ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
মাধবীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় হঠাৎই। আমি আমার নাকের ছোট একটা টিউমার অপারেশন করানোর জন্য মাধবীর শহরে যাই আমার ডাক্তার বন্ধু সুমনের কাছে। শীতের দেশে যাচ্ছি। সেখানে সমস্যা হতে পারে। বন্ধুর সাথেও শেষ দেখা হবে যাবার আগে।
সেদিন দুপুর প্রায় বারোটা। আমি মাধবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যান্টিনে বসে আমার বন্ধু সুমন ও তার প্রেমিকা বন্যাসহ চা খাচ্ছিলাম। মূলতঃ বন্যার সাথে দেখা করতেই এসেছি। সেও এখানেই পড়ে। সকাল থেকে আমরা ভার্সিটিতে ঘুরেছি। মেয়েদের হলের গেটে আরেক বন্ধুর ছোটবোনের সাথে দেখা করেছি। চা খেয়ে আবার যাব আরেক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।
ক্যান্টিনে খুব ভীড়। সবাই ছাত্র-ছাত্রী। হঠাৎ সুমন হাত তুলে বেশ খানিকটা দূরের এক টেবিলে ৩/৪ জনের একটি দলের দিকে ইশারা করে বলল, “এই মাধবী!” আমি তাকিয়ে দেখলাম মাধবী নামের সে মেয়েটি দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা। একটু মোটা, ছোটখাট গোলগাল মুখ। তেমন লম্বাও নয়। বন্ধুর ডাকে মেয়েটি খুশীতে ঝলমল করে উঠল। তারপর অনেকটা ছুটে আমাদের টেবিলে এসে বলল, “কি খবর?” তারপর বন্যার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার খবর কি?” আমি লক্ষ্য করলাম, মেয়েটির চেহারা ভীষণ মায়াবতী। কথা বলছে খুব আন্তরিকতার সাথে। আমার বন্ধুর সে অনেক কাছের মানুষ, ওর চোখমুখ তা বলে দেয়। পরে সুমনের কাছে ওর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছিলাম।
আমার সাথে পরিচয় হল খুব সাদামাটাভাবে। যেমন হয় আর কি। সুমন আলাপ করিয়ে দিল। সেদিন আমি কল্পনাও করিনি যে, এই মেয়ে আমার সঙ্গে আমৃত্যু এভাবে জড়িয়ে যাবে।
একবছর পরে এই মাধবীকে দেখেই আমি চোখ সরাতে পারিনি। অসম্ভব সুন্দরী। স্লিম, গায়ের রংও অনেক পরিস্কার। মানুষের চেহারা এতটা বদলে যায় কিভাবে, আমি আজও বুঝিনা।
ওইদিন রাতে মাধবী ফোন করেছিল সুমনের হলে। সুমনের সাথে কিছুক্ষণ
কথা বলার পর আমাকে চাইলো।
– তোমার ভয় করছে না?
– আমার ভয়-ডর কম। তাছাড়া অপারেশনটা জরুরী।
– আমি হলে করাতাম না। যতক্ষণ না করিয়ে থাকা যায়, থাকতাম।
আমি হাসলাম। কিছু মানুষের ডাক্তার ভীতি থাকে।
– এখানে তো তোমার কেউ নেই। অপারেশন বলে কথা। নাকি আছে?
আমি ওর খোঁচা বুঝলাম।
– আছে। অবশ্যই আছে।
একটু চুপ করে থাকলো। হতাশ হলো কিনা বুঝলাম না। কি ভাবলো সেইই জানে।
– কখন অপারেশন?
– মনে হয় কাল চারটা নাগাদ।
– দেখি, পারলে আসবো।
মাধবী এসেছিল। আমার সাথে দেখা হয়নি। আমি তখন ওটিতে।
আমাদের প্রেম হবার পর আমি মাধবীকে প্রশ্ন করেছিলাম, “কেন আমার প্রেমে পড়লে? আমাকে তুমি দেখেছ মোটে চারদিনে ৪/৫ ঘণ্টা। তারপর আমি চলে এসেছি। ঐটুকু সময়ে এমন কি দেখে আমাকে তোমার এত ভাল লাগলো?”
আমিও কবিতা পাগল। এই একটি জায়গায় আমাদের মিল সবচেয়ে বেশী। আমি লিখি কম। কিন্তু অন্যের কবিতা পড়ি, বন্ধুদের আবৃত্তি করে শোনাই। মাধবীর শহর ছেড়ে যেদিন আমি চলে আসি, তার আগের দিন বিকেলে আমরা ক’জন বন্ধু মিলে নদীর পাড়ে বেড়াতে যাই। সেদিন মাধবীও আমাদের সাথে ছিল। রিজু, সুমন, বন্যা, মাসুম আর আমরা। নৌকায় চড়ে নদীতে বেড়ানোর সময় আমি কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। আঠারো বছর আগের কথা বলছি। কোন কবিতা- ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, সবাই বলেছিল – “আরেকটা”। আমি মাধবীর অনুভূতি আলাদা করে খেয়াল করিনি। হয়ত তারও ভাল লেগেছিল বলেই আমাকে ভালবাসা। কিন্তু ও বলেছিল অন্যকথা। বলেছিল, “প্রথম তোমার যে জিনিসটা আমার ভাল লেগেছিল, তা ছিল তোমার কণঠস্বর। আর ক্লিনিকে ওটি থেকে ট্রলিতে করে অজ্ঞান অবস্থায় যখন তোমাকে ডাক্তার আর নার্সরা নিয়ে আসছিল, তখন তোমার নাক দিয়ে গলগল করে তাজা রক্ত পড়ছিল। আমি তোমার ঐ ব্যথাতুর মুখটার দিকে তাকিয়ে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম।”
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ।”
তাই কি? না। মোটেই সর্বনাশ না। মাধবী ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। মাধবীর কাছে আমিও তাই। এখনও।
প্রথমবার ক্যান্টিনে দেখা হবার পর মাধবীর সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হল আমার অপারেশনের পরের দিন। আমার নাক ফুলে গেছে, খুব ব্যথা, ঠিকমত কথা বলতে পারিনা। রাতে ব্যথায় ভাল ঘুমও হয়নি। বিকেলে পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে বিছানায় বসে আছি। সকালে ডাক্তার দেখে গেছে। কাল রিলিজ দেবে।
বন্যা আর সুমন পাশের বেডে বসে আছে। ওদের দু’জনকে দেখে মনে হয়, দু’জনেই ঘোরের মধ্যে আছে। সারাক্ষণ চোখে-মুখে অদ্ভুত এক মুগ্ধতা। দুপুরে যখন আমি চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম, আড়চোখে দেখেছি, সুমন ওর হাত ধরতেই লজ্জা পেয়ে সরে গেছে বন্যা। আমি দেখি, আবার দেখিনা। কি যে সুন্দর দৃশ্য!!!
ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বন্যার পরিবার মেনেও নিয়েছে। একটু আগে বন্যার মা এসেছিলেন আমাকে দেখতে। সবই ভাল, কিন্তু বন্যা দেখতে মোটেই ভালোনা। আমি পরে কথা প্রসঙ্গে একদিন ফোনে মাধবীকে বলেছিলাম, “সুমনের পাশে ওকে মানায়না। আমি সুমনকে বলেছি, বিয়ের আগে ভাল করে ভাবতে, যেহেতু চাচা-চাচীও রাজীনা।”
সুমন আর আমার বাড়ী একই জায়গায়। আমরা ছোটবেলার বন্ধু। ওর পরিবারের সবাই আমার আপনজনের মত। চাচা-চাচী চান সুমন ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করুক, যেহেতু সে নিজেও ডাক্তার। তাছাড়া বন্যাকে দেখে ওনাদের পছন্দও হয়নি।
আমার কথা শুনে মাধবী ভয়ানক রেগে গেল। রাগ করে সেদিন আর কথাই বললনা। তার পরের সপ্তাহে সে আমাকে চিঠিতে লিখেছিল : ধরা যাক বন্যার এক কোটি দোষ আছে যার জন্য ওকে বিয়ে করা যায়না। কিন্তু ওর একটাই প্লাস পয়েন্ট – সুমন তাকে চায়। বন্যার এই একটিমাত্র প্লাস পয়েন্ট ওর এক কোটি দোষকে ম্লান করে দেবার জন্য যথেষ্ট। আচ্ছা, তোমার কোন বন্ধু যদি তোমাকে বলে, মাধবী বিশ্রী মোটা। ওকে বিয়ে করিসনা। তাহলে তুমি কি করবে? কি করবে?
আমি অসম্ভব লজ্জা পেলাম। তাইতো! আমি সুমনকে এভাবে বলতে পারিনা। যার নয়নে যারে লাগে ভাল। তাছাড়া ভালবাসা বিষয়টা স্বর্গীয়। কেউ চাইলেই কাউকে ভালবাসতে বা ভুলে যেতে পারেনা। যেমন মাধবীকে এখন আমি নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসি। অথচ ওকে আমি দেখেছি খুবই অল্প সময়। মাধবীর চেয়ে কত সুন্দরী মেয়ে আমার পরিচিত ছিল। এখানে পড়তে আসার পরেও আমার চারপাশে কত সুন্দরী মেয়ে দেখি রোজ। কাউকেই আমার তেমন মনে ধরেনা। এ জীবনে আমি আর কাউকে কোনদিন ভালবাসতে পারবনা। মাধবী আমার বুকের সবটুকু ভালবাসা নিংড়ে নিয়েছে।
এদেশে সঙ্গী নির্বাচনের বিষয়টিও আমাদের দেশের চেয়ে আলাদা। এদেশে ছেলে-মেয়ে বড় হলে তাদের বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড না থাকলে বাবা-মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান এই ভেবে যে, নিশ্চয় তাদের সন্তানের কোন সমস্যা আছে। আমাদের দেশে ঘটে উল্টা। আমাদের বাবা-মারা মনে করেন, তাঁদের সন্তানরা প্রেমে পড়বে না। অথচ মানুষ প্রেমে পড়বে- এটাই আদি-অনন্তকালের নিয়ম। প্রকৃতি চলে তার স্বাভাবিক নিয়মে। তাই আমাদের ছেলেমেয়েরাও প্রেমে পড়ে, পালিয়ে বিয়েও করে। যদিও সব বাবামা মনে করেন, তাঁদের সন্তানদের সঙ্গী নির্বাচন করে দেয়া বাবা-মার স্বতঃসিদ্ধ অধিকার।
আমার বন্ধু পল এ্যারেঞ্জড ম্যারেজের কথা শুনে বলেছিল, “অসম্ভব! এটা হতে পারেনা। তুমি মিথ্যে বলছ। চিনিনা-জানিনা – তাকে বাবা-মার কথায় বিয়ে করে ফেলব? বল কি? এতো পাগলেও করবেনা। স্ট্রেঞ্জ!”
পল গত সপ্তাহে এলিজার সাথে ব্রেকআপ করেছে। ওরা গত দু’বছর লিভ টুগেদার করছিল। আমি কারণ জানতে চাইলে পল বলল, “এলিজা খুবই ভাল মেয়ে। কিন্তু আমি ওকে আর ভালবাসিনা। ভালবাসা না থাকলে একসাথে থাকার কোন মানে হয়না। এলিজাও এটা জানে। তাছাড়া আমি আরেকটি মেয়েকে ইদানিং পছন্দ করতে শুরু করেছি। তাই ওর সাথে ডেট করার আগে এলিজার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়া জরুরী। কারণ আমি ওকে আর ভাল না বাসলেও ওকে ঠকাতে পারিনা।”
আমি খুব কাছ থেকে এদের এ বিষয়টা দেখেছি। ওরা যখন বুঝতে পারে, দু’জনের মধ্যে আর ভালবাসা নেই, তখন ওরা উভয়ের সম্মতিতে ডিভোর্স নেয় বা ব্রেকআপ করে। আমাদের মত দিনের পর দিন ভালবাসার, ভালথাকার অভিনয় করেনা। ওরা সৎ। একটি সম্পর্কে থাকাকালীন সহজে অন্য আরেকটি সম্পর্কে জড়ায়না। আমরা পরকীয়া করি, এমন কি একই সাথে একাধিক প্রেমও করি। যেদিন ধর্ষণে সেঞ্চুরির পর মিষ্টি বিতরণের খবর জানতে পারি, লজ্জা-ঘৃণা-কষ্টে কুঁকড়ে গেছিলাম। কি নিদারুণ মানসিক দৈন্য! ছিঃ!
এরা বিয়ের আগে সেক্স করে। কিন্তু জোর করে নয়। যা হয়, দু’জনের সম্মতিতে হয়। এদেশে সেক্স দু’জনের সম্পর্ক, ভালবাসাকে আরো গাঢ় করে। আমাদের দেশে হয় উল্টোটা। ভার্সিটির হলে আমার পাশের রুমের এক বড়ভাই প্রায়ই তাঁর প্রেমিকাকে দুপুরবেলায় রুমে নিয়ে আসতো। মাস চারেক পর দেখলাম, ওদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। কারণটা আমরা জানি।
সেদিন বিকেলে ক্লিনিকে এসে মাধবী আমার খুব কাছে এসে একেবারে আপনজনের মত জিজ্ঞেস করেছিল, “এখন কেমন আছ?”
মনে হয় যেন কত জনমের চেনা! আমাকে বসে থাকতে দেখে ওর মুখ হাসিতে ঝলমল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাধবী আমাকে দেখতে এসেছে ওর এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। না জানি আমাকে দেখতে কি ভীষণ বাজে লাগছে!
– ভাল আছি।
– থ্যাঙ্ক গড! কাল তোমার অবস্থা দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমি রক্ত দেখতে পারিনা। আমি খুব ভীতু।
মাধবী “তেলাপোকা দেখে অজ্ঞান হওয়া” টাইপের মেয়ে। ওর মন ওর মুখের মতই কোমল। আমি তখন মনে মনে ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। ওর আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। কেন জানিনা, তখনই আমার আফসোস হতে লাগলো। আরো আগে কেন আমাদের দেখা হলোনা? আমার হাতে সময় নেই। আমাকে চলে যেতে হবে অনেক দূর! প্রিয় মাতৃভূমি, আপনজন সবকিছু ছেড়ে..
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
দ্বিতীয় পর্ব মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি…..
পরিচ্ছেদ- ১ সুবীরেশ সেন। কবি। সদ্য নর্থবেঙ্গল এসেছে।এখানেই শহীদুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। শহীদুল বিএ…..
পর্ব – চার ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে মাটির উপর খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। খড়ের উপর মোস্তাগের…..