মুনিয়ার ডানা ছিল না

সৈয়দ মনির হেলাল
গল্প
Bengali
মুনিয়ার ডানা ছিল না

মুনিয়া সমুখে তাকায়। পুরো শরীরকে পেছনে ঠেলে দিয়ে চোখসমেত মাথাটাকে ছড়িয়ে দেয় সামনের দিকে। মনে হয়- এখনই  দৌড় দেবে বুঝি! কিন্তু না, এক মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয় এবং ফলত পা-জোড়ার শরণ নিয়ে থমকে দাঁড়ায় সে। একান্ত আপন করে ভাবতে থাকে নিজের দেহসংলগ্ন ভূত-ভবিষ্যৎকে। উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকে হাত, হাতের তালু- আঙুল এবং আঙুলের নখগুলোকে। নিজেকে দেখতে বড় সাধ হয় তার। তাই আপ্রাণ চেষ্টা করে একান্ত নিজের অবয়ব, পা থেকে মাথা-  নিজের আস্ত শরীরটাকে দেখবার। এবং খুঁটে খুঁটে দেখতে থাকে নিজের দখলাধীন পদযুগলকে। পায়ের ঘন্টা, উপচানো শিরাসমেত পত্র-পল্লব এবং নখমন্ডলীতে মুনিয়া হাত বুলাতে থাকে অতীব যত্নের সাথে।

ভীষণ ঘূর্ণি ওঠে আকস্মাৎ! তীরের ফলার মতো আগুনের ছররা ছিটিয়ে সাঁ করে একটা ছাইরঙা গাড়ি  মুনিয়াকে প্রায় আন্ধা করে দিয়ে ছুটে চলে পশ্চিম থেকে পুবে। ধূলি-ঝড়ে নাকাল মুনিয়া অনেক্ষণ চোখের পাতা খুলতে পারে না। হলুদ-বরণ সর্ষেফুল কিংবা জোনাকির আলো টিম টিম করতে করতে আরেকটা গাঢ় নীল রঙের গাড়ি এসে থামে মুনিয়ার প্রায় নাকবরাবর। কালো গ্লাস ভেদ করে গাড়ির অন্দরমহলে চোখ দুটি ঠেসে ধরে মুনিয়া। পেছন-সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন কিংবা  দু’জন মানুষ হয়তো-বা। একজনকে কৈশোর-উত্তীর্ণ এক নারী বলেই আন্দাজ হচ্ছে। অথবা সুন্দরী এক যৌবনবতীও হতে পারে। আচ্ছা, মুনিয়া কি সুন্দরীর কাতারে পড়ে ? কাকে জিজ্ঞেস করবে সে। চরাৎ করে কাঁটা দিয়ে ওঠে মুনিয়ার প্রতি লোমকূপের গভীর থেকে।  না, মুনিয়া আর পেছনে তাকাতে চায় না। কিন্তু গাড়ির পেছনে ঝুলানো একটা বাচ্চার ছবি তাকে বেতাবু করে ফেলে। কী সুন্দর কলাফুলের মতন সফেদ একটা বাচ্চা! মুনিয়া কালো গ্লাস ছেদা করে উঁকি দিতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। হাতের ওম দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে হয় মুনিয়ার।

কিন্তু মুনিয়ার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে এখন।

সে কান পাতে উজান থেকে আরো উজানে।  বাদাম তোলা নায়ের মাল্লা-মাঝিদের ‘নাইয়া রে-’ মিলিয়ে যায় দূর- নিরুদ্দেশ। মেঘের ভেলায় উড়ে উড়ে দিকভ্রান্ত হয় নীল আসমান। তারই পিঠে সওয়ার হয়ে দুলকি চালে ছুটে চলে অনেক অনেক সুরতালি। মাটির সাথে লেপ্টে থাকা সুরতালি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে- আর বেঘোর চক্কর দিতে থাকে মুনিয়া এবং মুনিয়ার সমগ্র জগত-সংসার।

সুরতালির চোখ-মুখ লাল-করা চাহনিতে মুনিয়া যুতসই আড়াল খোঁজে। চোয়ালের শিরা ফুলিয়ে ফোঁস করে ওঠে সুরতালি-  ইস! দিলে তো ফড়িংটাকে উড়িয়ে! মুনিয়া দম বন্ধ করে চেয়ে থাকে ঘাসের ডগা আর ফড়িংয়ের ডানা ঝাপটানোর দিকে। লাল ঝালর দেওয়া ডানাওলা ঘাসফড়িং উড়ে উড়ে ভেসে চলে হাওয়ায় ভর করে। ঘাসের এক ডগা থেকে আরেক ডগায় কী আস্থার সাথে ভেসে ভেসে চলে। সদ্য গজানো  কঞ্চির মতন লেজটি  নড়ছে একই ছন্দে। সুরতালি গুটি গুটি পায়ে ধাওয়া করে ঘাস ফড়িংয়ের লেজ বরাবর। সুরতালি জানে, কত কসরৎ করতে করতে তবেই না একটি ফড়িং ধরা। মুনিয়া-বু বুড়ো হয়ে গেল- তবু সেটা বুঝল না আজো। কিন্তু সোনালি ঘাসফড়িংটার ফরফর ডানা ঝাপটানো দেখলে মুনিয়ার কেবলই বুক ধড়ফড় করতে থাকে।  সুরত, ফড়িংটা ভয়ে কেমন কাঁপছে দেখ! ছেড়ে দে- ছেড়ে দে ভাই!  সোনা-যাদু ভাই আমার, ফড়িংটা ক্যামন ধস্তাধস্তি করছে দ্যাখ!

ভোঁ করে একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগে মাথাটার পেছন বরাবর। একটা কপ্টার চক্কর দিয়ে যায় তার ঢাউস পাখা  ঘুরিয়ে। চোখ মেলে ধরে আকাশ দেখতে চেষ্টা করে মুনিয়া। কেবলই ভোঁ ভোঁ শব্দের ঘুর্ণি ছোটে মাথার ভেতর। এতদভিন্ন কিছুই আর ঠাহর করা যায় না। আকাশটার এ কেমন রূপ আজ! কেবলই ঝাপসা আর ধুলি-ধূসর চৌদিক।  কী মেঘ জমে আছে আসমানটাতে আজ ? ঘোড়দৌড়ের মাঠ মনে হয় আসমানটাকে।

অবিরত ঘট ঘট শব্দ কানে ভেসে আসে। বাপজানটা যে গেল কই। চল, যাই বাজান। এ ঘোড়দৌড় আমার ভাল্লাগছে না। কেবল ধোঁয়া আর ধুলি- ঘোড়া নয়  যেনো ছুটে যাচ্ছে  মেঘের কুন্ডলী! চল বাপজান, ঘোড়দৌড়ের মাঠ আজ ধুতরার বিষ খাইছে মনে লয়!

পাকনা গাবফল রঙের একটা বেলোয়ারি শাড়ি কিংবা রিনিঝিনি সুর তোলা রেশমি চুড়ি, শিশিরকণার মতন একটা নাকফুল কিংবা লাল ফিতা- কিছুই  আর কেনা হয় না মুনিয়ার। মৃতিঙ্গা বাঁশের বাঁশি কিংবা গগজ-ঘড়ি একটাও কেনা হয় না সুরতালির। বাপজানের বাঁ-হাতকে বগলে পুরে মুনিয়া প্রায় টেনে নিয়ে আসে পয়লা ফাল্গুনে শুরু হওয়া মকার হাওরের মেলা থেকে।

মুনিয়াকে জানান না দিয়েই কালো গ্লাস জড়ানো গাঢ় নীল গাড়িটা নাই হয়ে গেল। মুনিয়ার সমুখে তাই ছুটে চলেছে সীমাহীন পথ। এবং  বেচাইন মুনিয়া হাতড়াতে থাকে অতল দৃশ্য-অদৃশ্যপানে। কিন্তু পুনর্বার নীল আসমানটা দেখবার বড় সাধ হয় তার। চোখ মেলে ধরে উর্ধ্ব আসমান বরাবর। কিন্তু না, এ তো আসমান নয়! মুনিয়া দেখে একটা- দুইটা- তিনটা- এবং অনেক- বেশুমার মানুষ লটকে আছে আসমানের কার্নিশ থেকে। ঝুলছে- আর দুলছে! অথবা ঝুলে আছে মানুষ নয়- কতগুলো লম্বা ঠ্যাং! কখনো-বা উদড়িালের লেজ বলে ভ্রম হয় মুনিয়ার। এই লেজগুলো- অথবা লেজওলা মানুষগুলো আকাশে উঠতে গেল কোন দুঃখে- বুঝ পায় না সে। এখনই তো ঠাস করে পড়ে যাবে নির্ঘাত! মুনিয়ার বুকের ভেতর মুগুরপিটা চলে অবিরত। গলা শুকিয়ে চৈত মাসের খরখরা মাঠ প্রায়! চোখ দুটোকে কচলাতে থাকে দুই হাতে। রক্ত চুইয়ে পড়ার টপ টপ শব্দ ঝরছে কেবলই। সেই রক্ত-চোখ নিয়ে বড় বড় করে তাকায় আবার লেজ দেখবে বলে। তবে লেজ নয়, এবার কতকগুলো কংক্রিটের থাম চোখে পড়ে তার। থামের ওপর থাম, তার মাথায় মস্ত আকারের ছাদ- একটার পর একটা- উঠে গেছে মহাশূন্য অভিমূখে। কত কত মানুষ উঠছে আর নামছে! কত ইট- কত পাথর- কত লোহা-লক্কড়, দুনিয়ার হাবিজাবি! মুনিয়া বাতাস হাতড়ে ফেরে! বড় বড় শ্বাস নিতে চেষ্টা করে সে। বুক ভরে বাতাসে গেলবার জন্য জোরে দম টানে ভেতর দিকে। সবুজ একটা গাছ কিংবা নিদেন একটা সবুজ লতিকা কী নেই আশেপাশে ? হাঁপিয়ে ওঠে মুনিয়া। সে অবিরত হাঁফায় আর তড়পায়।

এবং মুনিয়া নুয়ে পড়তে থাকে অকালীন ঝড়োঝাপটার তোড়ে। কিন্তু সূর্যের তীব্র তেজ ও দগ্ধতায় চাবুক ছুটে তার উদোম পিঠে। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে মুনিয়া। আবারো চোখ নিবদ্ধ করে নিজের দিকে। খুঁজতে থাকে তার পা দুটোকে। সে জানে আবার পা চালাতে হবে জোরে-শোরে। কারণ তার তো চাকা নেই। তবে সে জন্য তার কোন দুঃখও নেই বিশেষ। কিন্তু ধুলিমাখা পা-টা তাকে কিছুটা দুঃখিত করে তোলে। দুই পায়ে দুইটা মলের বড় সখ ছিল তার। বিশেষ করে সে যখন দেখেছিল সিহাব কাকার ময়নাটাকে। কী সুন্দর  করে মল পরানো। ময়নার পায়ে মল, কিন্ত তার পায়ে নেই কেনো ? অবশ্য সিহাব কাকার দুইটা মেয়ে কিংবা  ছেলের বউটার পায়েও সে  মল খুঁজে পায় নি।

মুনিয়া পায়ের দিকে ঝুঁকে তার মল খুঁজে। মল নয়, মুনিয়া দেখে তার পায়ে জড়িয়ে রয়েছে অনেক লম্বা- প্যাঁচানো কতগুলো এনামেলের তার। অথচ প্যাঁচানো তার নয়, মুনিয়ার চাই  চাকা। তার দিয়ে মুনিয়ার কাজ নেই সবিশেষ। মুনিয়া দৌড়াতে চায়। রুদ্ধশ্বাস দৌড় প্রয়োজন তার। সে কেবল ছুটতে চায়। ডানে বাঁয়ে কিছুতেই তাকানোর সময় নেই।

বুবু, দৌড়া- দৌড়া বুবু। মুনিয়া হারিয়ে যেতে চায়। হারিয়ে যেতে চায় ঐ কেওয়া বন কিংবা সু্ন্দিবেতের  বনে। কী সুন্দর! গা জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠছে বনগুলো!  সুরতালির ওদিকে খেয়াল কম। তার মন কেবল প্রজাপতির পেছন পেছন। লাল-নীল আর বেগুনি পালকের ছোট বড় অগুনতি প্রজাপতি। মুনিয়াবু, ঐ নদীর ধারের বিন্না বনে দেখবি চল, কত রকমের যে প্রজাপতি। নদীর পার ঘেষে কতরকমের সবুজ গাছ হাওয়ায় দুলছে হলুদ সাদা ফুল নিয়ে, আর তাতে মনের ফুর্তিতে দোল খাচ্ছে বর্ণিল নানান প্রজাপতি। সুরতালি আর মুনিয়াকে প্রজাপতির নেশা পেয়ে যায়। কিন্তু জমাট বাঁধে ঘন অন্ধকার! বুবু, দৌড়া-  দৌড়া বুবু- দৌড়া!

মুনিয়া দৌড়াতে চায়। কিন্তু ভেবে পায় না, তার পায়ে চাকা না হয়ে তার কেন আজ ?

মুনিয়া কিছুই মনে করতে পারে না। মনে করাটা  খুব যে জরুরী- তা নয়। কিন্তু প্রজাপতির মতন নানান বর্ণের না হলেও, নিদেন সাদামাটা দুইটা পাখনা খুব জরুরী তার। বৃক্ষ থেকে বৃক্ষ- ফুল থেকে ফুল- কেবলই উড়তে চায় সে। মুনিয়া পুনর্বার তার পায়ের দিকে তাকায়। লম্বা সুডৌল পা-টার জন্য তার অনেক মায়া। এবং তার বিশ্বাসও। কপালে যতটা বিশ্বাস মুনিয়ার, তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস এই পায়ের ওপর।

কিন্তু, সুরতালি বারবার তার পথ আগলে দাঁড়ায়। কখনো জড়িয়ে ধরে। এত দূর পথ তুই একলা ক্যামনে যাবি বুবু ? বুবু, এই তোর মাথা ছুঁয়ে কিরা কাটছি, আর কোনোদিন টেংরা মাছের ঝুল চাইব না। কখনো বা ডর-ভয় দেখায় সুরতালি। জানস, গঞ্জের পথে অনেক অনেক শিংওলা মইষ আছে কইলাম। একটায় গুতা দিলে কে তোরে বাঁচাবে ক’ ? কিছুই বলে না মুনিয়া। শুধু আনমনে চেয়ে থাকে ধোঁয়া-বিছানো পথের দিকে ।  বাপজান কি জানে-  আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরে উদ্দেশে বাসে উঠতে যাচ্ছে সে ?  ধুর! বাপজান তো এখন নয়া নওশা, তার অতো সময় কই ? অদেখা মায়ের উদ্দেশে শাপ-শাপান্ত করে এবার তেতে ওঠে সুরতালি। দেখ মুনিয়া-বু, তুই আমার কথা শুনবি না যখন, আমি চললাম এই। তুই মর- আমি তোর কেউ না!

একদিনের পরিচয় হওয়া আফাজ মিয়ার পেছন পেছন হাঁটতে থাকে মুনিয়া। সময় গড়িয়ে পড়তে থাকে, দীর্ঘ পায়ে-হাঁটা পথ। দুপুর পেরিয়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল মুনিয়ার। কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি আধাবয়সী আফাজ মিয়াকে। শেষপর্যন্ত গঞ্জের বাজারে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা। এবং সে যখন বাসের হাতলটাতে কষে আঁকড়ে ধরে হাতদুটো দিয়ে , তার মনে হয়- হাত নয়, তার বুঝি পাখনা গজিয়েছে।

দুপুরের সুরুজ তখন হেলে পড়ছে পশ্চিমে। কিন্তু কেমন করে চটজলদি রাত হয়ে গেল,  হিসাব পায় না মুনিয়া। এবং মুনিয়ার চোখে ঘুটঘুটে রাত কেবল। কেবল রাত, রাত আর শেষ হয় না মুনিয়ার। মুনিয়া চিৎকার করল, আফাজ কাকা—-। কিন্তু মুনিয়ার সেই চিৎকার শূন্যতায় মিলিয়ে গেল। অন্ধকারের পেটে কষে এক লাত্থি দিয়ে  পায়ের ওপর ভর করে শূন্যে উড়াল দিতে চাইল। অমনি এক হেঁচকা টানে বিবস্ত্র হয়ে ভূমিতল হল মুনিয়া। তারপর—-।  মুনিয়ার চোখ বাঁধা হল। মুখ বাঁধা হল। মুনিয়ার হাত বাঁধা হল। দুইটা হাত টনটন করতে করতে রক্তহীন আর অবশ হয়ে গেল। দুইটা পা বাঁধা হল।  তারপর, তারপর-তারপর- মুনিয়া আর নড়তে পারল না। চিৎকার করতে পারল না। দেখতে পেল না কিছুই। মুনিয়া চিৎ হয়ে পড়ে থাকল পৃথিবীর পৃষ্ঠ হয়ে।

মুনিয়া নড়তে চেষ্টা করে। লম্বা করে একটা শ্বাস টানবার মরিয়া চেষ্টা করে সে। কিন্তু ভেবে কুল পায় না কোনদিকে যাবে এখন। ডানে, বামে- নাকি সামনে ? কোন দিকে নিশানা করবে এখন ? মুনিয়া আন্দাজ করতে চেষ্টা করে অন্ধকার নামতে কত দেরি আর ?  দিনের প্রহর ঠাহর করতে চেষ্টা করে মুনিয়া। আর তখনই সে দেখে, সূর্যের জোয়ান তেজ তাকে ভিজিয়ে জবজবা করে দিয়েছে। কিন্তু মাথার উপর তাকানোর সাবস হয় না মুনিয়ার। সেই ভালো। রাত নামবার আগেই তাকে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু পা চলতে চায় না আর। কেবল খানা-খন্দকে হোঁচট খেতে হয়। মলের সখ তার উবে গেছে অনেক আগেই। পায়ের ওপরও আর ভরসা করতে পারছে না। তাই মুনিয়ার আবারো ইচ্ছা হয় যদি দুইটা পাখনা পাওয়া যেত। লাল অথবা হলুদ ঝালর দেওয়া পাখনা। ঠিক প্রজাপতির মতন।

অথচ, সেই বিবস্ত্র রাত পেরিয়ে মুনিয়ার চোখে আবার সকালের রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল।

ঠিক তার বাপজানের লাহানই লোকটি। ওরকম সুন্দর জামা-কাপড় পরলে বাপজানকে ঠিক অমনই দেখাবে। চল মা, তোর ভাবনা করতে হবে না। খাবি-পরবি-আর এক-আধটু ফোট-ফরমাস খাটবি। তারপর চার চাকাতে ভর করে অনেকদূর–  মুনিয়াকে ঠিক ঠিক নিয়ে আসে এক স্বপ্নের দুনিয়ায়। চারদিকে শুধু দালান আর দালান। রঙিন ঝাড়বাতি আর কী ফকফকা আলোর নাচন। কিন্তু আশেপাশে গাছ-বিরিক্ষি নেই বলে, একমুঠো মাটি কিংবা একচিলতে রোদেলা উঠোন নেই বলে খুব মন খারাপ হয় মুনিয়ার।

তবুও বেশ ভালো। লোকটা অবিকল তার বাপজানের মতই। নিজস্ব একটা শয়নঘরও পেল সে। পিয়াজ-রসুন-আলু-মরিচ তার রাত্রিবেলার ইয়ার-দোস্ত।

আংকেল লোকটা ছিল তার বাপজানের মতনই। কিন্তু তার কাছে প্রতিটা রাত আসতে থাকে বিভীষিকা হয়ে। সে কুঁকড়ে যেতে থাকে। আর নিঃশ্বাস বন্ধ করে অসাড় পড়ে থাকে সে। এবং কেবলই রাত হয়ে যায় মুনিয়ার। সে নড়তে পারে না, চিৎকার করতে পারে না-  লম্বা আর লোমশ দুইহাত তাকে খামচে ধরে বেআব্রু করে দেয়। খাটিয়ায় শোয়ানো ডোমের হাতের রক্তহীন মাংশের দলা হয়ে পড়ে থাকে সে। আর হিম শীতল শরীর বেয়ে বয়ে যায় তাপিতজলের স্রোতধারা। ভিজে জবজবা হয়ে যায় তার আব্রু। লাল লাল রক্তে ভেসে যায়  আধুনিক স্থাপত্যনকশদার ইমারতের ইট-কাঠ-চৌকাঠ।

উফ কী যন্ত্রণা তলপেটটাতে! তবু যেতে হবে তাকে।  মুনিয়া পা চালায়। দৌড়ায়। বিরামহীন। মুনিয়ার পায়ের আঘাতে খসে পড়তে থাকে ঐ গগনচুম্বি অট্টালিকার ধারালো কংক্রিটসমূহ। মাটি ফুঁড়ে আকাশটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া ইস্পাতশলাকাটি দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে মুনিয়ার প্রশ্বাসের ঘায়ে। ঐ নীল গাড়ি- ঐ কালো কাঁচবন্দী সুন্দরীর নেকাবকে পেছনে ফেলে সে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে।

সুরতালি… আমি আসছি ভাই…। শোন, ঐ সুন্দিবেতের ঘন বন আর ঘাসফুল শিথানে নিয়ে আমি ঘুমাতে চাই। অনেক ঘুম আমার দুচোখে। আমি ঘুমোতে চাই নদী হয়ে- নদীর স্রোত হয়ে আমি উড়তে চাই।

ঝপ করে একটা শব্দ ওঠে। তারপর দুইটা ডানা নেমে আসে চোখের তারায়।  উড়তে থাকে মুনিয়া, উড়তেই থাকে।

সৈয়দ মনির হেলাল। লেখক ও আইনজীবি। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের সিলেট।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..