মুখরিতা

সৈয়দ মাহমুদ
ছোটগল্প
Bengali
মুখরিতা

মুখরিতা,

অনেক দিন পর কাল রাতে আবার সেই মাতাল করা ঘ্রাণ! টুক করে দরজায় আওয়াজ হতেই দূর্নিবার চেষ্টার তন্দ্রাটুকু কেটে গেল, সাথে সাথেই সজাগ শ্রবণেন্দ্রিয়। তখনই সেই চির চেনা ঘ্রাণ, তার পর মৃদু পায়ের আওয়াজ, সেটিও চির চেনা। তোমার পায়ের আওয়াজ অনুসরণ করে বারান্দায় চলে এলাম, মনে হলো তুমি আগে আগে হেঁটে যাচ্ছ। ইদানিং পুরু লেন্সের চশমায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাই খালি চোখে আবছা অবয়ব ঠিক ধরতে পাচ্ছি না। কিন্তু পরক্ষণেই স্পষ্ট হতে থাকল তোমার উল্টো পায়ে পিছন ফিরে হাঁটা। তুমি বেশ তফাতে হেঁটে যাচ্ছ আমার দিকে মুখ রেখে। আমি তোমাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছি আর দেখছি মাধবীলতায় ছেয়ে গেছে বিশাল বারান্দা, সামনে খোলা উদ্যান, অদূরে কিছু দেবদারু গাছ দাঁড়িয়ে আর তার পাতায় পাতায় আছড়ে পড়ছে অষ্টাদশী চাঁদের কিরণ! আকাশের দিকে তাকাতেই সেই ভয়ঙ্কর জ্যোৎস্না, যার রূপালী আলোয় ঝলমলে ধরিত্রী। হঠাৎ করে এক টুকরো আলো নেমে এলো তোমাকে লক্ষ্য করে। তুমি তখন শিউলি তলায়, দু’হাতে তুলে ধরেছ শাড়ীর আচঁল।

কে তোমাকে এমন চমৎকার সাজিয়েছে? উপরে পরিচ্ছন্ন আকাশে জ্যোৎস্না আর নক্ষত্রের দ্যুতি, তোমার শাড়ীতে হালকা গোলাপীর সাথে ফিরোজা রংয়ের কম্বিনেশন, পুরো পরিবেশটার সাথে কেমন মানিয়ে গেছে। তোমার দু’হাত ভর্তি ফিরোজা কাঁকন, কপালে ফিরোজা টিপ। প্রসারিত দু’হাতে তুলে ধরেছ আচঁল, আর তাতেই অনাবৃত নাভির উপর এসে পড়ল অষ্টাদশী চাঁদের কিরণ! দুধের সাথে আলতা মিশিয়ে যে রং, তোমার সেই রংয়ের সাথে মিশে গেল রূপালী আলোর ছটা, সে এক অবিশ্বাস্য মুগ্ধতার রং। আমি কয়েক মুহূর্ত তার পানে তাকিয়ে নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেললাম যেন। এটি কি শুধুই ক’টা মুহূর্ত নাকি অনন্ত কালের একটি স্থির চিত্র অথবা পিকাসোর তুলিতে আঁকা তৈলচিত্রে আটকে আছে পুরোটা সময়!  আমি এই স্থির চিত্রের এক মাত্র দর্শক হয়ে আমাকে ‍দু’টো চোখ দেয়ার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে থাকলাম। একই সাথে আমার শ্রবণেন্দ্রিয় কি এক স্বর্গীয় নেশায় আসক্ত হয়ে গেল, চারিদিকে সেই চির চেনা সুঘ্রাণ, বড্ড মাতাল করা।

এই অষ্টাদশীর চাঁদের সাথে সেদিনের তুমি-অনাঘ্রাতা অষ্টাদশী মিলেমিশে একাকার হয়ে আছ। সেদিন এমন জ্যোৎস্না রাত ছিল না, হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে কৈশোরোর্ত্তীর্ণ সদ্য যুবকের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে  অধর দিয়েছ এগিয়ে, আর তাতেই এই মাতাল ঘ্রাণের উৎস খুঁজে পাওয়া। অনাঘ্রাতা তুমি আর রইলে না অনাঘ্রাতা। সেদিনের মত সেই একই ক্যানভাসে আবারও আঁকা হচ্ছে আমাদের জীবনের জলছবি। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ সেই আলোর কিয়দংশ নাভি থেকে প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ল তোমার চিবুকে,অধরে আর দু’চোখে। ঠিক তখুনি তোমার চোখের সাথে মিশে গেল আমার দু’চোখ। এই অবিনাশী দৃশ্যেও আমার চোখে এতটুকু কামনার ক্লেদ ছিল না, যেমন ছিল না সেদিনও, যেদিন তোমার অধরে এঁকেছিলাম রক্ত চিহ্ন।

সেই যে আরও একদিন তুমি এলে মধ্যাহ্নের অনেক আগে, হাতে নিয়ে দু’টো সূর্যমূখী, তার উপর আলতো ছুঁয়ে আছে তোমার চিবুকের শেষ প্রান্ত। বিস্তীর্ণ সরিষার ক্ষেত, সদ্য ফোঁটা সরিষা ফুলের মৌ মৌ গন্ধে ছুটে এসেছিল মধু সন্ধানীর দল। দিগন্ত জোড়া হলুদ গালিচা পেতে প্রকৃতি তোমায় বরণ করতে ব্যস্ত। পাশে প্রবহমান শান্ত নদীটির এক প্রান্তে পরিযায়ী পাখিদের কলতান। আমার স্নায়ুতন্ত্রীতে তখন কাঁপন লেগেছে, শিরায় শিরায় ছিল রক্তের নাচন। সমগ্র চরাচর আলোকিত করে সূর্য্যিটাই অকস্মাৎ এল নেমে তোমার টোল পড়া চিবুকে। রোদেলা দুপুরের সেই অপরিসীম মুগ্ধতার মুহূর্তটিতে আজও আমার চক্ষু স্থির হয়ে আছে। সেদিনও আমার মনে কামনার ক্লেদ ছিলনা। ছিল শুধু আলোর ঝলকে দু’চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো বিস্ময়। কিন্তু কি দূর্ভাগ্য দেখ কোনো এক দুষ্ট বালক গুলতি ছুঁড়তেই আহত পরিযায়ীদের হঠাৎ উড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তোমারও অন্তর্ধান।

মুখরিতা, দু’টো পবিত্র আত্মার সম্মিলনে যে সৌধ গড়বার কথা ছিল তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ধর্ম নামক টিপিক্যাল সামাজিক ব্যাধি। চার চোখের নোনা জলের স্রোতেও আমরা সেই বাঁধার প্রাচীর ভাংতে পারিনি। ’মুখরিতা সঞ্চরণ’ নামের সেই অষ্টাদশী কখনো আমার হতে পারে না বলে সদর্পে ঘোষণা দিয়েছিল যে সমাজ, এখন তাকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমার সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে সেই সমাজের প্রতি  ঘৃণার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে আছে, তুমি তা নিশ্চয়ই দেখতে পাও। কাল অষ্টাদশীর চাঁদও সাক্ষী থেকে গেল নিষেধাজ্ঞার প্রাচীরটা বড় বেশী মেকী ছিল। তাই তো মাঝে মাঝেই আমরা তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছি।

কাল মাঝরাতে কি তুমি ভয় পেয়েছিলে? নিশাচর বন বিড়ালটা এত বেরসিক হতে গেল কেন, কেন যে ও তোমাকে ভয় পাইয়ে দিল! তুমি নিঃশব্দে চলে গেলে, যেমন করে আরও অনেক বার গেছ চলে। আমি তোমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বিস্ময় জানো, অষ্টাদশী চাঁদ অকস্মাৎ হাওয়া হয়ে গেল, মিটি মিটি নক্ষত্র রাজি লুকালো মেঘের আঁড়ে, আমার পথ চেনা দায়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ফিরেছি শূন্য ঘরে। তার পর থেকে চোখে যন্ত্রণার শুরু, পোড়া দু’চোখ শুধু সেই আলো আর ছবি খুঁজে ফেরে! কত দিন পর এলে তুমি! আবার কবে আসবে জানিনা। হিরন্ময় স্মৃতি গুলো বড় বেশী দংশন করে ইদানিং। কি করে বিস্মৃত হব সেই প্রথম এবং শেষ চুমুর স্মৃতি। কি করে ভুলব কোনো এক হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে তোমার কাঁপা কাঁপা রাঙ্গা অধর ছুঁয়েছি আমি, নিয়েছি তোমার শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ। কি করে ভুলে থাকব কাল রাতের  পিকাসোর স্থির চিত্র-নিসর্গের মাঝে তুমি-রাঙ্গা অধর-মুক্তো ঝরানো হাসি-হলুদের সাম্রাজ্যে তোমার সূর্য হয়ে ওঠা, – এত সব স্মৃতি যন্ত্রণার দানব হয়ে কত সহস্র বছর আমাকে কুরে কুরে খাবে আমি জানি না।

মুখরিতা, তুমি কি আমাদের যৌথ ঈশ্বরকে বলবে, আমার রাত গুলোকে তিনি যেন কাল রাতের মত করে দেন। কেননা, আমার চোখের যাতনার রং এখন রক্ত বর্ণ হতে শুরু করেছে।

-তোমার

মধ্য রাতের নক্ষত্র

সৈয়দ মাহমুদ। কবি ও গল্পকার। উত্তর জনপদের এক ছোট শহর গাইবান্ধায় জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে। ছোট বেলা থেকেই কিছুটা বোহেমিয়ান সৈয়দ মাহমুদ বেড়ে ওঠেন অনেকটা রক্ষণশীল পরিবারে। শৈশব থেকেই প্রকৃতি তাকে টানতো। বিরাণ প্রান্তরে, সারি সারি বৃক্ষের ছায়ায় হাঁটতে কিংবা...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ