মাধবী (পর্ব- ৯)

আলপনা তালুকদার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
মাধবী (পর্ব- ৯)

লন্ডনে ফিরে আমি প্রথম ফোনটা করলাম মাধবীকে। সোমাকে নয়। আমার নিজের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমি এক মিনিটের জন্যও মাধবীকে আর ভুলে থাকতে পারছিলাম না। সোমা বাসায় না থাকার কারণে মাধবীর সাথে আমার যোগাযোগ বেড়ে গেল। আমি নির্ভয়ে কথা বলতাম। ইমেল করতাম।

বুঝতে পারছিলাম, দেশে গিয়ে মাধবীর সাথে সুমনের বাসায় অন্তরঙ্গ  হওয়াটা উচিত হয়নি। সে কারণেই ওর প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে গেল  অনেক গুণ। ওকে ছোঁয়ার পর ও আমাকে প্রতিনিয়ত টানতো। বাঁধ একবার ভেঙ্গে গেলে যেমন পানি আটকানো যায়না, তেমনি আমার মনকে ওর কাছ থেকে আর সরাতেই পারছিলামনা। সব জেনে-বুঝেও আমরা দূরে সরতে পারছিলামনা।

– ভীষণ মেজাজ খারাপ। ইচ্ছে করছিল কষে একটা থাপ্পড় দেই।

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, “সে কি! কেন? কাকে?”

– হারামজাদা, আমার টাকায় কেনা গাড়ী আমি চালাচ্ছি। তোর সমস্যা কি?

– সত্যি সত্যি  মারোনি তো? ঠিক করে বল, কি হয়েছিল?

মাধবী জানালো, ও ওর ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে মাঠে গাড়ী চালানো শিখছিল। দু’জন লোক মাঠে ঘাস কাটছিল। মাধবীকে গাড়ী চালাতে দেখে একজন বাজে টোন করেছে। তাই শুনে সে ক্ষেপে গেছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রভাব। যেখানে পুরুষের কিছুই যায় আসেনা, সেখানেও তার টোন করা চাই। মেয়েরা সাহসী কিছু করবে, ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে যাবে – এটা তারা মেনে নিতে পারেনা।

মেয়েদের উপরে খবর্দারি করাকে আমাদের দেশের পুরুষরা নিজেদের ‘অধিকার’ বলে মনে করে। রাস্তায় মেয়েরা গাড়ী চালালে পুরুষ চালকরা সাইড দিতে চায়না। কোন মেয়েকে সাইকেল চালাতে দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। টোন করে। ইভটিজিং হল, মেয়েদেরকে বিরক্ত করে বন্য আনন্দ লাভ। মেয়েরা কোন কিছুতে ‘না’ বলতে পারবেনা। বললে পুরুষের পৌরুষে লাগে। রেপ, নারী নির্যাতনের পিছনেও দায়ী পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির। মেয়েরা সব সহ্য করে যাবে। বখাটের প্রেম প্রত্যাখ্যান করতে পারবেনা, পুরুষ গায়ে হাত দিলে বা টোন করলে সহ্য করবে, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীর লোকের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারবেনা, স্বামী-বাবা-ভায়ের হুকুম অমান্য করতে পারবেনা, পরিবারের অমতে বিয়ে করতে পারবেনা। এরকম হাজার ‘পারবেনা’।

আমাদের ব্যাপারটা মাধবীর পরিবারের সবাই জানতো। কারণ আমি চিঠি লিখতাম, ফোন করতাম। প্রথম প্রথম ‘বন্ধুত্ব’ ভাবলেও পরে সবাই বুঝেছে, আমাদের সম্পর্ক তার চেয়ে অনেক বেশী কিছু। আমি প্রপোজ করার পর পরই মাধবী ওর ছোট খালাকে বিষয়টা জানায়। তখন অবশ্য সে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলনা। পরে যখন বুঝেছে, সে আমাকে ভালবেসে ফেলেছে, তখন সবাইকে জানিয়েছিল তার মত।

মাধবীর আম্মার দিকের আত্মীয়দের সাথে ওর সম্পর্ক খুব খোলামেলা। তাই ও ওর মামী, এক খালু ও খালাদেরকে বলেছিল, ও আমাকেই বিয়ে করতে চায়। তাদের আপত্তিও ছিলনা। কিন্তু ওর বাবাকে সবাই ভয় পায়। তার উপরে কেউ কথা বলতে পারেনা। ফলে মাধবীর হয়ে কেউ ওর বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেনি।

মাধবীর আব্বার এক বন্ধু ছিলেন। যিনি মাধবীকে মেয়ের মত ভালবাসেন। কোন উপায় না পেয়ে মাধবী শেষ পর্যন্ত তাঁর সাহায্য চায়, যেন তিনি অন্ততঃ ওর বাবাকে বোঝান। মাধবীর বাবা তাঁর কথাও শোনেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল – ছেলের পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি। আদৌ সে কী চাকরী করবে, ব্যারিস্টারী পাস করবে কিনা, করলেও আইন পেশায় কেমন করবে, দেশে ফিরবে কিনা – এমন ছেলের হাতে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে তুলে দেবেন না। তাছাড়া মানুষ হিসেবে সে কেমন, কে জানে? মাধবীই বা তাকে কতটুকু চেনে? ক’দিনই বা দেখেছে? দশটা চিঠি আর বিশটা ফোনকলে মানুষ চেনা যায়?

মাধবী কি ওর বরকে চিনত? তাহলে তার সাথে বিয়ে দিল কেন? মাধবীর পরিবার কি তার বরকে চিনত? না। তবু বিয়ে হয়েছে। কারণ আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ের পছন্দের চেয়ে ছেলের চাকরী বা আর্থিক দিক বেশী প্রাধান্য পায়। এদেশে যেটা অসম্ভব। বাবামা কষ্ট করে সন্তান লালন-পালন করেন। তাই বাবামা মনে করেন, সন্তান কাকে বিয়ে করবে বা করবেনা, সে সিদ্ধান্ত দেবার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে। পাশ্চাত্যের মানুষরা তা মনে করেনা।

এনগেজমেন্টের দিনও মাধবী কেঁদেছে। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই সে কাঁদছিল। ওর অবস্থা দেখে ওর এক খালাতো বোন মনার দয়া হল। সে মাধবীর আম্মাকে বলেছিল, “খালাম্মা, ওর দিকটা দেখবেন না? ও দিন-রাত কাঁদছে।” মনা তখন হলে থাকতো। মাস্টার্সে পড়ছিল। মাঝে মাঝে মাধবীদের বাসায় আসতো। মাধবীর খুব ক্লোজ। আমাদের বিষয়টা জানে। চিঠিতে ওর কথা মাধবী আমাকে লিখেছিল। মাধবীর আব্বা বিষয়টা জানার পর ভীষণ রেগে গিয়ে মনাকে বাড়ী থেকে বের করে দেন। হলে চলে যেতে বলেন। মনা চলে যায়। তারপর মাধবীর আর কোন শুভাকাঙ্খী ওর আশেপাশে ছিলনা।

আমার সাথে যোগাযোগ করতে দেয়নি। ফোন ধরতে দেয়নি। বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। আমার চিঠিগুলোও ওকে দেয়া হয়নি। আমি সুমনকে ফোন করে বললাম, “ওর বিয়ের কথা হচ্ছিল। তুমি দেখ, মনে হয় ও বিপদে আছে।” জানিনা কি কারণে সুমন ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিলনা। বলল, “বিজি ছিলাম। তাছাড়া ফোনে কথা বলতে পারিনি। তুমি ভেবোনা। দরকার হলে আমি যাব।”

সুমন যায়নি। আমি রোজ ওকে ফোন করতাম। ও কোন খবরও নেয়নি। আমার তখন কাঁদতে ইচ্ছা করত। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারতামনা। আমি তাড়াতাড়ি দেশে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

মাধবী কিছুতেই যখন বিয়েতে রাজী হচ্ছিলনা, তখন ওর আব্বা ওর সেজ খালা ও খালুকে ডেকে পাঠান। এঁরা দুজনেই ব্যাংকের বড় অফিসার। মাধবী এঁদেরকে খুব মানে। মাধবীর আব্বা এঁদের বললেন, “তোমরা ওকে বোঝাও। আমি তো ওর খারাপ চাইনা। ও ভুল করতে চাইলেই আমাদের কি তা করতে দেয়া উচিত?”

অত উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলো মাধবীকে বাধ্য করল, আকাশকে বিয়ে করতে। বেচারা! পালিয়ে যেতেও পারেনি। আমি দেশে ছিলাম না।

আমাদের অভিভাবকরা মনে করেন, ছেলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভাল হলেই মেয়ে দিব্যি সুখে থাকবে। মেয়ে তাকে পছন্দ করে কিনা, তার সাথে মেয়ের মানসিকতা মেলে কিনা – এসব দেখার দরকার নেই। মেয়েদের আবার ইচ্ছা কি? অভিভাবকরা যা ভাল মনে করবে, সেটাই সে মেনে নেবে। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলেই ভালবাসা আসবে হাওয়া থেকে। আল্লাহর রহমত থেকে। না এলেই বা ক্ষতি কি? একবার বাচ্চা হয়ে গেলে ভাল না বেসে তো তার উপায় নেই। বাড়ীতে একটা কুকুর পুষলেওতো একসময় মায়া হয়,। আর সেখানে স্বামী!

ভারতে ও পাকিস্তানে কোন ছেলে বা মেয়ে পরিবারের অমতে ভিন্ন ধর্ম, জাত বা স্টেটাসের কাউকে বিয়ে করতে চাইলে যদি পরিবার তাকে নিবৃত করতে না পারে, তাহলে পরিবারের সবাই মিলে পরিকল্পনা করে ঠাণ্ডা মাথায় তাকে, কখনো কখনো তার প্রেমিকা বা প্রেমিকসহ তাকে হত্যা করা হয়। একে “honour killing”  বা “পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে হত্যা” বলা হয়। সমাজ একে ‘হত্যা’ বা ‘অপরাধ’ মনে করেনা। কি জঘণ্য চিন্তা! নিজের সন্তানের সুখ, ভালবাসা, এমন কি জীবনের চেয়ে পরিবারের সম্মান বেশী প্রিয়, সম্মান রক্ষা বেশী জরুরী। তবু ভাল, আমার মাধবীকে ওর পরিবারের লোকেরা অন্তত মেরে ফেলেনি! মাধবী অন্ততঃ বেঁচে আছে। সেজন্যই হয়তো এখনও আমিও বেঁচে আছি।

মাধবীর সাথে যোগাযোগ হবার আগ পর্যন্ত কত ভুল বুঝেছি ওকে। দোষ দিয়েছি। ভেবেছি, ভাল পাত্র পেয়ে আমাকে ভুলে দিব্বি ড্যাং ড্যাং করতে করতে স্বামীর ঘরে চলে গেছে। এখন বুঝি, আমার চেয়ে কিছুমাত্র কম কষ্টে ছিলনা মাধবী।

– জানাজানি হলে কি হবে?

মাধবী উদাস। আমিও চিন্তায় ডুবে গেলাম। এ ভাবনাটা যে আমার মাথায় আসেনি, তাতো নয়। ওর মত আমিও অসংখ্যবার ভেবেছি। কোন কূল-কিনারা পাইনি। শুধু মনে হয়েছে, মাধবীর পরিবার আমাদেরকে এভাবে আলাদা না করলে আজ আমরা একসাথে সুখে-দুখে ঘর করতাম। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ করতামনা। এতগুলো মানুষের জীবন এভাবে নষ্ট হতনা।

আমার কথা বাদ দিলাম। মাধবীর আপনজনেরা মাধবীর যে কী বিরাট ক্ষতি করেছে, সে বোধ কি তাদের আছে? আজ আমরা যা করছি, তারজন্য কি শুধু আমরাই দায়ী?

মাধবী আমাকে বলেছে, বাসররাতে কী অসহ্য কষ্ট সহ্য করেছে সে। মন না টানলে শরীরও যে টানেনা, সেটা আমার চেয়ে ভাল কে জানে? মাধবীর বাবা কি কোনদিন অনুভব করবেন, তাঁর জেদের কারণে আমরা এতগুলো মানুষ দিনের পর দিন কষ্ট পাচ্ছি? যে সময়গুলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের হবার কথা, সে সময়গুলো তাঁর মেয়ের কত কষ্টে কেটেছে?

সোমা ফিরে এলো। আমি খুব সাবধানে ওর সাথে আচরণ করতে লাগলাম, যাতে ও কিছু বুঝতে না পারে। মাধবীর সাথে ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিলাম। বাসার ফোন থেকে আর কথা বলতাম না। মাঝে মাঝে আমার কাজের জায়গা থেকে ফোন করতাম। আমাদের যোগাযোগ চলছিল ইমেইলে।

মাস ছয়েক পর। আমি সেদিন রাতে ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। আমার  ইমেইলে মাধবী একটা চিঠি পাঠিয়েছে। হাতে লিখে তারপর স্ক্যান করে পাঠানো। আমি পড়ছি আর বিমোহিত হচ্ছি। চিঠি পড়ে অন্য আরেকটা কাজে বিজি হয়ে গেলাম। ফলে আমি লগ আউট করতে ভুলে গেলাম। সোমা কাজ থেকে ফিরে বলল, “ল্যাপটপটা দাও তো, স্কাইপে আম্মার সাথে কথা বলব। আমার প্লট কেনার কি করল, শুনি।” আমি দিয়ে দিলাম। ফলে যা হবার তাই হল। সোমা আমাদের ইমেলইগুলো কপি করে নিল। জেনে গেল, আমরা এখনও দু’জন দু’জনকে ভালবাসি। সবই ঘটল আমার সামনে, কিন্তু আমার অগোচরে। এতদিন সোমা সন্দেহ করত যে, আমাদের যোগাযোগ আছে। আমি অস্বীকার করতাম। আজ প্রমাণ পেয়ে গেল।

ইমেইল থেকে সোমা মাধবীর ফোন নাম্বার পেয়ে ফোন করল। বিশ্রী ভাষায় গালি দিচ্ছিল। আমি বাধা দিতে গেলাম। সোমা আমাকে আঘাত করল। তার পরের অবস্থা ভয়াবহ। মারামারি, ধস্তাধস্তি, গালিগালাজ, কান্নাকাটি।

মাধবীর সাথে আমার যোগাযোগ আবার বন্ধ হয়ে গেল। ও সিম পাল্টে ফেলল। হয়তো চাচ্ছিল আর যোগাযোগ না রাখতে, যাতে আমার সংসার না ভাঙ্গে। কিন্তু আমার সাথে সোমার সম্পর্ক পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। সম্পর্ক এতটাই বাজে হয়ে গেল যে, ন্যূনতম মানবিক সম্পর্কটুকুও আর রাখা সম্ভব হল না। ফলে আমি আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এখন যেমন আছি, সোমার সাথে যখন ছিলাম, তখন এরচেয়ে ভাল ছিলাম কি? ভীষণ পরাধীন জীবন যাপন করেছি তখন। নিজের ইচ্ছামত শ্বাসও নিতে পারতামনা। মাধবী ছাড়াও সবসময় আমার মেয়ে বন্ধুদেরকে নিয়ে সন্দেহ। দূর্বিসহ জীবন ছিল আমার। কোন দোষ না করেও দিনরাত কথা শুনতে হয়েছে। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। আমি এখন ভাল আছি। বেশ ভাল আছি। এখন আমি আবার লিখি। বন্ধুদের সাথে কথা বলি। শুধু মাধবীর সাথে আর যোগাযোগ নেই। ও কেমন আছে, জানিনা। আর কষ্ট হয় নীলের জন্য।

আমি বাসা ছেড়ে চলে আসার পর সোমা তেমন বাইরে বের হতনা। কোথাও বেড়াতেও যেতনা। ছেলের দেখাশোনার জন্য জবও করতে পারতনা। দিনরাত বাসায় বসে থেকে থেকে আমার ছেলের ওজন বেড়ে যেতে লাগলো। আমি রোজ বিকেলে ওকে নিয়ে পার্কে খেলতে যেতাম, ওকে সাইকেল চালাতে দিতাম, এখানে ওখানে সাথে করে নিয়ে যেতাম। আমাদের দেশে ডিভোর্সের পর স্বামী-স্ত্রীর দেখা হওয়া, কথা বলা বা যোগাযোগ থাকাকে ‘পাপ’ হিসেবে ধরা হয়। এদেশে তা নয়। এদেশে ছাড়াছাড়ি হলেও বন্ধু বা পরিচিতজনের মত স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে। সন্তান থাকলে সম্পর্কটাকে আরও স্বাভাবিক বলে ধরে নেয় সবাই। শুধু ‘স্বামী-স্ত্রী’ না বলে বলা হয় ‘এক্স’। এই ‘এক্স’ শব্দটি আমার পছন্দ হয়না। সম্পর্ক কি কখনও ‘এক্স’ হয়? সম্পর্ক হয় সারাজীবনের। হয়ত সে সম্পর্ক কখনও ভাল, আবার কখনও খারাপ হতে পারে। কিন্তু এক্স হবে কেন?

আমি সোমাকে বললাম, “ওর যে ওজন বেড়ে যাচ্ছে, তুমি ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছনা কেন?” ও রেগে গিয়ে বলল, “আমি জানি ছেলের জন্য তোমার কেমন টান। অত দরদ থাকলে নিজের কাছে নিয়ে যাও।” ও খুব ভাল করে জানে আমি নীলকে নিজের কাছে আনতে পারবনা। এদেশে আমার দুইটা বাড়ী ছিল। বেচে দিয়েছি। এখন আমার নিজেরই থাকা-খাওয়ার ঠিক নেই ! কাজের সুবাদে আমি নানা শহরে ছুটে বেড়াই। তাছাড়া ছেলের স্কুল আছে। সোমা তবু ওকে দেখতে পায়, ছুঁতে পারে, আদর করতে পারে। আমি তো তাও পারিনা। আরো একটা কারণে নীলের জন্য বুকটা আমার ফেটে যায়। মানসিক চাপের কারণে সোমার মেজাজ ইদানিং আরো বেশী খিটখিটে হয়ে গেছে। যখন একসাথে ছিলাম, নীলকে সোমা মারধর করলে আমি ছুটে গিয়ে ওকে বাঁচাতাম। এখন আমি নেই। না জানি মনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেলেটার উপর কত অত্যাচার করছে! কেউ দেখার নেই। কেউ আগাবার নেই। ওরা থাকে আমার বন্ধু আওলাদের বাসার কাছে। আমি মাঝে মাঝে জেবাকে বলি, “গিয়ে ওদের খোঁজ নাও।”

আমি দুপুরে ম্যাকডোনাল্ডসে খেতে বসেছি। একটি ফুটফুটে বাঙ্গালী মেয়ে, বয়স উনিশ /কুড়ি হবে, আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডে নাম লেখা ‘রাফা’। আমি ভাল করে তাকালাম। এদেশে কারো দিকে সরাসরি তাকানো অভদ্রতা। অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো চোখে চোখ পড়লে এরা চোখ নামিয়ে নেয় বা মুচকি হেসে চলে যায়। আমাদের দেশের মানুষ হাঁ করে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ তাকিয়ে থাকলে যে মানুষের  অস্বস্তি হতে পারে, এটা আমরা বুঝিইনা। এই কি নাসরিন আপার মেয়ে? মেয়েটি পাশের টেবিলে খাবার সার্ভ করছে। মুখটা ভীষণ শুকনো। খুব বেশী মনমরা। কাজ করে যাচ্ছে রোবটের মত। আপা বলেছিলেন, রাফা বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছে। রাফার মধ্যে আমি মাধবীকে দেখলাম। ও কি এভাবে বাড়ী ছেড়ে চলে আসতে পারতো? মাধবী তখন সবে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছে। তখনো বেকার। এদেশে চাইলেই যেকেউ কোন না কোন কাজ করে নিজের খরচ চালাতে পারে। তাই এরা স্বাধীন। আমরা নই।

রাফা এখানে জব করছে। একা থাকে। আপার কাছে যায়না। কথাও বলেনা। নাসরিন আপা বিধবা। ওনার ব্যাবসা আছে। বেশ টাকাও করেছেন। রাফা ওনার অমতে যে ছেলেটিকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে, সে ব্যাংকে জব করে। আপার মোটেই পছন্দ না। ছেলেটি পাশের শহরে থাকে। আপার কারণে ওদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। আমার মেয়েটিকে দেখে মায়া হল। ইচ্ছে করছিল, কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, “কেমন আছ মামণি?” রাফা আমার মেয়ে হলে বলতাম, “যার সাথে ইচ্ছা বাঁচো। কারণ জীবনটা তোমার। আমার অধিকার নেই তোমাকে বাধ্য করি অপছন্দের কারো সাথে কষ্টকর জীবন কাটাতে।” রাফাকে কিছুই না বলে বেরিয়ে এলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, আমার আর মাধবীর কষ্টের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হলেও নাসরিন আপাকে অনুরোধ করব, রাফাকে ওর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে।

(চলবে…)

আলপনা তালুকদার। ড. আকতার বানু আলপনা (আলপনা তালুকদার নামেই বেশি পরিচিত) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর (শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট) - এর একজন অধ্যাপক। তিনি এসএসসি-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে রাজশাহী বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ