মাধবী (পর্ব-১)

আলপনা তালুকদার
উপন্যাস, ধারাবাহিক
মাধবী (পর্ব-১)

মাধবী (পর্ব-১)

 

(পর্ব – এক)

– হ্যালো! শুনতে পাচ্ছ? কথা বলনা কেন?

[Align_Justify]আজব কাণ্ড! অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষও যে সীমাহীন বোকা হতে পারে, এই মেয়েটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেল্ফ ফিনান্সে বিদেশে পড়তে আসা মধ্যবিত্ত বাঙালী ছাত্রদের প্রতিটা পয়সা যে গুণে গুণে খরচ করতে হয়; পার্টটাইম জব করে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা টিউশন ফি দিয়ে নিজের খরচ চালাতে হয়, সেটা সে জানে। এখানে সেই যৎসামান্য সঞ্চয় থেকে সপ্তাহে দুই দিন লংডিসটেন্স কল করার মত বিলাসিতা যে আমার সাজেনা, সেটা তার বোঝার কথা। তবু সে নিশ্চুপ। আমি তার কন্ঠস্বর শোনার জন্য মরীয়া। অথচ সে অভিমান নিয়ে বসে আছে।

বড় ভাল মেয়ে মাধবী। এমন কোন গুণ নেই যা তার নেই। অসম্বভ মেধাবী, ভীষণ অনুভূতিশীল, সৎ, গান-কবিতা পাগল, খুব মিশুক, সৃষ্টিশীল। দোষের মধ্যে এই যে, সে বড় অভিমানী। আমি একটু কড়া কথা বললেই তার চোখে পানি চলে আসে।

এখানে আসার পর ওকে লেখা প্রথম চিঠিতে আমি মোটে দুইটা বানান ভুল করেছিলাম। উত্তরে সে লিখেছে: এম.এ.- এর মৌখিক পরীক্ষায় বিদ্যাসাগরকে এক ইংরেজ শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, “বিপোড আর আপোডের মঢ্যে কি পারঠক্য আসে?” উত্তরে বিদ্যাসাগর বললেন, “মার চিঠি এসেছে। উনি অসুস্থ। বর্ষণমুখর গভীর রাতে ভরা দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়ে মার কাছে যেতে হবে- এটা বিপদ। আর বাঙালীর ছেলে হয়ে, বাংলা পড়ে, বাংলার মৌখিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে একজন ইংরেজ সাহেবের কাছে – এটা আপদ।”প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থেকে পাস করে বাংলা বানান ভুলের মত এমন আপদ তোমার শোভা পায়না। আমি বলিনা যে আমার ভুল হয়না। তবে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি ভুল না করার জন্য।

এই হল মাধবী। প্রথম প্রথম যখন ওর চিঠি আসতো, আমরা সবাই ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। বলা বাহুল্য, খরচ বাঁচানোর জন্য আমরা ক’জন বন্ধু মিলে বাসা ভাড়া নিয়ে একসাথে থাকি। বলতে গেলে, আমরা সবাই ওর চিঠির ভক্ত হয়ে গেছি; যদিও ও ছিল শুধু আমার পরিচিত।

এখনো সে কোন কথা বলছেনা। আমি যে গণক নই, না বললে তার সমস্যা বুঝতে পারবনা- এই সহজ কথাটা এই গাধী মেয়েটাকে কে বোঝাবে? বুঝতে পারছি, সে কোন সমস্যায় আছে। গত সপ্তাহেও যখন কথা বলি, ওর গলা ভারী ছিল। অনেক পীড়াপীড়িতে শুধু এটুকু বলেছে – তার বিয়ের কথা হচ্ছে। হওয়াটাই সাভাবিক। এমন রূপবতী-গুণবতী মেয়ে, যাকে পেলে যেকোন পুরুষের জীবন ধন্য হয়ে যাবার কথা – রোজ তার বিয়ের প্রস্তাব আসবে- এতে আর বেশী কথা কি? মাধবী মাস্টার্সে উঠেছে। আমাদের দেশে মেয়েদের বিয়ের জন্য এটাই উত্তম সময়। তাছাড়া আমাদের দেশের মেয়েরা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার কাছে ‘আমানত’ বৈ তো নয়, তা সে যে আর্থ- সামাজিক স্তরেরই হোক।

আমার পেটের মধ্যে কেজিখানেক ইউরিন। লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছি। এশিয়ার দেশগুলোর মত হলে কথা ছিলনা। রাস্তার পাশে বা যেকোন জায়গায় প্যান্টের চেন খুলে দাঁড়িয়ে গেলেই হল। আশেপাশে কোন টয়লেট দেখছিনা। আমি অপেক্ষা করছি ওর সাথে কথা শেষ করে সবার আগে টয়লেটে যাব।

টেলিফোন বুথের কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখলাম, শাড়ী পরা দু’টো মেয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে।বাঙালী অধ্যুষিত ইউরোপের শহরগুলোর রাস্তায় হরহামেশাই এমন দৃশ্য দেখা যায়। তবু শাড়ী পরা কাউকে দেখলে অজানা খুশীতে মন ভরে যায়। কেমন যেন “আপন আপন” অনুভূতি জাগে। ইচ্ছে করে সামনে গিয়ে বলি, “আপু, ভাল আছেন?”

দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি টান হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় বিদেশে এলে। যখনকার কথা বলছি তখন প্রবাসীদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্খিত জিনিস ছিল চিঠি। এখন মোবাইল, ইন্টারনেট হয়েছে। তখন প্রিয়জন-পরিচিতদের একটা চিঠি বা ফোনকল কোটি টাকার চেয়েও দামী মনে হত। সুকান্তের সেই কবিতার মত, “সকালের একটুকরো রোদ একটুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।”

আমি এদিক থেকে ভাগ্যবান। মাধবী প্রতি সপ্তাহে আমাকে দীর্ঘ চিঠি লেখে। কি যে অসম্ভব সুন্দর সে চিঠি! আমি হাজার বার পড়ি আর সব কষ্ট ভুলে যাই। গত সপ্তাহে ছিল ব্যাংক হলিডে। সব বন্ধ। আমি ভেবেছি, ওর চিঠি আসবেনা। অথচ চিঠি এসেছে। আমার বন্ধুরা এক একটা শয়তানের ডিব্বা। তারা মাধবীর চিঠি লুকিয়ে রেখে বলছে, আগে তারা পড়বে। কি মুশকিল!! কোন মানে হয়? চিঠিতে কতকিছু থাকে। ভালবাসা, স্বপ্ন, অনুপ্রেরণা, আরো কত কি! এমন চিঠি দেয়া যায়? মাধবীকে পাবার পর আমি আর কাউকে তেমন মিস করিনা। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য মন কেমন করত। এখন সয়ে গেছে।

আমি কান পেতে মাধবীর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার চেষ্টা করছি। এমন যে আগে কখনো হয়নি, তা নয়। একবার সে বলল, “আমার চিঠি তুমি অন্যদের পড়তে দেবে কেন?” আমি বললাম, “তাতে কি? ওরা আমার বন্ধু। তাছাড়া আমি আগে পড়ে তারপর ওদের দেই।” একটি চিঠিতে কিছু ‘বেশি বেশি’ ভালবাসার কথা লেখা ছিল। সেটা বন্ধুরা পড়েছে শুনে সে কেঁদে ফেলল। এরকম সময়ে আমার আলো, মেঘ, বাতাস বা নিদেনপক্ষে অতিথি পাখি হতে ইচ্ছে করে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ঠিক ছুটে আসব মাধবীর কাছে। তারপর ওর মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে ওর চোখে চুমু খাব। ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমি বুকের পাঁজরের মধ্যে ওকে আগলে রেখে বলব, “চুপ চুপ! আমার লক্ষী সোনা!”

আমাদের বাসা থেকে ঠিক চারটা বাসা পর একটি বাড়ীতে একটি প্রতিবন্ধী ছেলে থাকে। বয়স দশ-বারো। মাঝে মাঝে দেখি ওর মা ওর স্কুলব্যাগ ও বড় একটা ব্যাগসহ ওকে একটা গাড়ীতে তুলে দেয়। তার আগে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে গালে-মুখে চুমু খায়। তারপর হাত নেড়ে টাটা দেয়। গাড়ী চলে গেলে ওখানেই কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো দেখি বাবা-মা দু’জনেই ছেলেকে বিদায় দিচ্ছে। একদিন সকালবেলা ইসাবেলের সাথে দেখা। আলাপ করলাম যেচে। কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার ছেলেটি কোথায় যায়?” সে যা বলল, তা আমাদের দেশে ভাবাও যায়না। এদেশে এসব বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য সরকারী হোম আছে। প্রতি পনেরো দিন পর হোমের লোকেরা এসে এসব শিশুদের নিয়ে যায় পনেরো দিনের জন্য। এই পনেরো দিন এদের লেখাপড়া, যত্ন – সব করে হোমের লোকেরা। পনেরো দিন পর আবার দিয়ে যায়। এটা তারা করে এসব শিশুর বাবা-মাকে কিছুটা রিলিফ দেবার জন্য। রোজ এমন একটি শিশুর যত্ন নিতে গেলে বাবামার অফিসের কাজের ক্ষতি হবে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন আনন্দহীন, বোরিং হবে – তাই। কি অসাধারণ চিন্তা! বিদেশে আসার আগে এদের সম্পর্কে আমার যে নেতিবাচক ধারণাগুলো ছিল, কাছ থেকে দেখার পর ধীরে ধীরে সেগুলো চলে যাচ্ছে।

আজ সকালে যখন ইসাবেল ছেলেকে বিদায় দেবার আগে আদর করছিল, তখন তা দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন বড় আপার সাথে কথা হয়নি। একমাত্র তার বাসাতেই টেলিফোন আছে। সবার খবর আমি ফোনে আপার কাছ থেকে পাই।

– হ্যালো! মাধবী কথা বল। বল কি হয়েছে?

মাধবী কি যেন একটা বলার চেষ্টা করল। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওর গলাটা খুবই ক্ষীণ। যেন গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছেনা।

– আমার শরীর খারাপ। তুমি টেনশন করবে, তাই বলিনি।

সতেরো দিন পর মাধবীর গলা শুনলাম। মনে হচ্ছে, যেন সতেরো বছর কেটে গেছে। ফোন ধরেনি, চিঠির জবাব দেয়নি। চারদিন আগে একবার ফোন করেছিলাম। কাজের মেয়ে ফোন ধরে বলেছে, “আফা বাসায় নাই।” কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করার আগেই ফোন কেটে দিয়েছে। পরে আর ধরেনি। কি করব বুঝতে পারছিলামনা। ও কখনও এমন করেনা। বেড়াতে গেলে আগেই জানায়। সুমনকে ফোন করেছিলাম। সেও কিছু জানেনা। আমার কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। বিজি ছিলাম। কিন্তু টেনশন তো যায়না। সুমনকে গতকাল বলেছিলাম খোঁজ নিয়ে জানাতে। জানায়নি। দেশে থাকলে সব কাজ ফেলে আগে ওর খবর নিতাম। মেয়েটা নিজের ব্যাপারে বড় উদাসীন । একটু খেয়ালীও বটে। সহজে নিজের সমস্যা বলতে চায়না। আমাকেও না। ওর মনের কথা এখন আমি অনুমান করতে পারি ওর গলা শুনে। সেটাও পারিনি। মাঝে মাঝে ওর আম্মা ফোন ধরেন। ভীষণ বিচক্ষণ একজন মানুষ। আমি ‘হ্যালো’ বলার সাথেই আমার গলা চিনতে পারেন। মাধবীর পরিবার উচ্চশিক্ষিত। সবাই ভীষণ ভাল। শুধু ওর বাবাকে আমার একটু বেশী গম্ভীর আর রাগী মনে হয়েছে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আমি ওনাকে দেখেছি শুধু এক ঝলক।

মাধবীর এ্যাপেন্ডিক্স ফেলে দিতে হয়েছে। মাস দুই আগে ইনফেকশন হয়েছিল। চার দিন ক্লিনিকে ভর্তি ছিল। সে যাত্রা সেরে ওঠে। আবার হঠাৎ তীব্র ব্যথা ওঠায় এবার অপারেশন করাতে হয়েছে। কাল ক্লিনিক থেকে বাসায় এসেছে। এখনও পুরো সারেনি। আমি কিছুই জানিনা। ইচ্ছে করে বলেনি। এই পাগল মেয়েটা কেন বোঝেনা যে বললেই বরং আমার টেনশন কিছুটা কম হয়। এখন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ইস্! যদি যেতে পারতাম! না জানি কত কষ্ট পেয়েছে বেচারা! নিশ্চয় অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকি। রাতে যখন ও ঘুমাবে, আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকব। সারারাত। আমি ভেবে রেখেছি, যখন আমরা সংসার করব, ওকে আমি তেমন কিছুই করতে দেবনা। রান্নাও না। আমি এখানে আসার পর কিছুদিন রেস্টুরেন্টে জব করেছি। আমার রান্নার হাত পাকা হয়ে গেছে তখনই।

এদেশে সবাই নিজের কাজ নিজে করে। সবাই সব কাজ পারে। কোন কাজকে এরা ছোট মনে করেনা। ছেলেদের বা মেয়েদের কাজ বলে কাজের মধ্যে বৈষম্য ও করেনা। এখানে সব কাজ সবার। ছুটির দিনে এরা পরিবারের সবাই মিলে বাড়ী-গাড়ী পরিস্কার করে, বাগানে কাজ করে ইত্যাদি। এদের যত টাকাই থাকুক, এরা নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করে। আবার ছুটির সময় এদেশের ছেলেমেয়েরা পার্ট টাইম জব করে নিজের শখ মেটানোর জন্য, তা সে যত বড়লোকের সন্তানই হোক। জব করার সুযোগও তো থাকা চাই। আমাদের দেশে এমন সুযোগ থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও নিশ্চয় বসে থাকতনা। আমি নিজেওতো দেশে থাকতে কোনদিন কিছু করিনি। এখানে এসে কতকিছু শিখলাম![/Align_Justify]

চলবে……………

আলপনা তালুকদার। ড. আকতার বানু আলপনা (আলপনা তালুকদার নামেই বেশি পরিচিত) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর (শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট) - এর একজন অধ্যাপক। তিনি এসএসসি-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে রাজশাহী বোর্ডে মানবিক বিভাগ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় অষ্টম...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ