সুখের আগে অ
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১ ফ্লাশিং এর লাস্টস্টপে এসে ট্রেনটা থেমে গেল। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি অসংখ্য…..
আগের পর্ব পড়ুন এখানে…
আট.
দরজায় পর পর দুটো আলতো টোকার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল সাঁঝবাতির। বিছানা ছেড়ে সে হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে রঘুকে দেখল। মনে পড়ল কাল রাতেই রঘুদার টর্চ আনার কথা ছিল। তখন না এসে এত ভোরে! ক’টা বাজে বোঝার চেষ্টা করল সে।এখনো অন্ধকার হয়ে আছে। সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। বরং চাঁদটা এখনো তার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে। সে চোখ মুছে এক হাত দিয়ে টর্চটা নিল আর এক হাত দিয়ে ঈশারায় রঘুকে অপেক্ষা করতে বলল। রঘু মাথা নাড়া মাত্র সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মিনিট দশেকের মধ্যেই রেডি হয়ে বাইরে বেরবার আগে টর্চটা নিয়ে একবার নদীর দিকটায় আলো ফেলল। ভালোই দেখা যাচ্ছে। যাক,রঘুদা দেরি করলেও জিনিসটা ভালই এনেছে ভেবে মনটা হঠাৎই অকারণ আনন্দে নেচে উঠল। সে টর্চটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দরজা খুলে বাইরে এল।
রঘুদা, থ্যাঙ্কস।
প্রত্যুত্তরে রঘু হেসে বলল, সে না হয় হলো।কিন্তু টর্চ নিয়ে কী করবে সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বাঘ মারব। বলে সজোরে হেসে উঠল সাঁঝবাতি। তার হাসি দেখে রঘু আরো ঘাবড়ে গেল। সেই ঘাবড়ানো মুখের দিকে চেয়ে সে বলল, সব কিছু বোঝার কী দরকার! তার চেয়ে বরং চা খাওয়া যাক।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরের দিকে না গিয়ে সে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর বলল, চলো রঘুদা আজ বাইরে কোথাও চা খাই।এখানকার লোকজন নিশ্চয়ই ভোরেই ঊঠে পড়ে। চা পাওয়া যাবে?
সে যাবে। কিন্তু যেখানে সেখানে চা খাওয়া তোমার শোভা পায় ?
কেন বলো তো? আমি কে? বেশ বিরক্ত নিয়েই সাঁঝবাতি বলল, আজ আমরা বাইরেই খাব চা।
রঘু চিন্তায় পড়ল। মন্ত্রীর দুটো মেয়ের মাথাতেই কী গন্ডগোল আছে? অনেক মন্ত্রীর ছেলেমেয়েকেই সে সামনে থেকে দেখেছে কাজের সূত্রে। তাদের বেশিরভাগই ভদ্র ব্যবহার তো দূরের কথা মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না। তাদের সঙ্গে কথা বলাই যায় না। আর এই মেয়েদুটো একদম আলাদা। অতিরিক্ত আদর, প্রাচুর্য আর ক্ষমতার প্রভাবে এদেরও বাঁদর হবার কথা। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে সেটা বলা যায় না। বেশ মার্জিত ও ভদ্র দুই বোনই। তবে ছোট মেয়েটা ভীষণ খামখেয়ালী। কখন যে কী করতে চায় টের পাওয়া মুস্কিল। অবশ্য সে লক্ষ্য করে দেখেছে মেয়েটা এমন কিছু করে না যাতে তার চাকরি যেতে পারে।
আপন মনেই ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে সাঁঝবাতির পিছন পিছন হাঁটছিল সে। কাল রাতে তাদের এক ইনফর্মার খবর দিয়েছে সাহেবের এই মেয়ের সম্পর্কে। সে এখনো সাহেবকে জানায়নি ঠিকই কিন্তু ওসি শুনে বলেছেন, বেশ চিন্তার বিষয়। চোখে চোখে রাখতে হবে।
কিন্তু বিষয়টা সত্যি এত চিন্তার! ইনফর্মার ছেলেটি খবর দিয়েছে, সাহেবের ছোট মেয়ে রাতের বেলা একা একা নদীর ধারে ঘুরে বেড়ায়। এটা কী খুব ভয়ের কিছু! ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে ভয়ের কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। একটা মেয়ে শহরে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াতে পারে না। অবকাশ বা সুযোগ দুটোই সেখানে পাবার সুযোগ কম। তাছাড়া সিকিউরিটি আর এত কোলাহলের মাঝে নিরিবিলিতে এই আনন্দ উপলব্ধি করা যায় না। এখানে যদি সেই আনন্দটা উপভোগ করতে পারে তবে তাতে অসুবিধা কোথায়! অবশ্য … কী যেন ভাবল আবার। বড়ো মেয়েটাও তো একা একা ঘুরে বেড়ায়।এ যায় নদীর ধারে আর সে জঙ্গলে। কাল সেখানে একটা ছেলের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে। ছেলেটা বাইরের। শোনা যাচ্ছে তার মাথাতেও ছিট আছে। সারাদিন সে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। এখন কার দিকে নজর রাখতে হবে সেটাই তার কাছে ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে।
আপাতত যে ছোটো মেয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছি না তা বেশ বুঝতে পারছি , এটা ভেবে সে হাঁটার গতি বাড়াল।
সাঁঝবাতির পরণে নীল জিন্স। দেখলে মনে হবে রঙ চটা। কিন্তু রঘু বেশ কয়েকবার কলকাতা দিল্লী গিয়ে দেখেছে আজকাল ছেলেমেয়ে সবাই এমন জিন্স পরছে, আর এর দামও অনেক। মানুষের যে কী শখ এমন পোশাকে- ভাবতে ভাবতে তার চোখ গেল সাঁঝবাতির জামার দিকে। সাদা কুর্তি। হাঁটুর অনেক ঊপরে , কিন্তু কোমর থেকে খানিক নিচে। তার উপর একটা হালকা নীল জ্যাকেট। পায়ে চপ্পল দেখে নিজের মনেই হাসল।
আরো খানিকটা কাছে যাবার পর তার কানে এল একটা গানের সুর। সুরটা চেনা চেনা লাগছে। কান খাড়া করে আর একটু কাছে যাবার পর সে চিনতে পারল গানটাকে। এই গানটা স্কুলে একটা স্বাধীনতা দিবস পালনের অনুষ্ঠানে তাদের শেখানো হয়েছিল। সে বছর নতুন এক প্রধান মাস্টার এসেছিলেন। অল্প বয়স। গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। ধুতি পাঞ্জাবী পরে স্কুলে আসতেন। তিনি স্বাধীনতার নানান গল্প শোনাতেন, কত গান লেখা হয়েছিল সংগ্রামীদের মনের জোর বাড়াতে। আর রবিঠাকুর নজরুলের কবিতা পাঠ করে তাদের মুখস্ত করাতেন সেই মাস্টার। সে বছর তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল স্কুলের মাঠে। ফুল আর খড়িমাটি দিয়ে সারা স্কুল জুড়ে আলপনা দিয়েছিল তারা। এই গানটা গাওয়ার পর তাদের প্রত্যেককে লজেন্স আর বিস্কুট দেওয়া হয়েছিল। সেসব কবেকার কথা। আচ্ছা! এখনো স্কুলে বিস্কুট লজেন্স দেওয়া হয়? শহরে বড় বড় স্কুলে নিশ্চয়ই আর অনেক কিছু দেয়, ভাবতে ভাবতে তার আবার চোখ গেল সাঁঝবাতির দিকে।
মেয়েটাকে দেখে তো অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না। একবার জানতে চাইব অত রাতে নদীর ধারে ঘুরছিল কেন? রেগে যেতে পারে ? দ্বিধা নিয়েই সে বিনীত ভাবে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? যদি কিছু মনে না করো।
জিজ্ঞেস করার মতো হলে নিশ্চয়ই করবে। এতে এত কিন্তুর কি আছে?
রঘু জানতে চাওয়ার আগে আরো একবার নিজেকেই প্রশ্ন করল, তার এভাবে জানতে চাওয়ার এক্তিয়ার আছে কিনা! শেষে হিতে বিপরীত হয়ে গেলে মুস্কিল। পরক্ষণেই, যা হবার হবে ভেবে নিয়ে বলল, তুমি রাতে একা একা নদীর ধারে ঘুরে বেড়াও ? না মানে … হয়তো তুমি নও। আসলে অন্ধকারে ঠিক বোঝা নাও যেতে পারে…
তার কথা শেষ হবার আগেই উত্তর এল- হ্যাঁ , ঘুরছিলাম তো।
সোজাসাপটা উত্তর পেয়ে রঘু চুপ করে গেল। একটু ভেবে বিষয়টার গুরুত্ব বোঝানোর মতো ভঙ্গীতে বলল, তা বেশ করেছ। নদীর হাওয়া শরীরের পক্ষে ভাল। তবে কী জানো এখন ঠান্ডা বাতাস লেগে গেলে শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। গলাটা এবার একটু নিচু স্বরে। তাছাড়া দিনকাল আর আগের মতো নেই। অজানা অচেনা জায়গা। জানি সাহেব আমাদের মাটির মানুষ। তেনাকে সবাই ভালবাসে, শ্রদ্ধা ভক্তি করে। তবু শত্রুর তো অভাব নেই। তাছাড়া সাপখোপ বা জন্তু-জানোয়ার যখন তখন সামনে এসে যেতে পারে। তাই বলছি ,যখন বেরবার ইচ্ছে হবে তখন যদি পুলিশগুলোকে ডেকে নাও তবে ওদেরও শান্তি আর আমাদেরও নিশ্চিন্তি।
রঘুর কথাগুলোর কোনো উত্তর না দিয়ে যেন এতক্ষণ কোনো কথাই সে শোনেনি এমন নিরুত্তাপ গলায় সাঁঝবাতি বলল, রঘুদা চায়ের দোকান কোথায়? আর কতটা ?
রঘু বুঝতে পারল না মেয়েটা রেগে গেল কি না! সে তাড়াতাড়ি বলল, এই তো আর দু’পা এগিয়ে বাঁ দিক ঘুরলেই…
মাটির চালাঘরটার সামনে যখন তারা পৌঁছল, দোকানী তখন সদ্য উনুন জ্বেলেছে। একটা বড়ো কেটলিতে জল আর দুধ ফুটছে। বছর দশেকের একটা ছেলে ঝাঁটা দিয়ে চালার সামনেটা পরিস্কার করছিল। সেদিকে তাকিয়ে সাঁঝবাতি দেখছিল ঝাঁটার ওজন ছেলেটার থেকে বেশি। ভালো করে দু’হাত দিয়ে সে ঝাঁটাটা ধরতেই পাচ্ছে না। কিছু একটা বলবে ভেবেও সে চুপ করে ছেলেটাকেই দেখতে লাগল।
মিনিট দুয়েক বাদে লুঙ্গি আর খালি গায়ের সেই চা-ওলা মাটির ভাঁড়ে চা এগিয়ে দিল তাদের দিকে। চায়ে চুমুক দিয়ে একটা সুখের আঃ ধ্বনি বেরিয়ে এল সাঁঝবাতির মুখ থেকে। মাটির ভাঁড়ে দুধের চা খাওয়ার মজাই আলাদা। আর এক চুমুক দিল। তারপর বলল, ছোটবেলায় ঠাম্মা একটা কথা বলতেন। তখন মানে বুঝিনি। এখন প্রায়ই কথাটা মনে পড়ে, বুঝলে রঘুদা।
রঘু কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকাই ভালো মনে করল।পরমুহূর্তেই কী একটা ভেবে বলল, তোমার ঠাম্মা যখন বলতেন, নিশ্চয়ই তোমার ভালোর জন্যই ,
সেদিকে লক্ষ্য করে সাঁঝবাতি বলল, ঠাম্মা বলতেন, তেলা মাথায় তেল দেওয়াই বেশীরভাগ মানুষের ধর্ম। তারপর সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পালটে বলল, চা-টা বেশ ভালো হয়েছে দাদা। আরেক কাপ দিন … দোকানীর মুখে হাসি দেখে সেও হাসল । তারপর, কেমন চলছে দিরকাল? ঝামেলা দাঙ্গা খুনখারাপি ? জঙ্গল থেকে হিংস্র জন্তু সাপ হাতি শেয়াল বেড়োয় ?
দোকানী কোনো উত্তর দেবার আগেই সে চা শেষ করে, কত হয়েছে বলে জিন্সের পকেটে হাত ঢোকানো মাত্র রঘু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, দিতে হবে না। এই তো মাত্র দু কাপ চা… সে আমাদের বিশুদা এমনিই খাওয়াতে পারে, তাই না বিশুদা?
দোকানী সে কথা শুনে তৎক্ষণাৎ হাত জোড় করে বলল, দাম নেব না দিদি! সাহেবের মেয়ে আপনি! উনি আমাদের কত খেয়াল রাখেন…
তাকে শেষ করতে না দিয়েই সাঁঝবাতি বলল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ছেলেটা আপনার? তারপর একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দোকানীর হাতে ধরিয়ে গেস্ট হাউসের রাস্তা ধরল।
রঘু ভ্যাবাচাকা খেয়ে একবার বিশুদার দিকে একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সাঁঝবাতির পিছনে হাঁটতে লাগল।
কয়েক পা এগিয়েই সাঁঝবাতি থেমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে রঘুর দিকে তাকালো। হাসল- রঘুদা তোমার লোক ঠিকই দেখেছে। চাঁদের আলোয় নদীর বুকে ঢেউগুলো যেন মালা গেঁথেছিল। আলোর মালা খেলা করছিল সেখানে। পেছনের গাছগুলো কেমন রহস্যময় লাগছিল। ঘোর লেগে গেছিল তাকিয়ে থাকতে থাকতে…
কিন্তু…
এত ভেবো না রঘুদা। বরং ভাবনা হবার কথা এই বাচ্ছাটাকে নিয়ে।
কোন বাচ্চা?
দেখলে না চায়ের দোকানে ঝাঁট দিচ্ছিল।
রঘু এতক্ষণে যেন বাচ্ছাটাকে চিনতে পারল। সে তো বিশুদার ছেলে, নন্টে।
স্কুলে যায় বলে তো মনে হল না। এই বয়সেই কাজ করে খাচ্ছে। অথচ এদেশে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। নষ্ট শৈশব। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সাঁঝবাতি। এদের নিয়ে ভাবো রঘুদা। কী করলে এরা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে সেটা দেখ। তোমাদের মন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করো। তাঁর তো একটা দায়িত্ব আছে সমাজের প্রতি। ভুলে গেলে চলবে না রঘুদা শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ।
রঘু অবাক হয়ে সাঁঝবাতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার মাথায় সত্যি গোলমাল আছে। নইলে এমন কথা কেউ বলে! উন্নয়নের জোয়ার চলছে বলে সরকার যখন বড়ো বড়ো পোস্টার দিচ্ছে তখন খোদ মন্ত্রীর মেয়ে বলে কিনা এই বাচ্ছাদের কথা ভাবতে! তাদের স্কুলে যাবার ব্যবস্থা করতে! এ যে বিরোধীদের মতো বক্তব্য। সাহেবের কানে গেলে যে কী হবে ! কী কুক্ষণে যে এ মেয়ের সঙ্গে চা খেতে গেলাম !
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটা শব্দ তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। নষ্ট শৈশব। তার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। ভাগচাষী বাবাটা চাষ করতে গিয়ে দুই ভাইয়ের জমির লড়াইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাল। তখন তার আর কত বয়স! সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, সেই বছরই স্কুলের নতুন মাস্টার এল। এক বছর না যেতে যেতেই সেই মাস্টারকে কারা যেন রাতের অন্ধকারে মেরে দিল। মাস্টার নাকি বুর্জোয়া! শব্দটার মানে জানা হয়নি। তার আগেই মা তাকে গ্রামে রেখে শহরে চলে গেল এক বড়লোক বাড়িতে কাজ করার জন্য। আর ফিরে আসেনি। কানাঘুষোয় শুনেছে মাকে সে বাড়ির কর্তার ছেলে ধর্ষন করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। মা’ হারিয়ে গেল। তাদের স্কুলটাও বন্ধ হয়ে গেল মাস্টার খুন হওয়ায়। তারও স্কুলে যাওয়ার ইতি। তখন থেকেই কেবল দৌড় আর লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। দুটো খাবার জন্য এ দোকান, ও জমির মালিকের ফাই ফরমাশ … পনেরো বছর থেকে রাজনীতি। সেই বয়সেই বুঝে গেছিল এ ছাড়া বাঁচার উপায় নেই।
নষ্ট শৈশব! নিজের মনেই শব্দটা আবার বিড়বিড় করল সে। গরীবের ছেলেদের আবার পড়াশোনা! স্কুল যাওয়া! তুমি বুঝবে না খিদে কাকে বলে! দিনের পর দিন ভাত খাবার জন্য লোকের বাড়ির দরজায় দরজায় ঘোরার যন্ত্রণা …
অতীতের স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেখে সে শিউরে উঠল। তাড়াতাড়ি চোখ বুজে নিয়ে বড় করে শ্বাস ছেড়ে শ্বাস নিল। এটা তাকে এক বন্ধু শিখিয়েছিল সেই ছোটোবেলায়। বলেছিল, যখন খুব খিদে পায় তখন এটা করলে পেট ভরে যায়। কেন যায় সে প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলেও সে দেখেছে শুধু খিদে নয়, দুশ্চিন্তার সময়েও এটা ভাল কাজ দেয়।
রঘু আবার বড়ো একটা শ্বাস নিল।
রঘুদা, তোমার বাড়ি কোথায়? এখানেই?
বেশিদূর নয় এখান থেকে – মাইল খানেক।
চলো তাহলে দেখে আসি তোমার বাড়ি।
রঘু এবার হকচকিয়ে গেল। যেতে পারো।কিন্তু সেখানে তো কেউ নেই।
কেন, তোমার মা বাবা বৌ ?
মা বাবা তো নেই। আর বিয়ে! আমার মতো চালচুলোহীন বাউন্ডুলে ছেলের সঙ্গে কে মেয়ের বিয়ে দেবে? আমি একাই থাকি।তবে থাকি আর কতটুকু! এখান সেখান করেই দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছে।
সাঁঝবাতি আর কথা না বাড়িয়ে বলল, এবার চলো, ফেরা যাক। সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন।
নয়.
রাহুল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। কাল রাতে ঘুম ভাল হওয়ায় শরীরটা এখন অনেকটাই ফ্রেস লাগছে। এখন আর জ্বরটাও নেই। সে বিছানায় শুয়েই জানলা দিয়ে দেখল সাঁঝবাতি বছর ত্রিশ বত্রিশের এক যুবকের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে, গেট দিয়ে গেস্ট হাউসের ভিতরে ঢুকছে। তাদের দেখে সে বিছানা থেকে নেমে চট করে মুখ ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে সাঁঝবাতির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।
সাঁঝবাতি তাকে লক্ষ্য করে সেদিকেই এগিয়ে এল ।
মর্নিং ।
ভেরি গুড মর্নিং। ঘুম হয়েছে ঠিক মতো? সাঁঝবাতি জিজ্ঞেস করল।
একদম। তা কোথায় যাওয়া হয়েছিল?
একটু হাঁটছিলাম। ভোরের হাওয়া গায়ে মাখলে রোগভোগ অনেক কমে যায়।
রাহুল চারদিক ভাল করে দেখে বলল, এখন ভোর কোথায়? চারদিকে তো বেশ আলো দেখছি। রোদ উঠে গেছে।
না , রাহুল। এখন সবে ছ’টা দশ। শহরে মানুষ এখনো ঘুমোয়। গ্রামে খুব তাড়াতাড়ি ভোর হয়। আসলে গ্রামে তো লোকজন তাড়াতাড়ি ওঠে। আর মোরগও সেই রাত থাকতেই ডাকতে শুরু করে দেয়, বলেই সাঁঝবাতি বলল, তুমি সেই গল্পটা জানো নিশ্চয়ই!
কোন গল্প? অবাক হয়ে রাহুল জানতে চাইল।
সেই যে দেবী কন্যাকুমারীর কুমারী থাকার গল্পটা।
রাহুল সাঁঝবাতির কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, এর সঙ্গে মোরগ ডাকের আর ভোর হবার কী সম্পর্ক ?
সে প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে সাঁঝবাতি বলল, সাধে বলি ব্যবসার বাইরে একটু চারপাশের ঘটনা, গল্প, মিথ, রূপকথার দিকে চোখ দাও। নইলে জীবনটা তো পান্সে হয়ে যাবে।
রাহুল কোনো কিছুরই মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বোকা বোকাভাবে হেসে বলল, হেঁয়ালি না করে গল্পটা শোনালে ভালো হতো।
শুনতে চাও? আচ্ছা দাঁড়াও, দিদিকে ডাকি। সে বেচারা নির্ঘাত তোমায় খুঁজছে।
শাওন কি ঘুম থেকে উঠে গেছে?
এতক্ষণে উঠে গেছে। দেখছি। তুমি চা খেয়েছ?
না। এই তো…
বেশ তবে চলো , নদীর পাড়ে বসে চা খেতে খেতে গল্প করি। বলে একটু এগিয়ে গিয়ে থেমে গেল সাঁঝবাতি। রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি গিয়ে বোসো। আমি চট করে চা দিতে বলে দিদিকে ডেকে আনি।
রাহুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাঁঝবাতি রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল।
সেদিকে অনেকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকল রাহুল। তারপর নিজের মনেই বলল, চুপ করে বসে থাকা সময় জানে কার কাছে যাবে। তুমি একা একাই হেঁটে চলেছ। এ গলি ও গলি। রাজপথ আছে ঠিক কাছে বা একটু দূরেই, তোমার নাগালেই। সময় জানে ঠিক কবে ভোর হবে। অথচ তুমি কখন থেকে ভেবেই যাচ্ছ…।
সাঁঝবাতির জন্য অন্তত একটা পুরো কবিতার বই পড়ে ফেলেছি, এই ভেবেই মন ভালো হয়ে গেল রাহুলের।
নদীর পাড়টা যে এত সুন্দর রাতে বু্ঝতে পারেনি সে। সূর্যের আলোয় দূরের গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছে কে যেন সবুজ রঙ দিয়ে তাদের রাঙিয়ে দিয়েছে। রাহুলের ইচ্ছে হলো, নদীতে পা ডোবাতে। সে পাড়ে বসে নিচু হতে গেল আর তখনি চোখে পড়ল ট্রেতে চা নিয়ে একজন আসছে।তার পেছনে শাওন। সে সোজা হয়ে একগাল হেসে তার দিকে এগিয়ে গেল।
শাওনের পরনে হলুদ কুর্তি, লাল স্কার্ট।আর গায়ে লাল শাল। রাহুল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।
কেয়ারটেকার ছেলেটি কোথা থেকে দুটি ফোল্ডিং চেয়ার আর টেবিল এনে পেতে দিল। চা নিয়ে যে ছেলেটি এসেছিল কাপে চা ঢেলে রাহুলকে আর শাওনকে দিয়ে চলে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে শাওন বলল, কী দেখছ অমন করে!
তোমাকে।
ধ্যাৎ, বলে মাথা নিচু করে নিল শাওন।
তার সেই লাজুক হাসি ও চাউনির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রাহুল বলল, জায়গাটা ভারি সুন্দর। কাল রাতে এতটা বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আশেপাশে বাড়ি-ঘর বিশেষ নেই বলেই মনে হচ্ছে।
শাওন রাহুলের এই প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ায় যেন মুক্তি পেল। স্বাভাবিক ছন্দে বলল, হ্যাঁ , লোকালয় একটু দূরে। অবশ্য বেশিরভাগ সরকারি গেস্ট হাউসগুলোই লোকালয়ের থেকে দূরে নিরিবিলিতেই হয়। আসলে এখনকার গেস্ট হাউসের অধিকাংশই তো ইংরেজদের বানানো। তারা নেটিভদের ঘেন্না করত বলে তাদের থেকে দূরে নির্জন স্থানে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে এগুলো বানাতো।
এই অঞ্চলেও সাহেবরা ছিল? অদ্ভুত তো!
বোন তো তেমনই বলল। সে এখানে জঙ্গলের ভেতর সেই সাহেবের কবরখানাও দেখে এসেছে।
সে কী! ডাকো তো তাকে। আমরাও দেখে আসি।
সাঁঝবাতি কী আমাদের মর্জিতে যাবে! নিজের যখন ইচ্ছে হবে তখন নিয়ে যাবে। তুমি যেতে চেয়েছ সেটা তাকে বলে দেব। তবে আমি তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি।
কোথায়?
এই জঙ্গলের ভেতর একটা প্রাচীন গাছ আছে। হয়তো পরীক্ষা করলে দেখা যাবে কয়েকশো বছরের পুরোনো। শাওন বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল।
গাছ! সে তো চারদিকেই শুধু গাছ আর গাছ! আলাদা করে আর কি দেখার আছে! রাহুলের নিরুৎসাহিত মনোভাব দেখে শাওন আর কথা না বাড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে ঊঠে দাঁড়াল।
কী হলো? উঠে পড়লে যে!
যাই দেখি মা কী করছে? আর সাঁঝবাতিই বা কোথায় গেল! আসব বলে এলো না।
রাগ করলে? রাহুল শাওনর হাতটা টেনে ধরল। আচ্ছা বেশ চলো তোমার গাছ দেখে আসি।
থাক। পরে যাব। শাওন পিছন ফিরে ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলে রাহুল কী করবে ভেবে না পেয়ে তাকে নীরবে অনুসরণ করতে লাগল।
দশ.
সাঁঝবাতি কোথা থেকে যেন ব্যাডমিন্টন রাকেট আর কক যোগাড় করে রঘুর সঙ্গে খেলার চেষ্টা করছে। বেচারা রঘু! তার সব চাল নেটের বাইরে।
রাহুল আর শাওনকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, হবে নাকি এক রাউন্ড?
রাহুল শাওনর দিকে একবার তাকিয়ে কোনোরকম সম্মতির অপেক্ষা না করেই এগিয়ে গেল খেলার জায়গায়। শাওন স্থির পলকে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
দিদি, তুইও চলে আয়।
না ,আমার দ্বারা হবে না। তারচেয়ে তোরা খেল। আমি একটু ঘুরে আসি বাইরে থেকে। তারপর কী যেন একটু ভেবে বলল, কবরখানাটা যেন কোনদিকে বলেছিলি?
জঙ্গলের বাঁদিকে। একা যাস না। খুঁজে পাবি না।
শাওন একবার রাহুলের দিকে তাকালো। সে খেলার জন্য পুরো রেডি। সে আর অপেক্ষা না করে গেটের দিকে এগোলো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল ছেলেটি স্যালুট জানানো মাত্র সে হাসল। তারপর দুই হাত জড়ো করে প্রণাম জানিয়ে হাঁটতে লাগল। ছেলেটি তার এই অল্প চাকরি জীবনে এমন দৃশ্য সম্ভবত এখনো দেখেনি। সে অবাক হয়ে শাওনের চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল।
রঘু দূর থেকে শাওনকে গেটের বাইরে বেরতে দেখে রাহুলের হাতে ব্যাটমিন্টন তুলে দিয়ে দ্রুত পায়ে শাওনের কাছে চলে এল।
কোথায় যাচ্ছ?
রঘুর মুখ গলা পিঠ সব ঘামে ভিজে চপচপে। শীতের সকালে তাকে দেখে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ যেন সে রোদে। শাওন তার দিকে তাকাতে সে একটু লাজুক হেসে বলল, খেলার অভ্যাস নেই তো, তাই হাঁফিয়ে গেছি। শাওন দেখল তার চোখে ভাল লাগার একটা ছোঁয়া ফুটে উঠেছে। সে কিছু না বলে হাসল।
বড়ো বড়ো করে শ্বাস ছাড়া নেওয়া করে রঘু বলল, এখন কোথায় যাচ্ছ?
সেভাবে কোথাও নয়। একটু আশপাশটা দেখি।
দেখার কিছুই নেই।খালি জঙ্গল আর নদী। সে তুমি এখান থেকেই দেখতে পাবে।
শাওন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল একটু। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, গ্রাম দেখতে আমার ভালো লাগে।
তুমি এর আগে গ্রামে গেছ? শহরে বড়ো হওয়া মন্ত্রীর মেয়ের গ্রাম দেখতে ভাল লাগে শুনে রঘু অবাক হল।
আমরা অনেকবার গ্রামে গেছি। আমার ঠাম্মার বাপের বাড়ি। সে…ই…ই ধল্যা। তুমি জানো?
ধল্যা? সেটা কোথায়? রঘু এই জায়গাটার নাম কোনোদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারল না।
বোলপুরের নাম জানো? শান্তিনিকেতন ?
এবার রঘু যেন বুঝতে পারল।সে বলল, তাই বল। শান্তিনিকেতন তো গেছি।
ধল্যা আর শান্তিনিকেতন এক জায়গা নয় রঘুদা। তবে হ্যাঁ -দুটোই বীরভূমে।
রঘু কিছু না বলে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল। সে আর কতটুকুই বা জানে ! গ্রাম ছেড়ে কলকাতা, আর সাহেবের সঙ্গে দু’ বার দিল্লী। এর বাইরে সে আর কীই বা- চেনে!
জানো রঘুদা, ধল্যা গ্রামটার চারদিকে প্রচুর পুকুর। ঠাম্মার বাপের বাড়ির চারদিকটা শুধু পুকুর আর নারকেল, আর তাল গাছ দিয়ে ঘেরা। আমরা ধর্মরাজ পুজোর সময় সেখানে যেতাম। কী যে মজা হতো! একটা লোক মাথায় ধর্মরাজ দেবতাকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরত। যে বাড়িতে গিয়ে আটকে যেত সেই বাড়িতেই তখন রান্নার ব্যবস্থা হতো।
রঘু এর আগে ওলাই চন্ডী, ইঁদ পূজো, উত্তম ঠাকুর, দক্ষিণরায়, বনবিবি পুজোর নাম শুনলেও এই ঠাকুরের নাম কখনো শোনেনি। সে খানিক ভেবে বলল, ওসব পুজো আচ্চার চল কী আর আছে এখন গ্রামে! এখন দেখগে যাও সেসব আর হয় না।
রঘুদা, কিছু কিছু পুজো গড়ে ওঠে একটা সভ্যতার অঙ্গ হিসেবে। হয়তো আগের মতো শক্ত কঠিন নিয়ম, নিষ্ঠা এখন আর নেই। কিন্তু তা বলে পুরো সংস্কৃতটাই উঠে গেছে ভাবাটা বোধহয় ঠিক নয়।
রঘু কিছু বলার চেষ্টা করতে গেল। তাকে থামিয়ে দিয়ে শাওন বলল, এই গ্রামটা কিন্তু বেশ শান্তশিষ্ট। মানুষজনও খুব ভাল।
এমনিতে খারাপ নয়। কিন্তু আগের গ্রাম কী আর থাকে! এখন ঘরে ঘরে টিভি, মোবাইল। সন্ধ্যে নামলেই জলসা।
আমায় জলসা দেখতে নিয়ে যাবে?
যাঃ তারাঃ, বলেই তো বিপদে পড়লাম! ভেবে রঘু তাড়াতাড়ি বলে উঠল ,আরে সেখানে কী তোমাদের ঘরের মেয়েরা যায়, না যেতে পারে? একেবারেই নিচুতলার … বুঝলে না… ওসব দেখার চেয়ে নদীতে নৌকায় করে ঘোরাটাই ভালো।
এখন নৌকা পাওয়া যাবে?
যাবে। মাঝিকে তো বলাই আছে। যাবে তো চলো, এখন নদী শান্ত। আর রোদও চড়া নয়। ভাল লাগবে। ডাকব মাঝিকে?
শাওন একবার নদীর দিকে, পরমুহূর্তেই রঘুর দিকে তাকিয়ে বলল, এখন থাক। ইচ্ছে হলে পরে বলব। বলে সে নিজের মতো হাঁটতে লাগল।
রঘু তার পাশে পাশেই আসছিল। তার এই আসাটা শাওনের ভালো লাগছিল না। এখন তার একা থাকতেই ইচ্ছে হচ্ছিল। অথচ মুখের উপর চলে যেতে বলতেও পারছিল না। সে খানিকটা বিরক্ত লুকিয়ে রেখেই বলল, রঘুদা, এখানে কবরস্থানটা কোথায়?
এখানে তো কবরস্থান শ্মশানের পাশেই। সেখানে কী দরকার?
আমি সেই কবরস্থানের কথা বলিনি।
তাহলে? কার কবরের কথা বলছ তুমি?
ইংরেজ কিংবা কোনো বিদেশীর। এখানে আগে সাহেবরা আসতেন তো, তাদের কোথায় সমাধি দেওয়া হত?
রঘু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, এমন কোনো কবরস্থানের কথা তো শুনিনি।
শাওন রঘুর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার মানে বোন এটা বানিয়েই বলেছে।
রঘু জিজ্ঞেস করল, এখানকার কেউ কি তোমাকে বলেছে?
না বোধহয়। মনে হচ্ছে কারোর মুখে শুনেছিলাম। অন্য কোনো জায়গার বোধহয়। আমি ভুল করছি। কথা ঘুরিয়ে সে এবার বলল, আমি একবার জঙ্গলে যাব। তুমি যাবে?
আবার জঙ্গল কেন?
খানিক আনমনা হয়ে শাওন বলল, একটা প্রাচীন গাছ আর একজন রহস্যময় মানুষ।
তার কথা শুনে রঘু আবার চিন্তায় পড়ল। একে জঙ্গল, তার উপর রহস্যময় মানুষ! এই মেয়েটারও যে মাথার ব্যামো আছে সেটা আগে বোঝা যায়নি তো! দুই বোনই এক! তবে পরিবারের সবারই এক রোগ? কিন্তু সাহেব! সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আজ বেশ বেলা হয়ে গেছে। আরেকদিন সকাল সকাল আসব। এখন ঘরে চলো দেখি। সাহেব, বৌদি চিন্তা করবে দেরি দেখে।
শাওন বিরক্ত হয়ে বলল, এমন কিছুই দেরি হয়নি রঘুদা। সবে দশটা। জল খাবার খাওয়া তো দূরের কথা, মায়ের চা খাওয়াও এত তাড়াতাড়ি শেষ হবার নয়। এক কাজ করো, তুমি চট করে গেস্ট হাউস থেকে বোন আর রাহুলকে ডেকে আনো।একসঙ্গে ঘুরব।
একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর। নিজের মনেই বিড়বিড় করল রঘু। তারপর খানিক কৌতূহল আর খানিক ভয় নিয়েই ম্লান গলায় বলল, ওখানে কারোর আসার কথা আছে? তুমি কারোর সঙ্গে সেখানে দেখা করতে যেতে চাইছ? বলেই তার মনে হল এতটা কৌতূহল দেখানো ঠিক নয়। সে তাড়াতাড়ি জিভ বের করে বলল, ভুল হয়ে গেছে। এটা জানতে চাওয়া উচিত হয়নি আমার।
রঘুর এই কথাকে উপেক্ষা করে শাওন বলল, তোমাদের এখানে ভাল ফটোগ্রাফার আছে?
ছবি তুলবে ? তোমার কাছে মোবাইল নেই? তার ক্যামেরাতেই তো ভাল ছবি আসে। আমায় দাও, তুলে দিচ্ছি।
আমি আমার ছবি তোলার জন্য বলিনি। আমি জানতে চেয়েছি কেউ ছবি তোলেন কিনা ডিজিটাল ক্যামেরায়।
মানে তুমি স্টুডিওর কথা বলছ? না। এই ছোটো জায়গায় কে আর দোকানে গিয়ে ছবি তুলবে!
প্রত্যাশা মতো উত্তর না পেয়ে শাওন বলল, তুমি জঙ্গলের ভিতরে বুড়ো বটগাছটা দেখেছ?
তা আবার আলাদা করে দেখার কী আছে? চারদিকেই তো শুধু গাছ আর গাছ। বেশ বিরক্ত নিয়েই রঘু বলল, এবার চলো দেখি। মেলা বেলা হলো।
তখন থেকে চলো চলো বলে যাচ্ছ কেন বলতো? শাওনর মাথা গরম হয়ে উঠছে রঘুর কথায়। সে যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে ঠান্ডা স্বরে বলল, তোমাদের এখানে কী ভূত আছে?
রঘু যেন বুঝতে পারল শাওন রেগে যাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি বলল, না না ভূত প্রেত কিছু নেই। তবে যেকোনো মুহূর্তে শেয়াল, বুনোশুয়োর এসে যেতে পারে। কখনো কখনো ওই নদী পার করে হাতি ভাল্লুকও এসে পড়ে। তাই বলছিলাম…
যাক, তুমি যে বলোনি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসে, এই আমার ভাগ্য। শাওনের আর ভালো লাগছিল না রঘুর সঙ্গে কথা বলতে। এই লোকটা পুরো সকালটাই তার নষ্ট করে দিল ভেবে সে বলল, চলো এবার ফিরি।
তার কথায় রঘু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দুই বোন তাকে পাগল করে দিচ্ছে একেবারে। সে তাড়াতাড়ি বলল, সেই ভাল। তারপর নিজেই নিজেকে শুনিয়ে একটু জোর কন্ঠে বলল, ভূত বলে কিছু নেই। মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা, জমে থাকা অন্ধকারই ভূত। সেই ভূতের মতো শয়তান আর দুনিয়াতে নেই। যতক্ষণ ঘুমিয়ে আছে ততক্ষণ শান্তি। জেগে উঠলেই কখন যে কী করে বসবে কেউ জানে না।
সেই মুহূর্তে শাওনের মনে হলো রঘুর মধ্যেও একটা ইন্টারেস্টিং মানুষ লুকিয়ে আছে, যার দর্শনবোধ গভীর ।
এগারো.
গেস্ট হাউসের একটু দূর থেকেই শাওন দেখতে পেল দেবপ্রকাশ বারান্দায় চেয়ারে বসে। সামনে বসা কিছু মানুষ আপ্লুত বিগলিত ভঙ্গীতে তাঁর কথা শুনছে। বারান্দার দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে এল ঘরে। সাঁঝবাতি উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে মন দিয়ে বই পড়ছে।
তাকে না ডেকে সে রাহুলকে খুঁজল বাইরে এসে। আশেপাশে দেখতে না পেয়ে মায়ের খোঁজে রান্নাঘরে গেল। সেখানে না পেয়ে মায়ের ঘরে গেল।
শাল্মী তখন বিছানায় পা থেকে মাথা অবধি কম্বলে ঢেকে শুয়ে ছিল। মুক্তো কম্বলের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পা টিপে দিচ্ছিল।
শাওন ঘরে ঢুকে তা দেখে জিজ্ঞেস করল, মায়ের কী হলো? শরীর খারাপ নাকি?
না, না। অনেকক্ষণ একনাগাড়ে রান্না করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাই জিরিয়ে নিচ্ছেন একটু। মুক্তো জবাব দিল।
ও। বলে শাওন শাল্মীর পাশে গিয়ে বসল।
এখন ফিরলি? শাল্মী কম্বল থেকে মুখ বের করে মেয়ের একটা হাত নিজের বুকের উপর রেখে বলল, রাহুলের সঙ্গে আজ অনেক কথা হলো।
শাওন চুপ করে রইল।
রাহুলের মা এবার বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইছেন। তার ঠাকুমার অনেক বয়স হয়েছে। কত দিন থাকেন তার কোনো ঠিক নেই। তিনি যাবার আগে নাতির বিয়েটা দেখে যেতে চাইছেন।
তাই তোমরা আমাকে বিদায় করতে চাইছ?
না রে মা। আসলে রাহুলও বোধহয় তোকে ছেড়ে আর থাকতে পারছে না।
কই আমায় তো কিছু বলেনি রাহুল।
তোকে কখনো কোনোদিন সে কিছু বলেছে? নাকি বললেও তুই কিছু শুনেছিস ? মেয়ের আরেকটা হাতও কাছে নিল শাল্মী। আসলে সে খুব লাজুক। মনের কথা বলতে জানে না। অনেকটা আমার মতো।
সেকি মা! তোমার কোন গোপন কথা আমরা জানি না! আমি তো জানি তোমার মত সুখী আর সমস্যাহীন মানুষ এই পৃথিবীতে নেই। এত অল্পতে তুমি খুশি থাকো যে আমার খুব ভালো লাগে ভেবে যে, এই লোভহীন নিপাট ভালমানুষ মহিলা আমার মা। তারপর মুক্তোর দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলিনি?
মুক্তো কিছু বলার আগেই শাল্মী উঠে বসল। শাওন অবাক হয়ে দেখল শাল্মীর চোখে জল। সে বড় হবার পর থেকে কখনো মায়ের চোখের জল দেখেনি। সে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, কি হলো মা? আমি তোমায় কোনো দুঃখ দিয়ে ফেললাম? কাঁদছ কেন তুমি?
চোখের জল শাড়ির আঁচলে তাড়াতাড়ি মুছে নিয়ে শাল্মী বলল , কাঁদিনি। চল, তোদের খেতে দিয়ে দিই। বেলা অনেক হল। সে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগলো।
শাওন বিহ্বলভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে পড়ল। চল মুক্তো খেয়ে নিই। এবার মনে হচ্ছে খিদেটা পেয়েছে, বলে ড্রইং রুমের দিকে গেল সে।
বারো.
ঘড়ি বলছে এখন সবে পাঁচটা। অথচ দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।দূরের বাড়িগুলোতে এর মধ্যেই আলো জ্বলে উঠেছে।উলু আর শাঁখ বাজার শব্দ ভেসে আসছে। এইসব জায়গায় যত তাড়াতাড়ি ভোর হয়, রাতও তেমনি ঝুপ করে নেমে আসে।
শাওন এখন রাহুলের সঙ্গে নদীর পাড় ধরে হাঁটছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কিন্তু সেটা হাড় কাঁপানো নয়। বেশ কিছুটা হাঁটার পর শাওন পা থেকে চটি খুলে ফেলল। আপন মনেই পায়ের বুড়ো আঙুলটা ভিজে মাটিতে চেপে ঘোরার চেষ্টা করল। ব্যা্লেন্স রাখতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ল।
রাহুলের অবাক লাগছিল। আলো আঁধারে শাওন যেন কোনো অজানা লোকের বাসিন্দা। ভুল করে এই গ্রহে নেমে এসেছে। তার মনে হল এই মেয়েটি তার অচেনা।
শাওন মাটিতে বসে পড়ে নিজের খেয়ালে মাটি দিয়ে কিছু বানাবার চেষ্টায় ব্যস্ত। রাহুল ভিজে মাটিতে বসবে কী বসবে না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত বসেই পড়ল। শাওনের সঙ্গে তার পরিচয় তিন বছর। ইউনিভার্সিটির উল্টোদিকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারার সময় শাওনকে প্রথম দেখেছিল। বলতে গেলে তার টানেই আরো এক সপ্তাহ সে ওই চত্বরে যাতায়াত করে। তারপর এক বন্ধুর সাহায্যে বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে সোজা তাদের বাড়িতে হাজির।
সেখানেই নেমপ্লেট দেখে প্রথম জানতে পারে শাওন মন্ত্রীর মেয়ে। তখন আর ফেরার পথ ছিল না। সে সেইমুহূর্তে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে শাওনকে ডেকে পাঠিয়ে বলে, আমাদের কাগজের জন্য আপনার বাবার একটা ইন্টারভিউ চাই। কিছুতেই তাঁর সময় বা দেখা পাচ্ছি না। ম্যাডাম, আপনাকে একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে যেভাবেই হোক।
এই অদ্ভুত প্রস্তাব পেয়ে শাওন প্রথমে বলে, আপনি মন্ত্রীর পি এ বা পি এস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
তখন সে অনুনয় করে বলে, সেসব চেষ্টা করা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাগজ আর আমি দুজনেই নতুন বলে আমাকে পাত্তা দিচ্ছেন না তাঁরা। তারপর একটু থেমে জানায়, এখন আপনিই ভরসা। আপনার ওপরেই নির্ভর করছে আমার চাকরিটা।
রাহুলের স্বরে এমন একটা আর্তি ছিল যে শাওন তাকে ফেরাতে পারেনি। দেবপ্রকাশের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
ইন্টারভিউ বেরবার পর সে জেনেছিল রাহুল সাংবাদিক নন। শুধুমাত্র তার সঙ্গে যোগসুত্র গড়ে তোলার জন্য সে কাগজের দপ্তরের এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে এই সাক্ষাৎকার নেবার আসাইনমেন্টটা নিয়েছিল।
আসলে সে তখন সদ্য এম বি এ পাশ করে বাবার কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে।ততদিনে শাওনর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও মন দেওয়া নেওয়ার পর্বটি সমাপ্ত।
পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে রাহুল জিজ্ঞেস করল, কী বানাচ্ছ মাটি দিয়ে?
তেমন কিছু না। চেষ্টা করছি কিছু বানানো যায় কিনা। তুমি কিছু বানাতে পারো?
না। আমি হলাম নিরস ব্যবসায়ী মানুষ। লাভ ক্ষতি ছাড়া সেভাবে মাথায় কিছু আসে না।
তাহলে আমার সঙ্গে সম্পর্কটাও এসব হিসেব নিকেশ করে এগিয়েছিলে?
বোকার মতো কথা বোলো না। তোমাকে দেখার মুহূর্তে আমি আদৌ জানতাম না তোমার পরিচয়। তারপর খানিক চুপ করে বলল, জীবনের সবকিছু হিসেব নিকেশ করে হয় না। বিশেষ করে ভালোবাসা। তারপর শব্দ করে হাসল। এইমুহূর্তে অবশ্য আমি তোমাকে বলতে পারি নদীর বালি বা মাটি বিক্রি করে কত টাকা আসতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয় রামকৃষ্ণদেব একটা যথার্থ সত্যদর্শন খুব সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মাটি টাকা টাকা মাটি। যার হাতে মাটি তার হাতেই টাকা।
আকাশে রুপোর থালার মতো পরিপূর্ণ চাঁদ। তার আলো এসে পড়েছে নদী চরে। সাদা বালি চকচক করছে তার ছটায়। মনে হচ্ছে কেউ যেন সারা চর জুড়ে জুঁই ফুল বিছিয়ে রেখেছে। পাখির কলতানে নদীর ধারের গাছগুলো মুখর হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির নিজের হাতে আঁকা সেই মায়াবী ছবির দিকে তাকিয়ে শাওন বলল, পাখিরা যে যার ঘরে ফিরছে। কী অদ্ভুত না! ওদেরও নির্দিষ্ট বাসা আছে।
হ্যাঁ। জীবজগতের সকলেরই নির্দিষ্ট বাসা থাকে। তবে ব্যতিক্রমী জীব মানুষ। বারবার উচ্ছেদ হয়ে তারা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা কেউ বলতে পারে না।হয়তো অন্য কোনো দেশ, শহর , ফুটপাত, রিলিফ ক্যাম্প কিংবা বস্তি…।
শাওন অবাক হলো রাহুলের কথা শুনে। এতদিনের মেলামেশায় সে দেখেছে রাহুল কখনোই কোনো গভীর বিষয় বা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা পছন্দ করে না। জীবনটা খুব সহজ ভাবে দেখতেই সে ভালোবাসে। অথচ এখানে আসার পর থেকে সে কেমন যেন বদলে যাচ্ছে । কবিতা বলছে, দার্শনিক ভাবনা পোষণ করছে। শাওন ভালো করে একবার রাহুলের দিকে তাকালো। স্মিতভাবে হেসে বলল, জানো, তুমি আসায় আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আবার রেগেও আছি তোমার উপর।
রাগ কেন?
আমাকে একবারও বলোনি যে তুমি আসবে!
বললে কি এই মজা এই আনন্দ, ভালো লাগাটা হতো? রাহুল শাওনর হাত নিজের মুঠিতে টেনে নিল।
আসলে রাহুল আমার উচ্ছ্বাসটা কম , কোনো কিছু গুছিয়ে সেভাবে বলতে পারি না।
তাতে কী! আমি তো তোমাকে এতদিন ধরে দেখছি, চিনেছি, ভালোবেসেছি। এটাই কি সব নয়! তাছাড়া আমি তো তোমার। তোমার যা ইচ্ছে হবে আমাকে বলবে। সব মানুষের জীবনেই এমন একজন মানুষের দরকার যার সঙ্গে সব কিছু ভাগ করে নেওয়া যায়।
দুজনেই খানিক চুপ করে থাকার পর, নিজের হাতটা রাহুলের মুঠো থেকে বের করে নিয়ে শাওন বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি এখনো এমন কাউকেই পাইনি।
রাহুল বিস্মিত হয়ে বলল, সেকি ! আমাকেও পাওনি এখনো?
আমি সে কথা বলছি না। তুমি ছাড়া এত কাছের আমার আর কেউ হয়তো নেই। বোন ছিল। কিন্তু সেও তো এখন দূরে। কিন্তু…
তুমি কি এখনো আমাকে পুরোপুরি গ্রহণ বা ভরসা করতে পারোনি ?এখনো আমায় নিয়ে সংশয় আছে? আর ক’দিন বাদেই আমাদের বিয়ে।আর এখন তুমি মনের কথা বলার জন্য আলাদা সঙ্গী খুঁজছ? রাহুলের গলায় একটা হতাশার সুর।
সেটা লক্ষ্য করে শাওন নরম সুরে বলল, তা নয় রাহুল। একদিন হয়তো তুমিই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবে।কিন্তু একটা ভয় কাজ করে এখন। কেন জানি না মনে হয় , বেশিরভাগ স্বামী- স্ত্রীর মধ্যেই নানান গোপনীয়তা। যতটা ভালোবাসার ভাব দেখায় বা সুখী ইমেজ বাইরে দেখাবার চেষ্টা করে আসলে ততটা ভালো তারা নেই।
কী সব বলছ তুমি! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।একটু সোজাভাবে হেঁয়ালি ছেড়ে বলতো কী হয়েছে তোমার? তুমি কী অন্য কারোর প্রেমে পড়েছ? এই দু-তিন দিনে কী এমন ঘটল যার জন্য জীবনটা এত জটিল করে ফেললে?
শাওন উত্তর দিল, এমন কিছুই ঘটেনি। যেমন ছিলাম তেমনিই আছি। আসলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই বড় জটিল। আমার বাবা-মাকেই দেখো না! বাবা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সারাবছরে পরিবারের জন্য হয়তো তাঁর হাতে তিরিশ দিনও নেই। অন্যদিকে, মাকে দেখো, একা হাতে আমাদের বড় করেছেন। সংসারের দায়দায়িত্ব পালন করে চলেছেন নীরবে। কিন্তু দুজনের মধ্যে নিজেদের সুখ দুঃখ নিয়ে শেষ কবে ভালোভাবে গল্প করতে দেখেছি মনে পড়ে না। ছোটো থেকে দেখছি দুজনের মধ্যে এতটুকু চিন্তা ভাবনার মিল নেই।
দেখো , তোমার বাবা একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। যত না পারিবারিক তার থেকে বহুগুণ বেশি সামাজিক হয়ে উঠতে হয়েছে তাঁকে মানুষের পাশে থাকার প্রয়োজনে। তবেই তিনি আজ মন্ত্রী। আর তিনি এই জায়গায় থাকার জন্য তোমরাও কিন্তু তার সুবিধাগুলো ভোগ করছ। তাছাড়া তিনি কিন্তু তাঁর হাজার ব্যস্ততার মাঝেও তোমাদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। একটা জিনিস ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো, তোমাদের আজ বাবাকে নিয়ে যে অহঙ্কার, গর্ব তা কি বাবা এই জায়গায় না থাকলে এতটাই হতো! আর কাকিমার কথা যদি বলো, তবে বলব কাকিমাও কিন্তু কাকুকে নিয়ে দারুণ প্রাউড। স্বামী- স্ত্রীর রসায়ন বোঝার চেষ্টা না করে আমাকে ভালোবাসো সোনা- বলে শাওনের হাতদুটো নিজের হাতে নিল রাহুল।
একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে শাওন বলল, হয়তো তুমিই ঠিক। তুমি আমাকে খুব ভালোবাসবে তো রাহুল? আমার বন্ধু হয়ে উঠবে, আমায় আগলে রাখবে তো?
সেইরকম ইচ্ছাই তো আমার আছে সোনা।
রাহুল শাওনের হাতে মৃদু চাপ দিল। সে লক্ষ্য করল শাওন একদৃষ্টে বালির দিকে তাকিয়ে। তার মনে হল, এই মেয়েটি এখন তার সঙ্গে নেই। সেই আবেগ বা উচ্ছ্বাস সবটাই যেন এই বালিচর শুষে নিয়েছে অজানা লুকোনো কোনো চুম্বক দিয়ে।
সে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি কি তোমাকে কোনো আঘাত দিয়ে ফেলেছি? তুমি কি আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছ? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি অনিচ্ছাকৃত কোনো দুঃখ দিয়ে থাকি, আমায় মাফ করে দাও।কিন্তু এমনভাবে থেকো না। এত জটিল হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারি না। তুমি তো জানো আমার কাছে জীবন একটা সাদা খাতার মতন। সব সময় ভাল ভাল অনুভূতি দিয়ে সেগুলো ভরে রাখতে হয়। নেগেটিভ কিছু এলে সেগুলো ডিলিট করে দিতে হয়- বলে সে হাসল,এই ভাষাটা আমার নয়, সাঁঝবাতির। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ! রাহুল আবার হাসল।
রাহুলের দিকে একবার তাকিয়ে শাওন খানিক চুপ করে থাকল। নরম মাটিতে সে আঁচড় কেটে কিছু লিখল।তারপর বলল, চলো। ঘরে যাই।
এখনি?
হ্যাঁ। আমার শীত করছে। শাওন উঠে পড়ল। রাহুল উঠে পড়ার আগে দেখল, ভিজে মাটিতে লেখা , আমাকে তুমি নাও, তোমার মতো করে, আমাকে তুমি আঁকড়ে ধরো, কক্ষ পথে আটকে থাকা গ্রহের মতো- মাধ্যাকর্ষণ যতই টানুক, থেকো আমায় ধরে, চাঁদের টানে জোয়ার এলে ভাসিয়ে দিও না। ভাঁটার জলে সামলে রেখো বুকের মাঝখানে। আমাকে তুমি জড়িয়ে থেকো আমার মতো করে।
চলবে…
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১ ফ্লাশিং এর লাস্টস্টপে এসে ট্রেনটা থেমে গেল। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি অসংখ্য…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Last Episode) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>>…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-5) পূর্ববর্তী পর্ব এখানে>>> শেষ…..
ইংরেজি ভার্সান এখানে >>> Welcome to the Pataquerical Night Show (Episode-4) পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখানে>>>>…..