মিসক্যারেজ

পার্থ রায়
গল্প
Bengali
মিসক্যারেজ

শ্রাবণের একটা অলস দিনে চিলেকোঠায় বসে বসে অশ্বগন্ধী মেঘ গুলোর দৌড়াদৌড়ি দেখতে দেখতে হঠাৎ মাথায় বন্দি যক্ষের কথা মাথায় এলো। কেন জানি মনে হলো আমরা সবাই কলমচি, কলমজিবী। ফ্রম কালিদাস টু হাতকাটা কেলো মস্তান। কলম পিষে টু পাইস এর ধান্দা করে পেট চালাই।  তফাৎ খানা শুধু হাতকাটা কেলো চাঁদার রসিদের ওপর কলমের সাথে আরো অনেক কিছুই চালাতে পারে। তাহলে কি আমরা বুদ্ধিজীৱী। এই রে!! এই শব্দটা আবার  কাঁচা খিস্তি  হলো নাকি??   আধুনিক মনন শব্দকোষে। না আপডেট পাওয়া যাচ্ছে না। একটা কচি সবুজ ঠেকে একটু ঘষে ঘষে জ্বালিয়ে নিতে হবে দেখছি।

এক সমুদ্র মানুষের মাঝে একা হবার জায়গা কই? এমনি তোমায় কেউ দেখছে না তুমি বুকের ব্যাথায় বাসের সিটে পটল তুললে তোমার সহযাত্রী বেমালুম সম্রাট  নিরো,আপনমনে অদৃশ্য  বেহালায় ছর টানছেন। তারপর ক্যামেরায় বাইট তখন এ বাবা, হৃদরোগ কি নিঃশব্দ ঘাতক, আমার সাথে সাড়ে দেড় ইঞ্চি তফাৎ এ বসেছিলেন মানুষখানি, ডিও র গন্ধ পাই নি বসা অবধি, বুঝেই ছিলাম, ছাপোষা স্ট্যান্ড আলন, কমপ্লেক্স এর বাসিন্দা নয়। তাই সে ভাবে নজর আর করিনি, আর উনি ফেবু ও ঘাটছিলেন না, ওয়ালে উঁকি দিতে পারিনি স্বভাবত, তাই কখন কখন বাস থেকে যমদূত এর কাঁধে চাপলেন বুঝিনি। বুঝতেই পারছেন আপনারা হৃদরোগ কি নিঃশব্দ ঘাতক, সহযাত্রী পর্যন্ত বুঝলেন না। সাবধানে থাকুন, মুক্ত মনে থাকুন, ক্যামেরায় হনর্ষি র সাথে ভীষণ অমানবিক গন্ধ।

সমাজের পৌত্তলিকতার বাইরে যাবে, এক সমুদ্র মানুষ সাত সমুদ্রের জল ঢেলে তোমার বিদ্রোহী আগুন ফুউউশ করে ছাড়বে। তুমি কি রামমোহন না বিদ্যাসাগর হে!!

একঘর চেনা শরীরের মধ্যে বেশ একটা দ্বীপ খুজেঁ পাওয়া যেত কলম্বাসের মতো, নিজের শরীরের নিজের মনের একটা দ্বীপ।সকলের মাঝে থেকেও একটা ভাবার জায়গা শরীর কেন দেহ হয়, বা দেহ কখন হয় শরীর? বেশ হতো,নিজস্ব একটা দ্বীপ মানুষের, নিজের অ সুখ গুলো নিজের চেনা শরীর ভরা ঘরে রেখে, সুখ দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো। আসলে সম্পর্কগুলোর মাল্টি- ভিটামিন ডেফিসিএনসি। নুন মাখানো মাংস চিবোতে চিবোতে মাড়ি পচে স্কার্ভি। কথার পর কথা সাজিয়ে সাজানো ঘর থেকে ভেসে আসে শুধু পচা গন্ধ।চেনা শরীর চেনা ঘরে ওম কই!! শুধু সাইবেরিয়ান হাওয়ার শন শন আর কিছু জীবন্মৃত ফসিল এর গ্যাজেট ঘষে জীবন টানা। চার দেয়ালের দু কুঠরী, হারিয়ে গেল ন, ফুল, ভালো, সেজ ….. ঘরে চেনা শরীরের একঘেয়েমি। একলা হবার প্রচুর সুযোগেও একলা না হতে পারার আকুলতা, ডেডলাইন, টার্গেট, ক্রেডিট কার্ড ,ই. এম.আই …. সব মিলিয়ে নিঃশব্দ ঘাতক।

এই ভাবেই দিন কাটছিল মিমি আর রাজার।দেড় দশকের দাম্পত্য জীবন।অনু সংসারের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি দুজনেই।কলেজ জীবন শুরুর আগে থেকেই ওদের সম্পর্ক। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার আগেই বিয়ে, তারপর রাজার আস্তে আস্তে একটা বেসরকারি ব্লু চিপ কোম্পানির পূর্ব ভারতে পদাধিকারী। রাজশেখর সেনগুপ্ত। মিমি ও বেশ খানিক লড়াই করে আজ একটি আই.টি কোম্পানির সিস্টেম এডমিন। অনিন্দিতা সেনগুপ্ত,  আন্দি ম্যাম, বেশ উচ্চ পদ। জীবন তার নিজের গতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুজনকেই। দেড় দশক বাদে দুজনেই একান্তে ভাবে তারা দুজনেই এই জীবন চেয়েছিল? রাজা কতদিন ছবি আঁকেনা, দারুন হাসির ছড়া লেখেনা। কোথায় গেল সেই দিন গুলো? মিমি, মিমিরই বা কলম থেকে সেই মর্মস্পর্শী সাহসী লেখা গুলো কোথায় গেল, যে গুলো নিয়ে রাজা পাগলের মতন ঘুরতো ম্যাগাজিন, লিটিল ম্যাগ আর প্রকাশকের দরজায় দরজায়। খাতা গুলো কোথায় গেল? আছে হয়তো কোথাও এই ১৮০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটের স্ক্র্যাপ রুমে।

আজকে মিমির অফ ডে, ভেবেছিল আজকে রাজার সাথে আবার একটা সারাদিন কাটাবে মোবাইল, ল্যাপটপ ছাড়া। কিন্তু রাজার কোম্পানির একটা আর্জেন্ট ডিল ফাইনাল করতে  গতকাল রাতেই উড়ে গেছে গুয়াহাটি। আজকাল একসাথে আর সময় কাটানো হয়না রাজা আর মিমির। কারণ মিমির ইউ.এস, ইউরোপিয়ান ক্লাইন্ট হবার কারণে নাইট শিফট আর রাজা সকাল ৮:৩০ টায় অফিসের পথে। অধিকাংশ দিন ওরা একে অপরকে অতিক্রম করে আবাসনের রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ওঠার সিগনাল এ। এক ঝলক দেখে নেয়া, একজনের বিধ্বস্ত হয়ে ফেরা আর আরেকজনের বিধ্বস্ত হতে যাওয়া। মিমি মনেই করতে পারে না কবে একসাথে দুজনে বাড়িতে থেকেছে। শনি রবি মিমি খানিক সময় পেলেও রাজা পার্টি,ক্লাব, বিজনেস মিট নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে রাতে প্রায় বেহেড হয়ে ফেরে। একটা চেনা শরীর তখন হামাগুড়ি দিয়ে অপর চেনা শরীরের গন্ধ নিয়ে আগুন নেভায়। কখন কখন ঘুমহীন রাতে রাজা আলকোহল আর আলপ্রজালাম এর ফাঁকে খুঁজে বেড়ায় হাস্নুহানা মাতানো মিমি কে। দুটো দেহ খোঁজে শুধু দুটো চেনা শরীর আলোকবর্ষের এক পাড় থেকে আরেক পাড় এ।চেনা শরীরগুলো যে কতদিন দেহ হয়ে উঠতে পারেনা!!

এই ১৮০০ স্কোয়ার ফুটের ১৪ তলার প্রাসাদে মিমির একটা খুব পছন্দের জানালা আছে। সেই জানলায় বসে আজ বর্ষায় এক কাপ কফি নিয়ে জগজিৎ শুনতে শুনতে বৃষ্টি দেখার চেষ্টা করছে মিমি। ছোট থেকেই বৃষ্টি দেখার শখ মিমির, জানালায় বসে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতে ছুঁতে পৌঁছে যেতে চাইতো বৃষ্টির বাড়ি। কিন্তু আজ বৃষ্টির বাড়ির কাছাকাছি এসেও বৃষ্টিকে বড় অচেনা মনে হলো মিমির।কেমন একটা একঘেয়ে শৃঙ্খলে যেন ঝরে পড়ছে, কোথায় সেই মাটিতে পড়ে তার রিনি ঝিনি সুর, এখান থেকে তো…. ঠিক যেন নিজের বর্তমান অবস্থার সাথে মিল পেলো… ডেডলাইন, টার্গেটস ক্লায়েন্টস…… যা, কফিটা জুড়িয়ে গেছে। আলস্য ঝেড়ে আরো এককাপ বানিয়ে সেই জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মনে পড়লো ছোটবেলার কথা, একবার জানালার প্রতিশব্দ লিখতে না পেরে জানলায় বসেই কেঁদে ভাসিয়ে ছিল, তারপর বাবার কোলে বসে জেনেছিল ওটাকে নাকি গবাক্ষ ও বলে। মনে পড়ে গেলো ক্লাস ১১ এ এইরকমই এক বৃষ্টির দিনে ইংরেজী স্যার এর  বাড়ির জানলার সামনে দাঁড়িয়ে, ব্যাচ ভর্তি ছেলেমেয়ের সামনে বলে উঠলো….তুমি যদি চাও বলছি সকলের সামনে

তোমার মনের সসপ্যানে

সারাজীবন ডিম ভেজে খাবো সম্মানে…

আরো যেন কি সব বলে পাগলটা একটা চকোলেট দিয়ে পালিয়েছিল মিমি কে  হতভম্ব করে। ভাবতে ভাবতে মিমির কেন জানি চোখের কোনটা ভিজে উঠলো। জগজিৎ সিং তখন গেয়ে চলেছেন তুম যো ইতনা মুসকুরা রাহে হো, ক্যায়া গম হ্যায়  জিস কো ছুপা রাহে হো…

ধুর এই একঘেয়ে নর্থ ইস্টের ঘ্যান ঘেনে বৃষ্টি। এত দুরন্ত একটা ডিল ফাইনাল করেও শুধুমাত্র বৃষ্টির কারণে ফ্লাইট মিস হয়ে গেল রাজার। বেকার সময় নষ্ট একদম পছন্দ করে না রাজা। ডিল টা যা হয়েছে এবার ইস্টার্ন রিজিওনের রিজিওনাল ডাইরেক্টর পদের আর কোনো দাবিদার রইলো না। হু হু বাবা রাজা সেনগুপ্ত কি দিচ্ছ তুমি, আছে ভাই কিছু তোমার। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে পাঁচতারা আয়েশে একলা বসে রাজা নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো কলকাতায় কি এমনই বৃষ্টি? মিমি কি বেরোলো? এই রকম বৃষ্টি হলে আই. টি. পার্ক এর সামনে টায় খুব জল জমে। বেচারা কি পৌঁছাতে পারবে?? খবর নেবার চেষ্টা করতে করতে একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বর রাজাকে জানিয়ে যেতে থাকলো, due to congestion of this route,all the lines are busy…. ধুত্তোর নিকুচি করেছে তোর কোনজেশনের… আরো খানিক চেষ্টার পর রাজা বিরক্ত হয়ে বসে পড়লো হইস্কি নিয়ে।পাঁচতারার শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা বন্ধ করে জানালার বাইরে ফ্লুরোসেন্ট আলো ছড়ানো লনে পড়া বৃষ্টি গুলো যেন ফ্লুরোসেন্ট ছড়াচ্ছে।হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে যেন পিছলে যাচ্ছে ফ্লুরোসেন্ট বৃষ্টি, পাঁচতারা।পৃথিবী কত বদলে গেল মফস্বলের রাজা আজ খানিক রাজা তো বটেই। হঠাৎ এরকম একটা বৃষ্টির সন্ধ্যা বিদ্যুৎ এর ঝলক এর সাথে ফিরে এলো রাজার মনে বিদ্যুৎ এর ঝলকের মতোই। দুজনের তখন নতুন একত্র জীবনের মাত্র তিনটে বছর, প্রায়ই অফিস কেটে এদিক ওদিক, সিনেমা, মল লেক, প্রায় কলেজ জীবনের মতোই, শুধু পরিধি মহানগর। ফেরার সময় হঠাৎ নামা বৃষ্টিতে মিমির আদুরে আব্দার চলো ভিজি তোমার আড়ালে ঠিক সেই আগের মতো। পাগলিটার খেয়ালে সপা সপ ভিজতে ভিজতে বাসা বাড়ির পাড়ার মোড় থেকে খানিক আলুর চপ, পোকরি আর পিঁয়াজি কিনে প্রাগৈতিহাসিক বাড়িটার পেটে সেঁধিয়ে গেল দুটো নিবেদিত দেহ যেন এক শরীরে। ফ্রেশ হয়ে মিমির আসতে আসতে দেখলো সন্ধ্যের চা টা রাজা রেডি করে তখনো সেই ঝুপপুস ভেজা অবস্থায় রাজা। হঠাৎ কেমন যেন মায়ায় ভরে উঠল মিমির মনটা। সযত্নে বাচ্ছা ছেলের মতন করে মাথাটা মুছিয়ে রাজাকে ভেজা কাপড় জামা চেঞ্জ করে নিতে বললো। তারপর দুজনে বসে চা আর তেলেভাজা খেতে খেতে মিমি হঠাৎ খেয়াল করলো রাজা একটু উদাস। অনেক খোঁচানোর পর বেরোলো রাজার উদাসী হবার কারণ। পকেটের হাজার টাকা ভিজে গেছে।

দু হাতে আগলে, মিমি রাজাকে বলে উঠলো এই যে রাজামশাই এত ভাবুক হলে চলবে?

কি আর করি আমার ভেজা কবিতাটা কে লোকের থেকে আড়াল দিতে দিতে আর খেয়াল রাখতে পারিনি।

রাজা মশাই এবার একটা ভালো বাড়ি দেখো, এই বাড়িটা র সারাবছর  শ্যাওলা ভরা উঠান পেরিয়ে বাথরুম যাওয়া বড়ো বিরক্তিকর। রাতে কেমন ভুতুড়ে লাগে।

হে হে এ যে দেখি পেত্নীর ভুতের ভয়!!!

এইইই এটা কিন্তু…

দেখো জানো তো সব, বোঝ তো সব এই ভাড়ায় বা এর থেকে একটু বেশি ভালো বাড়ি কোথায় পাবো মিমি??সব বুঝি কিন্তু…. কয়েকটা ভালো কোম্পানির ইন্টারভিউ দিয়েছি , এখনো হয়নি কিছু।

সেটা আমি বুঝতে পারি, আসলে নিজের জন্য নয় রাজা আমার মধ্যে যে প্রাণ রয়েছে তার জন্য ভয় হয়,সকালে বেরোনোর তাড়াহুড়োয় খুব পিছলায় পা।

তোমার মধ্যে প্রাণ মানে এই মিমি তুমি কি জড় পদার্থ নাকি??

আরে বাবা এই গবেটটা এক ই রয়ে গেল কিছুই বোঝে না

না বুঝতে পারছি না ভাষা টা বাংলা কিন্তু বোঝার সময় হিব্রু লাগছে।

ওরে গবেট তুমি… বাবা হতে চলেছ…

হঠাৎ মিমি দেখলো ও রাজার কোলে। রাজা আত্মহারা, কি করবে খুঁজে পাচ্ছে না আনন্দে। আস্তে আস্তে খাটে মিমিকে বসিয়ে রাজা বলে উঠলো তিনটে মাস সময় দাও, এই বাড়ি বদল করে নেব। আর তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। শুধু বিশ্রাম এ থাকো। কাল একবার অফিসের দেবুদার সাথে কথা বলে ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা।

বাড়িতে জানিয়েছো??

দুই মা আর তুমি জানো

আমি সবার শেষে কেন??

আচ্ছা বাবা অন্যায় হয়েছে।

ঠিক আছে।

এইভাবেই বেশ কাটছিলো দিনগুলো। এর মধ্যে ওই আশে পাশেই একটা ভালো ফ্ল্যাট এর সন্ধান পেয়েছে ওরা। কয়েকদিনের মধ্যেই উঠে যাবে। সেদিন মিমিকে একটা অদ্ভুত আলস্য পেয়ে বসেছিল, সে রাজার অফিসের বাবস্থ্যা করে দিয়ে নিজে ডুব মারলো। বাদুলে দিন ছিল। রাজা অফিসে পৌঁছে কাজে ডুবে গেল। রাজা বেরোবার খানিক বাদ মিমি উঠলো উঠান পেরিয়ে কলঘর যাবার জন্য। প্রাগৈতিহাসিক শ্যাওলা গুলো বাচিয়েই পা টিপে টিপে পৌঁছে  গেল কলঘরের সামনে, হঠাৎ করে মাথাটা যেন কেমন করে উঠে মিমির মনে হলো যেন শূন্যে হাঁটছে। বহুদূর থেকে যেন কিছু কলরব ভেসে আসছিল ।

ঘণ্টাখানিক পর বাড়ির মালিকের ফোনে তখনই ফিরে আসার কথা শুনে রাজা ভড়কে গেল। মাথায় শুধু এটুকু ঢুকলো মিমি নার্সিং হোমে। নার্সিং হোমের ঠিকানায় অফিসের এক কলিগকে নিয়ে পৌঁছে রাজা দেখলো মিমি একটা বেড এ শূন্য চোখে শুয়ে আছে। রাজাকে দেখেই চিৎকার করে বলে উঠলো বেরিয়ে যাও তুমি আমার সন্তানকে মেরে ফেলেছো। তুমি খুনি। রাজার সব শূন্য হয়ে যায় হঠাৎ ই। পা গুলো কাঁপতে থাকে। কোনরকমে সেখান সরে এসে ধপাস করে বসে পড়ে একটা ঘরে।

খানিক বাদে এক ডাক্তার এসে রাজা কে বলেন মি সেনগুপ্ত, ভেঙে পড়বেন না, আপনার ওয়াইফ এখন প্রচন্ড শকের মধ্যে আছেন, ওনাকে বোঝার চেষ্টা করুন। কিছুদিন আপনি কোন রেএক্ট করবেন না। সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক হয়ে আসবে সব কিছু।

প্রচন্ড শব্দে পাঁচতারা হোটেলের লনের দেবদারু গাছের ওপর একটা বাজ পরে গাছটা দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করলো ওই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে। রাজা সম্বিত ফিরে পেয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো মিমি কি তখন থেকেই দূরে সরে গেল ওর জীবন থেকে!!

কাল শনিবার কলকাতা ফিরেই মিমির মুখোমুখি হতে হবে। রাজা ডিনার না করেই গুঁটি শুটি দিয়ে শুয়ে পড়লো। মনের ঘাড়ের শিরা দপ দপ করছে। আলকোহলের শিথিলতায় রাজা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যায়।

মর্নিং ফ্লাইট একদম ঠিকঠাক সময়ে নেমে পড়ায় রাজা 11 টা নাগাদ নিজের বাড়ি পৌঁছনোর পর দেখলো মিমি বাড়িতে নেই। কমন ড্যাস বোর্ডে দেখলো একটা চিরকুট সাঁটা। জরুরি ট্রেনিং এর জন্য 4 দিনের জন্য মুম্বাই গেছে মিমি। আর বাড়ির কাজের লোকেদের ফোন নম্বর লেখা। এইসব টুকিটাকি।

মিমি কি একটা ফোন করেছিল? চিন্তাটা আসার পরেই রাজার মনে পড়লো কাল সন্ধ্যায় রাজাও বহুবার চেষ্টা করেও মিমি কে পায়নি ফোনে। হয়তো সেই ব্যাপার। মনটা সকাল যতটাই উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিল মিমি কে জড়িয়ে ধরার জন্য, মিমির গন্ধ নেবার জন্য ঠিক ততটাই খিঁচড়ে উঠলো। স্নান সেরে রাজা অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেল।

অফিসে পৌঁছে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসতে ভাসতে কাজের মধ্যে থেকে রাজা বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। তারপর সন্ধ্যায় ওর সাফল্য উদযাপন হলো শহরের এক নামি পানশালায়। তার মাঝে একবার ফোন করলো মিমি কে। সাফল্যের এই স্তরে দাঁড়িয়ে আজ রাজা বড় একা অনুভব করছে। তাই এ ফোন। নিছক কুশল বিনিময়ের পর রাজা যখন সাফল্য ভাগ করে নেবার খবর দিলো ওপার থেকে শুধু এলো congrats Raj, you deserve it. কথাগুলো হঠাৎ করেই রাজার কানে বেজে উঠলো। আসলে সকাল থেকে ওর কানে শুধু এই কথাগুলোই বেজেছে বারবার।

পার্টি শেষে বাড়ি এসে রাজা অনেকদিন পর একা বোধ করতে থাকলো। নেশার প্রভাবে কোনো সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

ঘুমটা ভাঙলো বেশ বেলায়। ও আজ সিদ্ধান্ত নিলো অফিস যাবে না। খানিক এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ে এক কাপ চা নিয়ে বসে বসে রাজা অনুভব করতে আরম্ভ করলো, ১৮০০ স্কোয়ার ফুটের বৈভব ওকে উপহাস করছে।কেউ তো একা নেই, কাবার্ড দুটো, এ.সি. দুটো, বেডরুম দুটো, গেস্ট রুম প্রায় দুটো, শুধু রাজা একা।এইসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে বেখেয়ালি মন কখন যেন মিমির নাম্বারটা ডায়াল করে ফেলেছিল। খেয়াল হতে ফোনটা কানে নিতে ভরাট কণ্ঠস্বর বলে উঠলো ম্যায় ওর মেরি তনহাই, আকসার ইয়ে বাতে করতে হ্যায়…রাজা ট্রেইনিং এ আছি, কি হয়েছে তোমার?? কেন ফোন করছো?? পরে কথা বলি??

হ্যাঁ হ্যাঁ, সরি

তারপরেই যান্ত্রব টুং টুং।

রাজার ফোনটা আসার পর থেকেই মিমি একটু অন্যমনস্ক। বার দুয়েক হাল্কা করে বকুনি ও খেলো ট্রেনিং ফ্যাকাল্টির কাছে। মনটা এক জায়গায় আনার চেষ্টা করতে করতে লাঞ্চ ব্রেক হয়ে গেল।মিমি ডায়াল করে দেখল ফোনটা একটানা রিং হয়ে থেমে গেলো। এটাই স্বাভাবিক অফিসে ব্যাস্ত হয়ে গেছে। নিজের ব্যাস্ততার সময় বাবুর কোনো খেয়ালই থাকে না। যা তা একটা….

ট্রেনিং শেষে কলকাতার বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ফোনটা অন করতেই একটা মিস কল আলার্টের এস.এম.এস ঢুকলো। ১৯ বার একটা অজানা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। ১৯ বার !! কে এটা !! ক্যাব এ বসে মিমি রিং করতেই একটা অজানা মানুষ বলে উঠলো ম্যাম আপনি সোজা বাইপাস এপোলো হসপিটালে চলে আসুন। স্যার কে এডমিট করতে হয়েছে। এখন স্টেবল। মিমি কেমন যেন দুলে উঠলো। কি করবে ভাবতে ভাবতেই হসপিটাল এর ঈমার্জেন্সির সামনে আবিষ্কার করলো নিজেকে। খোঁজ খবর করে রাজার কেবিন এর সামনে আবিষ্কার করলো রাজার জুনিয়র আবির কে। আবির জানালো অতিরিক্ত স্ট্রেস, আর মদ্যপান এর জন্য রাজার রক্তচাপ খুব বেড়ে আছে।

দরজাটা ঠেলে ঢুকে রাজার মুখটা দেখে মিমির কেমন যেন একটা মায়া জেগে উঠেই নিভে গেল। সে খুব শান্ত ভাবে এগিয়ে কপালে একটা হাত দিতেই রাজার মুখে একটা শিশুর আনন্দ ফুটে উঠলো, ওর হাতটা টেনে নিজের মুঠোয় নিয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে দিলো।মিমি অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে উঠলো কেমন আছো? উত্তরে রাজা ওর মুঠোটা আরো শক্ত করে মাথা নেড়ে জানালো ভালো। মিমি কেমন যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। আস্তে করে রাজার বেডের সামনের টুল টা টেনে বসে পড়লো। রাজা আস্তে আস্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল, সারা মুখে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়লো ধীরে ধীরে। কিন্তু হাতের মুঠ টা শিথিল হলো না। চারতলার কেবিনের বাইরের দিকের প্রশস্ত কাঁচের জানালাটার বাইরে ছেঁড়া ছেঁড়া গোল গোল সাদা সাদা শিশু মেঘগুলো যেন আদিগন্ত নীলের মাঝে ছুটে ছুটে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। মিমির হঠাৎ মনে হলো তাদের সেই আধা গেঁয়ো শহরটার বালি ভর্তি নদীর পাড়ে বোধহয় কাশ ফুটেছে আগের মতোই। পুজো আসছে তার মানে…..।

পার্থ রায়। জন্ম ও বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের বর্ধমানে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..