মন মাতানো মুন্নারে (পর্ব-২)

সজল জাহিদ
ভ্রমণ
মন মাতানো মুন্নারে (পর্ব-২)

পর্ব – ২

রাতের মুন্নার ছিল, গাছে-গাছে, পাতায়-পাতায়, পাহাড়ে-পাহাড়ে, ফুলে-ফুলে, ঝর্না ধারায়, পাহাড়ি নদীতে বৃষ্টি ঝরা, বৃষ্টি জড়ানো, বৃষ্টিময়। কিন্তু সকালের মুন্নার? একদম অন্য রকম মুগ্ধতা ছড়ানো। খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে ছিল। সকাল ৮ টায় আমাদের অটো আসবে বলে আমরা সকাল ৭ টার মধ্যেই তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে।

আগের দিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মুন্নারের যে স্নিগ্ধ সবুজ রূপ দেখেছিলাম, সকালে সেই সবুজে সূর্যের প্রথম আলো পরে চারদিক যেন হলুদ রঙে সেজে উঠেছিল! সবুজ কচি পাতায়া, সূর্যের প্রথম স্পর্শে একটা হলুদের ঢেউ ওঠে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে নাম না জানা অনেক রকমের আর রঙ-বেরঙের ফুল হেসেছিল সূর্যের ছোঁয়া মেখে। পাহাড় আর অরন্যর ফাঁক গলে ঢুকে পরা শীত সকালের প্রথম সূর্যের উষ্ণ পরশ একটা অন্য রকম আরাম দিচ্ছিল। হোটেলের সামনেই একটু উপরে উঠে পাহাড়ের পিঠে গড়ে উঠা একটা টংয়ের দোকানে আমরা চা আর বিস্কিট দিয়ে প্রাথমিক নাস্তা সারলাম।

আগের দিন রাতে যে অটোতে করে আমরা এই হোটেলে এসেছিলাম, সেই অটোটাই ঠিক করেছিলাম আজ সারাদিন মুন্নারের সম্ভব্য সব যায়গায় ঘুরে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবে বলে। ভাড়া সরকারী রেট ১০০০ রুপী। তবে অফ সিজনে কখনো কখনো ৮০০ রুপীতেও সারাদিনের জন্য অটো পাওয়া যায়। যার পিছনে তিনজন আর সামনে একজন আরাম করে বসা যায়। পাহাড়ি পথে হেঁটে বসে, ছবি তুলে, টং এর চা খেয়ে অনেকটা সময় কাটালাম। ৮:৩০ এ আমাদের অটো চলে এলো। ব্যাগপত্র পিছনে তুলে রেখে বসে পরলাম। আমাদের অটো চলতে শুরু করলো মুন্নার দেখাতে।

আহ কিছুদূর এগোতেই আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পথে চলতে শুরু করলো। একপাশে গভীর খাঁদ, তবে ঝুকিমুক্ত। কারন খাঁদের পাশেই রয়েছে নানা রকম গাছের সমারোহ, কোন কোন ঢালু পাহাড়ে চাষের জমি আর খাঁদের ওপারে বড় বড় পাহাড়ের সারি, সবুজ গাছে গাছে আচ্ছাদিত। আর একটু এগোতেই সকালের প্রথম রোদ পড়া চা বাগানের হলুদ আলো চোখে এসে পরতেই ঝলসে যাওয়ার মত অবস্থা। খুব সকালের সদ্য গজানো চায়ের পাতায় যখন সূর্যের প্রথম আলো পরে তখন চা বাগান ঠিক সবুজ দেখায়না। তখন চা বাগান এক অন্যরূপ ধারন করে, চা বাগান এক অন্য সাঁজে নিজেকে সাঁজায়, একটা অন্য রকম মাধুরী নিয়ে প্রকৃতির মাঝে আলাদা হয়ে থাকে।

সকালের কচি সবুজ চা বাগানের পাতায় পাতায় সূর্যের আলো পরে সবুজ রঙ হয়ে ওঠে হলুদ, কখনো কখনো সোনালি রঙে সেজে ওঠে। সবুজের মাঝ থেকে তো তবু মাঝে মাঝে চোখ সরে, কিন্তু এই অপরূপ হালকা হলুদ আর সোনালি রঙের চা বাগান থেকে চোখ সরানো সাধ্য কার আছে জানিনা, আমার তো সেই সাধ্য নেই, ছিলোনা। কি রূপ সেই চা বাগানের, পাহাড়ে পাহাড়ে ঢেউ খেলানো সবুজ ঢেউয়ের মাঝে হলুদ আর সোনালি রঙের ছড়াছড়ি। কি যে এক আকর্ষণে, চোখ মন আর সমস্ত সত্ত্বাকে আটকে রাখবে বুঝে উঠা মুশকিল। এমন অপার্থিব সৌন্দর্যে পৃথিবীও যেন অপার্থিব হয়ে ওঠে। বহুদিন থেকে মুন্নারের যে ছবি দেখে দেখে আফসোস করেছি, আজ সেই ছবি একদম আমার, আমাদের সামনে, সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে!

চা বাগান তো অনেক দেখেছি আগে। আমাদের সিলেটে, শ্রীমঙ্গলে, মৌলভীবাজারে, তেতুলিয়ায়, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিংএ। কোথাও সমতলে, কোথাও টিলা টিলায়, কোথাও ছোট ছোট পাহাড়ে, কোথাও বড় বড় পাহাড়ের সমস্ত শরীর জুড়ে। কিন্তু এমন ঢেউ খেলানো, এমন আকৃতির আর আকর্ষণীয় চা বাগান এর আগে কোনদিন দেখিনি। হ্যা দেখেছি শুধু মুন্নারের ছবিতে আর সিনেমার নাচে গানে। কিন্তু আজ যে একদম হাতের নাগালে, চোখের সামনে, ক্যামেরার ক্লিকে।

ইচ্ছে হলেই নেমে পড়া যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, ছোঁয়া যাচ্ছে, আর প্রানভরে ওর রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করা যাচ্ছে। পাগল করা মুহূর্ত গুলো যতটা সম্ভব ধরে রাখতে কখনো ক্যামেরা আর কখনো মোবাইলে ধারন করে রাখছিলাম। সেই হলুদ-সবুজ আর সোনালি স্নিগ্ধ চা বাগানে অনেক অনেকক্ষণ কাটিয়েছিলাম। একটু বসে, একটু হেঁটে, একটু দৌড়ে আর কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থেকে।

এমন অসংখ্য চা বাগানে অনেকবার থেমেছি, নেমেছি, ছবি তুলেছি আর অপলক তাকিয়ে থেকেছি। কিন্তু এতোটুকু সাধ মেটেনি। ইচ্ছে হচ্ছিল যদি কোন এক চা বাগানের কটেজে, সবুজের মাঝে, কাটাতে পারতাম দুই একটা দিন, তবেই না পাগল প্রানে কিছুটা প্রশান্তির পরশ পেতাম হয়তো। কিন্তু সে যে সম্ভব নয়। আমাদের আজকে বিকেলেই ফিরতে হবে কেরালায়, পরদিন ট্রেন আছে ব্যাঙ্গালরের। আর আজকে আরও তো কতকিছু দেখা বাকি রয়ে গেছে।

আবারো পথ চলতে শুরু করলাম অটোতে করে। এবার আমাদের একদিনে ঢেউ খেলানো সবুজ চা বাগান আর অন্যদিকে ঝর্না ধারা বয়ে চলা বড় বড় পাহাড়ের সারি। কিছুটা পথ পেরিয়ে, কয়েকটা বাঁক এড়িয়ে আমাদের অটো থামলো এলিফেনট পয়েন্টে। এখানে গভীর অরন্যের মাঝে হাতির দেখা মেলে প্রচুর। এখানে হাতির পিঠে করে গভীর অরন্যের ভিতরে যাওয়া যায় শতেক রুপীর বিনিময়। আমরা প্রকৃতি দেখা ছাড়া কোন পয়সা আলাদা করে খরচ করার পক্ষে ছিলামনা বিধায়, শুধু দেখে, ছবি তুলে আবারো অটোতে উঠে এবার লেক ও ড্যামের পথ ধরেছিলাম।

আগের পর্ব পড়ুন এখানে:

মোহময় মুন্নারের পথে

সজল জাহিদ। ভ্রমণপিপাসু লেখক। সজল জাহিদ তাঁর লেখক নাম, তবে জন্মসনদ অনুযায়ী মোঃ জাহিদুল ইসলাম। জন্ম পাবনা জেলার পদ্মার তীর ঘেঁষা আর হার্ডিং ব্রিজের ঝমঝমে শব্দে মুখরিত পাকশীতে ১৯৮২ সালের ৮ মার্চ। বেড়ে ওঠা দিনাজপুর জেলার, পার্বতীপুরে। আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা আর চাওয়া-পাওয়ার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..