প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
শুকুর আলির নাক বরাবর অনেকগুলো উঁচু দালান আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছেটাকে মনে সেঁধিয়ে কেবলি ওপরে উঠছে। নিচে তার হাঁসফাঁস অবস্থা। যে-কেউ বুঝতে পারবে গল্পের নায়ক হলেও নায়কোচিত বীর-দর্প তার নেই। নীতিবোধ তাড়িত এক নিষ্পাপ সন্তুষ্টি তাকে দেয়নি দ্রোহের নাগাল। তাই বিনম্র অবনতি তার জীবনের ছাঁচ। কি এক অলিখিত দায় তাকে কেবল এলিয়ে পড়তে শিখিয়েছে। মাটিবর্তী লতার মতো তাই সে ছিলো জীবনঘনিষ্ঠ না হলেও মৃত্তিকা বরাবর। সমুদ্রের উত্তাল তাই তাকে টানে নাই। টেনেছে পাহাড়। পাহাড় মানে সর্বংসহা মাটির ঊর্ধ্বমুখী স্তুপ। পাহাড়ের বুক-চেড়া ঝর্ণার মতো একটা প্রবহমান ক্ষত নিয়ে সে এলো ঢাকায়। তবু সে কৃতজ্ঞ। পাহাড় তাকে মৌনতা শিখিয়েছে। নীলগিরি পাহাড়ে ওঠার সতেজ স্মৃতি আজও তাকে আনন্দ দেয়। সেবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেও গিয়েছিলো পার্বত্য জেলায়। একদিন দুইদিন করে প্রায় সপ্তাহখানেক ঘুরে ফিরেও ঘোর কাটেনি। হাত-খরচা ফুরিয়ে গেলে তবেই না ফেরার ইচ্ছেটা দানা বাঁধে। আর নীলনবঘন মেঘেদের ভেসে বেড়াতে দেখে মনে মনে উচ্ছ্বসিত সে বলেছিলো: আহা কি বিশাল হাওয়াই মিঠাই!
সেই থেকে পাহাড় তাকে স্বপ্ন দেখায়। আর পাদদেশে নেমে যতবার সে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে দেখেছে পাহাড়ের শীর্ষদেশ, ভেবেছে, একমাত্র পাহাড়ই বলতে পারে: উন্নত মম শীর। কিন্তু আজ উল্টোরথে চলা মনের দিশা সে নিজেই খুঁজে পাচ্ছে না। এত এত উঁচু দালানের সামনে দাঁড়িয়ে তার সেই প্রখর অনুভব নেতিয়ে পড়েছে হঠাৎ। সে ভাবছে জীবনের সঙ্কট নিরসনে পাহাড়ওতো গুঁড়িয়ে দিতে হয়। এই বহুতল ভবন-সমাজ হাঁসফাঁস করা বুকের ভিতর যে-ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে সেকি দ্রোহ? নাকি ঈর্ষা কেবল? পাহাড় দেখলে ঈর্ষা হয় না। সে-যে প্রকৃতি। ভোগের যতটা, তারও বেশি উপভোগের। মতিঝিলের এইসব বহুতল ভবনের পাশ দিয়ে চলতে চলতে শুকুর আলির মনে হলো সেই পুরনো গদ: পৃথিবী একটা অলঙ্ঘ্য নিয়মে বাঁধা পড়েছে। সেটি অসমতা। বস্তি ভাঙছে। উচ্ছেদ হচ্ছে। গড়ে উঠছে আবাসন। শুধু নির্বাসনের হিসেবটাই গোপন থাকে। যে-একতলা ভবনটি দলছুট, হাঁটু গেড়ে হাঁপাচ্ছে আকাশমুখো হা হয়ে, সাম্যের প্রশ্নটি মুখ্য হলে বাকি ভবনগুলো অন্তত ওই পর্যন্ত নামিয়ে আনতে হবে। নইলে নগরপ্রস্থে দাঁড়িয়ে থেকে অথবা চলতে চলতে বুকের মধ্যে কারবলা বয়ে যাবে, একফোটা পানিও পাবে না কেউ।
শুকুর আলির ভাবনা মাটি তথা ডাঙা থেকে অযাচিত জলে নামলো। জলপান সাঙ্গ করে তার গন্তব্য কোথায় হবে আমরা জানি না। শুধু জানি বাংলায় এম এ পরীক্ষা দিয়ে শুকুর আলি যখন জেলা শহর থেকে মফস্বল টাউনে ফিরে এলো, তখন জীবনতৃষ্ণা বলে কিছু ছিলো না তার। ছিলো না আকাঙ্খার দৈব দুর্বিপাক। কিন্তু জলের পাকের মতোই বিপদসঙ্কুল এই সংসারের ঘানি টানা। তার নিজের সম্পদ বলতে এই মফস্বল টাউনের গলির ভিতর একখানা টিনের ঘর। সুবিধা মতো সময়ে এর মেঝে পাকা করা হয়েছিলো। তার মা আছেন। আর কলেজ পড়–য়া দুই ভাই-বোন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে নিজেদের খরচ চালায়। স্কুল মাস্টার পিতার পেনসনের যৎসামান্য টাকায় মা নিষ্পন্ন করেন সংসারের বাকি খরচ। সে-ও দিত। মাধ্যম টিউশনি। কিন্তু পরীক্ষা শেষে মেস গুটিয়ে এলাকায় ফিরতে হলো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনির কথা ভাবতেই এখন হীনমন্যতায় গা রি রি করে। ফল বেরুলে ঢুকে গেল একটা বেসরকারি কলেজে। হাজী কুতুবুদ্দিন মহিলা ডিগ্রি কলেজ। পদ: প্রভাষক, বাংলা। স্থানীয় এম পি’র আনুকুল্যে এক পয়সাও ডোনেশন লাগেনি তার। এ নিয়ে রহস্যাবৃত এক জল্পনা গোল পাকিয়ে উঠেছিলো কিছুকাল। পরে সবাই জেনেছে, এ কলেজে চাকরি করা মানেই নির্জলা বেগার খাটা। সরকার এমপিওভুক্তি বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ অজ্ঞাত। প্রভাষক পদের যে-উপাদেয় কেরিয়ার দিয়ে শুকুর আলি যাত্রা শুরু করেছিলো, তাতে হোঁচট খেয়েও তার কিন্তু বিস্বাদ লাগেনি। বাংলায় দ্বিতীয় শ্রেণির একটা সামান্য ডিগ্রি। তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থতার আগেই একটা স্তরে এসে ঠেকে যাবে, এইতো স্বাভাবিক। কলেজটা ছেড়ে দিলেও সে দমে যায়নি। কিন্তু কর্মনিরূপনের তাগিদ সে অনুভব করে নাই। যেন এক আলস্য মোড়ানো হাঁটা তার জীবনের পথ বাতলে দেবে। দ্রোহের গতি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বার কিছু নাই। এ নিয়ে মায়ের ক্ষোভ ছিলো। অভিমান ছিলো ভাই-বোনদের। এসব এড়িয়ে মহুয়াগন্ধের দিকে তার মন শুধু আকুল হয়ে থাকতো। আদর্শ স্কুলের পুকুর পাড়ে সেই মহুয়া গাছ। ফুলে ফুলে আতপ চালের গন্ধ ছড়িয়ে বেড়ায়। শুকুর আলির মন তাই গন্ধ মাতাল। হৃদয়ের সেই গন্ধমর্মর শুধু জেনিই জানে। জেনি তার ক্লাসমেট। দু’একবার সাক্ষাতেই অনেক কথা হলো। তারপর সারা রাত ঘিরে মোবাইল যোগাযোগ। পার্কে হাঁটা আর বহুবিধ ব্যঞ্জনে প্রমত্ত হাসাহাসি। হয়তো একেই প্রেম বলে। ‘হয়তো’- কেননা ইদানিং অপ্রেমের একটা ডানা ঝাপটানি সে ঠিকই টের পায়। তার সঙ্গে দেখা না হলে জেনির মধ্যে অধীরতা কাজ করতো। কথাবার্তায় মনে হতো তার সঙ্গ ওকে জলকেলির উচ্ছলতা দেয়। সেই স্ফূর্তির কোথায় যেন টান পড়েছে। শেষ বেলায় ও অবশ্য বলতো: বাবা বর দেখছেন। কিছু একটা করো। শুকুর আলি জানতো জীবনবোধের কড়া নেড়ে প্রেম হয় না। জেনি যেন হঠাৎ হিসেবের কড়চা খুলে বসেছে। মাঝে মধ্যে ফোড়ন কাটতো: শুকুর আলি, এটা কোনো নাম হলো? তোমার নামের মধ্যে কালচার নাই।
অনেক কিছুই নাই তার। চাকরি অথবা সম্পদ। খ্যাতি, প্রভাব প্রতিপত্তি অথবা জীবনের নিশ্চায়ক অন্যকিছু। মহুয়া ফুলের গন্ধের সঙ্গে আতপ চালের সৌরভ-সাদৃশ্য নিয়ে যতই গল্প করুক সে। শুধু কথায় চিড়ে ভিজে না। তাই জেনির চেয়ে মহুয়া গাছটিকে বরং হাতের নাগালে মনে হয়। ওটি গাছ নয়। আতপ গন্ধের বাড়ি। বিশেষত যখন ফুল ফোটে। যেন এক অনন্য মাদক তাকে নেশায় আটকে রাখে। ইদানিং জেনির সঙ্গে আর কথা হয় না। মোবাইলের মেসেজ অপশনটাও বহুদিন অব্যবহৃত রেখে দিয়েছে সে। এভাবে জীবনের সব অপশন বন্ধ করে মানুষ একদিন মরে যায়। শুকুর আলি মরে নাই। বরং তার জীবন হঠাৎ একদিন উজ্জীবনের ভাষা পেয়ে গেলো। মেঘ পাহাড় এবং ছোট্ট পরিসরে সমুদ্রও যার অনুষঙ্গ মাত্র। কেবল প্রসঙ্গটা খুঁজে পেতে আমরা একটু পিছনে যাবো।
বহু বছর আগে শুকুর আলি যখন ছোট ছিলো ঈদের মওসুমে বাবা তাকে পাঞ্জাবি কিনে দিত। খুবই কমদামি। ফুটপাতে হকাররা বিক্রি করতো ওসব। লোকে বলতো নিলামি কাপড়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুইদিকে টান করে হাত মেলে ধরলে খানিকটা লম্বা হয়ে যেতো। হাত গুটিয়ে নিলে পূর্ববৎ ফিরে আসতো। সংকোচন আর প্রসারণ। জীবনের এই দ্বৈরথে শুকুর আলি যেন সেই নিলামি পকেট। জেনি এসেছিলো প্রসারণ নিয়ে। সংকোচনের আগে সেই ছোটবেলা নিলামি পাঞ্জাবির গন্ধ শুঁকে ঈদের আগের রাত্রি পার করে দিত সে। ঈদ গেলে আসতো শীতের মওসুম। ছবিনা পড়ার ধুম লেগে যেতো। হাফেজদের ভাড়া করে এনে সারা রাত মাইকে কোরান খতম করাতো বড় বাড়ির লোকেরা। একে বলতো ছবিনা। নানান সুরে দ্রুত লয়ের সেই মুখস্থ পাঠের মূর্ছনা এখনো তার কানে লেগে আছে। আরো বেশি মুখর ছিলো আতপ চালে রাঁধা পোলাওয়ের ঘ্রাণ। বড় বাড়ির সাহেব মিয়ার বাড়িতে ছবিনার পরের দিন সকালে এই ভোজের ব্যবস্থা হতো। লোকে বলতো ‘জেয়াফত’। সেই নিলামি পাঞ্জাবির দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখতো সে। টান টান লম্বা হয়ে ঘুরঘুর করতো জেয়াফতের চারপাশে। কিন্তু নাসারন্ধ্র পাগল করা সেই পোলাওয়ের গন্ধ ছাড়া অন্যকোনো স্মৃতিপাঠ গল্পের বিষয় হবার যোগ্যতা রাখে না। শুকুর আলি কখনো সেই জেয়াফতে অংশ নেয়নি। বাবা বলতো ওসব গরিবের হক। কিন্তু নিজের সামাজিক স্তরে সে-যে হত দরিদ্র, এ কথা মুখ ফুটে বলতো না কখনো। তবু পুবের ভিটায় মহুয়া ফুটলে গন্ধমুখরিত হাওয়ায় হাওয়ায় জেয়াফতের আগাম বার্তা তার নাকে আসতো ঠিক ঠিক। মনে হতো মহুয়ার পেটের মধ্যে প্রচ্ছন্ন পোলাও সঙ্গীত। আতপগন্ধের অনন্য মর্মর। তার জিভে নয়, নাসারন্ধ্রে সেই সৌরভের পূর্ণ অধিকার বলবৎ আছে। আজ বহু বছর পর যে-অধিকার সে হারাচ্ছে সেটি জেনি। পরিষ্কার বুঝা যায় আতপগন্ধের যে-সঙ্গীত জেনির বুকে ধ্বনি দিয়েছে, সেটা সহানুভূতি, প্রেম নয়। হয়তো প্রেম, কিন্তু পরিণয়ের অপেক্ষা ছাড়া যা শেষ হতে চলেছে, তার ভিত শক্ত বলা যায় না। আদর্শ স্কুলের পুকুর পাড়ে মহুয়া বৃক্ষের গোড়ায় গা এলিয়ে এসব ভাবে শুকুর আলি। তার চোখ আকাশ অবধি স্থির। নীলগিরি পাহাড়ে যে-মেঘ তার স্বপ্ন শানিয়েছে, তাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে বন্ধু নিতাই কুণ্ডুকে। সে কবিতা লিখতো। একদিন গাঁজা খেয়ে কলেজ মাঠে চিত হয়ে শুয়ে ছিলো ওরা দুইজন। বিষণœ মেঘের প্রস্তর ভাসছিলো এরকম। তাই দেখে নিতাই বললো: ওইটা মেঘ না। মাথা। লেনিনের নিষ্কলুষ মস্তক। দ্যাখ, ভাসতাছে। নিতাই ভাব করে বলতো: সাম্য-সুন্দর। একতলা বিল্ডিং পাঁচতলা করো। আবার পাঁচতলা ভাইঙ্গা একতলায় নামায়া আনো। দু’নোটাই বিপ্লব। দেশ ভেদে ধরন পাল্টে।
শুকুর আলির রাজনীতি হয় নাই। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ জিইয়ে রেখে গলাবাজি নয়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে একটু সমঝে চলায় তার স্বস্তি। তবু বলতো: আগে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়া যাও। তারপর নিজেরে নামায়া আনো সমতলে। গলা চড়ায়া বলো, বস্তিওয়ালা, জাগো।
নিতাই হাসতো। বলতো: তুই শালা বুঝস ভালোই। কিন্তু ইন্ট্রুভার্ট। আমি কই অন্তর্বাস। নিম্নাঙ্গে থাকস। হা হা।
এখনো কথা হয় নিতাইয়ের সঙ্গে। ওপাশ থেকে মোবাইল সে ছাড়তেই চায় না। কি এক সিদ্ধান্তে নিজেকে সপে দিয়ে তার রাজনৈতিক মন যেন নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। তাকে বলে: ঢাকায় আয়। কিছু একটা হবো। হওয়া না-হওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে তার মন তখন ভাবলেশহীন। জেনির বিয়ের জন্য নীরব সম্মতি ঠিক করে রেখেছে। শুকুর আলি ঢাকা যাওয়ার আগেই ওই বিয়ে সম্পন্ন হলো। জেনির বাবা সাহেব মিয়া জেলা শহরে বাড়ি করেছেন। কিন্তু মেয়ের বিয়েতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটাবেন বলে তিনি এই মফস্বল টাউনের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি সেন্টার বেছে নিয়েছেন। ইঁলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেও সূর্যমুখী কমিউনিটি সেন্টারে দারুণ জমজমাট হয়েছিলো সেই বিয়ের বৌভাত। লোকাল ভাষায় যাকে বলে ‘ওলিমা’। বলে রাখা ভালো, সাহেব মিয়ার পরামর্শেই শুকুর আলির বাবা গ্রামের যৎসামান্য জমি আর ভিটেমাটি বিক্রি করে টাউনে এসে বাড়ি করেন। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার দোহাই দিয়ে মফস্বল টাউনে তার এই অভিবাসন ফলপ্রসূ হয়নি। মৃত্যুর আগে ধার দেনা করে যে অকুল পাথারে রেখে যান নিজের সংসার, শুকুর আলি তার প্রথম শিকার। তার মা’তো বটেই এবং ভাই বোনেরাও।
জেনির সঙ্গে তার প্রেম পর্বের ইতিহাস হয়তো অনেকেই জেনে থাকবে। সেই সংকোচ এবং সামাজিক বিচারেও তাদের পরিবার বৌভাতের নিমন্ত্রণে যোগ্য বিবেচিত হয়নি। অবশ্য তার মা ভাইবোন এই অবমাননার জন্য প্রস্তুত ছিলো। আর আমরাতো জানি তার নিজের ছিলো মৌনতার পাঠ। বছর কয়েক আগে নীলগিরি পাহাড় যা তাকে দিয়েছে। তবু জমাট মেঘের সেই হাওয়াই মিঠাই ঝিরঝিরে বাতাসের মতো বিষণ্নতা বইছিলো তার বুকে। সুনীল সন্তরণে ভাসতে ভাসতে সে যেন চলে এলো বৌভাতে। জেনি তাকে দেখে নাই। সেও দেখে নাই জেনিকে। চেনাজানা মানুষের কানাঘুষা আর কৌতূহলি দৃষ্টিকে এড়িয়ে আতপ গন্ধের মর্মরিত মহুয়াকে আবার সে আবিষ্কার করলো। টেবিলে টেবিলে পোলাওয়ের সৌরভ। রকমারি খাবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুরো জায়গাটা আজ যেন মহুয়া বাগান। জেয়াফত! জেয়াফত! আতপের মতো তার সাদা শৈশব নিরন্ন ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠতে চায়। শুধু বাবা মৃত্যুর করাল থেকে অমোঘ শোকের মতো উসকে দিলেন: রুখ যা বাপ। ওসব বড়লোকের হক।
সেইযে বেড়িয়ে এলো, নিজেকে রুখতে গিয়ে জেনির প্রসঙ্গ জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হলো শুকুর আলির। আর অনুষঙ্গ ছেড়ে প্রসঙ্গে ফিরতে আমাদেরও যেতে হবে মতিঝিলে। যেখানে হাঁসফাঁস করা তৃষ্ণায় জলপান সাঙ্গ করে শুকুর আলির গন্তব্য কোথায়, আমরা জানি না। শুধু জানি মাসছয়েক আগে সে ঢাকায় আসে। চানখারপুলে নিতাইয়ের মেস। থাকার জায়গা জোটে ওখানেই। জীবনের গতি বলতে যা বুঝায় তা এখনো হয়নি। পুরনো বাণিজ্যটা চাঙ্গা করে অগাধ জলে মাথা উঁচিয়ে থাকার মতো একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে। একটা কোচিং সেন্টারে জায়গা করে দিয়েছিলো নিতাই। কিন্তু শিক্ষা যেখানে পণ্য সেখানে মার্কেটিঙের দায়িত্ব নিয়ে সে ভালো করবে না, এ ধারনা নিতাইয়ের ছিলো। তাই তিনটা টিউশনি সে জুটিয়ে দিয়েছে। নিতাই অবশ্য বলেছে, ভাষা গবেষণার জন্য একটা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান অচিরেই খোলা হবে। সে লিডারকে বলে রেখেছে। যেন এডহক ভিত্তিতে শুকুর আলির নিয়োগটা হয়। স্বপ্ন আর বিষণ্নতার যৌথ প্রকরণে তাই সে মেসের অব্যবস্থাও মেনে নিয়েছে। বাড়িওয়ালা লোকটা আশ্চর্য রকমের খবিস। স্বভাবদোষে অহেতুক অনর্থ করে। প্রয়োজন পড়লেও ন’টার পর পানি ছাড়বে না। আর সেই অমূল্য রত্ন পানিতেও বিষ দিয়ে রাখা। এত ফুটিয়ে খেয়েও তিন তিনবার পেটের পীড়ায় ভুগেছে সে। সেকি মরি মরি অবস্থা। একবার জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে একমাস কাটিয়েছে। দু’টো টিউশনি হাতছাড়া হয়েছে তখন। কিন্তু মাম বা ফ্রেশ ওয়াটারের বোতল কিনে খাবে কতদিন? তবে নিতাইয়ের সেবা আর অর্থক্ষয় সে এক বিরল প্রাপ্তি। বাথরুমের ছিটকিনি অকেজো হয়ে আছে। শত বলে কয়েও ঠিক হলো না। খুপরির মতো ছোট্ট ওই ঘরটাতে বসে শান্রি মলত্যাগ সম্ভব নয়। কখন কে ঢোকে, সেই আতঙ্ক। কাজের বুয়ার ছুটি ছাটা লেগেই আছে। তখন প্রায় অভুক্ত থাকতে হয়। আজও প্রায় সেই দশা। বুয়া আসতে দেরি করবে বলেছে। নিতাই অবশ্য বলে: তোরাতো রোজা রাখিস। আমাদেরও উপোস হয়। সত্যিকারের ক্ষুধা বুঝতে এবার শালা ভুখা-নাঙ্গা হয়া দ্যাখ। হলোও তাই। নাস্তা না খেয়েই বের হয় শুকুর আলি।
বঙ্গ বাজারের মোড়ে প্রতিদিন বাসে ওঠে সে। টিউশনি সেরে ওখানেই নামে। পায়ে হেঁটে মেসে ফেরে। একবার পাশের এক ডাস্টবিনে আধ-খাওয়া বিরিয়ানির কয়েকটা প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখে সে। সেই মহুয়াগন্ধের মর্মরিত আবেগটা ফিরে আসে। আরো উৎকট তাড়না নিয়ে এবার তাকে প্ররোচনা দেয় চেখে দেখবার। যেন আস্বাদ নিতেই আবর্জনায় উঁকি দিয়েছিলো সে। হঠাৎ কয়েকজন টোকাই এসে প্যাকেটগুলো নিয়ে গেলো। দুইজন বৃদ্ধ ভিখেরিসহ চেটেপুটে খেয়ে নিলো মুহূর্তেই। নিবিড় সেই খাওয়ার দৃশ্য সে অপলক চেয়ে দেখেছে। তার নিজের ভিতরে যে-আলোড়ন তা কেউ দেখেনি। মনে হলো ক্ষুধার রাজত্বে রাজা প্রজা নেই। সাম্য আছে। অনুভূতি সমান সমান। কেবল ভোগের বেলায় মানুষেরা ভাগ হয়। সেদিন বুয়া আসেনি। তারও ক্ষুধা ছিলো। কিন্তু ভক্ষণের এই মতো পদ্ধতি তার কেন মনপুত নয়? কেন সে পারেনি ওদের সঙ্গে বসে যেতে? ভিখেরি টোকাই ব্রাত্য কিংবা রাজা প্রজার সমস্ত সম্ভাবনা একই সঙ্গে সক্রিয় নয় কেন তার ভিতর? নিচে নামা কিংবা ওপরে ওঠা, ওপরে ওঠা কিংবা নিচে নামার মধ্যবর্তী যে-প্রতিরোধ, তাকে খুঁজতে গিয়ে শুকুর আলির কেবল জেনিকে মনে পড়ে সেদিন। মনে মনে ভাবতে থাকে: এই বিরিয়ানির প্যাকেট মূলত কার হক? গরিব না বড়লোকের? আজ নিতাইয়ের কথায় মুচকি হেসে সেইযে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছিলো, সন্ধ্যা অবধি মেসে ফেরা হয়নি। ছোট ভাই ফোন করেছিলো। বোনটির বিয়ে হয়েছে কিছুদিন। সমাজে মুখ রাখতে দু’চারজনকেতো খাওয়াতে হবে। কিন্তু টাকা কই? টিউশনিটাও আজ গেলো। জন্ডিসের সময় আগাম নিয়েছিলো সে। তাই শেষ মাসের বেতনটা দেয়নি। বলেছে, শোধবাদ। দায় মিটিয়ে সে যখন মতিঝিলে নেমে এসেছে, তখন দুপুর গড়ায়। এরি মধ্যে একটা হাড়-গেলা রোদ জেঁকে বসলো জ্যামের ওপর। বাস থেকে নেমে বরং হাঁটা দিলো সে। হাঁটতে হাঁটতে অনন্ত বোধির দেখা মেলে; তখন নির্বাণ হয় বসে থাকার- লিখেছিলো নিতাই কুণ্ডু। কিন্তু নির্বাণের আগেই ক্ষোভ হলো তার। সবার মুখে দু’মুঠো অন্ন দেবার আগে উঁচু উঁচু ভবনগুলো বাহুল্য মনে হলো। এত বাহুল্য যে, সব ভবন গুঁড়িয়ে দিলেও তৃষ্ণা মিটবে না। বুকের হাঁসফাঁস রয়ে যাবে। যেমন এখন এক নদী জল খেতে মন চাইছে। কিন্তু ফুটপাতের ফিল্টার থেকে খেতে গেলে শঙ্কা লাগে। যদি জন্ডিস হয়? পেটের পীড়া? প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বড়জোর একটা শষা কিনে খাওয়া গেলো। তাতেই পকেট সাবাড়। মোবাইলের চার্জ শেষ হবার আগে ফোন করলো নিতাই। বললো: চিন্তা নাই দোস্ত। লিডার বলছে, আগামি সপ্তাহে নিয়োগ। তুই হবি এডহক এডি। হা হা।
সেই হাসির রঞ্জন চোখ ধাঁধিঁয়ে দিলো। ঘোলা চোখে হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গবাজারের মোড়ে এসে কখন দাঁড়ালো সে, টের পায়নি। আজও ডাস্টবিন খালি নয়। তবে আবর্জনার উপর আধ-খাওয়া বিরিয়ানির প্যাকেট বেশি নেই। একটা কি দুটো হবে। আশে পাশে টোকাই কিংবা অন্যকোনো সাক্ষী সাবুদ কাউকেই দেখা গেলো না। যারা হাঁটছে তারা গন্তব্যের দিকে ব্যস্ত। কৌতূহলি নয়। হলেও সমস্যা নেই। তার সংকোচ নাই। নাই লোকলজ্জা ভয়। ক্ষুধা আছে, তবে সে ক্লিস্ট নয়। বরং তাড়িত। মহুয়াগন্ধের আতপ চাল রান্নার ব্যঞ্জনে ফুলে ফেঁপে আছে। ওইতো বিরিয়ানির প্যাকেট। গন্ধমাতাল শুকুর আলি একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে চেটেপুটে খায়। চরাচর অন্ধ অথবা প্রোজ্জ্বল তাকিয়ে দেখে। তারপর আরেকটা। ঠিক তখন ঢাকার ভবনগুলো ধসে পড়ে এবং গল্পের পাঠ চুকে গেলে বহু বহু বছরের পর সবাই জানবে এক অমোঘ ইতিহাস: সহস্রাব্দ আগে এ শহরে ভূমিকম্প হয়েছিলো। মুহুর্মুহু শব্দ আর পতনযজ্ঞের নিচে কোটি মানুষের চিৎকার এবং বাঁচার নিষ্ফল আকুতি নিয়ে যখন কেউ আর সহযোগী নয়, কেবল শিকার; তখন মৃত কাক কুকুর আর পোষমানা বিড়ালের মাংসের বিপরীতে পাহাড়ের মতো উঁচু একজন মান্যবর শুকুর আলি একাই জীবিত ছিলো। তার নির্বিকার ভোজনপর্বে তখনো একজন জেনিকেই স্মরণে রেখেছিলো সে। জেনি, যার লাল দোপাট্টায় একদা মহুয়ার গন্ধ লেগেছিলো।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..