পাগল
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
শ্রাবণের কালো ঝুল আকাশটা কেটে গিয়ে ভাদর মাসের কটকটে রোদ্দুর পেঁজাতুলো সাদা মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলেই কেমন জানি “এসেছে শরত” ফিলিংটা চাগিয়ে ওঠে। ভিমবার ঘষা স্টিলের বাসনের মত ঝকঝকে রোদ্দুর। গাঁয়ে-গঞ্জে মায় শহরের ছাদে পাঁচিলে একমাত্র ভাদর মাসেই বেনারসী তসর জামদানী থেকে শুরু করে কাঁথাকানি, লেপের ওয়ার, মশারি,পুরনো ফাইলপত্র, লেপ-তোষক পারলে ঘরের আসবাবপত্রগুলোকেও কড়া রোদে সেঁকে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে আম-বাঙালি। ঝাঁপিয়ে পরে একচিলতে রোদের ওপর। তা না হলে বারোমাস উদাসীন রোদ শুধুমাত্র ভেজা জামাকাপড়, বয়ামের আচার আর বিউলির ডালের বড়ির ওপর দিয়েই আঙুল বুলিয়ে যায়!শীতে বড়জোর হাতেবোনা হাফ-সোয়েটার কিম্বা লোহার তোরঙ্গের জং-লাগা সাদা শালের আদর। তা বাপু হবে নাই কেন! সেই কালবোশেখীর ঝড় নিয়ে সেই যে বিষ্টি এল, জষ্টির পাকা আম ঝরিয়ে, আষাঢ়মাসের বেলাগুলো ঝুপসি অন্ধকার করে, গোটা শ্রাবণ ঘ্যানঘেনে বিষ্টিতে যখন গেরস্তেরা অস্থির হয়ে পড়তো, চাষবাসের পর আবাদি জমি যখন খোকার ন্যাড়া মাথার মত ফাঁকা ফাঁকা ছেড়ে ঘনসবুজ হয়ে আসতো, তখনই ভাদ্রমাসের রোদখানা সেই সার্ফ-এক্সেল মার্কা সকালে ঝকমক করে উঠতো। এখন কি ছাই হয়েছে কে জানে, বিষ্টি নেই, বাদল নেই খটখটে শুকনো আষাঢ় আবার নাবলে পরে এক্কেরে ভাসিয়ে দিচ্ছে গো! তা সেই ভাদ্দর মাসের রোদে জামা-কাপড় উজাড় করে ঢেলে এক দুপুর তেষ্টা নিয়ে সিঁড়ির ধারে বসে থাকা। সেইসঙ্গে কত ছোটছোট নষ্ট্যালজিয়ার পাউচে মোড়া অমলিন সব স্মৃতি যা ঢাকা পরে থাকে সারাবছর শুধু নতুন করে জাগবে বলে বিস্মৃতির গভীর অন্ধকার থেকে, তাদের সাথে মোলাকাত।
ফ্ল্যাটবাড়িতে ওসব পাট নেই। বহুতল আবাসনের বসত-করা মানুষগুলোর ঘর আছে,ছাদ নেই। ভাগের ছাদে সে দু-একবার যে যাওয়া যায় না তা নয় তবে কিনা পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস সেন, মিসেস বাজোরিয়া কিম্বা উল্টোদিকের ব্লকের মিসেস মুখার্জিরা এসব দেখলে কিই বা ভাববেন। প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে তখন? তাছাড়া ফেসবুক আপলোড করা এক আর ছাদে গিয়ে এসব শাড়ি-টাড়ি, বালিশ-বিছানা… না বাবা! দরকার নেই। মিসেস সান্যালের যা চোখ, ঠিক বলে বসবে “এগুলো সিল্ক-মার্ক নয় বুঝি “!ছোটবেলায় মা-ঠাকুমারা যখন প্যান্ডোরার বাক্স খুলে বের করতো আশ্চর্য রঙিন সব শাড়ি ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা, ভাঁজ খুলে খুলে মেলে দিত সারাছাদময়, লেজওয়ালা পোকায় কাটা কত পুরনো বিয়ের কার্ড,” ভুলো না আমায়”লেখা ফুলতোলা রুমাল, কুরুশের কাজ করা নকশাকরা টেবিলকভার। কম চেনা, কম জানা, একটা অদ্ভুত মুগ্ধ জগত, অথচ তা আমাদেরই এই বোধ আচ্ছন্ন করে রাখতো সারাদিন। সিল্কের রুমাল জড়ানো সাদাকালো ছোপধরা কিছু ছবি, যারা এঁটে উঠতে পারেনি রংচঙে এ্যলবামে, তাও বুঝি পরে থাকতো সেই গরম হতে চাওয়া জিনিসপত্রের লিস্টিতে। যে ছবির মানুষজন হয়তো কেউ পরবাসে কেউ আর নেই,অনেকদিন আগেই চলে গেছে তারাদের দেশে,যেখান থেকে চাইলেও আর ফেরা যায়না। পরে আছে মানুষের ঘরবাড়ি, বিছানা-বালিশ, সুখ-অসুখ, জীবন-যাপন।
এই ভরা ভাদরেই তাল-নবমী। জন্মাষ্টমীর পুজো। পুকুরপাড়ে ধপধপ তাল পরার শব্দ শুনে পড়তে বসে উসখুস করছি, লোহার গরাদ দেওয়া জানলা দিয়ে উঁকি দিতেই, খালি-গা, কোমরে কষে লুঙ্গি পরা আসগর চাচা বলতেন, “পুকুরপাড়ে তাল খুঁজতে যেওনি মামনি, সাপখোপ কত কি আছে, বড় কিলবিলে জোঁক। বরষা গেল সবে, ও আমি জল থেকে তুলে দেব ‘খন।” সারদিন হা-পিত্যেশ করে সন্ধেবেলায় কখন যেন বাড়ি ম’ ম’ করতো মৌরির গন্ধমাখা তালফুলুরির গন্ধে। একছুটে রান্নার চালায় গিয়ে দেখতাম মা ফুলুরি ভেজে তুলে রাখছে চাঁচারির পেতেয় আর আসগর চাচা বাড়ির উঠোনে বসে চা-ফুলুরি খেয়ে মা কে বলছেন ” আজ তবে আসি মা, কাল আবার অষ্টুমির পুজো, হক্কাল হক্কাল ফুল বেলপাতা পারতি হইবো, আজানের সময়েই উঠে যাব এক্কেরে “।বাগদী পাড়ার পাঁচির মা, কাজ সেরে কোঁচড়ে ফুলুরি নিয়ে বাড়ির পথে ” এই হপ্তায় আবার রেঁদে রাকা আচে গো মা “।সন্ধ্যায় হরি-সংকীর্তন হতো, মন্দিরে খোল-করতাল বাজিয়ে। আরাঁধ হতো ঘরে ঘরে,তালের বড়া, টক-দেওয়া ডাল দিয়ে আগের দিনের রেঁধে রাখা ভাত খাওয়ার প্রথা। তাতে তো আর মুখে রুচবে না ছেলেপুলেদের। তাই সরু চালের সাদা ঝরঝরে ভাত একটু গা-থাকতে শক্ত করে নামানো, ভাজা মুগের ঘন ডাল গন্ধরাজ লেবুপাতা দিয়ে সাঁতলানো, তখন তো আর পাড়াগাঁয়ে ফ্রিজের চল ছিলনা, ভাদরের গরমে নষ্ট হতো টক দেওয়া না থাকলে। তাই সব পদই টক দেওয়া। পুকুরপাড় থেকে কলমী-শাক তুলে তা বাদাম দিয়ে ভাজা,কড়কড়ে করে আলুভাজা লাল লঙ্কা দিয়ে,ছোটছোট বড়িভাজা, পুরনো কালো তেঁতুল দিয়ে মাছের টক, চালতার চাটনী, ছোটমাছের গোটা গোটা ঝালদা সরষে বাটনা দিয়ে। আর শেষপাতে ঘরেপাতা টকদই, লাল মোটাদানার চিনি দেওয়া। কোথায় সেসব দিন পুরনো সাদাকালো বাংলা সিনেমার মত হারিয়ে গেল কে জানে!
এখন প্রি-পুজো অফার, অনলাইন সেল আর জোম্যাটো সুইগীর চক্করে কোথায় তলিয়ে গেল সেই জোনাক-জ্বলা নিখাদ অন্ধকারের ভাদ্রমাসের রাত, সরসরে হাওয়া, গন্ধরাজ লেবুর গন্ধমাখা ঘোলের শরবতের মতই ঘেঁটে গেল সব। নিজেকে এখন হ্যাঙারে ঝোলা পাঞ্জাবির মত অন্তঃসারশূন্য মনে হয়। নন-এনটিটি,বাড়তি, পুরনো।
“…হামারি দুখের নাহি ওর।”
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা; আমি বসে আছি একটি দোকানে, দোকানটি মূলত আমাদেরেই। দোকানের সামনে…..
১৮ মার্চ ২০১৯ মধ্যরাত! চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে শুধু বাড়ির চারিপাশে বিদ্যুতের বাল্বগুলো জ্বলছে তাদের…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..
পাঠকদের প্রায় জনেই হয়ত জানেন, সমকাম কি ? সমকামী কারা ? সমকামীর প্রকারভেদ, কেন…..