মাধবী (পর্ব ১৫)

আলপনা তালুকদার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
মাধবী (পর্ব ১৫)

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

আমি যখন আর একা চলতে পারবনা, তখন ওল্ড হোমে চলে যাব। তবু কিছুতেই নিজের আত্মীয়দের কাছে, এমন কি ছেলের কাছেও যাবনা। মলির বাবা দীর্ঘদিন প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। মলির সাথে তখনও আমার প্রেম হয়নি। একবার ছুটিতে বাড়ী এসে আমি ওনাকে দেখতে গেছিলাম। ভয়াবহ অবস্থা! বিছানায় পড়ে থেকে থেকে পিঠে ঘা হয়ে গেছিল। ছেলের বৌ ও মেয়েরা পালা করে ওনার দেখাশোনা করে। ঘা পরিস্কার করার সময় উনি ছোট শিশুর মত হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেন। তাই দেখে মলি বলেছিল, “আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, তাড়াতাড়ি আব্বার মৃত্যু হোক। মরতে তো হবেই। এত কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।” ওর কথা শুনে আমি চমকে গেছিলাম। আসলে রোগী টানতে টানতে মানুষ একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই ঠিক করেছি, আমি শেষ বয়সে কারো ওপরেই নির্ভরশীল হবনা।

সোমা ঐ ভদ্রলোককে বিয়ে করেছে। ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে কানাডা। দ্বিতীয় স্বামীর কাছে। যাবার আগে আমি নীলের সাথে দেখা করতে যাইনি। যেতে পারিনি। ওর সামনে গেলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবনা, সেই ভয়ে।

ইদানিং একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। সৎ বাবার সাথে নীল ভালো আছে তো? নিজের সন্তানকে আমরা যেমন ভালবাসি, সৎ বাবা-মা সব জেনেশুনে বিয়ে করলেও স্বামী বা স্ত্রীর আগের পক্ষের সন্তানকে তেমন ভালবাসতে পারেনা। এর কারণটা খুবই যৌক্তিক।

বাচ্চা মায়ের গর্ভে আসার পর থেকেই আমরা একটু একটু করে মা-বাবা হই। সন্তানের মুখ দেখার জন্য দিন গুনি। সন্তান জন্মাবার পর প্রতিদিন আমরা ওদের বেড়ে ওঠা দেখি। শিশুর শরীরের কোমলতা এবং ওদের অসহায়ত্ব তাকে ভালবাসতে আমাদেরকে বাধ্য করে। বিভিন্ন সময়ে ওদের সাফল্য, ব্যর্থতা, অসুস্থতা, আবেগ, বিভিন্ন ঘটনা আমাদের স্মৃতিপটে ক্রমাগত ছাপ ফেলতে থাকে। ফলে দিনে দিনে একটু একটু করে বাবামার সাথে সন্তানের সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। সৎ বাবামার সেটা থাকেনা। তাই দায়িত্ববোধ থেকে বা অগত্যা ভালবাসা আর প্রকৃত বা স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসা কখনো এক হয়না। এজন্যই বোধহয় বলা হয়, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কখনো বেশি হতে পারেনা।

আমার নীল কেমন আছে? তাকে যদি তার সৎ বাবা ভাল না বাসে, আমি তাকে দোষ দিতে পারিনা। আহারে আমার সোনা! তুই কোথায়? ভাল আছিস বাবা? জানি, খারাপ থাকলেও কোনদিন সেকথা বলবিনা। তুই যে আমারই রক্ত! ঠিক আমারই মত। যাদু আমার! তোকে হয়ত আর কোনদিনই সেভাবে কাছে পাবনা। তোর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। বড় হয়ে যাচ্ছিস। তোকে নিয়ে কত আনন্দময় সময় কাটিয়েছি! খেলেছি, ঘুরে বেরিয়েছি। আহ্! চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বড় কষ্ট! বড়ই কষ্ট!

এক জীবনে একে একে সবাইকে হারালাম। কি নিদারুণ কপাল আমার! এদেশে আসার পর হারিয়েছি আত্মীয়-বন্ধুর সঙ্গ। তারপর হারিয়েছি মাধবীকে। তার কিছুদিন পর বাবাও চলে গেলেন। তারপর হারালাম স্ত্রী-পুত্রকে। মা এখনও জীবিত। অনেক বয়স হয়ে গেছে। মা আমার থেকেও নেই। দেখা হয়না কতদিন! কানে কম শোনেন বলে কথাও হয়না। আমি কথা বলতে পারিওনা। মায়ের গলা শোনার সাথে সাথে আমার দু’চোখে বন্যা নামে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না। ভয়ও লাগে। মা আমার কষ্ট টের পেয়ে যান যদি!!!

কখনো ভাবিনি, আমার বেঁচে থাকাটা এরকম হবে। যারা আমার মাধবীকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, তাদেরকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করে। আজ ও আমার পাশে থাকলে আমার জীবনটা এমন হতনা। বর্ষার দিনে আমি মাধবীর হাত ধরে বৃষ্টি দেখতাম। জোছনা রাতে ছাদে বসে চাঁদের আলোয় গোসল করতাম। বসন্তের বিকেলে নদীর পাড়ে বসে ওকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম। আর ভাবতে পারিনা। কি লাভ?

গত সপ্তাহে নীলের সাথে কথা বলার জন্য আমি সোমাকে ফোন করেছিলাম। সোমা আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার অভিযোগ, বাবা হিসেবে আমি মোটেই ভাল নই। কারণ আমি ক্রিসমাসে ছেলেকে উইশ করিনি। গিফ্ট পাঠাইনি। অথচ তার সৎ বাবা তাকে বেড়াতে নিয়ে গেছে।

আমার রাগ হল খুব। বিদেশে থাকি বটে। কিন্তু ওটাতো আমাদের কালচার নয়। তাই ক্রিসমাসে ঘটা করে ছেলেকে উইশ করা আমার কাছে জরুরী মনে হয়নি। ডিভোর্সের পর থেকে প্রতিমাসে আমি ছেলের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছি। ঈদে, জন্মদিনে গিফ্ট পাঠিয়েছি।

অবশ্য দ্বিতীয় মেয়াদের নতুন বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার জন্য যেকোন উপলক্ষ্য হলেই চলে। না হলেও চলে। নিজের উৎসব নাকি ভিন্ন ধর্মের লোকেদের উৎসব, তখন লোকে সেটা ভাবেনা। এসময় অকারণে লোকে বেশী বেশী ভালবাসা দেখাবে, ভয়ানক ফূর্তিতে থাকবে, এখানে-সেখানে বেড়াতে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই সোমার কথায় রাগ হলেও আমি কষ্ট পাইনি। আমার কষ্ট হয়েছে অন্য কারণে। আমি ফোনে নীলকে চাইলাম।

– বাসায় এখন কে কে আছে বাবা?

– আম্মু আর আমি।

আমি যার পর নাই অবাক হলাম। কি বলব, ভেবে পেলামনা। কথাটা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবু আমি ছেলেকে প্রশ্ন করলাম।

– বাবা, ঐ ভদ্রলোককে তুমি কি ডাক?

ছেলে চোরের মত খুব নীচু গলায় জবাব দিল।

– আব্বু।

– কে ডাকতে বলেছে, মামা?

– হুম।

সোমার আর একটি জঘণ্য মানসিকতার প্রমাণ দেখে ঘৃণায় এই প্রথমবার আমার গা’ রি রি করতে লাগলো। সেই সাথে কষ্ট। নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে নিজের হাত নিজেই কামড়াতে ইচ্ছা করল। ছেলে আমাকে ডাকতো ‘বাবা’ আর ‘ড্যাডি’। সোমাকে ডাকতো ‘মা’, ‘মামা’, ‘মম’। ওর যখন যা ডাকতে ইচ্ছে করতো, তাই। আমি কখনো ওকে বলে দেইনি, কি বলে ডাকতে হবে। নীল নিজে থেকেই এসব ডেকেছে। গত এগারো বছর ও তাই ডেকে এসেছে। পৃথিবীর কোন মা ছেলের মুখের বুলি এভাবে কেড়ে নেয়না। তাও আবার এগারো বছর পর। নিজের কালচার পছন্দ বলে যদি ছেলের মুখের ডাক বদলে দিতে পার, তাহলে ভিন্ন ধর্মের উৎসব পালন করিনি বলে অভিযোগ কর কেন?

কথা কাটাকাটির পর আমি সোমাকে ব্লক করে দিলাম। আমার ফোনের সিম পাল্টে ফেললাম। আমি টানা ছ’মাস নীলের সাথে কথা বলিনি। কারো সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখিনি। বড় আপার সাথেওনা। শুধু মাধবী আর বেলির সাথে কথা হত। ঢাকায় মাঝে মাঝে দু’একজন বন্ধুর সাথে কথা বলতাম।

– বুজি, আপনারা কেমন আছেন?

আমার গলা শুনে বড় আপা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমি ভয়ে অস্থির। মায়ের শরীর খারাপ ছিল। এই ছ’মাসে তাঁর কি অবস্থা, আমি জানিনা। খারাপ কিছু হয়নি তো?

– বুজি, কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে?

– তর কোন খবর নাই। এতদিন ফোন করছনি। আমরা চিন্তায় মরতাছি।

যাক! মা ভাল আছেন। আমার দেহে প্রাণ ফিরে এলো। আপার সাথে কথা বলে আমি সবার খবর নিলাম। ছোটবোনটা মার কাছে আছে জেনে রাতে আমি ওর ফোনে কল দিয়ে মাকে চাইলাম।

– কেমন আছ মা তুমি?

শুধু মায়ের কান্নার শব্দ পেলাম। কি বলল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। গত তিন বছর আমি মার সাথে কথা বলিনি। বলতে পারিনি। বলতে গেলে মা বউ-ছেলের কথা জিজ্ঞেস করবে। আমি কী বলব? মাধবী হাজার বার বলেছে, “কথা বল। মায়ের মন। কষ্টে আছে। যখন থাকবেনা, তখন আফসোস করবে। কথা বল প্লিজ। দেখ, তোমারও ভাল লাগবে।” আমি অজুহাত দেখাই, “মা কানে কম শোনে। একই কথা বার বার রিপিট করতে হয়।” মাধবী বলল, “তোমার ছোটবোনকে বল স্পিকার অন রাখবে।”

যখন মাধবীকে জানালাম, কথা বলেছি, কি যে খুশী হল! বলল, “লাভ ইউ সোনা, থ্যাঙ্ক ইউ। আজ অনেকদিন পর উনি শান্তি পাবেন। হাজার জনকে বলবেন, ছেলে ফোন করেছিল, এই বলেছে, সেই বলেছে। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তোমার কথা ভাববেন। ছেলের ফেরার আশায় দিন গুনবেন। তুমি কী কী বলেছ, বার বার মনে করার চেষ্টা করবেন। এ আনন্দ কেমন, তুমি বুঝবেনা।”

আমার অবাক লাগে। আমার মাকে একটু শান্তি দেবার জন্য কেন ওর এত আকুলতা? ওর কিসের এত গরজ? তবে মা সত্যি খুব খুশী হলেন। আমারও খুব ভালো লাগলো। মাকে দেখার জন্য মন কেমন করতে লাগলো। ঠিক করলাম, মাকে দেখতে দেশে যাব। মাধবীর সাথেও দেখা করব।

সম্প্রতি আমার বন্ধু হাফিজ কানাডা থেকে বেড়াতে এসেছিল। এখানকার প্রবাসীদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা। ও এখন কানাডায় সেটেলড। ওখানে কেমন আছে, বাঙ্গালীদের অবস্থা কেমন – এসব আলাপ করতে করতে ও একটা নতুন তথ্য দিল। ইউরোপ-আমেরিকার মত কানাডাতেও বয়স্ক বাবা-মা বাড়ীতে একা থাকেন। ছেলে-মেয়েরা কাছে থাকেনা। তারা আলাদা থাকে। মাঝে মাঝে ফোন করে বা সুবিধামত সময়ে বেড়াতে আসে। খুব অল্প সময়ের জন্য এসে বাবা-মাকে দেখে আবার ফিরে যায় কর্মস্থলে। নিজের সংসারে। বাবা-মা নিজেদের রোজকার কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পারলেও তাঁরা সন্তান, নাতি-পুতিদের খুব মিস করেন। তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করেন, কবে তারা আবার আসবে। আমি এদেশেও অনেকবার দেখেছি, পুলিশ বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে কোন মৃত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার লাশ বের করছে। কখন মারা গেছে, কেউ জানেইনা। লাশ পচে গন্ধ বের হলে বা ফোন রিসিভ না করলে লোকে পুলিশে খবর দেয়।

কানাডায় সম্প্রতি সোমালিয়ান মেয়েরা এসে তাদের প্রয়োজনেই এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাথে সাবলেটে থাকছে। পাশাপাশি তাদের দেখাশোনাও করছে। তাদের সেবায় মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ তাদের সম্পদ সন্তানকে না দিয়ে এসব সোমালিয়ান মেয়েকে লিখে দিচ্ছে। তার মানে, ব্যাক্তিস্বাধীনতা, টাকা বা নিজে নিজে চলতে পারাই সব নয়। প্রিয়জনের সঙ্গ, বিশেষ করে শেষ সময়ে তাদের যত্ন, ভালবাসা সব বাবা-মাই কামনা করেন। সেদিক থেকে কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া আমাদের দেশের পারিবারিক বন্ধন এখনও অতটা খারাপের দিকে যায়নি।

মাধবী পরের বাচ্চাটা নিতে চায়নি। ওর বর নিতে বাধ্য করেছে। কারণ ওর প্রথম সন্তান মেয়ে। শ্বাশুড়ীর চাপও ছিল খুব। আমাদের দেশে সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্তে স্বামীর ইচ্ছাই মূখ্য। আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের পর নিজের শরীরের যত্ন নেয়া ছেড়ে দেয়। সাংসারিক কাজের চাপে দিতে বাধ্য হয়। আর বাচ্চা হবার পর নিজের প্রতি আরোই উদাসীন হয়ে যায়। মাধবীর দশাও তাই। একটু মুটিয়ে গেছে। মনের সেই আনন্দও নেই। তবে আজ মায়ের কথা শুনে খুব খুশী হল।

রবিনের উপর খুব রাগ হল আমার। আমি তিনদিনের জন্য বন্ধু লিপুর বাসায় বেড়াতে গেছিলাম। যাবার সময় মনার জন্য লাল শাক, ডাটা শাক, শীম, টমেটো, ধনেপাতা, লাউ – এসব নিয়ে গেছিলাম। প্রতি সামারে আমি আমার বাড়ীর পিছনের বাগানে এসব সব্জি চাষ করতাম। তিন বছর পর এবারও করেছিলাম। এর কৃতিত্ব মনার। আমি লিপুকে বলেছিলাম বীজ পাঠাতে। ও সময় পায়নি। কিন্তু মনা ঠিকই বাজারে গিয়ে বীজ কিনে এনে আমাকে পাঠিয়েছিল। তাই ওকে দিতে গেছিলাম। সেই সাথে বেড়ানোও হবে। সোমাকে ছেড়ে আসার পর আমি আর কারো সাথেই দেখা করতামনা। কেন জানিনা, অনেকদিন পর যেতে ইচ্ছে করছিল।

মনা জানালো, মিশেল তার তৃতীয় বরকেও তালাক দিয়ে দিয়েছে। মিশেল আমাকে শর্ত দিয়েছিল, ওকে বিয়ে করে জার্মানীতে গিয়ে সেটল করতে হবে। আমি রাজী হতে পারিনি। আজ ভাল লাগছে এই ভেবে যে, ভাগ্যিস ঝোঁকের মাথায় তখন ওকে বিয়ে করে ফেলিনি! করলে হয়ত এতদিনে আমাকেও তালাক দিয়ে দিত!

ফিরে এসে দেখি, রবিন আমার কেডস্, জ্যাকেট, কোট – সব চ্যারিটিকে দিয়ে দিয়েছে। কোন মানে হয়? দিতে হলে তো আমি নিজেই দিতে পারতাম। রবিন আমার ছোটভায়ের মত। এখন আমরা একই বাসায় থাকি। খুব গোবেচারা টাইপের ছেলে। দিনে রাতে বারো ঘণ্টা ঘুমায়। কাজে যাওয়া বাদে যেটুকু সময় জেগে থাকে, সেটুকু সময় নতুন বউ-এর সাথে নীচু গলায় কথা বলে। দেশে যাবে বউ আনতে। আমি দু’মাস পর এখান থেকে চলে যাব আমার কাজের সুবাদে আরেক শহরে। তাই ওকে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছেনা। আমরা বড় অবিবেচক। এদেশীরা কেউ কখনও না বলে কারো জিনিশে হাত দেবেনা।

এখানে নানা চ্যারিটি কাজ করে। যেমন – বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, বাড়ী বাড়ী গিয়ে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে গরীব দেশগুলোতে পাঠানো, গরীব দেশগুলোতে ধর্ম প্রচার, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি নানা সেবামূলক কাজ করার জন্য ফান্ড জোগাড় করা ইত্যাদি। আর আমরা নিজের কাজই ঠিকমত করিনা। আমি তিনদিন ছিলামনা। রবিন ঠিকমত ময়লাও ফেলেনি। রান্নাঘরে ঢুকে বিশ্রী গন্ধে আমার বমি পাবার জোগাড়। এখানে তো ময়লা ফেলতেও হয়না। শুধু আলাদা আলাদা বর্জ্য আলাদা আলাদা পলিথিনে ভরে দরজার পাশে রেখে দিলেই হল। ময়লা পরিস্কারের লোকেরা এসে নিয়ে যাবে।

এদেশের সবাই নিজেরাই নিজেদের সব কাজ করে। যখন পার্টিতে সবাই আনন্দ করবে, কেউ জানবে না যে, তার পাশের লোকটি সকালবেলা টয়লেট পরিস্কার করে এসেছে। আমরা বাঙালীরা কতটা নোংরাপ্রিয়, সেটা বোঝা যায় পাবলিক টয়লেটে গেলে আর রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে গেলে। ঢাকায় থাকাকালীন আমার সবচেয়ে বাজে লাগতো আবর্জনার দূর্গন্ধ, ধূলা, লোডশেডিং আর গাড়ীর উচ্চ শব্দ। আমি আমার দেশকে ভালবাসি। তাই চাই দেশটা সুন্দর হোক। দেশের খারাপ কিছু দেখলে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাই আমরাই। কারণ কথা শুনতে হয় আমাদেরকেই।

সেদিন আমার অফিসের কলিগ ডেনিসের সাথে আলাপ হল। ও নতুন এখানে। আমি বাঙালী শুনে বলল, “আমি জানি তোমার দেশ খুব গরীব। তোমার দেশের লোকেদের দুরাবস্থার ছবি আমি দেখেছি।” এই আরেক যন্ত্রণা! আমাদের দেশের কিছু মানুষ বিদেশী সাহায্য পাবার আশায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের ছবি এমনভাবে তুলে ধরে যে, এরা ভাবে, আমাদের দেশ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে, ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে। যেন আমার দেশের কোন লোক পেট ভরে খেতে পায়না। এদের একবার এরকম ধারণা হয়ে গেলে এরা আর সেটা ভুলতে পারেনা। ভাবে, আমরা পেটের দায়ে বিদেশে এসেছি। যতই বলি, আসলে ঘটনা তেমন নয়, তারা বিশ্বাস করেনা।

মাঝে মাঝে যখন জঙ্গী হামলার কথা শুনি, প্রথম যে কথাটা মনে আসে, সেটা হল, কাজটা কোন বাংলাদেশী করেনি তো? কোন মুসলিম করেনি তো? যদি দেখে, হামলায় কোন মুসলিম জড়িত, তখন ওরা আমাদেরকে আরো সন্দেহের চোখে দেখে। তখন খুব অপমানিত বোধ করি। আর এদের বর্ণ বৈষম্যবাদী মনোভাবতো আছেই। অপরিচিত কোন সাদা লোক হোটেলে আমাদের সাথে এক টেবিলে খাবেনা। বাসে-ট্রেনে পাশে বসতে চাইবেনা। কিন্তু যদি একবার কাউকে ওরা পছন্দ করে ফেলে, তাহলে তাকে খুব সম্মান করে। এমনকি, বিয়ে করে আমাদের দেশেও চলে যায় অনেকে। আমার বন্ধু শামীম মেম বিয়ে করে নিয়ে দেশে গেছে। এখন ওরা ওখানেই সেটল করে গেছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। আমার সাথেই এখানে বার এ্যাট ল’ করে ফিরে গিয়ে শামীম সুপ্রীম কোর্টে লইয়ার হিসেবে কাজ করছে। বেশ নাম করেছে শুনেছি। শুধু আমিই কিছু করছিনা।

চলবে…

আলপনা তালুকদার। ড. আকতার বানু আলপনা (আলপনা তালুকদার নামেই বেশি পরিচিত) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর (শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট) - এর একজন অধ্যাপক। তিনি এসএসসি-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে রাজশাহী বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ