রজকিনী রামি
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মিরিক লেকের পাশে বিকেলে যেন মেলা বসে যায়। সূর্য ডুবতেই ঝপ করে ঠাণ্ডা নেমে আসবে। লেকের ওপর ব্রিজ। আমি কবি হলে বলতাম “ব্রিজ অন রিভার কোয়াই”। তা আমিও কবি নই, আর মিরিক লেকটাও প্রাকৃতিক নয়। নেহাতই মানুষের হাতে তৈরি। একটা জলা জায়গাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার লেক বানিয়ে ফেলেছেন। চারপাশে টিলার মতো পাহাড় সেখানে পাইনের বন। জলচর পাখিরা সন্ধ্যা হবে টের পেয়ে বাসায় ফিরছে। ব্রিজের উপর একটা শাদা ঘোড়া দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে চিঁ হিহিহি করে উঠছে। যেন তার চালককে বলতে চাইছে, আর কেন, এবার ঘরে চলো।
“দি উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যাণ্ড ডীপ,
বাট আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কীপ,
অ্যাণ্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লীপ,
অ্যাণ্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লীপ”
রবার্ট লী ফ্রস্টের কবিতা। আমার জন্মের বছর ১৯৬৩তে তিনি মারা গেছেন, আর আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে ১৯২২ সালে তিনি কবিতাটা লিখেছেন।
আমি ফিরন্ত বলাকার দল দেখে বললাম, সব পাখি ঘরে ফেরে।
এমন সময় দেবস্মিতা খেপে উঠে ধমকের সুরে বললেন, যার ঘর নেই, সে কি করবে, ভেবে দেখেছেন কখনো?
আমি সংকুচিত চিত্তে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, কেউ তাঁর কথা শুনে ফেলেছে কি না। দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে হরেক বাঙালি মিরিকে একটু উঁকি মেরে যায়। ওদের কাছে মিরিক মানে মিরিকের কৃত্রিম লেক। একটা মারকাটারি সুন্দরী মেয়ে কেন মাঝবয়সী একটা লোককে ধমক দিয়ে কথা বলল, আর দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কি, তা নিয়ে ওরা কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে।
আমি দেবস্মিতার দিকে তাকালাম। মেয়েটির মিষ্টি মুখখানি দুষ্টুমি মাখানো। জলপাই রঙের তেলটান ত্বকে কোনো ন্যাকামি নেই। পুরো গা ঢাকা পোশাক ইচ্ছে করে বুকের কাছে বিপজ্জনক গভীরতায় লাফ দিয়েছে। আর সেখানে একটি হিরের পেনডেন্ট আমার চোখকে কয়েকবার আকর্ষণ করেছে।
বললাম, দেখুন, ওটা একটা কবিতার লাইন। বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা বনলতা সেন। আমি কবি নই। ভেতরের কথাটা জানি না। পাখিদের ফিরতে দেখে বলেছি। মনে পড়ে গেল কি না।
দেবস্মিতা বললেন, আপনি প্রেম করেন নি কখনো, তাই না?
আমি বেশ একটু অবাক হলাম। থতমত খেয়ে বললাম, বিয়ের পর প্রেম করতে সুযোগ পেয়েছি।
আমাকে মিষ্টি একটা ভর্ৎসনা করে তিনি বললেন, ধুর মশাই, প্রেম বলতে আমি লাভ মেকিং বলি নি। বিয়ের পর বৌরা তো আপনাদের বাঁধা গরু। তাকে যেমন ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে ভোগ করা যায়। মুখে বলেন ঘর করছি। আসলে মেয়েদের আপনারা একটা জ্যান্ত পুতুল মনে করেন। তার নিজের কোনো অস্তিত্ব স্বীকার করেন না আপনারা।
দেবস্মিতাকে বললাম, আপনি কোনো কারণে খুব ঝঞ্ঝাটে আছেন। চলুন, এবার আমরা ফিরে যাই। আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরব।
একটা রহস্যময় ভ্রূকুটি করে তিনি বললেন, আপনি বাসায় ফিরে যাবেন, আর আমি একা একা হোটেলে ফিরব?
মনে মনে বললাম, তা বাপু আমি নেহাতই ছাপোষা জড়ভরত লোকটা। কোনো মতে চাকরি বাঁচিয়ে রিটায়ার করে পেনসনের টাকায় দিন গুজরান ছাড়া আর কিছু জানি না। নইলে, অন্য কিছু ভাবা যেত। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সহসা একবার ঠোঁট চেটে নিলাম।
আমার ঠোঁট চাটা দেখেই খেপে গেলেন দেবস্মিতা। কি ভাবেন কি আমাকে, বেশ্যা?
আমি কোনো জবাব দিতে সাহস পাই না। সত্যি সত্যি মুহূর্তের শতভাগের একভাগের জন্য হলেও ও মেয়ে অঘটনঘটনপটীয়সী কি না, আমি ভেবেছিলাম। প্রাচীন সাহিত্যে মেয়েদের বর্ণনায় শরীরের বর্ণনাই আসল। “স্তনাভ্যাং স্তোকনম্রাং শ্রোণীভারাদলসগমনাং” এইভাবে কালিদাস বিরহকাতরা সুন্দরীকে এঁকেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে এসব ট্যাবু।
দেবস্মিতা বললেন, কি হল, জবাব দিচ্ছেন না যে? খুব শস্তা মেয়ে ভাবছেন না আমায়?
দেখুন, আপনার সাথে সবেমাত্র আমার সেদিন পরিচয়। বুমকুলুং এ নদীর কাছে ওই দিন ইকো ট্যুরিজম এ আপনার সাথে প্রথম আলাপ। আজ আজ এই দ্বিতীয় বার আপনি এসেছেন মিরিক।
ঠোঁট ফুলিয়ে সুন্দরী বললেন, কিন্তু, এরমধ্যে রোজ কতবার করে আপনি আমাকে ফোন করেছেন খেয়াল আছে? আমি ইচ্ছে করে কতবার ধরি নি।
সাফাই গাইতে বললাম, দেখুন, ফোন ধরলে হয় তো বারবার ফোন করতাম না। তাছাড়া আপনার বলার সুযোগ ছিল যে আপনার কথা বলার ইচ্ছে নেই।
দেবস্মিতা বললেন, কাউকে শক্ত করে কথা বলা আমার ধাতে নেই। ওইজন্যে আমার এত সমস্যা। নইলে প্রথম দিনেই আপনাকে আমার কাটিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
অবাক হয়ে বললাম, কেন বলুন তো?
ইশশ, আপনি যে রকম জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমার খুব রাগ হচ্ছিল।
একগাল হাসার চেষ্টা করে বললাম, আসলে আপনাকে ওই সবুজ পার্কের মধ্যে খুব ভালো লাগছিল।
সে মেয়ে বলল, উঁহু, আমায় নয়। আমার পোশাকটা। বা শরীরের যে খানিকটা পোশাক দিয়ে ঢাকা ছিল না, সেটুকু। বলুন, অস্বীকার করতে পারবেন? আর তাতেই ধরে নিলেন আমি কলগার্ল, বেশ্যা।
বললাম, সত্যি, আপনার পোশাকটা সেদিন পনেরো ষোলো বছরের খুকির মতোই ছিল। কে বলবে, আপনি একটা দশ বছরের ছেলের মা।
দেবস্মিতা বললেন, দেখুন, কে কি পোশাক পরে থাকবে, ঘুরবে, সেটা সম্পূর্ণ ভাবে তার ব্যক্তিগত অধিকার।
মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললাম, আমি কিন্তু আপনাকে সে ব্যাপারে কিছুই বলি নি।
দেবস্মিতা একটা ভ্রূকুটি করে বলল, আরে মশাই আপনি বলবেন কেন?
হতবুদ্ধি হয়ে আমি তাঁকে বললাম, তাহলে আমি যখন কিছু বলি নি, সে নিয়ে আপনি রাগ করেন কেন? একটু বায়বীয় হয়ে যাচ্ছে না?
দেবস্মিতা বলল, না হচ্ছে না। আমি আপনার অ্যাটিটিউডটা খেয়াল করেছি। প্রথম দিন বলে কিছু বলি নি। আজ পুরো গা ঢাকা এতবড় জামা পরেছি, তবু আপনার চোখ আমার বুকের খাঁজে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কিছু টের পাইনি বলতে চান?
বলতে ইচ্ছে হল, বুকের মাঝে যে হিরেটি রেখেছ, সেটি দেখানোর চেষ্টা কি তোমার তরফে ছিল না সুন্দরী?
সহসা দেবস্মিতার বুকের খাঁজের হিরেটা থেকে একটা কমলা নীলচে আলো ঠিকরে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ঠাকুরমা বলতেন, অমি জলের কাছে কোনো মারকাটারি অচেনা সুন্দরী মেয়ে দেখলে কাছে যাবি নি। ওরা যাদুকরী। জলপরী। মেয়ে সেজে বোকাসোকা ছেলেদের লুভিয়ে বেড়ায়।
আমি ঠাকুরমার গলা জড়িয়ে ধরে বলতাম, তুমি থাকতে আমার আর কোনো সুন্দরী লাগবে না। তুমিই আমার সেরা গার্লফ্রেন্ড।
ঠাকুরমা বলতেন, বোকামি করিস নি ভাই। জলের কাছে ডানাকাটা সুন্দরীদের কাছে ভুলেও যাবি না। না যাইও জলের ধারে।
ঠাকুরমাকে বলতাম ফিজিক্স অনার্স পড়ছি ঠাকুরমা। সব মেয়েকে বাজিয়ে নেব।
ঠাকুরমা হাসতেন। তিনি রোমিও জুলিয়েট নিশ্চয়ই পড়েন নি। আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি। কিন্তু তাঁর হাসি দেখে মনে হয়েছিল, বলতে পারেন, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ হোরেশিও, দ্যান আর ড্রিমট ইন ইয়োর ফিলজফি।
ঠাকুরমাকে বলতাম, বুড়িসোনা, তোর তো ছোট্ট বেলায় বিয়ে হয়ে ছিল। প্রেম কি জিনিস জানতে পেলি কই?
খই মুড়কি ক্ষীরের সন্দেশ দিয়ে মেখে আমার গালে পুরে দিতে দিতে ঠাকুরমা হাসতেন। তাঁর অতলান্ত চোখের গভীর থেকে কে বলত, লাভ ইজ হেভি অ্যাণ্ড লাইট, ব্রাইট অ্যাণ্ড ডার্ক, হট অ্যাণ্ড কোল্ড, সিক অ্যাণ্ড হেলদি, অ্যাস্লীপ অ্যাণ্ড অ্যাওয়ার — ইটস এভরিথিং এক্সেপ্ট হ্বোয়াট ইট ইজ।
বারান্দায় দোলনা চেয়ারে আধো শুয়ে থাকতেন তিনি। আমি কলেজ থেকে ফিরে কাছে গেলে বলতেন ওই চাঁদকে সাক্ষী করে কোনো কাজ করবি নি। ঠাকুরমা তো ইশকুলে যান নি। জানার প্রশ্নই ওঠে না, ডু নট স্বোয়্যার বাই দ্য মুন ফর শি চেঞ্জেস কনস্ট্যান্টলি, দেন ইওর লাভ উড অলসো চেঞ্জ। আমার বউ এলে অর্পিতাকে বলেছিলেন আমার লাভারটাকে তোমায় দিলাম। যত্ন করে আঁচলে বেঁধে রেখো। আমার সাদামাটা বৌ ঠাকুরমার ঠাট্টা বুঝতে পারেনি।
আমাকে ঠাকুরমা ডাকতেন হরিদাস। তাঁর নিজের নাম ছিল হরিদাসী। কিন্তু কেউ তাঁকে নাম ধরে ডাকত না। ঠাকুর নাম উচ্চারণ হবে বলে আমাকে হরিদাস বলতেন। কখনো বলতেন হরে। একতলার দালানে লাল রঙের মেঝেয় পদ্মফুল আঁকিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুরদা। আমি পায়ে সোনার মল পরে পদ্মফুলের উপর নাচতাম। ঠাকুরমা হাততালি দিয়ে বলতেন আমার হরিদাস দিব্যপ্রেমে মাতোয়ারা। বলতেন সর্বস্ব হরির চরণে সমর্পণ করো। পিসিমা এসে বলতেন, ওইটুকু ছেলে ওইসব ভারি ভারি কথা বোঝে? তখন ঠাকুরমা বলতেন কি নাচ নাচলে গো, কত মেয়ের মন জয় করবে গো!
মা সেই শুনে, রাগ করে, দুধ খাওয়ানোর ছলে, আমায় তুলে নিয়ে যেতেন।
দূর থেকে ঠাকুরমা হাতছানি দিয়ে ডাকছেন সরে আয়, চলে আয়।
আমি চলৎশক্তিহীন জড়বৎ নির্বাক। মাথাটা বুকের মাঝে টেনে নিলেন দেবস্মিতা। একটা সুরভি আমার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আমাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলছে।
ঠাকুরমা বলছেন, এ তুই কি করলি হরিদাস? জলের ধারে কেন গেলি? মনে পড়ল, দেবস্মিতাকে প্রথম দেখেছি বুমকুলুঙ এ বালাসন নদীর ধারে। জলের কলকল ছিল সেখানে। আর এবার মিরিক লেক। জল এখানে স্থির। অব্যক্ত আতঙ্কে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদস্রুতি। পরম মমতায় নিজের রুমাল দিয়ে আমার কপাল মুছে দিচ্ছেন দেবস্মিতা। তারপর আমি বদলে গেলাম। যাদুকরী আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল সাতাশ বছর আগের তারিখে আমার পুরোনো শহরে।
সাতাশ বছরের সাজোয়ান অভিষেকের পাশে তেইশ তন্বী অর্পিতা। কবে থেকে অর্পিতাকে জানতাম। ওর বাড়িতেও গিয়েছি কতবার। কখনো মনে হয় নি অর্পিতা আমার বিশেষ কেউ। একদিন চাঁদ উঠল নারকেল গাছের পাতা ছাড়িয়ে ওপরে। আমার বুকের ভেতর ভীষণ মোচড় দিয়ে কে গেয়ে উঠল, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…
পরদিনই বিকেলে অর্পিতার বাড়ি গিয়ে তাকে বললাম, সে কেঁদে আমার বুকে মুখ লুকোলো। তার বাবা মাকে যেই সে কথা বললাম, তাঁরা বললেন, তাঁরা নাকি সব জানতেন। বাড়িতেও দেখলাম সবাই সব জানে। শুধু আমিই জানতাম না। ঠাকুরমা বললেন, আমাকে পর করে দিলি ভাই? আমি ঠাকুরমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি যে কি বলো না? পর হবে কেন? বরং তোমার নিজের লোক আর একটা হল!
বৃদ্ধা ফোকলা দাঁতে হাসতেন।
সে সব যেন কতদিন আগের কথা। এক বহুমাত্রিক জগতের বিভিন্ন তলে আমি লোকটা ঘুরে বেড়াচ্ছি। কে একটা হরিদাস! এখন মিরিকে আমি পোস্টেড। রিটায়ারমেন্টের আর বেশি বাকি নেই। মনে মনে বলি, জীবন এত ছোট কেনে! সারা রাত নির্ঘুম কাটে। আর অফিস করতে করতে ঝিমিয়ে পড়ি। সুইপার কাম হেল্পার অনিতা দি ডাকল, সাব, ইভনিং হো গ্যয়া। মুঝকো ঘর যানা হ্যায়। সবাই ঘরে যাবে। সব পাখি। কপালের বিনবিনে ঘাম রুমালে মুছতে গিয়ে দেখি, সেটা একটা লেডিজ রুমাল। কোণে রেশমি সুতোয় লেখা “D”।
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..