ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
– মন খারাপ কেন? কি হয়েছে?
মাধবীর কথায় প্রাণ নেই। আমি ফোন করলে খুশীতে আহলাদিত কচি মেয়ের মত ঝলমলিয়ে ওঠে। আজ ওর গলা অন্যরকম। কেমন যেন বিষাদ মাখা। মাধবীর বর দিন পনেরো আগে আামেরিকা গেছে মাস ছয়েকের জন্য। অফিসিয়াল কাজে। প্রায়ই সে বিদেশে যায়। মাধবীকে সে সাথে নেয়না। আমি কারণটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। মাধবী বলেছিল, “আমি ঠিক জানিনা। হয়ত সে চায়না আমি বাইরে থেকে ডিগ্রী করে এসে নাম করি। হয়ত পরিবারের দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। হয়ত আমি গেলে তার আসল উদ্দেশ্য মাটি হবে। হয়ত মনে করে আমার বেড়ানোর প্রয়োজন নাই বা আমার জন্য টাকা খরচ করা অপচয়। হয়ত অন্য কিছু।”
অনেক বড় ঘরণীও ঘর পায়না, অনেক বড় সুন্দরীও বর পায়না। মাধবী যেমন ঘরণী, তেমনি সুন্দরী। মাধবী ওর মনের মত ঘর, বর না পেলেও মনের মত দু’টো বাচ্চা পেয়েছে। দু’টোর মানসিকতাই হয়েছে মাধবীর মত। ওর বরের মত স্বার্থপর, ক্যারিয়ারিস্ট, অমানুষ হয়নি। মাধবীর সান্তনার জায়গা এই একটিই। তাই বরের চিন্তা ও আর করেনা। আমি খোঁচা দিলাম।
– পতি বিরহ?
মাধবী জবাব দিলনা। অফিসে ওর রুমে একা মন খারাপ করে বসে আছে। আমি স্কাইপে ওকে দেখছি। গোলাপী জামদানীতে অসম্ভব মায়াবতী লাগছে। কিন্তু মন খারাপের কারণটা বলছেনা।
– বলতে ইচ্ছে করছেনা।
– আমাকেও না? বলনা, শুনি কি হয়েছে।
অনেক চাপাচাপিতে কারণটা বলল। মাধবী দেখতে এখনও যথেষ্ট সুন্দরী। এই রূপই ওকে মাঝে মাঝে বিপদে ফেলে। ওর বর যখন ওকে একা ফেলে বাইরে যায়, তখন ওর সমবয়সী আর সিনিয়র কলিগরা ওর দিকে নজর দেয়। ফাও খেতে চায়। ওর একাকীত্বের সুযোগ নিতে চায়।
আমাদের দেশের পুরুষরা মনে করে, একা মেয়ে মানেই সে ভোগের বস্তু; হোক সে বিবাহিতা, বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্তা। সবাই খুবলে খেতে চায়। মতলবী চোখে তাকায়। নানা কূট ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে। ক’দিন আগে একজন বলেছে, “আপা, বর নেই বলে মন খারাপ? তাতে কি? আমরা আছিনা?” একথা শোনার পর থেকে ও মন খারাপ করে ছিল। এর আগের বার যখন ওর বর বাইরে ছিল, তখন ওর বরের এক বন্ধু বলেছিল, “আপনার মত বউ রেখে গাধাটা দিনের পর দিন বিদেশে থাকে কি করে? আমি হলে তো এক সপ্তাহও থাকতে পারতাম না।” মাধবী হেসেছে। দুঃখ লুকানো হাসি।
আজ ওর এক সমবয়সী কলিগের সাথে বসে কাজ করছিল। হঠাৎ প্রশ্ন করেছে, “কিছু মনে করবেন না আপা, আপনার সেক্স লাইফটা কেমন?” মাধবী কিছু বলেনি। শুধু অবাক চোখে তাকিয়েছে। সেই থেকে ওর মন খারাপ।
– মেয়েদেরকে ছেলেরা এত সস্তা ভাবে কেন বলতো? কেন মনে করে, শারীরিক চাহিদা আছে বলেই সে যে কারো সাথে সেক্স করবে? শরীরটাই কি সব? মন বলে কিছু নেই?”
ওর এ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। আমাদের দেশের মেয়েদের ইচ্ছার কোন দাম নেই। পুরুষরা মনে করে, যখন তাদের ইচ্ছা হবে, তখনই মেয়েরা সাড়া দেবে। আর কোন মেয়েকে একা দেখলে তারা টোকা দিয়ে দেখতে চায় সে গলে কিনা। সুযোগ পেলে জোর করতেও তাদের বাধেনা।
তুরস্কের পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হতে যাচ্ছে, “কোন ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করলে তার ধর্ষনের শাস্তি মাফ করে দেয়া হবে।” এই আইনের প্রকৃত অর্থ হল, যদি কোন মেয়ে কোন ছেলেকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে রাজী না হয়, তাহলে তাকে রেপ করলেই তাকে বিয়ে করা যাবে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে আমাদের পুরুষদের মানসিকতা যে কী পরিমাণ দুরভিসন্ধিমূলক, এই আইনটি তার প্রমাণ।
এদেশে যদি কাউকে বলা হয়, “একটি মেয়ের সাথে আপনি সেক্স করতে পারবেন। কিন্তু মেয়েটি রাজী না। আপনি কি করবেন?” জবাবে একশ’ জনের মধ্যে নিরানব্বই জনই ‘না’ বলবে। আমাদের দেশে হলে জবাবটা হবে উল্টা। আমাদের দেশে প্রকাশ্যে ঘটা ভয়ংকর অপরাধগুলোর বিচারও ঠিকমত হয়না। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, নানা কুটকৌশল এবং ঘুষের কল্যাণে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। রেপ তো হয়ই, কোমলমতি শিশুরাও রেহায় পায়না। এমনকি ছোট শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে বড় করে নিয়ে রেপ করা হয়। মানসিকভাবে একটা জাতি কতটা বিকলাঙ্গ হলে এমন অপরাধ চলতে পারে? আমি মাঝে মাঝে খুব হতাশ হই। আমরা কি সভ্য হবনা?
দীর্ঘদিন এদেশে থেকে আমি দেখেছি, এরা জীবনকে উপভোগ করতে জানে। আমরা বিয়েবাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলে কোনরকমে খাওয়া শেষ হলেই বাড়ী চলে আসি। এরা প্রতিটা অনুষ্ঠান উপভোগ করে দীর্ঘ সময় ধরে। গল্প করে, খাওয়াদাওয়া করে, নাচ-গান করে। পার্টি, নাইটক্লাব, হলিডে। এরা প্রায় সব ছুটিতেই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়। পরিবার নিয়ে মজা করে। এতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয়। যদিও অনেকে মনে করে “টাকা নষ্ট”। মাধবীর বরও মনে হয় তাই ভাবে। অবশ্য আমাদের দেশের উচ্চবিত্তরা নানাভাবে জীবনকে উপভোগ করে।
গতকাল এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল। নাম জোসেফ। হোটেলে একটা টেবিলে একা বসে খাচ্ছিলেন। আলাপ করে জানলাম, উনি ক্যান্সার আক্রান্ত। বাঁচবেন বড়জোর এক বছর। ওনার স্ত্রী মারা গেছেন তিন বছর আগে। তাই উনি ঘুরতে বেরিয়েছেন। বাকী জীবন উনি দেশ দেখে কাটাবেন। আমরা হলে বিছানায় পড়ে থাকতাম আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতাম।
সোমা খারাপ খবরটা দিল। আমার সার্টিফিকেটগুলো নাকি খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো ফাইলটাই নাই। আমি চলে আসার সময় আমার কিছু জামা-কাপড়, ল্যাপটপ, মোবাইল আর কিছু কবিতার বই ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। আমি সে অবস্থায় ছিলাম না । সোমাকে বলেছিলাম, কিছু থাকলে লিপুর বাসায় দিয়ে দিও। নীল কিছু জানেনা। ও জানে আমি কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছি। ক’দিন বাদেই চলে আসব। যেমন আসি। সোমা আর আমি জানি আমাদের আর দেখা হবেনা। আমি আলাদা বাসায় উঠব। সোমাকে অনুরোধ করেছিলাম, নীলকে কিছু না বলতে।
আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ও ভিডিও গেম খেলছে। আমি চাচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে। নাহলে আমার কান্না পাবে। যেতে পারবনা। একবার খুব ইচ্ছে হল নীলকে বুকে জড়িয়ে ধরি। তারপর মনে হল, থাক। ও বুঝে ফেলবে। কান্নাকাটি করবে। আমি ট্রলিব্যাগ হাতে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সোমা পিছনে দাঁড়িয়ে। নীল ওর ঘরে। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওকে শেষবার দেখে নিয়েছি। ও তাকালে দেখতে পেত, আমি কাঁদছি। ভাগ্য ভাল, তাকায়নি। আমি পিছন ফিরে যথাসম্ভব গলা স্বাভাবিক করে বলেছি, “নীলু বাই।” নীল কিছু না বুঝেই বলেছে, “বাই বাবা। কাম ব্যাক সুন।” আমি কিছু না বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। সোমাকে কি বলা উচিত, স্থির করতে পারছিলাম না। শেষে দরজার কাছে একটু দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখি, সোমাও কাঁদছে।
সোমার প্রতি আমার ঘৃণা ছিলনা। ওর প্রতি কখনো কোন দায়িত্বে আমি অবহেলাও করিনি। অনেক সমস্যা থাকার পরেও মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। ওর পরিবারের সবাই আমাকে খুব পছন্দ করত। বিশেষ করে সোমার মা আর সোমার বড় বোন। সোমার মা খুবই বুদ্ধিমতী আর দায়িত্বশীল মহিলা। ওনার গানের গলাও বেশ ভাল। দেশ থেকে কেউ এলেই তার হাতে উনি আমাদের জন্য নানা উপহার পাঠাতেন। আমার জন্য শার্ট পাঠাতেন। আমি এখনও ওনাকে খুবই পছন্দ করি। ওনার স্বভাবের একটু ছিঁটেফোটাও যদি সোমা পেত, তাহলে আমি মহাসুখে থাকতাম।
আমি মাধবীকে প্রশ্ন করেছিলাম, “ডিভোর্স হলে শ্বাশুড়ীকে কী বলে? খালাম্মা বলে ডাকা যায়?” মাধবী বলেছে, সে জানেনা। যদি কখনও আমার সাথে ওনার দেখা হয়, আমি কথা বললে উনি কি কথা বলবেন? আমি দেশে থাকাকালীন একদিন উনি আমার জন্য হাঁসের মাংস রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন। আমার খুব প্রিয় খাবার। চলে যাবার সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, “শোন বাবা, সোমা ডিভোর্সের কথা ভাবছে। আমার মনে হয়, তোমাদের মধ্যে যে কারণে সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো তোমাদের এড়ানো উচিত।” বুঝলাম মাধবীর কথা সোমা ওনাকে বলে দিয়েছে। আমি মাথা নীচু করে বললাম, “জ্বী আম্মা”। সোমার কারণে আমি যে মানসিক কষ্টে থাকতাম, সেটা উনি বুঝতেন। নিজের মেয়েকে উনি ভালই চিনতেন। আমাদের ঝগড়া মেটাতে অনেকবার উনি আমার পক্ষে কথা বলেছেন।
উনি জানতেন, আমি সোমার সাথে ঝামেলা এড়ানোর জন্য কবিতা, বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, বাড়ীতে টাকা পাঠানো, সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি ওনাকে বলতে পারিনি, আমি মাধবীকে ফোন করেছিলাম শুধুই জানার জন্য যে, ও কেমন আছে। আর কেন ও আমাকে কষ্ট দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করল? সোমাকে ছেড়ে মাধবীকে বিয়ে করার জন্য বা ওর সাথে পরকীয়া করার জন্য আমি ওকে ফোন করিনি।
সার্টিফিকেটগুলো সে সময় তেমন প্রয়োজন ছিলনা। তাছাড়া এত জরুরী জিনিস সোমা হারিয়ে ফেলবে, আমি ভাবিওনি। আমি যদি কখনও স্থায়ীভাবে দেশে গিয়ে আমার পেশায় আবার যুক্ত হতে চাই, তাহলে ওগুলো লাগবে। এখানকার কাগজ তুলতে খুব বেশী ঝামেলা হবেনা। মুশকিল হবে মাস্টার্স পর্যন্ত আমার সবগুলো কাগজ তুলতে। আমার দেশে অফিসিয়াল কাজ করার ভোগান্তি আমার জানা। আমি বিরক্ত হচ্ছি।
আমি বললাম, “কি ব্যাপার? বাড়ী পরিষ্কার করছ। কেউ আসবে নাকি?” সোমা আমার ইশারা বুঝল। কিছু বললনা। আমি আবার বললাম, “দ্যাখ, রাগ করে কোথাও ফেলে-টেলে দিছ বোধহয়”। সোমা আফসোসের সুরে বলল, “ফেলিনি। লিপু ভায়ের বাসায় রেখে এসেছিলাম কিনা, মনে করতে পারছিনা।” আমি ওকে সান্তনা দিলাম, “না পেলে ক্ষতি নাই। আমার জীবন থেকে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, আর কাগজ!”
আমাদের দেশে স্বামী মারা গেলে, ছেড়ে গেলে বা ডিভোর্স হলে মেয়েদের আবার বিয়ে হওয়া খুবই কঠিণ। বিশেষ করে যদি মেয়ে অসুন্দর, বেকার হয় এবং তার পরিবার গরীব হয়। এই সমস্যা আরো প্রকট হয় যদি সেসব মেয়েদের বাচ্চা থাকে। যেসব মেয়েদের সুযোগ আছে, তারাও অনেকে ইচ্ছে করেই আর বিয়ে করেনা। স্বামীর অবর্তমানে সন্তান লালন-পালন করাই তখন এসব মায়েদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
অভাবী মায়েদের নিজের এবং সন্তানের জীবন বাঁচানোই বিরাট সমস্যা। তাদের পরিবার তাদের আর্থিক দায় নিতে চায়না। নিজের স্বাদ-আহলাদ, শারীরিক-মানসিক চাহিদাকে তারা দাবিয়ে রাখে। অস্বীকার করে। সমাজও মনে করে স্বামীহারা হওয়া তার দূর্ভাগ্য। তাই তাকে কষ্টকর জীবন মেনে নিতেই হবে। বিধবাদের ক্ষেত্রে সমাজ তবু কিছুটা সহানুভূতি দেখায়। কিন্তু ডিভোর্সিদের দেখা হয় সন্দেহের চোখে। নিশ্চয় মেয়েটার দোষ ছিল। নাহলে স্বামী তাকে ছেড়ে যাবে কেন? ফলে তাকে সহজে কেউ বিয়ে করতে চায়না। অনেক ক্ষেত্রে মায়ের বয়স কম হলে বা দেখতে ভাল হলে তাদের বিয়ে হলেও তাদের আগের পক্ষের সন্তানকে পরের স্বামী গ্রহণ করেনা। ফলে মা অনিচ্ছাসত্বেও সন্তানকে তার নানা- নানী বা-খালা-মামাদের কারো কাছে রেখে য়ায়। যেতে বাধ্য হয়। সন্তানকে ছেড়ে যেতে হবে- এই কষ্ট এড়ানোর জন্যই মূলতঃ বেশীরভাগ মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন না।
সোমা আবার বিয়ের কথা ভাবছে। ভাবতেই পারে। এদেশে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোন বিয়েই কোন সমস্যা না। নারী বা পুরুষ কারো জন্যই না। সন্তান থাকলেও না। না থাকলেও না। এদেশে ব্যক্তির ইচ্ছাটাই মূখ্য। ভাল লাগলে বা উভয়ে রাজী হলে সন্তান থাকলেও একাধিক বিয়েতে সমস্যা হয়না। সন্তানরা স্টেপ পেরেন্টসদের মেনে নেয়। বাবা-মা, বিশেষ করে মা সন্তানের জন্য সারাজীবন একা থাকবে- সন্তানরা বরং এটাই পছন্দ করেনা।
সোমা নীলকে নিয়ে একা আছে। আমি জানি, আমি না থাকার কারণে ওরা নানা সমস্যার মধ্যে আছে। কথা প্রসঙ্গে একদিন সোমা বলেছিল, “তুমি কষ্টে আছ শুনে তোমার ছেলে বলেছে, তাহলেতো বাবার একটা মামা দরকার।” আমি ঠাট্টা করে বললাম, “আর মামার বাবা দরকার নাই?” সোমা রেগে গেল। আমি আবার বললাম, “তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? কতদিন আর এভাবে একলা একলা থাকবা?”
আমি আগেই মনা আর জেবার কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম, সোমা ইদানিং এক লোকের সাথে কথা বলছে। ওর পরিবার থেকে বিয়ে ঠিক করছে এই লোকের সাথে। যোগাযোগও হচ্ছে পারিবারিকভাবেই। ভদ্রলোক নিজেও ডিভোর্সি। আগের পক্ষের একটি মেয়ে আছে।
নতুন বাবা আসবে শুনে আমার ছেলে ভীষণ খুশী। আমার বুকের মধ্যে আর একটা চাপা কষ্ট দানা বাঁধতে শুরু করেছে। একটা পুরোনো কষ্ট, একটা নতুন। একটার নাম মাধবী, আরেকটার নাম নীল। সোমার জন্য আমার কোন কষ্ট নেই। বরং অনুশোচনা আছে। ওকে বিয়ে করে এনে এতদিন কষ্ট দিয়েছি, সেই অনুশোচনা। অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে ও হয়তো ভালোই থাকতো। মাধবী হারিয়ে গেছে, এবার হারিয়ে যাবে নীল। জানিনা তার নতুন বাবা কেমন হবে। ওকে কতটা ভালবাসবে।
প্রায় আড়াই বছর আমি একা আছি। এ সময়ে মাঝে মাঝে দু’একজনকে আমার ভাল লেগেছে। কথা বলেছি। ভেবেছি, আবার বিয়ে করব। কিন্তু লক্ষ্য করেছি, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওদের উপর থেকে আমার মন উঠে যায়। নচিকেতার গানের মত নিজেই নিজেকে বলি, “এই বেশ ভাল আছি।” তাছাড়া একই ভুল দু’বার করার কোন মানে হয়না। বড় আপা প্রায়ই বলেন, “মানুষ দ্বিতীয় বিয়ে করেনা? এভাবে আর কতদিন? তাছাড়া শেষ জীবনে তোকে কে দেখবে?”
আমি ভয় পাই। সোমাকে বিয়ে করা আমার উচিত হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার বিয়ে করাই উচিত হয়নি। সোমার জায়গায় অন্যকেউ হলেই কি তাকে ভালবাসতে পারতাম? হয়তো, হয়তো নয়।
আমার শেষ জীবন কিভাবে কাটবে, তা নিয়েও ভেবেছি। এদেশে মানুষ বুড়ো হয়ে গেলেও একা থাকে, থাকতে পারে। সন্তান বা কারো ওপর নির্ভরশীল হয়না। একা চলতে পারে। তার কারণ এদেশে প্রায় সব কাজই হয় মেশিনে। কাপড় ধোয়া, ঘর পরিস্কার করা, রান্না করা- খুবই সহজ। এখানে ছেলে-মেয়ে বড় হলে আলাদা থাকে। বৃদ্ধ বাবা-মা থাকে আলাদা বাড়ীতে।
এসব বুড়ো-বুড়ীরা বাড়ীতে একা থেকে থেকে যাতে নিজেদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ না করেন, সেজন্য পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে
সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় রয়েছে কমিউনিটি এনগেইজমেন্ট সেন্টার বা দিবাকালীন সেবা আশ্রম। এই বৃদ্ধ মানুষগুলো যখন কর্মক্ষম ছিলেন, তখন দীর্ঘসময় তাঁরা সমাজকে অনেককিছু দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শেষজীবনে তাঁদেরকে কিছুটা ভাল সময় উপহার দেয়ার জন্য এসব সেন্টার কাজ করে। কি অসাধারণ দর্শন!
সেন্টারের নিজস্ব পরিবহণে এঁদেরকে সেন্টারে আনা-নেয়া করা ও নানা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। এঁদেরকে ভাল খাওয়ানোর, বিনোদন দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নানা কিছু শেখানোর মাধ্যমে এঁদেরকে ব্যস্ত রাখা হয়। এঁরা এসব সেন্টারে এসে বই পড়েন, নেট ব্রাউজিং করেন, ফেসবুক ও কম্পিউটার চালানো শেখেন, নেটে পেপার পড়েন, ইমেইল করা ইত্যাদি শেখেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায়, বিনা পারিশ্রমিকে এসব শেখায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে এঁদেরকে সুস্থ রাখার জন্য আছে ডাক্তার ও প্রফেশনাল ট্রেইনার।
কোন কোন এলাকায় দেখেছি, মায়েরা তাদের ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে আসেন এঁদের সাথে গল্প করতে, এঁদের বাড়ীর কাজে সাহায্য করতে বা এঁদেরকে সঙ্গ দিতে। আসার সময় এঁদের জন্য ছোটখাটো উপহার, রান্না করা খাবার, বই ইত্যাদি আনেন।
আরো আছে ওল্ড হোম। কেউ একা চলতে না পারলে বা স্বামী বা স্ত্রী যেকোন একজন মারা গেলে অন্যজন ওল্ড হোমে চলে যায়। সেখানে দেখাশোনার লোক আছে, ডাক্তার আছে। বুড়োো- বুড়ীরা সেখানে একসাথে গল্প করে, টিভি দেখে, বই পড়ে। আমাদের দেশের বুড়ো-বুড়ীদের কথা ভাবলে আমার মায়া হয়। আমাদের দেশটা এমন হতে পারেনা?
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..
দ্বিতীয় পর্ব মইদুল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে।রাতে মনে হয়েছিল প্রেসার বেড়েছে। হাইপ্রেসার আছে ওর বাবারও।বাড়ি…..
পরিচ্ছেদ- ১ সুবীরেশ সেন। কবি। সদ্য নর্থবেঙ্গল এসেছে।এখানেই শহীদুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। শহীদুল বিএ…..
পর্ব – চার ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে মাটির উপর খড় বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। খড়ের উপর মোস্তাগের…..