ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
আগের পর্ব পড়ুন এখানে…
আঠারো.
আকাশ এখন পরিষ্কার।কুয়াশা কেটে রোদের ঝিলিক। মাঝি নৌকা নিয়ে তৈরি।রঘুও এসে গেছে। শাওন বারান্দা থেকেই দেখতে পেল বোন বেরবার জন্য পুরো তৈরি।তার পরণে আজ হলুদ কুর্তি আর পালাজো। কানেও দুল। শাওন অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল। সাধারণত বোন এই রঙটা পরে না। সে কিছু বলবে ভেবেও চুপ করে ঘরে ঢুকে নিজে রেডি হতে লাগল।
কেমন দেখাচ্ছে দিদি?
দারুণ , বলে সে বলল, হলুদ রঙটা তোকে খুব মানিয়েছে। পরিস না কেন? দাঁড়া আঙুল কেটে দিই , কারোর নজর না লাগে- সে সাঁঝবাতির বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নখটা দাঁত দিয়ে কেটে থু থু করল।
লাজুক হেসে সাঁঝবাতি বলল, দিদি, তুই পারিসও। তারপর দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শাওন রেডি হয়ে বেরবার মুখে রাহুলের গলা পেল। বাঃ।কী দারুণ লাগছে তোমায়। গর্জিয়াস আর …
যা! দিন দিন তুমি বদলে যাচ্ছ রাহুল,
শাওন দেখল রাহুলের মুখ সাঁঝবাতির ঠোঁটের কাছাকাছি। সে সেখানেই স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল।
সাঁঝবাতি রাহুলের থেকে সরে এসে পিছন ফিরতেই দিদিকে দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে বলল, দিদি আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবি?
শাওনের মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরচ্ছিল না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে ঠোঁট নাড়ল- কোথায়?
একটা জায়গায়।
আমি কি যেতে পারি তোমাদের সঙ্গে ? রাহুলের জিজ্ঞাসায় সাঁঝবাতি বলল, না। আমরা দুজনেই যাব শুধু। আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে দিদির হাত ধরে সামনে হাঁটতে শুরু করল।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল।কেউ কোনো কথা বলছে না। যেন তাদের কোনো কথা নেই, ছিল না। শুধু হাঁটার জন্যই তারা হেঁটে যাচ্ছিল।
এই রাস্তাটায় শাওন এর আগে আসেনি। গেস্ট হাউসের পিছনের রাস্তা এটা। রাস্তা না বলে জঙ্গলের গুল্ম বিছানো সরু পথ বলাই ভালো। এদিকে জনমানব বেশি আসে বলে মনে হচ্ছিল না। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি আর পাখিদের ডাক ছাড়া কোনো শব্দ কানে আসছিল না।
বেশ খানিকক্ষণ এভাবেই হাঁটার পর সাঁঝবাতি থামল। শাওন দেখল সেখান থেকে পায়ে হাঁটার মতো তিন-চারটে পথ। সে বোনের দিকে তাকালো। দিদি এবার আমরা বাঁদিকের এই পথ ধরে আরো গভীরে ঢুকব। তোর ভয় লাগলে আমার হাত ধর।
সামনের দিকে তাকিয়ে শাওনের বুকটা ছাৎ করে উঠল। কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে বোন? সে কি রাহুলের প্রেমে পড়ে তাকে শান্ত মাথায় খুন করবে বলে আরো গভীর জঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইছে! সে চারদিক তাকালো। না, এখানে কিছু হলে কেউ টেরও পাবে না।
কী হলো দিদি? ভয় পাচ্ছিস?
চমকে উঠল সে। পরমুহূর্তেই মনে হলো, এসব কী ভাবছি? বোন কখনো আমার সঙ্গে এমনকিছু করতে পারে না।কিন্তু … শুনেছি প্রেমে পড়লে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না…. ।
কী ভাবতে বসলি দিদি? আয় আমার সঙ্গে , বলে বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে এগুতে লাগল সাঁঝবাতি।
সেদিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে, যা হবার হবে ভেবে তাকে অনুসরণ করল।
ছোটো ছোটো গুল্ম, লতানো গাছ ,বড়ো বড়ো ঘাস মাড়িয়ে, সরিয়ে এগাছের ফাঁক , সেগাছের ফোকর পেরিয়ে তারা প্রায় অন্ধকার, চারদিক থেকে গাছে ঢাকা একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।
কতগুলো গাছের পাতা চারদিক থেকে নেমে এসেছে একটা ভগ্নপ্রায় কবরের উপর। শুকনো পাতা, কিছু হলুদ সাদা বনফুল আর অজস্র ঘাসের আচ্ছাদনের ফাঁক দিয়ে শাওন দেখল লেখা- উইলিয়ম রিচার্ড। জন্ম -১৮৫৮। মৃত্যু- ১৮৫৮।
শাওনের হঠাৎ করে শীত করতে লাগল। তার মনে হল এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। সে কোনোরকমে শালটা গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে সামলে নিল।
কবরটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে সাঁঝবাতি বলল, অনেকে অনেক মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু এত কনফিডেন্সের সঙ্গে বলে যে বোঝা যায় না। আমি তোকে বললাম, অথচ তুই বিশ্বাস করলি না।ভাবলি মিথ্যে বলছি। অবশ্য এটাই আমাদের স্বভাব। কাউকে বিশ্বাস করলে অন্ধভাবে সে যা বলে মেনে নিই, আর যাকে মনে করি, এ সবটাই বানিয়ে বলে তার প্রতি কোনো অবস্থাতেই আস্থা রাখতে পারি না।
আমি তোকে মিথ্যেবাদী ভাবিনি। কিন্তু এটাও ঠিক যে কেউ বলতেও পারেনি এখানে এমন কিছু আছে। তাই…
আমি প্রথম এটা দেখার পর অবাক হয়েছিলাম। এই গভীর জঙ্গলের ভিতর একটাই মাত্র কবর কী করে এল? তোর মতো আমিও অনেককেই জিজ্ঞেস করলাম।কেউই বলতে পারল না। শেষঅবধি গেস্ট হাউসের লাইব্রেরি থেকে একটা স্থানীয় ইতিহাসের বই পেলাম। সেখান থেকেই জানলাম, সিপাহী বিদ্রোহের সময় সিপাহীরা কে ইংরেজ কে আইরিশ বা অন্য কোনো জায়গা থেকে এসেছে এসব কিছুই জানত না। তারা সাদা বর্ণের মানুষ দেখলেই তাকে আর তার পরিবারকে মেরে ফেলছিল। তখন অনেক আইরিশ চাকরি করার জন্য ব্রিটিশদের সঙ্গে এদেশে এসেছিল। তোর নিশ্চয়ই মনে আছে গোরা উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক আইরিশ মহিলা ও পুরুষের কথা বলেছিলেন, যারা প্রাণ বাঁচাবার জন্য নিজের সন্তান প্রসব করার পর তাকে রেখে চলে গেছিল। ঠিক এখানেও তেমন কিছুই হয়েছিল। এক আইরিশ দম্পতি সিপাহীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল।কিন্তু বাচ্চাটা এত কষ্ট সহ্য করতে পারেনি। শেষ অবধি মারা যায়।তখন তাকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়।
শাওন চুপ করে শুনছিল।
দিদি, তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস,আমি বাইরে এখন থাকলেও চট করে মিথ্যে কথা বলা রপ্ত করতে পারিনি। আর হ্যাঁ গল্প, প্রবন্ধ বা ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান যাই পড়ি না কেন ,আমি নিজের চোখ কান সবসময় খোলা রাখি। তোর মতো সব এড়িয়ে নিজেকে নিয়ে থাকতে পারি না।
শাওন বোনের দিকে তাকিয়ে আবার কবরটার দিকে তাকালো।
দিদি, তখন রাহুল আমার ঠোঁটের কাছে মুখ নিয়ে এসে কী বলছিল জানতে ইচ্ছে করছে না তোর! তুই ভাবলি আমি তোকে দেখে সরে এলাম, এখানে আসতেও তুই ভয় পাচ্ছিলি। ভাবছিলি বোন হয়তো তোকে খুন করে ফেলবে রাহুলকে পাবার জন্য। কিন্তু তোকে আমি আগেও বলেছি, রাহুল আমার যোগ্য নয়। সে আমাকে বলছিল, তোমাকে দারুন সেক্সি লাগছে।একটা চুমু খেতে দাও।
তুই থাম। আমি ফিরতে চাই।
না দিদি, তুই শুনে যা। রাহুল তোকে ভালোবাসে, আবার বাসেও না। সে এখন আমায় মজেছে। সে যদি শুধু তোকে ভালবাসত তাহলে আমাকে চুমু খেতে চাইত না। একটু থেমে সে আবার বলল, বিশ্বাস কর , রাহুল সম্পর্কে আমার অনুমান একটুও মিথ্যে নয়। তার প্রমাণ আমি আজই দেব।
আমি প্রমাণ চাই না, তুই এবার এখান থেকে চল। অস্ফুট স্বরে শাওন বলল। ফ্যাকাসে লাগছিল তার মুখ চোখ।
উঁহু, আর যাইহোক, বাইরের যে যাই ভাবুক আই ডোন্ট কেয়্যার। কিন্তু তোর চোখে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে থাকতে পারব না।
প্লিজ, চল এখান থেকে। আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না।
চল তবে। কিন্তু শুনে রাখ, আমি ফিরে গিয়ে বলব, আমার জ্বর আসছে, যেতে পারব না। দিদির সঙ্গে ঘুরে এস। দেখ সে কী বলে! আমি নিশ্চিত, সে বলবে, আজ থাক, অন্যদিন যাওয়া যাবে।
তুই চুপ কর। আমার আর ভালো লাগছে না।
দিদি, অনেক দেরি হয়ে যাবার আগে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়া। সাময়িক কষ্ট পেলেও তা ধীরে ধীরে সয়ে যাবে।কিন্তু এখনি নিজেকে সরিয়ে না নিলে সারাজীবন ক্ষতবিক্ষত হবি। সাঁঝবাতি দিদির হাতটা চেপে ধরল।তোর সঙ্গে আমি আছি, বলে ঘন ঘাসের জঙ্গল মাড়িয়ে ফেরার রাস্তা ধরল।
ঊনিশ.
(ক)
গেস্ট হাউসের সামনেই রাহুল আর রঘু দাঁড়িয়ে ছিল। রাহুলের গায়ে নীল জিন্স আর সাদা টি শার্ট। সেদিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল শাওন। তার মনের ভিতর সাঁঝবাতির কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
তারা গেটের সামনে পৌঁছনো মাত্র রঘু বলল, আর দেরি করা ঠিক হবে না। চা , জলখাবার, জল সব নিয়ে নিয়েছি। এবার বেরিয়ে পড়া যাক।
সাঁঝবাতি দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে রাহুলকে ডাকল। আমার শরীরটা ঠিক ভাল লাগছে না।
সেকী! এই তো ঠিক ছিলে।কী হলো এখনি?
গা হাত পায়ে ব্যথা করছে। বলে দিদির দিকে তাকালো সে।
শাওন রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছিল। সাঁঝবাতির কথা যেন সত্যি না হয়। তার হৃৎস্পন্দন এত বেড়ে গেছিল যে নিজেই এখন সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছিল।
রাহুল উৎকন্ঠা নিয়ে বলে উঠল, এ তো ভালো লক্ষণ নয়। আজ তাহলে রেস্ট নাও। অন্য কোনো সময় যাওয়া যাবে। এখানে শরীর আরো খারাপ হলে সবাই বিপদে পড়ে যাবে। তার থেকে আজ ঘরেতেই আড্ডা হোক। কী বলো শাওন!
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে রঘুর দিকে তাকিয়ে বলল, আজ যাওয়া হচ্ছে না। সাঁঝবাতির শরীর ঠিক নেই। এই অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া বা রেখে যাওয়া কোনোটাই ঠিক হবে না। তারপর সাঁঝবাতির দিকে ফিরে বলল, ঘরে চলো। কাল কাকিমা প্যা্রাসিটামল দিয়েছিল, সেটা খেয়ে নেবে চলো। বলে সে তার হাতটা ধরল।
নিস্পলক দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখে শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে শাওন বলল, সেরকম কিছু হয়নি বোনের।
বলে আর কোনো কথার বা অনুরোধের অপেক্ষা না করেই সে পিছন ফিরে দ্রুত বাগান অতিক্রম করে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার মাথাটা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক অনেক গাছেদের মাঝে সে হারিয়ে গেছে। সেখান থেকে আর ফিরতে পারছে না কিছুতেই। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। মা-আ-আ-… বা-আ-বা… বলে ।
তার চিৎকার শুনে শাল্মী ছুটে এল। তার চুল দিয়ে জল গড়াচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এখনি স্নান সেরে মাথা না মুছেই চিৎকার শুনে দৌড়ে এসেছে কোনো রকমে শাড়ি জড়িয়ে। গা দিয়ে অদ্ভুত একটা স্নিদ্ধ গন্ধ আসছে।
মাকে দেখে বালিশে মুখ লুকালো শাওন।
কী হয়েছে ?
কিছু না ,ভাঙা ভাঙা গলায় বলল সে।
মুখ তোল ,তাকা আমার দিকে। জোর করে বালিশ থেকে মেয়ের মুখটা তুলে বলল, বলতো সত্যি করে কী হয়েছে? কী লুকাচ্ছিস আমার থেকে?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মার বুকে মুখ গুঁজে দিল সে। তার ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কাঁদতে, বলতে, মা রাহুল আমাকে না, বোনকে ভালোবাসে। কিন্তু পারল না। শুধু তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল।
শাল্মী আর কোনো প্রশ্ন না করে বলল, তোকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। চোখ মুছে আসিস আমার ঘরে। আমি ততক্ষণ রান্না করে নিই। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে শাল্মী মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে শাড়িটা ঠিকমত পরে নিয়ে দরজা টেনে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
(খ)
শাল্মীর ঘর অন্ধকার। জানলাগুলো বন্ধ। ভারী পরদা টানা থাকায় আরো গাঢ় দেখাচ্ছে। শাওন ভেজানো দরজা খুলে মা বলে ডাকতেই শাল্মী বলল, দরজাটা বন্ধ করে দে। আলো সহ্য হচ্ছে না। শাল্মীর ডান হাত মাথার উপর রাখা। তাঁর কন্ঠস্বর অচেনা লাগছে এখন।
শাওন কয়েক মিনিট বোঝার চেষ্টা করল, কী ঘটেছে! নিজের মধ্যে কোনো সংকেত না পেয়ে বলল, মা মাথায় আবার ব্যথা হচ্ছে? টিপে দেব?
না, আমি ঠিক আছি। তুই আমার কাছে বোস।
তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না ভালো করে। ডিম্ লাইটটা জ্বালিয়ে দিই, বলে সুইচে হাত বাড়ানো মাত্র শাল্মী বলে উঠল, কোনো কোনো কথা বলার জন্য অন্ধকারই ভালো। আলোয় তা বেয়াব্রু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
শাল্মীর কথা শুনে শাওনের একটু ভয় করতে লাগল। তার মনে হলো, এখানে এসে থেকে এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে যেগুলোর উপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে কেবল নীরব দর্শক। সব চেনা মানুষগুলো যেন এই জঙ্গলের আলো আঁধারি অন্ধকারে নিজেদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নানা না-বলা- গোপন কথা এখানে এসে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। নাগরিক ঘেরাটোপে মুখোশের আড়ালে আটকে থাকা অভিব্যক্তিরা সহসা ভেঙে-চুরে দিচ্ছে যাবতীয় গোপনতা।
শাওনের ইচ্ছে হলো না শাল্মীর কথা শুনতে। সে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইল।অথচ কে যেন তার পা শক্ত করে সেখানেই বেঁধে রেখেছে। সে আরোও খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর কোনোক্রমে বলতে পারলো, থাক না মা, তুমি রেস্ট নাও। পরে আরেকদিন শুনব।
শাল্মী অদ্ভুত এক ভারী স্বরে বলল, না, আজই বলতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অগত্যা বিছানায় বসে পড়ল শাওন। কিছুক্ষণ চুপ। দেওয়ালে একটা টিকটিকির টিক টিক ধ্বনি। সহসা সব জাল ছিন্ন করে যেন শাল্মীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
বিয়ের পর থেকে এই সংসারে এসে একদিনের জন্যেও নিজের কথা ভাবার সময় পাইনি। তবু মনকে বোঝাতাম, তোর বাবা আছে পাশে। সে নিশ্চয়ই আমার জন্য ভাবে।তার ভাবনা আর আমার ভাবনা কী আলাদা! তাছাড়া তোরাও হয়ে গেলি পর পর। তাই আলাদা করে নিজেকে দেখার অবকাশ হলো না। সংসার আর তোদের নিয়েই ব্যস্ততায় দিন কাটছিল। এর মধ্যেই তোর বাবার কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন ও উন্নতি। দেখলাম উন্নতি শুধু প্রভাব প্রতিপত্তিতেই হয় না, চরিত্রেও হয়। অবশ্য চরিত্র শব্দটা বেশ গোলমেলে। একজনের জন্য যেটা খারাপ আরেকজনের জন্য সেটাই ভালো। চরিত্র দিয়েই বিচার হয় তার ক্ষমতা, তার প্রভাব প্রতিপত্তি। সঙ্গে যোগ হয় একাধিক নারী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ। বহু নারী পছন্দ করেন স্বেচ্ছায় ওপরে ওঠার, কিংবা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ক্ষমতা লাভের জন্য ক্ষমতাবান পুরুষদের সান্নিধ্য।
মা, আমি বুঝতে পারছি না আমাকে কেন এসব বলছ! এসব শুনে আমি কী করব! তুমি শান্ত হয়ে বিশ্রাম নাও, আমি এখন যাই , বলে শাওন উঠে দাঁড়াল।
চুপ করে বোসো। সব শুনতে হবে তোমাকে। যে যন্ত্রণা এতদিন ধরে আমি একা বহন করছি তা আমার সন্তান হয়ে তুমি জানবে না! ডাক্তার দেখাবার আগে জেনে নাও কেন আমি আজ অসুস্থ! হ্যাঁ, আমি অসুস্থ। শারীরিক ভাবে নয়, মানসিক ভাবে। মাথায় নানা চাপ নিতে নিতে আজ আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না- শাল্মীর কণ্ঠস্বর ভেজা।
শাওন বুঝতে পারছিল না কী ঘটতে পারে এরপর! সে চুপ করে থাকাই নিরাপদ মনে করল।
একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বলা শুরু করল শাল্মী। মন্ত্রী হবার সঙ্গে সঙ্গে তোর বাবার বাইরে যাওয়া বেড়ে গেল প্রচুর। আর তার সঙ্গেই বাড়ল নারীসঙ্গ। নিত্য নতুন মেয়ে। সব অল্পবয়সী। সবে চাকরিতে ঢুকছে এমন। যেন-তেন প্রকারে এরা চাইছিল তোর বাবাকে খুশি করে ওপরে উঠতে, চাকরির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে। প্রথম দিকে দেখতাম, শুনতাম। নানা মেসেজ, অন্তরঙ্গ বিভিন্ন ছবিও হাতে এসে পড়ছিল। ভাবছিস কী করে! আমি তো তোর বাবার কোনো ব্যক্তিগত জিনিসেই হাত দিই না। তবে কী করে জানলাম! আমারও এক একেক সময় মজা লাগত ভেবে। যে মেয়েটি ক’দিন আগেই ঘুরে এল দেবের সঙ্গে, সেই মেয়েটিই আবার আমাকে সব ছবি, সব মেসেজ কেন ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছে! দু’একবার ভেবেছি জানতে চাইব ব্যাপারটা কী!
মা তুমি চুপ করো, আমি এসব জানতে চাই না। শাওনের সেই কথা কানেই গেল না শাল্মীর। সে নিজের খেয়ালে বলে চলল, একদিন একটি মেয়ে দেখা করল আমার সঙ্গে, তোদের তখন স্কুলে দিয়ে ফিরছি। মেয়েটি বলল, ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে। মেয়েটিকে বিশেষ পাত্তা না দিলেও কৌতূহল হলো। বসলাম তার সঙ্গে একটা বুক স্টোরে। মেয়েটি বলল, আপনার হ্যাজব্যান্ড আমাকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ব্যবহার করেছে। এখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য আরেকজনের সঙ্গে… ।
জানতে চাইলাম, এগুলো আমায় কেন বলছেন! মেয়েটি বলল, আমি তাঁকে সব দিয়েছিলাম ভালবেসে। কিন্তু সে কোনোদিন আমাকে ভালোবাসেনি। জানেন- উনি আপনার সম্পর্কে কত খারাপ কথা বলেছেন!
তাই! এখন আমার কাছে কি চাইছেন? যদি আপনার সঙ্গে খারাপ কিছু হয়ে থাকে তবে থানায় গিয়ে কমপ্লেন করুন । প্রমাণ থাকলে আমি নিজে আপনাকে উকিল ঠিক করে দেব, খরচাপাতি দেব।চাইব যে দোষী সে যেন শাস্তি পায়।
মেয়েটি তখন বলল, কিন্তু উনি জানতে পারলে আমাকে পুলিশ দিয়ে থানায় তুলে নিয়ে এসে জেলে আটকে রাখবেন।
আমার এবার রাগ হলো খুব। তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?
জানি না, শুধু মনে হল , উনি এত মানুষকে ভালোমানুষের মুখোশ পরে ঠকান, অথচ কোনো শাস্তি পান না, আপনার জানা উচিত। মেয়েটি কাঁদছিল।
আমি তাকে স্বান্তনা দিলাম। নিজের মত বাঁচুন। দুজনেই মজা করেছেন। মজা ফুরিয়ে গেছে, এবার কাজে ফিরুন।আর খারাপ মানুষের শাস্তি হবেই।আজ না হোক কাল হবেই।এজন্মেই হবে।
এরকম কত মেয়ের কত দুঃখ ভরা কাহিনি শুনলাম। তবু চুপ থাকলাম। ভাবতাম বাইরে যা হচ্ছে হোক। ঘরে এসব না হলেই হলো। সংসার স্বামী সন্তান সব কিছুর উপর অসম্ভব মায়া বা লোভ আমাকে নিরুত্তাপ রাখল এসব থাকে। যদিও মনকে বোঝালাম আমার জীবন তো শুধু আমার একার নয়, তোদের জন্যেও আমাকে থাকতে হবে। নইলে তোদের পরিণতি কী হবে! কিন্তু নিজের খিদে ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেল অপমানে, যন্ত্রণায়, রাগে ,ঘেন্নায়, অভিমানে। মাথার ভিতর ভীষণ যন্ত্রণা। লোকটা মাঝরাতে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত।আর আমি… বলে কিনা আমার মাথার রোগ! আমি আর পারছি না এই যন্ত্রণা বহন করতে। তোরা এখন বড়ো হয়ে গেছিস। এবার আমি সব থেকে মুক্তি চাই… শাল্মী চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
ঘটনার আকস্মিকতায় শাওন হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শাল্মীর দিকে। কী শুনছে সে এগুলো? যে বাবা তার জীবনের আদর্শ পুরুষ- তার সম্পর্কে এসব কী বলছে মা! তার মাথা সাময়িকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের যত গাছ সব একসঙ্গে দুলছে। আর সেই দোলায় দুলে উঠছে বিশ্ব ব্রম্ভান্ড। তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। সে শাল্মীর বুকের মধ্যে মাথা রেখে আঁকড়ে ধরল।
শাল্মী শাওনকে দু’হাত দিয়ে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বলছিল, মুক্তোকে দেখিস। তার আমি ছাড়া কেউ নেই… সে আমাদের খুব ভালোবাসে…।
কুড়ি.
রাহুল বিকেলেই ফিরে গেল। সকালে নৌকা অভিযান বাতিল হবার পর সে একা একাই কিছুক্ষণ ঘোরার পর ঘরেই ছিল। দুপুরে খাওয়া শেষ করে সে জানালো, জরুরী কাজ এসে গেছে। ফোন এসেছিল। ফিরে যেতে হবে রাতের মধ্যেই।
তারপর থেকে শাওনের সঙ্গে আর আলাদা করে দেখাও করেনি। বারান্দা থেকেই শাওন দেখছিল, রাহুল গাড়িতে উঠছে। তার খুব ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে কথা বলতে। কিন্তু শরীর বা মন কোনোটাই সায় দিল না। সে সেখান থেকেই তাকিয়ে রইল রাহুলের দিকে।
তার মনে হচ্ছিল, কৃষ্ণ যেমন বৃন্দাবন ছেড়ে চলে যাবার পর আর কোনোদিন রাধার কাছে ফিরে আসেনি, তেমনি রাহুলও আর কখনো তার জীবনে ফিরে আসবে না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল দুজনের একান্ত মুহূর্তগুলো, অকারণ ঝগড়া, ভালোবাসা , ভবিষ্যতের কল্পনায় নানা গল্প। তাহলে এই সবকিছুই ছিল মরীচিকা! যা মানুষ চায় তা কোনো মানুষই শেষ অবধি পায় না! সেও আর পারবে না রাহুলকে আগের মতো ভালবাসতে। যদি শেষপর্যন্ত বিয়েটা হয়েও যায় তবুও যে সন্দেহর বিষ মনের মধ্যে বাসা বাঁধল সেটা কখনো দূর হবে না। মিথ্যে ভালোবাসার নাটক সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে। যেমন মা বয়ে বেড়াচ্ছে !
রাহুল এখন তার দৃষ্টির বাইরে। সেদিকে কেবল শূন্যতা। সে আরো খানিকক্ষণ সেদিকেই চেয়ে রইল। তারপর গায়ের চাদরটা ভালভাবে জড়িয়ে নেমে এল নিচে। হাঁটতে লাগল সামনের দিকে লক্ষ্যহীন হয়ে।
গোধূলির ঠান্ডা হাওয়ায় নদী আর গাছেদের গন্ধ কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে বিবশ করে তুলছিল তার শরীর ও মনকে। সে হাঁটছিল। কিন্তু সেই হাঁটার উপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যেমন কৃষ্ণ চলে যাবার পর রাধা পাগলের মত দৌড়েছিল তাকে ফিরে পাবার আশায়, ঠিক সেভাবেই সে এলোমেলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল কিছু ফিরে পাবার আশায়।
আরো কিছুক্ষণ এভাবেই দিক্বিদিক শূন্য হয়ে হাঁটার পর নিজের অজান্তেই সে পৌঁছে গেল সেই বট গাছটার সামনে। গুঁড়ির নিচে বসে পড়ল। এখানে আসার পর থেকে ঘটনার যে ঘনঘটায় তার মন অশান্ত হয়ে পড়েছিল- সেই ক্লান্ত, বিষণ্ন, ক্ষতময় মন নিয়ে সে আশ্রয় খুঁজল প্রকৃতির কাছে। খানিকবাদেই হিমেল বাতাসে দুচোখ বুজে এল তার।
ঘুমের মধ্যে সে হাঁটতে লাগল এক স্বর্গীয় বাগানে। বাগান জুড়ে লাল নীল হলুদ প্রজাপতি। থোকা থোকা ফুল ফুটে।তাদের গন্ধে মাতোয়ারা ভ্রমর। চন্দন গাছের সুরভিতে ছেয়ে গেছে চারদিক। হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে গেল এক প্রান্তে। এটা বাগানের শেষপ্রান্ত, নাকি পৃথিবীর! ভাবতে ভাবতেই তার চোখে পড়ল একটি ছেলে আপন মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তাকে তার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। একে আগে দেখেছি নাকি এটাও মায়া! সে বুঝতে না পেরে কিছু বলতে চাইল ছেলেটিকে।সামনে এগুনো মাত্র ছেলেটা তার পায়ের শব্দ টের পেয়ে তাকালো তার দিকে। তাকে দেখে উঠে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে হাঁটতে লাগল সে। শাওনও তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। ক্রমশই দুজনের দূরত্ব কমে আসছে। আর একটু গেলেই…
দিদি, এই দিদি… দিদি, এই দিদি… আচমকা ঘোর ভেঙে গেল তার।কোন সুদূর মায়াবী পুরীর বাগান থেকে সে যেন নেমে আসছে এই মাটি জলমাখা জীবনে।
দিদি, এই দিদি, ওঠ। কখন থেকে ডাকছি। শুনতে পাচ্ছিস না? কি ভীষণ ঘুমোচ্ছিস! সাঁঝবাতির ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল তার।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলি- তাই না!
সেই ঘোর-লাগা আচ্ছন্নময় মন নিয়ে যেন কোন পূর্বজন্ম থেকে ফিরে এসে সে বলল, একটা বাগানের মধ্যে হাঁটছিলাম। সেখানে সেই ছেলেটা…।
কোন ছেলেটা!
ঠিক জানি না! শাওন এবার ফিরে আসছে এই জন্মের এই মুহূর্তের জীবনে। সে বোনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, তুই কখন এলি?
অনেকক্ষণ। তোকে দেখছিলাম।তুই ঘুমোচ্ছিলি। কয়েকটা পাতা তার রোদে পুড়ে ফিকে হয়ে যাওয়া আধা সবুজ আধা হলুদ ওড়নার মতো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এসে পড়ল তোর কপাল ছুঁয়ে চোখের উপর। তারপর আরেক হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়ল তোর কোলে। আমি সেই ওড়নার ফাঁক দিয়ে তোকে দেখছিলাম। এই দেখ সেগুলো এখনো তোর কোলে জ্যোৎস্না মেখে শুয়ে আছে। বলে শাওনের কোল থেকে পাতাগুলো তুলে নিল সে। হাতের মধ্যে সেগুলো নিয়ে বলল, তোকে কী দারুণ লাগছিল দিদি। যেন কোনো কল্পলোকের মেয়ে, না- না। পরী তুই। মাটির পৃথিবী কেমন হয় দেখবি বলে নেমে এসেছিলি, তারপর ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলি।আর সেই ফাঁকে কেউ এসে তোর যাদু পাখনাটা চুরি করে নিল।ব্যস, তোর ফেরার পথ বন্ধ। বাকি জীবন এখানেই কাটাতে হবে মানুষ হয়ে…
শাওন সেসব আনমনে শুনছিল। এবার সে হাসল। কিন্তু তার দৃষ্টি এখনো কিছু খুঁজছিল। সেদিকে লক্ষ্য করে সাঁঝবাতি বলল, দিদি, তুই নিজেকে সব পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে নিস না। বাস্তব থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। যদিও অনেক কিছু আমাদের মেনে নিতে হয়, নইলে কষ্ট আরো বাড়ে।ক্রমশ একা হয়ে যেতে হয়। আমি চাই না আমার দিদি হয়ে তুই কোনো যন্ত্রণা একা একা ভোগ করিস।
শাওন মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে খুঁটছিল। যেন খুঁটে খুঁটে সে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল মনের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় বিষাদ।
তুই খুব ভালো দিদি। সমাজের জটিল জিনিসগুলো, সাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কালো তোর চোখে পড়ে না। সব চরিত্রগুলোই তোর কাছে এক। সেখানে কোনো শেড নেই। কিন্তু ভুলে গেলে তো চলবে না সাদার মধ্যেই লুকিয়ে বাকি রংগুলো। সেগুলোকেও দেখতে হবে। তবেই রঙের গুরুত্ব বুঝতে পারবি। এই যে রাহুল, তুই ভাবলি তার প্রতি আমার দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। আর ভাবা মাত্র নিজেকে সরিয়ে নিলি। কিন্তু আমার কোনো প্রেম জাগেনি তার প্রতি। শুধু সত্যিটা তোকে দেখাতে চেয়েছিলাম। তার মানে কিন্তু এই নয় যে রাহুল তোকে ভালোবাসে না। সে তোকে খুব ভালোবাসে, অথচ মনে মনে আমার মতো কাউকে খুঁজে চলে। তাই সে আমি সামনে এলে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারে না। আসলে কী বলতো দিদি, প্রতিটা মানুষের মনের অবচেতন স্তরে আরেকজন ঘুমিয়ে থাকে। মানুষ তাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তবুও কখনো কখনো সেই লুকিয়ে থাকা অস্তিত্বটা মাথা চাড়া দিয়ে তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে। তখন অবদমিত আবেগটা প্রকাশিত হয়ে যায়। তা বলে এতদিন ধরে দেখা মানুষটা মিথ্যে হয়ে যায় না।
আমি খুব বোকা, তাই নারে?
তুই বোকা নোস। তুই সরল। নিজের ছোট্ট জগতের বাইরে তুই কিছু জানিস না, জানতেও চাস না। অথচ তোর গড়ে ওঠা সেই ঘর বা চারদেওয়ালের বাইরেও তো একটা আস্ত পৃথিবী আছে। তাতে ভালো মন্দ সবকিছুই হাত জড়াজড়ি করে পাশাপাশি সহবস্থান করছে। সেখান থেকেই তোকে তোর আনন্দটুকু খুঁজে নিতে হবে। সাঁঝবাতি দিদির হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নিল।
তুই নিজেকে পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে না নিয়ে যা বলার, যেগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেগুলো বলতে শেখ। একবার জোর গলায় নিজের দাবীটা প্রকাশ করতে পারলেই দেখবি জীবন অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। তোর মনে আছে দিদি- সেই ছোটোবেলায় তুই পড়তে যেতিস। আর কিছু ছেলে তোকে বিরক্ত করত। তুই কোনো প্রতিবাদ না করে ভয় পেতিস আর কাঁদতিস।
হুঁ। বলে এতক্ষণে শাওন একটু হাসল। আর তুই তাদের গিয়ে পিটিয়ে আসতিস। কিন্তু আমি ভাবি তুই জানতিস কী করে কারা আমাকে বিরক্ত করছে!
নেট ওয়ার্ক দিদি, নেট ওয়ার্ক। তুই বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে বসে বসে কাঁদবি আর আমি তোর বোন হয়ে টের পাব না তাই হয় ! আমি তোকে অনুসরণ করতে বন্ধুদের বলে দিলাম। তারা ক’দিন দেখার পর আমাকে ছেলেগুলোর সম্পর্কে রিপোর্ট দিল। এরপর আমি নিজে গেলাম তোর পিছন পিছন। দূর থেকে দেখতে লাগলাম। তুই স্যারের বাড়ি ঢুকে যাওয়া মাত্র আমি আমার কাজ শুরু করে দিলাম।
তুই খুব গুন্ডা ছিলি। অবশ্য এখনো বিশেষ পালটাস নি।
দিদি, আমি গুন্ডা নই, প্রতিবাদ করতে শেখাটা মানুষের ফান্ডামেন্টাল রাইট।
খানিকক্ষণ বোনের বুকের মধ্যে মাথা রাখার পর খুব আস্তে করে শাওন বলল, মা ভালো নেই বোন। মায়ের বুকেও অনেক যন্ত্রণা…
জানি দিদি
কী জানিস তুই? মা কী তোকে … কথা শেষ হবার আগেই সাঁঝবাতি বলল- না, মা আমায় কিছু বলেনি। আমি অনেকদিন আগে থেকেই জানি।
তুই কী করে জানলি?
চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়, জানা যায়। তোকে একটা কথা বলি দিদি, মা ইচ্ছে করলে পারত বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে। নিদেনপক্ষে বাবার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি অশান্তি এগুলোও করতে পারত। অথচ দেখ, আমরা কোনোদিন প্রকাশ্যে মাকে বাবার সঙ্গে চেঁচাতে দেখিনি। কেন বলতো?
শাওন অবাক হয়ে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ভেবে দেখ মা কিন্তু সহজেই বাবার বিরুদ্ধে চারিত্রিক অবনতির অভিযোগ আনতে পারত। মামলা যদি নিজে নাও করত, কোনো মিডিয়ায় মুখ খুললেই তা খবরের হেডলাইন হয়ে যেত। যখন থেকে বাবার এসব চলছে তখন তো আমরা খুব ছোটো। আর বাবা তখন কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে। কাজেই সেটা নিয়ে খুব বেশি পাবলিসিটি না হলেও পরে যখন রাজনীতিতে এল তখন কিন্তু মা এটাকে সকলের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে পারত।পার্টিও হয়তো তখন মহিলাদের প্রতি অবিচার এই অভিযোগে বাবাকে বহিস্কার করত। অথচ মা এসব কিছুই করেনি। কয়েকবার আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু মনের দিক থেকে এতটাই দুর্বল ছিল যে সেটাও করতে পারেনি।
সে তো আমাদের জন্যই।
সেটা খানিকটা সত্য। কিন্তু পুরোটা নয়। যারা আত্মহত্যা করতে যায় তারা তখন আগে পিছে কিছুই ভাবে না, বা ভাবার মতো অবস্থায় থাকে না। মেন্টাল কন্ডিশন এতটাই দুর্বল হয়ে যায় যে তখন আর ব্যালেন্স করতে পারে না। মুহূর্তের উত্তেজনায় এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আসলে মা তার স্বামীকে বড্ড ভালোবাসে।এটা ঠিকই বাবার এইসব কান্ডকারখানায় তার ঘেন্না হয়, অসম্মানিত বোধ করে, কিন্তু পরমুহূর্তেই বাবার ভালগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো নিয়ে মেতে থাকে। বাবাকে যদি ভালো না বাসত তাহলে আমাদের তো এতদিনে কিছু বলত, তা কিন্তু কখনো বলেনি। এটাই মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই বাবার সবকিছু নীরবে সহ্য করে মাথা যন্ত্রণা নিয়ে দিনের পর দিন কাটালেও প্রকাশ্যে কোনো অভিব্যক্তি নেই।
একটু থেমে সে আবার বলা শুরু করল- মানুষের মন খুব জটিল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় তার তল পাওয়া খুব সোজা। জলের মত। কিন্তু জলের ভিতর যে জল জমতে থাকে তার তল কী সত্যি অত সহজে পাওয়া যায়! তাছাড়া মানুষ অভ্যাসেরও দাস। একটা জায়গায় যদি অভ্যস্ত হয়ে যায় তাহলে খুব অত্যাচারিত না হলে সেই জায়গা থেকে তার হুট করে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। মায়ের ক্ষেত্রে আর একটা কারণও ছিল বাবাকে ছেড়ে না যাওয়ার। মধ্যবিত্ত সামাজিক সেন্টিমেন্ট, লোকলজ্জার ভয়। ছেলেদের চরিত্রের অবনতি মানুষ সহজে মেনে নিলেও মেয়েরা বাচ্চা ফেলে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে এটা এদেশের মেয়েদের কাছে এখনো অনেকটাই ভাবনার অতীত। তার থেকে মেনে নিতে, যন্ত্রণা পেতে তারা অনেক বেশি পছন্দ করে। তবে হ্যাঁ, ধর বাবা যদি মাকে রোজ বাড়ি ফিরে পেটাত, অত্যাচার করত, তাহলে হয়তো মা অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য হতো। কিন্তু সে রকম পরিস্থিতি হয়নি।
শাওন অবাক বিস্ময়ে বোনের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। মেয়েটা এত বড়ো হয়ে গেল কবে! এই তো সেদিন জামার বোতাম লাগাবার জন্য তার পেছনে ছুটতে হতো। হাত ধরে রাস্তা পার করতে হত আইসক্রিম কেনার জন্য । চুল বেঁধে জুতো জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হতো। প্রতি কথায় দিদি দিদি করত, সেই মেয়েটা এত পরিণত হয়ে গেল কিভাবে! মানুষের মনের জটিল রহস্যময় বিষয়গুলোকে এত সহজভাবে বিশ্লেষণ করে ফেলল, বুঝে গেল আশেপাশের যাবতীয় ঘটে চলা দৃশ্যপটকে। তবে কি সারাদিন বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকা মেয়েটা জীবনের সব ধাঁধার উত্তর খুঁজে পায় বইয়ের মধ্যেই!
দিদি ভালবাসা হলো দাবিহীন একটা অপার্থিব সুখ। তার সন্ধানেই মানুষের দীর্ঘ পথ হাঁটা। এত সম্পর্ক ভাঙছে, তার থেকেও বেশি গড়ছে। মানুষ ভালোবাসা পাবার জন্য বারবার প্রেমে পড়ছে।অপমানিত অত্যাচারিত হয়েও চেষ্টা করছে প্রিয় মানুষের ভালবাসা পাবার। তাই আজো ভালবাসার গল্প উপন্যাস কবিতা সিনেমা হিট। ভেবে দেখিস- যে মেয়েটি অত্যাচারিত লাঞ্ছিত হয়েও প্রাণপণে সবার সেবা করে যাচ্ছে, আমাদের পুরো সহানুভূতি তার দিকে। দজ্জাল মেয়ে বা বিদূষী মেয়ে আমাদের মন জয় করে না। রূপে গুণে অন্যনার পাশাপাশি যে সর্বক্ষণ অবহেলিত আমাদের ফোকাস তার দিকেই থাকে। এটাই হিউম্যান সাইকোলজি। আবার দেখ পুরুষটিও বাইরে যা খুশি করুক, তার যত বৌ-ই থাক, সে কিন্তু একজনের জন্যই নিবেদিত প্রাণ। ঘটনাচক্রে নানা সঙ্গ।
আমাদের বাবাকেই দেখ। সে তো আরামসে মাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারত, কিন্তু করেনি। সেও আসলে মাকে কোথাও না কোথাও ভালোবাসে। কিংবা নির্ভর করে। আর তার জন্যেই আমাদের প্রতিও তার এত টান। হয়তো এটা একটা তীব্র লাভ-হেট রিলেশন। আমরা বাবার মনের ভিতরে কী চলছিল, কেন কোন জায়গা থেকে বাবার এই অন্য আসক্তিগুলো তৈরি হলো, কিছুই জানি না। আসলে দিদি সবাই সবকিছুকে তাদের মত করে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে চলেছে।
শাওন খানিক চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল- আমি মায়ের মত সব মেনে নিতে পারব না। রাহুল তোকে পছন্দ করে জানার পর কোনোভাবেই আর …
তুই ভুল করছিস। রাহুল আমায় ভালোবাসে না। আমার প্রতি, বলা যেতে পারে আমার ডোন্ট কেয়ার আটিচিউডের প্রতি সে আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সেটা সাময়িক। আমি নিশ্চিত সে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। কারণ তার বৌয়ের চরিত্রে অলরেডি তুই বসে আছিস। কিন্তু এখন এটা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। রাহুলের সঙ্গে তোর বিয়ে হয়ে যায়নি, বা ভেঙেও যায়নি সম্পর্ক। কয়েকটা ঘটনা কেবল আমি তোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছি যাতে তুই পরে আকস্মিক শক্ না পাস।
আমি এখন কী করব?
কিছুই করতে হবে না তোকে। আপাতত আমরা আজ এখানে বসে আকাশ দেখব। দেখ- আকাশ জুড়ে কেমন অজস্র তারাদের মাঝে মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে। আর চাঁদটার দিকে তাকা। কে বলবে তার গায়েও দাগ আছে! এখন দেখলে মনে হচ্ছে উজ্জ্বল সোনালী নিটোল এক চাঁদ। আমরা এখন এই রূপটাই দেখি।
শাওনের সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। এই স্থান থেকে কেউ তাকে কোনোদিন উচ্ছেদ করতে পারবে না। সে সাঁঝবাতির কঠিন বর্ম দিয়ে মোড়া কাঁধের মধ্যে মাথা রেখে সেখান থেকে নিশ্চিন্তে আকাশ দেখতে লাগল।
***
নিটোল একটা ঝকঝকে চাঁদ। তার কোলে বসে চরকি বুড়ি সোনালি রূপালি সুতো দিয়ে জামদানি শাড়ি বুনছে। আর সেই শাড়ির একটা দিক ছুঁড়ে দিচ্ছে পৃথিবীর দিকে। শতাব্দী প্রাচীন এক গাছের তলায় বসা দুই বোন নিঝুম রাতে সেই শাড়ির খুঁট ধরে ভালোবাসার কথা ভাবতে ভাবতে অচিনপুরের দিকে যাত্রা শুরু করল…।
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..