ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পূর্ব প্রকাশের পর…
(পর্ব – এগারো)
সকালে ছেলের হাত ধরে আমি গ্রামের পথে বেড়াতে বের হলাম। পরিচিত মানুষদের অনেকের সাথে দেখা হল। আমি আদর করে মাঝে মাঝে নীলকে ডাকি “মুটু কাঠবিড়াল” বলে। ও ক্ষেপে যায়। অনেকদিন ঐ নামে ডাকা হয়না। আমি ওকে ওর দাদার বসত ভিটা, পুকুর, ফলের বাগান, ফসলের জমি – সব ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছি। ও গ্রাম দেখেনি। এর আগে যখন এসেছিল, তখন ও ছোট ছিল। ওর তেমন কিছু মনে থাকার কথা নয়। গ্রাম অনেক বদলে গেছে। নতুন নতুন ঘরবাড়ী, দোকানপাট হয়েছে। শুধু ফসলের মাঠগুলো তেমনি আছে। আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় এসব মাঠে কত ঘুড়ি উড়িয়েছি, ফুটবল খেলেছি।
ছোটবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম। ভোরবেলা উঠে আম কুড়ানো, পুকুরে- নদীতে সাঁতা কাটা, মাছধরা, গাছে চড়া, সাইকেল চালানো- সারা গ্রাম মাথায় করে রাখতাম। একটু দূরে দেখতে পেলাম ছোটকাকা আসছেন। বয়সের ভারে শরীর ভেঙ্গে গেছে। আমার বাপ-চাচাদের মধ্যে ইনিই ছিলেন সবচেয়ে সৌখিন মানুষ। “খাইব দাইব, ঘুরিয়া বেড়াইব” টাইপ। ওনাকে দেখে আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
আমি ছোটবেলা থেকেই হাঁস-মুরগি-কবুতর পুষতাম। এদের খাবার দেয়া, দেখাশোনা আমি নিজে করতাম। হাঁস- মরগি ও ডিম বেচা পয়সা আমি জমাতাম। জমানো টাকা লুকিয়ে রাখতাম বইয়ের মলাটের ফাঁকে। সেই জমানো টাকা দিয়ে বন্ধুদের সাথে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। আমরা তিন ভাই ছিলাম খুব কাছাকাছি বয়সের। তিনজনই সমান বিচ্ছু। বাবা এই দুষ্টামির কারণে মাঝে মাঝে কিঞ্চিত প্রহার করতেন। বাবার কড়া হুকুম ছিল, মাগরেবের আজানের সাথে সাথে বাড়ীতে ঢুকে পড়তে বসতে হবে। একদিন সন্ধ্যা হবার অনেক পরে ভয়ে ভয়ে বাড়ীতে ঢুকে দেখলাম, আবহাওয়া থমথমে। বুঝলাম, মাইর অনিবার্য। আজ মাও কিছু করতে পারবেন বলে মনে হলনা। আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা ঘোষণা দিলেন, “তর আর লেখাপড়ার দরকার নাই। তর বইপত্র আজই আগুন দিয়া পুড়ুম”। আমার বুক ভয়ে ধক্ করে উঠল। বইয়ের শোকে না, বইয়ের মলাটের ভিতরে দেড়-দুই বছরের জমানো ৭/৮ শ’ টাকার শোকে। আমি ছোট কাকাকে বললাম, “কাহা, না পড়ি ক্ষতি নাই। বইগুলান কি দোষ করল? অন্য কেউ পড়তে পারব। আপনে বাবারে পোড়াইতে মানা করেন।” সেযাত্রা ছোটচাচার কারণে বেঁচে যাই।
পরের রাতে ঘটল বিপত্তি। নীলের গায়ে জ্বর এলো। শীতের দেশ থেকে এসে গরমে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। আবহাওয়া স্যুট করছেনা। জ্বরের অষুধ খাইয়ে ওকে শোয়ালাম। সোমা পাশেই শুয়ে আছে। মনটা ভারী। আরো নতুন চিন্তা জুড়ে দিল ছেলে। আমি বললাম, “তুমি ঘুমাও, আমি বাবুকে দেখছি”। আমি বালিশে হেলান দিয়ে নীলের কাছে বসে আছি। ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছি। মনে হতে লাগলো, ওকে এখানে না আনলেই বোধহয় ভাল হত। বেচারা কষ্ট পাচ্ছে। এখানে ভাল ডাক্তার আছে কিনা আমি জানিনা। বিদেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়া সব অষুধ পাওয়া যায়না। আমি ওকে জ্বরের যে অষুধ খাওয়ালাম, তা মোড়ের দোকান থেকে কেনা। ফোনে কথা বলে সোমাই আনতে বলল। তার ডাক্তার বান্ধবী ওটাই খাওয়াতে বলেছে। ওখানে এদেশের মত ডাক্তাররা পার্সেন্টেজের লোভে অপ্রয়োজনীয় অষুধ বা টেস্ট দেয়না। ওদের রোগের ডায়াগনোসিসগুলোও হয় খুবই নির্ভুল। ভেজাল অষুধ, ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নেই। নীলের জন্য আমারও দুশ্চিন্তা হতে লাগলো।
সারাদিন ছেলে কত মজা করেছে! আমার ছোটবোনের ও ভায়েদের বাচ্চাদের সাথে খেলেছে। এমনকি, আমার সাথে পুকুরে নেমে গোসলও করেছে। খুব আনন্দ পাচ্ছিল ও। বিকেলে ওকে গ্রামের রাস্তায় সাইকেল চালাতে দিয়ে আমি মোড়ের চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। বড় ভায়ের ছেলে লিপন ওর সাথে ছিল। বিকেল থেকেই গা গরম ছিল। পুকুর থেকে তোলা বিশাল কাতলা মাছ রান্না হয়েছে। ভাল করে খায়ওনি। আমি জ্বর মেপে দেখেছি। একশ এক। হঠাৎ সোমা বলল, “আমি কাল ফিরে যাব”। অনেকটা হুকুমের মত। আমি বললাম, “ঠিকআাছে। এখন ঘুমাও। আমি জেগে আছি।”
বাকী রাত আমি জেগে কাটালাম। নীল আর সোমা ঘুমিয়ে গেল। আমি বার বার ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি, আবার জ্বর এলো কিনা। সারারাত কত কথা মনে পড়ল। ওর ছোটবেলার কথা ভেবে বার বার চোখ ভিজে উঠেছে। কাল চলে যাবে। এভাবে পাশাপাশি হয়তো আর থাকা হবেনা। আমি আধো অন্ধকারে সোমার মুখের দিকে তাকালাম। ওর জন্য মায়া হল। আমার সাথে বিয়ে না হয়ে অন্য কারো সাথে হলে কি ও সুখে থাকতো? মানুষের বেসিক নেচার তো বদলায়না। কি জানি! হয়তো হত, হয়তো হতনা।
ভোরবেলা লক্ষ্য করলাম ছেলের সারা গায়ে লাল লাল র্যাশ বেরিয়েছে। আমি ওদের নিয়ে ফিরে এলাম ঢাকায়। রেখে এলাম সোমার বাবার বাড়ীতে। ধীরে ধীরে নীল সেরে উঠল। মাস তিনেক পর সোমা ফিরে গেল লন্ডনে। ছেলের স্কুল আছে।
একদিন সকালবেলা কী মনে করে আমি বেলিকে ফোন করলাম।
– একা একা থাকি। কি খাই, না খাই। বান্ধবী হিসেবে তোমার কি উচিত না, মাঝেমধ্যে বাসায় ডেকে দাওয়াত করে খাওয়ানো? কাল দুপুরে তোমার বাড়ীতে আমার দাওয়াত। তোমার বরকে বল, ভালমন্দ বাজার করতে।
– কাল না। পরশু।
– কেন? কাল কি সমস্যা?
– কাল আমার মেয়ের কোচিং এ পরীক্ষা আছে।
বেলির বড় মেয়েকে এক বছর ধরে কোচিং করাচ্ছে ভিখারুন্নিসাতে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানোর জন্য।গতবছর চান্স পায়নি। খুব টেনশনে আছে। গত বছর মোটা ডোনেশন দিয়েও ভর্তি করতে পারেনি। অন্য একটা স্কুলে পড়ছে। এবার আবার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াবে। পরীক্ষা যেন মেয়ের না, বেলির। রোজ সকালে স্কুলে, বিকেলবেলা কোচিং- এ আনা-নেয়া করে। বাসায় টিউটর এসে পড়ায়। বেলি নিজেও পড়ায়। ওর বর দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ভর্তি ফরম জোগাড় করেছে। রীতিমত ভর্তি যুদ্ধ। আমার বেলির জন্য খারাপ লাগছিল। বেচারা! কেবল ক্লাস ওয়ান। ভর্তি নিয়ে আরো যে কত ভোগান্তি বাকী আছে, কে জানে? আমার মায়া হয় ওর মেয়েটার জন্যও। নীলের বয়সী। খুব মিষ্টি দেখতে। ওইটুকু শিশুর উপরে এত চাপ!
আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ঐ বয়সে আমরা কিছুই পড়িনি। সাত/আট বছরে সরাসরি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। কোন পরীক্ষা ছাড়াই। একটা শিশুশিক্ষা বই, একটা খাতা আর একটা পেন্সিল নিয়ে স্কুলে যেতাম। পড়ার চেয়ে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো, মারামারি, ভাব, গাছে চড়ে ফল পাড়া- এসইব বেশী হত। কি মজার ছিল সেই শৈশব! এখনকার বাচ্চারা শৈশব কী, ওরা জানেই না।
ইংল্যান্ডে বাচ্চাদের ভর্তির ব্যাপারটা আমাদের চেয়ে আলাদা। একদিন সকালবেলা দেখলাম, দরজার কাছে চিঠি পড়ে আছে। যেমন মাধবীর চিঠি ফেলে দিয়ে যেত দরজার নীচ দিয়ে। পড়ে দেখলাম, নীলকে স্কুলে পাঠানোর তাগিদ। এদেশে শিশুদেরকে স্কুলে ভর্তির জন্য কোন ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়না। তিন/সাড়ে তিন বছর বয়সে বাড়ীর কাছের কোন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করালেই বাবা-মার দায়িত্ব শেষ। বাচ্চারা ওদের মেধা অনুযায়ী উপরের ক্লাসে উঠতে থাকবে। ছয় বছরে ওরা যাবে প্রাথমিক স্কুলে। মেধা অনুযায়ী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে। পাস করে পছন্দমত চাকরীও পাবে। কোথাও কোন ধরাধরি নেই। কোচিং, ভর্তি কোচিং, প্রাইভেট পড়াও নেই।। বাবা-মাকে তেমন পড়াতেও হয়না। স্কুলের পড়া স্কুলেই করানো হয় বেশী। আমরা যারা বাঙালী, তারা একটু বেশী খেয়াল করি। কারণ আমাদের বাচ্চাদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে ভাষা একটি বড় সমস্যা।
একদিন সন্ধ্যায় আমার প্রফেসরের বাসায় দাওয়াত খেতে গেছি। আমরা পাঁচ জন, যারা ওনার অধীনে কাজ করছি। স্যারের ছেলে এ্যাবি, বয়স নয়/ দশ। অল্প সময়ের মধ্যে আমার সাথে ওর ভাব জমে গেল। আমি বাচ্চাদের সঙ্গ খুব পছন্দ করি। ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি সবচেয়ে বেশী যেতাম রেজা ভায়ের বাসায়। উপলক্ষ্য – ওনার দুই মেয়ে আর ছেলে। আমি ওদের সাথে গল্প করতাম, খেলতাম। মাঝে মাঝে ওদের পড়াও দেখে দিতাম। ছোট ছেলেটা আমার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকতো। ঘাড়ে চড়ত। আমি ওদের জন্য চকলেট, পেয়ারা কিনে নিয়ে যেতাম। নীলা ভাবী কফি বানিয়ে খাওয়াতেন। মাঝে মাঝে রাত হয়ে যেত। নীলা ভাবী না খেয়ে আসতে দিতেন না।
রেজা ভায়ের ছোট বোন মিতু ওনার বাড়ীতে থেকে কলেজে পড়ত। ওর সাথেও আমার বেশ ভাব হয়ে গেছিল। পরে এখানে চলে আসার পরেও আমি বাচ্চাগুলোকে খুব মিস করতাম। আমি মিতুকে চিঠি লিখে ওদের খবর নিতাম। পরে জেনেছিলাম, মিতু আমাকে পছন্দ করত। কখনো বলেনি। আমিও ওকে সেভাবে দেখিনি। একদিন নীলা ভাবীর কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। ফোন করে কে, কেমন আছে খোঁজ নিচ্ছি। ভাবী বলল, “মিতুর একটা ভাল বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু সে বলছে, সে তোমাকে বিয়ে করবে। তোমার কি মত?” আমি তখন মাধবীকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। তখনো আমি ওকে প্রেম নিবেদন করিনি। তবে আর কারো কথা ভাবার মত অবস্থায় আমি ছিলামনা। পরে মিতুকে চিঠিতে আমি মাধবীর কথা বলেছিলাম। মিতুর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর দুই ছেলে। আমার সাথে কথা হয় এখনো। ভাল আছে। রেজা ভায়ের ছেলেমেয়েগুলো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
এ্যাবি তার হোমওয়ার্কের একটি অংক আমাকে করে দিতে অনুরোধ করল। আমি ওর খাতা-কলম হাতে নিতেই স্যার বললেন, “আমরা এটা করিনা। স্কুল থেকে কড়া নিষেধ আছে। ও নিজে নিজে চেষ্টা করে শিখুক। তাতে ওরা স্বাবলম্বী হবে। না পারলে শিক্ষক করাবেন। তবে হ্যাঁ, যে সমস্যার সমাধান পারছেনা, তার কাছাকাছি কোন সমস্যা তৈরী করে সেটার সমাধান করে দেয়া যেতে পারে।” স্যার ছেলেকে ঘুমানোর জন্য দোতলার ঘরে যাবার আদেশ দিলেন। এরা নিয়মের খেলাপ করেনা। বাচ্চারা ঠিক সময়ে ঘুমাবে, বড়দের আড্ডায় থাকবেনা। এ্যাবি মন খারাপ করে চলে গেল।
সোমা একদিন নীলকে বলেছিল, “বাবা, তুমি ডাক্তার হবে। আমাদের পরিবারে কেউ ডাক্তার নেই।” শুনে ছেলে জানালো, সে তার যা ইচ্ছা, তাইই হবে। তবে আমাদের পরিবারে ডাক্তার আসবে। কারণ সে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করবে। আমি শুনে হাসলাম।
ওদেশে ছেলেমেয়েরা যোগ্যতা থাকলে নিজের ইচ্ছামত যা খুশী পড়তে পারে। যা খুশী হতে পারে। তার ফলাফল দেখে স্কুল তার মেধার জন্য সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় স্থির করে দেয়। আমাদের মত বাবামার চাপে বা বাধ্য হয়ে কেউ কিছু পড়েনা। আমার মনে আছে, ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক রুমে আমরা সতেরো জন ছিলাম! মাধবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে চেয়েছিল। ওর পরিবার ভর্তি পরীক্ষাই দিতে দেয়নি।
সোমা ফিরে যাবার কিছুদিন পর আমিও ফিরে গেলাম। আমার এদেশে আর ভাল লাগছিলনা। নিজের পেশাগত কাজে মন বসছিল না। মাধবীও যোগাযোগ রাখেনি। ফলে দেশে থাকা অর্থহীন মনে হতে লাগলো। নীলের জন্য মন কেমন করছিল।
আমি ফিরে গিয়ে উঠলাম আমার বাড়ীতেই। সোমা তখনও আমার স্ত্রী। আমি ভেবেছিলাম, প্রায় দেড় বছর আমরা আলাদা আছি। এতদিনে সোমা পুরনো সব কথা ভুলে হয়তো চাইবে আবার একসাথে থাকতে। অন্ততঃ নীলের জন্য। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার প্রতি সোমার সন্দেহ কমার বদলে হাজারগুণ বেড়ে গেছে। ওর ধারণা, এই দেড় বছর মাধবীতো বটেই, আরো বহু মেয়ের সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক হয়েছে। আমি পুরোপুরি হতাশ হলাম। কিছু কিছু সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মুগ্ধতা ছড়ায়। আবার কিছু কিছু সম্পর্ক প্রবাহমান থাকার পরেও বিষময় মনে হয়। সম্পর্কের মধ্যে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা না থাকলে সে সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কোন মানেই হয়না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম। তারপর স্থায়ীভাবে আলাদা বাসায় উঠলাম। সোমা ও নীলের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। সোমার কারণে নীলকে দেখতে যেতেও আমার আর ইচ্ছে করতোনা। আমরা চিরতরে আলাদা হয়ে গেলাম। নীল রয়ে গেল সোমার কাছে।
আলাদা হবার পর আমার হাতে অফুরন্ত সময়। অবাধ স্বাধীনতা। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। মনে হলো, দীর্ঘদিনের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেলাম। প্রতিনিয়ত কারো খবরদারি আর সন্দেহ আমাকে তাড়া করবেনা। আমি আবার আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ – কবিতা লেখা শুরু করলাম। নির্ভয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে কথা বলতাম।
আমাদের দেশে মেয়ে বন্ধু মানেই প্রেমিকা মনে করা হয়। আমার কাছে বন্ধু মানে শুধুই বন্ধু। হোক সে ছেলে বা মেয়ে। সোমার সাথে ওর অনেক ক্লাসমেট, চাচাতো-খালাতো ভাইদের যোগাযোগ ছিল। আমি কখনো তাদেরকে নিয়ে ওকে সন্দেহ করিনি। আমি যখন প্রথম বাড়ী কিনি, তখন নীল হয়নি। ফলে অতবড় বাড়ী আমাদের দরকার ছিলনা। আমি সাবলেট দিলাম বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার হিমেল ভাইকে। আমি যখন বাসায় থাকতামনা, সোমা একা থাকতো। পাশের রুমে হিমেল ভাই। তবু কখনো আমার কিছু মনে হয়নি। ছ’ মাস পরে হিমেল ভাই বিয়ে করে বৌ নিয়ে এলেন। এখনো সোমার সাথে ওদের যোগাযোগ আছে। আমার নেই।
অনেকদিন পর মিশেলের ফোন পেলাম। বাঙ্গালী পার্টিগুলোতেই ওর সাথে আমার আলাপ। পরে বন্ধুত্ব। অনেকদিন ওর কোন খবর জানতামনা। কারণ সোমার সাথে ঝামেলা হবার পর আমি আর ওসব পার্টিতে যেতাম না। শুনেছিলাম, মিশেল ওর বরের সাথে অন্য শহরে চলে গেছে। ওর বাবা এখানকার দূতাবাসের বড় কর্মকর্তা। মা এদেশী। মিশেল ভাল বাংলা বলতে পারেনা। বলল, আমার কাছে বেড়াতে আসতে চায়। ও একজন আইনজীবি। আমি বাড়ী কেনার সময় আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল। আমি একা থাকি। সেটা ওকে বলেছি। তবু আসতে চায়। আমি ওকে আসতে বললাম।
মিশেলও আমার ভাল বন্ধু। সুন্দরী, যথেষ্ট মিশুক। ওর মুখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা শুনতে আমার বেশ লাগতো। যেদিন ও আমার বাসায় এলো, আমি ওকে দেখে অবাক হলাম। আরো স্লিম হয়েছে। চুলের স্টাইল পাল্টেছে। দেখে মনে হয়, বয়স কমে গেছে বছর পাঁচেক। মিশেলকে আমি হাসিমুখে ভেতরে আসতে বললাম। ডিভোর্সের আগে-পরে মিলিয়ে আমি প্রায় দু’বছর একা আছি। এরমধ্যে মাধবীর সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। সোমার সাথে কথা হয়, ছেলের সাথেও। দেখা হয়নি অনেকদিন। মিশেল আমাকে জড়িয়ে ধরল হাসিমুখে। এদেশে এটা হয়। প্রিয় মানুষকে দেখে এরা জড়িয়ে ধরে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল অন্যকারণে। আমি দীর্ঘদিন নারীদেহের কাছাকাছি আসিনি। শরীরের ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। ওকে দেখে পুরনো কথাগুলো মনে পড়তে লাগলো। মিশেল আমার মনের কথা বুঝে ফেলে কিনা, তাই নিয়ে অস্বস্তি।
রাতে খাবার পর আমরা গল্প করছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে মিশেল জানালো, তারও ডিভোর্স হয়ে গেছে বছরখানেক আগে। ওর ছেলেদুটো ওর কাছেই আছে। মায়ের কাছে রেখে এসেছে। আমরা দু’জন সংসার ভাঙ্গা মানুষ তখন কাছাকাছি। সোমা ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে আমি রাতে একই ঘরে কখনো থাকিনি। তবু আমার অস্বাভাবিক লাগছিলনা। কারণ মিশেল খুব স্বাভাবিক আচরণ করছিল। ওরা এসবে অভ্যস্ত।
লক্ষ্য করলাম, মিশেল ওয়াইনের গ্লাস হাতে আমার খুব কাছে এসে বসল। আমি ওর মনের কথা বুঝতে পারছিলামনা। আমরা কথা বলছিলাম খুব কাছের মানুষের মত। নানা বিষয় নিয়ে। ওর জব, ওর বর, সোমা, মাধবী…। “আমরা কি আরেকটু কাছাকাছি আসতে পারি”? আমি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’, কিছু বলার আগেই মিশেল আমার ঠোঁটে চুমু খেল। প্রথমে আলতো, পরে গাঢ়।
শরীরের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। দুটো অভুক্ত শরীর খাবার চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। এরা ভনিতা করেনা। আমরা করি। আমরা জোর করে শরীরের চাহিদাটাকে অস্বীকার করি। হিন্দু বিধবাদেরকে ধর্মের দোহায় দিয়ে নিরামিষ খাওয়ানোর প্রথা চালু হয়েছিল তাদের স্বাভাবিক যৌন চাহিদা অবদমন করে রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকে। আমাদের দেশের বিধবা ও প্রবাসী স্বামীদের স্ত্রীরা মাঝে মাঝে ভনিতা করতে পারেনা বলে সমাজ তাদেরকে চোখ রাঙ্গায়। অথচ ঘরে বৌ থাকতেও পুরুষদের জন্য অন্য সব দরজাই খোলা।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..