ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা পথটুকু ভীষণ বিরক্তির। আমার বাবার বন্ধু সোম কাকুর বাড়ি সেই পথের ধারেই। বাড়ির সামনে বাঁশের মাঁচায় সোম কাকুর ভাইয়ের ছেলে চিন্টু বসে থাকে রোজ দু’জন চ্যালামুন্ডা নিয়ে। ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময় রোজ রোজ আওয়াজ দেয় চিন্টু “লাভ ইউ ইরা” “লাভ ইউ ইরা” বলে। আর ওর চ্যালা দু’জন সুর তোলে “ওয়ে…..ওয়ে……ওয়ে…..ওয়ে….।”
বাবাকে সে কথা বলতেই বাবা বললেন,
“কে কি বলল তা শোনার জন্য ভার্সিটিতে পাঠাইনি আমি তোমাকে। তুমি কি করবে সেটা বোঝার জন্য পাঠিয়েছি।”
আহ্! জ্বালা তো। একে তো চিন্টুকে আমার অসহ্য লাগে তার উপর বাবার এমন উদাসীন আচরণ আমার আরও অসহ্য লাগল। কিন্তু বাবা তো এমন ছিলেন না। কৈশোরে কেউ আমাকে কোন বাজে আওয়াজ দিলে তার খবর করতেন বাবা। অথচ এখন! কেন এমন?
এসব ভেবে ভেবেই সকালে আমি মনে মনে ভীষণ রাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলাম।
বাঁশের মাঁচার কাছে এসে অবাক হলাম। আজ চিন্টু একা! উদোম গা, লুঙ্গি পরণে। ব্রাশ করছে দাঁতে। আমি চিন্টুকে ছাড়িয়ে বাঁশের মাঁচা পার হয়ে গেলাম কিন্তু কোন আওয়াজ নেই। আশ্চর্য! কেন জানি পিছিয়ে এলাম আবার। বাঁশের মাঁচায় চিন্টুর পাশে বসলাম।
চিন্টু তো অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
বলল,
“কি হল তুমি কেন বসলে?”
আমি বললাম,
“আচ্ছা আমাকে যদি এতই “লাভ” কর তাহলে চ্যালামুন্ডা নিয়ে আওয়াজ দাও কেন? শুনতে বাজে লাগে।”
চিন্টু দাঁত কেলিয়ে বলল,
“ভালো লাগে যে।”
ততক্ষণে আমার চোখ চলে গেছে বাঁশের মাঁচার ফাঁক গলে নীচে। সেখানে শুয়ে আছে চিকন একটা কাঁটা যুক্ত মান্দার গাছের ডাল। মাথায় কিছু একটা খেলে গেল। মাঁচা থেকে নেমে পড়লাম।
চিন্টু বলল,
“চলে যাও কেন সুন্দরী?”
আমি তড়িৎ মান্দার গাছের চিকন ডাল তুলে সপাসপ চিন্টুর উদোম গায়ে ঘাঁ বসাতে থাকলাম। চিন্টু চিৎকার করে উঠল—
“কি করছ—- কি করছ”— বলে।
আমিও চিৎকার করি,
“হারামজাদা, আজ তোর একদিন কি আমার দশ-বারো-চৌদ্দ দিন।”
চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সোম কাকু বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। এসেই চিন্টুর ঝুঁটি বাঁধা চুল ধরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে?”
আমি হাঁফাতে হাঁফাতে কাকুকে বলি যে,
“চিন্টু রোজ রোজ আমাকে বিরক্ত করে।”
কাকু আমার হাত থেকে মান্দার গাছের ডাল নিয়ে বললেন,
“তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও। ওকে আমি দেখছি।”
আমি চলে গেলাম ভার্সিটিতে। ক্লাশ শেষে ইচ্ছে করেই দুপুর বেলা বাড়ি ফিরলাম না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পার করে বাড়ি আসতেই দেখি পথের উপর বাবা পায়চারি করছেন। ভীষণ অস্থির বাবার চাহনি। ভয়ে আমারও যেন জ্বর এল।
ভাবলাম,
“আজ আর আমার পিঠ বাঁচানোর কোন উপায় নেই। তবে যা হোক হবে। চিন্টুকে তো মেরেছি।”
কিন্তু কি আশ্চর্য! বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। নিরবেই আমার সাথে হাঁটা জুড়লেন। বাড়িতে এসে বললেন,
“হাত দেখি।”
আমি হাত বের করে দেখালাম। বাবা বললেন,
“স্যাভলন দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিও আর একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিও।”
আমি ভাবলাম, বাবা এসব কেন বলছেন? কিন্তু হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে বেশ ক্ষত। মান্দার গাছের ডাল দিয়ে ঝোঁকের বশে মেরেছিলাম চিন্টুকে। আমার হাতেও সে গাছের কাঁটা ফুটে রক্ত ঝরেছে। কিন্তু সারাদিন আমার তা খেয়ালেই আসেনি। আসলে আমি যে চিন্টুকে মেরেছি সেটাই ভেবেছি সারাদিন। আমি বাথরুমের দিকে যেতেই বাবা বললেন,
“আজকাল সাহস খুব বেড়েছে দেখছি। মান্দার গাছের ডাল দিয়ে একে ওকে মারা হচ্ছে। তা মারামারিই যখন করবে তখন কারাতে শিখছ না কেন?”
চমকে উঠলাম আমি।
“কারাতে?”
কি বললেন বাবা? ঠিক শুনলাম তো? তার মানে? থাক বরং মানে টানে। বরং একটু হেসে নিই মনে মনে।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
অতঃপর আমার জায়গা হল এই লাশকাটা ঘরের এক ফালি এক স্ট্রেচারে। হঠাৎ ডাক্তারের বিকট চিৎকার।…..