মাধবী (পর্ব ৬)

আলপনা তালুকদার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
মাধবী (পর্ব ৬)

মাধবীকে ছাড়াই এদেশে ফিরে আসার পর আমি কোনকিছুতে মন বসাতে পারতাম না। পড়াশোনা করতেও ইচ্ছা করতো না। বন্ধুদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতাম। কারণ মাধবী কেন আরেকজনকে বিয়ে করলো, এই কৈফিয়ত দেওয়া আমার জন্য ছিল মৃত্যুযন্ত্রণার সমান।

আমি একটা সেমিস্টার ড্রপ করলাম। পার্টটাইম জব আর বাকী সময় ঘরেই থাকতাম। মাধবীকে ভোলার জন্য আমি তখন এর ওর সাথে কথা বলতাম, চ্যাট করতাম। এভাবেই সোমার সাথে আমার আলাপ। তারপর এক বছরের মাথায় বিয়ে।

আমার স্ত্রী সোমা যখন সন্তানসম্ভবা, তখন আমি পেটারনিটি লিভ নিয়ে বাসায় থাকতাম। সোমাও মেটারনিটি লিভে আছে। দু’জনেই উইথ পে তে আছি। এদেশে এরা এটা করে মায়ের শারীরিক-মানসিক যত্নের কথা ভেবে। সকালে সোমা যখন বমি করে করে নেতিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ত, আমি তখন বিন্দুমাত্র ঘৃণা ছাড়া ওর বমি পরিস্কার করতাম, বাথরুমে ফিনাইল দিতাম, এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করতাম। আর অবসর সময়ে পড়ে পড়ে ঘুমাতাম। একদিন সোমা বলল, “বেবী হচ্ছে আমার, আর দিন দিন সুন্দর হচ্ছ তুমি!”

আমি ‘বাবা’ হবার অপার্থিব  আনন্দে যেমন উদ্বেলিত  ছিলাম, তেমনি সোমার কষ্ট দেখে খারাপও লাগতো। বেচারা! কিছুই খেতে পারেনা। শুধু বলে, “গন্ধ লাগে।” কাল আমি ওর পছন্দের ইলিশ মাছের ভাজি আর কচু শাকের ভর্তা করেছিলাম। একটু ঝাল ঝাল করে। সাথে লেবু আর কাঁচা মরিচ। এই আশায় যে, যদি এটা অন্তত একটু খেতে পারে। বার চারেক মুখে দিয়ে ও দৌড় দিল টয়লেটে। বড় কষ্টকর!

আমাদের দেশে শহরে অবস্থাপন্ন ঘরের গর্ভবতী মায়েদেরকে দেখা হয়  ‘অসুস্থ’ হিসেবে। এদেশে উল্টো। এরা মনে করে ‘সন্তানধারণ’ আমাদের জীবনের অতি সাধারণ ও কাঙ্খিত ঘটনাগুলোর মতই একটি। তাই এ সময়ও এরা স্বাভাবিক সব কাজকর্ম করে। নিয়মিত ব্যায়ামও করে। প্রথম প্রথম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ৮/৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা যখন বিশাল পেট নিয়ে আসতো, আমি দেখে ভাবতাম, “এ অবস্থায় না এলে কি হত?” এরা সবকিছু উপভোগ করে। জীবনের প্রতিটি স্তরের মত এ স্তরটাও। আমরা লজ্জায় গোপন করি, বড় পেট নিয়ে মানুষের সামনে যাইনা। আর এরা ফলাও করে বলে, “মা হচ্ছি! ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেতে যাচ্ছি, এতে লজ্জার কি আছে? শারীরিক পরিবর্তন?  সেতো হতেই হবে। নাহলে ‘মা’ হব কিভাবে?”

ডেলিভারীর জন্য যখন সোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করি, ও বলল, “সিজার হোক। আমি অত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবনা।” সপ্তাহ দুই আগে পেটে গ্যাস হওয়ার কারণে পেইন হচ্ছিল। ডাক্তার সব দেখে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিল, “দেরী আছে।” সোমার সিজারের আবদারে তারা নাখোশ। “কিছু হবেনা, আমরা আছি। ভয় কি?” এরা চায় সবকিছু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হোক। আর আমাদের দেশের ডাক্তাররা “নরমাল ডেলিভারী” শব্দটা ডিকশনারী থেকে তুলে দিতে পারলে বাঁচে।

তীব্র ব্যথায় সোমা যখন ছটফট করছে, ওর গা ঘেমে একাকার! দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। ওর চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম। আমি বললাম, “সরি ডাক্তার, আমি থাকতে পারবনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।” ভ্রু কুঁচকে ডাক্তার বলল, “এসময় আপনাকে তার সবচেয়ে বেশী দরকার। আর আপনি তাকে ফেলে চলে যাবেন?”

যথেষ্ট সাহসী মানুষরাও যে কখনও কখনও ভয়ে শিউরে ওঠে, সেদিন বুঝেছিলাম। আমাদের দেশে বউয়ের বাচ্চা হবার সময় স্বামী পাশে থাকবে – এটা অকল্পনীয়। ছেলে হবার পর আমার মনে হয়েছিল, আমিও ওকে জন্ম দিলাম।

মাধবী বলত, “আমি হব পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। সবচেয়ে ভাল স্ত্রী,  সবচেয়ে ভাল বৌমা, সবচেয়ে ভাল মা; এমনকি সবচেয়ে ভাল শাশুড়ী। তুমি রোজ দু’বেলা আমার পা ধুয়ে পানি খাবে। কারণ সুখী হবার এবং সুখী করার সব কৌশল আমার জানা।” ওর আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অবাক হতাম। বলে কি গাধীটা! কি এমন মহামন্ত্র সে জানে যে সুখের বন্যা বইয়ে দেবে? পৃথিবীর ম্যারেজ কাউন্সেলিং অফিসগুলো জানতে পারলে তো ওকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাবে!

সব সংসারে অশান্তি হয়, প্রেমের বিয়েতে আরো বেশী হয়। কারণ সেখানে একে অন্যের প্রতি প্রত্যাশা বেশী থাকে, আবেগ বেশী থাকে, ফলে যুক্তি কাজ করেনা। আর তারা সংসার জীবনের নানা বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে কল্পনায় সুখের সাগরে ভাসতে থাকে। একে অন্যকে ইমপ্রেস করার জন্য নিজের খারাপ দিকগুলো স্বেচ্ছায়, সযত্নে আড়াল করে রাখে। সেটল ম্যারেজে প্রত্যাশা কম থাকে। ফলে মনের মত অল্প কিছু পেলেই মনে হয়, “এটুকুও নাও পেতে পারতাম। শুকুরআলহামদুলিল্লাহ!!” আমাদের হবে প্রেমের বিয়ে। সুতরাং ঝগড়া অনিবার্য। আমি বেশীক্ষণ ওর উপরে রাগ করে থাকতে পারিনা। ওর পায়ে ধরে মান ভাঙ্গাতে হলেও আমার আপত্তি নেই। তবে আমি আশাবাদী। আমার মাধবী খুবই বিচক্ষণ মেয়ে। যেকোন পরিস্থিতি সামলে নেবার অলৌকিক  ক্ষমতা ওর আছে।

পরে জেনেছি, মাধবী ভুল বলেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসাধ্য সাধন সে করে ফেলেছে! শাশুড়ীকে পর্যন্ত বশ করে ফেলেছে। আমাদের দেশে সবচেয়ে বৈরী সম্পর্ক হয় শাশুড়ী-বৌয়ের। মাধবীর শাশুড়ী “বড় বৌমা” বলতে অজ্ঞান। ননদ, দেবর, ভাশুর, জা – সবাই ওর উপরে নির্ভরশীল। ননদ, ভাশুরের বাচ্চাগুলোও ওকে খুবই পছন্দ করে। যেকোন সমস্যায় বা সবার বিপদে সবার আগে এগিয়ে যায় মাধবী। ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা ওর বরের চেয়ে ওর উপরে বেশী ভরসা করে। মাধবীর নিজের আত্মীয়স্বজনদের যেকোন সাহায্যে ওর হাত ওঠে সবার আগে। ও নিজে কতটা সুখী হয়েছে জানিনা, তবে নিজের আত্মীয়স্বজন ও শ্বশুরবাড়ীর সবাইকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে, সেটা জানি। মাধবীর স্বামী তার পা ধুয়ে পানি খায় কিনা, সে খবর অবশ্য আমি এখনো পাইনি। এমন মেয়েকে পেয়ে কোন পুরুষের অসুখী হবার কথা নয়।

আমি মাধবীকে প্রশ্ন করেছিলাম, “কি করে শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের মন জয় করে সবাইকে সুখী করবে?” ও লিখেছিল, “আশি ভাগ দাম্পত্য কলহের কারণ হল আর্থিক। আমাদের দেশের মেয়েরা ভীষণ কৃপণ। তার কারণও আছে। মেয়েরা সারাজীবন পরনির্ভশীল। বাবা, স্বামী বা ছেলের উপর। তারা জানে, স্বামীর অবর্তমানে মেয়েদের অবস্থা কতটা নাজুক হয়। মেয়েদেরকে অধিকাংশ সময় আর্থিক দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাবার সম্পত্তির অংশ বা বিধবা হলে স্বামীর সম্পত্তি মেয়েদেরকে ঠিকমত দেয়া হয়না। মেয়েরা উপার্জন করলেও তাদের ইচ্ছামত স্বামী তা খরচ করতে দেয়না। এমন কি, দেনমোহরটাও ঠিকমত দেয়না। তাই সারাজীবন, বিশেষ করে বিয়ের পর মেয়েরা হয় হিসেবী। শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের পিছনে টাকা খরচ করা তারা পছন্দ করেনা, অপচয় মনে করে। ফলে শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভাল হয়না। ফলে এই কারণে স্বামীর সাথেও তার সম্পর্ক খারাপ হয়।

বউরা যদি একটু উদার হয়ে শ্বশুরবাড়ীর লোকদের আপন করে নিতে পারে, স্বামী বলার আগেই তাদের প্রতি  কর্তব্য করতে পারে, যদি মেনে নেয় যে স্বামীর রোজগারে তাদেরও হক আছে, যেহেতু তারা স্বামীকে মানুষ করেছে – তাহলে স্বামী ও স্বামীর চৌদ্দগুষ্টি বউদেরকে মাথায় করে রাখতে বাধ্য। তখন স্বামীও স্ত্রীর রিলেটিভদের দিকে খেয়াল করবে। স্ত্রীর মতের দাম দেবে। ভালবাসবে।

আমি এটা জানি। সব মেয়ে জানেনা।”

চলবে…

আলপনা তালুকদার। ড. আকতার বানু আলপনা (আলপনা তালুকদার নামেই বেশি পরিচিত) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর (শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট) - এর একজন অধ্যাপক। তিনি এসএসসি-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে রাজশাহী বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ