মিলির পালিয়ে যাওয়া

রওশন হক
গল্প
Bengali
মিলির পালিয়ে যাওয়া

হুট করেই ফ্লোরিডা মুভড হয়ে গেল মিলি। বলা যায় একা একাই সামাল দিল সব। মেয়েকে হস্টেলে দিয়ে বড় বাঁচা বাঁচল সে। মেয়ে পুরো বাপের স্বভাবচরিত্র পেয়েছে। এই মেয়ে যত দূরে থাকে ততই ভালো; ইদানীং তার জন্য মিলির আর যেন মায়া লাগে না!

লং আইল্যান্ডের বাড়ি বিক্রি করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সোহানেরই কেনা বাড়ি। সেখানে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই সেই শহর ছেড়েই পালাতে চেয়েছে সে। রিয়েলটর বন্ধু ব্রিটনির মাধ্যমে বাড়িটা ঝামেলা ছাড়াই বিক্রি করতে পারল। ওই টাকায় মেয়েকে ডর্মে দিয়ে ফ্লোরিডায় পাড়ি দিল সে।

ওই ব্রিটনির মাধ্যমেই মিলি চাকরি জোটাতে পেরেছে একটা বারে। ভাগ্যিস, নিউইয়র্কে থাকার সময়ই তার বারটেন্ডারের লাইসেন্স নেওয়া ছিল। তবে লাইসেন্স নেয়া থাকলেও আগে কখনো সে এ ধরনের কাজ করেনি। অভিজ্ঞতার মধ্যে শুধু বেবিসিটিংয়ের আছে ওর। কোথাও বেবিসিটিং করতে হলে আগে শিশুদের রাখার উপযোগী ভালো বাড়ি নিতে হয়। ভেবে দেখেছে এই কাজে হাত দিতে কিছু সময় লাগবে। এ বয়সে এসে বারে কাজ পেয়ে যাবে, এটা ও কোনো দিন ভাবেনি। তা ছাড়া কাজটা করতে কষ্টও হচ্ছে। নিয়মিত মদ্যপায়ী না হয়ে হাজার রকমের মদের নাম মুখস্থ করা খুব সহজ কাজ নয়।

লাইসেন্স নেয়ার প্রস্তুতির সময় বিখ্যাত বারটেন্ডার অ্যাডা কোলম্যানের নাম অনেক শুনেছে মিলি। তেইশ বছর ধরে তিনি লন্ডনের স্যাভয় হোটেলে হেড বারটেন্ডার ছিলেন। কৌতূহল থেকে সে সময় তাঁর সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করেছিল। মিলি জেনেছে স্যাভয়ে কাজ করার সময় তিনি ‘হাঙ্কি পাঙ্কি’ নামে একটি ককটেল-টি আবিষ্কার করেছিলেন। খেতে নাকি দারুণ, বেশ জনপ্রিয় ককটেল এটা।

রাজশাহী শহরের মেয়ে মিলি। পড়াশোনা শেষ না করেই সোহানের সঙ্গে এ দেশে চলে আসে। মিলি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে; ইংরেজিতে সেকেন্ড ইয়ার শেষ হয়নি তখনো, সোহানের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায়। গায়ের রং শ্যামলা হলেও লম্বা আর শরীরের গড়নের জন্য ক্যাম্পাসের দুয়েকজন মিলিকে তখনই পাওলি নামে ডাকত। পাওলি মানে কলকাতার নামি নায়িকা পাওলি দাম। মিলি নিজেও বুঝত তার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আর কারো নেই। ওর সৌন্দর্য অন্য রকম। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ওর জীবন প্রেমে ভরপুর। যেখানেই যায় সেখানেই ছেলেদের কেউ-না-কেউ তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে। সে নিজে অবশ্য কাউকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না, আবার সরাসরি না-ও বলে না। মোটামুটি সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলত তখন তার দিনকাল।

রাজশাহীতে ওর বাবা ছোট একটা গ্রোসারি দোকান চালান। মা একটা আধা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। মিলির মা-ও খুব সুন্দরী। মিলির তিন ভাই। রিয়াদ, রিয়াজ ও রিজভী। সবাই ওর ছোট। তিনজনই পড়াশোনায় ভালো। মা-ই তাদের পড়ায়। বাবা ব্যস্ত দোকান নিয়ে; মায়ের ব্যস্ততা স্কুল আর তাঁর ছেলেদের নিয়ে। মিলির দিকে তাঁদের তেমন নজর নেই। তাঁদের বুকজুড়ে আছে কেবল তিন ছেলে। মিলি বড় মেয়ে। পড়াশোনার ফাঁকে ঘরের সব কাজও করতে হয়। অবশ্য ঘরের কাজ সে মন দিয়ে করত।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরে খুশির সীমা ছিল না ওর। তবে এর চেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার তার হোস্টেলে সিট পাওয়ার দিনটা। মিলির মনে হয়েছিল হোস্টেলের সিট তো নয়, যেন ওড়ার জন্য স্বাধীন আকাশ পেয়ে গেছে।

বাবা-মা আর সবাই এসে হোস্টেলে রেখে গিয়েছিল ওকে।

এবার মিলি পুরোপুরি স্বাধীন! থাকো তোমরা তোমাদের ছেলেদের নিয়ে, মনে মনে মা-বাবার উদ্দেশ্যে বলেছিল মিলি।

হোস্টেলে মিলি রুমমেট হিসেবে পেয়েছিল শিলাকে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় শিলার সঙ্গে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ওখানেই সোহানের সঙ্গে দেখা। সেখানেই ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওদেরই আরেক বন্ধু জিসান। প্রথম পরিচয়ের সময়ই সোহানকে ভালো লেগেছিল মিলির।

সোহান স্মার্ট। বড় ব্যবসায়ী। চারটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে ওর। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মিলিকে সে খেয়াল করলেও তেমন মনোযোগ দেয়নি।

মিলি তখন ভেবেছে এ কী হলো তার জীবনে! একজন মানুষকেই তার পছন্দ হলো, সে কিনা মাঝবয়সী এক লোক!

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সেদিন রাত গভীর হয়েছিল। মিলি আর শিলা জিসানের বাসাতেই থেকে গিয়েছিল রাতে। ঠিকমতো  ঘুম হয়নি মিলির। সোহানের কথা ভাবছিল বারবার। ইউনিভার্সিটির ছেলেরা রীতিমতো লাইন ধরে থাকে ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে! আর সোহান কিনা একবার তাকায়ও নি তার দিকে! মিলি ঠিক করল সোহানের ফোন নম্বর জোগাড় করে কথা বলবে।

সকালে নাশতার টেবিলে সবার সঙ্গে রাতের পার্টি নিয়ে গল্প আর সঙ্গে ছবি দেখাদেখি চলছিল। হঠাৎ সোহান এল। সে নাকি রাতে মোবাইলফোন এবং ব্যাগ ফেলে গেছে। সেসব নিতে এসেছে। জিসান বলল, ভাইয়া, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিলেই হতো। আপনি আসতে গেলেন কেন শুধু শুধু কষ্ট করে! আপনার সময়ের দাম তো আমি বুঝি!

মিলিও এমনটাই ভেবেছিল। বড়লোকেরা সাধারণত এসব ছোটখাটো কাজ ড্রাইভার বা অফিসের লোক দিয়েই করায়।

খাবার টেবিলে বসে অন্যদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে সোহানকে দেখছিল মিলি। মানুষটা সত্যিই সুন্দর আর স্মার্ট! এই বয়সেও শরীরে কোনো মেদ নেই। এরই মধ্যে সোহান বলছে, বড় ছেলেটা আজ স্কুলে যায়নি। তাই বউ ছোট ছেলেকেও স্কুলে পাঠায়নি।

মিলি বুঝল সোহানের দুই ছেলে।

মিলি আর শিলা বের হচ্ছিল। তখন সোহানও বিদায় নিয়ে বের হয়ে এল। বের হতেই শিলা সোহানকে বলল, ভাইয়া আমাকে একটু ধানম-িতে একটা অফিসে ড্রপ করতে পারবেন?

সোহান জানতে চাইল ওখান থেকে কীভাবে যাবে তোমরা?

মিলি উত্তর দিল, ওখান থেকে বাস নিয়ে নেব।

মিলি দেখল সোহানের সঙ্গে কোনো ড্রাইভার নেই। সে বসল পেছনের সিটে। শিলা ও সোহান গল্প করতে করতে ধানম-িতে পৌঁছে গেল। মিলি জানত না শিলার অন্য কাজ আছে। শিলা গাড়ি থেকে নামার আগে সোহান মিলিকে প্রশ্ন করল, আপনারও কি এখানেই কাজ নাকি?

শিলাই উত্তর দিল, না ভাইয়া। ওর কোনো কাজ নেই। আমার কাজ শেষ হলে এক সঙ্গে ফিরব। তা ছাড়া ও এখনো রাস্তাঘাট চেনে না। হারিয়ে যেতে পারে।

সোহান বলল, তাহলে উনি থাকুন। তুমি কাজ সেরে আসো। ফোন দিয়ো আমি ওনাকে তোমার কাছে পৌঁছে দেব।

আমার কিছু কেনাকাটা আছে। মিলি আমাকে একটু হেল্প করুক। তুমি তোমার কাজ শেষ করে এসো।

সেদিন থেকে মিলি পেল নতুন এক জীবন।

শিলা চলে যেতেই সোহান মিলিকে সামনের সিটে আসতে বলল।

মিলি বাধ্য মেয়ের মতো সামনের সিটে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসল। এই প্রথম কোনো দামি গাড়ির সামনের সিটে বসেছে। মিলির গায়ে কালচে মেরুন রঙের সুতি শাড়ি। এতসব ব্যাপার আজকে হবে আগে জানলে মিলি ভালো একটা জামা পরে আসত। এসব ভাবতে ভাবতে সামনে দেখছিল সে। মনে হলো সোহান ইচ্ছা করেই গাড়ি স্লো চালাচ্ছে। সোহানই প্রথম কথা বলল, কাল রাতে বারবার আমার দিকে কী দেখছিলে?

মিলির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, সোহান তাহলে সবই লক্ষ্য করেছিল। সে কোনো বাহানা না করে সোজাসুজিই উত্তর দিল, আপনাকে দেখতে ভালো লাগছিল, তাই।

তাহলে এখন দেখছ না কেন?

এখন ভয় লাগছে।

ওই বাসায় ব্যাগ ফেলে আসার কারণ বুঝতে পারছ?

হ্যাঁ, এখন পারছি।

তাহলে হাতটা দাও।

মিলি যেন তৈরি হয়েই ছিল। কাল রাত থেকে মিলির শরীর অবশ হয়ে আছে। মিলি হাতটা বাড়িয়ে দিল।

সোহান এমনভাবে তাকিয়ে হাতটা কাছে টেনে নিল, যেন মিলির গায়ে জাদু খেলে গেল।

কাল আমার বউ আর ছেলেদের দেখেছ?

হ্যাঁ দেখেছি।

ছোট ছেলেটা আপনার মতো হয়েছে।

আপত্তি আছে দুই ছেলের বাবার সঙ্গে প্রেম করতে?

মিলি বলল, একটু সময় লাগবে, ভাবতে হবে।

আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই।

এরপরে মিলি-সোহানের প্রেম কোনো রকম সামাজিক বাধাবিপত্তি মানে না। দুজনে ভেসেছে ভালোবাসার বন্যায়। একটি দিনের জন্যও মিলির মনে হয়নি সোহান বিবাহিত। তার দুটো ছেলে বা বউ সোহানকে ভালোবাসায় বাধা তৈরি করেনি মিলির  মনে। কোনো দিন সোহানের পরিবার নিয়ে কমপ্লেইন করেনি মিলি। এভাবেই দুজনের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হয়। মিলি ও সোহানের বেপরোয়া প্রেম কোনো সামাজিক বাধাই মানে না। মিলিকে হোস্টেলে থাকতে দেয়নি সোহান। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছে, সঙ্গে সব সময়ের জন্য রেখেছে গাড়ি ও ড্রাইভার।

বিয়ে ছাড়াই শুরু হয় ওদের সংসারজীবন। আধুনিক সমাজে এটাকেই বলে লিভটুগেদার। কোনো রকম সামাজিক বাধাবিঘœ ছাড়া সোহান দুটি সংসার চালিয়ে যেতে থাকে। সময়-সুযোগ বুঝে দুজনে বিদেশের নানান জায়গায় বেড়াতে যায়। একটা সময় ইউনিভার্সিটিতে মিলিকে নিয়ে এতই কথাবার্তা শুরু হয়ে যায় যে মিলি নিয়মিত ক্লাস পর্যন্ত করতে পারে না। এভাবে কোনো রকমে ফার্স্ট ইয়ার শেষ করে। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে মিলি অনেকটা একা হয়ে পড়ে। সহপাঠীরা কেউ আর তার সঙ্গে মেশে না। বই পড়া, শপিং করা, জিম করা, টিভি দেখা আর টুকটাক রান্না করে সোহানের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না মিলির।

পরিস্থিতি এতদূর গড়ালে তো আর চাপা থাকে না কিছু। স্বাভাবিকভাবে মিলির বাবা-মাও জেনে গেছেন সব। তাঁরা এতাটাই রেগে গেছেন যে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেও মানা করে দিয়েছেন। বাড়ির কারো সঙ্গেই তার এখন আর যোগাযোগ নেই! তার প্রতি সোহানের ভালোবাসাই এখন সবচেয়ে বড়। এখানে তো কোনো কমতি দেখে না মিলি। এতেই চলবে তার জীবন!

মিলির জন্য অ্যাডফার্ম থেকে টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য অ্যাড করার অফার আসতে থাকে। একবার সোহানকে বলতেই রেগে গিয়েছিল সে, আর কোনো দিন এসব নিয়ে কথা তুলবে না! আসলে সোহান চায় সব সময় মিলিকে লুকিয়ে রাখতে। আগলে রাখতে। যখনই সুযোগ পায় ছুটে চলে আসে তার কাছে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে।

সোহানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আরো বড় হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে সোহান। ফলে মিলির একাকিত্ব বাড়তে থাকে। এক সময় মিলি সবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও একা হয়ে পড়ে। কেউ কেউ মিলিকে মনে করিয়ে দেয় ও  নাকি সোহানের রক্ষিতা। কিন্তু মিলি তো তা মনে করে না। কারণ কাগজের বিয়েতে ওর আস্থা নেই! গতানুগতিক সম্পর্কে মিলি বিশ^াস করে না। কারণ মিলি জানে সোহানের সঙ্গে সম্পর্কে ওর কোনো অবিশ^াস নাই। আছে আস্থা, সমঝোতা; আছে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান।

ডমলি অবশ্য কখনো সোহানের কথার অবাধ্য হয়নি। সোহান একবার শুধু বলেছিল সে নিজে ফোন না করলে যেন মিলি কোনো দিন তাকে ফোন না করে। আজ দুই বছরে একবারও সে সোহানের ফোনে নিজে থেকে কল দেয়নি। হাজারো রিং হলেও মিলি সোহানের ফোনে হাত দেয় না। তবে সোহান এসেই মিলির ফোনে গেম খেলে আর খুঁটিনাটি বিষয় চেক করে। কারো সঙ্গে মিলির কোনো যোগাযোগ নেই দেখে সোহান যে খুশি হয় মিলি সেটা বুঝতে পারে।

ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় সোহান এসে বলল, কাল-পরশুর মধ্যে তোমার আমেরিকায় যাওয়ার জন্য ভিসার ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। তৈরী থেকো আর ব্যাগ গুছিয়ে ফেলো। আমরা শিগগিরই আমেরিকায় যাচ্ছি।

আমরা আমেরিকায় যাব? অবাক হয়েছিল মিলি।

হুম, যেতে হবে। আমার কয়েকটা জায়গায় মিটিং আছে।

কত দিন থাকতে হবে মিলি সেটা জানতে না চাইলে সোহান নিজেই আবার বলল,

আমরা বেশ কয়েক মাস থাকবো। তুমি তোমার পছন্দের কাপড়চোপড় সহ সব দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে নিও। যত দামি গহনা আছে সেসবও নিয়ে নাও।

গহনা কেন নেব? আর ওগুলো তো তোমার লকারে রাখা আছে।

এ কথা শুনে সোহানকে একটু অস্থির দেখায়। মিলি জিজ্ঞাসা করল,

কেন এত তাড়াহুড়া করে যেতে হবে? তা ছাড়া কয় মাসের জন্য গেলে আমার কোন গহনা লাগবে না।

সোহান বড় ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে মিলি দেশের বাইরে ঘুরতেই বেশি পছন্দ করে। দেশের বাইরে সোহানকে তার সত্যিকারের স্বামীই মনে হয়। দুজনেই দেশের বাইরে ঘুরতে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। সোহানের জন্য কোনো দেশের ভিসা পাওয়াই কোন সমস্যা না। মিলির পাসপোর্ট থেকে শুরু করে দামি গয়না সবই সোহানের জিম্মায় লকারে রাখা থাকে।

একদিন সকালে আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে ইন্টারভিউ দিয়ে এল। পাঁছ বছরের ভিসাও পেয়ে গেল সে। শুনেছি মানুষের ভিসা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। সোহানের কাগজপত্রের কাজ খুবই নিখুঁত। তাই মিলির কোথাও ঝামেলা হলো না। ওদের সব প্রশ্নের উত্তর সোহান আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল। মিলি বলতেও পেরেছিল ঠিকমতো। সহজেই সব হয়ে গেল।

ডিসেম্বরের হালকা শীতের ভোরে মিলি তার পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এই পরীক্ষাটা শেষ হলেই অনার্স সেকেন্ড ইয়ার শেষ। এর পর মিলি ফ্রি। সে সোহানের সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য ঘুরতে যাবে। এর আগেও তারা দেশের বাইরে ঘুরতে গেছে। এক-দুই সপ্তাহের বেশি থাকেনি। সোহান বলেছে, এবার কয়েক মাস থাকবে। ভাবতেই মনটা নেচে উঠছে।

হঠাৎ ড্রাইভার এসে বলল,

ম্যাডাম, স্যার বলেছেন তৈরি হয়ে নিতে। আজই আপনাদের ফ্লাইট।

তোমার স্যার কোথায়?

জানি না ম্যাডাম।

ড্রাইভার কেমন রোবটের মতো উত্তর দিল। মিলি আজ পরীক্ষাটা না দিলে এক বছর পিছিয়ে পড়বে। সোহানকে কল দিল সে। মিলি জানাতে চায় পরীক্ষা শেষ করে রাতের ফ্লাইটে যেতে হবে। এখন সে পরীক্ষা দিতে যাবে। ফোনে সোহানকে পাওয়া গেল না। টেক্সট করেছে। উত্তর আসেনি।

ড্রাইভার আবার নিচ থেকে জানতে চায় ম্যডাম তৈরি কি না। এখনই রওনা দিতে হবে।

মিলি ধমক দিয়ে বলে, তোমার স্যারকে বলো আমাকে কল দিতে। আমি এখন পরীক্ষা দিতে যাব।

মিলি অপেক্ষা করে, সোহানের কোনো কল আসে না।

আবার এক ঘণ্টা পর ড্রাইভার আসে। তাড়া দেয়। বলে, স্যার বলেছেন তৈরি হয়ে রওনা দিতে।

মিলি এবার রেগে যায়, ওকে বলো আজ আমার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ করে যাব।

মিলি সোহানকে আবার কল করে। এবার সে অবাক হলো দেখে যে ড্রাইভারের কাছে সোহানের মোবাইল ফোন এবং রিং হচ্ছে।

মিলি ড্রাইভারকে বলল, সোহানের ফোন তোমার কাছে কেন?

ড্রাইভার জানাল, স্যার ফোনটা রাখতে দিয়েছেন এবং আপনাকে নিয়ে রওনা দিতে বলেছেন।

নাহ। তুমি তোমার স্যারকে জানিয়ে দাও পরীক্ষা শেষ করে বের হব। তুমি নিচে যাও।

ড্রাইভার বের হতেই মিলি টিভির স্ক্রিনে দেখতে পেল চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের গ-গোলের কারণে সব বিশ^বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

তাহলে সোহান সবকিছু জেনেই ড্রাইভারকে পাঠিয়েছে তাকে নিতে। শুধু অবাক লাগছে সোহানের মোবাইল ড্রাইভারের কাছে কেন? ওর ফোন তো অন্য কারো কাছে থাকার কথা না।

মিলি দ্রুত তৈরি হয়ে ড্রাইভারকে ডেকে রওনা দেয়। গাড়ি এয়ারপোর্টে না গিয়ে কাছাকাছি একটা হোটেলে যায়। মিলিকে একটা রুমে তুলে দেয় ড্রাইভার। কিছুক্ষণ পর চলে আসে সোহান। মিলি লক্ষ করে সোহান একটু বেশি অস্থির, কেমন যেন খাপছাড়া। মনে হয় কিছু খায়নি। মিলি সোহানকে দেখে তার পরীক্ষার কথা বলতে ভুলে গেছে। সোহানের মাথায়-কাঁধে হাত রেখে বলল, আমরা কি আজই দেশের বাইরে যাচ্ছি?

সোহান বলল, ইয়েস, টু নাইট।

তুমি কি সারা দিন কিছু খাওনি?

সোহান উত্তর দিল না। মিলি বুঝে গেল, ও কিছু খায়নি। মিলি সোহানের পছন্দের খাবার অর্ডার দিল।

সোহান যাও, গোসল করে আসো। খাবার খাব, আমিও সারা দিন কিছু খাইনি। সোহান মিলিকে একপলক চেয়ে দেখে বাথরুমে গেল। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দুজনে এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করল।

রাত ১১টায় এমিরেটস এয়ারে তারা দেশের বাইরে যাবে।

দুপুরের খাবার খেয়ে মিলি হালকা ন্যাপ নিতে খালি বেডে শুতে গেল। সোহান পাশের বেডে আগে থেকেই শোয়া। মনে হয় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

মিলি এয়ারপোর্ট এসে জানতে পারল এবারই তারা আমেরিকায় যাচ্ছে। মিলি আনন্দে ভুলে গেল পরীক্ষা না দিতে পারার কষ্টটুকুও। বিমানের ভিআইপি সিটে বসে মিলি আর সোহান পৌঁছে গেল বিশে^র রাজধানী ¯েœা-ঢাকা নিউইয়র্কে। জীবনে প্রথম স্নো দখার চমকে আত্মহারা মিলি। তারা উঠল ম্যানহাটানের হোটেল হায়াতে।

ঐতিহাসিক সব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এক সপ্তাহ পর সোহান মিলিকে লং আইল্যান্ডে একটা বাড়িতে এনে তুলল। জানাল, তারা এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে। এই বাড়ি কেনাই হয়েছে মিলির জন্য। বাড়ি দেখে তো খুব খুশি মিলি। এ যেন স্বপ্নের বাড়ি। কখন এসব করল সোহান? মিলিকে সারপ্রাইজ দিতেই এ কাজ করেছে সে। কখন এত সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলল! প্রশ্ন কোনটা রেখে কোনটা করবে তার যেন তালগোল পাচ্ছে না মিলি।

বাড়ির সামনে-পেছনে অনেক জায়গা। সুন্দর ফুল গাছের বাগান। সম্পূর্ণ সাজানো-গোছানো পরিপাটি বাড়ি। মিলি যেন একমুহূর্তে স্বপ্নের রাজ্যে চলে এসেছে। এখানে মিলি যা খুশি করতে পারবে। কেউ ওদের নিয়ে কথা বলবে না। ঢাকায় মিলি-সোহানের মেলামেশায় অনেক বিধিনিষেধ ছিল। ওরা এক সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যেতে হলে দেশের বাইরে ছাড়া সম্ভব ছিল না। দুজনের আনন্দের জায়গা ফ্ল্যাটবন্দী ছিল বলা যায়। বদ্ধ রুমেই আটকে ছিল ওদের ভালোবাসা। সমাজের চোখে ছিল সবই অনৈতিক। বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা হয়ে একা জীবনযাপন করত মিলি। কখনো সন্ধ্যারাতে, বেশির ভাগ মাঝরাতে সোহানের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সোহানের ভালোবাসায় মিলি অন্ধ। তাই মানুষের কথায় কান না দিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।

এখন এই দেশে তাদের কেউ খুঁজে পাবে না। সোহান মিলিকে আশপাশের জায়গা, গ্রোসারি, চেইন শপ, সুপার শপ, বাস, ট্রেন সব খুব দ্রুত চিনিয়ে দিল। এর মধ্যেই বাড়ির কাগজপত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে পরিপাটি করে গুছিয়ে দিল। সোহান প্রতিদিনই মিলির সংসারের জন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে দেয়।

মিলি নিষেধ করে। কয় মাসের জন্য এত জিনিসপত্র কিনো না। এসব তো আর দেশে নিয়ে যেতে পারব না। দেশের ফ্ল্যাটের জিনিসপত্র মিলি একাই ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে কিনেছিল। দেশে সোহান মিলিকে নিয়ে কোনো শপিং করতে যায়নি। মিলিকে নিয়ে মানুষের সামনে বের হয় না সোহান। মিলিও আপত্তি করে না।

সোহান মিলির কথার উত্তর দেয় না। এই কদিনে তাদের সম্পর্ক যেন নতুন রূপ নেয়। সোহান প্রতিমুহূর্ত মিলিকে আদরে আদরে ভরিয়ে রাখে। একটু বেপরোয়া লাগে মিলির কাছে সোহানকে। হয়তো দেশে থাকতে এসব সে দেখাতে পারেনি। তাছাড়া যতবারই দেশের বাইরে গেছে এক সপ্তাহ কি দুই সপ্তাহের বেশি থাকেনি।

দেশ থেকে সোহানের কল আসলেই মিলি দূরে সরে যায়। সোহান তার দুই ছেলে এবং বউয়ের সঙ্গে কথা বলে। তাদের খোঁজখবর নেয়। বউকে বলেছে বিজনেস মিটিংয়ে এখনো কিছু জরুরি ডিসিশন নেওয়া বাকি আছে। তাই আরো কয় দিন লাগবে। মিলি দূর থেকে যেন এক অন্য সোহানের দেখা পায়। এ যেন অন্য কেউ। একজন দায়িত্বশীল বাবা। একজন দায়িত্বশীল স্বামী। মিলি লক্ষ করে, সোহান ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে শান্ত হয়ে বসে কী যেন ভাবে।

মিলি এক মাসের মধ্যেই পুরো সংসার শুরু করে দিয়েছে। পুরোদস্তুর সংসারী গিন্নিদের মতো রান্নাবান্না করে; সোহানের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সাধারণ দম্পতির মতো।

জানুয়ারি মাসের আগের শীতের মাইনাস তাপমাত্রার ঠা-ায় ভোররাতে মিলি হঠাৎ লক্ষ করল সোহান খুব সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে যাচ্ছে। ফোন হাতে নিয়ে নিচতলায় নেমে গেল। চারদিক নিস্তব্ধ থাকায় ফোনে ও যে কথা বলছে তার সবই প্রায় শোনা যাচ্ছে!

কী বলছ তুমি! … কী হয়েছে? কেন এমন করছ? … একটু ধৈর্য ধরো। বলেছি তো আমি এসে তোমাকে সব খুলে বলব। এমন করে না লক্ষ্মী সোনা।

শুয়ে শুয়ে সোহানের ফোনে বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হলো আকাশ ডাকছে। খুব জোরে বৃষ্টি হবে। ঘরে হিটার চালু আছে, তারপরও যেন ঠা-ায় জমে যাচ্ছে সে।

হঠাৎ মিলি দেখেতে পেল সোহান খুব দ্রুত ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগটা নিয়ে নেমে গেল দ্রুত। নতুন কেনা গাড়িটা চালিয়ে বেরিয়ে গেল সোহান। মিলি দৌড়ে নেমে এল সোহানকে কিছু বলবার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে সোহানের গাড়ি বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে। সোহানকে আর দেখা যায় না।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওটা তার ঢাকার বাসার ফোন ছিল। কোথাও বড় কোনো সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কিছু না বলে ও কোথায় গেল! দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে যাওয়া মিলির মনে উল্টোপাল্টা কথার জন্ম নিচ্ছে। মিলি সেসব চিন্তা মাথায় না ঢুকিয়ে ফিরে এল ওপরে। কফি বানাল। গরম কফির মগে চুমুক দিতে দিতে সোহানের ফোনে কল দিল সে। ফোন বন্ধ। ও কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত হয়তো, তাই মোবাইলফোন সুইচডঅফ করে রেখেছে।

সোহানের ভাবনা থেকে সরে এসে ওর প্রিয় হার্ড চিকেনের ঝোল আর করলাভাজি আর বাসমতী চালের ভাত রাঁধায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে মিলি। অপেক্ষা করতে থাকে রান্না শেষে।

অপেক্ষার ছোট্ট সময়গুলোও অনেক দীর্ঘ হয়, যেন কাটতেই চায় না। তবু অপেক্ষা করতে ভালো লাগে। এর উৎস ভালোবাসা!

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সোহানের দেখা মেলে না। ফোন এখনো বন্ধ। সন্ধ্যাও পেরিয়ে যায়। আঁধার নামে রাতের। মিলি হাল ছাড়েনি। সোহান আসবে। খিদে লাগলে কয়টা বাদাম চিবাতে থাকে মিলি।

পরদিন সকালে এক ভদ্রলোক আসেন গাড়িসহ চাবি বুঝিয়ে দিতে। নাম বললেন মামুন। সোহানের তিনি বাল্যবন্ধু। বললেন কোনো কিছুর দরকার হলে যেন তাঁকে ফোন দেয়া হয়। তিনি নিউইয়র্কেই থাকেন। এই বাড়ি-গাড়ি সব তাঁর মাধ্যমেই কেনা। তার মানে মিলির ব্যাপারে এই দেশে কেউ কিছু জেনে থাকলে জানেন এই মামুন নামের মানুষটি।

সোহান কোথায়?

দেশে গেছে।

মানে কী।

মানে কিছু না, সোহান দেশে গেছে। বলেছে তোমাকে দেখে রাখতে।

আমাকে না নিয়ে চলে গেল কেন!

তুমি তো আর দেশে ফিরে যেতে পারবে না মিলি!

কী বলছেন এসব? কেন পারব না? আমার আর ওর টিকিট তো কাটাই আছে, শুধু কল দিলে টিকিট কনফার্ম করে নেব। নাহ্ সোহানকে ছাড়া আমি এখানে এক দিনও থাকব না। বলেই দৌড়ে ওপরের রুমে গেল পাসপোর্ট আনতে। কোথাও খুঁজে পেল না পাসপোর্ট। আবার দৌড়ে নিচে নেমে গেল।

মামুন ভাই, আমার পাসপোর্টটা তো এই মুহূর্তে খুঁজে পেলাম না। আমি খুঁজে রাখব। আপনি কাল আমার দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

মামুন চুপচাপ সোফায় বসে রইলেন। যেন তিনি মিলির কথা শুনছেন না। নির্বিকারভাবে তাঁর বসে থাকা মিলিকে আরো অস্থির করে তুলল। মিলি বোঝাল তার ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করার বিষয়ে। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবারও তারিখ ঘোষণা হবে। এই পরীক্ষা দিতে হবে, না হলে এক বছর পিছিয়ে পড়বে।

মামুন ভাই আমি কাল না হয় পরশু চলে যেতে চাই।

মামুন সব শুনে জানালেন, সোহান তোমার পাসপোর্টও নিয়ে গেছে। ও চায় না তুমি বাংলাদেশে ফিরে যাও।

কী বলছেন এসব! অসম্ভব কথা। সোহান এমন কাজ করতেই পারে না।

মিলি মামুনের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। পাশাপাশি সোফায় মিলি মামুন চুপচাপ বেশ কিছু সময় বসে রইল। মাঝরাতে মামুন মিলির মাথায় ভরসার হাত রাখল। বলল, শান্ত হও। মাথা গরম কোরো না। আমি আসা-যাওয়ায় থাকব।

মামুন বেরিয়ে গেলে মিলির ঘোর কাটে না। মামুনের কথা মিলি বিশ^াস করে না। মিলি মনে করে, কদিন পর সোহান এসে ঠিক নিয়ে যাবে।

অপেক্ষা মানে অনিশ্চয়তা, আর এই অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কারো জন্য অপেক্ষা করার নামই ভালোবাসা। মিলি দিন গোনে সোহান আসবে। ভাবতে ভাবতে সপ্তাহ পার হয়ে মাস হয়ে যায়। সোহানের দেখা মেলে না, এমনকি কোন ফোনও আসে না। মামুন মাঝেমধ্যেই আসে। আমেরিকার লিগ্যাল হওয়ার নানা রকম বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়। মিলি মামুনকে বোঝায় সোহান আসবে তাকে নিয়ে যেতে। মিলি জানে সোহান মিলিকে ছাড়া বাঁচবে না, তাদের ভালোবাসা সাধারণ মানুষের ভালোবাসা না।

দিন যায় রাত যায়। মিলি এক মাসের মধ্যে জানতে পারে তার শরীরের সোহানের সন্তান। পাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে যোগাযোগ করে মিলি। তারা তার বিস্তারিত জানতে চায়। মিলি জানায় সোহান যেহেতু তার বিয়ে করা স্বামী না, সেহেতু সে তার বাচ্চার বায়োলজিক্যাল ফাদার। হাসপাতালের রেকর্ডে তাই লেখা হয়।

মামুন জানল মিলি মা হবে। মামুনকে হতাশ হতে দেখল মিলি।

মিলির অপেক্ষা শেষ হয় না। সঙ্গে যোগ হয় অভিমান। রাগ-অভিমান করার পাশাপাশি ক্ষমা করাও শিখতে হয়, তাহলেই ভালোবাসার সম্পর্কগুলো টিকে থাকে। মিলি ক্ষমা করতে থাকে। সময় পার হয়। মিলির শরীরে সোহানের সন্তান বড় হতে থাকে। সে ভুলে যায় দেশে ফেরার কথা। বিয়ে ছাড়া সন্তান বড় করা বাংলাদেশের মতো দেশে অসম্ভব। দেশে সব শিশুরই পিতৃপরিচয় লাগে। এখানে না হলেও চলে। এতদিনে সোহান নিশ্চিত জেনেছে যে তার সন্তান আসছে তারপরও সে কোনো রকম যোগাযোগ করেনি। মিলির গল্প এর মধ্যে কমিউনিটির সবাই জেনে গেছে। সোশ্যাল ওয়ার্কার আসে। মিলিকে সময় দেয়। ভুলিয়ে রাখে সোহানের কথা।

একা মা হওয়ার কথা এত দিন ভাবতে ভাবতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এ দেশে যে কেউ একা মা হতে পারেন অনায়াসেই। ‘সিঙ্গল মাদার’ হওয়া কোনো সমস্যার নয়। তবুও বাধো বাধো ঠেকে। ভয় হয়। সমাজের ভয়, নিয়মের ভয়। কিন্তু, মেয়েরা এখন স্বাবলম্বী হয়েছে। আর পেছনে তাকানোর সময় নেই। সব ভয় কাটিয়ে একজন মা একাই দায়িত্ব নিতে পারে তার সন্তানের। মা একা হয়ে গেলেও যাদের ওপর ভরসা করা যায় পরিবারের অন্তত এমন কারো সহযোগিতা থাকবে। তবে মিলি আরো কয়েকজন সিঙ্গেল মাকে পেয়ে গেছে। ওদের কাছ থেকেও জেনেছে এ দেশে একা মা হওয়া বিরাট কোনো কঠিন বিষয় না।

সামারের এক সুন্দর সকালে মিলির কোল আলো করে জন্ম নেয় সামারা। মিলি জানে সামারে তার মেয়ে হবে। তাই সামার এবং সোহান মিলির নামে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখে সামারা।

সোহান তার মেয়েকে দেখতে আসবে মিলি সে আশা ছাড়েনি।

সোহানের দেখা মেলে না, এমনকি মামুনও আসা-যাওয়া কমিয়ে দেয়। একা হয়ে যায় মিলির দুনিয়া। সংসার শুরু করে মেয়েকে নিয়ে। টাকাপয়সা সব শেষ হয়ে যায় মিলির। বেইসমেন্টটা ভাড়া দিয়ে সচ্ছলতা ফেরে কিছুটা।

সামারা বড় হতে থাকে। সোহানের দেখা মেলে না। মেয়ের কথা বন্ধুর কাছে থেকে শুনেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কোনো খবর নেয়নি। মিলি মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। এত কিছুর পরও আশা ছাড়েনি সোহানের। ঘরজুড়ে মিলি সোহানের ছবি ঝুলিয়ে রাখে মেয়েকে বাপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।

সময় যায়। পাল্টে যেতে থাকে মিলির ভালোবাসার ভাবনা। অবিশ^াস দানা বাঁধতে শুরু করে। মিলির বিশ^াস ভঙ্গ হয়। মানুষের মুখে শুনেছে সোহান ওকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছে। ও তার পরিবার থেকে কোনো দিন আলাদা হবে না। সোহান তার বউকে অনেক ভালোবাসে। মিলি এতটাই সোহানকে ভালোবেসেছে যে এসব তার মাথায় নেয়নি। সোহানের বিবাহিত জীবনযাপন নিয়ে মিলি কোনো দিন মাথা ঘামায়নি। সোহান মিলিকে রানির মতো করে রেখেছে। কোনো দিন অসম্মান করেনি। তবে এ কথা ঠিক যে মিলি কোনো দিন বিয়ের কথা তোলেনি। কেন তোলেনি, তার জানা নেই। মা বলতেন ও তোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তার বউয়ের কাছে ফিরে যাবে। মিলি ওসবে কান দেয়নি। এখন কি তাহলে সেসব কথাই সত্য হলো! ও কি সত্যিই ফেলে চলে গেল। তা না হলে কেন এত দিনে একবারও খোঁজ নিল না?

জীবনের জোগান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিলি। থাকার ঘরের আরো দুইটা রুম ভাড়া দিয়ে দেয়। সরকার থেকে মেয়ের জন্য কিছু টাকা আসে, তা দিয়ে চলে যায় মাসের খরচ। এভাবেই মেয়েকে বড় করতে থাকে। এক সময় দেয়ালে সোহানের ছবিতে ধুলো জমে। কিছু ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। ছবির ধুলো আর পরিষ্কার করতে মন চায় না।

হুমায়ূন আহমেদের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি লিখেছেন জীবনের সত্যি কথা, ‘যখন মানুষের খুব প্রিয় কেউ তাকে অপছন্দ, অবহেলা কিংবা ঘৃণা করে তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায় এবং চায় যে সব ঠিক হয়ে যাক। কিছুদিন পর সে সেই প্রিয় ব্যক্তিকে ছাড়া থাকতে শিখে যায়। আর অনেক দিন পরে সে আগের চেয়েও অনেক বেশি খুশি থাকে যখন সে বুঝতে পারে যে কারো ভালোবাসায় জীবনে অনেক কিছুই আসে-যায় কিন্তু কারো অবহেলায় সত্যিই কিছু আসে-যায় না।’

মিলির চলা আর থেমে থাকে না। নিউইয়র্কের আনাচ কানাচ চিনে ফেলে। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে নিজ বাসাতেই বেবিসিটিং করে। সাদাকালো মিলে সাতটা বাচ্চা দেখাশোনা করে ভালোই কেটে যায় জীবন। সামারা বড় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেমন যেন একরোখা স্বভাবের হয়ে উঠছে মেয়েটা। সোহানের মতো কথা কম বলে। দেখতেও হয়েছে বাপের মতো। বড় হতে হতে মেয়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে মায়ের। মেয়ের বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মিলির বুঝতে কষ্ট হয় না তার একা থাকার দিন ঘনিয়ে এসেছে। মেয়েকে সে বুঝতেই দেয়নি তাকে বড় করতে কত কষ্ট করতে হয়েছে।

সামারা বাফেলোতে পড়তে যাবে। ডর্মে থাকবে। মিলি চেয়েছিল সে সিটির কোনো কলেজে পড়ুক, তাহলে রাতে অন্তত মা-মেয়ে এক সঙ্গে থাকবে। মেয়েকে কাছ থেকে দেখবে। মেয়ে কঠিন গলায় জবাব দিল সে আর এ বাসায় থাকতে চায় না।

মিলি যেন এক মুহূর্তের জন্য তার কলেজজীবনে ফিরে গেল। সেও কি তার মায়ের সঙ্গে এমনটা করেনি? এর চেয়েও বড় অন্যায় ও করেছে। মাকে সম্মান করেনি। মাকে পাত্তা না দিয়ে সোহানের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করেছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এর সবই ছিল সোহানের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সোহান তাকে একা ফেলে চলে গেল। এখন মেয়েও চলে যাবে। তাহলে কি আবার নতুন করে শুরু করতে হবে? এই আঠারো বছরের জীবনে মিলি অনেক বিয়ের অফার পেয়েছে, অনেকেই বন্ধু হতে চেয়েছে। তাদেরকে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, না আর কোনো সম্পর্ক না। মিলি বাঁচবে তার মেয়ের জন্য। মিলি জানে এই বয়সে ও আরো ম্যাচিউরড, আরো বেশি সুন্দরী হয়েছে। নিজের প্রতি আরো কন্ট্রোল করতে শিখে গেছে। আর কোনো ভালোবাসাবাসি না।

মেয়ে চলে গেল বাফেলো। থাকবে হোস্টেলে। মেয়ে মন চাইলে ফোন করে। সে মাঝেমধ্যে মিলির ফোন ধরে। খোঁজখবর নেয়। সামারা বিজনেস পড়বে বলে ঠিক করেছে। মাকে না জানিয়ে সে পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দেবে বলে জানিয়েছে মিলিকে। মিলি শুনে গেছে, কোনো উত্তর দেয়নি। মনে মনে ভাবছিল তোর বাপ তো তোকে দেখতেও আসে নাই। সে তার নিজের সংসার নিয়েই ব্যস্ত। তুই হলি একজন পয়সাওয়ালার রক্ষিতার মেয়ে। তোর মাকে এ দেশে এনেছিল দুনিয়ার সব মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতে। সোহান না বলে পালিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় ইচ্ছা করে মিলি যাতে দেশে যেতে না পারে, সে জন্য সঙ্গে নিয়ে গেছে তার পাসপোর্টটাও। মিলির জীবন-যৌবনের দাম পুষিয়ে দিতে এই বাড়ি-গাড়ি কিনে দেয়। মিলি এখন সব জেনে গেছে, সব বুঝতে শিখেছে। মিলির এখন দেশে যেতে মন চায়। মাকে দেখতে মন চায়। ভাইদের দেখতে মন কাঁদে। কিন্তু যাওয়ার তো কোনো উপায় নেই। এই আঠারো বছরে মিলির পাসপোর্ট করার কথা মনে হয়নি। মেয়েকে বড় করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সে বুঝতে পারেনি যে এতটাই একা হয়ে পড়বে সে। এক শনিবারের সকালে মেয়ে কয়দিনের জন্য বেড়াতে আসবে বলে অপেক্ষা করছিল মিলি। মেয়ে এলো না; ফোন করে বলল, মা, বাবা এসেছে আমার কাছে।

কী বলছ, কার বাবা?

আমার বাবা!

কী! সোহান এসেছে? তোদের দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ মা। আজ দুপুরে আমরা এক সঙ্গেই লাঞ্চ করেছি।

তবে তুমি ছবিতে যাকে দেখাতে ও এখন দেখতে সে রকম না।

মিলি আর কোনো প্রশ্ন করে না। ওর মনে হলো অনেক দিন ধরে কাঁদে না সে। তাহলে আজকেই কি সেই কান্নার দিন! বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না আসে। মিলি নিজের মধ্যে বেশ অস্থিরতা অনুভব করতে থাকে। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।

কখন থেকে যে সোহানের বন্ধু মামুন পেছনে দাঁড়িয়ে মিলিকে লক্ষ করছিল, তা সে বুঝতে পারেনি। হঠাৎ চোখাচোখি হওয়ায় মিলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মামুনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কাঁদতে লাগল। পুরো শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল তার। কেমন করে রাত পার হলো মিলির মনে নেই। মামুন মিলিকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে মাঝরাতেই চলে যায়, এটুকুই শুধু মনে আছে।

সমাজে অধিকাংশ ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্ককেও চিরকাল বিয়ে নামের ছাতার তলাতেই থেকে যেতে হয়। জল-হাওয়া না পাওয়া দাম্পত্যগুলোকেও শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে হয় ওই ছাতার তলাতেই। তাই মিলি জোর করে এই বিশেষ সম্মাননা চায়নি। কোনো দিন সোহানকে প্রশ্ন করেনি। তরুণ বয়সে পরিচিত পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা পরামর্শ দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন, ভবিষ্যতে যাতে একা থাকতে না হয় সারাটা জীবন, তাই একজন সঙ্গী দরকার এবং বিয়ে করেই কাউকে সারা জীবনের সঙ্গী বানাতে হবে। মিলি এসব আর গায়ে মাখে না।

সময়টা বেশ কদিন ধরে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই হতাশা বাড়ছে। কিচ্ছু ভালো লাগে না আজকাল, গন্তব্যের পথ থেকে ছিটকে পড়বার ভয়টা দিন দিন গাঢ় হচ্ছে। কয়েক দিন থেকে প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করছে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে। যতই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা ততই যেন একের পর এক প্রশ্নেরা দানা বেঁধে ওঠে মস্তিষ্কের গহ্বরে। কোনো সমাধান নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় এত প্রশ্ন করেই-বা কী লাভ কিংবা তার উত্তর থাকা-না-থাকায় কিইবা যায় আসে। জীবনের কাছে অস্তিত্বের আদৌ কোনো দায়ভার আছে কি না সেটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ধার্মিকদের অনেক সুবিধা, নিজের সব ব্যর্থতা-সফলতার হিসাব মেলাতে না পারলে, অদৃশ্য সত্তার কাছে নিশ্চিন্তে ঢেলে দেয় সব দায়ভার। তারপর ইচ্ছেমতো নিজেকে প্রবোধ দেবার যথেচ্ছ উপকরণ তৈরি করে সেগুলোকে শূন্যের কাছ থেকে সত্যায়িত করে নেয়। সোহানের সঙ্গে সম্পর্ক হবার পর থেকেই মা বলেছে আল্লাহ নাকি আর মিলির সঙ্গে নাই। তাই আল্লাহ-খোদার চর্চা তেমন একটা করেনি। বেশ চমৎকারভাবে সব কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই মিলি বন্ধু ব্রিটনিকে দিয়ে বাড়ি বিক্রির সব কাজ গুছিয়ে সব দেনা-পাওনা শোধ করে বাকি টাকা সামারার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলে। এখানে আর এক দিনও থাকা যাবে না। মেয়ে তার বাবা পেয়ে গেছে। তার আর দরকার কী! আর কারো সঙ্গে দেখা করতে চায় না সে। একদম না! পালিয়ে থেকেই কাটে মিলিদের জীবন!

রওশন হক। লেখক ও সাংবাদিক। রওশন হকের জন্ম জন্ম হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রামে। ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম থেকে এমবিএ করেছেন ব্যবসায়ী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক করেছেন নাসিরাবাদ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে।...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..