ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
আগের পর্ব পড়ুন এখানে…
তেরো.
গেস্ট হাউসে ফিরে শাওন নিজের ঘরে এল। দেখল, সাঁঝবাতির একটা পা আরেকটা পায়ের উপর তোলা। বালিশে ঠেস দিয়ে বসে সে যথারীতি মন দিয়ে কিছু পড়ছে। সেই সকালের পর সেভাবে আজ আর তার সঙ্গে শাওনের দেখা হয়নি। সে আজ খেতেও নামেনি নিচে।
শাওন ঘরে ঢুকে গায়ের শালটা বিছানায় রাখল। তারপর বলল, কিরে, শেষ অবধি কে জিতল তোদের খেলায়?
রাহুল। তোকে বলেনি? অবশ্য রাহুল নিজে থেকে তো আর জেতেনি। আমি ইচ্ছে করে তাকে জিতিয়ে দিলাম।তাই বোধহয় বলেনি।
তা কিভাবে জেতালি?
আসলে আমিই জিতছিলাম। হঠাৎ মনে হলো রাহুল এবাড়ির জামাই হতে চলেছে, ওকে জিতিয়ে দিই।আর তখনি আমার পায়ে টান ধরে গেল। ব্যস, রাহুল এই সুযোগটা নিয়ে নিল।খেলা শেষ।
তা সত্যি কি টান ধরেছে ? ওষুধ লাগিয়েছিস কিছু?
আরে না। তেমন কিছু নয়। রাহুলের মুখের অবস্থা দেখেই আমার টান উধাও। মনে হচ্ছিল আমার নয়, তার পায়েই চোট লেগেছে।
বোনের কথা শুনে শাওন ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর বলল, তুই দিন দিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। সে বেচারা তোকে কত স্নেহ করে আর তুই কিনা! একটু থেমে বলল, যাক, বাদ দে। এখন বলতো তুই কবরখানাটা ঠিক কোথায় দেখেছিলি?
বললাম তো তোকে। জঙ্গলের মধ্যে। তুই গেছিলি?
যাব বলেই তখন বেরলাম। কিন্তু কেউ বলতে পারল না কোথায় সেটা।
কেউ মানে রঘুদা তো! সে কিছুই জানে না। কিন্তু সেটা আছে।আমি সচক্ষে দেখেছি।
কী দেখেছিলি?
একটা উঁচু ঢিপি। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পুরোনো। চারপাশ গাছপালায় ছেয়ে গেছে।তার মধ্যেই একটা ফলকে লেখা উইলিয়ম রিচার্ড।জন্ম ১৮৫০।মৃত্যু ১৮৫৮। ভাব দিদি অতটুকু একটা বাচ্চা কিভাবে কোথায় মারা যাচ্ছে!
হুঁ। বলে চুপ রইল শাওন। বোনের কথা কতটা বিশ্বাস করা যায় বুঝে উঠতে পারছিল না সে। বোনের দিকে তাকিয়ে বলল , আমায় নিয়ে যেতে পারবি সেখানে?
না পারার কী আছে? এখন যাবি? বলে বিছানা থেকে তড়াং করে নেমে পড়ল সাঁঝবাতি।
সেদিকে তাকিয়ে শাওন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, এখন নয়। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল পরশু যাব। তুই পড়। আমি মাকে দেখে আসি। বলে শাওন শাল্মীর খোঁজে গেল।
চৌদ্দ.
শাল্মীর ঘরের দরজা ভেজানো। দরজার বাইরে বারান্দায় চেয়ারে বসে দেবপ্রকাশ। গম্ভীরভাবে সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে কিছু ভাবছেন। শাওন তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে মেয়েকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু হাসি এল না। তিনি চোখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্য দিকে।
শাওন এবার সামনে গিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞেস করল , কী হয়েছে বাবা? তুমি এখন বাইরে বসে কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে যে! মা কোথায়?
তিনি ঘরে । কী যে হয় তাঁর ! অকারণেই চেঁচায় ।কাঁদে । তারপর মাথা ধরে গেল বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন। আর মাথারই বা কী দোষ! দিনের পর দিন যদি একটা মানুষ না ঘুমিয়ে জেগে থাকে তবে তাঁর মাথা এমনিতেই ধরতে বাধ্য।
মা ঘুমায় না? তুমি কী করে জানলে? তুমি তো অর্ধেক দিন থাকোই না।
ঠিক। বেশিরভাগ থাকি না। কিন্তু যে কটা দিন থাকি সেই দিনগুলোয় তো দেখতে পাই।একটা মানুষ পাশে শুয়ে অথচ… দেবপ্রকাশ চুপ করে গেলেন।
তাহলে তো এবার একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হয় বাবা।
কতবার বলেছি। এখন কী আমাদের ডাক্তারের অভাব! যাকেই বলব , তিনিই এসে দেখে যাবেন। কিন্তু তোমার মা শুনলে তো! বেশি বললে আরো অশান্তি। দেশ উদ্ধার করছ করো। তাই নিয়েই থাকো। আমি মরলাম না বাঁচলাম তা তোমার জানার দরকার নেই। বলে চিৎকার করে উঠবে। তখন মনে হয় এর থেকে যেমন আছে থাকুক। একটু থেমে আবার বললেন, আমি যা করেছি বা করছি সব তো তোমাদের জন্যই । তোমরা ছাড়া কে আর আছে আমার! ছোটবেলায় যে সুযোগগুলো আমি পাই নি, সেগুলো যাতে আমার পরিবার পায় তার জন্যই তো এত লড়াই। খানিকক্ষণ নীরবতা।
জানিস মা, কী ভীষন পরিশ্রম করতে হয়েছে আমায় এই জায়গায় আসার জন্য। একেবারেই ছাপোষা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে আমি।এক সময় প্রচুর অর্থ ছিল। কিন্তু তা চোখে দেখিনি। বাবা একটা সামান্য চাকরি করতেন। তাই দিয়েই পাঁচ ভাই বোনের পড়াশোনা থেকে যাবতীয় দায়দায়িত্ব মিটিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতে স্বচ্ছল ভাবে কী চালানো যেত! কোনোরকমে টেনেটুনে মা সংসার চালাতেন। অধিকাংশ মাসেরই শেষদিকে শুধু ডাল ভাত আলুসেদ্ধ দিয়েই খাওয়া হতো দু’বেলা।
সেখান থেকে বেরিয়ে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি।তাই নিজে যা পাইনি সেগুলো সব তোদের দিতে চেষ্টা করি। এত কাজের মধ্যেও তোদের যে নিয়ে এলাম এখানে, তা কি শুধু আমার একার আনন্দের জন্য ! তোরা, বিশেষ করে তোদের মা যাতে একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পায় তারজন্য-ই তো!। অথচ তোর মাকে দেখ, এখানে এসেও সেই রান্নাঘর, অথবা ঘরে শুয়ে। বেরনোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই। এত সুন্দর আশপাশটা ,একটু হেঁটে এলেও তো মন ভালো থাকে।
এতক্ষণ বাবার কথা মন দিয়ে শুনছিল শাওন। সে এবার বাবার হাতে মাথা রেখে বলল, বাবা, এত চিন্তা কোরো না। আমরা তো আছি। হয়তো সত্যি মাথা ধরেছে । ওয়েদারটা তো এখানে আলাদা।
কী জানি! ভালো লাগে না আর। পঁচিশ বছর বয়সে যখন তোর মাকে বিয়ে করি তখন তার কীই বা বয়স! বছর কুড়ি।আমি তখন একটা সাধারণ সেলসম্যান। তোর মায়ের উৎসাহেই আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলাম। আজ আমি যতটুকু করেছি, যেখানে পৌঁছেছি ,সব তোর মায়ের জন্য । সে কত কষ্ট সহ্য করেছে আমাকে এই উচ্চতায় দেখার জন্য । লেগে থেকেছে আমার পিছনে, দিনরাত নিজের পড়ার পাশাপাশি আমাকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছে। আর এতদিন বাদে যখন সত্যি আমি সফল – সম্মান, প্রতিপত্তি, অর্থ, নাম, যশ … তখন তোর মা যদি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে আমার কী ভাল লাগে! দেবপ্রকাশ ভেঙে পড়লেন।
বাবা, এমন কোরো না। মায়ের তেমন কিছু হয়নি। আর মায়ের ডিপ্রেসন আছে বলেও তো বুঝতে পারিনি কখনো।তুমি একটু বেশিই ভাবছ। আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলব, যাতে ফিরে গিয়ে ডাক্তার দেখায়। শাওন এতটাই আত্মপ্রত্যয় আর অভয় দিয়ে কথাগুলো বলল, যে দেবপ্রকাশের মনে হলো, আর কী চাই এ জীবনে! এত সুন্দর দুটো মেয়ে আমার। এদের জন্যই বেঁচে থাকা!
সে শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। যা মা, মায়ের ঘরে গিয়ে দেখ। শাওন বাবার কপালে চুমু খেয়ে সেদিকে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে রইল দেবপ্রকাশ। মেয়েগুলো আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল। কিন্তু শাল্মী! তাকে আর কোনোদিন ফিরে পাব আগের মতো করে! গত দশবছর ধরে যে ভাঙন শুরু হয়েছে তা’তো কেবল বেড়েই চলেছে। আমিও দায়ী এর জন্য। পারিনি তার ভালোবাসার, আত্মত্যাগের পুরো মর্যাদা রাখতে! দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়লেন মন্ত্রীমশাই।
আমি তো নিজের মেয়েদেরও ঠিকমত সময় দিতে পারি না! মাকেও কী ভাল রাখতে পেরেছিলাম! শেষের দিকে তার সঙ্গে ভালো করে দেখাও হতো না। তিনিও শেষ অবধি শাল্মীর উপরেই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। বড়মেয়ের সঙ্গে অত গায়ে ল্যাপটানো সম্পর্ক না হলেও ছোটমেয়ে সাঁঝবাতি ছোট থেকেই বাবা অন্ত প্রাণ। তাকেই বা কতটা সময় দিতে পারি ! ছোটোবেলায় মেয়েটা না ঘুমিয়ে বসে থাকত কখন আমি ফিরব- এই আশায়। ফিরে শুধু জামা খোলার অপেক্ষায়। তারপর খালি গায়ে জাঙ্গিয়া পরেই শুরু হতো কোমর দুলিয়ে নাচ। কথাগুলো মনে পড়তেই একা একাই হেসে ফেললেন দেবপ্রকাশ।
তারপরেই যেন শুনতে পেলেন শাল্মীর চিৎকার। রাতদুপুরে তোমাদের বাপ-মেয়ের তান্ডব নৃত্যে পাড়ার সবাই জেগে উঠল বলে! মাঝরাতে যত পাগলামি! সেই শুনে বাপ- বেটিতে হেসে গড়িয়ে পড়ে নতুন উদ্যমে আবার নাচতে শুরু করত, এমনকি কোমর দোলাবার জন্য শাল্মীকেও বাধ্য করত। কোথায় যে হারিয়ে গেল সেইদিনগুলো! ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তার।
মেয়েদুটোর সঙ্গে কতদিন ভালো করে গল্প হয় না।
সাঁঝবাতি এখন কতদূরে থাকে। তার আর কতটুকু খবর নিতে পারি! দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে দপ্তরে, মিটিং-এ, কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসাবে। বাকি সময়টা কাটে কর্মীদের আর স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে জনসংযোগে। তার মধ্যেই কার ছেলের কলেজে ভর্তি ,তার মেয়ের বিয়ে আটকে গেছে,অমুকের বদলি, কার বাড়ি নিয়ে ঝামেলা… এমনকি স্বামী- স্ত্রীর ঝগড়াও তাকেই মেটাতে হবে। কেন রে বাবা, নিজেদের ব্যক্তিগত ঝামেলা বাইরের লোকের কাছে হাট করা! প্রথম প্রথম খুব রাগ হত। থাকতে পারছিস না যখন ডিভোর্স কর, ভালো উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নে। তা না, যা কিছু হবে সবেতেই মন্ত্রী।আমি যেন যাদুকর। মন্ত্র বলে একনিমেশে সব সমস্যা দূর করে দেব। কিন্তু এমন ধৈর্য হারালে চলবে না। তুমি এখন শুধু দুই মেয়ের বাপ কিংবা শাল্মীর বর নও, তুমি এখন রাজ্যের মন্ত্রী- উন্নয়ন মন্ত্রী। কথাটা ভেবেই নিজের মনেই হেসে উঠল দেবপ্রকাশ। মন্ত্রী হবার আগে মনে করতাম, অনেক কাজ আছে এই সমাজের জন্য, মানুষের জন্য। কিন্তু গদিতে বসে বেশ বুঝেছি, ‘উন্নয়ন’ বলে কোনো কিছু হয় না।এটা আসলে একটা ইউটোপিয়ান ভাবনা। এখানে জনসংযোগ ভালভাবে রাখতে পারাটাই উন্নয়ন। বাকি সব এমনিই হয়ে যায়…।
পনেরো.
শাল্মীর ঘরের সামনে গিয়ে শাওন মা… মা বলে বার তিনেক ডেকেও কোনো সাড়া পেল না। মিনিট দুয়েক সেখানেই অপেক্ষা করল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে বাবার দিকে তাকালো। বারান্দার অল্প আলোয় সে দেখল বাবা উদাসভঙ্গীতে সামনের দিকে চেয়ে। মনে হচ্ছে কোনো গভীর ভাবনায় মগ্ন। সেই দৃষ্টিটা বড় শূন্য আর নিঃসঙ্গ বলে মনে হল। কী জানি বোধহয় আমারই ভুল, ভেবে সে নিজেদের জন্য বরাদ্দ ঘরে ফিরে গেল।
ঘরে এসে দেখল সাঁঝবাতি তখনো উপুড় হয়ে শুয়ে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে বই পড়ছে। মেয়েটা বই পেলে সব ভুলে যায়, ভেবে শাওন বোনের পিঠে আলতো করে হাত রাখল।
এখনো পড়ছিস?
হুঁ। বই থেকে মুখ না তুলেই সাঁঝবাতি বলল, তুই শুয়ে পড় দিদি।আমার আর কয়েকটা পাতা বাকি।শেষ করে নিয়ে শোবো।
লাইট জ্বললে ঘুম আসবে না রে। তারচেয়ে তুই শেষ করে নে। আমি পাশে শুয়ে থাকব। বলে সরে গিয়ে পোশাক পালটিয়ে একটা লাল ম্যাক্সি পরল। আয়নার সামনে গিয়ে হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করে গার্ডার দিল। তারপর বোনের পাশে আরেকটা বালিশ টেনে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। একটা টিকিটিকির ডাক শোনা গেল। দূরে কোথাও পেঁচা ডাকছে। আরো কিছুক্ষণ এভাবে অতিক্রান্ত হবার পর শাওন নীরবতা ভঙ্গ করল।
তোকে দেখে আমার খুব ভাল লাগে রে বোন। কোনো কিছুকেই বেশ পাত্তা দিস না। নিজের মত বই নিয়ে ব্যস্ত। আশেপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে তোর কোনো মাথা ব্যথা নেই।
মুখ না তুলেই সাঁঝবাতি বলল, কে বলল তোকে? আমার তিনটে চোখ, মা দুর্গার মতো। সব দেখতে পাই। সব বুঝি। কিন্তু প্রকাশ করি কম। কারণ সত্য প্রকাশিত হলে অনেক সময়ই সাজানো জিনিস ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। তাছাড়া এখন আমি দূরে থাকি।কী দরকার সব বিষয়ে মাথা ঘামানোর!
কী যে বলিস তুই বুঝি না। তবে তোর কথা শুনতে ভালো লাগে।
আসলে কী জানিস দিদি, আমি ভাল থাকতে ভালবাসি। নিজেকে ভালো রাখা একটা আর্ট। সেটা অবশ্য একটা দীর্ঘকালীন অভ্যাস।
তাই?
হ্যাঁ।এই ধর তোর কথা। তোকে খুব সহজে সুখী করা যায়, আবার পরমুহূর্তেই কাঁদানো যায়। এই ভাল আছিস আবার পরক্ষণেই মুড অফ। এটা তোর নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাবে ঘটে।
চুপ করতো। খালি পাকা পাকা কথা। বোনকে প্রশ্রয়মিশ্রিত বকুনি দিয়ে দিদিসুলভ ভঙ্গীতে বলল শাওন। এগুলো হচ্ছে অতিরিক্ত নাটক নভেল পড়ার ফল, বুঝলি!
দিদি একটা কথা বলব? রাগ করিস না। বলে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বলল, তুই আজও জঙ্গলে যেতে চাইছিলি পিয়ালের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তোর বোধহয় যাওয়া হয়নি। তাই তোর মেজাজ ঠিক নেই।
মানেটা কী? আমি কেন তার সঙ্গে দেখা করতে যাব? জঙ্গলে যেতে চাইছিলাম কবরের জায়গাটা দেখবার জন্য। কিন্তু কেউ বলতেই পারল না।
রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি এমনি বললাম। মনে হলো পিয়ালকে তুই আবার দেখতে চাইছিস। কারণ তার সম্পর্কে তোর একটা কৌতুহল তৈরি হয়েছে। আর সেটা খুব স্বাভাবিক।
আমি তার কথা মোটেই ভাবিনি। ইচ্ছে হয়েছিল জঙ্গলে যেতে। রাহুলকেও বলেছিলাম, কিন্তু সে তোর সঙ্গে খেলাটা বেশি পছন্দ করল।
হয়তো তুই সেটা ভেবেই যাচ্ছিলি। কিন্তু দিদি জানিস ,মানুষের অবচেতন মনের মধ্যে আরেকটা জগৎ আছে। অনেক সময় সে সেখান থেকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে।আমরা সেটা বুঝতে পারি না।
তুই কি আজকাল সাইকোলজি নিয়ে পড়ছিস?
না, তবে আমি কিছুটা বুঝি। এই যেমন বুঝি তুই রাহুলকে ভালোবাসিস , অথচ তোর সাবকনসাস মাইন্ডে অন্য কারোর ইমেজ। সেটা রাহুল নয়। তুই সেই ইমেজকে খোঁজার চেষ্টা করিস, তাই এতদিন পরেও রাহুলকে তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরতে পারছিস না।
আবার ভুলভাল কথা! এবার কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি আমি।
দিদির কথায় সাঁঝবাতি বেশ জোরে হেসে উঠে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেল।
ছাড়। ছাড় বলছি।
সে আরো জোরে দিদিকে জাপটে ধরল। তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, পরের কথাগুলো শুনলে তুই আমায় শুধু বকবি না, মারবিও।
আরো কী বলবি ! এতেই তো আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম। রাতদুপুরে কার পাল্লায় পড়লাম!
দিদি, এই যে তুই ভাবছিস রাহুল তোকে খুব ভালোবেসে, তোর টানেই থাকতে না পেরে এখানে চলে এসেছে, হয়তো সেও তাই ভেবেই এসেছে, কিন্তু সে আসলে নিজেই জানে না সে কাকে চায়!
কী বলতে চাইছিস তুই?
না, জোর দিয়ে কিছু বলছি না, নেহাতই একটা অনুমান মাত্র। ভুল হতেই পারে।
পরিস্কার করে বল। শাওনের গলায় উৎকন্ঠা।
দিদি, একটু থেমে সাঁঝবাতি বলল, আমার কেন জানি না মনে হয়, তোর থেকে সে আমার সান্নিধ্যে থাকতে বেশি ভালবাসে। আবার একটু থামল সে। তুই আমায় ভুল বুঝিস না। আমি তোকে প্রমাণ দিতে পারি। আগের ঘটনা বলছি না। আমি হোস্টেলে থাকাকালীন সে আমাকে অনেক টেক্সট ও ফোন করে, সেগুলো নিয়েও বলছি না। শুধু এখানে এসে থেকে যা যা ঘটেছে, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বলছি। প্রথম দিন থেকে দেখ। আমি তাকে বললাম , শীতের সন্ধ্যায় নদীতে স্নান করতে, সে কোনো কিছু না ভেবেই স্নান করে নিল। তারপর তাকে বললাম , নদীর ধারে বসে চা খেতে ভাল লাগে।সে তাই খাচ্ছে। ভোরবেলা না উঠলে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা যায় না বললাম, দেখলাম সে ভোর পাঁচটায় উঠে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নদীর ধারে ঘুরছে।
চুপ কর। আমার এখন এসব শুনতে ভালো লাগছে না।
শোন দিদি। না ভালো লাগলেও শোন।এটা তোর জীবনের সঙ্গে জড়িত। তুই রাগ করিস না। একটু ভেবে দেখ, তুই তাকে জঙ্গল দেখতে যেতে বললি। সে তোর সঙ্গে না গিয়ে আমার সঙ্গে খেলাটা বেশি পছন্দ করল। আমার পায়ে টান ধরায় আমি যা কষ্ট পেলাম, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল আমার থেকে বেশি যন্ত্রণা তার হচ্ছে। আমার পা টেনে টেনে কতবার ম্যাসাজ করে দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরপর এসে খোঁজ নিয়ে গেছে ,আমি কেমন আছি।
একটু থেমে দিদির দিকে তাকালো সে।
শাওনের মুখ ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে উঠছিল। সে আবার বলতে শুরু করল, সবচেয়ে যেটা বড়ো ব্যাপার, তুই কখনো জেনেছিস বা জানতে পেরেছিস যে রাহুল কবিতার ভক্ত! সম্ভবত রাহুল কোনো দিনই কবিতা পড়েনি। এক পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্গত কবিতা ছাড়া। তাও পড়েছিল কিনা আমার সন্দেহ আছে যথেষ্ট। অথচ এখানে এসে থেকে সে কারণে- অকারণে কবিতা আওড়াচ্ছে। যদিও সেগুলো সবই একটা দীর্ঘ কবিতার অংশ- তবুও। তুই তো কবিতার ভক্ত নোস। তোর দুনিয়া তো কেবল পাঠ্য বইয়ে আটকে। তাহলে রাহুল তোকে কবিতে শুনিয়ে ইমপ্রেস করবে এমন ভাবা যায় না। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, যে কবিতাটা বলছে , সেটা আমার খুব প্রিয় কবির লেখা। আমিই একদিন রাহুলকে তাঁর নাম বলেছিলাম কথা প্রসঙ্গে। সে বইটা এনে আমাকে দিয়েছে। আমার ধারনা সে আমাকে ইমপ্রেস করতেই বইটা কিনে মুখস্থ করেছে। দেখবি তুই?
না। প্লিজ এবার থাম। সাঁঝবাতির মুখ চেপে ধরে তাকে থামাবার চেষ্টা করল শাওন। হিসহিস করে বলল, আমি আর কিছু শুনতে , দেখতে বা জানতে চাই না। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তুই রাহুলের প্রেমে পড়েছিস। আমাকে রাহুলের থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এইসব কথা বলছিস।
দিদি! স্বপ্নেও এসব ভাবিস না- খুব ঠান্ডা গলায় সাঁঝবাতি বলল, রাহুল আমার পছন্দের পুরুষ নয়। যতই হ্যান্ডসাম আর পয়সা থাকুক না কেন, মেধা না থাকলে সে পুরুষ আমার নজরে আসে না। তোকে আরেকটা প্রমাণ দিতে পারি। তাতে তুই বুঝতে পারবি আমি ভুল বলছি না! মিলিয়ে নিস।
বিশ্বাস অবিশ্বাসের এক দোল নিয়ে শাওন বলল, কী?
কাল রঘুদা বলেছে, নদীতে নৌকা করে ঘোরা হবে। আমি বলব, ‘আমি যাব না। তোরা যা’ – দেখ সে কী বলে! আমি নিশ্চিত সে কিছুতেই যাবে না আমায় ছেড়ে। কিন্তু তুই যদি নাও যাস ,আমি গেলে সে যাবেই। আমি নিশ্চিত বাজী রেখে এ কথা বলছি।
তুই যা বলছিস ভেবে বলছিস!
একদম। দায়িত্ব নিয়ে বলছি।
তাহলে সে যে এখানে এসে মা –বাবাকে বলেছে এবার তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় আমায়, সেটা মিথ্যে? আমার মনে হচ্ছে তুই কোথাও বুঝতে ভুল করছিস…
তাহলে তাই। আচ্ছা চল, আমি শুলাম। ঘুম এসেছে খুব। বলে বড়ো করে হাই তুলল। মুহূর্তেই মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
শাওন কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল। নিঃস্তব্ধের ঘড়ি টিকটিক করে প্রহর বাড়ার ঘোষণা সংকেত দিচ্ছিল। সে বোনের বালিশের পাশে উলটে রাখা বইটা হাতে নিয়ে ওল্টালো। বইয়ের উৎসর্গ পাতার ওপরের সাদা অংশে সবুজ কালি দিয়ে লেখা- আতস কাচ দিয়ে মেপে নিই সম্পর্কের রঙ। সব রঙ মিশে গেলে রঙিন মন নিয়ে হাত ধরি তোমার।
আমার তোমাকে,
রাহুল।
শাওনের মনে হলো তার চারদিক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। এমনকি নিজের হার্টবিটটাও বুঝি থেমে গেছে। একটা হিমশীতল অনুভূতি নিয়ে সে যেন নিকষ কালো অন্ধকারে অচেনা কোনো রাস্তায় এসে পড়েছে। ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তার চোখ ভরে গেল জলে।বালিশে মুখ গুঁজে সে কাঁদতে লাগল। সেই কান্না রাহুলের জন্য, নাকি সম্পর্ক থেকে মুক্তির- সেই মুহূর্তে নিজেও বুঝতে পারল না। শুধু একটা সুঁচ ফোটানোর মত যন্ত্রণা ঘিরে থাকল তাকে।
ষোলো.
ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল শাল্মী। তার আজকাল কোনোকিছুতেই ভালো লাগে না, আনন্দ হয় না। মাথার এই যন্ত্রনাটা প্রায় ক্রনিক রোগের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ডাক্তার দেখালে ভালো হয়। অথচ সেটাতেও এক ধরণের আলিস্যি কাজ করে। কখনো কখনো ইচ্ছে করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে। তখনি তার বাবার মুখটা মনে পড়ে।বাবা ক্রমশ ঘুমের ওষুধের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছিল যে দুপুরেও ওষুধ খেত। দিনে দিনে ডোজের পরিমান বেড়ে যাচ্ছিল। শেষের দিকে কোনো ওষুধই আর ঘুম পাড়াতে পারত না। অথচ সারাদিন একটা ঘোর আর আচ্ছন্নের মধ্যে থাকত। হাত পা সবসময় কাঁপত।
না, আমি এভাবে ওষুধ খেয়ে নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নিতে পারব না। তার থেকে এভাবেই ঠিক আছি। একদিন না একদিন ঠিক ঘুম আসবেই- নিজেকে বোঝায় শাল্মী।
আমার কি একজন সাইকিয়াটিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার? আমি মনোরোগী হয়ে পড়ছি? সকাল থেকে ঘরের কাজকর্ম, রান্না, শাওন কলেজে বেরিয়ে গেলে স্নান পুজো খাওয়া… এই অবধি ঠিকই থাকি। তারপরেই কী ভীষন নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে। যত সময় গড়ায় সেই একাকীত্ব ক্রমশ মাথার যন্ত্রনায় পরিনত হয়। তখন আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। খালি চুপ করে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকা ছাড়া। মাথা অবধি টানা চাদরটা মুখ থেকে সরিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল।
আচ্ছা, দেবের সঙ্গে আজ কত বছর হলো ঠিক করে কথা হয়নি! দশ… বারো…পনেরো… কে জানে! এইমুহূর্তে কিছুই মনে পড়ছে না। শেষ কবে সে আমায় আদর করেছিল, তার বুকে মাথা রেখেছিলাম! না, মনে পড়ছে না। অথচ ফুলশয্যার রাতটা মনে পড়ছে। শাল্মী চোখ বন্ধ করল।
ও বড়দি কাকে ঘরে আনলে ? এমন নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েমানুষ তো বাপের জন্মে দেখি নি। বৌভাতের পরদিন ভোরবেলায় দরজা খুলে বাইরে বেরনো মাত্র খুড়শাশুড়ি চিৎকার করে সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন।
শাল্মী বুঝতেই পারছিল না ঘর থেকে বেরনোমাত্র কী ঘটল! কাল রাতে সবাই মিলেই তো তাকে হাসি ঠাট্টা করতে করতে দেবের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি করে কপাল অবধি ঘোমটাটা ভালভাবে টেনে নিল। আর তখনি মাঝের ঘর থেকে শাশুড়ি বেরিয়ে এসে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার অনাবৃত শরীরের অংশের দিকে তাকিয়ে দেখে টানতে টানতে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। একটু লজ্জাবোধ নেই তোমার! মা কিছুই শেখায় নি?
বাথরুমে দাঁড়িয়ে সে অনেকক্ষণ বোঝার চেষ্টা করেছিল কী এমন করছে সে! বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল। নবাব নন্দিনী এতক্ষণ বাথরুম আটকে রেখো না, এখানে একটাই টয়লেট। সে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নতুন শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাইরে এসেছিল। অবাক হয়ে দেখছিল ননদ , দেওর সহ আরো অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সেখান থেকে দৌড়ে তার জন্য বরাদ্দ ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল সে।তখনি নজরে এল দুই গাল, গলা, ঘাড় , ঠোঁটের উপর… সব জায়গাতেই রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে।
অপমানে রাগে তার চোখ ঝেপে জল এলো। এর জন্য আমি দায়ী! আমি খালি পুতুলের মতো নিশ্চুপভাবে শুয়েছিলাম। এদের ছেলে তো সারারাত ধরে… এগুলো তারই চিহ্ন। তাকে না বলে কেন আমাকে বলছে এরা! মাকেও তুলে এনে কথা শোনালো।
মনের মধ্যে রাগ চেপে চুপ থাকল সে। শুধু রাতে দেবের সঙ্গে এক ঘরে শুতে অস্বীকার করল। মৃদু অথচ দৃঢ় কন্ঠে সে জানিয়ে দিল, ওই ঘরে ভূত আছে। আমাকে কাল খুব মেরেছিল। গায়ে হাত পায়ে এখনো ব্যথা।ওই ঘরে আমি কিছুতেই শোবো না। যদি আবার…
অষ্টমঙ্গলা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে আর দেবের ঘরে ঢোকেনি। শেষঅবধি শাশুড়ি মা অনেক বুঝিয়ে তাকে দেবের কাছে পাঠাতে পেরেছিলেন।
শাল্মী ক্রমশ দেবকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। সে লক্ষ্য করেছিল, মানুষটার মধ্যে অপরকে আকর্ষণ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আর আছে এক আত্মপ্রত্যয়। নানান কথার মধ্যে দিয়ে সে এটাও বুঝেছিল, দেব এই সামান্য চাকরি করার জন্য জন্মায়নি। কিন্তু সঠিক দিশা পাচ্ছে না বলে বিকল্প কিছু ভাবতে পারছে না।
শাল্মী বাড়িতে না জানিয়ে খোঁজ নিতে শুরু করল, রাতে কোথায় কী পড়ানো হয়। যে কটি খোঁজ পেল, সেখান থেকে বেছে নিল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট। প্রায় জোর করেই সেই সান্ধ্য ক্লাসে ভর্তি করল দেবকে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ত দেব। নুন চিনির জল আর কড়া চা মুড়ি খাইয়ে সে ম্যা্নেজমেন্টের ভারী ভারী বই নিয়ে বসত তার পাশে। তারপর গল্প বলে ছেলে ভোলানোর মতো করে পড়া বোঝাত দেবকে। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেত সে।
শাল্মীর খুব মায়া হতো তার করুণ ক্লান্ত মায়াময় ঘুমন্ত মুখ দেখে।কিন্তু পরমুহূর্তেই জেদ চাপত। না, যেকোনো মূল্যেই দেবকে পরীক্ষায় সফল হতেই হবে। সে নিজেই যোগাযোগ করল দেবের সতীর্থদের সঙ্গে। তাদের থেকে নোট নিয়ে এসে নিজের কাজের ফাঁকে সেগুলো টুকে রাখত খাতায়। রাতে দেবকে সেগুলোই মুখস্ত করাতো।
এর জন্য কী কম অশান্তি হয়েছে! শাশুড়ি মা নিয়ম করে গাল দিতেন। আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে এই রাক্ষুসী।কী নিষ্ঠুর মেয়ে, শরীরে মায়া-দয়া কিছু নেই! এমন মেয়ে আমার সংসারে এল! কবে যে এর হাত থেকে আমার ছেলেটা মুক্তি পাবে! সেইসব অপমান, অশান্তি নীরবে সহ্য করেছে সে, শুধু দেবকে ভালো জায়গায় পৌঁছে দেবার জন্য।
দেব তার সেই পরিশ্রমের মূল্য দিয়েছে। ভালভাবে পাশ করে ক্যামপাস থেকেই সিলেক্ট হয়ে যোগ দিয়েছে নামকরা সংস্থায়। তখনো তাদের দুজনের মধ্যে শান্তি, সুখ ছিল, এক সঙ্গে ছুটির দিনে বেরনো ছিল। দুই মেয়ে আর তারা- জীবনটা নানান চড়াই উতরাইয়ের মাঝেও মাঝ নদীর শান্ত ঢেউয়ের মত ছিল।
তারপর কবে যেন ধীরে ধীরে সব পালটে যেতে শুরু করল। মেয়ে আর সংসার নিয়ে ব্যস্ততার মাঝে নজর পড়েনি দুজনের মাঝে ফাটল ধরে গেছে কখন। দেব ততদিনে চাকরি ছেড়ে আইন নিয়ে পড়ে কোর্টে যাতায়াত শুরু করে দিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ল। এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী।
মানুষ তাকে চেনে মন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে।সর্বত্রই তার সম্মান ও গুরুত্ব। এটাই তো চেয়েছিল সে। তবু কেন এত নিঃসঙ্গতা, এত যন্ত্রণা তার বুকের মধ্যে জমা!
শাল্মী বুঝতে পারে না সে ঠিক কী চেয়েছিল! তার চাওয়া-পাওয়াগুলো সব কেমন গুলিয়ে গেছে। কতবার ভেবেছে এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে, কতবার মনে মনে অন্য সম্পর্ক খুঁজেছে। পরমুহূর্তেই মুহূর্তেই গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। অচেনা কারোর সঙ্গে চলার থেকে চেনা শত্রু ভাল । নতুন করে মানিয়ে নেওয়ার থেকে মেনে নেওয়াই অধিক সুবিধার বলে তার মনে হয়েছে। তাছাড়া দুটো মেয়ের দায়িত্ব তার। বাড়িতে নানান ধরনের মানুষের আনাগোনা। তাদেরকে ঠিক মতো রাখাটাও তার মা হিসেবে প্রধান কর্তব্য।
অবশ্য, দেবকে সে ভালবাসে।কেন বাসে এর কোনো মনোস্তাত্তিক ব্যাখ্যা সে নিজেও খুঁজে না। কী ভীষণ ঘেন্না তার দেবের প্রতি। তবু এখনো ঘুমের মধ্যে দেবের গায়ের গন্ধ ভেসে আসে তার নাকে। অথচ বিগত কতগুলো বছর তারা পাশাপাশি থেকেও দূরে। শরীরে শরীর মেশেনি কতদিন। এর জন্যই বোধহয় আমি এত খিটখিটে, অসুস্থ হয়ে পড়ছি! কোথায় যেন পড়েছিলাম স্বাভাবিক যৌনজীবন মন সুস্থ রাখে, শরীরও।
শাল্মী মনে করতে পারে না কবে কখন পড়েছিল। অথচ তীব্রভাবে ইচ্ছে করে দেবের বুকে মাথা রাখতে, প্রাণভরে আদর করতে, তখনি মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে নানান দৃশ্য। সে কুঁকড়ে যায় অপমানে।
শাশুড়ি মায়ের কথা মনে পড়ল তার। মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত নয়। আকাশচুম্বী প্রত্যাশা আর অর্থ ক্ষমতা সমাজ সংসার ভালোবাসা সব গুঁড়িয়ে দেয়।
কেন যে সেদিন তাঁর কথা শুনিনি! কিন্তু সফলতা কি চরিত্রও নষ্ট করে দেয়! শাস্ত্রে বলে, নারীচরিত্র স্বভাবতই বহুগামী।তাই তাকে নীতি আর অনুশাষণ দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। কিন্তু পুরুষের উপর কোনো বাধা নিষেধ নেই। তাদের চরিত্রের অবনতি হয় না! নাকি পুরুষমানুষের চরিত্র যাইহোক সে পুরুষ বলে সাতখুন মাপ!
আচ্ছা, চরিত্র বলে আদৌ কোনো শব্দ আছে? নাকি সবটাই তৈরি করা একটা ইমেজ!
শাল্মীর মাথার চারপাশে সবকিছু এলোমেলো হয়ে ঘুরতে লাগল। যেন নানান শব্দ জট পাকিয়ে ঘুরছে। সেগুলোকে সে কিছুতেই সাজাতে পারছে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে সে মৃদু স্বরে মুক্তোকে ডাকল। সাড়া পেল না। আরো একবার ডেকে নিশ্চিন্তে চোখ বুজল। তারপর এক কল্পলোকের দুনিয়ায় হারিয়ে গেল।
চোখের সামনে এখন কত আলো। রুপোর মতো মেঘ আকাশে। পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে আসছে।চারদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। একটা নীল নদী, মৃত্যুর মতো সীমান্তহীন, তাকে অজানা কোনো গন্তব্যে নিয়ে চলেছে…। সেখানে কেবল সুখ আর ভালোবাসা। এটা একটা মিথ্যে শব্দ। অস্তিত্বহীন। তবু সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল বুকের উষ্ণতায়, চোখের পাতায়, ঠোঁটের গোলাপী আভায় আর অনন্ত বিস্তৃত এই ঘন অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে তার সব ভালবাসা সুখ শান্তি। চোখ খুললেই যেগুলো হারিয়ে যাবে।
শাল্মী চোখ বুজে শুয়ে রইল রাত ভোর হওয়া পর্যন্ত।
সতোরো.
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেল শাওনের। সাঁঝবাতি এখনো ঘুমচ্ছে। পাশবালিশটা বুকের মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে মনে হচ্ছে জীবন্ত কাউকে জড়িয়ে। গায়ের কম্বল সরে গেছে। গুটিসুটি মেরে শুয়ে সে। গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে দিয়ে বোনের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। ঘুমন্ত মুখটা কেমন মায়াময়, যেন অন্য কোনো গ্রহের। সে বোনের কপালে একটা চুমু খেয়ে বিছানা ছাড়ল।
ভোরের দিকে এদিকে ভালোই শীত পড়ে। শাওন ম্যাক্সির উপর চাদরটা ভালোভাবে মুড়িয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল। গেস্ট হাউসের ঠিক গা দিয়েই নদীটা। অথচ কুয়াশায় ঢাকা থাকায় চারদিক ঝাপসা। মনে হচ্ছে এখনো রাত। সে চোখ কচলে হাই তুলে রান্নাঘরের দিকে যাবে বলে মুখ ঘোরাতেই দেখল রাহুল বারান্দায় রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখে বোনের আগের রাতে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। মনটা হঠাৎ কূ ডাকল। মুহূর্তখানেক থমকে দাঁড়িয়ে সে ধীর পায়ে সামনে এগোলো।
তাকে দেখে একগাল হাসল রাহুল। গুড মর্নিং। তোমার কথাই ভাবছিলাম।
কথাটা শুনে মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। সে আলতো স্বরে আদুরে গলায় বলল,এত ভোরে উঠেছ? ঘুম হয়নি?
না না , ঘুম খুব ভালো হয়েছে। আসলে এসব জায়গায় এসে ভোরবেলা না উঠতে পারলে প্রকৃতিকে ঠিক অনুভব করা করা যায় না। বলে রাহুল হাসল।
সেইমুহূর্তে শাওনের বুকের মধ্যে হাজার মত্ত হাতির গর্জন বেজে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বলল, কী ভাবছিলে বলো।
ভাবছিলাম তুমি বা সাঁঝবাতি উঠে পড়লে একসঙ্গে বসে চা খাব।
আর কিছু?
আর! কই নাতো! কত কুয়াশা চারদিকে! দেখেছ?
হুঁ।
আজ আবার নৌ-ভ্রমণ। কে জানে এত কুয়াশায় নৌকা যাবে কিনা!
একটু বাদেই এই কুয়াশা কেটে যাবে। বেশ নিস্পৃহভঙ্গীতে বলে সামনের দিকে এগুলো শাওন।
বলছ? তাহলে এখন একটু চা খাওয়াতে পারবে? নদীর ওই পাড়টায় বসে খাব দুজনে আর গল্প করব। বলে একটা হাত তুলে আঙুল দিয়ে নদীর এক দিক দেখালো সে। যাই বলো সাঁঝবাতি কিন্তু ঠিকই বলে। ভোরে না উঠলে কত কিছু যে অদেখা থেকে যায়।
রাহুলের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরুত্তাপ স্বরে শাওন বলল, তুমি যাও। আমি… এত আস্তে কথাগুলো বলল যে নিজের কানেই স্বর পৌঁছল না।
কিছুই ভালো লাগছে না তার। এতদিনের সম্পর্ক তবে মিথ্যে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, শাল্মী এর মধ্যেই চা করে ফ্ল্যাক্সে রেখে ময়দা মাখছে। মেয়েকে দেখে হাসল। কিরে, এত সকালে উঠেছিস যে! ঘুম হয়েছে ?
শাল্মীকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না কাল রাতে সে দরজা বন্ধ করে একাই শুয়েছিল। ঘুম আসেনি তার।
মায়ের হাসি মুখটা দেখে শাওন মাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখল।
কি হলো? স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি? মা মরে যাবার স্বপ্ন নির্ঘাত! শাল্মী হাসল।
আঃ মা! সাতসকালে ভুলভাল কথা না বললেই নয়!
তা কি হয়েছে সেটা তো বল।মুখটা তোল দেখি-
কিছু হয়নি মা। এমনিই… তোমার একটু আদর খেতে ইচ্ছে হল।
ও! বলে শাল্মী মেয়ের মাথার চুলগুলো একটু ঘেঁটে দিয়ে বলল, আমি ভাবলাম, রাহুলের সঙ্গে কিছু হয়েছে।
মা, রাহুল বাদেও আমার একটা জগত আছে। তার সঙ্গে কিছু হয়নি।শাল্মীর বুক থেকে মাথাটা সরিয়ে মুক্তোকে ডাকল। মুক্তো রান্নাঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। চায়ের কাপ বেসিনে রাখার পর শাওন তার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে বলল, রাহুল নদীর ধারে বসে ,তাকে দিয়ে এসো।
মুক্তো চলে যাবার পর আরো তিনটে কাপে চাল ঢালল সে। মা চলো, আজ আমি তুমি আর বাবা একসঙ্গে বসে চা খাই।
দেখছিস না ময়দা মাখছি! তোরা তো খানিক বাদেই বেরবি আবার।খেয়ে যেতে হবে তো!
মা, খুব রেগে যাব, তুমি না গেলে, বলে কপট রাগ দেখাল শাওন।
মেয়ের ধমক খেয়ে হাত ধুয়ে বারান্দায় এল শাল্মী।
কাল সারারাত দেবপ্রকাশ ঘুমোতে পারেননি।বারান্দাতেই বসে ছিলেন প্রায় মাঝরাত অবধি। তিনটে নাগাদ শাল্মী দরজা খুলে দিলে ভিতরে গিয়ে শুতে পেরেছেন। কিন্তু ঘুম আসেনি। ভোর না হতেই বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় বসে সিগারেট টানছেন তিনি। সিগারেটের প্রতি তার অনুরাগ সাঙ্ঘাতিক। টান না দিলে আত্মবিশ্বাস পান না। যথারীতি এখনো তিনি সিগারেট মুখে নিয়েই বসে সামনের দিকে তাকিয়েছিলেন। শূ্ন্য সে দৃষ্টি। যেন এই জগতের কোনোকিছুর সঙ্গেই এখন তার যোগ নেই, এমনিভাবে বসে সিগারেট টানছিলেন তিনি।
শাওন সামনে রাখা ছোটো কাচের টেবিলে চা সমেত ট্রে রেখে, তাকে ডাকা মাত্র দেবপ্রকাশ যেন বহুদূর থেকে ভাবনার রাজ্য পেরিয়ে এখানে ফিরে এলেন। সামনে মেয়েকে দেখে মন ভালো হয়ে গেল হঠাৎই।
কিরে মা এত সকালে?
বাবা আজ আমাদের নদীতে নৌকা বিহার।
হ্যাঁ, তাইতো! ভুলেই গেছিলাম।তা সাঁঝবাতি রাহুল উঠেছে?
বোন ঘুমচ্ছে বাবা। খানিক বাদে ডাকব। সবে ছটা। বেরতে বেরতে আটটা হবেই। রাহুল উঠে পড়েছে। নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আচ্ছা।তা তোদের এখানে ভালো লাগছে তো? কথাটা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেও আসলে শাল্মীর থেকেই সে জানতে চাইছিল।
শাল্মী কিছু না বলে মনোযোগ দিয়ে চা খেতে লাগল।
হ্যাঁ, বাবা। জায়গাটা খুব সুন্দর।
তোদের ভালো লাগলেই আমি খুশি রে মা। বলে শাল্মীর দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তোর মায়ের মন টিকছে না।ফিরতে চাইছে।
কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল শাল্মী। তোরা বাপ বেটিতে গল্প কর। আমার চা শেষ। এবার হেঁশেলে যাই।মেলা কাজ বাকি। বলে আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো সে।
সেদিকে তাকিয়ে দেবপ্রকাশ বলল, তোর মা দুদন্ড শান্তিতে বসতে পারে না। সবেতেই তাড়া।এখন যে তার কী কাজ কে জানে!
হুঁ, বলে শাওন বলল, ছাড়ো বাবা।
জানিস মা, এখান থেকে মাইল দশেক দূরে একটা প্রাচীন কালী মন্দির আছে। নৌকা করেই যেতে হয়।
কী কালী বাবা? তুমি দেখেছ?
অনেকবছর আগে একবার এসেছিলাম।তখন আমি সবে কলেজে পড়ছি। এক বন্ধুর বাড়ি ছিল এদিকেই। তার বাড়ি এসেছিলাম একটা ছুটিতে। সেই নিয়ে গেছিল। আজও ভাবলে কাঁটা দেয় মা।
কোন বন্ধু বাবা? আমি চিনি?
নারে মা। তবে সাঁঝবাতিকে বোধহয় বলেছিলাম তার কথা। তার নাম সুবল। সে যাইহোক, কথিত আছে, রঘু নামে এক বিখ্যাত ডাকাত এই জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছিলেন। তিনি ছিলেন সেইযুগের ত্রাস। সেই সময় নদী দিয়ে কোনো নৌকা গেলে কিংবা জঙ্গলের পথ ধরে কোনো পথিক গেলেই তিনি তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসতেন তার ডেরায়। তারপর কালীর নামে বলি। একদিন একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন বলি দেবেন বলে। মেয়েটাকে বেঁধে রেখে তিনি পাশে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। বোধহয় একটু চোখ লেগে গেছিল। তখন তিনি স্বপ্ন দেখলেন, একটা বিশাল দর্শন কুচকুচে কালো মেয়ে তাকে ভীষণ রেগে বলছে, তুই আমাকে মারতে চাইছিস? তুই ভুলে গেছিস আমিই তোকে সৃষ্টি করেছি। তোর এই অন্যায় কাজ আমি আর সহ্য করব না। তোকে আমি এখনি ধ্বংস করব। বলে হাতে খাঁড়া তুলে মারতে যাচ্ছে তাকে। রঘু ভয় পেয়ে সেই মেয়ের পা ধরে বলল, আমাকে মেরো না। আমি আজ থেকে আর কোনো পাপ কাজ করব না। তখন সেই মেয়ে তাকে বলল, বেশ এবারের মতো তোকে ছেড়ে দিলাম।কিন্তু…
শোনা যায় এরপর রঘু পুরো পালটে যায়। ডাকাত থেকে সে একজন দানবীর ও গরীব দরদী বলে ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠে।
শাওন চুপ করে শুনছিল বাবার কথা। সেদিকে লক্ষ্য করে দেবপ্রকাশ বললেন, এখনো সেদিনের কথা মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। তার ক’দিন আগেই অমাবস্যা গেছে। চাঁদ তখনো আধখানাও হয়নি। নৌকা থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিক পথ হেঁটে সেখানে পৌঁছলাম। আমাদের দুজনের হাতেই লন্ঠন আর লাঠি।
লাঠি কেন?
জঙ্গলের ভিতর কত কিছু থাকতে পারে, তাই সাবধানতা। তা যা বলছিলাম, ভাঙাচোড়া এক পোড়ো মন্দির। চারদিক আগাছা আর জংলী লতায় ভরা। কোনোরকমে মন্দিরে ঢুকলাম। সাপ কিলবিল করছে সেখানে। লাঠি ঠুকে ঠুকে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওরে বাবা- সামনে দাঁড়ানো মাত্র ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। একতলা বাড়ির থেকেও উঁচু কালো কুচকুচে, গলায় মুন্ডমালা, জিভ বের করা এক ভয়ঙ্কর দর্শণরূপী মা। দেবপ্রকাশ নিজের হাতের দিকে তাকালেন। দেখ মা, এখনো সে কথা বলতে গিয়েই কাঁটা দিচ্ছে।
শাওন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়েই আমার মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখনি বুঝি চারদিক থেকে ডাকাতরা ঘিরে ধরবে। আর তার পরেই… সুবলকে দেখলাম হাত জোড় করে বসে পড়ল সেই ধুলো শ্যাওলা পড়া মেঝেতেই। আমি তাকে দেখে সাহস আনলাম মনে।তাকালাম মায়ের দিকে। কী উজ্জ্বল সে দৃষ্টি!
তারপর …
কতক্ষণ সেভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই। মনের মধ্যে একের পর এক বিখ্যাত ডাকাতদের কথা উঁকি মারছে আর ভাবছি এবার আমার পালা। হঠাৎ মনে হলো, মা যেন বলছেন, বোস এখানে। কোনো ভয় নেই। আমি আছি।
এই পর্যন্ত শুনে শাওন বলল, বাবা এবার বুঝতে পারছি বোন তোমার থেকেই গল্পের বই পড়ার অভ্যাসটা পেয়েছে।
হঠাৎ এই কথা কানে যেতে দেবপ্রকাশ যেন অতীত থেকে ফিরে এল বাস্তবে। কেন বলতো মা?
না , এমনি, তুমি বলছ ভয়ঙ্করী কালীর গল্প আর বোন বলছে কবরস্থানের গল্প।
সাঁঝবাতি কী বলেছে জানি না।তবে এই মা সত্যি আছেন। শুনেছি সেখানে এখন নিয়মিত পুজো হয়। শোনা যায়, এক কাঠুরে স্বপ্ন পেয়ে মাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।মন্দিরের সংস্কারও হয়েছে। রঘুকে বলিস, সে জানে নিশ্চয়ই।
আচ্ছা বাবা। আমি এখন উঠি।
হ্যাঁ মা, রেডি হয়ে নে। বেলা হলো অনেকটাই।
শাওন মাথা নেড়ে উঠে পড়ল। সাঁঝবাতি আর রাহুল এতক্ষণে নিশ্চয়ই রেডি হয়ে গেছে, ভেবে, ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..