করাচিতে নজরুল
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
শুরুর কথা
‘নারীদিবস’ কিংবা ‘নারীবাদ’। বাংলার যুক্তিবাদী আন্দোলনে দশক তিনেক রগড়ে রগড়ে কিঞ্চিৎ রঙচটা, ঝানু এবং বিগতস্পৃহ হয়ে যাওয়া একজন ব্যক্তি হিসেবে এ নিয়ে কিছু বলতে হবে, অংশুমালী সম্পাদকের নির্দেশ। মানে, ওইরকম একজন লোক হিসেবেই বলতে হবে, সেটা অবশ্য সম্পাদক মহাশয় মুখ ফুটে বলেন নি। তবে কিনা, আখেরে মোদ্দা ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে সেই রকমই। তো চলুন, একটু ভাবা প্র্যাকটিস করি তবে।
একটি মান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন কোনও এক মানবগোষ্ঠীর নামে একটি ‘দিবস’ চালু করেছে এবং আমরা যখন তা নিয়ে কথাবার্তা বলছি, তার মানে নিশ্চয়ই এই যে, আমরা তাকে এবং তার ভাল থাকা-না-থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। তার সমস্যাকে বুঝতে চাইছি, তা নিয়ে চর্চা করতে চাইছি। তাহলে এখন প্রশ্ন, নারীর ভাল থাকা বা না থাকার চেহারা এবং কার্যকারণের নকশাটা কী রকম? নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া নারীবাদী তত্ত্ব ও আন্দোলনই বা এ ব্যাপারে কী বলে?
তাত্ত্বিক অবস্থান যা-ই হোক, নারীর ভাল থাকা-না-থাকার প্রশ্ন নিয়ে চর্চা শুরু হয় কয়েকটি মৌলিক সত্য থেকে, সেগুলো খানিকটা এই রকম। পৃথিবীতে নারীর সংখ্যা মোটামুটিভাবে পুরুষের সমান, অথচ সারা পৃথিবীর মোট ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে নারীর ভাগ অর্ধেক নয়, অনেক কম। উচ্চশিক্ষা, প্রশাসন, বিভিন্ন ধরনের মোটা আয়ের ও সম্মানজনক পেশা ও চাকরি-বাকরিতে মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে কম। সবচেয়ে নামজাদা বিজ্ঞানী, গবেষক, সাহিত্যিক, শিল্পী ইত্যাদিদের মধ্যে মহিলা খুবই কম (পার্ফর্মিং আর্ট বাদ দিলে)।
এইসব ‘গ্লোবাল’ সত্যের পাশাপাশি আছে কিছু মর্মান্তিক ‘লোকাল’ সত্য। যেমন, বিভিন্ন দেশে ঘটে চলা অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা, নারী ভ্রূণ ও শিশু হত্যা, আমাদের দেশে পণের জন্য গৃহবধূর অত্যাচারিত ও খুন হয়ে যাওয়া। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব সমস্যা নিয়ে চিন্তা ও লড়াই কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছল, সেটা এখন একটু পেছন ফিরে দেখে নেওয়া যাক, অতি সংক্ষেপে যদিও।
নারী আন্দোলন ফিরে দেখা
প্রাচীন ও মধ্যযুগের পৃথিবী আম মানুষের ব্যক্তি-অধিকার রক্ষার পক্ষে খুব অনুকূল ছিল না, ব্যক্তি-নারীর অধিকারের পক্ষে তো নয়ই। তবু, প্রায় সবযুগেই হাতে গোনা দুই একজন মহিলার সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা চিন্তা ও কর্মে ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। সেসব দৃষ্টান্ত চমকপ্রদ হলেও, তাতে সমাজে নারীর অবস্থানের মোদ্দা তফাত কিছু হয়নি। এই সংক্ষিপ্ত চর্চায় তাই সেসব খুঁটিনাটির দিকে না তাকিয়ে সরাসরি চলে আসব উনিশ শতকে, যখন নারী অধিকারের পক্ষে বড় আকারে শুরু হয়েছে এক স্পষ্ট ও দৃষ্টিগ্রাহ্য সক্রিয়তা, এবং তা আলোড়িত করছে গোটা সমাজকে। পটভূমি, বলা বাহুল্য, পশ্চিম- নির্দিষ্ট করে বললে ইউরোপ ও আমেরিকা। তারপর থেকে এ সক্রিয়তা থেকেছে ধারাবাহিক, কিন্তু অতিক্রম করেছে একেকটি দশা বা পর্যায়। ধারাবিবরণীকারদের মতে, এরকম পর্যায় দেখা গেছে মূলত তিনটি। প্রথম দশাটির কাল-বিস্তৃতি উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত, দ্বিতীয়টির বিশ শতকের মাঝ থেকে পরবর্তী প্রায় তিনটি দশক, এবং তৃতীয়টি তার পরেরটুকু, আজ পর্যন্ত।
প্রথম পর্যায়ের নারী-অধিকারের প্রবক্তাদের লক্ষ্যটা ছিল, একেবারে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবার অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে, বৃহত্তর নাগরিক জীবনের আঙিনায় এসে দাঁড়াবার প্রথম পদক্ষেপগুলো করা। ফলত, তাঁদের দাবিগুলো ছিল পছন্দমত জীবনসঙ্গী বেছে নেবার অধিকার, নির্বাচনে ভোট দিতে পারার অধিকার, নিজের নামে জমি-বাড়ি-সম্পত্তি রাখার অধিকার, এইসব। যাঁরা এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, লুক্রেশিয়া মট, সোজোর্নার ট্রুথ, এমেলাইন প্যাঙ্কহার্স্ট, এমা গোল্ডম্যান। তবে, নিজেদের আন্দোলনকে ‘নারীবাদী’ বলে চিহ্নিত করার কাজটি তাঁরা নিজেরা করেন নি। সেটা করেছিলেন দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদীরা, প্রথম পর্যায়ের ধারাবাহিকতায় নিজেদেরকে দেখাবার জন্য যেমন, তেমনি তা থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশের জন্যও বটে। এই সময়কালটির অব্যবহিত আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতালাভের সুযোগ নিয়ে আসে ইউরোপ ও আমেরিকার মেয়েদের কাছে। যুদ্ধের সময়ে ছেলেরা দলে দলে যুদ্ধে চলে যাওয়ায় মেয়েদের জন্য প্রচুর চাকরি খালি হল। সেসব চাকরিতে যোগ দিয়ে মেয়েরা বুঝল, রান্নাঘরের ঠুংঠাং, বাচ্চার ভিজে কাঁথা বদলানো আর স্বামীর কাছে হাতখরচার জন্য হা-পিত্যেশ করার চেয়ে এই নতুন ভূমিকাটি মোটেই এমন কিছু খারাপ নয়। কিন্তু যুদ্ধের পর যুদ্ধফেরত ছেলেরা যেই এসে আবার জাঁকিয়ে বসল চাকরি-বাকরিতে, তখনই মেয়েরা ফের কর্মচ্যুত হয়ে ফিরতে শুরু করল গৃহকোণে। এই নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে এবং পূর্ববর্তী নারীবাদীদের থেকে এক পা এগিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদীরা দাবি করলেন, বৃহত্তর নাগরিক জীবনের আঙিনায় শুধু পা রাখা নয়, পুরোপুরি সমান পরিসরেরও। দাবি করলেন জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতের অধিকার, সমস্ত রকম চাকরিতে প্রবেশের অধিকার, কর্মস্থলে পুরুষের সমান বেতন পাবার অধিকার, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার না হওয়ার অধিকার, এবং স্বামীর সাথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনসংসর্গ না করার অধিকারও। এবং শুধুই দাবি করা নয়, এইসব দাবি তাঁরা বাস্তবেও আদায় করে ছাড়লেন আইনিভাবে। এই পর্যায়ের কয়েকটি অতি পরিচিত সামনের সারির নাম বেটি ফ্রিডান, জার্মেন গ্রিয়ার, গ্লোরিয়া স্টেইনেম।
এভাবে নারী-পুরুষের পূর্ণ সমানাধিকারের দাবিটি যখন অন্তত ধারণাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হল (অনেকখানি বাস্তবেও, অন্তত উন্নত পশ্চিমে), তখন তৃতীয় পর্যায়ের নারীবাদীরা নজর দিতে চাইলেন তাত্ত্বিক গভীরতা ও ভিন্ন কণ্ঠস্বরের প্রতি। ইতোমধ্যে নারী আন্দোলনের ঢেউ ভালভাবেই এসে পড়েছে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায়। অভিযোগ উঠেছে, পূর্ববর্তী নারীবাদীরা নারী-অধিকার বলতে শুধুই বোঝেন উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোর শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের সুযোগ সুবিধের কথা, তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের সমস্যা মোটেই তাঁদেরকে স্পর্শ করে না। যেমন, পশ্চিমী নারীবাদীরা অত্যন্ত সোচ্চার তৃতীয় বিশ্বের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে (বিশেষত আফ্রিকায়) চালু ধর্মীয় রীতি ‘ফিমেল জেনিটাল ম্যুটিলেশন’ নিয়ে, যাতে অল্পবয়সী মেয়েদের যোনিতে ধারালো হাতিয়ার দিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু আফ্রিকার নারীবাদীরা বললেন, ওটা তত বড় সমস্যা নয়, আসল সমস্যা হল তাঁদের দেশে পশ্চিমী শ্বেতাঙ্গদের দখলদারি, সেটা ঘটবার আগে ও দেশের মেয়েরা বরং আরেকটু ভালই ছিল। ভিন্নতা শুধু যে সাদা আর কালো চামড়াকে ঘিরেই, বা উন্নত ও তৃতীয় বিশ্বকে ঘিরেই, এমনটা নয় আদৌ। সেটা টের পাওয়া যায় শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীদের ভেতরে পর্নোগ্রাফির পক্ষে ও বিপক্ষে তীব্র বাদানুবাদের দিকে নজর করলে। একপক্ষ বলছেন পর্নো হল মেয়েদেরকে অপমান করার পুরুষতান্ত্রিক চক্রান্ত, আর অপরপক্ষ বলছেন এ হল আদতে মূলস্রোতের পুরুষতান্ত্রিক যৌন নৈতিকতা থেকে মুক্তির বার্তা।
বলা বাহুল্য, এসব দাবি ও পাল্টা দাবির সত্যমিথ্যে যাচাই করা এ ক্ষুদ্র লেখার উদ্দেশ্য নয়, এখানে উদ্দেশ্যটা হল তৃতীয় পর্যায়ের নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যে পরস্পরবিরোধী কণ্ঠ-সমাবেশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন এর তাত্ত্বিক মেজাজ ও প্রবণতার দিকেও, যাবতীয় আন্তরিকতা সত্ত্বেও যার মোদ্দা স্বরূপটি কিঞ্চিৎ বিচিত্র। এইরকম চর্চার মধ্য দিয়েই নারীবাদী তত্ত্বের ভাঁড়ারঘরে ঢুকেছে ‘ইন্টারসেকশনালিটি’-র মত শব্দ ও ধারণা। মেয়ে হওয়ার সমস্যা কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার সমস্যা বা অ-মূলস্রোতের প্রান্তিক সমাজে জন্মানোর সমস্যার সাথে মিলে আরও কঠিন ও জটিল আকার ধারণ করে, সেই প্রক্রিয়া ও পরিস্থিতিরই নাম ‘ইন্টারসেকশনালিটি’।
কিন্তু আবার, তৃতীয় পর্যায়ের এই নারীবাদী চর্চাই নারী-সমস্যার মূল খুঁজতে ঢুকে পড়েছে দর্শনশাস্ত্রের জটিল ও কূট গোলকধাঁধায়। আগের দুই পর্যায়ের নারীবাদীরা এই সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই দাবি করেছেন ক্রমশ আরও আরও অধিকার। আর তাঁদের উত্তরসূরীরা ভেবে দেখতে চাইলেন, এই ব্যবস্থাটিই একেবারে ভেতর থেকে নারী-বিরোধী কীনা, এবং ফলত এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সমানাধিকার চাওয়াটা বুনো হাঁসের পেছনে ছোটার মত ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে কীনা। সেইমত, সমাজ-রাষ্ট্র-ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে তাঁরা খুঁজতে লাগলেন লুকিয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক নকশা। না, তাঁদের কাছে ছাড় পায়নি বিজ্ঞান এবং যুক্তিও।
মনের নানা অভ্যেস এবং সংস্কার সরিয়ে রেখে যুক্তির সতর্ক ছাঁকনিতে ছেঁকে তবেই নিষ্কাশিত হয় খাঁটি বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু নারীবাদীরা প্রশ্ন তুললেন, বিজ্ঞান-যুক্তি-বস্তুনিষ্ঠা জাতীয় ব্যাপারগুলোই স্বয়ং নারী-বিরোধী কীনা। সে নিয়ে দুয়েক কথা আমি এখন বলতে চাইব, কিন্তু তার আগে শেষ একটি কথা বলে নিয়ে এই ইতিহাস-পর্বের সমাপ্তি ঘটাব। কথাটা হচ্ছে, নারীবাদের প্রতিটা পর্যায়েই ছিল বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনগুলোর ছাপ। যেমন, প্রথম পর্যায়ের প্রেক্ষাপটে ছিল উদারনৈতিক আধুনিকতাবাদী আন্দোলন (এবং শেষের দিকে সাম্যবাদ), দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদের প্রেক্ষাপটে ছিল নাগরিক অধিকার ও নয়াবাম আন্দোলন, এবং তৃতীয় পর্যায়ের নারীবাদী চিন্তা ও কর্ম জারিত হয়েছে পরিবেশ আন্দোলন এবং পৃথিবীব্যাপী প্রান্তিক মানুষের (কখনও মূলস্রোতেরও) গোষ্ঠী-পরিচিতিভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনে।
নারীবাদ, বিজ্ঞান ও যুক্তি
নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞান ও যুক্তির যে সমালোচনা, যা বিগত শতকের শেষ দিকে (মূলত আট ও নয়ের দশকে) যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তা বিজ্ঞানের দর্শন-সমাজতত্ত্ব-ইতিহাস চর্চার জগতে পরিচিত হয়েছিল ‘ফেমিনিস্ট ফিলোজফি অফ সায়েন্স’ নামে। এই বিষয়ক চর্চার মুখ্য প্রবক্তারা, যেমন ইভলিন ফক্স-কেলার, স্যান্ড্রা হার্ডিং, ডোনা হারাওয়ে, হেলেন লনজিনো বা ভারতীয় পরিবেশ-চিন্তক বন্দনা শিব প্রমুখ ব্যক্তিরা নানাভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁদের কথাগুলো এক জায়গায় করে কিছু ঝাড়াই বাছাই করে নিলে কয়েকটি মোদ্দা বক্তব্য বেরিয়ে আসে। সেগুলো অনেকটা এইরকম। এই যে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের জন্য আমরা নিরাবেগ নিরপেক্ষ নিষ্পৃহ মননের কথা বলি, যাতে খাঁটি বস্তুগত সত্য আমাদের কুসংস্কার ও একপেশেমিতে কলুষিত না হয়ে পড়ে – এ আসলে এক পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ, আবেগ-অনুভূতিকে মেয়েলি জিনিস বলে দাগিয়ে দিয়ে জ্ঞানের জগত থেকে মেয়েদেরকে বিচ্ছিন্ন করবার চক্রান্ত। বৈজ্ঞানিক সত্যকে সার্বজনীন সত্য বলে দাবি করা হয়, কিন্তু আসলে তা পশ্চিমী শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের এক দখলদারি সংস্কৃতি মাত্র, যার উদ্দেশ্য অন্যদের জ্ঞানকে কুসংস্কারের ছাপ্পা দিয়ে নস্যাৎ করা। আধুনিক বিজ্ঞানের উত্থান এবং সারা পৃথিবীকে ইউরোপের কলোনিতে পরিণত করা – এ দুটো প্রক্রিয়ার শুরু প্রায় একই সময়ে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের যে দেকার্তীয় পদ্ধতি, অর্থাৎ বিরাট ও জটিল জিনিসকে ছোট ছোট সরল অংশে ভাগ করে নিয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা, এ হল আসলে পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষকামিতার লক্ষণ, যার প্রকাশ ঘটে প্রকৃতিকে ছিঁড়েখুঁড়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রকৃতিকে ধর্ষণ করে আধুনিক কলকারখানা চালানোর মধ্যে। অন্য সব বিজ্ঞানকে যে আমরা জড়বিজ্ঞানের (মূলত পদার্থবিজ্ঞানের) ছাঁচে ঢালবার চেষ্টা করি, সেও নাকি এইরকম নিষ্ঠুর পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তিরই ফসল।
বিজ্ঞানের এরকম একটি চিত্র হাজির করলে তা দিয়ে বিজ্ঞানে নারীর অ-যথেষ্ট অংশগ্রহণের এক অতি সহজ ও উত্তেজক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, এবং একইসঙ্গে নারী-অধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণের পক্ষেও জোরাল অবস্থান নেওয়া যায়, তা ঠিক। তবে, এর সমস্যার দিকটা হল, শুধুমাত্র ওই ক’টা সুবিধের জন্য বোধহয় কোনও তত্ত্বকে ‘সত্যি’ বলে দাবি করা যায় না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দীর্ঘকালীন ও সন্দেহাতীত সাফল্যের সামনে দাঁড়িয়ে এরকম তত্ত্বায়নকে শুধু অবাস্তব ও অবান্তর বলেই প্রতীয়মান হয় না, সেইসঙ্গে এর মধ্যে কিঞ্চিৎ কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ততা আছে বলেও যেন সন্দেহ হয় (আন্দোলনের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত লেখালিখির ক্ষেত্রে যা খুব অসম্ভব নয়)। তার ওপর এসে জোটে এই প্রশ্ন যে, বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ধারণাই যদি অপাংক্তেয় হয়ে যায়, তবে নারীবাদী তত্ত্বের নিজের সত্যাসত্যের দশাটাই বা কেমন দাঁড়াবে?
আর, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তাটা বোধহয় এই রকম দাঁড়ায় যে, অবিশ্লেষণী আবেগ-অনুভূতিসর্বস্ব ‘মেয়েলিপনা’-র যে স্টিরিওটাইপকে অস্বীকার করে প্রথম দুই পর্যায়ের নারীবাদ প্রবল বেগে দাবি করেছিল ছেলেদের সমান হয়ে ওঠার অধিকার, পুরুষতন্ত্রের অতিসূক্ষ্ম উন্মোচনের নাম করে সেই ‘মেয়েলিপনা’-রই মাহাত্ম্যকীর্তন গেয়ে নারীবাদী বিজ্ঞান-দর্শন আবার তা থেকে পেছন দিকে মুখ ঘোরাতে চাইছে না তো? এ আশঙ্কাও এসেছে নারীবাদের ভেতর থেকেই। এ রকম অযৌক্তিক ও বিজ্ঞান-বিরোধী প্রবণতাকে সমালোচনায় ছিন্নভিন্ন করেছেন মীরা নন্দ ও অন্যান্য নারীবাদী লেখকেরা।
শেষের কথা
বলা বাহুল্য, সমগ্র মানবেতিহাস জুড়ে সমাজ ও জ্ঞানের মুক্তি এবং ব্যক্তি-মানুষের অধিকারের ধারণার যে উদ্ভব ও বিকাশ, নারীবাদ তারই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফলত, বিজ্ঞান আর যুক্তি তার অপরিহার্য উপাদান। নারী কোথায় ছিল, এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, এবং কোথায়ই বা তাকে গিয়ে পৌঁছতে হবে – এ ব্যাপারে দৃঢ় বস্তুনিষ্ঠই উপলব্ধি ছাড়া এগোনো অসম্ভব, আর সে উপলব্ধি আসতে পারে শুধু বিজ্ঞান আর যুক্তির হাত ধরেই। তাই, কবি জীবনানন্দের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে নারীও নিশ্চয়ই বলবে, “জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই”!
করাচি বন্দরে এককালে গ্রিক-পারসিক-আরবীয় সওদাগরেরা নোঙ্গর করেছে; অনেক স্থাপত্য চিহ্ন আজো রয়ে গেছে; যা…..
তিনি বললেন, ভাষা হল ওষ্ঠের উপর সুধার মতো। আর বললেন, কবিতা যথেষ্ট স্বাদু, কিন্তু…..
রূপকথা পড়েছেন ছোট বেলায় অনেকে একথা আর বলা সন্দেহমুলক, প্রযুক্তির ব্যবহার জন্মের পর থেকে এখন …..
একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..