মাধবী (পর্ব ১৬)

আলপনা তালুকদার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
মাধবী (পর্ব ১৬)

এদেশে হেরে যাওয়া মানুষ রাত-দিন মদ খেয়ে খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেয় অথবা আত্লহত্যা করে। অথবা সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করে। আমি কোনটাই করছি না। শুধু ভেসে বেড়াচ্ছি। এ শহর থেকে সে শহর, এর কাছ থেকে তার কাছে। কাউকেই আমার ভাল লাগেনা। কাউকেই বিয়ে করতে ইচ্ছে করেনা। শুধু মনে হয়, মাধবী, তুমি ফিরে এসো। তোমার মত আমায় কেউ বোঝেনা। ভালবাসেনা। আমার কোন কিছু চাইনা। শুধু দিন শেষে যদি তোমাকে দেখতে পাই, আমার প্রাণ জুড়াবে। আমি সব কষ্ট ভুলে যাব। শরীরের প্রয়োজন বোধ করলে এদেশে সব করা সম্ভব। মিশেলের সাথে সেক্স করেছি, এটা এখন আমার মধ্যে এত বেশী গ্লানিবোধ তৈরী করেছে যে, মাধবীকে সব বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। বলেছি, তুমি এসো, আমি বাকী জীবন অন্ধ হয়ে থাকব। আর কোন মেয়েকে দেখবনা পর্যন্ত।

মাধবী দ্বিধায় আছে। ক’দিন আগে মাধবীর এক সিনিয়র কলিগ দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সড়ক দূর্ঘটনায় স্বামী মারা যাবার পর মহিলা সাত বছর কষ্ট করে দুই মেয়েকে বড় করেছেন। তারপর এক ভদ্রলোককে বিয়ে করেছেন। সে কারণে দুই মেয়ে মাকে ছেড়ে চলে গেছে দাদার বাড়ী। মায়ের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনা।

আমার ফোনে আটটা মিসকল উঠে আছে। বাংলাদেশের নাম্বার। অচেনা। কল ব্যাক করে জানতে ইচ্ছে করছেনা, কে। গত ছ’মাস আমি কারো সাথে কথা বলিনি। আমাকে খুঁজে পাবার সবগুলো জানালা বন্ধ করে রেখেছিলাম। তাই কেউ আমাকে বিরক্ত করতে পারেনি। বড় আপা ফোন করতেন। আমেরিকা থেকে মাঝে মাঝে মেজ আপা ফোন করে আমাকে গালাগাল দিতেন। কেন আমি সোমার হাতে-পায়ে ধরে হলেও সংসারটা টেকানোর চেষ্টা করিনি, সেজন্য। ছ’মাস আরামে ছিলাম। গতকালই আগের নাম্বারটা একটিভ করেছি। তারপরেই মিসকল।

– মলি?! কি ব্যাপার? ফোন করেছিলে কেন?

আমি অবাক! এতদিন পর! মলির সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল, আমি এদেশে আসার এক সপ্তাহ আগে। আমিই দেখা করেছিলাম। মলির সাথে আমার সম্পর্ক চুকে যায় খুব রাগারাগি করে। কারণ আমার সাথে প্রেম চলাকালীন ও আরও একটি ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখছিল।

আমি মলিকে খুব কড়া ভাষায় গালি দিয়েছিলাম। তারপর আর আমাদের কথা হতনা। পরে খুব খারাপ লেগেছিল আমার। আমি কারো সাথে কখনও অত বাজে আচরণ করিনি। “আমি ভুলে গেছি। তুমিও পারলে ভুলে যেও। আবার কবে আমাদের দেখা হবে কি হবেনা, তুমি কিছু মনে রেখোনা। ভাল থেকো”- এই কথাগুলো বলার জন্য দেখা করেছিলাম।

তারপর সোমাকে ছেড়ে যখন আলাদা থাকা শুরু করি, তখন আমার কবিতায় মলি মাঝে মাঝে লাইক দিত। কথা হয়নি কখনও। আমি জানতাম, ও ঐ ছেলেটাকেই বিয়ে করেছিল, যার কারণে আমি ওকে ছেড়েছিলাম। মলি প্রাইমারী স্কুল টিচার। বর ব্যবসা করে। ঢাকায় থাকে। দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার।

এতদিন বাদে মলি কি মনে করে আমাকে ফোন করল, বুঝতে পারছিলাম না। হয়ত আমার দুরাবস্থার কথা শুনে থাকবে, যেহেতু সে আমার এলাকার মেয়ে। মলি শোনালো আরো আজব গল্প। ওরও তালাক হয়ে গেছে চার বছর আগে। কেউ জানেনা। বর চলে গেছে বিদেশে। ফলে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। ওদের মিউচুয়াল ডিভোর্স। তাই সন্তানদের কথা ভেবে ডিভোর্সের কথাটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত ওদের দু’জনেরই। গোপনই আছে। আমি ছাড়া আর কাউকে কথাটা মলি বলেনি।

কয়েকদিন কথা বলতে বলতে মলির সাথে আমার সম্পর্ক ভাল হয়ে গেল। বন্ধুর মত। আমরা নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতাম। বেশী কথা হত মাধবীকে নিয়ে। ও খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতো। একদিন জিজ্ঞেস করল, “এতই যদি ভালবাসতে, তাহলে সোমাকে বিয়ে করার আগে ওর সাথে একবার দেখা করলেনা কেন? ওর খোঁজ নিলেনা কেন?”

ভুল করেছি। বিরাট ভুল করেছি। আমার উচিত ছিল, বিয়ে করতে এসে মাধবীর খোঁজ নেয়া। নিলে তখনই আমি মাধবীকে বিয়ে করতে পারতাম। ওর পরিবারও খুব বেশী আপত্তি করতনা। কারণ ততদিনে মাধবীর পরিবার জেনে গেছিল, মাধবী ওর বরের সাথে ভাল নেই। জোর করে বিয়ে দিয়ে তারা মাধবীকে কষ্টে ফেলেছেন। এখনও তাইই জানে, মাধবী ভাল নেই। এখনও আমি যদি জোর করে ওকে তুলে এনে বিয়ে করি, বাচ্চা দু’টোর কথা ভেবে হয়তো ওর বাবা-মা অসুখী হবেন, কিন্তু মাধবী ভাল থাকবে, এটা জেনে তারা খুশী হবেন। এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত।

আরও একটা ভুল করেছি। আমার উচিত ছিল, বার এ্যাট ল’ শেষ করে দেশে ফিরে এসে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করা। করলে তখন আমি দেশে থাকতাম। তখন কোন না কোনভাবে মাধবীর সাথে আমার দেখা হত, কথা হত। একসময় আমাদের যোগাযোগের বিষয়টা জানাজানি হত। কিছুদিন আমরা দোটানায় থাকতাম। দুজনের সংসারেই কলহ হত। তারপর একসময় আমরা এক হতাম।

আমি জেনে খুব খুশী হয়েছি যে, নাসরিন আপা আমার অনুরোধ রেখেছেন। তিনি রাফার বিয়ে দিয়েছেন রাফার পছন্দের সেই ছেলের সাথেই। আমি বিয়েতে যেতে পারিনি। কিন্তু আমি খুব তৃপ্ত। অন্ততঃ একজন মাধবীকে আমি স্বামীর হাতে রেপ হওয়া থেকে বাঁচাতে পেরেছি। আমার জীবনে এটি অনেক বড় পাওয়া।

নীলের সাথে কথা বলিনি অনেকদিন। রক্তের টান খুব সাংঘাতিক জিনিস। সোমার উপরে ভীষণ রাগ থাকা সত্ত্বেও আমি ফোন করলাম। সোমা জানালো, নীল ইদানিং তার কথা শোনেনা। পড়তে চায়না। বন্ধুদের সাথে বাইরে বাইরে ঘোরে।

এদেশে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারাও একা একা ঘুরতে যায়। নীল প্রথমবার আউটিং – এ ফ্রান্স গিয়েছিল সাত দিনের জন্য। ওদের স্কুল থেকে নিয়ে গেছিল। নিজের ব্যাগ নিজে বয়ে নিয়ে যেতে হয়। নিজের কাজ নিজেই করতে হয়। সোমা ভয়ে অস্থির হলেও আমার টেনশন হয়নি। বরং খুশী হয়েছিলাম এটা ভেবে যে, ও স্বাবলম্বী হতে শিখবে।

একবার স্কুল থেকে ওদেরকে নিয়ে গেছিল শহর থেকে দূরের এক গ্রামে। খামারবাড়ী দেখতে। কৃষকরা কিভাবে ফসল ফলায়, ফসল মাড়াই করে, বাজারজাত করে, সংরক্ষণ করে, গবাদি পশু-পাখি লালন-পালন করে- এসব নিজে চোখে দেখে শিশুরা অনুভব করবে, কৃষক বা খামারীদের কাজটা কত কঠিণ। তারা কষ্ট করে ফসল ফলায় বা দুধ-ডিম মাংসের জোগান দেয় বলেই আমরা খেতে পাই। এর থেকে তাদের প্রতি শিশুদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরী হবে।

ইংল্যান্ডের মত দেশেও কৃষককে ভর্তুকি দেয়া হয়, যাতে ফসল ফলিয়ে তারা লাভবান হয় এবং এ পেশা ছেড়ে না দেয়। দিলে খাদ্য আমদানি করতে হবে। তখন দেশের অর্থনীতির উপর প্রভাব পড়বে। আর আমাদের দেশের গরীব কৃষকরা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে ফসল ফলিয়ে খরচের অর্ধেক দামও পায়না। যারা এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে বছরের পর বছর খাবার জুগিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, সরকারের শত শত কোটি টাকার খাদ্যশস্য আমদানীর খরচ বাঁচিয়েছে, তারা নিজেরা ঠিকমত খেতে পায়না। তারা অনাহারে, অর্ধাহারে রোগে-শোকে ধুকে ধুকে মরে। কষ্ট করে কৃষকরা, আর তাদেরকে বঞ্চিত করে সুবিধা নেয় মধ্যসত্ত্বভোগী পাইকার, মজুতদার, ব্যবসায়ী আর ট্রাফিক পুলিসরা।

গত বছর পর্যন্ত আমাদের পরিবারের সবার সারা বছরের চাল আসতো আমাদের জমির ধান থেকে। এবছর আমরা আবাদ করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে চাল কেনা যায়। মা অবশ্য সিদ্ধান্তটা পছন্দ করেননি। কৃষকের জমিতে, উঠানে ধান থাকবেনা, এটা তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া শক্ত।

আমরা মাস্টার্সের ছেলেমেয়েরা এক্সকারশনে গেছিলাম কক্সবাজার। আমাদের সাথে বেশ ক’জন মেয়ে যায়নি। যেতে পারেনি। পরিবারের অনুমতি পায়নি বলে। আর আমার ছেলে দশ বছর বয়সেই বাবামা ছাড়া বিদেশে গেছে। ওদের যাওয়া বাধ্যতামূলক। ওরা নানা দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখবে, সেগুলো সম্পর্কে জানবে। শুধু বইতে পড়ে মুখস্থ করবেনা। কারণ মুখস্থ করার চেয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কোনকিছু শিখলে সেই শিক্ষা অনেক বেশী স্থায়ী হয়। নীল পড়ালেখায় ভালো। তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াতে আমি খারাপ কিছু দেখিনা।

বেলি জানালো, তার মেয়েকে নাকি এখনও মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। নাহলে খায়না। সকালে না খেয়েই স্কুলে যায়। আমার পুরনো কথা মনে পড়ে গেল।

নীলের বয়স যখন দুই, তখন সোমা ওকে ডেকেয়ার সেন্টারে রেখে অফিস করত। সারাদিন পর এসে কিছুতেই নীলকে খাওয়াতে পারতো না। ও খেতে চায়না। এই নিয়ে খুব অশান্তি। ছেলে খায়না শুনে ডেকেয়ারের ওরা বলেছে, “এখানে তো ঠিকই খায়। আপনাদের বাঙ্গালী মায়েদের সমস্যা আছে।” তারপর শিখিয়ে দিল কিভাবে বাচ্চাকে খাওয়া শেখাতে হয়। ওরা বলে দিল, খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে একসাথে বসবেন। বাচ্চা নিজে যতটুকু খায় খাবে। না খেলে খাবার উঠিয়ে ফেলবেন। আর খাবার কথা বলবেন না। খাবার নিয়ে বাচ্চার পিছে পিছে ঘুরবেন না। তাহলে বাচ্চা বুঝবে, শুধু খাবারের সময়েই খেতে হয়।

পরের দিন একসাথে টেবিলে আমাদের সাথে নীলের প্লেটেও খাবার দেয়া হল। ও খেলল। কিছুই খেলনা। সোমা খাবার ফ্রিজে তুলে দিল। আমি কাজে চলে গেলাম। সোমার সেদিন অফডে। দুপুরে ফোন করে জানতে চাইলাম, নীল খেয়েছে কিনা। সোমা জানালো, খায়নি। সোমা টেবিলে খাবার দিয়েছিল। শুধু দু’বার মুখে দিয়েছে। বিকেলে ফিরে যখন শুনলাম তখনো খায়নি, আমার চোখে পানি চলে এলো।

আমরা পাশের রুমে টিভি দেখছি, আর খেয়াল করছি, নীল কী করে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, নীল ফ্রীজ খুলে একা একা জুস খাচ্ছে। অনেকটা খেল, খানিকটা ফেললো তার জামাতে। তারপর কার্পেটের উপর শুয়ে একাই ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন টেবিলে নিজেই এসে বসল। এভাবে অল্প অল্প করে খেতে খেতে নিজেই খাওয়া শিখে গেল।

আমাদের দেশের প্রতিটা ধনী পরিবারের বাচ্চাদের এই ‘না খাওয়া’ রোগ আছে। ঘরে প্রচুর খাবার আছে। কিন্তু বাচ্চা খায়না। আবার কিছু কিচ্ছু বাচ্চা প্রচুর খায়। কিন্তু কোন শারীরিক পরিশ্রম করেনা। ফলে সেগুলো হয় এক একটা চর্বির গুদাম। গরীবের বাচ্চাদের এসব সমস্যা নেই। এখানকার কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের খেলার ছলে একটু একটু করে পড়া শেখানো হয়। আর সেই সাথে নিজে নিজে খাওয়া, নিজের প্লেট-গ্লাস নিজে ধোয়া, হাতমুখ ধোয়া, টয়লেট করা, নিজের পোশাক নিজেই পরা, নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখা – এসব শেখানো হয়। এভাবে ছোটবেলা থেকেই এদেরকে স্বাবলম্বী হতে শেখানো হয়। তাতে শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এরা পরনির্ভরশীল হয়না। প্রতিটা শিশুর জন্য এটা খুব জরুরী। ওরা যত বেশী স্বাবলম্বী হবে, তত ওদের আত্মবিশ্বাস, উদ্যম ও কর্মক্ষমতা বাড়বে।

আমি দেশে এসেছি, সেকথা মাধবী ছাড়া আর কাউকে জানাইনি। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা মাধবীর সাথে দেখা করতে এসেছি। উঠেছি হোটেলে। আমি হোটেলে ঢোকার গেটের কাছের এক কর্নারে বসে অপেক্ষা করছি। কাঁচের দেয়ালের কারণে বাইরের সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

মাধবী অটো থেকে নামলো। অফিস থেকে এসেছে। নীল জামদানি শাড়ী পরে আছে। চুলগুলো খোঁপা করা। কপালে নীল টিপ। ভীষণ সুন্দর লাগছে। ওকে দেখেই আমার বুকের ভেতর কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হলো।

আমি গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে একটু চমকে গেল মনে হল। ওর মুখটা গম্ভীর। আমি হাসিমুখে বললাম, “এসো। কেমন আছ?” খুব মৃদুস্বরে বলল, ‘ভাল’।

আমি ওকে নিয়ে আমার রুমের দিকে গেলাম। মাধবী ঘরে ঢোকার পর আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। তারপর ভিখারীর মত ওর দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “বুকে আয় সোনা।” মাধবী একান্ত বাধ্যগত শিশুর মত আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহ্! কতদিন পর ও আমার বুকে। যেন মরুভূমির বুকে ভরা বর্ষাপাত। আমার মনের মধ্যে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমি আমার এতদিনের দুঃখ, কষ্ট, একাকীত্বের যন্ত্রণা, সব এক নিমেষে ভুলে গেলাম। অসম্ভব ভালোলাগাবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। অনেকদিন পর! আমি ওকে শক্ত করে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে আছি।

সব মানুষের শরীরের গন্ধ আলাদা। আমার বন্ধু সুলতানের গায়ের গন্ধ এত বাজে ছিল যে, আমি ওর আশপাশে ঘুমাতে পারতাম না। মায়ের শাড়ীর গন্ধ ছিল অসাধারণ। ঐ গন্ধটা আমি আর কিছুতে পাইনি। এখনও নাকে লেগে আছে। ছোটবেলায় ভাত খাবার পর আমি হাত-মুখ মুছতাম মায়ের শাড়ীতে। তখন গন্ধটা পেতাম। সবচেয়ে বেশী পেতাম তখন, যখন বাবার মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য মাকে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরতাম। মায়ের পেটের সাথে আমার নাক-মুখ গোঁজা থাকতো। আর রাতে ঘুমানোর সময় যখন মাকে জড়িয়ে ধরে গল্প শুনতাম, তখন। বোনেরা হিংসে করত। মা আমাকে বেশী আদর করছে বলে।

সোমার গায়ে গন্ধ হত খুব বেশী ঘামলে। মাধবীর শরীর থেকে আমি একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। সেটা ওর শরীরের নিজস্ব। ও কোন পারফিউম মেখে আসেনি। আগেই বলেছিল, তাই করবে। আমাদের তো আর একে অন্যকে মুগ্ধ করার প্রয়োজন নেই। তাই সে চেষ্টাও নেই। আমি ওর চুলের গন্ধ পাচ্ছি। ওটা আরও মিষ্টি। ওর চুলগুলোও খুব সুন্দর! ঘন কালো আর মসৃণ। বিধাতা ওকে দিতে কোন কার্পণ্য করেননি। শুধু ওর আপনজনেরাই ওকে সুখী হতে দেয়নি।

মাধবী কাঁদছে। কাঁদছি আমি নিজেও। কাঁদছি আমাদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে। দু’জন শক্তিমান মানুষ পরিস্থিতির কাছে কতটা অসহায়, সেই কথা ভেবে। এত ভালবাসার পরেও আমরা দু’জন এক হতে পারছিনা বলে।

মাধবীর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে। আমার ঘর ভেঙ্গেছে ওর কারণে – এই অপরাধবোধ ওকে কষ্ট দিচ্ছে অনেকদিন ধরে। আচমকা মাধবী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল।

– তুমি আবার বিয়ে কর।

মাধবীর হুকুম। মাধবী খুব ভাল করে জানে, আমি এ জীবনে আর কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারবনা। তাহলে বিয়ে করে কি হবে?

আমি ওর অবস্থা বুঝতে পারছি। মাধবী আমাকে আগেই বলেছিল, সে আমার কাছে আসতে পারবেনা। বাচ্চাদের কারণে। আমি ওদেরকে আপন করতে চাইলেও ওরা আমাকে মেনে নেবেনা। ওদের ছেড়ে মাধবীও থাকতে পারবেনা। তাই আমার কাছে এলেও ওর ছেলেমেয়ের জন্য ওর কষ্ট হবে। তাছাড়া সামাজিকতা আছে। বাচ্চাদের ভবিষ্যত আছে। তারচেয়ে বড় কথা, ওরা আমার ছেলের মত নয়। আমার ছেলে যে পরিবেশে বড় হয়েছে, সেখানে ডিভোর্স, বাবা বা মায়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই সোমার দ্বিতীয় স্বামীকে বাবা হিসেবে মেনে নিতে নীলের তেমন সমস্যা হয়নি। মাধবীর ছেলেমেয়েরা আমাকে তাদের বাবা হিসেবে মেনে নিতে পারবেনা। তখন চরম অশান্তি হবে। এটা এমন একটা সমস্যা যার কোন সমাধান নেই।

– তুমি অযথা কষ্ট পাচ্ছ। এখন আমি বেশ ভাল আছি। আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি। এখন আমি কবিতা লিখতে পারি। যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।

– কত রোগা হয়ে গেছ। চোখের নীচে কালি। একে ভালো থাকা বলে?

মাধবী আরো বেশী কাঁদছে। ওর চোখের পানি যেন থামছেইনা। আমি ওর কান্না আর সহ্য করতে পারছিলামনা। আমি ওর পাশে বসে ওর ডান হাতটা আমার হাতে নিলাম। ওর আঙ্গুলগুলোর মধ্যে নিজের আঙ্গুল গলিয়ে দিলাম। ওর হাতদুটোও কী নরম! আমি ওর হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেলাম।

– শোন, তুমি চাও আমি ভাল থাকি। তুমি কি করে বুঝলে, বিয়ে করলেই আমি ভাল থাকব? তুমিও তো বিয়ে করেছ। তুমি ভাল আছ? বল আছ?

মাধবী কাঁদছেই। এবার ফুঁপিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল করে ফেললো। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমি যাব। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

চলবে…

আলপনা তালুকদার। ড. আকতার বানু আলপনা (আলপনা তালুকদার নামেই বেশি পরিচিত) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর (শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট) - এর একজন অধ্যাপক। তিনি এসএসসি-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে রাজশাহী বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ