মা, সভ্যতা ও অন্যান্য

ফরিদুর রেজা খান
গল্প
Bengali
মা, সভ্যতা ও অন্যান্য

মানুষের জন্মের ক্ষমতা তার নিজের কাছে থাকে না। জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী দম্পতিও জানে না তারা স্রষ্টার উপহারশালা থেকে ঠিক কোন উপহারটি নিজেদের জন্য বাছাই করছেন। এমনটা হতেই পারে যে একটা নিষিদ্ধপল্লীতে নিছক অসাবধানতাবশত একটা ভুলের কারণে একটা শিশু এই পৃথিবীতে এসেছে। দু হাত পা মেলে সে চিৎকার করে কান্না করছে, তার অজান্তেই এই জগৎ এর সুন্দর আলো তার কাছে হয়ে উঠছে ভয়াবহ এক বিভীষিকা। সে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। তাকে কোলে নিয়ে কানের কাছে আহ্লাদি শব্দ করার জন্য বা রোদ চড়ানোর জন্য কেউ আগ্রহ নিয়ে বসে নেই। আবার এমনটাও হতে পারে যে এক মধ্যবয়সী দম্পতির এক যুগ প্রার্থনা আর আরাধনার পর একটা শিশু এই পৃথিবীর মুখ দেখছে। সেই দম্পতি সন্তান জন্মের আনন্দে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিলিয়েছে। যে কৃপণ পুরুষ রাস্তায় কোনো দিন একটা ভিক্ষুককে একটা দুই টাকার নোট দেওয়ার কথাও চিন্তা করে দেখেনি সেই বাবা হওয়ার পর নিজের সদ্য জন্মানো ফুটফুটে সন্তানের মুখের মায়ায় পড়ে কোনো এক অশীতিপরায়ণ বৃদ্ধের হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলছে, ‘বাবা আমার মেয়েটার জন্য একটু দোয়া কইরেন।’

এই পৃথিবীতে ঈশ্বর বলে কারোর অস্তিত্ব যদি সত্যিই ধর্মগ্রন্থগুলোর বাইরেও থেকে থাকে তবে কেনো তাঁর সৃষ্টিরাই এরকম বিভাজনের শিকার হচ্ছে? কেনো প্রতিটি শিশু এই পৃথিবীতে হাসতে আসে না? একটি দেশে যেখানে একটা পরিবার কয়েকটা শৌখিন শোপিস কিনতে গিয়ে লাখ টাকা উড়িয়ে ফেলছে সেখানে কেনো দিনে দু বেলার ভাত যোগাড় করতে একটা পথশিশুকে পোশাকি ভদ্রলোকদের মুখে গালি শুনতে হচ্ছে? এই পৃথিবীতে যদি কোনোদিন একটা মহামারি হয় বা এই সভ্য মানবসসমাজই যদি কোনো কৃত্রিম দূর্যোগ নামিয়ে নিয়ে আসে আর তার বদৌলতে যদি সভ্যতার পথচলাটা একদম নতুন করে শুরু হয় তবে ঈশ্বর সম্পর্কিত এই শতাব্দীর মানুষের যে ধারণা আছে তাকে হয় বানোয়াট বলা হবে, নয়তো পুরনো ব্যাংক নোটের মতো ‘আর চলছে না’র খাতায় ফেলে দেয়া হবে। মানুষ ধর্মগ্রন্থগুলো নিয়ে ছুটবে ধর্মযাজকদের কাছে। নির্দিষ্ট অর্থমূল্য না থাকুক, ভালোবাসার মতো বিশ্বাসেরও একটা দাম আছে। সেই দাম বা পাওনা আদায় করতে গিয়ে এই বিশ্ব বাস্তবতার একটা নতুন মোড়ে নতুন একটা সভ্যতার জন্ম হবে।

আয়েশা সর্দার বসে আছে উঁচু বটগাছটার নিচে। গত তিন চারদিন যাবত এই পল্লীতে খুব একটা শোরগোল চলছে। এমনিতে সাধারণত এই পল্লীতে খুব বেশি একটা ঝামেলা বাঁধে না। বাঁধলেও সেটা নিতান্তই নিছক কোনো একটা বিষয়ে। হয়তো দেখা যাচ্ছে কোনো খদ্দের কথামতো দাম মিটাচ্ছে না বা পল্লীর ভেতরের দোকানদারেরা বাকির খাতা নিয়ে অনেকদিন ঘুরেও পাওনার শোধ পাচ্ছে না-এই ধরণের কিছু একটা। এর বাদে তেমন কোনো বিশেষ সামাজিক কোলাহল নেই এখানটাতে। সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষদের এই হচ্ছে এক সুবিধা। এদের জীবনে বিত্তশালীদের মতো বড় বড় সমস্যা আসে না। আসে খুবই ছোট ছোট সমস্যা। এইসব সমস্যা তাদের ছোট ছোট ঘরগুলোর ভেতরেই জায়গা করে নিতে পারে। বিত্তশালীদের মতো নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় না, ছড়িয়ে পড়েও না।

তবে এবারের ঝামেলাটা একটু অন্যরকম। এই পল্লীতে এইরকম ঘটনা যে আগে কখনোই ঘটেনি তেমন কিছু না। ঘটেছে এবং সেটা সংখ্যায়ও অনেক, একেবারেই কম না। কিন্তু এই ঘটনাটা নিয়ে সবার ঘুম মোটামুটি হারাম হয়ে গেছে। পল্লীর ভেতর খদ্দের ছাড়াও ক্যামেরাসহ ঐসব টিভিওয়ালা আর খবরের কাগজের লোকেরা ঘুরাঘুরি করছে, সাথে মানবাধিকার নাকি কি যেনো বলে সেসবের লোকেরা আর তাগড়া জোয়ান পুরুষদের চেয়েও ভয়ঙ্কর মহিলারা তো আছেই। আয়েশা সর্দার এইসব দেখতে দেখতে এখন নিতান্তই ক্লান্ত। একটা বয়সে পৌঁছালে মানুষ আর জীবনের পথটাতে হাঁটার কোনো আগ্রহ খুঁজে পায় না। কিন্তু রুপকথার পথিকের মতো হয় না সবার জীবনের কথা। এই পৃথিবীতে মানুষ আজন্মই পথিক। হামাগুড়ি দিতে দিতে হাঁটাটা শিখে যাওয়ার পর তাকে হাঁটতেই হবে। হাঁটতে হাঁটতে সে একটা জীবন পার করে ফেলবে। তবুও তাঁকে হাটতে হবে। সে হাঁটবে। মানুষের জীবনটাকে এভাবেও বলা যায় যে তার জন্ম হবে-সে হাঁটবে-হাঁটতেই থাকবে, তারপর একদিন মারা যাবে।

– শালার মাগি। বাচ্চাটা যখন পেটে আসলো তখন বুঝবার পারে নাই মানলাম। তাই বইলা দশ মাস একটা জারজ পোলা পেটে নিয়া ঘুরছে, একটুও টের পাই নাই যে সে পেট বান্ধায় বসছে?

আয়েশা সর্দারকে ঘিরে রাখা অন্যরা কোনো শব্দ করে না। আসলে তাদের মুখ ফুটে কোনো শব্দ বের হয় না। তিনদিন আগে আরুর ঘর থেকে এই আলোচনার শুরু। আরু বাচ্চা মেয়ে। মাঝখানে বেশ কয়েকদিন এই পল্লীতে নতুন মানুষের আনাগোনা হয়নি। এই সময়টাতে আসলে সবকিছুতে অনেকটা কড়াকড়ি এসে গেছে। আগে দালালেরা গ্রাম থেকে একটা মেয়েকে এনে যতটা সহজে এখানে বিকিয়ে দিয়ে যেতে পারতো এখন আর তা পারে না। দু দিনেই থানা পুলিশ, এনজিও আর মানবাধিকার কর্মীদের একটা শোরগোল পড়ে যায়। আগে এইসব অভিযোগে ধরা পড়লে কেবল দালালের শাস্তি হতো। সেটাও গ্রাম্য সালিসের সর্দারগোছের কারোর হাতে কিছুটা টাকা গুঁজে দিয়ে দফারফা করে ফেলা যেতো মাঝে মাঝে। কিন্তু এখন তেমন কোনো সুযোগই নেই। এইসব কারণেই গত কয়েক বছরে এই পল্লীতে নতুন কেউ আসেনি। শহরের বাইরের বড় ট্রাকস্ট্যান্ডটাতে দূরের জেলা শহরগুলো থেকে আসা ড্রাইভাররা একই মুখগুলো দেখতে দেখতে বিষিয়ে উঠছিলো। আসলে মুখ বলাটা ভুল হবে, বলা উচিত শরীর। এই পল্লীতে ভালোবাসা শরীরের ভাঁজে হয়, নাভির খাদে হয়। এখানে কেউ মুখ দেখে বলে না, ভালোবাসি। প্রেমিকার কানের কাছে কান নিয়ে ফিসফিস করে মনের কথা বলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে না এখানে। এই ভালোবাসার গড়নের সাথে আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক বাঙালি সমাজের কিছুটা মিল আছে। দুই ক্ষেত্রেই স্বার্থ থাকে। কারোর স্বার্থ বা বিনিময়টা প্রকাশ্যে, কারোরটা গোপনে-উদ্দ্যেশ্য হাসিলের মাধ্যমে। এটাই সভ্যতার নিয়ম। একটা পর্যায়ে এসে আপাতদৃষ্টিতে নিম্নবিত্ত সমাজের ‘নগ্ন’ আর ‘নগণ্য প্রথা’গুলো এসে বিত্তশালী সমাজের ‘শৌখিন আধুনিকতা’র সাথে মিশে যাবে। উভয় ক্ষেত্রে চর্চাটা একই হলেও সংজ্ঞাটা হবে ভিন্ন, ব্যাখ্যাটাও।

তবে পল্লীর এই শুষ্ক খরার অবস্থাটাতে কিছুদিন হলো কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কাছেই কক্সবাজার। মিয়ানমারে সু চির ভাসুর জ্ঞাত সামরিক কর্তাদের নির্যাতন শুরু হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষ পিপীলিকার মতো সরু লাইন ধরে এপারে আসতে শুরু করলো। শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চি তখন কি করছিলো কে জানে। সুচি বাঙালকন্যা হলে বলা যেতো ভাসুরের লজ্জায় আঁচলে মুখ ঢেকেছিলো। কিন্তু সে তো বাঙালি না, বাঙাল ঘরের মেয়েও না। যাই হোক, ওপার থেকে ছুটে আসা সেই মিছিলের সরলরেখাটাও বদলে যেতো মাঝে মাঝে। কেবল ঘরবাড়িতে আর হাটবাজারে না-প্রাণের ভয়ে ছুটতে থাকা মানুষদেরও রাস্তায় মেরে ফেলা হতো, একেকটা উদ্বাস্তুর মিছিলের সামনে হঠাৎ করেই হাজির হয়ে যেতো বার্মিজরা। গুঁড়িয়ে দিতো ওদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাকে। এই মিছিলের একেকজনের একেক গল্প। কারোর নবজাতক শিশুটিকে বার্মিজ কোনো এক সৈন্য হয়তো বুটের নিচে ফেলেই পিষে ফেলেছে, কোনো পরিবারের সদ্য পরিণীতা মেয়েটিকে হয়তো বাবা আর মার সামনের বে-আব্রু করে পৈশাচিক নির্যাতন করেছে দানবগুলো। কারোর পরিবারকে হয়তো ঘুমের মাঝেই বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, ধোঁয়ায় একদম ঢাকা পড়ে যাওয়া সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদার সময়টুকুও পায়নি ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া সেই পরিবারের একমাত্র সদস্য। হয়তো নিজের জীবনটাকে নিয়েই ছুটতে হয়েছে তাকে। নীলাভ নাফ নদীটা পার হয়ে আসতে হয়েছে নতুন কোনো এক দেশে, ভিড়তে হয়েছে অজানা এক পাড়ে। নিজের দেশে হয়তো সবই ছিলো, কিন্তু এখানে একবেলার সামান্য খাবারের জন্যও দাঁড়াতে হচ্ছে বিশাল লাইনে। যে দেশটিতে তারা আশ্রয় নিয়েছে সে দেশটিও তেমন কোনো বিত্তশালী দেশ নয়, কেবল সদ্য দাঁত গজানো শিশুর মতো সারল্য নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছে এরকম একটি দেশ। এই দেশটিরও ঠিক এরকমই একটি ইতিহাস আছে। গত শতকের একটা সময়ে ঠিক ওদের মতন করেই এক কোটি মানুষ ছুটে গিয়েছিলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে, আশ্রয় নিয়েছিলো প্রায় অভিন্ন ছোট ছোট খুপড়িগুলোতে। নিজ দেশ ছেড়ে হয়েছিলো শরণার্থী। তবে ওদের খুব বেশিদিন সেই অবস্থায় থাকতে হয়নি। ওদের একটা সূর্য ছিলো। সেই সূর্যের আলোতে ওরা উদ্ভাসিত হয়েছিলো, পুনর্জন্ম নিয়েছিলো। আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়েছিলো বৌদ্ধরা। আর সেই সময়টাতে ওদের তাড়িয়েছিলো পাক মুমিনরা, হিন্দু আর রবীন্দ্রনাথের পা চাটা মুশরিক দোহাই দিয়ে। অবশ্য সেই পাক জিহাদিদের (!) হাতে ওই সময়টাতেই পূর্ব দেশের বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লিও মারা পড়েছিলেন। আসলে সহিংসতা বা অমানবিকতা কোনো ধর্ম মানেনি কখনো, মানেনি কোনো জাতিগত পরিচয়। মানুষের মাঝে সর্বত বিরাজ করা দ্বিতীয় সত্ত্বা হচ্ছে পৈশাচিকতা। এই পৃথিবীতে মানবিকতার বিশাল ঝান্ডাবাহী আদর্শপুরুষ বাদে সবার মধ্যেই পৈশাচিকতা আছে, হয়তো তাঁদের মাঝেও ছিলো। তাঁদের মাঝে থাকা পৈশাচিকতাটা বের হয়ে আসেনি বলেই তারা আজও পূজনীয়। তাঁদের অনুসরণ করা হয়, অনুকরণ করা হয়।

নাফ নদীর ঐ পাড় থেকে বিশাল বড় একটা জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ এই দেশটাতে আসার পর মাথা গোঁজার ঠাঁই পাক বা না পাক, ঘুমের মাঝে বুটের গুঁতো খাবে না বা মেশিনগানের গুলি-বেয়নেট চার্জে মারা পড়বে না সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিলো। এদেশের সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্রয় দিয়েছিলো আর বিশ্ব মোড়লরা তাঁদের দায়িত্ব মেটাতে এগিয়ে এসেছিলো ত্রাণ নিয়ে। আরু সেই ছুটে আসাদের মধ্যে একজন।

– এই পোলার কি হবে?

– সর্দারনী, পোলাডার এখনও চোখ ফুটে নাই ভালামতো। এরে কি আর করবেন? এই পল্লীতে তো এইটা প্রথমবার না। আগেও এরকম অনেক ঘটনাই ঘটছে।

– হ, তা ঘটছে। কিন্তু এই পোলারে নিয়া এর মধ্যেই সব জানাজানি হয়া গেছে। টিভির লোকেরা ক্যামেরা নিয়া আইসা ছবি তুইলা নিয়া গেছে। সবাই জাইনাও গেছে যে এই পোলার মা এই দেশের না। সে রোহিঙ্গা। আমরা রাস্তায় পইড়া মরলেও কারোর কোনো কিছু হইবো না, আইসা একটা লাত্থি দিয়া যাইবো মরার শরীরে। আর কইবো, দেখ মাগি মইরা পইড়া আছে রাস্তাত। এরে তুইলা নিয়া ভাগাড়ে ফালায় রাইখা আস আর রাস্তাটায় পানি ঢাইলা পরিষ্কার কর। কিন্তু এই ছেমড়ি আর ওর পোলার কিছু একটা হইলে সবাই আইসা আমগোরে ধরবো। ওর জানের দাম তিনশো কোটি, বুঝছস তোরা? এর থাইকা গুম  কইরা দেওয়া ভালো না? আমরা কি বইয়া আছি পোয়াতি গুনার লাগিন? কে কোন সময় পোয়াতি হইলো, কার কোন সময় পেট হইলো এইসব তো আমগোর হিসাব না।

পলি নামের সেই যুবতী কি বলবে বুঝে পায় না। আচ্ছা, এই সময়টা কি তবে লাশের দাম করার? এই পৃথিবীতে কি শুধুই লাশের দাম হয়? জ্যান্ত মানুষের কোনো দাম নেই?

– আচ্ছা, আমি বলি কি? পোলাডারে আমরা রাইখা দেই। একটা দুধের শিশুরে এইরকম শাস্তি দেওয়াডা আল্লাহরও সইহ্য হইবো না। মাইয়াডা তো কষ্ট পাইবোই। ওর কাছ থাইকা আমি যখন পোলাডারে নিয়া আসি তখন কি যেনো বলতেছিলো আমি ঠিক বুঝি নাই। বোবা মাইয়া, হাত পা নাড়াচাড়া কইরা কি যে কইতাছিলো আল্লাহই মালুম। পরে আমি ওর মাথা হাতায় দিয়া কইলাম, চিন্তা কইরো না বইন। তোমার পোলার কিছু হইবো না আমি থাকতে। আল্লাহ মাবুদ আছেন, তিনি সব জানেন। তিনি সব দেখেন। সবই বোঝেন তিনি। তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। মাইয়া আমার কথার কি বুঝলো জানি না, কিন্তু শক্ত কইরা রাখা মুখটা নরম করলো। বাচ্চাটা আমার কোলে দিলো।

আয়েশা কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। একবার বাচ্চাটার দিকে তাকায়। চোখ মুখ বুজে কেবল কেঁদেই যাচ্ছিলো এতক্ষণ। এখন চোখ বুঁজে আছে। ওর বোঁজা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা যেনো পড়তে চেষ্টা করে আয়েশা। না, পারে না। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না সেই বুঁজে থাকা চোখজোড়ার দিকে। আয়েশার দৃষ্টি বাচ্চাটার চোখজোড়া থেকে সরলরেখা হয়ে ছোট পাগুলো পর্যন্ত নেমে আসে।

– কবর কইনে খুদমু? জায়গাটা দেহায় দেন।

হঠাৎ সৎবিত ফেরে আয়েশার। আয়েশা চাচ্ছে না আসলে অযাচিতভাবে পৃথিবীতে আসা এই শিশুটা বেঁচে থাকুক। এই পল্লীতে সেই বয়োজ্যেষ্ঠা। সে জানে এই পল্লীতে জন্মানো শিশুদের অবস্থা বা ভবিষ্যত কেমন হয়। আর তার ওপর বাচ্চার মার পরিচিতি নিয়ে বাড়তি ঝামেলা তো আছেই। আয়েশা চোখ ঘুরিয়ে একবার বাচ্চাটার শরীর মাপে, আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো মাঠটা দেখে। বিশাল বড় মাঠ। কিন্তু কোন কোণায় এই ছোট শিশুটার জায়গা করা হবে তা ঠিক করতে পারছে না সে! এই পৃথিবী কতই না ধাঁধার, কতটাই না প্যাঁচানো!

– কইলেন না কই খুদমু?

– খুদ যেইনে মন চায়। এইটুক বাচ্চার লাগিন আবার জায়গা বাছনের কি আছে?

আয়েশা উঠে আসতে আসতে আরেকবার বাচ্চাটার দিকে তাকায়। ও জেগে উঠেছে, হাত পা নেড়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে। দূরের মসজিদে মুয়াজ্জিনের দরাজ কণ্ঠে খোদার পথে আহ্বানের সেই সুরের সাথে কেমন যেনো মিশে যাচ্ছে এতটুকুন বাচ্চাটার আধপোয়া গলা। সেই শব্দের মিশেল নেয়া যাচ্ছে না, সহ্য করা যাচ্ছে না। এই পৃথিবীটা আসলেই অনেক সুন্দর। যতটা না সুন্দর তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর।

– বাচ্চাটারে কি জ্যান্তই পুঁইতা দিবেন?

আয়েশা কিছু বলে না। মুখ দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে যায় মাটিতে। ধপাস করে একটা শব্দ হয়। পাশে থাকা মেয়েগুলো ছোটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু কেনো ছোটে কেউ জানে না। একজন দৌড়ে এক ঘটি ভর্তি পানি নিয়ে আসে। পুরো পল্লীর নিরব পরিবেশে হঠাৎ কেমন যেনো একটা দাঙ্গা দাঙ্গা ভাব চলে আসে। গলির ভেতর কুকুরগুলো ইতস্তত ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কাকগুলো এ ডাল ও ডাল করতে করতে যেনো মানুষের গড়ে তোলা তামাম সমাজের প্রতিই বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেয়। আয়েশা ওভাবেই মাটিতে শুয়ে থেকে উপরে একটা আস্ত আকাশ দেখতে পায়। সূর্যটা থেকে যেনো গলে গলে লাভা পড়তে থাকে তার চোখে। মনে হয় যেনো অসহ্য গরম একটা তরল ঝলসে দিচ্ছে তার চোখ। সেই লাভার মতো তরলটা আস্তে আস্তে তার মুখ বেয়ে নিচে নামছে, গলাটা পুড়ে ভেতরের ঘুণে ধরা হাড্ডিগুলো বের হয়ে আসছে।

দুই

আরু বুঝতে পারছে না তার সাথে এই মুহূর্তে ঠিক কি ঘটে চলেছে। মংডুর কাছাকাছি একটা ছোট্ট গ্রামের বাসিন্দা ছিলো সে। তার স্বামী কাছেই বাজারে একটা খাবারের দোকানে রাঁধুনির কাজ করতো। তিন সদস্যের পরিবারে তেমন একটা অভাব ছিলো না। ওর আশেপাশের মুসলিম পরিবারগুলোতে সবসময় যেমন একটা ভাঙন লেগে থাকতো সবসময়। কিন্তু ওর পরিবারে সেটাও ছিলো না। সাধারণ হিসেবে সুখ জিনিসটা আসলে আপেক্ষিক। একটা পরিবারে হাজার অভাবের পরেও সুখ থাকবে, কর্তা কর্ত্রী হাসিমুখে জীবনযাপন করবে-এমনটা হয়তো বানোয়াট, নয়তো পুরাতন সভ্যতাগুলোর রেখে যাওয়া দলিল যেগুলো এতদিনে নিজেদের মেয়াদ আর সত্যতা দুটোই হারিয়েছে। মধ্যবিত্ত সংসারগুলোতে সুখ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এমনটা হতেই পারে যে আগেরদিন রাতেই কর্তা তার অল্পবয়স্কা তরুণী পত্নীকে গভীর ভালোবাসায় কপালে চুমু খেয়েছে, কিন্তু সকালেই তাকে মুখের ওপর বলে দিয়েছে যে সে তাকে ঘেন্না করে বা তার স্ত্রী তার জন্য অলুক্ষণে কিছু মুহূর্ত তার জীবনে নিয়ে এসেছে। গতরাতে ভালোবেসে যে স্বামী তার স্ত্রীর খোঁপায় ফুল গুঁজে দিয়েছিলো, পরদিন শুন্য হাতে কাজ থেকে ফেরার পর সে তার স্ত্রীকে আঘাতও করতে পারে। স্ত্রীর স্নেহমাখা কথাগুলো তার স্বাধীন কিন্তু নির্ভরশীল জীবনযাপনকে কটাক্ষ করছে-এমনটা মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, যে কিশোরীর প্রেমে পড়ে সে তাকে নিজের জীবনসঙ্গী করেছিলো সেই কিশোরীটিকে সে আসলে ঠিক ভালো করে চিনতেই পারেনি। মধ্যবিত্তের অভাব খুবই বিচিত্র বিষয়। এই অভাব বাঁচার তাগিদটাকে অবলম্বন করে পুরো মানবসভ্যতাটার অভিন্ন বৈশিষ্ট্যটাকেই চোখ রাঙিয়ে বসতে পারে।

কিন্তু আরুর পরিবারটা সত্যিই অন্যরকম ছিলো। তার স্বামী সকাল হতেই কাজের জন্য বেরিয়ে পড়তো। তার দিন শুরু হতো ছেলেকে তৈরি করার মাধ্যমে। এলাকার একটা মক্তবে পড়ছিলো তার ছেলে। ছেলেকে মক্তবে পাঠিয়ে আরু খুন্তি আর কোদাল নিয়ে চলে যেতো বাড়ির পেছনের মাঠটাতে। সেখানে ওর বোনা নানা ফল সবজির চারাগুলো যেনো ওদের মধ্যবিত্ত পরিবারের অকৃত্রিম ভালোবাসারই সাক্ষ্য দিতো। সন্ধ্যার দিকে ওর স্বামী যখন কাজ থেকে ফিরে আসতো ও তখন তোয়ালে নিয়ে ছুটতো কলপাড়ে। কল চেপে পানি বের হবে, সেই পানিতে তার স্বামী হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছবে-এই দৃশ্যটা আরুর অল্পদামি জীবনের মধ্যেও অমূল্য মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি ছিলো। সন্ধ্যার দিকে ছেলেকে পড়াতে বসাতো। নিম্ন-মধ্যবিত্ত এশীয় পরিবারগুলোতে যেমনটা হয়; কিছুটা পড়ালেখা জানতো ও। বাবার দারিদ্র্যের সংসারে যদিও খুব বেশিদূর এগোনোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি আরুর। কথা বলতে না পারার কারণে এই লিখতে পারাটা ওকে সাহায্য করতো খুব।

আরুর আশেপাশে কি হচ্ছে বা কেনো হচ্ছে জানার প্রয়োজন বোধ করেনি সে কোনোদিন। শুধু এটুকু জানতো, মাথা গোঁজার জন্য তার স্বামীর বুকটা শুধু তারই। রাত গভীর হলে, বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়লে তার স্বামীর লোমশ বুকটাতে নাক ঘষার অধিকার শুধু তারই আছে। অন্য কারোর নেই। ওর কাছে ওর জগৎ বলতে ওর একমাত্র ছেলে, স্বামী আর নিম্নবিত্ত ভালোবাসার স্থাবর দলিল কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই কামরার একটা বাড়ি। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো-এমনটাই জানতো আরু। আসলে চলছিলো না। তাদের জন্মসূত্রের ভিটেবাড়ি তাদের আসল ঠিকানা না, তারা পঙ্গপালের মতো উড়ে এসেছে অন্য দেশ থেকে, এই দেশের আদি নিবাসী তারা নয়-বরং আদিনিবাসীদের জায়গায় অযাচিত অনধিকার চর্চা করছে তারা। মূলত এসবের কিছুই জানতো না আরু। জানতো না যে, একই রক্তমাংসের মানুষ হলেও তারা কেবল মুসলিম হয়ে নাকি বৌদ্ধদের আদিম এই আবাসের পবিত্রতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তবে কয়েকদিন ধরে শুনতে পাচ্ছিলো দূরের গ্রামগুলোতে নাকি বার্মিজ মিলিটারি বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, মানুষদের মেরে ফেলছে। সবকিছু শুনে একটু ভয় পেলেও সেই কথাগুলো এতটা গাঢ়ভাবে বিশ্বাস করেনি আরু। আঞ্জুমান নামের যে মেয়ের কাছে সে এই খবরগুলো পেয়েছিলো সেই মেয়েটিকে এমনিতেও গ্রামের তেমন কেউ একটা বিশ্বাস করে না। একটু বাড়িয়ে বলার বাতিক আছে মেয়েটার। তবুও সবকিছু শুনে সে একদিন তার স্বামীকে আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করেই বসে। অনেক চেষ্টায় সে তার স্বামীকে তার প্রশ্নটা ঠিক করে বোঝাতে পেরেছিলো। তার স্বামী উত্তরে সেদিন তাকে যা বলেছিলো তার মর্মার্থ অনেকটা এরকম যে, বার্মিজ সেনাদের চৌকিতে নাকি আক্রমণ করে বসেছিলো এই আরাকানেরই কিছু ছেলেপেলে। মুসলিম। মূলত আর্মি ওদেরকেই খুঁজছে। গ্রামে গ্রামে তল্লাশি চালানোর ব্যাপারটা আরুর স্বামীও কিছুটা শুনেছে। সে যেখানটাতে কাজ করে সেখানে প্রায়ই এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা ওঠে। তবে এটা নিয়ে এতটা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আরুর স্বামীর সহজ যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু তারা কারোর কোনো অপকার করেনি কোনোদিন-কাজেই তাদের সুন্দর এই জীবনটায় কারোর ভয়ে কুঁকড়ে থাকার আসলে কোনো যৌক্তিকতাই নেই। স্বামীর কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলো আরু। সেটাই তো। ওদের জীবনে কারোর বিন্দুমাত্র কোনো ক্ষতি করেনি ওরা। শুধু তিনজনের সংসারটাতে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্রষ্টার গড়ে দেয়া পৃথিবীটাতে কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন এনেছে। সেগুলো তো প্রতিটি মানুষই করছে, তাদের আদি পিতা-মাতারাও করে এসেছে। এতে তো আর তেমন দোষের কিছু থাকতে পারে না!

তিন

নাফিসা আশরাফ চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সিভিল সার্ভিসে আসার পর এই ক্ষুদ্র চাকরি জীবনে তিনি অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা কুড়িয়েছেন। লিখতে বসলে সেই অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে একটা দশ ফর্মার বই দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। উদাহরণ হিসেবে ঠিক এই মুহূর্তে তার কেবিনের পরিস্থিতিটা বলা যায়। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে একজন যুবতীকে দালাল শ্রেণির কিছু লোক কাজ দেয়ার কথা বলে নিয়ে এসেছিলো চট্টগ্রাম। এই ঘটনা খুব বেশি অপ্রতুল নয়। অনেক রোহিঙ্গা মেয়েকেই শহরে এনে দেহব্যবসায় লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। বিনা পুঁজিতে শুধু ভয় দেখিয়েই মাসে বেহুদা পয়সা আসছে। এর চেয়ে ভালো ব্যবসা আর কি হতে পারে!

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অনেক বিচিত্র। এই শহর কোনো দিক থেকেই রাজধানী ঢাকার থেকে কম যায় না। শহরের নান্দনিকতা বা কদর্যতা, মানুষের জীবনযাপনের ধরণ বা অপরাধের নকশা-সব কিছুই এলাকাভেদে বদলায়। রকমফের হয়। এখানটাতেও তাই হয়েছে। এখানকার অপরাধগুলো অনেকটাই অন্যরকম, অনেকটাই বিচিত্র। আগে একটা সময় এই দেশ থেকে হিউম্যান ট্রাফিকিং হয়ে লোক যেতো মধ্যপ্রাচ্যে বা বঙ্গোপসাগর হয়ে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে। এখন অবস্থা বদলেছে। মিয়ানমার থেকে অসহায় রোহিঙ্গাদের স্রোত এই দেশের দিকে আসা শুরু হওয়ার পর থেকে এই এলাকাগুলোতে অপরাধের সংজ্ঞা ভিন্ন মাত্রা নিয়েছে। আগে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আনা ও তা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য খুব অল্পসংখ্যক লোকই কাজ করতো। সেই ক্ষুদ্র চক্র এখন হয়েছে অনেক বড়, অনেক শক্তিশালী। অর্থের অভাবে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ছেলেপুলে থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও এখন মাদক চোরাচালান চক্রের বিশ্বস্ত ক্যারিয়ার। মাদক পাচার ছাড়াও অপহরণ, অস্ত্র পাচার বা পরিবহন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এমনকি পুলিশের উপর হামলা করার মতো অপরাধ ঘটানোরও নজির রয়েছে তাদের। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এই ছুটে আসা জনস্রোতকে আশ্রয় দেয়াটা বাংলাদেশের নৈতিক দায়বদ্ধতা ছিলো। কিন্তু বাস্তব দিক থেকে চিন্তা করলে, হঠাৎ করেই এই বিপুলসংখ্যক বাস্তুহারা জনগোষ্ঠীকে একটি সভ্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতে দেয়া উচিত হয়নি যারা কিনা মাঝে মাঝে এক থালা ভাত আর এক বাটি তরকারির জন্যও মানুষ খুন করতেও বাধ্য হতে পারে।

– ওসি সাহেব, আপনি বলতে চাচ্ছেন এই মেয়েটি কুতুপালং থেকে পালিয়েছে?

– হ্যাঁ ম্যাডাম। আমার কাছে প্রমাণও আছে।

– যেমন?

– আমার কাছে সোর্স ইনফরমেশন আছে।

– ওসি সাহেব, আমি এডমিনের লোক। পুলিশ ক্যাডারের না। পুলিশ সায়েন্স বা ক্রিমিনোলজি নিয়ে পড়িও নাই। তারপরেও আমার ধারণা সোর্স ইনফরমেশনকে ঠিক সেভাবে ‘প্রমাণ’ বলা যায় না। আপনার চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা এই সম্পর্কে কি বলে?

লম্বা টেবিলের সামনে বসে থাকা ওসি সাহেব হঠাৎ করেই কথার খেই হারিয়ে ফেলেন। এসআই কামরুলের কথা শুনে তার সাক্ষাৎ করতে না আসাটাই উচিৎ ছিলো। এই ভদ্রমহিলা গত আধঘন্টা যাবত তাকে একের পর এক কঠিন কঠিন কিছু প্রশ্নের ফাঁদে ফেলছেন। সাধন কর্মকারের উত্তরে হয়তো তিনি খুব বেশি মনঃপূত হতে পারছেন না। প্রতিবার সাধন বাবুর উত্তর শুনে শক্ত চোখমুখ করে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আর্দালিকে ডেকে বলছেন চা দিতে। এই চা দিতে বলাটাও সাধন সাহেবের কাছে একধরণের শাস্তি মনে হচ্ছে। প্রশাসনের লোকদের বোঝা বড়ই মুশকিল। এরা হাতেও মারে না, ভাতেও মারে না। ভাত খেয়ে উঠে এঁটো হাত দিয়ে মেরে বসে।

এরই মধ্যে সাধন কর্মকার চার কাপ চা নিয়েছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। অপারেশন আছে বা ডিউটিতে যেতে হবে বলে উঠে আসা যায় ঠিকই। কিন্তু এই ভদ্রমহিলাকে ওসি সাধন কর্মকার খুবই ভয় পান। মুখ থেকে এখনও তরুণীর কমনীয়তা সরেনি, প্রায় তার মেয়ের বয়সী। পার্থক্য হলো, চাইলেই নিজের মেয়েকে চায়ে চিনি কম হওয়ার অযুহাত দেখিয়েও প্রতিদিন সকালে অযথা তুলোধুনো করতে পারেন। অথচ এখানে ঝাড়ি খেতে খেতে চায়ের কাপ গুণছেন।

– সাধন বাবু, আপনি আমার কথা পরিষ্কারভাবে শুনুন। আমার এসিল্যান্ডকে আমি বলেছিলাম খোঁজ করতে। সে খোঁজ করেছে। সোর্স লাগিয়ে খোঁজ নয়, কাগজে কলমেই খোঁজ করেছে। সে আমাকে জানিয়েছে যে আরু খাতুন নামের এই মেয়ে মংডুর কাছাকাছি একটা গ্রাম গোকে পি এর বাসিন্দা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বিতীয় দলটির সাথে সে দেশে ঢুকেছে। কুতুপালং শিবির থেকে দালাল মহিবুরের মাধ্যমে সে প্রথম এসেছে কক্সবাজারে। সেখানে কয়েকদিন টর্চার করে ওকে দিয়ে হোটেল টাইগার সি তে দুই মাসের মতো এস্কর্টিং করানো হয়েছে। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে গেলে সেই দালাল তাকে এসে রেখে গেছে আনোয়ারার ওই পল্লীটাতে। আর ইউ ক্লিয়ার?

সাধন কর্মকার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। এই মহিলা এই জায়গায় বসে থেকে এতগুলো তথ্য এই সময়ের ভেতরে কিভাবে তুলে আনলেন সেটা আসলেই একটা রহস্যের বিষয়।

– জ্বি ম্যাডাম, এখন আমি কি করব?

– এরকম স্টুপিডের মতো প্রশ্ন করছেন কেনো! আপনি কি করবেন মানে? আপনি কালকের ভেতর ফোর্স রেডি করে যাবেন উখিয়া। আমার এসিল্যান্ডও আপনাদের সাথে যাবে, সার্কেল এএসপি জুয়েল ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি ডিসি স্যারের সাথেও কথা বলেছি। উনি উখিয়ার ইউএনওকে বলে দিয়েছেন। আর এসপিকে বলে সার্কেল এসপিকেও বলে রাখবেন।

– ম্যাডাম, বলতেছি কালকে আমার ছোট মেয়েটার জন্মদিন। আমার এসআইরে পাঠাই? সে খুবই সাহসী অফিসার, ছোট অফিসার বইলা পিপিএম বিপিএম পায় নাই। নাইলে ঠিকই পায়া যাইতো।

নাফিসা ওসি সাহেবকে কি বলবেন ঠিক বুঝে পাচ্ছেন না। তার ইচ্ছা হচ্ছে এই মুহূর্তে মধ্যবয়স্ক এই লোকটিকে আর্দালি ডাকিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে কেবিন থেকে বের করে দেয়ার। কিন্তু সেটা করা যাবে না। বিপিএটিসি থেকে তাদেরকে যে জিনিসগুলো শেখানো হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘প্রটোকল ভাঙ্গা যাবে না’ সম্পর্কিত ধারণা। সার্কেল এএসপি বা এসপিকে ডিঙ্গিয়ে তিনি যে অন্য ডিপার্টমেন্টের এই অফিসারকে ডেকে শাসাচ্ছেন সেটার জন্যও তাকে তার সিনিয়রের কাছ থেকে কথা শুনতে হতে পারে।

– ওসি সাহেব, একটা অসহায় রিফিউজি মেয়েকে চাকরির লোভ দেখিয়ে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে এসে তাকে দিয়ে এস্কর্টিং করানো হয়েছে-ইভেন সে প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থাতেও। একটা বোবা মেয়ে-তাকে দিনের পর দিন টর্চার সহ্য করতে হয়েছে। আপনি ভাবতে পারেন তার উপর দিয়ে ঠিক কি গিয়েছে? মেয়েটির সন্তানকে কেড়ে নেয়া হয়েছে আর এখনও আমরা জানি না সেই নিষ্পাপ শিশুটি আদৌ বেঁচে আছে নাকি তাকে মেরে গুম করে দেয়া হয়েছে। আর আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার মেয়ের জন্মদিনের দোহাই দিচ্ছেন?

– সরি ম্যাডাম। ইয়ে মানে, আমি অবশ্যই যাবো কালকে। আমি নিজে টিম লিড দিবো। ওই ফালতুটারে ধরে নিয়া আসবো।

ঘাড় নেড়ে নাফিসা ফাইলে ঠাসা এলোমেলো টেবিলে নিজের ফোন খুঁজতে খুঁজতে আবার ঘুরে তাকান সাধন বাবুর দিকে।

– ওসি সাহেব, আপনি কাল যাবেন না।

হাত কচলে সাধন বাবু কিছু একটা বলতে চাইছিলেন নাফিসা আশরাফকে। তার আগেই তার মুখে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আশার আলো নিভে যায়।

– আপনি আজকেই যাবেন। আমি আপনার সিনিয়র জুয়েল সাহেবের সাথে কথা বলছি। আজকে রাতের ভেতর পৌঁছে যাবেন। কাল অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগে আমি সাসপেক্টেডদের আমার সামনে দেখতে চাই।

একটু থেমে আবার যোগ করেন, আর শোনেন। আমার দিকে ব্ল্যাংক লুক দেবেন না। আমি আপনার ব্ল্যাংক লুককে ভয় পাই না। এখন আসতে পারেন।

সাধন কর্মকার চলে গেলে ল্যান্ডফোনটা টিপে বাসায় একটা ফোন করেন নাফিসা আশরাফ। ফোন তোলে তার আয়া।

– আয়া, মেয়েটাকে খাবার দেয়া হয়েছে?

– হ ম্যাডাম। হেতি মনে কয় আবড়া, কি কয় কিস্তাই বুঝে পড়ে না। খালি আউআউ করে আর কান্দে।

খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখেন নাফিসা। খুব ছোটবেলা থেকেই নিম্নবুদ্ধির মানুষদের কেনো যেনো একদমই সহ্য করতে পারেননা তিনি। তার ইউনিভার্সিটির এক বন্ধু বলেছিলো তার মতো মানুষদের নাকি ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’ বলা হয়ে থাকে। এরা নিজেদের আশেপাশে বুদ্ধিমান মানুষদের উপস্থিতিই কামনা করে, বুদ্ধিহীনদের নয়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, নাফিসা আশরাফকে যে পরিবেশে কাজ করতে হয় বা হচ্ছে সে পরিবেশের পুরোটাই ঘিরে রেখেছে এসব নিম্নবুদ্ধির মানুষেরা। এরা না পারে নিজের কাজটা করতে, না পারে অন্যকে তার কাজটা করতে সাহায্য করতে। মূলত এরা অনুঘটক হয়ে থেকে যায়। কেউ কাজে লাগাতে পারলে কাজে লাগলো, নয়তো মাসের মাস স্বাক্ষর করে সরকারি কোষাগার থেকে বেকার টাকা উঠিয়ে অলসের জীবনযাপন করবে।

চার

– স্যার, আমার কি অপরাধ সেইটা কি একবার জানতে পারি? আমারে এইভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো?

– তুই একটা বজ্জাত, থানায় নিয়ে তোর কাছ থেকে বজ্জাতগিরি শিখবো। এই কারণে। অন্য কোনো বিশেষ কারণ নাই। কারণ জাইনা শান্তি হইছে?

মহিব হলুদ দাঁত বের করে কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে বলে, জ্বি জনাব। ঠিক আছে। আগেভাগে জানতে পাইরা বড়ই উপকার হইলো। একটু থেমে আবার বলে, বেয়াদবি না নিলে আমার বুকপকেটের থেকে একটা জিনিস বের করে দিবেন? সাধন বাবু মহিবের দিকে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন। মহিব আবার দাঁত বের করে হাসে; না মানে, একটা সিগারেট খাবার ইচ্ছা হইতেছিলো। পকেটে সিগারেটের প্যাকেটও ছিলো। যদি একটু উপকারে আসতেন।

সাধন বাবু চোখ কটমট করে তাকান মহিবের দিকে। সেলের ভেতর পোরার আগে পর্যন্ত এর কোনো কথা বা আচরণেরই জবাব দেয়ার ক্ষমতা নেই তার। একে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে, অন্তত থানা পর্যন্ত।

পাঁচ

আয়েশা সর্দারের মনে হচ্ছে এত বড় যাত্রার জন্য এই সিটটা ঠিক ততটা আরামদায়ক না যতটা আরামদায়ক হবে বলে সে আন্দাজ করেছিলো। চট্টগ্রাম শহরের নারিকেলতলা থেকে এই অঞ্চলের বিপরীত অংশের দিকে কিছু বাস ছেড়ে যায় সন্ধ্যায়। তারই একটাতে উঠেছে সে। বাসের নাম ‘হাওর বিলাস’। বাসের সাথে হাওর বা হাওরে বিলাস করার কি সম্পর্ক সেটা সে ধরতে পারছে না। বাসের কণ্ডাক্টরকে ডেকে সিটের জন্য গালাগাল করতে ইচ্ছা হচ্ছে তার। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তাকে এখন থাকতে হবে মায়াবী হরিণের মতো, বাঘিনীর আচরণ এই অবস্থায় মানায় না। একটা জীবনকে বাঁচাতে সে ছুটে চলেছে নিজের ঠিকানা আর সাম্রাজ্য ফেলে। পৃথিবীর ইতিহাস এই পর্যন্ত অনেক সাম্রাজ্য বা সভ্যতাকেই বর্বরের তকমা দিয়েছে, কিন্তু সেই একই ইতিহাসের পাতা ঘেঁটেও নিজের সাম্রাজ্য সম্পর্কে নীচু মত পোষণকারী সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীকে খুঁজে পায়নি। একজন মারাত্মক মাত্রায় শোষক সম্রাটেরও তার গড়ে তোলা সম্রাটের প্রতি একটা গভীর মায়া থাকে, একটা ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। ন্যায়ের কাঠগড়ায় সেই সম্রাটকে জালেম প্রমাণ করা যেতেই পারে, তবে তারই গড়ে তোলা সাম্রাজ্যকে সে কখনোই ভালোবাসার খাতা থেকে কাটবে না। ভালোবেসে যাবে, ডুবে ডুবে ভালোবেসে যাবে। তার সাম্রাজ্যের নাগরিকেরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলেও ভালোবেসে যাবে।

আয়েশা সর্দার নিজের সাথে পলি নামের মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে। তারা চেপে বসেছে নেত্রকোণার বাসে। টানা তিন চারদিন এই বাচ্চা আর তার মাকে নিয়ে পল্লীর ভেতর বেশ একটা হল্লা হয়েছে। গতকাল সকালে এসে পল্লীর ভেতর থেকে আরুকে নিয়ে গেছে পুলিশ। আয়েশার খোঁজ করছিলো তারা, আর খুঁজছিলো বাচ্চাটাকেও। আয়েশা ওদের হাতে নিজেকে ধরা দেননি।

– কি! সোনা মানিক আমার! জাদু মানিক আমার! তোমারে কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। এই দেখো আমরা তোমারে নিয়া অনেক দূরে চইলা যাইতাসি। বাসে উঠছি, ভুম ভুম ভুম।

আয়েশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পলি। মাত্র কয়েকটা দিন আগেও এই মহিলা বাচ্চাটাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে যাচ্ছিলো। আজ এই বাচ্চাটার সাথে সাথে নিজেও কেমন যেনো বাচ্চাই হয়ে গেছে। কে বলবে এই মহিলাই চট্টগ্রাম শহর থেকে খানিক দূরেই একটা পল্লীর কর্ত্রী যেখানে সন্ধ্যা নামলেই সামান্য কয়েকটা টাকার বিনিময়ে শরীর বেঁচাকেনার পসরা বসে। ভালোবাসাকে যে কখনও টাকার বাইরে মাপেনি, হয়তো ভালোবাসা কি সেটাই জানে না-সেই আজ পাগলের মতো ছুটে চলেছে, উদভ্রান্তের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাও সেটা ভালোবাসার জন্য! কিন্তু কেন? কিসের জন্য?

এই সভ্যতা অনেক প্রশ্নেরই দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। এই প্রশ্নগুলো সেগুলোর কয়েকটি।

– শোন ছেমড়ি, আমি হইতাছি তোর শ্বাশুড়ি। তুই আমার ছেলের বউ। আর এই বাচ্চাটা তোর। কেউ যেনো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে আমরা কেউ কারোর কিছু হইনা। বিপদের মাঝে সবসময় সচেতন থাকতে হয়, সজাগ থাকতে হয়।

পলি কিছু বলে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আয়েশার দিকে। আয়েশা বাচ্চাটার কানের কাছে মুখ নিয়ে অদ্ভুত একটা কণ্ঠস্বরে তখনও বলে চলেছে, কি হইবো তোমার মানিক? কি হইবো হ্যাঁ? আম্মা ভালো আছে। তোমার কিচ্ছু হইবো না। ওরা তোমার কিচ্ছু করতে পারবো না। আমি আছি না? আমি আছি না?

দুধের বাচ্চাটা আয়েশার কথার কি বোঝে কে জানে! মুখটা বাঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ করেই চেহারায় কেমন যেনো একটা হাসি ছড়িয়ে দেয়। পলি বুঝতে পারে না এই বাচ্চা আদৌ আয়েশার কথা শুনে হাসছে নাকি সেটা শুধুই তার চোখের ভ্রম বা নিতান্তুই একটা নিছক ঘটনা।

ছয়

– নাফিসা! আমি তোমাকে বলেছিলাম মেয়েটার দিকে নজর রাখতে। তুমি কি করেছো আমি জানি না। আই ক্যান’ট টেক দিস এনিমোর। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ ইন মাই অফিস ইন নেক্সট ওয়ান আওয়ার! কিভাবে আসবে জানি না, আই জাস্ট ওয়ান্ট টু সি ইউর গাফি ফেস ইন নো টাইম।

ঠাস ঠাস করে কথাগুলো বলে রিসিভারটা শব্দ করে নামিয়ে রাখেন প্রণয় চাকমা। প্রণয় চাকমা নামের অসম্ভব এই খুঁতখুঁতে ও রাগী মানুষটি নাফিসা আশরাফের উর্ধ্বতন, তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। নাফিসা অনেক চেষ্টা করেছেন পুরো ঘটনাটা ব্যাখ্যা করার। কিন্তু এই ভদ্রলোককে কোনোভাবেই তিনি বুঝাতে পারছেন না যে আরু নামের এই মেয়েটি যে আত্মহত্যা করতে পারে সেটা সম্পূর্ণভাবে তার ধারণার বাইরে ছিলো। এ বিষয়টা প্রণয় চাকমাকে সামনাসামনিও বোঝানো যাবে কিনা জানেন না তিনি। নাফিসা আশরাফের মাথায় অহস্য যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথার ভেতরটাতে কোনো হিংস্র পশু হয়তো চার নখরের হাত দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে। চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে পারেন না তিনি। ঘন্টা দুয়েক আগেই মেয়েটার নিথর দেহ পাঠিয়ে দেয়া উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে, ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু এসব তো আনুষ্ঠানিকতাই কেবল। নাফিসা খুব ভালো করেই জানেন এই মেয়েটি তার বাড়িতে রাখা জীবানুনাশক তরলের পুরোটা গিলে আত্মহত্যা করেছে।

-ম্যাডাম, সিটি নিউজ থেকে বলছিলাম। শোনা যাচ্ছে, আরু খাতুন নামের এক রোহিঙ্গা যুবতীর মৃতদেহ আপনার কোয়ার্টারে পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে আপনি কি বলতে চান? তার সম্পর্কে কি আপনারা আসলে কিছু গোপন করতে চাচ্ছেন?

নাফিসা আশরাফ কিছু না বলেই ফোনটা নামিয়ে রাখেন। একবার তার টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়া চিরকুটটা নজরে আসে। সেখানে আরবি বা উর্দু হরফে গুটি গুটি হাতে কিছু একটা লেখা। এই চিরকুটটা আরুর মৃতদেহের পাশেই পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এটা হয়তো আরুর সুইসাইড নোট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের তার এক শিক্ষক বন্ধুকে এই চিরকুটের ছবি তুলে পাঠিয়েছিলেন নাফিসা আশরাফ। এখন দেখা যাক সেটার মর্মার্থ উদ্ধার করা যায় কিনা।

সাত।

– এই মামা, যাবেন?

– হ মামা, কোথায় যাবেন?

– নতুন কলা।

– উঠেন।

জহিরুল সাহেব এই ক্যাম্পাসটাকে খুব কাছ থেকে দেখছেন প্রায় বছর পনেরো হলো। এই দেশের তরুণেরা যখন ওইভাবে ফোন বা স্মার্টফোন চালাতে শেখেনি, তখনকার ঘটনা। দুটো ঝোলা ব্যাগ নিয়ে তিনি এসেছিলেন এই ক্যাম্পাসে। বাড়ি থেকে বোন আর মার পাঠানো চিঠি পড়ে কাঁদতে কাঁদতেই প্রথম বছরটা পার করে দিয়েছিলেন। তার পরের বছরগুলো খুব একটা খারাপ যায়নি। বিশাল পরিধির ক্যাম্পাস, চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অভয়ারণ্য এরকম একটা জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয় না। তিনিও মানিয়ে নিয়েছিলেন, খুব সহজেই। তার এই ছোট জীবনেও প্রেম এসেছিলো। আবার চলেও গিয়েছে। সেই সময়টাও খুব বেশি সহজ ছিলো না। হঠাৎ করে সাজানো সব কিছু কেমন যেনো বিচ্ছিরিভাবে বিগড়ে যেতে শুরু করেছিলো। মোটামুটি একটা ভালো রেজাল্ট নিয়ে স্নাতক স্নাতকোত্তর করে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন ইউরোপের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থিসিস করতে। তারপর পোস্টডকটাও সেরে ফিরে এসেছিলেন দেশে। সবাই খুব অবাক হয়েছিলো। এখন পর্যন্ত দেশের মেধাবী গবেষকরা বিদেশে গেলে তাদের মোটামুটি সিংহভাগই সেদেশের পাসপোর্টের স্বপ্ন নিয়েই যায়, কিন্তু জহিরুল কেনো যেনো তেমন কোনো স্বপ্ন দেখতে পারেননি। তার চোখে বারবার ভেসে উঠেছে ছয়শত সাতানব্বই একরের বিশাল এক রাজ্য যার কাছে প্রথম বিশ্বের কোনো দেশে থেকে প্রথম শ্রেণির জীবনযাপন করাও নস্যি।

তিনি ফিরে এসেছিলেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগদান করেছিলেন প্রভাষক হিসেবে।

রিকশাটা চলতে চলতে একটু থামে। হড়হড় করে বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ে উঠে যায়। জহিরুল সাহেব একটু চেপে বসেন। যদিও জহিরুল সাহেব জানেন যে হুড খোলা ভ্যানের মতো এই রিকশাগুলোতে উঠলে এই অভিজ্ঞতা সবসময়ই পেতে হবে তবুও তিনি ইচ্ছা করেই এই রিকশাগুলোতে ওঠেন প্রতিবার। এইসব তরুণ-তরুণীর শরীর থেকে ছুটে আসা তারুণ্যের উগ্র মাদকীয় গন্ধ, তাদের শশব্যস্ত ছুটে চলা জহিরুল সাহেবের ভালো লাগে। ব্যাপারটা হয়তো একটু বিচিত্র, তবুও তার ভালো লাগে।

– জহিরুল, তুমি যেমনটা বলছো সেটাই ঠিক। তুমি যথার্থ পাঠোদ্ধারই করেছো।

– হ্যাঁ, আমি জানি। তবু আমার মনে হলো একবার তোমাকে দেখিয়ে নিই। এই ‘পাঠোদ্ধার’ করার বিষয়ে তো তোমাকে গুরু মানা হয়। ভাবলাম গুরুর কাছে হাজিরা না দিয়ে যজ্ঞ শুরু করে দেয়াটা তো মহাপাপ। তোমার অফিসের পিয়ন বললো তুমি এখানের সেমিনারটাতে। তাই এখানেই চলে আসলাম।

নাঈম সুলতানা জহিরুল সাহেবের দিকে একটু আড়চোখে তাকান। দুজন একই বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন, একইসাথে বের হয়েছেন। একটা সময় টিএসসিতে কবিতা আবৃত্তি করতো এই সৌরভ জহিরুল, সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে তার গম্ভীর কণ্ঠে প্রেমের কবিতা শুনে প্রেমে পড়েছে এরকম যুবতীর সংখ্যা কম নয়। নাঈমা সুলতানাও তাদের একজন। তবে অন্যদের মতোই, ওভাবে বলা হয়নি কখনও।

– আচ্ছা, কেমন হয় যদি আমি এই রোহিঙ্গা মেয়েটিকে বিয়ে করে নিই? এই বিষয়ে আইন কি বলে জানতে হবে। তোমার পরিচিত কোনো ল’ইয়ার আছে? আমি বাচ্চাটাকেও দত্তক নিতে চাই।

– তুমি কি তাহলে ঠিক করেই নিয়েছো যে এই মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করবে?

– হ্যাঁ। হঠাৎ করেই এই মেয়েটাকে কেনো যেনো খুব আপন লাগছে। ওর চিঠিটার অর্থ বের করার পর মনে হচ্ছে আমি যেনো মেয়েটাকে অনেক দিন ধরেই চিনি, সে আমার পূর্বপরিচিতাদের একজন।

নাঈমা সুলতানা কিছু না বলে খুবউকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। একবার ভাবেন জহিরুলের কাছ থেকে চিঠিটা আর একবারের জন্য চেয়ে নেবেন কিনা। এতদিন তিনি জানতেন বা তার এরকমটা ধারণা ছিলো যে প্রীতিলতা হলে বসে লেখা চিঠিটা হয়তো তখন জহিরুলের কাছে পৌঁছায়নি। কিন্তু জহিরুলের সব কথাবার্তা শুনে সে বুঝতে পারছে না ঠিক কেনো তার কাছে ওই মেয়েটিকে পরিচিত লাগছে, কেনো মনে হচ্ছে সে পূর্বপরিচিতাদের একজন। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে মেয়েটি চিঠিতে ঠিক সেভাবেই নিজের কথাগুলো লিখেছে যে অসহায়ত্ব নিয়ে একদিন নাঈমা জহিরুলকে চিঠিটা লিখেছিলো। নাঈমা সুলতানার মন উসখুস করতে থাকে, সে কিছু বলবে কিনা ঠিক করে উঠতে পারে না।

আট

প্রণয় চাকমা বিরস মুখে বসে আছেন। অনেক আগেই উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে শুন্যপদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই কর্মস্থলে যোগদান করেছেন দশদিন হলো। এই কয়েক দিনের ভেতরেই তার চাকরি জীবনের সবচেয়ে বাজে ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ারার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ভদ্রতাবশত হলেও এই ভদ্রমহিলাকে বসতে বলাটা উচিৎ ছিলো। কিন্তু প্রণয় চাকমা এখন এসব জাগতিক আচরণ সংহিতার বাইরে। গত কয়েক ঘন্টায় টেলিফোনে বিভাগীয় কমিশনার থেকে শুরু করে দুই মন্ত্রণালয়ের দুইজন সচিবের রাগি গলার হুমকি-ধামকি শুনতে হয়েছে তাকে। আর কি একটা অনলাইন নিউজের ইডিটর ফোন করে তো এক প্রকার শাসিয়েই গেলো তাকে। এতসব কিছুর পরেও এখনও একটা বিষয় তার মাথায় ঢুকছে না। একটা রোহিঙ্গা মেয়ে, যে কিনা সব কিছু ত্যাগ করে এই দেশে শরণার্থী হয়ে এসেছে তার এতটা অসহায় অবস্থার মধ্যেও সামাজিক মর্যাদা বা এই সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যার কথা মাথায় আসে কি করে?

আর্দালিকে ডেকে পানি দিতে বলবেন এমন সময় দেখলেন মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নাফিসা আশরাফ। কেনো যেনো হঠাৎ করে মাথায় রক্ত উঠে যায় তার।

– হোয়াট ননসেন্স! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছ কেন? আমি কোনো কিন্ডার্গাটেন স্কুলের প্রিন্সিপাল না আর তুমি ক্লাসমেটের টিফিন চুরি করে খেয়ে ধরা পড়া কোনো ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া বাচ্চা মেয়েও না।

নাফিসা আশরাফ নিজেকে সামলাতে পারেন না। কাঁদতেই থাকেন। তার চোখ বেয়ে পড়া অশ্রুতে ফোনের স্ক্রিন ভেসে যায়। চোখে ঝাপসা দেখতে দেখতে একটা চেয়ার টান দিয়ে বসেন। হাত বাড়িয়ে প্রণয় চাকমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দেন তিনি। রিডিং গ্লাসটা খুঁজে বের করতে একটু বেগ পেতে হয়। সেটা চোখে দিয়ে প্রণয় চাকমা পড়তে শুরু করেন। একবার বিরক্ত মুখে একটু দরজার দিকে তাকান। বাইরে মানুষ গিজগিজ করছে এটা প্রায় সিকগালা একটা ঘরে থেকেও তিনি বুঝতে পারছেন। সবাই আজকে শুধু তাকে প্রশ্ন করবে এবং তাকে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে-এটা ভাবতেই কেমন যেনো একটা অস্বস্তিকর লাগছে। একবার আয়েশা আশরাফের দিকে তাকান চোখ তুলে। চোখে রাগটা ধরে রাখতে পারেন না, পড়ে যায়। আবার চোখ নামিয়ে পড়তে শুরু করেন।

“আমি আরু খাতুন। মংডুর কাছাকাছি গো কে পির বাসিন্দা। ছিলাম, এখন আর নই। এখন আর কোনো কিছুরই বাসিন্দাই নই। আচ্ছা, আমার ঠিক কি দোষ ছিলো? ঠিক কি কারণে আমার পরিবার, আমার স্বামী সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে চাইবো না। কেনো আমার দুধের শিশুকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সেই উত্তরও আমি জানতে চাই না। শুধু একটা কথাই বলতে চাই, এই শিশুটি কোনো অপরিচিত পুরুষের বীর্য থেকে জন্ম নেয়নি। এই শিশুটির বাবা আমার খুব পরিচিত, বছরখানেক আগেও আমি রাতে তার বাহুতে নিজেকে গুঁজে দিতাম। আমি চাই না আমার শিশু জানুক তার মা তাকে গর্ভে নিয়ে অজানা দেশের কোনো এক বেশ্যাপল্লীতে পালা করে একেকবার একেক পুরুষের সাথে বিছানায় গিয়েছে। আমার ছেলেটার জন্য যদি কেউ পারেন, আমাকে ভুলে যাবেন। আমার সন্তানকে যেনো কোনোদিন মাথা নিচু করতে না হয়। জানি না ওর বাবা হওয়ার জন্য কেউ আছে কিনা, জানি না ওর মা হওয়ার জন্য কেউ আছে কিনা। তবে এটা জানি, হাজার অমানুষের ভিড়েও এই পৃথিবীতে এখনও অনেক মানুষ বেঁচে আছে। তারা এগিয়ে আসবে।”

নাফিসা আশরাফ তখনও ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছেন। এবং অবাক হয়ে দেখছেন, প্রণয় চাকমার চোখও আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে।

ফরিদুর রেজা খান। কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষার্থী। জন্ম ৬ এপ্রিল। জন্ম বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলায়। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করছেন। প্রকাশিত বই: 'তখন আঁধার ছিলো' (উপন্যাস)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..