মাটি জলমাখা জীবন (পর্ব- ২)

বিতস্তা ঘোষাল
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
মাটি জলমাখা জীবন (পর্ব- ২)

আগের পর্ব পড়ুন এখানে…

চার.

গেস্ট হাউসের শেষপ্রান্তে পুব দিকের ঘরটা আপাতত সাঁঝবাতির দখলে। সাঁঝবাতি ন্যাশানাল ল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। একটা শর্তেই সে সকলের সঙ্গে এখানে এসেছে ছুটি কাটাতে যে তাকে নিজের ইচ্ছে মতো থাকতে দিতে হবে। কোনো কিছুতে জোর করা চলবে না। অথচ দীর্ঘ আট মাস পরে বাড়ি এসেছে বলেই তাদের এক সঙ্গে ঘুরতে আসা।

সাঁঝবাতির এই ঘরটার জানলায় দাঁড়ালে নদী দেখা যায়। নদীর পিছনে সবুজ জঙ্গল। ভোরের প্রথম সূর্য সেই জঙ্গল ভেদ করে এসে পড়ে ঘরে। সেই আলোকরশ্মির দিকে সাঁঝবাতি মুগ্ধ হয়ে যায়। তার মনে হয় এই পৃথিবীকে কেউ একজন এত নিখুঁত অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন। কোথাও সবুজ, কোথাও নীল, কোথাও ধূসর… যেখানে যেমন দরকার সেখানে ঠিক ততটা দিয়েই সাজানো। প্রাচুর্যের সঙ্গে ভালবাসা জড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে। কোনো জটিলতা নেই, সব কেমন মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ। অথচ মানুষের মন কত জটিল! মানুষ কেন যে এই রূপ রস শব্দ গন্ধ অনুভব না করে ইন্দ্রিয়ের দরজাগুলো বন্ধ রাখে- আর চাওয়া- পাওয়ার হিসেব করে! তার তো ইচ্ছে করে প্রকৃতির কোলে মিশে যেতে।

শাওন রাহুলকে একতলা দোতলার কোনো ঘরেই না পেয়ে সবশেষে সাঁঝবাতির ঘরে এল। এসে প্রথমেই জানলার সামনে দাঁড়াল। দূরে গাছগুলো ক্রমশ কালো হয়ে উঠছে। আর ঘন্টা খানেক বাদেই গভীর অন্ধকারে ডুবে যাবে। তখনি একটা গোটা চাঁদ তার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের পাহারা দেবে। চাঁদের কথা মনে আসতেই তার পিয়ালের কথা মনে পড়ল। জ্যোৎস্না রাতে যে শিহরণ জাগে তার তুলনায় সব নেশাই নগণ্য , মানেহীন লাগে।

একটা শ্বাস ফেলে সে বোনের দিকে তাকালো। সাঁঝবাতি আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। সে শুধু পাঠ্য বই- ই আনেনি, তার সঙ্গে নিজের পছন্দের একগাদা বই নিয়ে এসেছে। এই ঘরটা যেন এখন অস্থায়ী লাইব্রেরী। তার আনাচে- কানাচে শুধু বই।

সাঁঝবাতির গায়ে একটা নীল রঙের ভারী পুলওভার। সেদিকে তাকিয়ে শাওন জিজ্ঞেস করল, তোর কী খুব শীত করছে?

হ্যাঁ। খুব। জ্বর এসেছে বোধহয়।

বোধহয় মানেটা কি? চোখ তো দেখছি লাল। বোনের কপালে উৎকন্ঠা নিয়ে হাত রাখল সে।

তুই বাইরে থেকে বুঝতে পারবি না দিদি। ভেতরে ভেতরে প্রবল জ্বর এসেছে। আমি অনুভব করছি। চোখ কান নাক দিয়ে গরম হাওয়া বেরচ্ছে।

ওষুধ খেয়েছিস? মা কে ডাকব?

না না, দরকার নেই।একটু আগেই স্নান করে এলাম। ঠিক হয়ে যাবে।

শাওন তবু অস্থির হয়ে খাটের ডানদিকে রাখা টেবিলটার জিনিসপত্রগুলো ঘাঁটতে লাগল। সেদিকে লক্ষ্য করে সাঁঝবাতি বলল, দিদি এত উতলা হবার কিছু নেই। এই টেবিলে নিশ্চয়ই আমার জ্বর হবে ভেবে কেউ ওষুধ রেখে যাবে না। এইটুকু উষ্ণতা আমি সহ্য করতে অভ্যস্ত। তারপর হাসল। আমি এখন কোথায় থাকি জানিস তো? যোধপুর। গরমে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শীতে মাইনাস। বলে শব্দ করে হেসে উঠল সে।

শাওনও হেসে উঠল। কি পড়ছিলি রে এত মনোযোগ দিয়ে?

হাতের বইটা উলটো করে বিছানায় রেখে সাঁঝবাতি বলল, মহেঞ্জোদরো দ্য আনটোল্ড স্টোরি।

কি বিষয় নিয়ে? মহেঞ্জোদরো তো ভারতের প্রথম প্রাচীন সভ্যতা। সেটার আবার না বলা ঘটনা কিছু আছে নাকি?

দিদি এই জন্যই বলি, পাঠ্য বইয়ের বাইরে একটু পড়। মহেঞ্জোদরো মানে কি শুধুই মৃতের স্তূপ? আর খালি কিছু বাসনপত্র, মূর্তি আর স্নানাগার? একটা আস্ত সভ্যতা কি শুধু এই কটা বিষয় নিয়েই গড়ে উঠেছিল? কেমন ছিল সেখানকার বাসিন্দারা? কিভাবে তারা প্রেম করত , কিভাবে তারা সেখানে বসতি স্থাপন করল, তাদের প্রত্যেক দিনের দিনলিপি কি ছিল সবই তো অজানা এখনো তাই- না?

কিন্তু সেখানে তো মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা ছিল, কাজেই নারী যাকে পছন্দ করত তার সঙ্গেই নিশ্চয় প্রেম করত।

উফঃ দিদি! মাতৃতান্ত্রিক সমাজ মানেই যে সব কিছু নারীর ইচ্ছায় চলবে তার কোনো যুক্তি আছে কি? নারী হচ্ছে একটা প্রতীক। ধ্বংসাবশেষ থেকে মাথায় মুকুট পরা এক নারীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। তাই ধরে নেওয়া হয়েছে রানীর মাথায় মুকুট। অর্থাৎ এই সভ্যতা মাতৃকেন্দ্রিক। কিন্তু তার অর্থ কি সেটাই?

শাওনের এখন এসব শুনতে ভালো লাগছিল না। সে থামিয়ে দিয়ে বলল, বুঝেছি। তুই নিজের পড়া ছেড়ে এখন এসব পড়ছিস। তা পড়। আমার এসব না জানলেও চলবে। তবে মনে রাখিস তুই যেখানে পড়তে গেছিস সেখানে পাশ করা খুব কঠিন। আশা করি সেটা তুই ভুলে যাসনি।

আমার পড়া নিয়ে আমাকেই ভাবতে দে দিদি। তোর কথা শেষ হলে তুই এবার আয়।বেশ ইন্টারেস্টিং জায়গায় আছি এখন। বেশি বকবক করলে পড়ার মুডটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

ও। ঠিক আছে। বলে চলে যেতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে গেল শাওন। একটু ভেবে আলতো স্বরে ‘বোন’ বলে চুপ করে গেল।

সে কী বলতে চাইছে সেটা যেন সাঁঝবাতি বুঝে গেল। রাহুলের খোঁজ করছিস তো? এতক্ষণ এটা সেটা না বলে সরাসরি সেটা জানতে চাইলেই তো হতো। সে যে এখানে নেই সেটা দেখতেই পাচ্ছিস নিশ্চয়ই।

আমি কি সেটা বলেছি? আমি জানতে চাইলাম তুই কি দুপুর থেকেই এখানে ?

অলমোস্ট। একবার শুধু উঠেছিলাম। বাবা মুক্তোকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন কচ্ছপ দেখার জন্য। বাপিদা বলে কিনা আজ নাকি কচ্ছপের মাংস খাওয়া হবে! বেচারা নিরীহ এক প্রাচীন জীব। ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার। সেই সত্যযুগ থেকে তিনি বিরাজমান। উপরের অংশ মানুষের আর নিচের অংশ কচ্ছপের রূপ নিয়ে তিনি মহাপ্রলয়ের পর সাগরের নিচে ঘুমন্ত অবস্থায় থেকে যান। আবার সমুদ্র মন্থনের সময় তাঁর পিঠে মন্দার পর্বত স্থাপন করে মন্থনের কাজ সম্পন্ন হয়। ভাব দিদি, অথচ এই জীব ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। আর সেই কচ্ছপ মেরে বলে কিনা মাংস রাঁধবে! মানুষের মতো নৃশংস জীব আর হয় না, বুঝলি দিদি। যত দেখি, ভাবি- অবাক হই।

শাওন কোনো উত্তর না দিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে সে এমন সব কথা বলে যার মানে বুঝে উঠতে পারে না। তার মনে হলো এই তো সেদিন জন্মালো বোন। হাসপাতালে বেবি কটে উঁকি মেরে দেখছিল সে। ছোট্ট ফরসা, পুরো মাখনের মতো নরম একটা বাচ্চা। চোখও খুলতে পারছিল না। খালি মাঝে মাঝে হাই তুলছিল। তারই বা বয়স তখন কত! মাত্র তিন। অথচ নিজেকে কত বড়ো মনে হচ্ছিল ওই পুচকেটার তুলনায়। আর আজ সে কিনা এত কিছু তাকে বোঝাচ্ছে।

বোন কি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, জটিল হয়ে উঠছে? একবছর হলো বাইরে পড়তে গেছে। তবে কি নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সে হঠাৎই বাইরের পৃথিবীর মানুষদের কদর্য রূপগুলো দেখতে পাচ্ছে নাকি পরিবেশ তাকে বাধ্য করছে মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী পালটাতে!

বোন যে এ- বিষয়ে কিছুই বলবে না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তাই আর কথা বাড়ালো না। শুধু একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল।

সাঁঝবাতি সেদিকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, বেকার কথায় সময় নষ্ট করছিস। রাহুল নদীতে স্নান করতে গেছে। এদিকের বারান্দা দিয়ে নদী তীরে চলে যা। দেখতে পাবি।

সাঁঝবাতির এই রাহুল বলে ডাকাটা শাওনের একেবারেই পছন্দ নয়। অনেকবার বলা সত্ত্বেও সাঁঝবাতি একই অভ্যাস বজায় রেখেছে। সে নাকি বাইরের কাউকে দাদা বলে ডাকতে পারবে না। তা রাহুল দুদিন পর তোর জামাইবাবু হবে, সে কি বাইরের হল! এতটুকু সম্মান তো দেওয়াই উচিত। কিন্তু শুনলে তো! আর রাহুলও তেমনি। তার নাকি বেশ ভাল লাগে এই রাহুল ডাকটা। আন্তরিক মনে হয়। আদিখ্যেতা দেখে মাথা গরম হয়ে যায়।

নিজের মনেই বিড়বিড় করল শাওন। কী করবে ভেবে না পেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। তারপর নদীর দিকে যাওয়াই স্থির করে বারান্দা ধরে হাঁটতে লাগল।

বারান্দা শেষ হয়ে কতগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে পাথর বিছানো রাস্তা ধরে কয়েক পা হাঁটলেই নদী। শাওন বারান্দা থেকেই দেখতে পেয়েছে রাহুল টাওয়েল দিয়ে গা মুছতে মুছতে ঠান্ডায় কাঁপছে। সে ইচ্ছে করেই হাঁটার গতি কমিয়ে দিল।

গেস্ট হাউসের দারোয়ান বাঁ হাতে এমার্জেন্সি লাইট নিয়ে দু’পা দূরে দাঁড়িয়ে। তার আরেক হাতে রাহুলের প্যান্ট আর গেঞ্জি। শাওন আড়চোখে দেখে নিল লাল রঙের গেঞ্জি। এটাই সে এবারে রাহুলের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল।

গা মোছা শেষ হলে রাহুল শাওনকে দেখতে পেল। দেখেই একগাল হাসল-  নদীর জল যে এত ঠান্ডা তা বুঝতে পারিনি।

নদীর জল এমন ঠান্ডাই হয়। আর এখন তো শীত। বাথরুমে তো গিজার ছিল। সেখানেই করতে পারতে।

আরে আমি তো তাই ভেবেছিলাম।এতটা জার্নি করে এসে ক্লান্ত লাগছিল। সাঁঝবাতিকে বললাম, স্নান করে নিলে ভাল হতো। সে বলল, নদীর জলে ডুব দিয়ে এস। নিমেষে ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।

বোনের সঙ্গে রাহুলের দেখা হয়েছিল? অদ্ভুত তো! আমায় কিছু বলল না তো! নিজের মনে বিড়বিড় করল শাওন। রাহুলের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, ও। সে নিজেও ঠান্ডা জলে স্নান করে জ্বর বাঁধিয়েছে। এবার তুমিও বাঁধাও।

আরে না না, কিছু হবে না। সত্যি বলতে কি কথাটা কিন্তু সাঁঝবাতি ঠিকই বলেছে। প্রথমে ঠান্ডা লাগছিল, কিন্তু এখন বেশ আরাম লাগছে। কথা বলতে বলতেই জামা-প্যান্ট পরে নিল সে। শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল। তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়া অবধি শান্তি লাগছিল না।

শাওন উচ্ছ্বাস চেপে রেখে বলল, তাই? তা হঠাৎ চলে এলে যে বড়ো?

তুমি না থাকলে পুরো শহর ফাঁকা লাগে। কাছে এগিয়ে এসে গাঢ় স্বরে বলল, তোমার আনন্দ হচ্ছে না আমায় দেখে?

শাওনের ইচ্ছে হলো বলতে- খুশিতে মনে হচ্ছে চিৎকার করে গান গাই। দু’হাত তুলে নাচি। কিন্তু সে এসব কিছুই না বলে অদ্ভুতভাবে হাসল।

সেদিকে তাকিয়ে রাহুল বলল, জানো কত কী ম্যানেজ করে এখানে আসতে হয়েছে! রাত অবধি মনে হচ্ছিল আর আসতে পারব না। শেষ অবধি জেদ চেপে গেল। ভাবলাম, যা হবার হোক, আমি যাবই।

শাওন লাজুক ভঙ্গীতে হাসল- এবার ঘরে চলো। ঠান্ডা ভালই আছে। বলা মাত্রই রাহুলের হাঁচি শুরু হল। আর তখনি ঝুপ করে সূর্যটা নদীর মধ্যে ডুবে গেল।

 

পাঁচ.

শাল্মী চা আর পকোড়া বানিয়ে ডাইনিং রুমে শাওনদের অপেক্ষায় বসেছিল। এখানে এসে থেকে সে দেখছে সন্ধ্যের মুখে রোজ লোডশেডিং হচ্ছে। জেনারেটর না চলায় এমার্জেন্সি লাইটই ভরসা। ডাইনিং টেবিলটা গোল এবং বেশ বড়। স্নান করে রাহুল খানিকক্ষণ এদিক ওদিক পায়চারি সেরে যখন সেখানে পৌঁছল তখন সকলেই সেখানে বসে নিজেদের মতো গল্পে মত্ত। সে সাঁঝবাতির পাশের ফাঁকা চেয়ারটা বেশ শব্দ করে টেনে নিয়ে বসল।

সেদিকে লক্ষ্য করে সাঁঝবাতি পকোড়া খেতে খেতে প্রশ্ন করল, তারপর মিস্টার সাইমন, আমরা কি স্বরাজ লাভ করতে পারি?

রাহুল বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে রইল। শাওনও বোনের এমন কথার কোনো মানে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।

কেবল দেবপ্রকাশ হো হো করে হেসে উঠল। আমি কিন্তু আগেই ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু পারফেক্ট ফ্রিডমের অপেক্ষা।

শাল্মী তাদের দিকে বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। কি যে বলো তার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যায় না। তা তোমাদের এখানে কি রোজই লোডশেডিং চলে?

এটা আমার দপ্তরের আওতায় নয়। তাই আমার জানার কথা নয়। এটা বিদ্যুৎ দপ্তরের কাজ।

সাঁঝবাতি পাশ থেকে বলে উঠল, ইলেক্ট্রিসিটি স্টোর করা ভালো। সৌরবিদ্যুৎ এখন সবচেয়ে উপকারী ও দূষণমুক্ত আলো। অবশ্য উন্নয়নের সঙ্গে আলোর কী সম্পর্ক সেটা কি তোমার দপ্তর জানবে বাবা?

মা, অত জেনে লাভ কি? তুমি কি জানতে চাও তা বলো। জেনে দিচ্ছি এখনই।

বেশ তবে মাননীয় মন্ত্রী, আপনি আমাকে জানান এই নদীর গভীরতা কত? এখানকার জঙ্গলে কতগুলো শাল আর সেগুন গাছ  আছে ?

দেবপ্রকাশ মুলোর দিকে তাকিয়ে সচিবকে ফোনে ধরতে বললেন।

তোরা পারিসও বটে! শাওন পকোড়া খাওয়ায় মন দিল।

রাহুল খানিকক্ষণ চা খাবার পর হঠাৎ বলে উঠল, কিন্তু ডোমিনিয়ন আর পারফেক্ট ফ্রিডম বোঝা গেল না।

সাঁঝবাতি গম্ভীরভাবে বলল,  রাহুল, তুমি শেষ কবে ইতিহাস বই পড়েছ?

মানে? হিস্ট্রি কেন পড়ব?

কিছু না। তুমি বোধহয় খুব ক্লান্ত। রেস্ট নাও। বলে সাঁঝবাতি চা পানে মনোনিবেশ করল।

রাহুল বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে, হ্যাঁ , ঠিক বলেছ, ঘুম আসছে, শীতও করছে খুব।

শাল্মী সেই কথা শুনে বলল, মুক্তো তাড়াতাড়ি রাহুলকে ঘরটা দেখিয়ে দে। এতটা জার্নি করে এসেছো। যাও গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নাও।

হ্যাঁ যাই, বলে রাহুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দুই বোনের দিকেই তাকিয়ে স্মার্ট হাসি হাসার চেষ্টা করল। অসফল হয়ে তার জন্য নির্ধারিত ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

শাওন সেদিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করল হঠাৎ রাহুলের কী হলো ! বেশ তো বসে চা পকোড়া খাচ্ছিল। কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্তি নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে চায়ের কাপ হাতে টেনে নিয়ে চুমুক দিতে শুরু করল।

রঘু একটা বুড়ো মতো লোককে নিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকল। পরণে তার ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি। সেটার অবস্থাও তথৈবচ। সেদিকে একবার তাকিয়ে দেবপ্রকাশ মুলোকে তাড়া দিলেন।

লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। পরে দেখছি আবার।ওয়্যারলেসে দেখব একবার?

দেবপ্রকাশ উত্তর দেবার আগেও সাঁঝবাতি বলে উঠল, হ্যাঁ, তাই নাও।আমার জানাটা জরুরী।

এটা জানা এমন কি জরুরী বুঝতে না পেরে দেবপ্রকাশ রঘুর দিকে মনোনিবেশ করলেন।

সাহেব কচ্ছপটা নিয়ে কী করব?

মন্ত্রী অবাক হবার ভান করলেন। কিছু যেন ভাবলেন চোখ বন্ধ করে।ওটাকে নদীতে ছেড়ে দিয়ে এস। জোয়ারে ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।

রঘু যেন পৃথিবীর সেরা আশ্চর্যের কথা শুনছে এমন ভাবে বলল, সেকী সাহেব? কী হল?

 ওর গন্তব্য সমুদ্র। আমাদের উদর নয়। সেই একই চোখ বোজা ভঙ্গী। দার্শনিকসুলভ স্বর দেবপ্রকাশের কন্ঠে।

শাওন বাবার কথায় স্বস্তি পেয়ে শাল্মীর দিকে তাকালো। মা গায়ে চাদর দাও নি কেন? তোমার তো একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়।

এক্ষুনি ঘরে চলে যাব। স্নান সেরে সন্ধ্যা দিতে হবে।

শাল্মীর কথা কানে যাওয়া মাত্র দেবপ্রকাশ চোখ খুললেন। তুমি ভীষন শুচিবাই হয়ে যাচ্ছ।এই সন্ধ্যায় স্নানের কী দরকার! একটু আগেই তো করলে। কতবার সন্ধ্যা দেবে? লোডশেডিং এ গিজারও চলবে না। একে ঠান্ডা জল তাতে আবার শীতকাল। তুমি তো দেখছি এভাবে কঠিন অসুখ বাঁধাবে!

আমি মরলে তোমার আরো সুবিধা। বলেই উঠে গেল শাল্মী।

শালা মর গে যা। যেখানে যাবে একটা না একটা অশান্তি, আপদ। নিজের বুঝে নিজে চল। বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করে নিল দেবপ্রকাশ। মেয়েদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রঘুর দিকে তাকালো।

সাহেব তা হলে…

বললাম তো ওটাকে নদীতে দিয়ে এস। মুলো যা ওদের সঙ্গে। আর হ্যাঁ , লুঙ্গি পরা লোকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওকে কিছু টাকা দিয়ে দিস। একটা চাদর অন্তত কিনুক। নইলে আমাদের সরকারের বদনাম। বিরোধীরা তো এমনিতেই বলে, এই সরকার গরীবদের পাশ থেকে সরে গেছে।

দেবপ্রকাশের কন্ঠে রূক্ষতা অনুভব করে মুলো তৎক্ষণাৎ লোকটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।রঘু কী করবে বুঝতে না পেরে একটু দাঁড়িয়ে তাদের পিছু নিতে যাওয়া মাত্র সাঁঝবাতি ডাকল।

রঘুদা, একবার আমার ঘরে আসবে? তোমার সঙ্গে একটু দরকার আছে।

রঘু সাহেবের এই ছোটোমেয়েটাকে এড়িয়ে চলাই পছন্দ করে। কখন যে কী বলবে তার কোনো ঠিক নেই। একবার বলেছিল, রঘুদা আমি তোমায় ভূত দেখাব। আরো বলেছিল, সে নাকি ভূতের সঙ্গে কথা বলে! সাহেবের বাড়িতে থাকাকালীন রঘু একবার অদ্ভুত খোনা গলা শুনেছিল। সেই থেকে এ মেয়েকে সে এড়িয়েই চলে। এখন সন্দেহের চোখে বলল, এখানে বলা যাবে না?

বলা গেলে নিশ্চয়ই বলতাম। গম্ভীরভাবে বলে সাঁঝবাতি নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল।

রঘু সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল তার কী করা উচিত। এই মেয়ে সাহেবকেও মাঝে মাঝে নাকানি চোবানি খাওয়ায়। না গেলে হয়তো তার বিরুদ্ধে এমন কিছু বলে দেবে সাহেবকে যে তখন সবকিছু হ-য-ব-র-ল হয়ে যেতে পারে।

সে যাওয়াই স্থির করে সাঁঝবাতির পিছন পিছন হাঁটতে লাগল।

সাঁঝবাতি একটু এগিয়ে বারান্দার রেলিং এ ভর দিয়ে দাঁড়াল। রঘু হাঁটা থামিয়ে কাছে যাওয়া মাত্র সে বলল, রঘুদা আমার একটা উপকার করতে হবে।

তোমার উপকার? আমি কিভাবে করব? একই সঙ্গে ভয় আর কৌতুহল দুটোই খেলে গেল রঘুর চোখে। আবার কিসে ফাঁসব কে জানে! মনে মনে গোবিন্দকে স্মরণ করল রঘু।

তোমার দ্বারাই হবে। এমন কিছু কঠিন আর মহার্ঘ কাজ নয়। এত ভয় পাবার কিছু নেই। সাঁঝবাতি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল।

তবু রঘুর মনে দ্বিধা। বলো দেখি,

একটা জোরালো টর্চ।

ও , এই জিনিস! রঘু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পরমুহূর্তেই মনে হল সব ঘরেই এমার্জেন্সী লাইট আছে। তবে আবার টর্চ কেন? রাতবিরেতে একা একা ঘুরতে বেরবে না তো! সে ইতঃস্তত করে হাত চুলকিয়ে বলল, এখন টর্চ দিয়ে কী করবে? এখনি কারেন্ট এসে যাবে। আর … তার কথা শেষ হবার সুযোগ না দিয়েই সাঁঝবাতি বলল, টর্চই লাগবে,আর আজ রাতেই লাগবে।

রঘু জানে সাহেবের এই মেয়ে যা চাইবে তাই তাকে দিতে হবে, নইলেই বিপদ। তবু সে শেষ চেষ্টা করল। আমায় বিপদে ফেলো না বোন আমার। সাহেব যদি জানতে পারেন…

বাবা জানবে না। তোমার কোনো চিন্তা নেই। এখন যাও। দেরি কোরো না। আমার আজ রাতেই লাগবে।

সাঁঝবাতি আর কথা না বলে নদী দেখায় মন দিল। নদীর জলে চাঁদের আলো।জল চিকচিক করছে। এই মায়াবী রাতেই বোধহয় নিশি ডাকে, ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই গুনগুন করে উঠল সে।

রঘু কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কী করবে ভেবে না পেয়ে। তারপর ,যা কপালে আছে হবে, ভেবে সিঁড়ির দিকে হাঁটা লাগালো।

ছয়.

রাহুলের জন্য শাওনের ঘরটা বরাদ্দ হয়েছে। সে ডাইনিং রুম থেকে ফিরে এসে গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁপছে। সাঁঝবাতির কথা শুনে নদীতে স্নান করাটা ভুল হয়েছে। কিন্তু এর জন্য তার সাঁঝবাতির উপর এতটুকুও রাগ হচ্ছে না। বরং অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে। সে নিজের মনেই এর কারণটা বোঝার চেষ্টা করছে। অবশ্য মাঝে মাঝে কাঁপুনি হওয়ায় সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

তার মধ্যেই দেবপ্রকাশ একবার এসে দেখে গেলেন। জ্বর কতটা বোঝার জন্য গায়ে হাত দিয়ে উষ্ণতা দেখলেন। ডাক্তার ডাকবেন কিনা জানতে চাইলেন।

তাঁর অবস্থা দেখে রাহুল হেসে বলল, এখন কী ডাক্তার পাওয়া যাবে? গ্রামে তো সাতটা আটটা বাজলেই গভীর রাত হয়ে যায় শুনেছি। তাছাড়া জ্বর খুব বেশি নেই। খানিক বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করি।

সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে দেব বললেন, না, না নেগলেক্ট করা ঠিক নয়। তেমন হলে এখনি সদর হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আনাতে হবে গাড়ি পাঠিয়ে।

তাকে আশ্বস্ত করে রাহুল বলল, অযথা চিন্তা করছেন স্যার। তার কোনো দরকার পড়বে না। যদি বাড়াবাড়ি হয় তখন না হয় দেখা যাবে।

দেবপ্রকাশ শুকনো মুখে সেখান থেকে উঠে এসে নিজের ঘরে এলেন। শাল্মী তখন আবার গা ধুয়ে সন্ধ্যা দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে দেব বললেন, এখানে এসে ছেলেটা জ্বর বাঁধালো। মুখে বলছে বটে কিছু হয়নি, সেরে যাবে কিন্তু গায়ে তো ভালোই তাপ দেখলাম।

শাল্মী দ্রুত পুজো সারল। শাড়ি আর চাদর গায়ে জড়িয়ে নিজের ওষুধের ব্যাগটা নিয়ে রাহুলের ঘরে গেল।

রাহুল মুখ অবধি কম্বল টেনে শুয়ে।শাল্মী আলতো স্বরে ডাকা মাত্র রাহুল কম্বলের তলা থেকে মুখ বের করে বিষন্ন ভাবে হাসল।

কেমন বোধ করছ? বলে কপালে হাত দিল শাল্মী। তারপর সঙ্গে আনা ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে তার হাতে দিল।

খেয়ে নাও। দেখো জ্বর নেমে যাবে একটু বাদেই। বলে সাইড টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে গ্লাসে জল ঢেলে রাহুলকে দিল।

বেশি কষ্ট হলে ,আরো জ্বর বাড়লে আমাকে ডাকবে। আমি পাশের ঘরেই আছি। কোনো দ্বিধা করবে না। আমি সারারাত জেগেই থাকি।

রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, জেগে থাকো কেন? ঘুমোও না?

না। নতুন জায়গায় নতুন বিছানায় আমার ঘুম আসে না। সেইজন্য আমি খুব একটা নিজের জায়গা ছেড়ে বাইরে যেতে চাই না।কিন্তু আমার কথা কে শোনে! ঈষৎ ক্ষোভ তার স্বরে ।

রাহুল তা লক্ষ্য করল। এ নিয়ে ভেবো না কাকিমা।ক’দিন থাকলেই অভ্যাস হয়ে যাবে। বাড়িতে তো কোনো বিশ্রাম পাও না।ক’দিন এই সুযোগে রেস্ট নিয়ে নাও।

হুঁ। খুব ছোটো করে বলে শাল্মী হঠাৎ বলে উঠল, শোওয়ার আগে তুমি চা কফি কিছু খাও?

না, মানে…

বুঝেছি।খেলে বা ইচ্ছে হলে বলতে পারো।আমি এখন বানাবো। এই সময় একটু চা না খেলে আমার আবার মাথা ধরে যায়।

এত রাতে? সবাই তো শুয়ে পড়েছে।তুমি আবার…

আমি চা নিজের হাতে বানাতেই পছন্দ করি। আর রাতে শোবার আগে মাস্ট।ঠিক যেমন তোমরা সিগারেট বা … কথা শেষ না করে শাল্মী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সেদিকে তাকিয়ে ঠিক কি করা উচিত বুঝতে না পেরে একবার ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কম্বলটা মুখ অবধি টেনে নিল রাহুল।

খানিক বাদে চা নিয়ে ঘরে এল শাওন। রাহুল একটা পা আরেকটা পায়ের উপর তুলে নাচাতে নাচাতে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। পাশে একটা বই। যদিও দেখে মনে হচ্ছে না কোনোদিন এর কোনো এক পাতাও ওলটানো হয়েছে। তাও সেটা পাশেই রাখা। সে সদ্য জেনেছে ছুটি কাটাতে গেলে গল্প বা কবিতা, যাইহোক না কেন, কোনো একটা বই সঙ্গে নিতেই হয়। তাই তার পাশে বই রাখা।

সেদিকে একবার তাকিয়ে শাওন  ‘রাহুল’ বলে ডাকল।

রাহুল যেন ভাবনার রাজ্য পেরিয়ে নেমে এল। তারপর তাকে দেখে হাসল- একটু আগেও মনে হচ্ছিল মরে যাব।

 যতসব ভুলভাল কথা! সামান্য জ্বরে কেউ মরে না। বলে তার ডান হাতটা রাহুলের কপালে ছোঁয়াল- না এখন তো সেরকম জ্বর দেখছি না।

ছিল এতক্ষণ। তোমার হাতের স্পর্শে পালালো।

তাই? বলে লাজুক ভঙ্গীতে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো শাওন।

তুমি চাও না আমার কাছে থাকতে?

শাওন অন্যদিকেই চেয়ে থাকল। সে ভেবে পেল না এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে! আর ক’দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে। তারপর চিরদিনের মতো সে রাহুলের। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো কিছু না বলে চুপ করেই থাকল  সে।

শাওন।

হুঁ। বলো-

রেগে গেলে? আমি তো মন থেকেই বললাম।

রাগি নি ।

তাহলে কী ভাবছ? একটু চুপ থেকে রাহুল বলল, আমি তোমার সঙ্গে সবসময় মেপে বুঝে কথা বলার চেষ্টা করি। খালি মনে হয় এই বুঝি তুমি রেগে গেলে। খুব ভয়ে ভয়ে থাকি তোমাকে নিয়ে।

কিসের ভয় ?

মনে হয় তুমি যদি হঠাৎ আমায় না জানিয়ে চলে যাও, আর ফিরে না আসো…

সে কথার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বা বিরোধিতা না করে শাওন চায়ের কাপটা রাহুলের দিকে এগিয়ে দিল। ওঠো। খেয়ে নাও।জুড়িয়ে যাচ্ছে।

রাহুল কম্বলটা গা থেকে সরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। এক ঢোক খেয়ে বলল, এই যে তুমি এখানে চলে এলে, আমার জন্য তোমার মন খারাপ করেনি?

শাওন এবার রাহুলের চোখে চোখ রাখল।কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। মনে মনে বলল, হ্যাঁ, খুব মিস করছিলাম তোমায়। আমার সোনা। লাভ ইউ।

রাহুল তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীর কন্ঠে বলল, আমার কী মনে হচ্ছিল জানো? উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, শালিকের ডানায় ভর দিয়ে এক ফাগুন এসেছিল মায়াবী পাকদন্ডীর আড়ালে। কত পথ সেই আলো মাখা… দীর্ঘ প্রেমের পর এক সন্ধ্যায় হারালে তুমি। তখন থেকে অব্যবহৃত সরু গলির অবসাদ গায়ে মেখে মাটির কান্না, সৃষ্টির আকুতি।  কালো কালো মেঘ আর বিষণ্ণতা। কোথাও কোনো প্রেম নেই, নেই ভালবাসা…

শাওন কথা ভুলে রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাহুল কী করে এত ভালো বাক্য সাজিয়ে বলছে! সে কী কখনো কবিতা লিখত? এটা তার লেখা নাকি অন্য কারোর?

এটা তোমার লেখা?

দূর পাগলী! এটা তো…, বলেই কথা ঘুরিয়ে নিল। কেমন ঘোরা হচ্ছে তোমার? আসার সময় দেখলাম চারদিকে প্রচুর জঙ্গল। নিশ্চয়ই সাপ আছে। খুব সাবধান।

শীতে সাপ থাকে না মশাই। শব্দ করে হাসল শাওন। ঘোরা দারুণ হচ্ছে। মা রান্নাঘরে সারাদিন। বাবা পার্টির লোকেদের নিয়ে ব্যস্ত।বোন সারাদিন নিজের মতো।কখনো বই পড়ছে, কখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের মতো।

আর তুমি? তুমি কী করছ?

আমিও নিজের মতোই ঘুরছি।ঘরে বসে থেকে কী করব!

আমাকে না নিয়েই? তা বেশ।তবে তোমার একা ঘোরার সাহস হয়েছে দেখে ভালোই লাগছে। একা তো বেরতেই চাও না। আজ কোথায় গেছিলে? এসে তো দেখতে পেলাম না।

শাওন বুঝতে পারল না রাহুল তার একা ঘোরাটা পছন্দ করল কিনা! নাকি রেগে গেছে? তাই এভাবে বলছে! সে বিস্তারিত কিছু না বলে খালি বলল, জঙ্গলে গেছিলাম।একটু ভিতরে একটা বটগাছ আছে। অনেক পুরোনো। তারপর যেন নিজের মনেই বলল, ওখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার মজাটাই… চুপ করে গেল সে।

তুমি কি চাঁদ উঠতে দেখলে? আমি যখন স্নান করছিলাম চাঁদ তো তখন দেখা দিল।তার আগে … রাহুলের কথা শেষ না হতেই শাওন বলে উঠল- না না, তখনো চাঁদ ওঠেনি। তখনো তো অল্প আলো। আমি বলছিলাম, জঙ্গলে চাঁদের আলো পড়লে সুন্দর লাগে।

ইন্টারেস্টিং। ঠোঁট ওল্টালো রাহুল। কোনো কিছুতে অবাক লাগলে বা বিরক্ত হলে সে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানায়।

সে এইমুহূর্তে অবাক হলো, না বিরক্ত- সেটা শাওন বুঝতে পারল না। রাহুল আবার জিজ্ঞেস করল, আর কি দেখলে?

আর নাম না জানা কত গাছ, পাখি দেখলাম। খুব উৎসাহ নিয়ে বলল , কাল তোমায় নিয়ে যাব। যাবে?

খুব সংক্ষেপে হুঁ, বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করল রাহুল। তারপর এক্সকিউজ মি, বলে বিছানা ছেড়ে উঠে লাইটার হাতে নিল।

শাওন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, তুমি কবে থেকে সিগারেট খাচ্ছ? তোমার তো এর গন্ধই সহ্য হয় না।

আবারো শুধু একটা হুঁ, বলে সিগারেটটা ধরালো, আসলে কাজের এত চাপ… তাই…

শাওন ভ্রু কুঁচকালো। সেকী! তোমার তো ওই ছোট্ট অফিস।তাতেও দুজন এমপ্লয়ী। আর ব্যবসা নিয়ে তুমি খুব মাথা ঘামাও এটা আমার বিশ্বাস হলো না।

সেটা তোমার পার্সোনাল প্রবলেম, বলতে গিয়েও থেমে গেল রাহুল। তার বদলে বলল, সেক্রেটারীর কথা আর বোল না। সেদিন একটা চিঠি টাইপ করতে দিলাম। ড্রাফটিং আমিই করে দিয়েছি। তা বলে কিনা স্যার compensation এর বাংলা কী? আরে আমিই যদি জানব তো তোমাদের রেখে লাভ কী? শেষে একজনকে ফোন করে জানা হলো।

আজকাল কি তোমরা অফিসিয়াল চিঠি বাংলায় চিঠি লিখছ?

না মানে, এটা ঠিক অফিসিয়াল লেটার নয়।

ওঃ। এই নিয়ে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে শাওন বলল, দু-একটা খাচ্ছ, খাও। কিন্তু নেশা করে ফেল না। গন্ধটায় আমার কাশি হয়। আমি যাই। তুমি এখন শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে।

ওহ সরি। সিগারেটটা ফেলে দিল রাহুল। সত্যি বলতে কী আমারও কষ্ট হচ্ছিল টানতে, বলে বোকা বোকা হাসল। এখনি চলে যাবে? আর একটু থাকা যাবে না ?

না। দৃঢ় গলায় সে দাবি নাকচ করে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোলে সে।

একটা চুমু, শাওনের হাতটা ধরে নিজের দিকে টানল রাহুল।

কঠিন চোখে তার দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গুড নাইট বলে রাহুলের দরজাটা টেনে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল শাওন।

সেদিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় রাহুল বিড়বিড় করে বাই বলল। তার আবার কাঁপুনি শুরু হল।জ্বরটা বোধহয় আবার আসছে। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে।

সাত.

শাওন রাহুলের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার একধারে কাপটা নামিয়ে সাঁঝবাতির ঘরে ঢুকল।আজ রাতটা তার বোনের সঙ্গেই শুতে হবে। একদিকে ভালো আবার বহুদিনের অনভ্যাসে ঘুম আসবে কিনা কে জানে, এসব ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়না দিয়েই দেখতে পেল সাঁঝবাতি আড়চোখে একবার তাকে দেখে আবার বই পড়তে শুরু করে দিল। তার উপস্থিতিটা তার কাছে যে যথেষ্ট বিরক্তিকর সেটা আয়নায় পড়া প্রতিবিম্ব দেখে অনুভব করল শাওন। সেখান থেকেই সে জিজ্ঞেস করল, তুই কি চাস না আমি এ ঘরে রাতে থাকি?

কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বলল, কিরে ? কিছু বল।

বইয়ের পাতা থেকে মুখ না তুলে সে বিরক্ত নিয়েই বলল, যদি আমার উত্তর জানতে চাস তবে বলব, না চাই না। কিন্তু কিছু তো করার নেই। বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হবে।

তোর কি অসুবিধা হবে আমি থাকলে? রাতটুকুই তো শুধু।

বইটা এবার মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বালিশের পাশে রেখে সাঁঝবাতি বলল, অসুবিধা তো অনেক। আমি প্রায় সারারাত জেগে থাকি। বই পড়ি। আমার ইচ্ছে হলে চিৎকার করে আবৃত্তি  বা গান করি বা শুনি, আবার একা একা নাচও করি।অনেক রাত অবধি ঘরে আলো জ্বালানো থাকে। তোর এগুলো কোনোটাই ভালো লাগবে না। আর সেই জন্য আমি চাই না কারোর সঙ্গে রুম শেয়ার করতে।

বুঝলাম।কিন্তু এখন তো কিছু করার নেই। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। নইলে রাহুলকে ঘর থেকে বের করে দিতে হবে, কিংবা তার সঙ্গে শুতে হবে। বলে শাওন হেসে বিছানায় গিয়ে বসল। তার থেকে তুই বরং একা থাকার অভ্যাসটা বদলা। আর ক’দিনই বা! এর পর তো আরেকজনের পাশে শুতেই হবে। তখন দেখব… বলে হাই তুলে শুয়ে পড়ল সে।

দিদির দিকে একবার চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার পাশে রাখা বই হাতে তুলে নিল সাঁঝবাতি। সেদিকে লক্ষ্য করে শাওন বলল, আর এখন পড়তে হবে না। অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড় দেখি। কম্বলটা টেনে নিল গায়ে। একটাই দেখছি, অসুবিধা নেই নিশ্চয়ই।

সে কথার উত্তর না দিয়ে সাঁঝবাতি বলল, সবে সাড়ে বারোটা। এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসবে না। হস্টেলে অল মোস্ট সারা রাত জেগে থাকি।

আচ্ছা বেশ, তাহলে আয় দুজনে গল্প করি। শাওন প্রায় জোর করে বোনকে নিজের দিকে টেনে বেড সুইচ থেকে লাইটটা নিভিয়ে দিল। একটু ইতঃস্তত করে পাশবালিশ জড়িয়ে ধরার মতো দিদির গায়ে পা তুলে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল সে। তারপর বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে লাগল।

এত জোরে শ্বাস নিচ্ছিস কেন? শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ? ইনহেলার নিবি?

না না। ওসব কিছু হচ্ছে না। কত বছর পর তোর গায়ের গন্ধ পাচ্ছি রে দিদি। তাই প্রাণ ভরে নিয়ে নিচ্ছি।

তাই? একটু আগে যে বলছিলি, একা থাকতে ভালো লাগে।

সাঁঝবাতি আরো নিবিড়ভাবে জাপটে ধরে দিদির বুকের মধ্যে হাতটা ঢুকিয়ে দিল। ওই ছাড়। কী হচ্ছে কী? এভাবে ঘুমোনো যায় নাকি? গলায় প্রশ্রয়ের সুর।

যায় যায়। দু’দিন বাদে তো এভাবেই শুবি। আর এভাবেই তো আমি ছোটবেলায় তোর পাশে শুতাম।

দূর। লজ্জা মাখানো স্বরে শাওন বলল, তুই এখনো একই থাকবি? বড়ো হবি না?

কথাটা শুনে একটু যেন চুপ হয়ে গেল সাঁঝবাতি। গম্ভীর স্বরে বলল, বড়ো হওয়াটা বড্ড চাপের। তারপরেই আদুরে গলা- দিদি একটা গল্প বল।

গল্প? কিসের গল্প? আমি অত গল্প জানি না। আমি তোর মত এত বই পড়ি না।

উঁহু, জানি না, পড়ি না বললে হবে না। ছোটোবেলায় তুই কত গল্প বলতিস ঘুম পাড়াবার জন্য।ও রকম গল্প কেউ কোথাও বলে না।

ওগুলো গল্প ছিল নাকি? যা মনে আসত তাই বানিয়ে বানিয়ে বলতাম।এখন  আর সেসব মনে নেই। তারচেয়ে বরং তুই শোনা, আমি শুনি।

উঁহু , চালাকি করলে শুনছি না। শুনব না।মানছি না। আমার দাবী… বোনের বলার ভঙ্গীতে হেসে উঠল শাওন।

জানিস বোন, তুই একদিন স্কুল থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চিৎকার করছিলি ওদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। মা শুনে রেগে কাঁই। এ আবার কী কথা বলছে মেয়ে! ধমক খেয়ে তুই আমার কাছে দৌড়ে এলি। ঠোঁট ফুলিয়ে বললি, দিদি আমি নিজের থেকে বানিয়ে বানিয়ে বলিনি এসব। অনেকগুলো লোক পতাকা নিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলছিল। শঙ্করকাকু গাড়ি চালানো থামিয়ে সেই কথাই বলল। তখন আমরা গাড়ির সবাই সেটাই বললাম।

হুঁ। মনে আছে। তুই বলেছিলি, যে কথাগুলো রাস্তায় হয় সেগুলো বাড়িতে বলতে নেই। যাক, এসব কথা আমি শুনতে চাইছি না। তুই কথা না ঘুরিয়ে গল্প বল।

কী বলব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

যা ইচ্ছে বল। আচ্ছা বেশ আজ সারাদিন যে একা একা ঘুরে বেড়ালি, কোথায় গেছিলি কী করলি এইসব, তার গল্পই বল।

সে আর কী বলার আছে! জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে হারিয়ে গেছিলাম। কত রকম গাছ, পাখি সেখানে। এক প্রকান্ড বটগাছ। তার গা বেয়ে ঝুরি নেমে এসেছে। ঠিক যেন আদ্যিকালের বুড়ির মাথার চুলের নুড়ি।একদিন তোকে নিয়ে যাব। দুই বোনে সেখানে বসে সূর্যাস্তের পর চাঁদের আলো দেখব। সে আলোয় মেঘ সরে গিয়ে কেবল বেলফুলের মতো সাদা রঙ ছড়িয়ে পড়ে। যেন কেউ সোনালি রুপোলি পাত দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে চারপাশটা। সেই আলো মাখা রাতে …

দাঁড়া দাঁড়া। সাঁঝবাতি দিদির উপর উঠে বসল। তুই কবে এভাবে সূর্যাস্ত দেখলি আর চাঁদই বা এলো কোথা থেকে? এত বর্ননা কিভাবে দিচ্ছিস? তার মানে তুইও আজকাল অনেক বই পড়ছিস।

দূর! এগুলো তো পিয়াল বললেন। বলেই থেমে গেল শাওন।

থামা মাত্রই বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে সাঁঝবাতি জিজ্ঞেস করল, ওই এখানে পিয়াল কোথা থেকে এল? সে কে? বল শিগগিরি।  মনে হচ্ছে কাহিনীতে নতুন টুইস্ট। অন্য নায়কের আবির্ভাব। গা ছম ছম জঙ্গল।একাকিনী রাজকন্যা পথ হারিয়েছে। আর সেই পথে রাজপুত্র হঠাৎ হাজির। তারপর …

দূর বাবা! কোথা থেকে কী যে সব বলছিস! পিয়াল এক ফটোগ্রাফার। তিনি কানাডায় থাকেন। বললেন, কলেজে পড়ান সেখানে।

কানাডা ছেড়ে এদেশের জঙ্গলে! স্ট্রেঞ্জ ! তা তিনি সেখানে কী করছিলেন?

বললেন তো জঙ্গলে রাত দেখবেন বলে এসেছেন।

ইন্টারেস্টিং। হাইলি সাসপিসিয়াস। তারপর? থামলেন কেন? বলে যান…

একটু ভেবে নিয়ে শাওন তাকে সব ঘটনার বর্ননা দিল। আর তখনি অনুভব করল, বলার সময় তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাল লাগা কাজ করছে, যার কোনো ব্যাখ্যা সে সেইমুহূর্তে খুঁজে পেল না।

মন দিয়ে সব শুনলো সাঁঝবাতি। তারপর বলল, সবই ঠিক আছে। কিন্তু তুই শুধু শুধু তাকে ধমক দিলি কেন?

আমাকে তিনি তার সঙ্গে সুর্যের ডুবে যাওয়া আর তারপর চাঁদের উদয় হওয়া দেখতে বললেন। তাই রাগ হয়ে গেল।

এই রাগের কোনো মানে হয় ! একজন সুদর্শন আপনভোলা পুরুষ পূর্ণিমার রাতে জঙ্গলে এক সুন্দরী নারীকে নিয়ে মায়াবী আলোয় ভেসে যেতে চাইছেন… আর তুই কিনা! কী আনরোমান্টিক রে দিদি তুই! বলে আলোটা জ্বালিয়ে দিল সাঁঝবাতি।

উফ্‌ আলো জ্বাললি কেন আবার? চোখে লাগছে- হাত দিয়ে চোখ ঢাকলো শাওন।

অন্ধকারে এত কথা হয় না দিদি।আমার অন্ধকারে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।তাছাড়া দেখি তো তোর মুখখানা কতটা আরক্ত হল তাঁর কথা বলতে গিয়ে! বলে দিদির মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল সে।

ফাজলামি হচ্ছে? আমি না বড়ো দিদি তোর! না জ্বালিয়ে এবার ঘুমোতে দে দেখি।

না , এখনি শুনে নে। কাল সকালে আমার মনে নাও থাকতে পারে। কিংবা হয়তো সুযোগ পেলাম না বলার।

এতে আবার কী বলার আছে?

শোন তাহলে। তোর কথা শুনে এটুকু বুঝলাম যে পিয়াল রোজ ওখানে আসেন। অন্তত যখন থেকে এখানে এসেছেন ও জায়গাটার খোঁজ পেয়েছেন তবে থেকেই আসছেন। এমনও হতে পারে উনি বিদেশে যাবার আগেও ওই জায়গাটায় যেতেন। এবং জায়গাটা তাঁর বেশ পছন্দের। নির্জন জায়গা অনেকেই ভালোবাসেন। পূর্ণিমার ভরা জ্যোৎস্নায় যেকোনো পথিক পথ ভুল করে, একথা সারা পৃথিবীর সাহিত্যিকরাই বলে গেছেন। আর ইনি তো বলছিস ছবি তোলেন। খানিক দম নিয়ে সে আবার বলল, তুই শুনছিস?

হুঁ

না ঘুমিয়ে শোন। দেখ ভালো লাগবে। হ্যাঁ যা বলছিলাম…. পিয়াল একা বসে ছিলেন। হঠাৎ তোকে দেখল একা একা সেখানে আসতে। ওই গভীর জঙ্গলে শেয়াল হরিণ সাপ নিদেন পক্ষে মোষ থাকা স্বাভাবিক। না বাঘ নেই তিনি এটা জানেন। বলে হাসল সাঁঝবাতি। কিন্তু একজন নারী! কুমারী সুন্দরী একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে বনদেবীর মতো।তাঁর চিন্তা ভাবনা বোধ বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেল। সব পুরুষই তাঁর কল্পলোকে এক নারীর ছবি এঁকে রাখেন। অধিকাংশ পুরুষের মাথাতেই এক্ষেত্রে তোর মতো রূপসীর ছবিই আঁকা থাকে। পিয়ালের মনেও নিশ্চয়ই এমন কিছু ছবি রয়েছে। ওরকম জায়গায় তোকে দেখে বিহ্বল হয়ে বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে গেলেন তিনি। তাঁর ঘোর লেগে গেল। তিনি তখন নিজের প্রেয়সীকে যে ভাষায় নিজের কোনো পছন্দের বিষয় দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, সে ভাবেই তোকে আহ্বান করলেন।

শাওন হেসে উঠল বোনের কথায়- বুঝলাম। অতিরিক্ত গল্প আর উপন্যাস পড়ে পড়ে তোর মাথাটা একদম গেছে। আমি নাকি তাঁর কল্পলোকের নারী! প্রেয়সী! যত সব যুক্তিহীন বোকা বোকা কথা। তিনি খুব ভালো করেই জানেন আমি কে, কার মেয়ে, কোথায় উঠেছি, এমনকি আমাদের নামও তার জানা।

এ আর কঠিন বিষয় কী? মন্ত্রীর মেয়েকে না চেনার কী আছে, বিশেষ করে এখানে! সেটা এমন কিছু বিষয় নয়। কথাটা হচ্ছে তুই তার কাছে কিভাবে কোন পরিবেশে উপস্থিত হলি! সেই সময় যে অনুভূতিগুলো তার মাথায় প্লে করল সে সেভাবেই রিয়্যাক্ট করল।

বাদ দে। এসব এখন ভালো লাগছে না।এবার ঘুমো। বলে হাই তুলে পাশ ফিরে শুলো শাওন। ভাগ্যিস আমি ছিলাম।তুই থাকলে নির্ঘাত রাতে ওখানেই থেকে যেতিস পিয়ালের সঙ্গে।

কে জানে! সেটা নির্ভর করত সেই সময়ে আমার মানসিক ইচ্ছার উপর। বিছানা থেকে উঠে পাশের টেবিলে রাখা বোতল থেকে খানিকটা জল ঢেলে খেল সাঁঝবাতি। তারপর বিছানায় ফিরে এসে গুড নাইট বলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সাঁঝবাতি।

 জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় তার মুখটা অদ্ভুত এক মায়াবী আলো মাখা লাগছে। সেদিকে কয়েক মিনিট নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইল শাওন। আলতো করে বোনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বিছানা ছেড়ে  উঠে পড়ল সে।

আর ঘুমতে ইচ্ছে হলো না তার। শালটা গায়ে জড়িয়ে শব্দ না করে দরজা খুলে বারান্দায় এল। ঠান্ডা হাওয়ায় গা’টা কেঁপে উঠল তাঁর। রাহুলের ঘরের দিকে তাকালো। আলো জ্বলছে। রাহুল জেগে আছে? জ্বর কি বাড়ল? একবার যাব ওর কাছে, ভেবে দু’পা এগিয়েও থেমে গেল সে। না থাক। এত রাতে না যাওয়াই ভালো ভেবে নিচের বারান্দার দিকে তাকালো। সেখান থেকে সে শাল্মীকে চায়ের কাপ হাতে বসে থাকতে দেখল। আর একটু দূরে মুক্তো রেলিংএ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। মা এত রাত অবধি জেগে? ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এল সে।

মা, খুব মৃদু স্বরে ডেকে শাল্মীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। এত রাতে জেগে কেন মা? শরীর ঠিক লাগছে না?

ঘুম আসছে না, তাই বসে।

ঘুম না এলেও চোখ বুজে শুয়ে থাকতে হয় মা, তাহলে ধীরে ধীরে ঘুম এসে যায়।

আসবে না।

তুমি না শুলে যে মুক্তোও জেগে থাকবে মা।

তাকে আমি বসে থাকতে বলিনি।

আরো কিছু বলার আগেই মুক্তো বলে উঠল, তুমি ঘরে যাও। আমি এখানে ঠিক আছি।অযথা ঘুরে বেড়িয়ে ঠান্ডা লাগিও না।

আর কথা না বাড়িয়ে শাওন ঘরে ফিরে বোনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণের মধেই ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে দেখল, চারদিক জুড়ে কেবল সাদা আলোর ঝলকানি। সে বটগাছটার নিচে একা দাঁড়িয়ে।আলোর তীব্রতায় তার সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি। সে যেন তাকে ঈশারা করছে…।

 

চলবে…

বিতস্তা ঘোষাল। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ই জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক', 'চলন্তিকা' পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২২টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ