মরা বিকেলের আলো

জলি চক্রবর্ত্তী শীল
অণুগল্প
Bengali
মরা বিকেলের আলো

‘নে টাকাটা ধর সুখী’।

একটু বোধহয় ঝিমুনি গিয়েছিল সুখী‚ আচমকাই চটকা ভেঙে জেগে ওঠে। দেখে পদা   দুটো একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একটু আগেই সে পদার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এই ঝোপের ভিতর কাঠকুঠোর খোঁজে এসেছিল। কয়েকটা গাছের ডাল একটা দড়িতে বেঁধে হাঁপিয়ে গেছিল। দুপুরের পড়ন্ত রোদেও তাত কম না। বড় অশত্থ গাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।

‘টাকা‚ আমি তো তর কাছে টাকা চাইনি’। পদার মুখের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলে সুখী।

‘চাসনি জানি‚ কিন্তু বেদানার কাছে তো টাকা চাইছিলি। কিন্তু তখন তো দেবার উপায় ছেল না‚ তাই বেরিয়ে দেব ভেবেই টাকাটা আনছি। নে ধর।’

‘বৌ দেল না যখন‚ তাখন তো তুই আসি দিতে পারতিস। তাখন তো দিলি না‚ অখন বৌকে লুকিয়ে দিতে আসছিস?’ সুখীর গলা থেকে অভিমান ঝরে পড়ে।

অশত্থগাছের গুঁড়ির অন্যধারে বসে পড়ে পদা। ঠিক তখনই উত্তর দেয় না।  তারপর ধীরে ধীরে বলে‚
‘ লুকিয়ে ছাড়া দেবার উপায় বা কী?’

সুখীও উত্তর দেয় না। পদা তার সৎ বোনপো। কিন্তু সম্পর্কে সৎ হলেও সেই যেদিন বিধবা হয়ে মেয়েটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁটাতারের বেড়া পার করে এদেশে চলে এসেছিল‚ সেদিন এই সহায় সম্বলহীন সুখীর পাশে দাঁড়িয়েছিল এই পদাই। বড় মুখে করে বলেছিল‚ ‘ তর যখন যা দরকার পড়বে আমারে বলবি। ‘ দিদির সৎ ছেলে হলে কী হয় দুজনের সম্পর্ক দেখলে কে বলবে ওদের নাড়ীর সম্পর্ক নেই। পদা বয়সে সুখীর থেকে অনেকটাই বড়। তাই আর মাসী বলে ডাকে না। তারপর তো জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। নিজে বাড়ি বাড়ি বাসনমাজা-ঘরমোছার কাজ নিয়েছে‚ মেয়েটাকে বড় করে বিয়ে দিয়েছে‚ সেই মেয়ের চিতায় আগুনও দিয়েছে। এখন টান বলতে মেয়ের ঘরের নাতিটা।  নাতিটা বেশ ছিল‚ বয়সের ছেলে যা হয়‚ প্রেমে দাগা খেয়ে মরতে গেছিল।  মরণ নেই তাই বেঁচে গেল‚ কিন্তু মাথায় চোটটা ভালো। কাজে যেতে পারে না। সুখীর নিজের কোন কাজ নেই। নাতিটা কাজ ছাড়িয়ে দিয়েছিল‚ রোজগার করছিল বলে।   এই অবস্থায় ঘরে একটাও টাকা নেই। টাকা কটা না হলে যে কালকে ঘরে উনুন জ্বলবে না। তাই চাইতে গেছিল বেদানার কাছে। কিন্তু বেদানা সরাসরি না করে দিল।

‘তর মনে পড়ে সুখী সেই যেদিন তুই আসছিলি‚ তরে কয়েছিলাম যখনই দরকার পড়বে আমারে বলবি। আর কেউ তর পাশে থাক না থাক আমি আছি সবসময়। আমার যেটুক খ্যামতা আমি সেটুকু দিয়া তর পাশে আছি’।

সুখীর চোখ বেয়ে জল নামে। কালো‚ দোহারা‚ গাল বসে যাওয়া দড়ি পাকানো শুকনো শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে কান্নার দমকে।

পদা আলতো করে পিঠের উঁচু হয়ে ওঠা শিরদাঁড়াটার ওপর আশ্বাসের হাত রাখে। ঠিক এমন করেই তো সে সুখীর পাশে থাকতে চায়।

‘তর কাছ থেকে তো নিয়েই যাচ্ছি। কিছু তো দিতে পারি না তরে।’ সুখীর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলা কথাগুলো নিস্তব্ধ দুপুরে অশত্থগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে ঘুরে ফেরে।

পদা মৃদু হাসে। তারপর বলে‚ ‘তরে কোনদিন কই নাই‚ আজ কই‚ সেই যেদিন বাপটা তর দিদিরে বিয়ে করতে গেল‚ তুই তখন কত ছোট‚ তরে দেখে সেদিনই বুকের ভিতর কী যে নাচন হল ‚ বুঝলাম না‚ শুধু বুঝলাম তরে আমি সেই ক্ষণ থেকে ভালোবাসতে লাগলাম। বেদানারে বিয়ে করলাম‚ ছেলে-পুলে হল‚ তবু বুকের নাচন কমল না। আজও তরে আমি সেই দিনটার মত করেই ভালোবাসি সুখী। কিছু পাওনের জন্যি নয়‚ শুধু তর পাশে পাশে থাকতে দিস এটাই আমার বড় পাওনা রে।’

মরা বিকেলের রোদ এসে পড়ে সুখীর কান্নাভেজা‚ তুবড়ে যাওয়া মুখে এক অপার্থিব আলো হয়ে।

জলি চক্রবর্ত্তী শীল। নেশা বই পড়া। জীবনকে কাছ থেকে দেখতে আর শব্দের পর শব্দ জুড়ে সেই জীবনকে বুনতে ভালো লাগে। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়েই কাটাছেঁড়া।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..