মাটি জলমাখা জীবন (পর্ব- ১)

বিতস্তা ঘোষাল
উপন্যাস
Bengali
মাটি জলমাখা জীবন (পর্ব- ১)

বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে-
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে-
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু
মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।

কবিগুরুর এই অসাধারণ লাইনগুলোর মধ্যে গ্রাম-বাংলার লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। এ যেন প্রাকৃতিক এক সাধারণ দৃশ্যের মধ্যে অসাধারণ রূপ খুঁজে ফেরা। শীতের সময় কুয়াশামোড়া ভোরের গ্রামকে মনে হয় ধোঁয়ায় ডুবে থাকা এক রহস্যময়ী নারী। শীত চলে যাওয়ার পরও গ্রামে কুয়াশার এই দৃশ্য অনেক দিন থেকে যায়।এখন অবশ্য ভোর নয়। তবু মাঠের পর মাঠ সবুজ খেত ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুতে ঢেকে।

সেই অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে শাওন মায়া কাজল গ্রামের মেঠো রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে। কতক্ষণ তা নিজেও জানে না। কোনোদিনই সে ঘড়ি পরে না। পরলে মনে হয় হাতের ওজন বেড়ে গেছে। কলেজে এই নিয়ে বন্ধুরা প্রায়ই হাসি- ঠাট্টা করে। এখন অবশ্য মোবাইলেই সময় দেখা যায়। আজ অবশ্য তার কাছে সেটাও নেই। এখানে আসা অবধি এই যান্ত্রিক জিনিসটা থেকে দূরে থাকবে বলেই মনঃস্থির করেছে।শহরের জটিলতা,কোলাহল থেকে যত মুক্ত থাকা যায় আর কি!

বাংলো থেকে দুপুরে বেরবার সময় বেশ গরম লাগছিল। শালোয়ারের উপর সোয়েটার চাপাবার দরকার পড়েনি। এখন একটু শীত লাগছে। হঠাৎই যেন বদলে গেল আবহাওয়াটা ।

তার পরনে গাঢ় সবুজ আর খয়েরি রঙের ফুল আঁকা শালোয়ার কামিজ। শহরে কখনোই সে শালোয়ার পরে না। জিন্স টপ, প্ল্যাজো কুর্তিতেই স্বচ্ছন্দ। কিন্তু এখানে আসার আগে বাবা নিজের হাতে কতগুলো শালোয়ার নিয়ে এসে বারবার বলেছেন, মা ওখানে আমার পজিশনটা একটু খেয়াল রাখিস।

এই বিষয়টাই শাওনের মাথায় ঢোকে না। পোশাকের সঙ্গে পজিশনের কী সম্পর্ক! যাতে সে অভ্যস্ত তাই তো পরা উচিত। ধুর- বিরক্তিকর! তাছাড়া এই সবুজ খয়েরির কম্বিনেশন তার একদম পছন্দ নয়। এটা যেন গাছেদের সাজ। কেন সে গাছ হতে যাবে!
এই মুহূর্তে অবশ্য এসব কোনো বিরক্তিই তার মনে এল না। বরং একটা নাম না জানা ভাল লাগা তাকে আচ্ছন্ন করল। গাছেদের সঙ্গে প্রবল আত্মীয়তা অনুভব করছিল সে।

হাঁটতে হাঁটতে একজায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এতক্ষণ সে চোখ নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে ঘাস মাড়িয়ে হাঁটার পথ তৈরি করতে করতে হাঁটছিল। এখন তার সামনে প্রচন্ড বাধা। আর একটু হলেই ধাক্কা খেত। সে ওপরের দিকে তাকাল। চারদিক থেকে ঝুরি নেমে এসেছে মাটি অবধি। পুরো গাছটাকে মনে হচ্ছে ছোটোখাটো একটা পাহাড়। কী গাছ এটা ভাবতে ভাবতে মনে এল সেই লাইনটা , বটের ঝুরি বেয়ে অন্ধকার…হ্যাঁ , এই সে। তাকে তার চেনা পরিচিত কোনো মানুষের মত লাগল। সে মৃদু স্বরে বলে উঠল , হ্যালো স্যার, হাউ আর ইউ?- বলেই তার মনে হল, এ কি ইংরেজি বুঝবে? ভেবেই সে এবার আর একটু জোরে বলল – এই যে প্রাচীন বটবৃক্ষ আপনি কেমন আছেন? আমি শাওন।

চারদিক তাকাল সে। না , এই ঘোর জঙ্গলে কেউ নেই, নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারে। আর যদি কেউ থাকত এখানে তাহলে সে কি পাগল ভাবত তাকে! কে জানে! কিন্তু এখন আমি একা। মুক্ত। স্বাধীন।এই বট গাছটার মতোই। তার মাথায় আর একটা প্রশ্ন এল। এবার আগের থেকেও আরও জোরে সে বলে উঠল , হে বৃক্ষ, আপনি কত বছর ধরে এখানে আছেন? আপনার জন্ম কি পরাধীন দেশে, নাকি স্বাধীন দেশের নাগরিক আপনি? যদি আপনার বয়স একশো পেরিয়ে যায় তবে বলুন, কেমন লাগছে এই স্বাধীনতা ?
শাওন যেন একজন দক্ষ সাংবাদিক। ঠিক সেই ভঙ্গীতে সুনিপুণ ভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগল । আর তখনি সে ক্যামেরা –নিদেন পক্ষে মোবাইলটা সঙ্গে রাখার প্রয়োজন অনুভব করল। সাক্ষাৎকারে ছবি মাস্ট। এর জন্য আবার একদিন আসতে হবেই , নিজেকে বোঝালো সে।

শীতকালে ঝুপ করে আলো নিভে আসে। কটা বাজে বোঝাই যাচ্ছে না এই জঙ্গলের ভেতরে। চারদিকে কেবল গাছের ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো –আধাঁরি অদ্ভুত ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল। পাখির ডাকটা অচেনা। কাক বা টিয়া নয়। আন্দামানে প্যারট আইল্যান্ডে বেশ কয়েক বছর আগে সূর্য ডোবার আগে নৌকায় বসে লক্ষ লক্ষ টিয়াকে আইল্যান্ডের গাছে ফিরতে দেখেছে সে। তাদের ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে আর একসঙ্গে উড়ে আসা দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি ঝড় উঠেছে। কালো মেঘ বিশ্রীভাবে ভীষন আক্রোশে গর্জন করতে করতে গাছেদের ওপর আছড়ে পড়েছে। সেই মুহূর্তে সে শক্ত করে বাবার হাত ধরে বসেছিল। তার কাছে বাবাই এই পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ যে তাকে সব অশুভ শক্তি থেকে সরিয়ে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা দিতে পারে।

বাইরে যতই সাহসী হবার ভাব দেখাক আসলে সে বেশ ভীতুই। ঠাম্মা মারা যাবার পর বহুদিন ঘুমোতে পারেনি ভয়ে। খালি মনে হত এই বুঝি ঠাম্মা তার পাশে বসে গল্প করতে শুরু করবে , জানো তো ভাই, আমাদের বাড়িতে আলো ছিল না। বাথরুম বা তোমরা যাকে টয়লেট বলো, তাও ছিল না। আমরা দল বেঁধে মাঠে যেতাম। সবার হাতে মগ, আর তাতে জল।এমনি সময় অসুবিধা হতো না। কিন্তু বর্ষাকালে খুব কষ্ট হতো। তখন ঘরের পাশেই তালপাতার ছাউনি দিয়ে অস্থায়ী ব্যবস্থা। একজন করে করত আর করার পর ছাউনিটা আর একটু দূরে সরিয়ে দিত যাতে অন্য কেউ সেটা না মাড়াতে পারে।

তবে ভয় করত রাতের বেলা। সাপ , শেয়াল , হায়না …আরও কত কি! একবার কী হয়েছে জানো! খুব বৃষ্টি। সময়টা কিন্তু দুপুর। এই সময় অন্য দিন লোক থাকলেও সেদিন বৃষ্টির জন্য ছিল না। আমি অনেকক্ষণ পেট চেপে রেখে শেষে আর না পেরে বেরলাম। সবে ছাউনির নিচে বসেছি , দেখি একটা ভাম…

সেটা কি?

বিড়াল আর বেজির মাঝামাঝি একটা প্রাণী। দেখলেই ভয় লাগে।

তারপর ?

প্রথমে প্রচন্ড ভয় পেয়ে ভাবলাম পালাই,তারপর কী একটা ভেবে বসে পড়লাম। আমার চোখ ওদিকে। বুক দুরদুর করছে। একটু পরে উপলব্ধি করলাম সে বেচারাও বৃষ্টির জন্য এর নিচে আশ্রয় নিয়েছে। আমার কোনো ক্ষতি করা ওর উদ্দেশ্য নয়। সেদিন একটা জিনিস বুঝলাম, মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে একটা ফারাক আছে। মানুষ নিজের স্বার্থে যেকোনো সময় অন্যকে মারতে পারে, কিম্বা ক্ষতি করতে পারে , কিন্তু পশুদের যদি না আক্রমণ করা হয় ওরা অযথা মানুষকে বিরক্ত করে না ।
তোমরা কী ভাবে পড়াশোনা করতে ?

হ্যারিকেনের আলোয় একটা মাদুর বিছিয়ে সবাই দল বেঁধে গোল করে পড়তে বসতাম।একসঙ্গে পাঁচজন পড়ছি একটা হ্যারিকেনে। সবার দিকে ভাল করে আলো যাচ্ছে না। তবু পড়তাম ওভাবেই। কারণ ওর মধ্যেও একটা আনন্দ ছিল। তবে সুর্যের আলো থাকতে থাকতেই বেশিটা পড়ে নিতাম। তখন হয়তো খালি হোমওয়ার্কটা করতাম।
তোমাদের খুব কষ্ট ছিল- তাই না ?

কষ্ট ? কই নাতো ! আমরা এক গ্রামের কুড়ি- পঁচিশ জন ছেলেমেয়ে মিলে তিনটে গ্রাম পার করে স্কুলে যেতাম দেড় মাইল হেঁটে। পাঁচটা গ্রাম মিলিয়ে একটাই তো স্কুল। গরমে ঘেমেনেয়ে একসা হলেও শীতে হেঁটে যেতে ভালোই লাগত। কিন্তু বর্ষাকালে নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠত। তখন খুব অসুবিধা। জল ঠেলে বই মাথায় দিয়ে , কোনো রকমে শাড়িটা সামলে …কতবার যে বই জলে পড়ে গেছে, সেটা তুলতে গিয়ে নিজেও পড়ে গেছি জলে তার কোনো ঠিক নেই।

নৌকা ছিল না?

যখন জল একবারে বিপদসীমা ছুঁত তখন তার দেখা মিলত। কিন্তু ততদিনে স্কুল ছুটি হয়ে যেত। সেই দিনগুলো বাড়িতে বসে খুব মন খারাপ করত। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হত না, আড্ডা হতো না। তখন তো আর তোমাদের মতো ফোন, মোবাইল ছিল না। তবে আমরা চিঠি লিখতাম সেইসব দিনে। রোজ একটা করে। যেদিন আবার সবার সঙ্গে দেখা হত সেদিন সবাই সবাইকে সেগুলো দিতাম।

তোমার অনেক বন্ধু ছিল?

সে ছিল। তবে গৌরী, লীলা,কৃষ্ণা, মীনা আর আমি এক সঙ্গে যেতাম।

মীনা মানে মীনা দিদা? তোমার বোন?

হ্যাঁ। আমি আর গৌরী এক ক্লাসে পড়তাম। মীনা নিচু ক্লাসে।

গল্প শেষ করে ঠাম্মা বলত , আর বকিও না তো ,গলা শুকিয়ে গেল বকে বকে। এবার পানের বাটাটা দাও তো ভাই।

ঠাম্মা চলে যাবার বহুদিন পরেও তার মনে হতো খাটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আবার পড়ার সময় মনে হত এই বুঝি ঠাম্মা ফ্ল্যাক্স থেকে চা ঢেলে দিচ্ছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মুখে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ত সে।
মা এই অবস্থা দেখে ঘর পালটে দিলেও এখনো মাঝে মঝেই রাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। কারোর পায়ের শব্দ যেন তার বিছানার ঠিক পাশে এসে থেমে গেল । তার গলা শুকিয়ে যায়, তবু চোখ খুলে জল খায় না। মনে হয় আলো জ্বালালেই সে ঠাম্মাকে দেখতে পাবে।

আজ কিন্তু এই জঙ্গলে তার ভয় করছে না। একটা ভালোলাগা তাকে গ্রাস করছে ক্রমশ। এই গাছেদের সঙ্গে তার আরো অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করল। যে কথাগুলো এত বছর ধরে বুকের মধ্যে জমে ছিল আজ যেন মনের মতো সঙ্গী পেয়ে সেগুলোই সে বলে উঠল ।

আমি কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে গল্প করতে চাই, আশা করি আপনি বিরক্ত হবেন না। যদি খারাপ লাগে ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ। একটু থেমে আবার বলল, বুঝতে পেরেছি আপনি বলতে চাইছেন আমি কী করে আপনার কথা বুঝব? সে চিন্তা করবেন না। আপনার ডালপালাগুলো জোরে নাড়িয়ে দিলেই আমি বুঝে যাব আপনি কী বলতে চাইছেন!

মুহূর্ত খানেক বিরতির পর, এবার তাহলে প্রথমেই বলুন, এই নির্জন জঙ্গলে আপনি কিভাবে এলেন? কোনো পাখি কি সুদূর কোনো প্রান্ত থেকে মুখে করে আপনাকে নিয়ে এসেছিল? নাকি কোনো মানুষ? গুঁড়ি আর শিকড় দেখে মনে হচ্ছে আপনি দুশো বছর ছাড়িয়ে গেছেন। এতদিন নিরুপদ্রপে এখানে রয়েছেন দেখে অবাক হচ্ছি। এখনো কোনো চোরকারবারির কুড়ুল আপনাকে নগ্ন করে দেয়নি দেখে ভালো লাগছে। নিজেকে কিভাবে রক্ষা করছেন আপনি ?

প্রশ্ন করতে করতে সে আরো সামনের দিকে এগিয়ে এল। হঠাৎ তার ইচ্ছে হল বটের ঝুরিগুলো ধরে ঝুলতে। ছোটোবেলায় একবার তারা গ্রামে গেছিল। দেখেছিল বাচ্চারা এগুলো ধরে দোল খাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে। কিন্তু মা’ বারণ করায় চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। আজ তার সেই শখ পূরণের সাধ জাগল। সে ঝুরি ধরা মাত্র কেউ যেন বলে উঠল , সাবধানে।

গাছটা বলল ? না না ,এতো মানুষের মত গলা । চারপাশ তাকাল সে। তার মনে হল ঝুরিগুলো একসঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরেছে, তার দমবন্ধ হয়ে আসছে, সে আর নিজেকে ছাড়াতে পারছে না।

কম্পিত স্বরে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে সে বলে উঠল , কেউ আছেন? সেই স্বর তার নিজের কানেও পৌঁছল না।

না,আমার আর বাড়ি ফেরা হবে না।এখানেই আমার মৃত্যু নিশ্চিত।কেউ জানতেও পারবে না।বাবা কি টের পেয়েছে সে ঘরে নেই! ক’টা বাজে এখন? ক’টার সময় তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে? সে চারদিক তাকাল।

হাত দুই দূরে কি কিছু নড়ে উঠল? কোনো বুনো জন্তু নাকি দস্যু ! চন্দনদস্যু ? না । এখানে কোনো চন্দন গাছ নেই। তাহলে? সে আরেকবার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করল।

কেউ আছেন? ওখানে কে ?

জায়গাটা আবার নড়ে উঠল।একটা ছায়া মুর্তি। ভূত? শাওন মাথা ঘুরে পড়ে যাবার আগে টের পেল দুটো শক্ত হাত তাকে ধরে নিল।

বেশ খানিকক্ষণ বাদে তার সম্বিৎ ফিরল। সে এখন একটা লোকের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে। তাড়াতাড়ি উঠে বসার চেষ্টা করতেই লোকটি বলল , ভয় পাবেন না। ধীরে ধীরে উঠুন। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না।

মুহূর্তখানেক বাদে উঠে বসে লোকটির মুখ দেখার চেষ্টা করল। অল্প আলোয় মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। আবছা ভাবে মনে হল তার থেকে সামান্যই বড়ো।এবার সে পোশাকের দিকে দেখল। জিন্স আর একটা ফতুয়া। ছেলেটার গায়ের চাদরটাই সম্ভবত এখন তার গায়ে জড়ানো। রঙটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

শাওনের সাহস এবার ফিরে আসছে। সে জিজ্ঞেস করল , আপনার নাম ?

আমি পিয়াল।

পিয়াল আবার কারোর নাম হয় নাকি! সে তো গাছের নাম।

কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।

সে এবার ধমকের সুরে প্রশ্ন করল , আপনি এখানে কী করছিলেন ?

বসে ছিলাম।

এটা কি বসে থাকার জায়গা?কে পাঠিয়েছে আপনাকে? আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করছিলেন ।

একসঙ্গে এত প্রশ্নের মুখে পড়ে পিয়াল নিরুত্তর থাকাই ভালো মনে করল ।

কী হলো বলুন? ঈষৎ গম্ভীর এবার শাওন।

আমি ছবি তুলি। এবার পিয়ালের কণ্ঠস্বর সাবলীল ।

এই সময় আপনি ছবি তুলতে এসেছেন? আপনার ক্যামেরা কোথায় ? দেখি –

এখন নেই। সূর্যাস্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । কিছুটা আনমনেই বলল, এখান থেকে আকাশটা দারুন লাগে।

তাই? তা কোথায় থাকা হয় আপনার?

আপাতত পাশের গ্রামে।

আপাতত কেন ? স্থায়ীভাবে কোথায় থাকেন?

ওন্টারিও, কানাডা। একটু হেসে বলল , বিশ্বাস হলো না? আসলে ফটোগ্রাফারদের কোনো স্থায়ী বাসস্থান , দেশ বাড়ি হওয়া ঠিক না ম্যাডাম।

কথাটার ঠিক মানে না বুঝে শাওন পিয়ালের মুখের দিকে তাকাল ,তারপর গম্ভীরতার মুখোশ পরে নিল। এই ছেলেটির কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? এখনো পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি না করলেও এটা নিশ্চিত সে লুকিয়ে তার উপর নজর রাখছিল। সে ধমকের সুরে বলল ,আপনি একটি বিপজ্জনক মানুষ। মুহূর্তের জন্য দারুণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। আমার হার্ট ফেল করতে পারত আর একটু হলেই। তখন তার দায় কে নিত?

পিয়ালের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু থেমে আবার বলল , কিন্তু আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। কারণ আপনি আমাকে শেষ মুহূর্তে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

পিয়াল কোনো উত্তর না দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গীতে একটা ঝুরিতে হাত বোলাতে লাগল। যেন খুব কাছের কোনো মানুষকে আদর করছে ,এমন প্রশান্তি তার মুখে।

সেদিকে লক্ষ্য করে শাওন বলল , দয়া করে আমাকে বাংলোয় পৌঁছে দেবেন? এখন আর পথ চিনে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। বাংলোটা চেনেন?

এখানে একটাই বাংলো ম্যাডাম। সেটাতে আপনারা থাকার জন্য অন্যদের নিশ্চিত বুকিংও ক্যান্সেল করা হয়েছে । নিস্পৃহ ভঙ্গীতে পিয়াল বলল।

শাওনের মনে হলো পিয়ালের কণ্ঠস্বরে খানিক ব্যঙ্গ লুকিয়ে। পিয়াল এখানেই থাকতে চেয়েছিল? ওর বুকিং কি ক্যান্সেল হয়েছে, এইসব ভাবতে ভাবতে সে জিজ্ঞেস করল , আপনি জানেন আমি কে ?

হুঁ। জানি। মাননীয় মন্ত্রীর বড়ো মেয়ে।

ও। শাওন চুপ করে গেল।একে আর ধমক দিয়ে কথা বলা ঠিক না।একে তো রাস্তা চিনে ফেরার সমস্যা ,তার ওপর যদি বাবা জেনে যান কাউকে না বলে সে একা জঙ্গলে এসেছে তবে তার বকুনি থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। সে এবার বিনীত স্বরে বলল , ভেবেছিলাম একা ঠিক ফিরে যেতে পারব। কিন্তু সবই যে একরকম লাগবে বুঝিনি।

একটু ন্যাকা সুরে বলল, প্লিজ আমার ওপর রাগ করবেন না।

পিয়ালের হাত তখনো গাছের উপরেই ।

সেদিকে তাকিয়ে শাওন বলল, আমরা কি এবার যেতে পারি ? এবার বাড়ির লোক খুব চিন্তা করবে। এতক্ষণে নির্ঘাত খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে।

চিন্তা করবেন না। এখন সবে বিকেল। যদিও শীতের দিনে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। চলুন – বলে পিয়াল গাছের উপর আরেকবার পরম মমতায় হাত রাখল, যেন এটাকে ছেড়ে যেতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে এমন ভাবে হাত বোলালো, তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

শাওন সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে তার পিছনে হাঁটতে শুরু করল। পিয়াল ধীরে সুস্থেই হাঁটছিল ঝোপঝাড় ভেঙে। তার দৃষ্টি সামনে। ইচ্ছে করেই যেন তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছিল। শাওন সেই ঘন নির্জনতা ভঙ্গ করার জন্য বলল, আপনি কি আমাদের সব কথা শুনেছেন ?

আমাদের মানে?

ওই যে বটের সঙ্গে…

আমাদের বলছেন কেন? ওদিক থেকে তো কোনো উত্তর আসেনি।আপনিএকাই বকবক করছিলেন ।

সে তো গাছের দোষ। সে উত্তর দেয়নি।

ভুল ধারনা। ঠিকঠাক প্রশ্ন করলে ওরাও উত্তর দেয়।

আপনি প্রমাণ দেখাতে পারবেন? বলেই শাওনর মনে হলো পিয়াল কি ইচ্ছে করেই তাকে আর একদিন এখানে টেনে আনতে চাইছে! পিয়াল গাছটাকে অদ্ভুত ভাবে স্পর্শ করছিল। কি অনুভব করছিল সে এত নিবিড় ভাবে! তার খুব জানতে ইচ্ছে করল। সরাসরি জিজ্ঞেস না করে তাই একটু ঘুরিয়ে বলল , আপনিও তাহলে কথা বলেন ওদের সঙ্গে। তাই আপনার অবাক লাগেনি,তাই না?

অবাক? না। তবে হঠাৎ আপনাকে একা একা কথা বলতে দেখলে আশ্চর্য হতাম হয়ত । কিন্তু আমি আপনাকে দূর থেকেই দেখেছিলাম আসতে ।

আমাকে একা আসতে দেখেও অবাক হলেন না, একা দেখেও অবাক হলেন না?

না।

কেন?

আমি যদি একা আসতে পারি, আপনিও পারেন। এই বনে তো আর কারোর নাম লেখা নেই। তাছাড়া আপনাকে আগেও দেখেছি একা একা ঘুরতে।

পিয়াল নির্লিপ্ত ভাবে বললেও শাওনের মনে হলো পিয়াল তাকে বিদ্রুপ করেই কথাটা বলল। সে খানিক চুপ থেকে বলল , আপনি আমাকে ফলো করেন নাকি?

দেখুন, মন্ত্রীর মেয়ে না হয়ে যদি অন্য কোনো সুন্দরী হতো হয়তো তাকাতাম। কিন্তু… পিয়াল হেসে ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, রেগে যাবেন না, মজা করছিলাম। আপনি যথেষ্ট সুন্দরী। তবে এই ছোট্ট অঞ্চলে বাইরে থেকে একজন মানুষও নতুন এলে সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখে পড়ে। সেখানে আপনারা হলেন ভি আই পি, না চাইলেও নজর পড়ে যায়। শুধু আমারই ভাববেন না, সকলেই জানে ।
শাওনের হাসি পেল তার বলার ভঙ্গীতে। না , ছেলেটার মধ্যে একটা সহজ সরল স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে। সে প্রসঙ্গ ঘোরাল।

আপনার আসল বাড়ি কোথায়?

অধমের বাড়ি পাশের গ্রামেই।পড়াশোনার জন্য কানাডা। তারপর থেকে সেখানেই।

আপনি কি নিয়ে পড়ছেন ? ফটোগ্রাফি নিয়েই?

পড়ছি না আর। বাবার ইচ্ছায় লেজার বিম নিয়ে গবেষনা। তারপর ওখানেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো। ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়িনি। ওটা আমার প্যাশন। সময় পেলেই ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ি ,ইচ্ছে মত ছবি তুলি। তবে এখন ভাবছি অনেক হল, এবার পড়ানো ছেড়ে ছবি নিয়েই কাজ করব ।

শাওন বিস্মিত হলো ! আশ্চর্য মানুষ তো! অধ্যাপনা ছেড়ে ছবি তুলবে? এদেশে কেউ ভাববেই না এমন কথা। পরমুহূর্তেই মনে হল আদৌ সত্যি বলছে নাকি! মন্ত্রীকন্যাকে এসব বলে প্রভাবিত করার চেষ্টা! অবশ্য একে খুব খারাপও লাগছে না। বরং এর সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছে। সে এবার জিজ্ঞেস করল ,

আপনি আমার নাম জানতে চাইলেন না?

ব্যক্তিগতভাবে জানার ইচ্ছে না থাকলেও জেনে গেছি। আপনার নাম শাওন।

এই গ্রামের সকলেই আমাদের নাম জানে নাকি ! কৌতুহলী মন নিয়ে শাওন এবার বলল , আর কী জানেন?

এই সবাই যা জানে , আপনারা দুই বোন শাওন আর সাঁঝবাতি ।

আর ?

আর কী?

মানে আমরা কী করি ,তাও নিশ্চয়ই সকলে জানেন।

সবাই আর কী জানে সেটা বলতে পারব না,তবে এর থেকে বেশি আমি অন্তত জানি না।পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে গেল পিয়াল। শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল ।

হাসিটার মধ্যে এমন এক সহজ সরল ভাব ছিল যে শাওনের এতক্ষণ ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা নানা সংশয় মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। সেও হাসল।

তারা এখন জঙ্গল আর মেঠো পথ ছেড়ে পিচ বাঁধানো রাস্তায়। আর হারাবার ভয় নেই। সোজা এই পথ বাংলোতে গিয়েই মিশেছে। কাছাকাছি এসে শাওন পিয়ালকে বলল , চলুন- ভিতরে গিয়ে চা খেয়ে আসবেন। বাবা নির্ঘাত খুব বকবেন। বলা যায় না আপনাকেও বকে দিতে পারেন। রেগে গেলে বাবার কোনো জ্ঞান থাকে না। তখন চেনা অচেনা কাউকেই রেয়াৎ করেন না। আমার অবশ্য খারাপ লাগবে আপনার সামনে বকুনি খেতে।

পিয়াল খুবই নির্লিপ্ত ভাবে জানালো , ধন্যবাদ, আমন্ত্রণের জন্য। কিন্তু আজ আমার তাড়া আছে। বলেই উল্টোদিক ফিরে ফেলে আসা পথের দিকেই হাঁটতে লাগল ।

সেদিকে তাকিয়ে বিস্মিত স্বরে শাওন বলল , আবার ওদিকে যাচ্ছেন কেন?

ঘাড় ঘুরিয়ে সে বলল, সূর্যাস্ত দেখা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল যে ,

সূর্যাস্ত কি এতই সুন্দর ?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পিয়াল যেন খানিকটা আপন মনেই বলল, সূর্যের লাল কনে দেখা আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে গেলে চাঁদ ধীরে ধীরে উঁকি দেয়। আজ আবার পূর্নিমা। চাঁদের আলোয় গাছগুলো আলোকিত হবে।ওদের নিঃশ্বাস গাঢ় হবে , পৃথিবীর সঙ্গে মাটির আর আকাশের প্রেম বাড়বে। আমি তার সাক্ষী হতে চাই।

কি যা –তা বলছেন!

সূর্যাস্ত আর পূর্নিমার আলোয় শিহরণ জাগে পাতায় পাতায়। সেটা দেখার মজাই আলাদা।এই নেশাটায় পাগল আমি। অন্য কোনো কিছুই এর মতো টানে না আমায়। ইচ্ছে করলে আপনিও যেতে পারেন।

আমি এতক্ষণ ধরে সূর্য চাঁদ দেখব বলে জঙ্গলে থাকব? পাগল নাকি?

পাগল তো আমরা সবাই। বেশি আর কম ।

শাওনের এবার রাগ হল। কী স্পর্ধা এর! সে গম্ভীর গলায় কর্কশ স্বরে বলল , এগিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।কিন্তু আপনার সঙ্গে আকাশ দেখার প্রস্তাব মেনে নেবার মত বোকা আমি নই।এই প্রস্তাব দেওয়ার জন্য আপনাকে আমি এক্ষুনি পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি।কিন্তু এই অবধি আমায় পৌঁছে দিয়েছেন,তাই …এবার আপনি আসুন। বলে কোনো উত্তরের প্রত্যাশা না করে গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল।সিঁড়ির সামনে এসে পিছন ফিরল। সে দেখল পিয়াল আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেল জঙ্গলের পথে ।

দুই.

বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক বিরক্তি আর একই সঙ্গে একটা বিষন্নতা কিম্বা চিনচিনে অজানা অনুভূতি নিয়ে শাওন ভেতরে ঢুকল।তার বাবা একদা বিখ্যাত আইনজীবী ,এখন মন্ত্রী দেবপ্রকাশ উপাধ্যায়। ঈষৎ ভুড়ি,নাদুসনুদুস চেহারা,মাঝারি উচ্চতার মন্ত্রীমশাইয়ের মাথার চুল মিলিটারি  ছাঁচে কাটা।দেখলে মনে হয় ফাঁকা জমিতে সদ্য গজানো ধানের চারা।গায়ের রঙ ফর্সার দিকেই। গলার স্বরে বেশ দাপট ।এই মুহূর্তে তিনি বেশ খোশমেজাজেই গল্প করছেন সামনে বসে থাকা স্তাবক ও দর্শন প্রার্থীদের সঙ্গে।এদের মধ্যে মন্ত্রকের ইউনিয়নের স্থানীয় নেতা রঘুবীরকে সে চিনতে পারল সহজেই।তিনি প্রায় নিয়মিতই কলকাতায় আসেন, থেকেও যান দিনের পর দিন।সঙ্গে নিয়ে আসেন আরো জনা দশেক লোক। তারাও ইউনিয়নের কাছের লোক। বাড়ির একতলাটা পুরোটাই মন্ত্রীর লোকজনের জন্য উন্মুক্ত।তাদের তদারকির জন্য একজন আছে। তার নাম মূলো। ছোটবেলায় সে একবার তাকে প্রশ্ন করে জেনেছিল তার এই অদ্ভুত নামের কারণ। তার দাঁতগুলো খুব উঁচু বলে লোকেরা তাকে মূলো বলে খেপাত। শেষ অবধি এই নামটাই রয়ে গেল। আসল নাম গোপীনাথ , সেটা সম্ভবত তার এখন নিজেরও মনে পড়ে না।

বাবার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী এই মূলোদা। এই মুহূর্তে সে মাটিতে বসে কিছু একটা দেখছে। রঘুবীর দাঁত বের করে হাসছে। মাঝে মাঝে হাত কচলে ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলছে – তা তো বটেই, তা তো বটেই।

স্থানীয় ওসি একধারে দাঁড়িয়ে। তিনিও ফিকফিক করে হাসছেন। সিকিউরিটি ইনচার্জ বাবার পাশে। তার চোখও এখন মাটির দিকেই।আরো বেশ কিছু লুঙ্গি আর চাদর জড়ানো লোক মাটিতেই বসে হাত জোড় করে ।

দেখতে দেখতে শাওন ভাবল এদের পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে যাবে।কিন্তু কী যেন ভেবে সেখানে দাঁড়ানো মাত্র গেটের সামনে পাহারারত কনস্টেবল এগিয়ে এসে তাকে স্যালুট করল। আগে তার অস্বস্তি হতো। এরা স্যালুট করলে প্রত্যুত্তরে তার কি করা উচিত! নমস্কার জানাবে নাকি সেদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে যাবে এইসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরত। এখন সে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে সামান্য হাসল , সেই দেখে বিহ্বল খাকী পোশাকের ছেলেটিও বিগলিতভাবে হাসল।

শাওন ভেবেছিল সবাই উৎকন্ঠিত থাকবে তার জন্য। আরো ভেবেছিল, তার খোঁজে এতক্ষণে বাবা চারদিকে লোক পাঠিয়ে দেবেন। মা দুশ্চিন্তায় ঘর বার করবে। আর বাবা চিৎকার করে সবাইকে বকবে। কিন্তু না, সেরকম কিছুই চোখে পড়ছে না। সবাই নিশ্চিন্তে কিছু নিয়ে মগ্ন।

যাক বাবা! এদের সামনে বকা খেতে হল না। ভেবে পা বাড়ানো মাত্র দেবপ্রকাশ তাকে দেখতে পেয়ে উঁচু গলায় কাছে ডাকল।এদিকে আয় মা, দেখ রঘুবীর কী নিয়ে এসেছে!

সামনে এগোনো মাত্র বসে থাকা মানুষগুলো ওর দিকে তাকিয়ে নমস্কার জানালো। কী করা উচিত ভেবে না পেয়ে সে মিষ্টি করে হাসল । আর তখনি লক্ষ্য করল দেবপ্রকাশের পায়ের কাছে একটা বড় কচ্ছপ ।

এটা এখানে কী করে এল? তার মুখের কথা কেড়ে নিল রঘুবীর।

নিজে থেকে কী এসেছে! ধরে এনেছি। আজ ভোরে চরে পাওয়া গেছে। জোয়ারে সমুদ্রের জল নদীতে ঢুকে পড়ে। তখনি এসেছে।ভাটায় আর ফিরতে পারেনি।তাই সাহেবের জন্য নিয়ে এলাম। বিগলিতভাবে হেসে রঘুবীর হাত কচলাচ্ছিল।

বাবা বুঝি কচ্ছপ পুষবে ?

না, না আসলে কচ্ছপের মাংস খেতে দারুণ।তাই সাহেবকে রেঁধে খাওয়াবার আগে একবার দেখিয়ে নিলাম।

দেবপ্রকাশের মুখের হাসি বলে দিচ্ছিল সেও কচ্ছপ পেয়ে খুশি।

আজকাল তো এতবড় কচ্ছপ দেখাই যায় না। ছোটো বেলায় কয়েক বার খেয়েছিলাম। খুব সুস্বাদু ।

 দেবপ্রকাশ কচ্ছপটার দিকে তাকিয়েছিলেন। খোলসের ভেতর গুটিয়ে থাকা আদপে নিরীহ একটা জীব, অথচ পুরাণে বলছে সমস্ত পৃথিবী যখন প্রলয়ের পর জলমগ্ন তখন এই কচ্ছপের পিঠে চেপেই প্রাণীকুল বেঁচে গেছিল। তার ছোটোবেলার একটা কথা মনে পড়ল।এক বন্ধু গঙ্গার তীরে পাওয়া কচ্ছপটাকে বাড়ি এনে বিশাল গামলার মধ্যে রেখেছিল জল দিয়ে।একদিন সে আর আরেক বন্ধু লাঠি দিয়ে কচ্ছপকে খোঁচাচ্ছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে সহ্য করার পর কচ্ছপ হঠাৎ মুখ খুলল , মুহূর্তের মধ্যেই বন্ধুর আর্ত চিৎকারে তারা দেখল হাতটা মুখের মধ্যে চেপে ধরা , সেখান থেকে রক্তের স্রোত বইছে। অনেক কষ্টে হাত বার করা গেলেও সে হাত সারতে বহু দিন লেগেছিল।

সেই বন্ধুর মা বলেছিল ,বসুন্ধরা যার পিঠে আশ্রয় নিয়েছে তাকে তোমরা জ্বালাতন করেছ । আমার কপাল ভাল।তাই শুধু সুবলের হাতটাই গেছে। যদি তিনি রেগে যেতেন সত্যিকরে তবে পুরো পৃথিবী ওলোট পালোট হয়ে যেত ।

তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে রঘু বলল, এই তো শাওন মেমসাহেব এসে গেছে। তোমার জন্য সেহেব চিন্তা করছিলেন।

রঘুর কথা শুনে বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শাওনের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হাসল দেবপ্রকাশ। নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল , কোথায় গেছিলি মা কাউকে না জানিয়ে? এভাবে একা যাওয়া ঠিক নয়। দিনকাল ভালো নয় , বলেই সামলে নিলেন নিজেকে। আসলে আমাদের শত্রুর তো অভাব নেই চারপাশে। তাই একটু সাবধানে, যদিও এখানে সবাই আমাদেরই লোক। সামনে বসে থাকা লোকগুলোর চোখের দিকে তার চোখ।

লোকগুলো সমস্বরে বলে উঠল , কোনো চিন্তা নেই সাহেব, এখানে সবাই আপনার গোলাম।

প্রশস্ত হাসি টেনে দেবপ্রকাশ বলল , গোলাম আবার কী? বলো সহযোদ্ধা।এই সরকার মানুষের সরকার ,আমি তোমাদের কথা বলার জন্যই এই চেয়ারে।নইলে তোমাদের সঙ্গে আমার কোনো ফারাক নেই।

শাওন বাবার দিকে তাকিয়েছিল। বাবা যেভাবে কথাগুলো বলছে তাতে তার মনে হচ্ছিল বাবা কি প্রকৃতই এভাবেই ভাবে ? নাকি সবটাই অভিনয়!

দেবপ্রকাশ মেয়েকে আরো কাছে টেনে নিল।কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল , ভেতরে যা মা। একটা সারপ্রাইজ আছে।

কী বাবা ? আজ পুরো দিনটাই অবাক হবার দিন। জঙ্গলে পিয়াল ,এখানে কচ্ছপ আর ভেতরে নতুন কি? শাওন ভাবছিল।

বলতো কী হতে পারে? দেবপ্রকাশের চোখে প্রশ্ন।

বুঝতে পারছি না। শাওনের চোখ এখন কচ্ছপের দিকে। বাবা তুমি কি এটাকে মেরে ফেলতে দেবে? এর মাংস খাবে তুমি?

না মা। আগে হলে হয়তো ভাবতাম। কিন্তু এখন শত্রুর অভাব নেই।তার ওপর মিডিয়া ,সারাক্ষণ আমাদের ত্রুটি ধরার জন্য ছোঁক ছোঁক করছে। হয়তো বলা যায় না এতক্ষণে খবরও হয়ে গেছে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ নিধন করা হচ্ছে উন্নয়নের নামে, তাই দিয়েই জঙ্গলে ভোজন সারছেন মন্ত্রী …। চোখ ছোটো করে সামনে  তাকালেন । এখন তো আমি স্বাধীন নই।পাবলিক ফিগার। বুঝিস-ই তো সব।

সত্যি কি বুঝি? কতটুকুই বা বুঝি! যাক! এটা নিশ্চিত,কচ্ছপটা এই মুহূর্তে প্রাণে মরছে না। সেদিকে তাকিয়েই সে বলল, বাবা, এটাকে ফুলী নদীতে ছেড়ে আসতে বলো। আর মূলোকে সঙ্গে পাঠিও। নইলে বলা যায় না…

দেবপ্রকাশ মেয়ের দিকে তারিফের দৃষ্টিতে তাকালেন। হাসলেন। এবার ভেতরে যা। রাহুল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে।

রাহুল? এখানে? শাওনের বুকের মধ্যে হঠাৎ যেন জলতরঙ্গ বেজে উঠল। নিঃশ্বাস দ্রুত হলো। তার ছুট্টে ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করল। নিজেকে সংযত করে নিল তখনই। মাটির দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল , তুমি মজা করছ ,তাই না বাবা ?

  না রে মা। সত্যি এসেছে। আমি এদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। দেখি রাহুল। ভাবলাম ভুল দেখছি। সামনে এলে দেখলাম ভুল না,সত্যি সে-ই। বেচারা তোকে ছেড়ে থাকতে পারছে না,এখানেও তাই হাজির। ভাবছি সামনের মাঘেই তোদের এক করে দেব।

ফাইন্যালটা হোক বাবা। তার আগে কিছু কোরো না। হঠাৎই দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল শাওন।

সে দেখা যাবে। পরীক্ষাও হবে, রেজাল্টও ভালোই হবে। আমি তো আছি। তার কথার ধরণ দেখে শাওনের মনে হল , সে নয়, পরীক্ষা আসলে অন্য কেউ দেবে, আর তার ভালো রেজাল্ট কেউ আটকাতে পারবে না।

কথা না বাড়িয়ে সে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোলো।

মা তোর মাকে বল তো , একটু কড়া করে চা দিতে। গলাটা শুকিয়ে গেছে।

বলছি বাবা।

দোতলায় উঠে রাহুল কোন ঘরে থাকতে পারে ভাবল।পরমুহূর্তেই আগে মার কাছেই যাই ভেবে রান্নাঘরের দিকেই পা বাড়াল।

তিন.

গেস্টহাউসের রান্নাঘরটা খুব বড়ো না হলেও একেবারে ছোটোও নয়। শাল্মী এসে থেকে প্রায় সর্বক্ষণই হয় রান্নাঘরে রাঁধতে ব্যস্ত, নয়তো নিজের ঘরে শুয়ে। তাকে দেখলে মনে হবে এর আগে এই রান্নাঘরে আর কেউ রাঁধেনি। প্রথমদিনই তিনি নিজের রান্নার জন্য যা যা প্রয়োজন সব আনিয়ে নিয়েছেন।আগের কোনো বাসন ব্যবহারে তার প্রবল অনীহা। গেস্ট হাউসের রাঁধুনি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেই রান্নার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন।

 রাঁধুনি ছেলেটির নাম গোপাল।  প্রথমে সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছিল খোদ মন্ত্রীর স্ত্রী রান্নাঘরে এসে রান্না করবেন শুনে। তার এতদিনের কর্মজীবনে এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। এর আগে যত বিখ্যাত মানুষ এসেছেন এখানে থাকার জন্য তাঁদের থেকেও তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ঝামেলায়, বায়নাক্কায় প্রায়ই নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে তাকে।

আগে তো সে এত রকম যে রান্না হয়, এত কিছুর বড়া হতে পারে , তাই জানত না। ছোটো থেকে সে কেবল দেখেছে মা ডাল ভিজিয়ে শিলে বেটে বড়া বানান। সেই বড়ার নাম যে পকোড়া তাও তার অজানা ছিল। এখন সে জেনে গেছে বড়া শুধু ডালের হয় না। চিকেন, মটন ,মাছ … সবেরই বড়া বানাতে এখন ওস্তাদ সে। শুধু কি তাই! চীনে রেসিপিতে চাউমিং কিংবা ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেনের পাশাপাশি নানা স্বাদের স্যুপও জল-ভাত তার হাতের জাদুতে।

অবশ্য তার মধ্যেই সুযোগ পেলে সে চেষ্টা করে ঘরোয়া রান্না যেমন ঝিঙে- আলু পোস্ত, বিউলির ডাল, বড়ি দিয়ে সুক্ত, মাছের ঝোল, আলু-পটল দিয়ে চিংড়ি রাঁধতে। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে চেষ্টা করে সেরকম মানুষ এলে মোচা , থোড়, পলতা পাতার বড়া, ধনেপাতার চাটনি দিয়ে তাদের খুশি করতে। পার্টি খুশি হলে যাবার আগে ভালো বকশিস। যদিও এসব রান্নার সুযোগ বছরে একবার দু’বারই আসে। অধিকাংশ মানুষই সেই গড়পড়তা ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। বড়োজোর কষা করে খাসির বা মুরগীর মাংসের ঝোল আর দেরাদুন চালের ভাতেই আটকে।

এত বছরে সে এও জেনে গেছে শহর থেকে আসা মানুষের জলখাবারেও কোনো নতুনত্ব নেই। লুচি তরকারি, আলুর পরোটা, ধোসা, পাউরুটি জ্যাম জেলি মাখন, ডিমের পোচ ,অমলেট অথবা দুটো পাউরুটির ভিতর মাখন দিয়ে শশা, চিজ, চিকেন বা যাহোক দিয়ে স্যান্ডউইচ আর তার সঙ্গে এখন আবার নতুন যোগ হয়েছে দুধ আর ভুট্টার খই, তাকে আবার বলে কর্নফ্লেক্স।প্রথম প্রথম তার নিজের বেশ মজা লাগত এসব বানাতে, কারণ আজন্ম পান্তা ভাত , চিড়ে , মুড়ি, খই এর বাদেও যে এত খাবার ভাতের আগে খাওয়া যায় তাই তার কাছে অজানা ছিল। এখন আর এসব তাকে টানে না। এর থেকে রুটি বা মুড়ি অনেক ভালো।

কিন্তু এবার সে বুঝে উঠতেই পারছে না এই নতুন মেমসাহেব রান্নাঘরে এসে কি রাঁধবেন আর কেনই বা রাঁধবেন! কর্তার কানে এই খবর গেলে তার চাকরি চলে যাবে কিনা সেটাও তার বোঝার অগম্য। প্রথম দিন সে চেষ্টা করেছিল মেমসাহেবকে রান্নাঘর থেকে সরাতে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা বিফল করে স্বয়ং মন্ত্রী তাকে আশ্বাস দিয়েছেন ,এতে ভয় পাবার কিছু নেই। মেমসাহেব নিজের হাতে রান্না করতে এবং খাওয়াতে ভালবাসেন। যেখানেই যান এই কাজটি তিনি নিজেই করেন। তাতে সাময়িক স্বস্তি বোধ করলেও রান্নাঘরেই মেমসাহেবের আশেপাশেই সারাদিন থাকছে সে। আর একটি জিনিসও গোপাল এই কদিনে দেখেছে। মেমসাহেব আর সবার মতো ম্যাডাম বা মেমসাহেব বলা পছন্দ করেন না। নিজে থেকেই বৌদি বলে ডাকতে বলেছেন। আর তাঁর মেয়েদের দিদি।

গোপাল এখন শাল্মীকে নটে শাকের চচ্চড়ি কিভাবে বানাতে হয় শেখাচ্ছিল। আর মনোযোগ দিয়ে সে তা শিখে নেবার চেষ্টা করেছিল। শাওন রান্না ঘরে ঢুকে দেখল মা গ্যাসের একটা ওভেনে একটা কিছু খুন্তি দিয়ে নেড়ে চলেছেন আর গোপাল কিছু একটা বোঝাচ্ছে। মুক্তো বাঁদিকের এক কোণে দাঁড়িয়ে সেই কথাই শুনছে।সে পিছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল শাল্মীকে।

দিলি তো বাইরে থেকে এসে ছুঁয়ে। দেখছিস রান্না করছি।

শাওন আগে বুঝে উঠতে পারত না মা কী করে বুঝে যায় সে-ই জড়িয়ে ধরেছে ! মাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করে জেনেছে সন্তানের গায়ের গন্ধ, নিঃশ্বাসের শব্দ, এমনকি তার পায়ের আওয়াজও নাকি মায়েরা দূর থেকে বুঝতে পারেন। একেই নাকি বলে নাড়ির টান। সে আরো কিছুক্ষণ এভাবেই জড়িয়ে থাকল শাল্মীকে।

আরে ছাড়। শিগগিরি ছাড় বলছি। শাল্মী মেয়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার কপট চেষ্টা করল। তারপর বলল, কী চাই শুনি? হঠাৎ এত খুশি কেন?

মায়ের কাছে কোনো কিছুই গোপন থাকে না, ভাবতে ভাবতে পিছন থেকেই শাওন বলল , কী রাঁধছ ?

নটে শাক। কি বলতে এসেছিলি সেটা চট করে বলে ফেল।

শাল্মীকে ছেড়ে শাওন বলল, বাবা চা চাইছেন।

দিন রাত শুধু চা আর চা। এদিকে পেটে কিছু নেই। এই নিয়ে সকাল থেকে দশ কাপ হল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল,  আর খেতে হবে না। বল গিয়ে তাঁকে এবার দয়া করে ভিতরে এসে ওষুধ খেতে। সকালের রান্না শেষ হয়ে রাতের রান্নাও প্রায় শেষ।আর তার চা পর্বই এখনো শেষ হল না।

মা, রাগছ কেন? চা-ই তো চেয়েছে। আচ্ছা তুমি যাও, আমি করে নিচ্ছি। গোপালদা বা মুক্তোও তো বানিয়ে দিতে পারে। একটা ওভেন তো ফাঁকাই আছে।

হ্যাঁ, এবার সেটাই বাকি আছে! এক কাপ  চা বানাতে গিয়ে তিনি পুরো রান্না ঘর জলে ভাসাবেন। সারা গ্রামের লোক সে চা পান করে কৃতার্থ হবে। আর মুক্তো -তুই এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তখন থেকে বলছি, দেখ রাহুলের কিছু লাগবে কিনা?

শাওন জানে শাল্মী রান্নার সময় খুব দরকার না থাকলে কারোর থাকা পছন্দ করেন না। এই সময়টুকু যেন তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন সারা জগৎসংসার থেকে। নিজের মনেই রেঁধে যান একের পর এক পদ। অথচ বাবা বা তারা দুই বোন যে খেতে খুব ভালবাসে বা খাবারের কোনো ঝামেলা আছে তাদের-এমন নয়। যা হোক একটা হলেই হল। পেট ভরানোটাই আসল। কিন্তু মা এই বিষয়ে ভীষণ পরিপাটি।

শাওন দেখল মুক্তো না গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

মুক্তো যখন তাদের বাড়ি এসেছিল তখন মুক্তোর বয়স খুব বেশি হলে বারো। সে তখন আট। আর সাঁঝবাতি চার। শাওনের এখনো মনে আছে, সেবার আয়লা হয়েছিল। সুন্দরবন থেকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বৌ কোলে কাঁখে হাত ধরে বাচ্চা নিয়ে তাদের বাড়ি  আসছিল ভিক্ষে করতে। মা তখন অন্নপূর্ণারর মতো সবার জন্য তাঁর ভান্ডার খুলে দিয়েছিল। ঠাম্মা বলেছিল, বৌমা হলো সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। দুখী মানুষের জন্য তার মন কাঁদে। ঠাম্মার মুখে সে শুনেছিল, বিয়ের পর শিব পার্বতী  সুখে শান্তিতে বসবাস করলেও বেকার দরিদ্র শিবের আর্থিক অনটনের জেরে কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। তখন শিব ভিক্ষা বৃত্তি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন।কিন্তু কোথাও ভিক্ষে পেলেন না।শেষে দেবীই তাকে অন্ন প্রদান করে অন্নপূর্ণা হন। কিন্তু কেন তাঁর মা শাল্মী অন্নপূর্ণা বা লক্ষ্মী সেই প্রশ্ন মাথায় এলেও ঠাম্মার থেকে তা জানা হয়নি।

 মুক্তো একাই ভিক্ষে করতে এসেছিল। শাল্মী তাকে দেখে বলেছিল, তোর আর দোরে দোরে ঘুরে ভিক্ষে করার দরকার নেই। এখানেই থেকে যা।

মুক্তো কোনো কথা না বলে তখন চলে গেছিল। ভিক্ষেটাও নেরনি। পরদিন সকালে আবার এসেছিল।সঙ্গে এক মহিলা। চারদিকে তাপ্পী দেওয়া শাড়ি , চুল তুলে বাঁধা। শাওন দূর থেকে দেখেছিল তাদের। সেই মহিলা নিজেকে মুক্তোর মা বলেছিল। মাটিতে বসে পড়ে সে বলছিল, আপনি একে রাখবেন বলেছেন মা? সত্যি যদি রাখেন তবে মেয়ে আমার বেঁচে যাবে। গ্রামের বাড়ি ঘর জমি সব গেছে। বহু মেয়ে নিখোঁজ। মেয়ের আমার এত রূপ! পোড়া কপাল আমাদের। এমন গরীব ঘরে যে ভগবান কেন এমন মেয়ে দিলেন! আগলে রাখাই মুশকিল। আপনি যদি রাখেন টেপি আমার সব দিক থেকেই বেঁচে যাবে।

টেপির দিকে তাকিয়ে শাল্মী বলেছিল , এত সুন্দর মেয়ের নাম টেপি কেন? মেয়েকে এখানে রাখব। কিন্তু শর্ত আছে। টেপির মার থেকে কোনো জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন আসার আগেই শাল্মী বলেছিল, মেয়েকে এখান থেকে যখন তখন এসে নিয়ে যেতে পারবে না। আর যে কেউ এসে এর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। শুধু তুমি মাসে একবার আসতে পারো।আর কেউ আসবে না। ভেবে দেখ আজ। রাজি থাকলে দিয়ে যেও।

ভেবে দেখার আর সুযোগ নেয়নি টেপির মা। সেদিন সেই মুহূর্তেই শাল্মীকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তার টেপিকে রেখে চলে গেছিল। শাওন দেখেছিল তার চোখে জল। কিন্তু সে আর কোনোদিন আসেনি মেয়েকে দেখতে।

অনেকদিন বাদে এক ভোরে টেপি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমার মা মরে গেছে।

তুই কী করে জানলি? সাঁঝবাতির প্রশ্নের জবাবে সে বলেছিল, সে ঘুমের মধ্যে দেখেছে তার মা ট্রেনে কাটা পড়েছে, টেপি টেপি বলে ডাকছে।

শাল্মী খোঁজ নিয়ে জেনেছিল সত্যি সেদিন ভোরে এক ভিখারি লাইন পার হতে গিয়ে …।

টেপি অবশ্য ততদিনে তাদের বাড়িতে শাল্মীর দেওয়া মুক্তো নামে পরিচিত। মুক্তো শাল্মীকে বড় মা ডাকে। ঘরের সব কাজকর্মের তদারকির সঙ্গে সঙ্গে সে দেবপ্রকাশের লোকেদেরও আপ্যায়ন করে। পড়াশোনাও শিখেছে কাজ চালিয়ে নেবার মত। বাড়ির সর্বত্র তার অবাধ বিচরণ। শুধু রান্নাঘরে মুক্তো রান্না করে না। হাতে হাতে শাল্মীকে যোগান দেয়।

মুক্তো আঠেরো হলে তার বিয়েও দিয়েছেন শাল্মী। দেবীপ্রসাদের খোদ ড্রাইভার বাপির সঙ্গে। এতে সুবিধাই হয়েছে। বিয়ের পরেও মুক্তো এই বাড়িতেই রয়ে গেছে। এখনো তার বাচ্চা না হওয়ায় শাল্মী যেখানেই যান সঙ্গে নিয়ে যান মুক্তোকে।

মুক্তোর দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিল শাওন।

শাল্মী আবার মুক্তকে তাড়া দিলেন রাহুলের খোঁজ নেবার জন্য।

ফ্ল্যাশব্যাক ছেড়ে শাওন সেই শব্দে ফিরে এল বর্তমানে। মা চা দেবে না?

বললাম তো না। বাবাকে ডাক। এবার খেয়ে নিক হাত মুখ ধুয়ে। আর শোন, রাহুলের সঙ্গে দেখা করেছিস?

না মা। এই তো বাইরে থেকে এসে তোমার কাছেই আগে এলাম।

ও। জানিস আজ সকাল থেকেই মন বলছিল রাহুল আসবে। তোর বাবাকেও বলেছিলাম।

নির্ঘাত রাহুল তোমায় ফোন করেছিল। বলেই মনে পড়ল মা মোবাইল ব্যবহার করে না। হেসে বলল, মা- তুমি দিন দিন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হয়ে উঠছ।

শাল্মী মেয়ের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। কি যেন ভাবল। তারপর বলল, তুই এখন যা।

 আমি কিন্তু বাবাকে বলেছি চা নিয়ে আসছি। আমি বা মুক্তো বানিয়ে নিই না মা।

না ,এখন চা নয়। সারাদিন চা খেয়ে খেয়ে ক্ষিধে বোধটাই চলে গেছে লোকটার। এর পর পেটে ঘা হবে। শাল্মী গজগজ করতে লাগল।

মা যে কোনো অবস্থাতেই আর চা করে বা করতে দেবে না শাওন বুঝেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল আরো কিছুক্ষণ।

ঠাম্মা একবার বলেছিল, মেয়েরা হলো দ্রৌপদীর উত্তরসূরী। বুঝলে দিদিভাই, অর্জুন তো পরীক্ষায় পাশ করে মালা পরালো দ্রৌপদীর গলায়। তারপর আনন্দ করে নিয়ে এল কুন্তীর কাছে বৌ দেখাতে। কুন্তী না দেখেই কুটিরের ভিতর থেকে বললেন, যা এনেছ তা পাঁচ ভাইয়ে ভাগ করে নাও। এখন মায়ের আদেশ তো ফেলা যায় না।তাই পাঁচ ভাই-ই বিয়ে করল তাঁকে। কিন্তু আসলে সে তো অর্জুনের স্ত্রী। যখন সে যুধিষ্টিরের কাছে বউ হয়ে গেল তখন তিনি তাঁকে একসঙ্গে থাকাকালীন রাতগুলোতে ধর্মশিক্ষা নীতিশিক্ষা দিলেন। আর ভীমের কাছে যখন গেলেন তখন ভীম তাঁকে দিলেন রান্নার শিক্ষা। আসলে ভীম নিজেই তো খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন। বিরাটপর্বে অজ্ঞাতবাসের সময় তিনি তো রাঁধুনি সেজেই আত্মগোপন করে ছিলেন। এই ভীম যে তাঁর যাবতীয় অর্জিত জ্ঞান তাঁর বৌকেই শেখাবেন তা তো স্বাভাবিক- তাই না দিদুভাই! সেই জন্যই দ্রৌপদী হলেন পৃথিবীর সেরা পাচক। ওই যে তোদের ভাষায় ইন্টারন্যাশানাল শেফ্‌।

শাওনের এখন শাল্মীকে দেখে সেই কথাটা মনে পড়ল। তাঁর মা নির্ঘাৎ দ্রৌপদীর একদম কাছের উত্তরসূরী। বহু ডালপালা নেই তাতে। সে শাল্মীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সে বলতে চাইল , মা, চায়ে প্রচুর ক্যালরী থাকে। কেউ যদি সারাদিন অন্য কিছু না খেয়ে শুধু চা-ই খায় তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রাহুলের খোঁজে গেল।

চলবে…

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ