মানিকজোড়

ফিরোজ আখতার
অণুগল্প
Bengali
মানিকজোড়

পলাশ আর রাজেশকে সকলে মানিকজোড় বলে ডাকে। দুজনেই ক্লাস টেনে উঠেছে এবার। একই স্কুলের একই সেকসানে পড়ে তারা। পলাশ গ্রামের ছেলে। নদীয়ার করিমপুরে বাড়ি। বাবা তার চাষি। কলকাতায় এক দূরসম্পর্কের পিসির বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে। পড়াশুনায় ভালো। কালো লিকলিকে চেহারা।

আর রাজেশ? সে শহরের ছেলে। বাবার একটা জেরক্স আর বইখাতার দোকান আছে পাড়ায়। পড়াশুনায় মাঝারি। দেখতে দারুণ। ফর্সা, টিকালো নাক আর সুঠাম চেহারা।

দুজনের মধ্যে এত অমিল থাকা সত্বেও লোকে তাদের মানিকজোড় বলে। কারণ আর কিছুই নয়, তারা দুজনেই দারুণ ফুটবল খেলে। শীতগ্রীষ্মবর্ষা প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির মাঠে তাদের দেখা যাবেই। আর হ্যাঁ, তাদের মধ্যে আরেকটি মিল আছে। দুজনেই মনে মনে একই মেয়েকে ভালবাসে…। আর সেটা জানে একমাত্র কাবেরী। ওদের কমন ফ্রেন্ড। একসঙ্গেই টিউশনি পড়ে ওরা। শ্যামলা হলেও মুখে একটা ফলফলে, আদুরে ভাব আছে কাবেরীর।

শর্বাণী ফিজিক্সে এম.এস.সি পাশ। ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত বেশ কিছু ছেলেমেয়ে নিয়মিত পড়তে আসে তার কাছে। তাদেরই মধ্যে পলাশ, রাজেশ আর কাবেরী অন্যতম। শর্বাণীকে দেখতে অনেকটা বাংলা সিনেমাজগতের শ্রাবন্তীর মত। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমাটা পড়লে তার আকর্ষণটা আরও বেড়ে যায়। আর হ্যাঁ, পলাশ আর রাজেশের স্বপ্নের রাজকন্যা সেই।

 

দুই.

প্রতিদিনের মত আজকেও সন্ধ্যা ঠিক ৬ টায় পড়তে এসেছে ওরা তিনজন। আজ একটা আগুনে বাসন্তী রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে শর্বাণী। রাজেশ আর পলাশ তো ম্যাডামের দিক থেকে চোখ সরাতেই পারছে না। উপপাদ্য দুটোই ভুল করেছে দুজনে। কপট রাগ দেখিয়ে শর্বাণী বলল,

আজকে তোদের কি হয়েছে? সোজা সোজা উপপাদ্য দিয়াছিলাম। সেটাও ভুল করেছিস!”

পাশ থেকে খুক খুক করে কেশে উঠল কাবেরী। একবার কটমট করে ওর দিকে তাকিয়েই মাথা নামিয়ে নিলো দুই মানিকজোড়।

-“কি হল? চিৎকার করছ কেন শর্বাণী?”, বলে সামনে এসে দাঁড়ালেন এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। দেখে ৩০৩২ বছর বয়স মনে হল। মাজামাজা রঙ। চওড়া মুখ, চোখে রিমলেস চশমা।

-“তোদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই! ইনি প্রফেসর অমিয় দাস। এতদিন শিলিগুড়িতে ছিলেন। ট্রান্সফার হয়ে কয়েকদিন হল কলকাতায় এসেছেন।

সামনে সপ্তাহেই আমরা বিয়ে করবো। ২৮ তারিখ, বুধবার। তোদের আসতে হবে অবশ্যই”।

হইহই করে উঠল কাবেরী। “বাঃ দারুণ খবর ম্যাডাম! আমরা অবশ্যই আসব।”

নিরবে মাথা নাড়ল দুজন। ঘটনার আকস্মিকতায় ও হঠাত পাওয়া দুঃসংবাদে দুজনেরই চোয়াল ঝুলে গেছে।

-“ম্যাডাম, আমরা আজ যাই…”, রুদ্ধ গলায় বলে উঠল পলাশ।

-“আচ্ছা, ঠিক আছে। তোরা এই কদিন আর আসিস না। একেবারে পরের মাসেই আসিস। বিয়ে হয়ে গেলেও এখনই শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি না আমি। আর শ্বশুরবাড়ি বলতেও তেমন কিছু নেই রে। শ্বশুরশাশুড়ীও নেই। ছোট থেকেই বাইরে বাইরে মানুষ ও। কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছে সম্প্রতি। যতদিন না ফ্ল্যাটটা ভালভাবে সাজানো হচ্ছে ততদিন অমিয় এখানেই থাকবে…”!

-“রিসেপশানের দিন দেখা হচ্ছে তাহলে…”। হাত নেড়ে ওদের বলে উঠলেন অমিয়বাবু।

 

তিন.

বাইরে বেরিয়ে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল রাজেশ কাবেরীর পিঠে। ‘উফফ’ করে চেঁচিয়ে উঠল কাবেরী।

-“বেঁড়ে পাকা কোথাকার!” মুখ ভেংচিয়ে বলে উঠল রাজেশ।

-“বুঝলি রাজেশ, আমাদের বড় হয়ে প্রফেসর হতেই হবে!”, স্বগতোক্তির মত ধীরে ধীরে বলল পলাশ।

-“ঠিক বলেছিস! না হলে আমাদের জীবনই বৃথা!”, সমর্থন করলো রাজেশ।

-“আহা রে! দেবদাস প্রফেসর …”, বলেই খি খি করে একচোট হেসে নিল কাবেরী।

-“চোখ দুটো কেমন কুতকুতে দেখেছিস? আর নাকটা কেমন বোঁচামত। ম্যাডাম কি করে পছন্দ করলো মাইরি লোকটাকে!”

-“ঘরজামাই থাকবে বোধহয়, বুঝলি!”

-“ঠিক বলেছিস!”, রাজেশ যেন মনে মনে একটু সান্তনা পেল।

পলাশের ঘর এসে গেলো। ‘বাই’ বলে বাড়িতে ঢুকে গেলো সে সুড়ুত করে। বাকি রাস্তাটা আর একটাও কথা বলল না রাজেশ কাবেরীর সাথে। কাবেরী অবশ্য দুএকবার কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু রাজেশ নিরুত্তরই থাকলো। বাড়ির সামনে এসে কাবেরী জিগ্যেস করলো, “বিয়েতে যাবি তো?” হ্যাঁনা কিছুই বলল না রাজেশ। শুধু একবার কাঁধটা ঝাকাল। রাজেশ বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে কয়েক মুহূর্ত ছলছল চোখে চেয়ে থাকল কাবেরী তার গমনপথের দিকে। বিড়বিড় করে একবার বলল, ‘তুই মনে হয় কোনদিনই আমার মনের কথা বুঝবি না রে…”।

লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো হঠাৎ কাবেরীর ভেতর থেকে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..