ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
আমি দেশে ফেরার জন্য দিন গুনছিলাম। মাধবীর সাথে আবার যেদিন দেখা হবে, সে দিনটাকে নিয়ে আমার উত্তেজনার শেষ ছিলনা। রোজ রাতে শুয়ে শুয়ে শতেক পরিকল্পনা করতাম। দেশে গিয়ে আমি উঠব সুমনের বাসায়। মাধবী ভার্সিটি যাবার নাম করে সুমনের বাসায় আসবে। আমরা দু’জন দু’জনকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হব। তারপর একসময় আমরা কোন একটা রুমে একা হব। সুমন আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে যাবে। আমি মাধবীকে জড়িয়ে ধরবো। ও প্রথম প্রথম খুব লজ্জা পাবে। আমার মনে হয়, ও একটু বেশীই লাজুক। হোক। আমি একটু জোর করে হলেও ওর ঠোঁটে চুমু খাব। এরপর আর ভাবতে পারিনা। প্রতিবার আমার কল্পনা এ পর্যন্ত এসে থেমে যায়।
আমি ওর জন্য হীরার আংটি কিনেছি। বলতে দ্বিধা নেই, আমার সাধ্যের অতিরিক্ত দাম দিয়েই কিনেছি। আরো কিছু জিনিসপত্রও কিনেছি। যখন আমি ওর হাত ধরব, তখন আমাদের ভাললাগার অনুভূতিগুলো ছড়িয়ে যাবে দু’জনের শরীরে। ঠিক করে রেখেছি, তখন কিছুতেই আমি ওর হাত ছাড়বনা। ‘ হৈমন্তী’ গল্পের অপুর মত আমারও মনে হবে- “পাইলাম! আমি ইহাকে পাইলাম!”
আমি ওর হাতের সরু আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করব। তারপর পকেট থেকে আংটিটা বের করে ওর হাতে পরিয়ে দিয়ে বলব, “মাই ফেয়ার লেডী, উইল ইউ ম্যারী মি?” তখন ওর চোখমুখের অবস্থা কেমন হয়, তা দেখার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি।
মাধবীর সাথে যেদিন আমার প্রথম দেখা হয়, সে দিনটাকে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল দিন বলব, নাকি সবচেয়ে খারাপ দিন বলব, বুঝতে পারিনা। ভাল বলতে ইচ্ছে করে এজন্য যে, ওর সাথে দেখা না হলে আমার পৃথিবীর কোন কিছুই অনুভব করা হতনা বলে মনে হয়। আর দুঃখের মনে হয় এজন্য যে, ওকে হারানোর পর যে কষ্ট আমি পেয়েছি বা এখনও পাচ্ছি, এর চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল ছিল।
আমার এ জীবনে আমি মাধবীকে দেখেছি মোট পাঁচ দিন। তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। অথচ আমার পুরো পৃথিবী জুড়েই মাধবী ছাড়া আর কিছু নেই। আমি অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এক মিনিটের জন্যও ওকে মাথা থেকে সরাতে পারিনি। আজ এত বছর পরেও যখন ওর কথা ভাবি, অজান্তেই চোখের কোণ ভিজে ওঠে। ওকে ভালবাসার আগে আমি বুঝতামইনা যে, একজন পুরুষমানুষ কি করে কাঁদে? আমি এদেশে আসার সময় বিমানবন্দরে বিদায় দিতে গিয়ে আমার বোনেরা কেঁদেকেটে হুলুস্থুল। আমি কাঁদিনি। আমার কান্না পায়নি। এখন কাঁদি। রোজ কাঁদি।
মাধবী আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। আসতে চায়নি মোটেই। অনেক আড়ষ্টতা নিয়ে আমার আর সুমনের জোরাজুরিতে এসেছে। চোখে-মুখে সেই খুশী নেই। কেমন যেন প্রাণহীন, মলিন। সাদা সালোয়ার-কামিজে তবু ওকে পরীর মত লাগছে। কি সুন্দর হয়েছে দেখতে! আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। অনিচ্ছাসত্বেও আমার চোখ বার বার আটকে যাচ্ছে ওর চোখেমুখে। আমি চোখ সরাচ্ছিনা। কারণ আমি তখনো ভাবছি, মাধবী শুধুই আমার। এক বছর আগে সেদিন সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে এই লজ্জাবতী মেয়েটিকেই আমি ছেড়ে গেছিলাম। আজ সকালে যে আমার সামনে, সে কি সেই মাধবী?
ওর চুলগুলো সারা পিঠে ছড়ানো। এলোমেলো। তেমন সাজেওনি। খুবই সাদামাটা। আড়চোখে দু’বার আমার দিকে তাকালো। যেন নিজেকে লুকোবার চেষ্টা করছে। খুব নীচু গলায় বলল, “কেমন আছ?” আমি কোন জবাব দেইনি। দিতে পারিনি। কি বলব আমি? আমি সত্যি সত্যি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মাধবীর কাছে এসেছি। মাধবীও আমার সামনে। কিন্তু আমরা আর কেউ কারো নই। সুমন আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ দিয়ে পাশের রুমে গেল বটে। কিন্তু আমাদের কথা ফুরিয়ে গেছে। মাধবী সোফায় আমার পাশে বসল, একটু দূরে। যেন সে আমাকে ছুঁতে চায়না। আমি এখন তার পর হয়ে গেছি। তখনো আমি আশা ছাড়িনি। আজও যেমন ভাবি নরেশ গুহের সেই কবিতার মত –
যদি আজ বিকেলের ডাকে
তার কোন চিঠি পাই?
যদি সে নিজেই এসে থাকে,
যদি এতোকাল পর তার মনে হয়
দেরী হোক – তবু যায়নি সময়।
আমি মাধবীর কাছে সরে এসে দু’হাতে ওর হাত ধরলাম। চোখে ততক্ষণে সমুদ্র। আমি ধরা গলায় বললাম, “ফিরে এসো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবনা। তুমি জান। তুমি আমাকে বোঝ।” মাধবী হতভম্বের মত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। চোখে কোন ভাষা নেই। যেন আমি কি বলেছি, সে শুনতে পায়নি।
ভেবে রেখেছিলাম, যখন একান্তে মাধবীর সাথে দেখা হবে, ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাব। সেই মায়াবী চোখ, গোলাপী পুরু ঠোঁট, সেই তুলতুলে গাল। কিন্তু আমার চুমু খেতে ইচ্ছে করছেনা। এমন কি জড়িয়ে ধরতেওনা। আমি ওর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। ও কিছুই বলছেনা। উদ্ভ্রান্তের মত শুধু চেয়ে আছে। যেন একসাথে অনেকগুলো দুঃসংবাদ শুনলে মানুষ যেমন দুঃখে পাথর হয়ে যায় – তেমনি।
মাধবী উঠে দাঁড়াল। সে চলে যাবে। আমার আনা হীরার আংটি, উপহার কোনকিছুই সে নেয়নি। সে শুধু যেতে চায়। আমার কাছ থেকে, আমার সামনে থেকে, আমার জীবন থেকে। দূরে, অনেক অনেক দূরে। আর বেশীক্ষণ এখানে থাকলে ও নিজেকে সামলাতে পারবেনা। বাঁধ ভেঙ্গে গেলে যেমন তীব্র গতিতে পানি ছুটে আসে, তেমনি এত যত্ন করে লুকিয়ে রাখা তার আবেগ বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ওর মুখটা ফ্যাকাসে। একেবারে মরা মানুষের মত। নতুন বৌয়ের চেহারা কখনো এত মলিন হয়না।
কত স্বপ্ন ছিল আমাদের! মাধবী বলেছিল, “তুমি এলে তোমাকে প্রাণভরে দেখব, সারাদিন তোমাকে ছুঁয়ে থাকব, এতদিনের বিরহ সুদে-আসলে উসুল করে নেব।” আজ তার কোন ইচ্ছে নেই। আমার দিকে সে ভাল করে তাকাচ্ছেওনা। পাছে আমি তার মনের কথা চোখের চাহনিতে পড়ে ফেলি, সেই ভয়ে। শুধু মাথা নীচু করে বলল, ‘আসি’। বলেই সে যাবার জন্য পা বাড়ালো। এক নিমেষে আমার সবুজ পৃথিবী মরুভূমি হয়ে গেল। আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম, সেই জনমানবহীন মরুভূমিতে আমি একা। আমি ভিখারীর মত ওর হাত চেপে ধরে বললাম, “সোনা আমার, তোমার পায়ে পড়ি, এমন করোনা।”
আমার গলার স্বরে বোধহয় এমন কিছু ছিল, যার আঘাতে পাথর ফেটে তীব্র গতিতে পানি বেরিয়ে এলো। ডুকরে কেঁদে উঠে মাধবী আমাকে জড়িয়ে ধরল। সুমনের সামনেই। আমরা লজ্জা পাচ্ছিনা। আমি দু’হাতে মাধবীকে বুকের সাথে জাপটে ধরে আছি। ও ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর শরীর আর চুলের মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে-মুখে। ওর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানিনা। সুমন বলল, “মাধবী, আমার মনে হয় তোমার এবার যাওয়া উচিত।” আমি আরো শক্ত করে ওকে আঁকড়ে ধরে বললাম, “না, ও যাবেনা।” সুমন কড়া গলায় শাসনের সুরে বলল, “ওকে যেতে দাও।”
আমি মাধবীকে যেতে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ও চলে গেল। যতক্ষণ দেখা যায়, আমি হতাশ চোখে ওর পথের দিকে তাকিয়েছিলাম। সেই থেকে আমি একা। ভীষণ একা। অনেকের মাঝে থেকেও একা।
মাধবী একবার লিখেছিল, “তুমি ভীষণ সাহসী। ঝুঁকি নিতে ভয় পাওনা। আর আমি বড্ড ভীতু। বন্ধু হিসেবে তোমাকে ভাল লাগার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ। তোমার এই গুণটা আমাকে খানিকটা ধার দেবে?” উত্তরে আমি লিখেছিলাম, “আমি বন্ধুকে গ্রহণ করি বন্ধু হিসেবেই; গুণবান বা গুণহীন হওয়ার কারণে নয়।”
মাধবী লিখল, “তোমার কথার জবাব দেবার আগে ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা দেই। ব্যক্তিত্ব হল ব্যক্তির এমন কতকগুলো গুণ বা বৈশিষ্টের সমষ্টি, যা তাকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে এবং অন্য ব্যক্তি থেকে আলাদা করে। সত্যবাদিতা বা দানশীলতা গুণটি কম-বেশি আমাদের সবার মধ্যেই আছে। কিন্তু এই দু’টো গুণ অন্য মানুষদের থেকে আলাদা করেছে শুধুমাত্র মহানবী (সাঃ) ও হাজী মোহাম্মদ মোহসীনকে। আমি বন্ধুকে গ্রহণ করি বন্ধু হিসেবেই। তবে তার অসাধারণ গুণগুলোকে আমি শ্রদ্ধা করি, আমার নেই বলে তাকে ঈর্ষা করি এবং তা অর্জন করার জন্য চেষ্টা করি (যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা পারিনা)।”
আগে জানলে আমার সবটুকু সাহস মাধবীকে দিয়ে দিতাম। আমি বুঝিনি, ও এভাবে অন্যায়ের কাছে হেরে যাবে। একটু সাহস করে যদি প্রতিবাদ করতো, আমরা বেঁচে যেতাম। এভাবে মরে বেঁচে থাকতে হতনা।
মাথার মধ্যে একসাথে দশটা বোমা ফাটলে যেমন অনুভূতি হবার কথা, আমার ঠিক তেমনি অনুভূতি হয়েছিল যখন শুনেছিলাম মাধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি সুমন মিথ্যে বলছে। যখন বুঝলাম ঘটনা সত্যি, তখন মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। মাধবী রাজী হল কিভাবে? ও জানে, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবনা। ও এমন কাজ করতে পারেনা। সেদিন আমি পাগলের মত কেঁদেছি। সেই থেকে আমার কান্নার শুরু। এত বছর ধরে কাঁদছি। এখনও চোখের জল শুকায়নি। এত কান্না আসে কোথা থেকে?
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..