ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
মাধবীর সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে সোমার রাগ করাটাকে আমি অযৌক্তিক মনে করিনা। সোমা যদি কারো সাথে সম্পর্ক করতো, আমি কি সেটা মেনে নিতাম?
আমাদের দেশের পুরুষরা নিজেরা হাজার দোষ করলেও সমস্যা নেই। তারা নিজেরা পরকীয়া করে, পতিতালয়ে যায়, এমনকি কাজের মেয়ের সাথেও সেক্স করতে দ্বিধা করেনা। অথচ তারা চায়, তাদের স্ত্রীকে হতে হবে শতভাগ সতিসাদ্ধী।
এদেশে প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার সমান। একজন ছেলে যা যা করতে পারে, একটি মেয়েও তাই। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে মেয়েদের প্রতি যত বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তারমধ্যে মানসিক দিক থেকে সবচেয়ে নির্মম হল, স্বামীর বহুস্ত্রীর একসাথে বসবাস। শান্তির ধর্ম ইসলাম কেন এটাকে সমর্থন দিয়েছে, আমি ভেবে পাইনা। চোখের সামনে স্বামীকে অন্য স্ত্রীর ঘরে শুতে যেতে দেখাটা যে একটা মেয়ের জন্য কতটা অমানবিক, একটু কল্পনা করলেই বোঝা যায়। মেয়েরা এমন করলে পুরুষদের কেমন লাগবে? মাঝরাতে স্ত্রীর মোবাইল ফোন বেজে উঠলে যেখানে পুরুষদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়, সেখানে…।
পুরুষরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বহুবিবাহের মত অনেক আইন বানিয়ে নিয়েছে। এখনও নিচ্ছে। ইরানের পার্লামেন্ট আইন পাস করেছে যে, মেয়ের বয়স তেরো বছর হলেই পিতা তার পালক কন্যাকে বিয়ে করতে পারবে। ভাবা যায়?
আমার এক আরবীয় বান্ধবী আছে। নাম হুমা। ওর মুখে শুনেছি, ওদের দেশে পুরুষরা একাধিক স্ত্রীতো রাখেই, এমনকি একই কাজের মেয়ের সাথে বাবা, ছেলে, জামাই, ছেলের বন্ধু সবাই সেক্স করে। কোন স্ত্রী এর প্রতিবাদ করতে পারেনা। স্বামীরা কোথায়, কখন, কার সাথে কি করে বেড়াচ্ছে, তা জানার অধিকারও স্ত্রীদের নেই। একই কাজ স্ত্রী করলে তাকে মাটিতে পুঁতে পাথর মেরে বা গলা কেটে হত্যা করা হয়। কি চরম বৈষম্য!
আমাদের দেশের অনেক স্বামী তার স্ত্রীকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়না, পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সময় তার সাথে আলোচনা করেনা, স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বোরখা পরায় বা কোনকিছু করতে বাধ্য করে, লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়, চাকরী ছাড়ায়। এমন কি, স্ত্রীর চলাফেরায় নানা বিধিনিষেধও আরোপ করে। কোন বিবাহিত মেয়ের ছেলেবন্ধু থাকা যাবেনা, তাদের ফোন করা যাবেনা, দেখা করা যাবেনা- এমন হাজার বাধা। বিয়ে করেছে মানে স্ত্রীকে সারাজীবনের জন্য গোলাম হিসেবে কিনে নিয়েছে।
মাধবীর স্বামী ছিল এরকম টিপিক্যাল বাঙ্গালী মানসিকতার। মাধবীর সাথে তার মানসিক দূরত্বের এটিই ছিল মূল কারণ। আমি কোনদিন সোমাকে সন্দেহ করিনি, যদিও ওর অনেক ছেলেবন্ধু ছিল। ওকে কোনকিছু করতে বাধ্য করিনি। কোন কাজ করতে বাধাও দিইনি কখনও। এজন্যই সোমার সাথে এখনও আমার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক আছে।
সোমার সাথে সম্পর্ক খারাপ হবার পর আমি আলাদা বাসায় উঠলাম। খুব কষ্ট হতো নীলের জন্য। মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতাম। বাসায় যেতাম না। সোমার দূর্ব্যবহারের মাত্রা ছিল সীমাছাড়া। আমার অসহ্য লাগতো। যদিও বুঝতাম, ওর ওরকম আচরণ খুবই যৌক্তিক।
এখানে আমাদের বাঙালী কমিউনিটির মধ্যে একটা চমৎকার ট্র্যাডিশন গড়ে উঠেছিল। প্রতি উইকএন্ডে আমাদের কোন একজন বন্ধুর বাসায় পার্টি থাকতো। আমরা সবাই, এমনকি কেউ কেউ পাশের শহর থেকে লংড্রাইভ গাড়ী চালিয়ে পরিবার নিয়ে এসে এসব পার্টিতে যোগ দিতাম। সবাই একসাথে গল্প-গুজব করা, বাঙালী খাবার খাওয়া, নতুন যারা এদেশে এসেছে, তাদের সাথে আলাপ করা। ভীষণ মজা হত। আমরা ছেলেরা কথা বলতাম দেশ, রাজনীতি, ব্যবসা এসব নিয়ে। মেয়েরা আড্ডা দিত আলাদা, কখনও একসাথে। সবার সাথে দেখা হত। সবার ভাল-মন্দ খবর পেতাম এখানে।
এসব পার্টি আমার ভাল লাগতো আরো একটা কারণে। সেটা হলো, নীল এসব পার্টি খুব উপভোগ করতো। সবার বাচ্চাগুলো একসাথে হলে ও তাদের সাথে খেলতো, কথা বলতো। ও একদম বাংলা বলতে পারেনা। আমি চাইতাম, ওদের সাথে কথা বলতে গিয়ে হলেও ও কিছুটা বাংলা বলুক, শুনুক, শিখুক। সেইসাথে বাসার গুমোট পরিবেশ থেকে ও কিছুটা দূরে থাকুক। কেননা সোমা ভীষণ বদরাগী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। আমাকে জব্দ করতে না পেরে ও নীলের সাথে দূর্ব্যবহার করতো।
সোমার যে স্বভাবটা আমার সবচেয়ে বেশী বাজে লাগতো, তা হল, ওর সবসময় আমাকে ফলো করা। আমার কবিতায় কারা কারা লাইক দিয়েছে, কি কি কমেন্ট করেছে এসব সে দেখতো। আমার পাসওয়ার্ড হ্যাক করে পড়ে দেখতো, আমি কার সাথে কি কথা বলি। এমন কি, যেসব মেয়েদের সাথে আমার সম্পর্ক ভাল, তাদেরকে ফোনে গালি দিত। আজেবাজে মেসেজ পাঠাতো। আমি মাঝে মাঝে খুব লজ্জায় পড়ে যেতাম। তেমনি এক কাণ্ড করেছিল বেলির সাথে।
বেলি আমার ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী। ‘বান্ধবী’ বলা ঠিক হবেনা। আমরা একসাথে পড়তাম। কিন্তু বেলি আমাদের কারো সাথেই কথা বলতোনা। ভীষণ সুন্দরী ছিল। ওর বান্ধবী ছিল হাসি। সবসময় ওরা দু’জন একসাথে থাকতো। সে সময়ের একটি জনপ্রিয় টিভি নাটকের দুই চরিত্রের নামে আমরা ওদের নাম দিলাম “জামাল-কামাল”। ওদের নিয়ে আমরা ঠাট্টা করতাম, “ঐ দ্যাখ! জামাল-কামাল আইচে!” বেলি সেসব কিছুই জানতোনা।
একদিন কী মনে করে অনলাইনে খুঁজতে খুঁজতে বেলীকে পেয়ে গেলাম। ওর প্রফাইল দেখলাম। বিয়ে করেছে। বর ইঞ্জিনিয়ার। দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি হয়েছে। বেলি গৃহিণী। মেসেজ দিলাম। প্রথমে চিনতে পারলনা। পরিচয় দেবার পর চিনল। তারপর কথা বলতে বলতে আমাদের বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও আমার কবিতা পড়ত, লাইক দিত, কমেন্ট করত। একদিন লিখেছে, “এত প্রেম কার জন্য? ভার্সিটি লাইফে তো দেখি নাই”। পড়ে সোমা ভীষণ ক্ষ্যাপা। “এই নতুন বান্ধবী কই পাইলা? ও নিশ্চয় মাধবীকে মিন করছে..!” তারপর বেলীকে অকথ্য ভাষায় গালি। ওটাই ছিল সোমার সাথে থাকাকালীন আমার লেখা শেষ কবিতা।
আমি যখন একা থাকা শুরু করলাম, তখন বেলির সাথে প্রায়ই আমার কথা হতো। আমার সব কথা শুনে বেলি বলল, “তুমি যখন বৌ- ছেলের কাছে যাবে, তখন তোমার বৌয়ের সাথে আমার কথা বলিয়ে দিও। আমি মাধবীর ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে বলব। ও নিশ্চয় বুঝবে।”
আমি জানতাম, সেটা হবার নয়। তবু বেলি জোর করল বলে পরের উইকএন্ডে আমি আমার বাসায় গেলাম। প্রায় দুমাস পর ছেলে আমাকে দেখে ভীষণ খুশী। কিন্তু সোমার মনের তেমন কোন পরিবর্তন দেখলাম না। খুশী হওয়া তো দূরের কথা, সে মহাবিরক্ত। যেন আমি এসে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ওর জন্য আনা খেলনা, উপহার পেয়ে সে খুব উৎফুল্ল। আমি মাঝে মাঝে সোমাকে দেখছি। ওকে বোঝার চেষ্টা করছি। ছেলে সারাক্ষণ আমার পিছে পিছে, যেন আমি আবার হারিয়ে না যাই। ভীষণ মায়া হচ্ছিল ওর জন্য। শেষে আমি স্থির করলাম, বেলির কথাই শুনি। ও যদি সোমাকে বোঝাতে পারে, তাহলে ছেলের জন্য হলেও আমরা আবার একসাথে থাকব।
“কথা বল। বেলি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে”- শুনে সোমা অস্বাভাবিক রেগে গেল।
– তোমার স্বভাব কি কোনদিন বদলাবেনা? এতদিন পর বৌ-ছেলের কাছে এসেও বান্ধবী? আমি কারো সাথে কথা বলবনা…।
আমি তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলাম। বেলি মনে হয় সবই শুনতে পেল। পরে আমাকে বলেছে, “মিনিমাম কার্টেসী পর্যন্ত নেই। তোমার বৌয়ের মানসিকতা এমন কেন?” এ প্রশ্নের জবাব আমি জানিনা। সব মেয়েই কি এমন?
মাসছয়েক একা থাকার পর আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। এদেশে আমার আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না। তাই ঠিক করলাম, স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে যাব। অন্ততঃ প্রিয় মানুষগুলোর কাছাকাছি থাকা যাবে। বিশেষ করে মা যতদিন আছেন, তাঁর সঙ্গ পাব। তিনিও আমাকে দেখে সুখ পাবেন। কোর্টে প্র্যাক্টিস শুরু করব। আমার যেসব বন্ধুরা ইতোমধ্যে দেশে সেটল করেছে, তাদের সাথে কথা বললাম।
কথা ছিল, বার শেষ করেই দেশে ফিরব। মাধবীকে বিয়ে করে সংসার শুরু করব। তা হয়নি। আমি সোমার সাথে কথা বলে চলে এলাম দেশে। ঢাকাতে বাসা নিলাম। এক সিনিয়র আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজও শুরু করলাম। আমার বন্ধু মাসুম কাজ করে পত্রিকা অফিসে। ওকে বললাম, আবার লেখালেখি করতে চাই। ও বলল, ব্যবস্থা করে দেবে।
মাঝে মাঝে আমি নিজেই রান্না করতাম। ফল কিনে আনতাম। ফল আমার খুব প্রিয়। কিন্তু দেশে ফলে ফরমালিন দেয়া থাকতো বলে খেতে ইচ্ছা করতো না। মাঝে মাঝে আমার ছোট ভাই ও ওর বৌ এসে থাকতো আমার বাসায়। বড় আপাও আসতেন মাঝে মাঝে। আমার শ্বাশুড়ী প্রায়ই আসতেন আমার জন্য এটা সেটা রান্না করে নিয়ে। কিছুদিন মাও এসে ছিলেন আমার সাথে। আমি ওনার দেখাশোনা করতাম, গল্প করতাম, একসাথে খেতাম, রাতে একসাথে টিভি দেখতাম। আমার বেশ ভাল লাগতো। কিন্তু মুশকিল হল, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি নীলকে মিস করতে শুরু করলাম।
আসার আগে মাধবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। ও ওর ইমেইল আইডি ক্লোজ করে দিয়েছিল। কারণ সোমা প্রতিনিয়ত ইমেইল করে ওকে হুমকি দিচ্ছিল যে, ওর ইমেইলগুলোর কপি আকাশকে পাঠাবে। সোমা কতটা এ্যাগ্রেসিভ হতে পারে, ও সেটা জানে। ওর নতুন ফোন নাম্বার জানিনা। অফিসেও ফোন করিনি। বুঝতে পারছিলাম, ও আমাকে নিয়ে টেনশনে আছে। হয়তো ভয়ও পেয়েছে। স্বাভাবিক। দু’টো বাচ্চা আছে।
সুমনের বাসা থেকে সেদিন চলে আসার আগে শেষবার মাধবী আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমিও দু’হাতে ওকে বুকের সাথে জাপটে ধরে রেখেছিলাম। ওকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না।
– আমার মনে হয়, একটা বিষয়ে আৃমাদের একমত হওয়া উচিত। একসময় আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাজানি হবে। তখন কী করব?
আমি নিরুত্তর। মাধবী আমার দুহাত ধরে আমার চোখের দিকে তাকালো। আমি ওর চুলের গন্ধ পাচ্ছি।
– আমাদের কারো একজনের ডিভোর্স হলে আমরা বিয়ে করব। তুমি সোমাকে বা আমি আকাশকে ডিভোর্স দিয়ে।
আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। আমাদের মানসিকতা হল, একবার বিয়ে হয়ে গেলে তা সারাজীবনের জন্য। কেউ চায়না আলাদা হতে। চরম অশান্তিতে থাকলেও না। এতদিন বিদেশে থেকেও আমি ওদের কালচারকে আপন করে নিতে পারিনি। সোমার সাথে আমার এত ঝামেলা, তবুও তখন ওকে আমি ছাড়তে চাইছিলাম না। আমি কোন জবাব দিলাম না। মাধবী রাগ করল।
– মনে হচ্ছে, তোমার সাথে দেখা করতে আসা আমার উচিত হয়নি। তুমি তোমার বৌ-ছেলেকে আমার চেয়েও বেশী ভালোবাস।
আমি ভেবে এসেছিলাম, মাধবীর সাথে দেখা করব। তারপর আমরা কোন একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসব। এভাবে আর ভালো লাগছিল না। সোমার সাথে আমি আর থাকতে চাইছিলাম না। সোমাও বুঝে গেছিল যে, আমি ওকে আর ফিল করিনা। আমি জানতাম, মাধবী আকাশের সাথে ভাল নেই। ও সংসার করে শুধু দুই ছেলে-মেয়ের কথা ভেবে। মাধবী
আমাকে সবই বলেছে।
– প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আমার কাছে রেপের মত মনে হত। যাকে ভালবাসিনা তার সাথে সেক্স করা যে কী ভয়ংকর কষ্টকর, তুমি বুঝবেনা। এক একটা রাত মনে হত চরম শাস্তি ভোগ করছি। কখন ছাড়া পাব তার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম।”
আমি এ কষ্ট বুঝি। আমি মাধবীর অফিসে ফোন করলাম।
– আর ফোন করোনা। তোমার সংসার টিকবেনা। ছেলে আছে। আমি কিছুতেই চাইনা ও কষ্ট পাক।
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মাধবী ফোন কেটে দিল। আমি যার পর নাই অবাক হলাম। তারপর থেকে আর ওকে ফোন করিনি। অনায়াসে ওর অফিসে গিয়ে দেখা করতে পারতাম। যাইনি। কারণ ও যেহেতু চাচ্ছেনা, সেখানে দেখা করে কি লাভ?
ও জানতেও চায়নি আমি কেমন আছি। এমন কি, আমি যে দেশে এসেছি থাকব বলে, সেটাও বলার সুযোগ দিলনা। আমার সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেল। ফলে আমি দেশে থাকার সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। মনে হল, ফিরে যাই। মাঝে মাঝে ছেলেকে দেখতে তো পাব। ওদেশে অন্তত আর্থিক নিরাপত্তা আছে। অপঘাতে মৃত্যু নেই। ভেজাল খাবার নেই। কেনাকাটা করতে নিয়ে ঠকার ভয় নেই। বৃদ্ধ বয়সে কারো অবহেলা সহ্য করতে হবেনা। এখানকার মত পদে পদে নানা অনিয়ম হজম করতে হয়না।
ওদেশে আইন সবার জন্য সমান। প্রেসিডেন্ট-প্রধাানমন্ত্রী হলেও লাইনে দাঁড়িয়ে রুটি কিনতে হবে, বাসে-ট্রেনে সিট না থাকলে দাঁড়িয়ে যেতে হবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অফিসে, দোকানে – সবখানে সিসি ক্যামেরা। ফলে এখানে অন্যায় করা সহজ না। এরা করেওনা। এদের আর একটা ভাল গুণ হল, যেটা তারা ডিজার্ভ করেনা, সেটা তারা নেয়না। দিলেও না। আমাদের দেশে ঘটে উল্টাটা। আমরা জোর করে, ছলচাতুরী করে, বাধ্য করে হলেও অন্যের জিনিস কেড়ে নেই। ঘুষ দিতে বাধ্য করি। ওদেশে অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। কেউ অপরাধ করে পার পায়না। আমাদের দেশে রাষ্ট্র অপরাধী তৈরী করে। যখন মানুষ দেখে, অপরাধ করেও শাস্তি হয়না বা পার পাওয়া যায়, তখন সেটা দেখে আরো অনেক মানুষ অপরাধ করে।
আমি যখন ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন সোমা দেশে এলো ছেলেকে নিয়ে। উঠলো মায়ের বাসায়। আমার কাছে ওঠেনি। আমি এয়ারপোর্ট থেকে ওদেরকে ওর বাবার বাড়ী রেখে এলাম। তিনদিন পর সোমা এলো আমার বাসায়। যেমন লোকে পরিচিত কারো বাসায় যায়, তেমন। আধা ঘণ্টা ছিল। সবাই ধরে নিল, আমরা আবার এক হতে যাচ্ছি। শুধু আমি আর সোমা জানতাম, তা আর কোনদিনই হবেনা।
মা অসুস্থ। তাছাড়া শহরে বেশীদিন থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। আমার কাছে মাসখানেক থাকার পর আমিই মাকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে এসেছি। নাতি এসেছে শুনে তাকে দেখতে চেয়েছেন। আমি সোমাকে অনেক অনুরোধ করে রাজী করালাম।
ছেলে-বৌ নিয়ে শেষবার বাড়ী যাচ্ছি। সারাপথ ভেবেছি, আর হয়ত কোনদিন এভাবে যাওয়া হবেনা। হয়ওনি। লঞ্চে উঠে আমি বসে পেপার পড়ছিলাম। ছেলে নদী দেখছে। সোমা চুপচাপ, গম্ভীর, চিন্তিত। খুব প্রয়োজন ছাড়া আমরা তেমন কথাও বলছিনা। কেউ কারো দিকে সরাসরি তাকাচ্ছিওনা। কত কাছের মানুষ, আজ কত দূরে চলে গেছি!
আমরা সুখী দম্পতির মত বাড়ী পৌঁছালাম। আমাদের দেখে বাড়ীতে খুশীর বন্যা বয়ে গেল। আশপাশের আত্মীয়রা দেখা করতে এলো। এলো প্রতিবেশীরাও। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু নীল। আমি আর সোমা দু’জনেরই গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। নীল হয়েছে টকটকে ফর্সা, একদম বিদেশীদের মত। গোলগাল, নাদুস-নুদুস। কিন্তু স্বভাব হয়েছে আমার মত। কষ্টের কথা সহজে কাউকে বলতে চায়না। সোমার দিকেও মেয়েদের উৎসুক চোখ।
মা নীলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আমার ছোটবোন দু’দিন আগেই এসেছে। আমরা যে ক’দিন থাকব, সেও থাকবে আমাদের দেখাশোনার জন্য। মায়ের হুকুম। সে আমাদের শোবার ঘর, বিছানা আগেই পরিষ্কার করে রেখেছে। সোমা যেন কোনরকম অসুবিধা বোধ না করে, সেজন্য বাড়তি সতর্কতা সবখানে। মা বড় ভাইকে দিয়ে বেশী করে বাজার করিয়ে রেখেছেন। সোমা, আমার ছেলে কী কী খেতে পছন্দ করে, সেগুলো সব রান্না হচ্ছে, হবে।
আমি সন্ধ্যেবেলা একবার বাইরে বেরিয়েছিলাম। আমার বন্ধু ফজলু এসেছিল দেখা করতে। ওর সাথে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধার পর্যন্ত চলে গেছিলাম। অনেক কথা হল। কী করছি, কেমন আছি, কদিন থাকব – এসব। ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে পড়েছি, খেলেছি, সিনেমা দেখেছি। এখন ও ব্যবসা করে। জমিজমাও আছে। আমি এসেছি শুনে ছুটে এসেছে। ওর বাড়ী আমার বাড়ী থেকে খুব কাছে নয়। কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেল। আমি বললাম, “এবার যা। কাল দেখা হবে।” ও শুনলনা। আমাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে তারপর গেল। নিখাদ ভালবাসা। বাল্যবন্ধুত্বের মত এমন নিঃসার্থ ভালবাসা বোধহয় আর কোন সম্পর্কে হয়না।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমি সোমাকে বললাম, “নীলকে নিয়ে তুমি শুয়ে পর। জার্নি করে এসেছ। তোমরা ক্লান্ত।” সোমা শুতে গেল। আমি মার সাথে বসে গল্প করছিলাম। ছোট বোন, মেজ ভাইও ছিল। মা সম্পত্তির কথা তুললেন। “আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তোরা সবকিছু ভাগ বাটোয়ারা করে নে।”
বাবা ছিলেন বৈষয়িক মানুষ। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি সম্পদও করেছিলেন ঢেড়। আশেপাশের দু’চার গ্রামের মধ্যে আমাদের মত এত জমিজমা কারো নেই। সেসব আমাকে টানেনা। বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশী সম্পদের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। প্রয়োজন মিটলেই হল। আমাদের দেশের মানুষরা ভাল-মন্দ সব পথে সম্পদ অর্জন করে কুক্ষিগত করতে চায় তার পরিবার ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। এজন্যই এরা যত পায়, তত আরো চায়। সম্পদের এই সীমাহীন লোভ তাকে অনেক সময় অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করে। বিদেশে এটা নেই। ওরা বর্তমান নিয়ে বাঁচে। সন্তানদের জন্য কিছু রাখতেই হবে, তারা তা মনে করেনা। তারা চায় সন্তানেরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তার প্রয়োজন নিজেই মেটাবে। তবে ওরা কঠোর পরিশ্রম করে। যা আয় করে তাই খরচ করে। ওদের সঞ্চয়ের চিন্তা থাকেনা। কারণ ওরা পেনশন পায়, স্বাস্থ্যবীমা আছে চিকিৎসার জন্য, বাড়ী না থাকলে কাউন্সিলে আবেদন করলে বাড়ী বা ঘর পাওয়া যায়, এমনি আরো হাজার সুবিধা।
আমার মনে আছে, যেদিন নাসরিন আপার স্বামী স্ট্রোক করে হঠাৎ মারা গেলেন, সেদিন আপা খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন। স্বামী শোকের চেয়েও আর্থিক অনিরাপত্তার কথা ভেবে। আবেদ ভাই ছিলেন এখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পড়াপাগল মানুষ। মোটেই বৈষয়িক নন। নাসরিন আপাও কিছু করতেন না। রাফা-রায়া তখন স্কুলে পড়ে। তেমন সেভিংসও নেই। আমরা আপাকে একটি রেস্টুরেন্টে জব দিলাম। কাউন্সিলে আবেদন করিয়ে ওনার সাধ্যের মধ্যে বাড়ীও কিনে দিলাম। এখন উনি বেশ ভাল আছেন।
আমি চাইলে আলাদা ঘরে শুতে পরতাম। ছোট বোনকে বললেই ব্যবস্থা করে দিত। মা জানলে কষ্ট পাবেন। তাই সোমার ঘরেই ঘুমাতে গেলাম। নীল ঘুমে অচেতন। ছেলেটা ঘুমালে একেবারে কাদার মত। কোন হুঁস থাকেনা। শুধু কোলবালিশ সরে গেলে চোখ বন্ধ করেই হাতড়ায়। এখানে কোলবালিশ নেই। একটা মাথার বালিশই পায়ের নীচে দিয়েছে। আমি দেখলাম সোমা জেগে আছে।”ঘুমাওনি? কোন অসুবিধা হচ্ছে?” সোমার ভার্টিগো আছে। মাঝে মাঝে মাথা ব্যথায় ঘুমাতে পারেনা। সোমা আমার কথার জবাব দিলনা। “তোমার শরীর ভাল আছে তো?”। সোমা এবারও নিশ্চুপ। আমি আর কথা না বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। জানি ঘুম আসবেনা, তবু।
আমাদের মাঝখানে নীল। আমি সোমার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলাম। ও যেন না ভাবে, রাতের অন্ধকারে আমি ওর কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করব। আমি নীলের গায়ে হাত দিলাম। আমার রক্ত, আমার অস্তিত্ব, আমার বংশধর! ও আমাকে ভুলে যাচ্ছে, ওর রুট ভুলে যাচ্ছে। ও যে এ বাড়ীর অংশ, একসময় ওর তা মনে থাকবেনা। পরগাছা হয়ে রয়ে যাবে কোথাও, কোন দেশে। মানুষের জীবনইবা কতটুকু? বাবা মারা গেছেন, আমিও মারা যাব, একদিন নীলও। কি যায় আসে কোথায় কিভাবে বাঁচলাম? যেখানেই থাকুক, ভাল থাকুক, আনন্দে থাকুক – আমি এর বেশী কিছু চাইনা। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সোমা ঘুমিয়ে গেছে। ভাল হয়েছে। ও কিছু টের পায়নি।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..