ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
মালঞ্চার পথে
ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ করে একটি পাবলিক বাস দাঁড়িয়ে। বৈশালী হনহন করে হাঁটতে লাগল। কাঁধে সাইড-ব্যাগ। প্রতিদিনের মতো মাধবী বৌদি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিল। রাস্তার মধ্যে বৈশালীর সাথে দেখা। মাধবী বৌদি দাঁড়িয়ে পড়ল। বৈশালীও দাঁড়িয়ে গেল। মাধবী বৌদি জিজ্ঞেস করল,” কি রে বৈশালী,খুবই সুন্দর ভাবে সেজেগুঁজে একা-একা এত সকালে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস বুঝি? প্রেমিকের সাথে দেখা করার সময় দেওয়া আছে বুঝি?” বৈশালী বিরক্তি সহকারে উত্তর দিল,”কি যা তা বলো না বৌদি । ওসব কিছুই না। আমি বালুরঘাটের মালঞ্চা দত্তক-গ্রামে ঘুরতে যাচ্ছি। আমি দত্তক-গ্রাম দেখিনি। তাই দত্তক-গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছি।” বৈশালী তার কথাতে অসন্তুষ্ট হয়েছে বুঝতে পেরে মাধবী বৌদি আর কথা বাড়াল না। বলল,”ঠিক আছে যা।” মাধবী বৌদি প্রাতঃভ্রমণে চলতে লাগল। বৈশালী বাস ধরার জন্য আবার জোরে-জোরে হাঁটতে লাগল। বৈশালী কাছে গিয়ে দেখল,বাসটির নাম ‘শুভেচ্ছা’। বাসের সামনে গিয়ে দেখল,বাসের সামনের কাঁচে ‘বালুরঘাট’ লেখা বোর্ড লাগানো। চালকের আসনে চালক বসেছিল। বৈশালী দেরি না করে দ্রুত বাসে উঠে জানলার ধারে একটি ফাঁকা আসনে বসে পড়ল।
রাত থাকতে বৈশালী ঘুম থেকে উঠে মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে বেশ করে স্নান করে নিয়েছিল। হেয়ার-ড্রায়ার দিয়ে চুল ভাল মতো শুকিয়ে নিয়েছিল। লম্বা কোমর অবধি চুল। সামনের দিকে বাদামি-রং করা। চুলগুলো ক্লিপ লাগিয়ে ভালভাবে লাগিয়ে নিয়েছিল। হাত আর পায়ের আঙুলে মনোযোগ দিয়ে নেল-পালিশ পরেছিল। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক,চোখে কাজল দিয়েছিল। সাদা রঙের চুড়িদারের সাথে হলুদ রঙের ওড়না পরেছিল। একটি ফ্লোল্ডিং ছাতা বের করে আবার ছাতাটি রেখে দিয়েছিল। বৈশালী রোদে তার শরীর ভেজাতে চায়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে রোদে গগলস পরা উচিত জেনেও বৈশালী সঙ্গে গগলস নেয়নি। কারণ,বৈশালী মনে করে,গগলস পরে কোনও কিছুর প্রকৃত রূপ জানা যায় না,গগলস চোখে আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। বৈশালী কপালে একটি বড় আকারের খয়েরি রঙের টিপের ওপর একটি ছোট আকারের নীল-টিপ পরেছিল। খুব….খুব সুন্দর লাগছিল বৈশালীকে।
ড্রাইভার বাসে স্টার্ট দিল। বাস চলতে শুরু করল। পিচের পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে বাসটি চলতে লাগল। বৈশালী বালুরঘাটের বাস ভাড়া কাটল। মালঞ্চায় যেতে হলে বুনিয়াদপুর থেকে প্রথমে বালুরঘাট পৌঁছতে হবে। তারপর বাস কিংবা অটো অথবা টোটো ধরে মালঞ্চা। সকালের দিকে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। পাকা রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে ‘শুভেচ্ছা’ বাসটি বৈশালীকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল। জানলা খোলা ছিল। উন্মুক্ত জানলা দিয়ে ঢোকা ঠান্ডা হাওয়া বৈশালীর শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। বৈশালী আসনের পেছনের দিকে আরাম করে হেলান দিল। বৈশালী ভাবতে লাগল,পাকা রাস্তা হোক আর মাটির রাস্তা হোক,সব ধরণের রাস্তার প্রধান কাজ হল পথচারিকে তার গন্তব্যের জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। মসৃণ রাস্তা হোক, এবড়োখেবড়ো রাস্তা হোক কিংবা কাদা-ভরা-রাস্তা হোক, সকল রাস্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল পথিককে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া।
বৈশালীর মনে পড়ল,প্রথম রাস্তার উৎপত্তি হয়েছিল জীবজন্তুর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। তবে এই কথা সর্বস্বীকৃত নয়। কেননা,অনেক ক্ষেত্রে জীব-জন্তু সুনির্দিষ্ট পথ ব্যবহার করে না। কিন্তু কিছু রাস্তার উৎপত্তি ঘটেছিল প্রাণীদের পথ-চলা থেকে।
তার উদাহরণ হল ‘আইনিল্ড ওয়ে’। ওই রাস্তায় মানুষ এবং প্রাণী উভয়ে চলাচল করত। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দশ হাজার বছর আগে মাটির কাচা-রাস্তার উদ্ভব হয়েছিল। মিশরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ পাকা রাস্তা নির্মিত হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ‘উর’ শহরে পাথর সহযোগে নির্মিত পাকা রাজপথের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষে ইটের তৈরি রাস্তা ছিল। প্রথম দারিয়াস ‘রয়েল রোড’ নামে পারস্যে ব্যয়বহুল রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যে সোজা, মজবুত পাথর দিয়ে রোমান রোড তৈরি হয়েছিল। আরব সাম্রাজ্যে ইরাকের বাগদাদে
খলিফারা আলকাতরা ব্যবহার করে পাকা রাস্তা বানিয়েছিল। আমেরিকা ডেনমার্ক,জাপান,দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান,তাইওয়ান,চীন, নেদারল্যান্ডস, ইন্দোনেশিয়াতে এমন কিছু পাকা রাস্তা রয়েছে,যে-রাস্তা ধরে একটি নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি চালিয়ে গেলে সুরেলা ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। রাস্তাগুলো এমন ভাবে তৈরি করা যে,রাস্তার সঙ্গে গাড়ির চাকার ঘর্ষণে সুরেলা আওয়াজের সৃষ্টি হয়। এদের সংগীত-মুখর-রাস্তা বা গান-গাওয়া-রাস্তা বলে। এই সমস্ত গান-গাওয়া রাস্তা গান করলেও,সঙ্গীত পরিবেশন করলেও কাজে কোনওরূপ গাফিলতি না করে তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে মানুষকে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়।
বাস বালুরঘাট বাসস্ট্যান্ডের ভেতর প্রবেশ করে থেমে গেল। বালুরঘাট এসে গেছে। বৈশালী বাস থেকে নেমে পড়ল। কিছুটা দূরে টোটো দাঁড়িয়ে ছিল। বৈশালী টোটোওয়ালাকে বলল,” দাদা,মালঞ্চা দত্তক-গ্রামে যাবে?”টোটোওয়ালা বলল,”হ্যাঁ,যাব।” বৈশালী টোটোতে উঠে বসল। টোটো চলতে লাগল মালঞ্চার উদ্দেশ্যে। বালুরঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে হিলি যাওয়ার রাস্তা ধরে মালঞ্চা গ্রাম প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। পাকা রাস্তা ধরে এগোতে লাগল টোটো। ফাঁকা রাস্তা। অল্প সময়ের মধ্যে মালঞ্চায় পৌঁছে গেল টোটোটি। বৈশালীর চোখে পড়ল,একটি সাইনবোর্ডে বড়-বড় হরফে লেখা ‘মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম’। ভাড়া মিটিয়ে টোটো থেকে নেমে মালঞ্চার মাটিতে বৈশালী যখন প্রথম পা রাখল, বৈশালী তার হাত-ঘড়িতে দেখল, তখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বৈশালী মনে-মনে বলল,রাস্তা তার দায়িত্ব,তার কর্তব্য খুবই ভালভাবে পালন করেছে। কোনওরকম বাধা-বিঘ্ন ছাড়া,তাকে কোনওরূপ কষ্ট না দিয়ে রাস্তা তাকে তার গন্তব্যে সুন্দর ভাবে পৌঁছে দিয়েছে।
মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম। বালুরঘাট কলেজ থেকে পাঁচ বছরের জন্য মালঞ্চা গ্রামকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। তিন বছর হয়ে গেছে গ্রামটির দত্তক নেওয়া।বৈশালী নিশ্বাস টেনে বুক ভরে মালঞ্চা গ্রামটির বাতাস গ্রহণ করল। সাইড-ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়না বের করে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিল। বৈশালী চারদিকে দেখতে লাগল। গ্রামে পাকা-রাস্তা, কাঁচা রাস্তা দু,ধরণের রাস্তা রয়েছে। বৈশালীর চোখে পড়ল,গ্রামের মাঝখানে একটি কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। প্রচুর লাল-লাল-কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরতি কৃষ্ণচূড়া গাছটি। মনে হচ্ছিল,লাল ফুলে ভরতি কৃষ্ণচূড়া গাছটি নারীর কপালের লাল-সিঁদুর। চারপাশে সবুজ গাছপালা। সবুজে সবুজময় গ্রাম। গ্রামটির বেশ কিছু অংশ জুড়ে মাটির রং লাল। বৈশালীর মনে হল,গায়ে সবুজ শাড়ি পড়ে,পায়ে আলতা লাগিয়ে,কপালে লাল-সিঁদুর দিয়ে মালঞ্চা-গ্রামটি বিবাহিত গ্রাম্য-বধূ সেঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম দেখাতেই মালঞ্চা গ্রামের রূপে বৈশালী মুগ্ধ হয়ে গেল।
ঘর
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বৈশালী ভাল করে খেয়াল করল,গ্রামটির বেশির ভাগ গাছেই লাল,নীল,সবুজ,হলুদ,কমলা,আকাশি,বেগুনি বিভিন্ন রঙের ছোট-ছোট ঘর ঝুলছিল। নানা আকারের ঘর। বৈশালী এক দৃষ্টিতে গাছে-গাছে নানা রঙের,বিভিন্ন আকৃতির ঝুলে থাকা ঝুলন্ত-ঘর দেখতে লাগল। ঘর দেখতে দেখতে নিজেকে কিছুক্ষণ হারিয়ে ফেলল বৈশালী। এরপর বৈশালী আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগল আর গাছে লাগানো ঘর দেখতে লাগল। ঘর দেখে বৈশালীর প্রাণ ভরে গেল।
গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ মাসের প্রথম দিক। মাথার ওপর সূর্য। বৈশালী পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। দত্তক-গ্রামের-রোদ বৈশালীর গায়ে পড়তে লাগল। মালঞ্চার-রোদে বৈশালী রৌদ্দুর-স্নান করতে লাগল। মালঞ্চার-বাতাসে দেহ ভেজাতে লাগল। মালঞ্চার-আকাশের-রূপ উপভোগ করতে লাগল। বৈশালীর ছায়া পশ্চিম দিকে ক্রমশ লম্বা হতে লাগল। বৈশালী পায়ে হেঁটে গ্রামটি ঘুরতে লাগল। পাকা বাড়ি আধুনিকতার ও কাচা বাড়ি বৈশালীকে মাটির গন্ধ শোঁকাল। লাল-মাটির একটি কাচা রাস্তা গ্রামের মাথার সিঁথির-সিঁদুরের অনুভূতি জাগাল। গ্রামের এক দিকের কৃষি-জমি গ্রামের প্রাণকে উপভোগ করাল। মালঞ্চা-গ্রামের একটি দাতব্য চিকিৎসালয় একজন রূপবতী মেয়ের মনোমোহিনী রূপকে প্রত্যক্ষ করাল। একটি সুদৃশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি দোতলা উচ্চ-বিদ্যালয় একটি সুন্দরী নারীর অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশ করল। এরপর বৈশালী মালঞ্চা দত্তক-গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। রাস্তার মধ্যে বাঁশের চটা ও পাতা দিয়ে তৈরি মাথাল মাথায় এক বয়স্ক লোকের সাথে দেখা। বৈশালী লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,”কাকা,আপনার নাম কি?” লোকটি জানাল,”আমার নাম পঞ্চানন। আমি এই গ্রামের বাসিন্দা।” বৈশালী লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা পঞ্চানন কাকা,এই গ্রামে গাছে-গাছে ঘর ঝুলানো কেন?” পঞ্চানন কাকা বলল,”ম্যাডাম,গাছে টাঙানো ঘরগুলো হল পাখির-বাসা। পাখি পৃথিবীর বুকে এক মনোরম সৌন্দর্য। পাখির রং-বাহারে চোখ মুগ্ধ হয়,পাখির কলকাকলিতে প্রাণ জুড়িয়ে যায়,পাখির আকারে মন ভরে যায়,পাখির চলনে থাকে ছন্দ । পৃথিবীকে অপরূপা করে তোলা এই পাখি অনেক কষ্ট করে,বহু পরিশ্রম করে খড়কুটো,ডাল,লতাপাতা দিয়ে গাছের ডালে তাদের স্বপ্নের বাসা তৈরি করে। সেই ঘরে পাখি সপরিবারে বসবাস করে। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিতে তাদের সেই স্বপ্নের বাড়িগুলো প্রায়ই নষ্ট হয়ে যায়,ধ্বংস হয়ে যায়। পাখি প্রায়শ গৃহহীন হয়ে পড়ে,ঘরছাড়া হয়ে পড়ে। সেইজন্য পাখিদের বসবাস করার জন্য গাছে-গাছে মজবুত-বাড়ি, শক্ত-বাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে,যাতে তারা মন দিয়ে সংসার করতে পারে,আরামে ঘুমাতে পারে,সুখে স্বপ্ন দেখতে পারে।” পাখির ঝুলন্ত-বাসাগুলোর দিকে তাকিয়ে বৈশালী বলে উঠল,”সুন্দর! খুবই সুন্দর!”
বটগাছ
দূর থেকে বৈশালী দেখল, গ্রামের একপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা অনেক বড় বটগাছ রয়েছে। প্রচুর তার ঝুরি। ঝুরিগুলো মাটির মধ্যে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হচ্ছিল,বটগাছটি একজন বৃদ্ধ আর ঝুরিগুলো বৃদ্ধটির দাড়ি আর অসংখ্য দাড়ি নিয়ে গ্রামের মধ্যে প্রবীণ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বটগাছটিতে বেশ কিছু বিভিন্ন রঙের পাখির ঘর ঝুলছিল। বৈশালী ধীরে-ধীরে বটগাছটির কাছে গেল। দেখল,ইট-সিমেন্ট দিয়ে বটগাছটির গোঁড়াটি গোল করে ভাল মতো বাঁধানো। একটি লোক সেই বাঁধানো জায়গায় বসেছিল। বৈশালী লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,”দাদা,এই বটগাছটির বয়স কত হতে পারে?” লোকটি বৈশালীকে বলল,”ম্যাডাম,আমার নাম শম্ভুনাথ। এই বটগাছ বহু….বহূ ক্লান্ত পথিককে আশ্রয় দিয়েছে। অনেক …অনেক নব বিবাহিত বর-বউকে ছায়াদান করেছে। অজস্র স্বামী-স্ত্রীকে একসাথে বসার সম্মতি দিয়েছে। প্রচুর প্রেমিক-প্রেমিকাকে প্রেম করার অনুমতি দিয়েছে।” শম্ভুনাথ নামের লোকটি দম নিয়ে আবার বলল,”ম্যাডাম,আমি বাবা-ঠাকুরদার কাছে শুনেছি,এই বটগাছটির বয়স আনুমানিক চারশো বছরের মতো। গ্রামের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী এই বটগাছ। বটগাছটি আমাদের মালঞ্চা-গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন,সবচেয়ে বয়স্ক, সবচেয়ে প্রবীন। বটগাছটি আমাদের মালঞ্চা গ্রামের সম্মান। বটগাছটি আমাদের দত্তক-গ্রামের শ্রদ্ধা।” শম্ভুনাথ চলে গেল। বৈশালী বটগাছটির নিচে বসল। হাওয়া বইতে লাগল। বৈশালী বটগাছটির পাতার-বাতাস খেতে লাগল।
বৃষ্টির মধুরতা
আবার পথে মাথাল মাথায় দেওয়া পঞ্চানন কাকার সাথে বৈশালীর দেখা। পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল,”ম্যাডাম,আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” বৈশালী বলল,”আমার বাড়ি বুনিয়াদপুর। আমি কলেজে পড়ি। আমি মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম ঘুরতে এসেছি,আমি মালঞ্চা গ্রাম দেখতে এসেছি। সারাদিন আমি এই গ্রামে থাকব।” পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল,”ম্যাডাম,আপনি মালঞ্চা গ্রাম ঘুরতে এলেন কেন?” বৈশালী বলল,”দত্তক-গ্রামে থাকে অপরূপ রূপ,দত্তক-গ্রামে থাকে অতুলনীয় সৌন্দর্য। আমি দত্তক-গ্রামের মনোহারিনী রূপ,দত্তক গ্রামের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখার জন্য মালঞ্চা দত্তক-গ্রামে এসেছি।”
বৈশালীর ছায়া পশ্চিম দিকে ক্রমশ লম্বা হতে লাগল। বৈশালী গ্রামের ভেতর হাঁটছিল। মনে তার খুশি। চোখে-মুখে আনন্দ। বৈশালীর চোখে পড়ল, গ্রামের এক ধারে একটি বড় ট্যাঙ্ক বসানো। ট্যাঙ্ক থেকে পাইপ লাগিয়ে ট্যাঙ্কের নিচে কয়েকটি ট্যাপ লাগানো। শম্ভুনাথ তার বাড়ি রং করার জন্য গ্রামের একটি রঙের দোকান থেকে রং আনতে পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বৈশালী শম্ভুনাথকে জিজ্ঞেস করল,”শম্ভুনাথদা,এই ট্যাঙ্কটি কিসের জন্য?” শম্ভুনাথ বলল,”ম্যাডাম,এই বড় ট্যাঙ্কে আকাশের বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয়। এই জলাধারে রয়েছে ঝমঝম বৃষ্টি,রিমঝিম বৃষ্টি, ফিনফিনে বৃষ্টি,আয় বৃষ্টি ঝেঁপে,টাপুর-টুপুর বৃষ্টি।” বৈশালী আস্তে-আস্তে ট্যাঙ্কটির কাছে গেল। একটি ট্যাপের দিকে এগিয়ে গেল। বৈশালী ট্যাপটি চালাল। ঝরঝর করে ট্যাপ দিয়ে জল বের হতে লাগল। বৈশালী বৃষ্টির জল দিয়ে তার চোখ-মুখ বেশ ভাল করে ধুতে লাগল।
শম্ভুনাথ বৈশালীকে বলল,”ম্যাডাম,আপনার চোখে-মুখে রয়েছে রিমঝিম বৃষ্টি,ঝমঝম বৃষ্টি, ফিনফিনে বৃষ্টি, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’,’টাপুর টুপুর বৃষ্টি’।”
শম্ভুনাথ রং আনতে চলে গেল।
বৈশালী দেখতে পেল,অপর পাশে থাকা আর একটি ট্যাপে একজন সুদর্শন যুবক ছেলে ট্যাঙ্কের জলে দিয়ে তার চোখ-মুখ বেশ যত্ন করে ধুচ্ছিল। যুবক ছেলেটির পরনে ছিল নীল জিন্সের প্যান্ট ও বেগুনি রঙের জামা। ফর্সা,সুন্দর,লম্বা,সুঠাম চেহারা। বৈশালী যুবক ছেলেটি দেখতে লাগল। চোখ-মুখ ধোওয়া শেষ করে যুবক ছেলেটি মুখ তুলে তাকাল। চমকে গেল বৈশালী। দেখল,এ তো নির্ঝর। সঞ্চালক নির্ঝর। তার কলেজের নির্ঝর। বৈশালী তার চোখে-মুখে লাগানো ঝমঝম বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি, ফিনফিনে বৃষ্টি,আয় বৃষ্টি ঝেঁপে,টাপুর-টুপুর বৃষ্টি নিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রইল আর যুবক ছেলেটিও তার চোখে-মুখে লাগানো ফিনফিনে বৃষ্টি,রিমঝিম বৃষ্টি,ঝমঝম বৃষ্টি,আয় বৃষ্টি ঝেঁপে,টাপুর-টুপুর বৃষ্টি নিয়ে বৈশালীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একে-অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দু’জন।
বৈশালী ও নির্ঝরের কথা
বৈশালী খেয়াল করল, এত রোদ সত্ত্বেও নির্ঝরের মাথায় কোনও টুপি নেই। হাতে কোনও ছাতা নেই। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রোদে গরমের ঝাপটা চোখে এসে লাগে,চোখ জ্বালা করে। এজন্য বেশির লোক এই গ্রীষ্মকালে চোখে গগগস পরে। কিন্তু বৈশালী নির্ঝরের হাতে বা বুকপকেটে কোনও গগলস দেখতে পেল না। নির্ঝর বৈশালীকে দেখে দ্রুত জায়গা থেকে সরে যাচ্ছিল। বৈশালী বলে উঠল,”নির্ঝরদা দাঁড়াও, দাঁড়াও।” নির্ঝর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। শম্ভুনাথ রং নিয়ে ফিরে আসছিল। বৈশালী ও নির্ঝরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বৈশালী ধীরে-ধীরে নির্ঝরের দিকে এগোতে লাগল। নির্ঝর একইরকমভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। নির্ঝরের কাছে গিয়ে বৈশালীকে বলল,”নির্ঝরদা,আপনি কেন আমার পেছনে ঘুরঘুর করছেন? আপনি কেন আমাকে বিরক্ত করছেন? আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে ঘুরতে এসেছি। এখানে আমি নির্ঝঙ্ঝাট ভাবে, নিরুপদ্রবে সময় কাটাব। আপনি এত দূরে আমার পিছু নিয়েছেন। এটা কোন ধরণের অসভ্যতা? তাছাড়া আপনার সাহস তো কম নয়।” নির্ঝর বলল,”বৈশালী,আমি তোমার পিছু নিইনি। আমি মালঞ্চা দত্তক গ্রামে ঘুরতে এসেছি,মালঞ্চা-দত্তক-গ্রাম দেখতে এসেছি। আমি জানতাম না, তুমি এখানে আসবে। আমি আজ সকাল সাতটায় মালঞ্চা গ্রামে এসেছি। আজ সারা দিন এই গ্রামেই কাটাব।” শম্ভুনাথ বলল,”ম্যাডাম,দাদাবাবু একদম ঠিকই বলেছেন। সকাল সাতটা থেকে দাদাবাবু আমাদের গ্রামে রয়েছেন। আমাদের গ্রাম ঘুরে দেখছেন।” শম্ভুনাথ রং নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
বৈশালী বলল,”নির্ঝরদা, এই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জে রয়েছে বৃহৎ বটুক গ্রাম। যার বর্তমান নাম বটুন গ্রাম। অতীতে পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত ছিল এই গ্রাম। এই বটুন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিখ্যাত কবি সন্ধ্যাকর নন্দী। তিনি পাল আমলের রামপাল-এর সভাকবি ছিলেন। তিনি বটুন গ্রামে থেকেই ‘রামচরিত’ নামে বিখ্যাত বই লেখেছিলেন। তিনি নিজেকে ‘কলির বাল্মীকি’ বলতেন। ঐতিহাসিক দিক থেকে বটুন গ্রামটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বুনিয়াদপুর থেকে বটুন গ্রামের দূরত্ব আর মালঞ্চা গ্রামের দূরত্ব প্রায় এক। তুমি ঐতিহাসিক বটুন গ্রামে না গিয়ে এই মালঞ্চা গ্রামে এলে কেন?” নির্ঝর উত্তর দিল,”দত্তক’ কথাটির মধ্যে শোভা আছে, সুগন্ধ রয়েছে। আমি ‘দত্তক’ কথাটির শোভা আস্বাদন করতে দত্তক-গ্রামে এসেছি,দত্তক -কথার সুগন্ধ নিতে মালঞ্চা দত্তক-গ্রামে এসেছি।”
নবীন-বরণ
বৈশালী ও নির্ঝর একই কলেজে পড়ে। বৈশালীর মা-বাবা ও এক ভাই আছে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। মা গৃহকর্ত্রী। বাবার সোনার দোকান। নির্ঝরের বাড়িতে বাবা-মা আছে। এক দাদা ও বৌদি রয়েছে। বাবার বড় কাপড়ের দোকান আছে । বৈশালীর বাড়ি বুনিয়াদপুর । নির্ঝরের বাড়ি মালদা জেলার পান্ডুয়াতে। বুনিয়াদপুর কলেজ। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত নির্ঝর। প্রথম বর্ষে পড়ত বৈশালী। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছিল বৈশালী। খুবই সুন্দরী বৈশালী। ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। জিন্সের প্যান্ট,ওপরে টপ আর চোখে সানগ্লাস পরে কলেজে আসত। হাতে থাকত দামি মোবাইল।
কলেজে নবীন-বরণ অনুষ্ঠান হচ্ছিল। যে-সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী কলেজে নতুন ভরতি হয়েছিল,তাদের কলেজ থেকে বরণ করে নেওয়া হচ্ছিল। নবীন-বরণ অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিল নির্ঝর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে নির্ঝরের ভাল লাগত। বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেছিল। নির্ঝর লম্বা,ফর্সা,সুঠাম চেহারার যুবক। মাথার চুল বাদামি রং করা। ছাই রঙের জিন্সের প্যান্ট,সাদা রঙের টি-শার্ট। স্মার্ট। নির্ঝর সুন্দর ভাবে অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করছিল। অনুষ্ঠান মঞ্চের টেবিলের ওপর রাখা একটি ছোট বাক্স দেখিয়ে নির্ঝর মাইকে ঘোষণা করেছিল,”টেবিলের ওপর রাখা ছোট বাক্সটির ভেতর অনেকগুলো টুকরো কাগজে অভিনয়ের বিভিন্ন বিষয় লেখা রয়েছে। টুকরো কাগজগুলোকে হাত দিয়ে এলোমেলো করে দেওয়া হবে। একজন করে নবাগত ছাত্র -ছাত্রী মঞ্চের ওপর এসে বাক্সের মধ্যে হাত দিয়ে তার পছন্দ মতো একটি কাগজের টুকরো তুলবে। সেই কাগজের টুকরোটিতে যে-বিষয় লেখা থাকবে,সেই বিষয়ে তৎক্ষণাৎ মঞ্চের ওপর একক-অভিনয় করে দেখাতে হবে।” নবাগত ছাত্র -ছাত্রীরা একে-একে মঞ্চের ওপর গিয়েছিল। বাক্সের মধ্যে হাত দিয়ে কাগজের টুকরো তুলেছিল। কাগজে লেখা বিষয়ের ওপর যথাসাধ্য একক-অভিনয় করে আবার নিজের আসনে গিয়ে বসে পড়ছিল। অনুষ্ঠানটি দেখে নতুন ছাত্র-ছাত্রী সহ সকলে খুবই মজা পাচ্ছিল,ভীষণ আনন্দ উপভোগ করছিল। অনুষ্ঠান জমে উঠেছিল। বৈশালী মঞ্চের ওপর উঠে একটি কাগজের টুকরো তুলেছিল। কাগজে লেখা ছিল—‘প্রেমের প্রস্তাবে অরাজি এক মেয়ের সাথে রাস্তার মধ্যে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া ছেলের দেখা হলে মেয়েটির ভাবভঙ্গি কেমন হবে?’ বৈশালী মঞ্চের ওপর একক-অভিনয় শুরু করেছিল। বৈশালী দু’বার হেঁটে-হেঁটে মঞ্চের একদিক থেকে অপর দিকে গিয়েছিল। তারপর মঞ্চের মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর বৈশালী বড়-বড় চোখ করে তার সামনে দাঁড়ানো প্রেমপত্র দেওয়া অদৃশ্য ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে তার ফর্সা মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠেছিল। নাকটি ফুলে তুলেছিল। পাতলা লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছিল। তার শরীর ফুঁসছিল। এরপর তার সামনে দাঁড়ানো প্রেমের চিঠি দেওয়া অদৃশ্য ছেলেটিকে তর্জনী তুলে শাসিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল। হাততালি আর হাততালি। হাততালিতে ভরে গিয়েছিল চারপাশ। নির্ঝর মাইকে ধরে বলেছিল,”আমরা সকলে বৈশালীর অভিনয়ে খুবই মুগ্ধ। ধন্যবাদ জানাই বৈশালীকে তার সুন্দর পরিবেশনের জন্য। বৈশালী তার আসনে বসেছিল। নির্ঝর বৈশালীর কাছে গিয়ে বলেছিল,”বৈশালী,খুবই সুন্দর হয়েছে তোমার অভিনয়। অপুর্ব! অসাধারণ! অতুলনীয়!”
নবীন-বরণ অনুষ্ঠানের ক’দিন পরের ঘটনা। বৈশালী শ্যাম্পু কিনতে একা বাইরে গিয়েছিল। শ্যাম্পু কিনে বৈশালী বাড়ি আসছিল। নির্ঝর বৈশালীর কাছে এসে বৈশালীর হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে গিয়েছিল। নির্ঝর বৈশালীকে প্রেমপত্র দিয়েছিল। বৈশালীর কাছ থেকে প্রেমপত্রের কোনও উত্তর নির্ঝর পায়নি। তারপর পনেরো দিন হল কলেজে নির্ঝর যায়নি।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প হল মুখা-শিল্প বা মুখোশ শিল্প। কুশমন্ডীর মহিষবাথানে রয়েছে গ্রামীণ হস্তশিল্প সমবায় সমিতি। এই সমিতিতে মুখা-শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন রকমের মুখোশ তৈরি হয়। মুখোসগুলো বানানো হয় গামা গাছের কাঠ দিয়ে। তবে বাঁশের মুখোশও তৈরি হয়। সমিতি থেকে কাঠ দেওয়া হয়। শিল্পীরা সমিতিতে এসে মুখোশ বানায়। সমিতি-ই মুখোশ বিক্রির ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন দেবদেবী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতীর মুখোশ বানানো হয়। মহিষবাথানে প্রতি বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে মুখোশ-মেলা হয়। ঢাক,সানাই, ঘন্টা বাজতে থাকে আর মুখোশ পরে মানুষ খোলা মাঠে প্রচুর দর্শকদের সামনে নাচ করে দেখায়। এটাই মুখা-নাচ। এই শিল্পের জন্য ইউনেস্কো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতা,মুম্বাই,দিল্লি,গোয়া,বেঙ্গালুরুতে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মুখোশের ব্যাপক চাহিদা। এই কাঠের তৈরি মুখোশ ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে এবং ভীষণ সাড়া ফেলে দিয়েছে। মহিষবাথানে মুখা-শিল্প দেখে বাড়ি ফিরছিল বৈশালী। মনে একরাশ মুগ্ধতা। মুখা-শিল্পীদের কাছে বসে কাঠ দিয়ে মুখোস বানানো দেখেছিল। শিল্পীদের হাতের অপুর্ব কাজে কাঠ থেকে বেশ কিছু সময়ের মধ্যে একটি কাঠের মুখোস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বৈশালী আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল,কীভাবে তার চোখের সামনে একটি কাঠ শিল্পীদের হাতের জাদুতে কথা বলে উঠেছিল,কেমন করে শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় কাঠের মুখোসেও ‘হাসি’ ফুটে উঠেছিল। বৈশালী অনুভব করছিল,শিল্পীদের সংস্পর্শে জড়বস্তু কাঠও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
রাস্তার মাঝে বৈশালীর সঙ্গে নির্ঝরের দেখা। রাস্তার মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বৈশালী। চমকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল নির্ঝর। বৈশালীর চোখ-মুখের আকৃতি পালটে গিয়েছিল। বৈশালী চোখ বড়-বড় করে নির্ঝরের দিকে তাকিয়েছিল। সমস্ত মুখমন্ডল লাল হয়ে গিয়েছিল বৈশালীর । নাকটি ফুলে-ফুলে উঠছিল। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছিল। সমস্ত দেহ ফুঁসছিল বৈশালীর। শেষে নির্ঝরের সামনে তর্জনী উঁচিয়ে,তর্জনী নাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল বৈশালী। এই ঘটনার প্রায় এক মাস হতে চলল লজ্জায়,অপমানে নির্ঝর আর কলেজমুখো হয়নি।
.
বৈশালীর আনন্দ
মালঞ্চার মাটিতে নির্ঝরের কথা শুনে খুশিতে ভরে গেল বৈশালীর মন। নির্ঝরের কথাতে আনন্দে ভরে উঠল বৈশালীর প্রাণ। সেই খুশি,সেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল বৈশালীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গে। বৈশালীর দেহের ভেতর ‘মোহিনীআট্টম’ নাচ চলতে লাগল। ‘মোহিনী আট্টম’-এ ছেয়ে গেল বৈশালীর শরীরের মধ্যটা। বৈশালীর চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠল খুশি,আনন্দ। বৈশালীর চোখ-মুখ আনন্দে কেন ছেয়ে গেল,নির্ঝর তা বুঝে উঠতে পারল না। সেটা নির্ঝরের মাথায় ঢুকল না। বৈশালীর মুখে ‘হাসি’। বর্তমানে মানুষের মুখের ‘হাসি’-র ভীষণ অভাব। এখনকার ব্যস্ততার যুগে মানুষের মুখে ‘হাসি’ দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তবে সব ‘হাসি’ কিন্তু মঙ্গলজনক নয়। কিছু-কিছু হাসি বিপজ্জনকও হয়। নির্ঝর সেটা ভালভাবে জানে। নির্ঝরের মুখমন্ডলে দুশ্চিন্তা। চোখ-মুখ কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন। নির্ঝর চুপচাপ। মুখে কোনও কথা নেই। সে নিশ্চুপ ভাবে কেবল দাঁড়িয়ে রইল।
বেশ কিছুটা দূরে একটি শিমুল গাছ থেকে সাদা-সাদা তুলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। টুকরো-টুকরো সাদা মেঘের মতো সেই তুলোগুলো বাতাসে ভাসতে লাগল। বৈশালী বলল,” নির্ঝরদা,চলো,বটগাছটির নিচে গিয়ে বসি।” নির্ঝর বৈশালীকে মন থেকে ভালবাসে। নির্ঝর বৈশালীর কথা ফেলতে পারল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। বৈশালীর চোখ-মুখে খুশির ছাপ। নির্ঝরের মুখে দুশ্চিন্তা। বৈশালী সামনে এগিয়ে চলল। নির্ঝর বৈশালীর পিছে-পিছে চলতে লাগল।
প্রেম বড় মধুর
বৈশালী গিয়ে বটগাছটির বাঁধানো জায়গায় বসল। নির্ঝরকে বলল,”নির্ঝরদা, বসো।” নির্ঝর বটগাছের ইট-সিমেন্টর বাঁধানো জায়গায় গিয়ে বসল। চুপচাপ দু’জনে। শুধু বটগাছের পাতাগুলো তাদের দু’জনকে শীতল হাওয়া দিচ্ছিল। এক সময় নির্ঝর খেয়াল করল,একটি নরম হাত তার হাতের ওপর এসে পড়ল। চমকে গেল নির্ঝর। দেখল,নখে নেলপালিশ পরা বৈশালীর ফর্সা, সুন্দর, ডান হাতটি তার হাতের ওপর। নির্ঝর বৈশালীর চোখের দিকে তাকাল। বৈশালী নির্ঝরের চোখের দিকে তাকাল। দু’জনে দু’জনের চোখে চোখ রেখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। দু’জনে হারিয়ে গেল কিছুক্ষণ। তারপর বৈশালী নির্ঝরের হাতটা ভাল করে ধরল। নির্ঝরের চোখ-মুখের দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে গেল। খুশি ফুটে উঠল নির্ঝরের চোখ-মুখে। বৈশালী উঠে দাঁড়াল। নির্ঝরও উঠে দাঁড়াল। বৈশালী হাত ধরে নির্ঝরকে বটগাছটির নিচে সবুজ ঘাসের কাছে নিয়ে গেল। তারা দেখল,অনেক– অনেক লাল-বটফল মাটিতে পড়ে রয়েছে। লাল আর লাল যেন লাল-বিছানা পাতা রয়েছে। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছিল। বটগাছটিতে অনেক পাখির-ঘর ঝুলানো ছিল। পাখিগুলো একবার ঘরের ভেতরে যাচ্ছিল আবার ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছিল। কিছু বটফল সরিয়ে বটফলগুলোর মাঝখানে বসল বৈশালী। হাত ধরে নির্ঝরকে তার পাশে বসাল। তাদের চারপাশে লাল-বটফলের বিছানা। বৈশালী বুকের ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল। মাথার চুলে লাগানো ক্লিপগুলো খুলে মাথার চুলগুলো খুলে দিল। চুড়িদারটা দেহের সঙ্গে সেটে ছিল। চুড়িদারটা টেনে আলগা করে নিল। বড় লালের টিপের ওপর বসানো নীল রঙের টিপটি ঠিক করে নিল। তারপর বৈশালী নির্ঝরের হাঁটুর ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। হালকা বাদামি রং করা চুলগুলো এলিয়ে দিল। হাওয়া বইছিল। হাওয়াতে কিছু বাদামি চুল বৈশালীর মুখের এসে পড়েছিল। বৈশালী নির্ঝরের চোখে চোখ রাখল। স্থির দৃষ্টিতে নির্ঝরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্ঝরও তাকিয়ে থাকল বৈশালীর চোখের দিকে। এক সময় বৈশালী বলল,”নির্ঝরদা,আমি তোমাকে ভালবাসি। খুব ভালবাসি। আই লাভ ইউ ,আই লাভ ইউ।”
নির্ঝর বৈশালীর হাঁটুতে মাথা দিয়ে শুল। বৈশালীর খোলা চুলগুলো হাওয়াতে উড়তে লাগল। নির্ঝর বৈশালীর চোখে চোখ রাখল। নির্ঝর বলল,”বৈশালী,আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। খুব, খুব। আই লাভ ইউ বৈশালী,আই লাভ ইউ।”
একটি বটফল
জোরে বাতাস বইতে লাগল। ফসলের ওপর হাওয়া খেলতে লাগল। বটগাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে জাম-পুকুরের জলে ছোট-ছোট ঢেউ খেলতে লাগল। গাছের পাতা এদিক-ওদিক দুলতে লাগল।
দত্তক-গ্রামের বটগাছের ওপর থেকে একটি লাল-বটফল বৈশালী আর নির্ঝরের দেহের ওপর পড়ল। বটফলটি ফেটে গিয়ে বটফলটির বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ল বৈশালী আর নির্ঝরের দেহের ওপর।
পায়ে-হাঁটা
বৈশালী ও নির্ঝরের ছায়া ক্রমশ পূর্ব দিকে বড় হতে লাগল। বৈশালী ও নির্ঝর বটগাছতলা থেকে উঠে দাঁড়াল। একে-অপরের হাত ধরে দু’জনে দত্তক গ্রামের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বৈশালী বলল,”জানো নির্ঝর,যদি সময়কে এক জায়গায় স্থির রাখা যেত,এক স্থানে টেনে সময়কে আটকে রাখা যেত, তাহলে খুব ভাল হতো। প্রতিটি মানুষের ইচ্ছে জাগে সময়কে টেনে ধরতে। বয়স বাড়ার সাথে-সাথে সময়কে টেনে ধরার ইচ্ছেটা মানুষের মনে প্রবল ভাবে মাথা চাড়া দেয়। সব মানুষের ইচ্ছে জাগে,তার পছন্দ মতো জায়গায় সময়কে বেঁধে রাখতে।” কিছু দূর যাওয়ার পর নির্ঝর বলল,”বৈশালী,আমি প্রতিদিন সকালে তিন-চার কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করি। হেঁটে-হেঁটে বাজার করি। কিন্তু হাঁটার মধ্যে যে এত আনন্দ,এত খুশি রয়েছে, তা আমি বুঝতে পারিনি।” নির্ঝর বলল,”বৈশালী,আমার কেবল মনে হচ্ছে,শুধু হাঁটি…… শুধু হাঁটি……..
হাত ধরাধরি করে দু’জন সমস্ত দত্তক-গ্রামটি ঘুরে বেড়াতে লাগল। বৈশালী বলল,”নির্ঝর,মানুষের মন-মস্তিষ্ক-শরীর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মন খারাপ থাকলে মস্তিষ্ক ও শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। আবার মস্তিষ্ক ভাল না থাকলে মন ও শরীর বেসামাল হয়ে পড়ে। অপরদিকে শরীর অসুস্থ থাকলে মস্তিষ্ক ও মন সুস্থ থাকে না। মানুষের মন, মস্তিষ্ক ও শরীর তিনটি-ই যদি ভাল থাকে,তাহলে মানুষ ভীষণ সুখ অনুভব করে। আমার মন-মস্কিষ্ক-শরীর তিনটি-ই ভাল লাগছে। খুবই সতেজ, তরতাজা লাগছে।” হাঁটতে-হাঁটতে নির্ঝর বলল,”জানো বৈশালী, সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন কোনও না কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা একে-অপরকে ‘আই লাভ ইউ’ বলছে। কেউ না কেউ একে অপরকে বলছে,’আমি তোমাকে ভালোবাসি’। সারা বিশ্বে প্রতিদিন কোনও না কোনও জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকার সুমধুর প্রেমালাপ ধ্বনিত হচ্ছে। প্রেম-ভালোবাসার ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। পৃথিবী প্রতিদিন সৌন্দর্যময় হয়ে থাকছে। আর এই প্রেম-ভালোবাসাকে নির্ভর করে বিশ্ব প্রতিদিন সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। লোকে বলে,পৃথিবীতে নাকি প্রেম নেই,ভালোবাসা নাকি উধাও হয়ে গেছে। কথাটি মোটেই ঠিক নয়। জগতে এখনও প্রেমের জন্য মানুষ পাগল হয়ে যায়, এখনও মানুষ ভালোবাসার জন্য বিয়ে না করে একা-একা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। প্রেমের জন্য মানুষ এখনও সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত,সন্ন্যাস নিতে প্রস্তুত।
সামনের দিকে কিছুটা দূরে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ। দত্তক-গ্রামটিতে সেই একটি মাত্র কৃষ্ণচূড়া গাছ।গাছটির নিচে অনেক লাল-ফুল পড়েছিল। বৈশালী ও নির্ঝর হেঁটে গাছটির কাছাকাছি আসতেই তাদের কানে ওপর থেকে মাটিতে কিছু একটা পড়ার শব্দ কানে এল। বৈশালী ও নির্ঝর সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বৈশালী দেখল, কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে মাটিতে একটি ছোট্ট পাখির বাচ্চা পড়ে। ঠিক মতো চলতে পারছে না,ঠিক মতো নড়াচড়া করতে পারছে না পাখির বাচ্চাটি। বৈশালী গাছটির ওপর দিকে তাকাল। দেখতে পেল,ওপরে গাছটিতে একটি ঝুলন্ত-ঘর লাগানো। বৈশালী বুঝতে পারল,ওপরে কৃষ্ণচূড়া গাছটিতে লাগানো ঝুলন্ত-পাখির-বাসা থেকে পাখির বাচ্চাটি অসাবধানবশত নিচে পড়েছে । বৈশালী ধীরে-ধীরে মাটিতে পড়া পাখির ছানাটির দিকে এগিয়ে গেল। নির্ঝরও এগিয়ে চলল। বৈশালী ও নির্ঝর পাখির বাচ্চাটির খুব কাছে পৌঁছে গেল।
কৃষ্ণচূড়া তলায়
জোরে বাতাস বইতে লাগল। হাওয়াতে বৈশালীর চুল উড়তে লাগল। হলুদ ওড়নাটি হাওয়ায় দোল খেতে লাগল। বৈশালী পাখির বাচ্চাটিকে পরম যত্নে হাতে তুলে নিল। পাখির ছোট্ট বাচ্চাটিকে হাতে নিয়ে বৈশালী বলে উঠল,”আহ, কি সুখ! কি আনন্দ!” নির্ঝর ছোট্ট পাখির ছানাটিকে খুব সাবধানে হাতে নিল। পাখির বাচ্চাটি হাতে নির্ঝর বলল,”আহ,কি খুশি! কি প্রশান্তি!”
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..