি পাবে।
আপনা-আপনি ফানা হলে সে ভাব জানা যাবে
আল্লা, হরি, ভজন-পূজন সকলি মানুষের সৃজন
অনামকো চিনায় বচন বাগেন্দ্রিয় না সম্ভবে।

আপনাতে আপনি ফানা, হলে তারে যাবে জানা
সিরাজ সাঁই কয় লালন কানা, স্বরুপে রুপ দেখ সংক্ষেপে ।
আপনা-আপনি ফানা হলে সে ভাব জানা যাবে।

কোন নামে ডাকিলে তারে হৃদাকাশে উদয় হবে
আপনা-আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে । । (লালন ফকির)

যার কোন নাম নাই, রুপরসগন্ধশব্দস্পর্শাতীত যিনি তাকে কি আসলে কোনভাবে ডাকা বা বিশেষায়িত করা যায়?

বাউল বলছেন, মুসলমান যাকে বলে আল্লাহ, তিনিই হিন্দুর হরি, যীশুর চ্যালা পল তাকেই বলেছেন গড। এসব নামের মধ্যে কোন নামে ডাকলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। কোনটা তাঁর আসল নাম? কবিয়াল বিজয় সরকারের অনুরুপ একটা গান আছে, মূলকথাগুলো এরকম,

“ জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি
আমরা বহুনামে ধরাধামে কত রকমে ডাকি
কেউ তোমায় বলে ভগবান আর গড কেউ করে আহ্বান
কেউ খোদা কেউ জিহুদা কেউ কয় পাপীয়ান
গাইলাম জনম ভরে মুখস্থ গান মুখ বুলা টিয়াপাখী
সর্বশাস্ত্রে শুনিতে যে পাই তোমার নাকি পিতামাতা নাই
তবে তোমার নামকরন কে করলে সাঁই বসে ভাবি তাই
তুমি নামি কি অনামি হে সাঁই আমরা তার বুঝি বা কি
কেহ পিতা কেহ পুত্র কয় আবার বন্ধু বলে কেউ দেয় পরিচয়
তুমি সকলেরই সকল আবার কারো কেহ নয়
তোমার যে আসল পরিচয় কে জানে তা কি না কি
বিজয় বলে মনের কথা কই আমি খাঁটি ভাবের পাগল নই
আমার গোল বেঁধেছে মনের মাঝে কাজেই পাগল হই
আমার বুকে যা নাই মুখে তা কই কাঁটা কান চুলে ঢাকি।“

ফকির লালনের প্রশ্ন কোননামে ডাকলে হৃদয়ের শতদল পদ্মে তাঁর উদয় হবে? কারণ যুগে যুগে সাধকেরা বলে গেছেন বিশ্বাসীর হৃদয়ে তিনি অবস্হান করেন। বিখ্যাত সুফীসাধক ইবনে আরাবী বলেছেন, The heart of the believer is the real Kaaba।

ধরা-ছোঁয়ার অতীত যিনি তাকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বুঝা যাবে না। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমাদের যে বোধ জন্মে এবং সেখান থেকে যে জ্ঞান হয় তা সীমিত তার থেকে আমরা অসীম সত্ত্বাকে বুঝতে পারব না। চরম সত্যের সন্ধানে সাধকেরা যুগ যুগ ধরে নেতির চর্চা করে গেছেন, মানে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য কোন কিছুতে চরম সত্য নেই, যাকে বলা হয়,‘নেতি, নেতি’। যার নাম নেই সে ‘অনামকো চিনায় বচন বাগেন্দ্রিয় (বাক+ ইন্দ্রিয়) না সম্ভবে’। যার নাম নাই তাকে বাক্য বা ইন্দ্রিয় (চক্ষু,কর্ণ,নাসিকা,জিহবা,ত্বক) গোচর করা যায় না। কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে আপনাতে আপনি ফানা বা বিলীন হলে সে ভেদ বুঝা যাবে। Mysticism শব্দের রুট গ্রিক Myen (উৎপত্তি) এর অর্থও হল– to close our senses। তা ইন্দ্রিয়ের দ্বার বন্ধ করে যে করে বায়ুর বা দমের সাধন সেই তো বাউল।

চিন্তায় সত্যকে পাওয়া যায় না, সত্য উপলব্ধির বিষয়, যাকে ধ্যানে পাওয়া যায়। চিন্তা বা মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষ ভাষার জন্ম দিয়েছে, কিন্তু চিন্তার অতীত, মনের অতীত যিনি তাঁকে সেই ভাষা বা বাক্যে পাওয়া যাবে না। এইজন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, “ঈশ্বর জ্ঞান ছাড়া আর সব জ্ঞান উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে”। অর্থাৎ বাকি সব জ্ঞান অন্য মানুষের কাছ থেকে জানা সম্ভব কিন্তু ঈশ্বর বা পরম সত্যের জ্ঞান সবাইকে নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে পেতে হবে। এ জ্ঞানে পরের মুখে ঝাল খাওয়ার সিস্টেম নাই।

তাহলে এত যে নামে তাকে ডাকা হয় এতসব নামের উৎপত্তি হল কিভাবে ? ফকির লালন বলেন এসব নাম মানুষেরই সৃজন বা সৃষ্টি। ফানা অবস্হায় সাধকের অনুপ্রেরণা থেকেই এসব প্রেরণাপ্রাপ্ত নাম এবং ভজন-পূজনের যত পদ্ধতি।

নাম ধরে ডেকে যদি তাকে না জানা যায় সেক্ষেত্রে ঈশ্বরকে দেখার উপায় কি? সিরাজ সাঁইয়ের দোহাই দিয়ে ফকির লালন জানাচ্ছেন, ‘স্বরুপে রুপ দেখ সংক্ষেপে’, অর্থাৎ মানুষের ভেতরেই খোদা, মানুষের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই, আপনাতে আপনি ফানা বা সমাধি হলেই সেটা জানা যাবে। বড়ু চন্ডীদাসের ভাষায়, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাউল তাই মানুষ ভজনা করে। এ মানুষ নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে মনে করে।

 

চলবে…

নাজিম উদ্দিন, পিএইচডি। লেখক, বিজ্ঞানী ও সমাজ বিশ্লেষক।  জন্ম নারায়ণগঞ্জে, বেড়ে ওঠা লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায়। পেশাগতসূত্রে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছেন। তিনি অংশুমালী'র যুক্তরাষ্ট্র (USA) চ্যাপ্টারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। লেখাপড়া করেছেন ঢাকার নটরডেম কলেজে। এরপর করেছেন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..