প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নুর মোহাম্মদ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটছেন। একহাতে স্কুল ছাত্রের মত বুকের সঙ্গে ধরে আছেন দুটি বই। অন্য হাতটি দিয়ে অনেকটা বৈঠার মত বাতাস কেটে স্কুলের বারান্দায় উঠলেন। গায়ে একটি সুতি চেক জামা। পরণের কালো প্যান্টটির বয়স হয়েছে। সিগারেটের আগুনে দু-এক জায়গায় অতি ছোট ছোট ছিদ্র। খুব কাছে থেকে ছিদ্রগুলো দেখা যায়। চোখে ভারী চশমা। চশমা ছাড়া তিনি একেবারে অচল। ভুগোলের টিচার সুশীল গোস্বামির প্রায়ই অন্য শিক্ষকদের বলেন, ‘বুজলেন, পুর্বজন্মে শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের সময় ভুলে চশমাটা খোলা হয় নাই। ফের জন্মের সময় নুর মোহাম্মদ সাহেব ওটা চোখে নিয়েই আবার মর্তে এসেছেন।’ শুধু এই চশমাটার কারণে ফর্সা, একহারা গড়নের হালকা পাতলা মানুষটাকে অন্য সব মাস্টারের চেয়ে আলাদা মনে হয়। মানুষের চেহারায় নাকী তার স্বভাবের ছবি থাকে। নুর মোহাম্মদের চেহারায় একটি নিস্পাপ ভাব আছে। নবম-দশম শ্রেণীর কিশোরী মেয়েগুলো স্যারের ভাব দেখে মুখ টিপে হাসে। নুর মোহাম্মদ তা জানেন না। সবসময় তাকে মনে হয় অন্যজগতে আছেন।
নুর মোহাম্মদ হাত ছড়িয়ে বাতাস কেটে বারান্দায় উঠতেই অফিস পিয়ন মনির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আপনারে হেড স্যার দেখা করতে কইছেন।
নুর মোহাম্মদ দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারছেন না কমন রুমে যাবেন, নাকি হেডমাস্টার স্যারের সঙ্গে আগে দেখা করে আসবেন।
মনির আবার বলল, ‘স্যার বলছেন, আপনে আসলেই যেন তার রুমে যান।’
নুর মোহাম্মদ ভাবলেশহীন চেহারায় হেডমাস্টার স্যারের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
[ এই গল্পের অডিও শুনুন এখানে ]
প্রধান শিক্ষকদের চেয়ারের সঙ্গে একটি হলুদ তোয়ালে ঝোলানো থাকে। নুর মোহাম্মদ মাথাটা সারস পাখির মত সামনে বাড়িয়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন চেয়ারটা খালি। হলুদ রঙের তোয়ালে ঝুলছে। পরক্ষণেই রুমের ডানদিকে চোখের কোণে কিছু নড়ে উঠতেই তিনি বুঝতে পারলেন প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুস সালাম আনসারী নামাজ শেষ করে উঠলেন। হেডমাস্টার সাহেব মাথার টুপি ভাঁজ করে টেবিলে রাখতে রাখতে পরিস্কার গলায় বললেন, ‘নুর মোহাম্মদ, বসেন।’
নুর মোহাম্মদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সামনের চেয়ারে বসলেন।
প্রধান শিক্ষক আনসারী সাহেব রেগে আছেন। অন্য কোনো কথায় না গিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ‘বলেন তো, আপনার সমস্যাটা কী?’
নুর মোহাম্মদ সরল হেসে দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন,‘আমার কোনো সমস্যা নেই স্যার।’
হেডমাস্টার এবার শক্ত গলায় বললেন, ‘আপনার সমস্যা নেই, কিন্তু আপনাকে নিয়ে আমাদের সমস্যা আছে।’
নুর মোহাম্মদ অবাক চেয়ে বললেন, ‘কী সমস্যা স্যার?’
‘আপনার নাম হল, নুর মোহাম্মদ। নুর মানে জগতের আলো, আর আপনে জগতটারেই অন্ধকার করে আছেন!’
‘স্যার, নুর মানে আলো। নুরজাহান মানে জগতের আলো।’
‘দেখেন নুর মোহাম্মদ সাহেব, আমার সঙ্গে জ্ঞান কপচাবেন না! নুরজাহান মানে জগতের আলো তা আমি ভালো জানি। যা জিজ্ঞাসা করি সেটার জবাব দেন। আপনি নাহারের সঙ্গে কী আচরণ করেছেন?’
নুর মোহাম্মদ একটু টান হয়ে বসে পুরু কাঁচের ভেতর দিয়ে হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন নাহার?’
‘নাহারকে চেনেন না? দশম শ্রেণীর মানবিক বিভাগের ছাত্রী সাবিকুন নাহার।’
‘সাবিকুন নাহারের সঙ্গে, কোন বিষয়ে, কী করেছি?’
‘বোঝেন নাই কী করেছেন! যা করেছেন বলতেও তো লজ্জা লাগে!
নুর মোহাম্মদ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললেন, ‘কীসের লজ্জা?’
‘কীসের লজ্জা বোঝেন না! গতকাল আপনি নাহারের অতি কাছে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে যুবতী মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়েছেন না?’
নুর মোহাম্মদ উপরের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবলেন। তারপর মাথা সামান্য দুলিয়ে বললেন, ‘জ্বী।’
তাকিয়েছেন!
‘জ্বী।’
‘বলতে আপনার একটু লজ্জা করছে না?’
‘লজ্জা করবে কেন?’
‘বাপরে বাপ! আপনে কী জিনিশ? আপনার লজ্জার থলি যে এমন খালি তা জানতাম না!’
নুর মোহাম্মদ একটু প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘ না স্যার, আমার প্রচুর লজ্জা আছে।’
‘সেটা বুঝতে পারলাম। সবার সামনে দশম শ্রেণীর একটা মেয়ের কাছে গিয়ে তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে যারা, তাদের প্রচুর লজ্জা। ঠিক বলছেন!
‘স্যার, আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি যে বুঝতে পারবেন না সেটা আগে থেকেই জানি।’
নুর মোহাম্মদ আবার বললেন,‘কীভাবে জানতেন স্যার।’
‘জানার অনেক তরিকা আছে। আপনি কয়েকদিন আগে স্কুল কমিটির কয়েকজনসহ বিভিন্ন জায়গায় দাবী করেছেন, এই স্কুলের নাম পাল্টে নারায়ণ ঘোষ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় রাখার?’
‘জ্বী।’
‘আপনি কি জানেন যে স্কুল কমিটির সভাপতির বাবা মমিনউদ্দিনের নামে এই স্কুল? সভাপতি সাহেব আপনাকে নারায়ণ ঘোষ না, নারায়ণ দেবতার নামও ভুলিয়ে দেবেন!’
‘জ্বী, জানি।’
তারপরও কেন করলেন?
নুর মোহাম্মদ মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চুলকে বলেন, এই স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারায়াণ ঘোষ নামের ওই মহামানব।
‘মহামানব ?’
‘জ্বী, মহামানব।’
‘ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ! মহামানব কারে কয় তা জানেন? শোনেন নুর মোহাম্মদ সাহেব, আপনার কাজ স্কুলের ছেলে মেয়েদের ইংরেজি শেখানো, মহামানব খুঁজে বের করা না।’
‘জ্বী স্যার।’
হেডমাস্টার সাহেব একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, ‘নারায়ণ ঘোষকে আমি আপনার চেয়ে ভালো চিনতাম। বাজারে একটা মিষ্টির দোকান ছিল। কৃপন মানুষ ছিল। ওরকম একটা কৃপন, মিষ্টির দোকানদার মহান হলো কী করে?’
‘সামান্য মিষ্টির দোকান করে তিলে তিলে টাকা জমিয়েছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি এই স্কুলের জায়গা কিনেছিলেন, দুটি স্কুলঘর তুলেছিলেন। এমন কৃপন হওয়া কিন্তু খুবই কঠিন কাজ স্যার! তিনি ধুমপান করা ছেড়ে দিয়েছিলেন এই স্কুলের জন্য টাকা জমাতে গিয়ে।’
‘আপনি দেখি ইতিহাস জেনে ফেলেছেন!’
‘জ্বি স্যার, ইতিহাস ছাড়া জাতি সভ্য হয় না।’
‘মিষ্টির দোকানদারের জীবন হইল ইতিহাস?’
‘অবশ্যই স্যার, রাজা-বাদশার ইতিহাস মিথ্যা আর স্তুতির ইতিহাস।’
‘থাক, আর ইতিহাস শিখায়েন না! আপনি নুর মোহাম্মদ নামের কলঙ্ক। আপনার নাম থাকা উচিত ছিল রামচন্দ্র ঘোষ!’ শোনেন, আপনাকে বোধহয় স্কুল কমিটি আর রাখতে চাচ্ছে না। আগামীকাল একটি মিটিং কল করা হয়েছে।
নুর মোহাম্মদ নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘জ্বি স্যার।’ নুর মোহাম্মদ উঠে দাঁড়ালেন।
হেড মাস্টার আনসারী বললেন, কোথায় যাচ্ছেন?
‘ক্লাসে।’
‘আপনার আর ক্লাস নেবার দরকার নেই। কাল সিদ্ধান্ত হোক, তারপর টিকে থাকলে ক্লাস নেবেন।’
‘জ্বি আচ্ছা,’ নুর মোহাম্মদ বের হতে গিয়ে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, একটা বিষয় একটু জানার ছিল স্যার।’
‘বলেন।’
‘মহামানব হইতে কী কী যোগ্যতা লাগে?’
‘এইটা আপনার আমার বিষয় না। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই মহামানব নির্ধারণ করে দেন। মানুষের কোনো হাত নাই।’
‘আপনার জ্ঞানের কোনো তুলনা নাই স্যার। এত পরিস্কার জ্ঞানের শিক্ষক না হলে ছাত্রদের মানুষ হওয়া সম্ভব না।’
হেডমাস্টার বিদ্যা-শিক্ষাহীন চোখদুটো তুলের পিটপিট করে তাকালেন। সন্দেহ করলেন, বলদা কী তাকে টিটকারি মারল?
নুর মোহাম্মদ আর লাইব্রেরিতে গেলেন না। বারান্দা দিয়ে আবার নেমে এলেন। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। মুখে একটা তেতো ভাব চলে আসছে। স্কুলের ফাঁকা বিশাল মাঠের ভেতর দিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। মাঠের এক কোণে বহু পুরাতন আমগাছটির দিকে একবার তাকালেন। চশমার ভেতর দিয়ে গাছটিকে ঝাপসা কালো দেখা যায়। ধীর পায়ে তিনি গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন। নুর মোহাম্মদের ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি ছোট। কিন্তু বুঝতে পারেন সব। এই গাছটি এতটা হৃষ্টপুষ্ট ছিল না। একহারা গড়নের ছিল। এই গাছের সঙ্গে নারায়ণ ঘোষকে বাঁধা হয়েছিল। সেই দৃশ্য পরিস্কার চোখে ভাসে। লোকটি একটুও ছুটাছুটি করতে চেষ্টা করেননি। শুধু ঘাড় কাত করে কয়েকবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। রাজাকার আর বিহারিরা যেভাবে বাঁধতে চেয়েছে, তিনি সেভাবে বাঁধতে দিয়েছেন। একটু দূরে সারি বেধে দাঁড়িয়েছে তিন চারজন। যেন ফুটবলে পেনাল্টি শট নিতে দাঁড়িয়েছে। মমিনউদ্দিন মাঝখানে স্টাইকারের জায়গায়। তাঁর হাতে একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। তখন নুর মোহাম্মদ এই রাইফেলের নাম জানতেন না। মমিনউদ্দিন রাইফেল তাক করে নারায়ণ ঘোষের ঠিক পেটের ওপর একটি গুলি করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণ ঘোষের পা দুটো ভাঁজ হয়ে গিয়েছিল। মাথাটা নিচ দিকে ঝুলে পড়েছিল। এই আমগাছটার সঙ্গেই সেই মৃতদেহ বাধা ছিল!
একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন নুর মোহহাম্মদ। দুটি ছেলে ছিল নারায়ণ ঘোষের। তারা আগেই পালিয়ে ভারত চলে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। আসবে কী, এই স্কুলটা করা ছাড়া নারায়ণ ঘোষ সন্তানদের জন্য বিশেষ কোনো কিছু রেখে যাননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্কুলটির নাম দেয়া হয়েছিল শহীদ নারায়ণ ঘোষ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে কী দিয়ে কী হয়ে গেল কে জানে! ১৯৭৭ সালে হঠাৎ করেই স্কুলের নামটি পাল্টে যায়। সাইনবোর্ড, খাতা-পত্র সবকিছু পাল্টে যায়। মানুষজনও নারায়ণ ঘোষকে ভুলতে থাকে। আর হয়তো বছর দশেকের মধ্যে যারা তাঁকে দেখেছেন তারাও এ পৃথিবী থেকে চলে যাবেন। লোকটিকে সবাই কৃপন বলে জানতো। অথচ স্কুলটি গড়ে তোলার জন্যই একটি পয়সা তিনি বাজে ব্যয় করতে না।
নুর মোহাম্মদ মাঠ থেকে রাস্তায় উঠলেন। কিছুদূর গিয়ে মমিনপুর বাজার ডান পাশে রেখে বা পাঁশের রাস্তা ধরলেন। সামনে মমিনউদ্দিনের ছেলে এখলাসের বিশাল দোতালা। মমিনউদ্দিন বেঁচে থাকতেই এ বাড়ি পাকা হয়েছিল। এখন আরো বেড়েছে। নুর মোহাম্মদ বুঝতে পারছে না তিনি এদিকে কেন এলেন। মনের অজান্তেই কী এখলাসউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? তিনি কি মনে মনে ভেবেছেন যে দেখা হলে সব কথা এখলাস সাহেব জানতে চাইতে পারেন। তিনি বুঝিয়ে বললে এবারের মত চাকরিটা বেঁচে যাবে? পরক্ষণেই মনে হল, না তিনি মোটেই সেজন্য আসেননি। হয়তো অবচেতন মন তাকে টেনে নিয়ে এসেছে আজকের দিনের মমিনউদ্দিনের পরিবারের অবস্থা দেখাতে।
নুর মোহাম্মদের সিগারেট খেতে ইচ্ছা করল। বাড়িটার সামনে দিয়ে খানিক আগালেই ছোট একটি মুদি দোকান। রমেশ শীলের দোকান। হিন্দুরা কেন যেন বংশের পেশা হারিয়ে ফেলছে। রমেশ শীল দোকান করে খায়, নুর মোহাম্মদের প্রতিবেশি নিখিল কর্মকার এখন বাজারে মাছ বিক্রি করে।
দোকানের সামনে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চে বসলেন নুর মোহাম্মদ। জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হাঁটার ক্লান্তি দূর করে বললেন, ‘রমেশ দা, কেমন আছো?’
রমেশ শীলের মুখের দাঁত বোধকরি একটিও নেই। জিহ্বা আর মাড়ির ঠোকাঠুকি করে জড়ানো শব্দে বললেন, ‘ভগবান রাখছে ভালোই।’
‘একটা সিগারেট দাও। তোমার শরীর কেমন?’
‘শরীরের কথা আর বোইল না। মাজার ব্যথাটা বাড়ছে। শরীরটাও ছাইড়া দিছে। পাইলসের সমস্যাটা খুব জ্বালাইতেছে। রাতে ঘুম হয় না।’
‘তাহলে আর ভগবান ভাল রাখল কই?’
‘বাঁইচা তো আছি রে ভাই। চোখের সামনে কতজন চইলা গেল, আমি তো কেমনে যেন রইয়া গেলাম।’
রমেশ শীলের বাড়িয়ে দেয়া সিগারেটটা নিতে নিতে নুর মোহাম্মদ বললেন, ‘এখলাস সাহেবরাও তো রয়ে গেলেন।’
রমেশ শীল সঙ্গে সঙ্গে যেন সতর্ক হয়ে উঠলেন। চুপসে গেলেন। বললেন, ‘হে, তারা বড় মানুষ। তারা তো থাকপেই।’
‘রমেশ দা, একটা কথা কিন্তু আমার জানা নাই। এই বাড়িটা এখলাস সাহেবদের হল কী করে,বলবা?’
কথাটা বলেই বাঁ দিকে মানুষের শব্দ পেয়ে নুর মোহাম্মদ চশমার ভেতর দিয়ে তাকালেন। ঝাপসা চোখে জব্বার বাউলের লম্বা চুলগুলো দেখলেন। শীর্ণ শরীরের এই মানুষটি কথা বলে বেশ উঁচু গলায়। কিন্তু বাউল সুলভ বিনয়ের কোনো অভাব নেই। বাউলদের বিষয়টা যে কি নুর মোহাম্মদ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। জব্বার নমস্কার জানানোর ভঙ্গিতে দু’হাত তুলল। তারপর সামনের বেঞ্চে বসতে বসতে বলল, ‘মাফ করবেন মাস্টার সাহেব। কথার ভেতর প্রবেশ করা ঠিক না, পাপের কাজ। কিন্তু গুরু লালন বইলা দিছেন, সত্য বল, সুপথে চল। তাই সত্য বলার খায়েশ ছাড়তে পারি না। ওই বাড়িটা আছিল নারায়ণ ঘোষের। তারে মাইরা ফেলানোর পর তো পরিবার পালাইল। কিন্তু ওইখানে থাইকা গেছিল তাঁর বোন দিপিকা। আমার বয়স তখন ১২-১৩ বছর। নতুন দু-একটু বিড়ি টান দেওয়া শিখছি। তখন তো এই এলাকা নির্জন। আমি ও-ই কোনাটায় বইসা বিড়ি টানতেছি আমাগো হারেস মিয়ারে সাথে নিয়া। হঠাৎ দেখলাম নিরবে তিন-চারজন লোক নারায়ণ ঘোষের বাড়ি ঢোকে।
‘নারায়ণ ঘোষ তখন…’
নারায়ন ঘোষতো নাই। মাইরা ফালাইছে। দিপিকা পিসি ওই বাড়িতে থাকেন। হাতের বিড়ির আগুন মুঠের মইধ্যে লুকাইয়া ভাল কইরা তাকায় দেখি সামনের মানুষটা মমিনউদ্দিন। তারা বাড়ির ভেতর ঢুকার একটু পর দিপিকা পিসি দুই তিনটা চিৎকার দিল। তার সাথে সাথে টিনের ঘরের ভেতর বিকট জোরে একটা গুলির আওয়াজ হইল। দিপিকা পিসির জামাই একটা চিৎকার দিল মাত্র। আমি একটু আগায় গেলাম। শুনি ঘরের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তির শব্দ। আর দিপিকা পিসি গোঙ্গায়! ভয়ে আমার হাত-পা শুকায় গেল। আমি কী করব বুঝি না। হারেস মিয়ারে সাথে নিয়া একটু দূরে গিয়া অপেক্ষা করতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি তারা বাইর হইয়া যায়। ওই যে ও-ই রাস্তাটা দিয়া চইলা যায়। আমরা খুব ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়া উঁকি দিলাম। দেখি পিসা মশাইর লাশ পইড়া আছে। একটু দূরে দিপিকা পিসি একেবারে ন্যাংটা পইড়া আছেন! তার পেটের ওপর বেনেট দিয়া কুমরার মত ফাইড়া দিছে। আহা! এরপর যে কী দিয়া কী হইল…ওয়ারিশ নাই। দেশ স্বাধীনের ৪-৫ বছরের মধ্যে দেখি বাড়িটা হইয়া গেল মমিনউদ্দিনের! এখনো তো তার পোলা এখলাসের কথায় বাঘে-মইষে একসাথে পানি খায়…’
নুর মোহাম্মদ সিগারেটের ফিল্টারটা হাত থেকে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ি যাওয়া দরকার। জব্বার বাউল পিঠের সঙ্গে রাখা দোতারা সামনে এনে কায়দা করে ধরল। তার চোখ-মুখে ভীষণ হতাশা। যেন এক মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল ধরা। নুর মোহাম্মদ পেছন থেকে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেলেন জব্বার বাউল গান ধরেছে-
ওরে রাক্ষুসে মশা তুই করলি বড় দুর্দশা
জীব জানোয়ার সব খাইলি, আর খেতে কি তোর আশা…
নুর মোহাম্মদ পাটখড়ির বেড়া পার হয়ে নিজ বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই বজ্রের মত ঠা ঠা শব্দ তুলে স্ত্রী রেহানা ছুটে এল। তার হাতে ছিল একটি আধপোড়া খড়ি। ছুটে আসতে আসতে হাতের খড়িটি ছুড়ে মারল নুর মোহাম্মদের দিকে। চিৎকার করে বলল, অসভ্য লোক কোথাকার! লম্পট!
নুর মোহাম্মদ হতভম্ব হয়ে হাসি হাসি মুখ করলেন। রুদ্রমুর্তি নিয়ে প্রায় কাছে চলে আসা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হইছে, কী ব্যাপার?’
‘ব্যাপার কিছু জানেন না! কিছু জানেন না!’
‘কী জানব?’
স্ত্রী রেহানা হাপাতে হাপাতে বলল, ‘স্কুলের মেয়ের সঙ্গে কী করছেন! আন্ধা কোথাকার! নিজের বউরে ভাত-কাপড় দিতে পারেন না, এত বদমায়েশি আসে কোথা থিকা?’
তখনো নুর মোহাম্মদের কিছু মনে আসছে না। তিনি বললেন, ‘কীসের বদমায়েশি?’
‘বোঝেন না কীসের বদমায়েশি? আমি আব্বারে খবর দিছি। আব্বা আসতেছে। এখনই চইলা যাব!’
নুর মোহাম্মদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর স্ত্রী একটু সময় নিয়ে তারপর যেন নিজে নিজেই কথা বলছে এমন ভাবে বলল, ‘কত বড় বেলজ্জা লোক! ক্লাস টেনের মেয়ের বুকে হাত দেয়!’
নুর মোহাম্মদ কিছু বলার আগেই তাঁর শ্বশুর রব্বানী সাহেবকে দেখা গেল। লম্বা, একহারা মানুষ। পরণে সাদা পাঞ্জাবী। মুখে সুন্দর করে ছাটা দাড়ি। তিনি ছোট করে কাশ দিলেন।
নুর মোহাম্মদ দু’ পা সামনে এগিয়ে গেলেন। রেহানা তাঁর আগে লাফ দিয়ে চলে এলেন। বলল, ‘এই খবরদার! আমার আব্বার সঙ্গে কোনো কথা না!’
রব্বানী সাহেব হাত উঁচু করে মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নুরু, তুমি আমার সঙ্গে আসো।’
নুর মোহাম্মদ তাঁর পেছনে পেছনে উঠোনের পাঠখড়ির বেড়া পার হয়ে বাইরে গেলেন। রব্বানী সাহেব কোনো ভুমিকা না রেখেই বললেন, ‘কথাটি আমার কানেও আসছে। ঘটনা কী?’
‘কোন ঘটনা?’
রব্বানী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী মুশকিল! এই যে তোমার স্কুলে একটি মেয়ে নিয়ে কেলেঙ্কারির ঘটনা।’
নুর মোহাম্মদ মোটা কাঁচের ভেতর দিয়ে একবার খোলা আকাশের দিকে দেখতে চেষ্টা করলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘কাল দুপুরে হঠাৎ আমার চোখের কোণে কিছু একটা রোদের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল। তাকিয়ে দেখি, কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো একটি মেয়ের গলার লকেট। মনে হল লকেটিতে সোয়াস্তিকা চিহ্ন। কাছে গিয়ে ভাল করে লকেটটি দেখলাম। তাতে দোষের কী হইছে বুঝতে পারছি না…’
‘লকেটে কি স্বোয়াস্তিকা চিহ্ন ছিল?’
‘না, স্বোয়াস্তিকার মত দেখা গেলেও সেটি স্বোয়াস্তিকা না।’
‘স্বোয়াস্তিকা হলে তোমার অসুবিধা কী?’
‘স্বোয়াস্তিকার বহু ব্যবহার আছে। ক্লাস টেনের একটি ফুটফুটে মেয়ে, তাও আবার আমারই ছাত্রী। ভুল স্বোয়াস্তিকা গলায় দিয়েছে কিনা… ’
রব্বানী সাহেব বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ‘তুমি এত বেশি বোঝো কেন! স্বোয়াস্তিকা ভুল বা শুব্ধ হলেই বা তোমার কী!’
নুর মোহাম্মদ নার্ভাস হয়ে বললেন, ‘জ্বী আব্বা!’
রাতে নুর মোহাম্মদের স্ত্রী রেহানার চোখে মুখে অনুতাপ দেখা গেল। দুপুরে কান্নাকাটির কারণে এখনো তার চোখ মুখ ফুলে আছে। রেহানা বলল, ‘আপনি দেইখেন, কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের সঙ্গে আল্লাহ আছে। তাছাড়া এতদিন ধরে আপনি চাকরি করতেছেন। কমিটির লোকজন কিছু না শুনেই কি আপনার চাকরি খেয়ে ফেলবে? আপনি তো আর খারাপ চোখে মেয়েটার দিকে তাকান নাই। আপনারে তারা চেনে না?’
নুর মোহাম্মদ কোনো মন্তব্য করলেন না।
রেহানা আবার বলল, ‘তারপরও আমার হাত-পা কাঁপতেছে। আপনার চাকরি গেলে আমরা খাবো কী? যাবো কোথায়?’
রাতভর নুর মোহাম্মদ বিছানায় ছটফট করলেন। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রা এল। তিনি স্বপ্ন দেখলেন। দেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। মমিনপুর উচ্চ বিদ্যালয় দোতলা হয়েছে। স্কুলের সামনে শিক্ষকদের দু-তিনটি সাদা প্রাইভেট কার দাঁড়ানো। ক্লাসের ভেতর প্রত্যেকটি মেয়ে একটি করে আলাদা ডেস্কে বসে আছে। তাদের সবার সামনে একটি করে ল্যাপটপ। একজন শিক্ষক ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে একটি ছোট ডিভাইস। তিনি সেটিতে চাপ দিলেই ডিজিটাল ব্ল্যাকবোর্ডের ছবি পাল্টে যাচ্ছে। শিক্ষক উঁচু গলায় বলছেন, ‘তোমরা সবাই আঞ্চলিক ইতিহাসের কিছু নোট নিয়ে নাও। মহান শিক্ষানুরাগী আমাদের এখলাসউদ্দিন সাহেবের পিতা মরহুম মমিনউদ্দিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪০ সালে। দারিদ্র্যের ভেতর বেড়ে উঠলেও তিনি ছিলেন সমাজের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় শিক্ষা বিস্তার। বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে গ্রামে উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন….’
ব্ল্যাকবোর্ডের মত পর্দাটিতে তখন ফুটে উঠেছে মমিনউদ্দিনের ছবি। ষাটোর্ধ বছরের মমিনউদ্দিনের মুখ ভর্তি দাড়ি। নোট নেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস টেন-এর মেয়েগুলো পরম শ্রদ্ধায় অতীতের মহান মানুষটির ছবির দিকে তাকাচ্ছে…
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..