প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
পাকানো নারকেল দড়িটা জায়গায় জায়গায় ফেঁসে এসেছে। ওস্তাদ বলেছিল ছ’মাসের বেশি রিক্স্ নিবি না,রস্সি পুরানা হলে তার জোর যায় কমে,ঝট্সে টুটে গেলে আদমি বেসামাল ভি হতে পারে – চাই কি গিরনেসে,মতলব পড়ে গেলে একদম খতম। দুহাতের আড়ালে চামড়ার ছোট্ট ডুগডুগিটা বাজাতে বাজাতে কত কত ছ’মাস বিন্দাস কেটে গেছে খেয়াল করেনি দিলীপ অথবা ওর গুরু রঘুবীর। আসলে নতুন রস্সি বললেই তো আর মাটি ফুঁড়ে তা হাজির হয়ে যাবে না,তার জন্য ভাল মত এথি লাগে। জুটবে কোত্থেকে? মানুষ এখন অনেক সেয়ানা হয়ে গেছে। মুফতে দয়া দাক্ষিণ্য দেখানোর মত বোকামো আর বিশেষ কেউ করে না। এদের মধ্যে আবার কঞ্জুস – মাক্ষিচুসদের সংখ্যাও গেছে বেড়ে। অতএব পারলে দিলীপরা বরং নিজেদের শরীরটাকে আর একটু হালকা করে নেয় যাতে রস্সি পুরানা হলেও খতরনাক না হয়ে ওঠে। এরজন্য অবশ্য আলাদা করে কোনো ব্যায়াম – পরিশ্রম করতে হয় না ওদের,ইদানীং রোজগারের যা বহর – রোজ দুবেলা না জোটার কারণে বডি এমনিতেই যথেষ্ট হালকা।
মাটি থেকে দশ – বারো ফুট উঁচুতে বাঁশের ডগাটায় গোল চাকতির মত ফিট করা। চাকতির ভেতর বাঁশের গা ছুঁয়ে বল – বিয়ারিং- এর মসৃণ ঘোরাফেরা। অফিস টাইমে মেন রস্তার পাশে বাঁশ গাঁথলে পথ চলতি মানুষের ভিড় হয় প্রচুর,তালি পড়ে ঘন ঘন। কিন্তু খেলা শেষে চাদর কুড়িয়ে যা জোটে তাতে না ভরে পেট না ভরে মন। আসলে খেলা দেখে নেশা জাগত সবারই – মনে হত আরেকটু দাঁড়াই, কিন্তু অফিসে বেটাইমে দাখিল হলে বসের চেহারা ছবি এমন পাল্টে যেত যে কম লোকই সাহস করত তা করার। একসময় এসব ঠিক বুঝতে পারত না দিলীপ। ওস্তাদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সময়ের সাথে সবই শিখে গেল ও। তাই পরের দিকে আর সকালের দিকে অফিস পাড়ায় বাঁশ পুঁতত না,খেলা সাজাত মানুষের অফিস থেকে ফেরার সময়। এরকমই একদিন ভুখা পেটে চাকতির ওপর গোটা শরীরের ভর রেখে ঘুরতে ঘুরতে মাথাটাতে কেমন চক্কর দিয়েছিল আজ আর মনে করতে চায় না দিলীপ। অত উঁচু থেকে পড়াতে একেবারে জবুথবু হয়ে গিয়েছিল। ওর গুরু রঘুবীর খুব দৌড়াদৌড়ি করে ডাগতার,ইলাজ,দাবা – দারু করে একসময় ওকে ফিরিয়ে এনেছিল ওর পুরোনো ঝুপড়িতে। ফিরেছিল দিলীপ,কিন্তু তা ঠিক সেরে উঠে ফেরা নয়। এ যেন অন্য দিলীপ। ঝুপড়িতে ফেরানো থেকে নিজের জীবনের আখরি দমতক্ দিলীপেরই খিদমদগিরি করে গেছে রঘুবীর। কিন্তু শরীরের আসল তাকত ব্যাপারটাই কোথায় যেন হাপিস হয়ে গেছে দিলীপের। তাকত নাকি সাহস? ঠিক বুঝতে পারে না আজও। তরপর থেকেই রঘুবীরের দেওয়া ছোট্ট এই ডুগডুগিটা হাতে তুলে নিয়েছে দিলীপ। খেল – কুঁদ ছেড়ে এখন যেন নবজন্ম ওর। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত মনের ভেতরে। কারণ আগে এই দড়ি কিংবা বাঁশের খেলা দেখানোর সময় নিজেকে বেশ বাহাদুর মনে হত। তামাম দুনিয়াকে নিজের খেলা দেখিয়ে আবিষ্ট করে রাখার ওস্তাদিটা একটা আলাদা মজা এনে দিত ওর ভেতরে। অথচ দুর্ঘটনার পর নিজেকে এক ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না।
ডুগ ডুগ ডুগ – ডুগ ডুগ ডুগ – হাত নেড়ে নেড়ে বাজাচ্ছিল দিলীপ। আর বছর বারোর নীতা,ওর একমাত্র মেয়ে,সেই ডুগ ডুগির দ্রুত তালে ফুট দশেক লম্বা একটা বেতের লাঠি দুহাতের মুঠোয় ধরে গলি রাস্তার এপার – ওপার টাঙানো মাটি থেকে প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু,সরু দড়িটার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ছোটবেলায় বাপের কাছে হাতেখড়ি ওর এই বিশেষ খেলায়। প্রথম যেদিন বাবার হাত ধরে ধরে অনেক সময় নিয়ে নিয়ে খুব নীচু করে টাঙানো দড়িটা পেরোলো – কেঁদে ফেলেছিল নীতা। নিজের খুব ভেতর থেকে কে যেন ওকে সাবাসী দিয়েছিল। বৃদ্ধ রঘুবীর বলেছিল – তুম সকোগে বেটি,মন লাগাকে শিখনা। বেশ নিয়ম করে অভ্যেস করে গেছে বিগত কয়েক বছর। এখন পুরোপুরি অভ্যাসে এনে ফেলেছে দড়িতে হাঁটা ব্যাপারটা। শুধু হাঁটা নয়,দড়ির খেলায় ওর বাবাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ও। দড়ির ওপরে অর্ধচন্দ্রাকারে শরীর বাঁকিয়ে এখন আর্চ করতেও পারে নীতা। ইদানীং বয়সের কারণে কিনা জানে না, মেয়েটা দড়ির মাঝ বরাবর এলেই দিলীপের বুকটা কেমন যেন করে ওঠে। সংসারের একমাত্র রোজগেরে মানুষ কিনা!
ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল দিলীপ। এক ওস্তাদের ডুগডুগির পিছু নিয়েছিল। ও হারিয়ে যাওয়ার পর পাড়ার সবাই বলেছিল সেই ওস্তাদ সেবার মেলার সময় খেলা দেখাতে এসে ওকে নাকি ডুগ ডুগি বাজিয়ে তুকতাক কিছু করেছিল। হাঁড়ির ভেতরে পুরে নিয়ে যাওয়ার গল্প ছাড়াও আরও অনেক গল্প তৈরী হয়েছিল ওকে ঘিরে। নিজেকে ওস্তাদ বানানোর ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখত ও। কী এক অমোঘ আকর্ষণ ঐ ডুগ ডুগ শব্দের তা বলে বোঝাতে পারবে না আজও। নিজেও যে খুব ভাল করে বুঝেছে তাও ঠিক নয়। কিন্তু তবু পড়াশোনা থেকে শুরু করে ঘর বাড়ি সব কিছু ছেড়েছে ঐ খেলা শেখার নেশায়। তারপর বিভিন্ন ওস্তাদের নজরদারিতে নিজেও কখন যেন আর এক ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। এভাবেই এক ওস্তাদ থেকে আরেক ওস্তাদের আখড়া ঘুরতে ঘুরতে দড়ি আর বাঁশের কক্টেলে এ ধরণের যাবতীয় মাদারি কা খেল – এ নিজেকে নিপুণ থেকে নিপুণতর করে তুলেছে। ওদের এলাকার আশেপাশে আরও যারা এ পেশার সঙ্গে যুক্ত,তাদের সবার চেয়ে লিস্টির একেবারে ওপরে তুলে নিয়েছে নিজেকে। তবেই না জোয়ান বুড়ো থেকে শুরু করে সমবয়েসী বা একটু ছোট ছুঁড়ি – ছেমড়িদের নজরে পড়েছে দিলীপ। এরকমই এক দিল খালাস খেল শেষে জবার সাথে আলাপ। রঘুবীরের তখনকার এক চেলার মেয়ে জবা মানে এক সব পেয়েছির দেশ। খেলা শিখত দিলীপ আর ডুগির বোলের সঙ্গে কখনও কাঁসর কখনও শিঙে ফুঁকত জবা। খেলা শেষে পয়সা কুড়াতে কুড়াতেই আলাপ দিলীপের সঙ্গে,আলাপ থেকে প্রেম,প্রেম থেকে আগুন আর সলতের গল্প। বেশ চলছিল এভাবেই। ঠিক কবে থেকে রঘুবীরও একসঙ্গে থাকতে থাকতে যেন ওদেরই একজন হয়ে গেছে। একটু একটু করে টাকা জমিয়েছে ওরা সবাই মিলে। জবা আর দিলীপ ওদের গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে সংসারও পেতেছে একসময়। কালের নিয়মে সেই সংসার বেড়েছে,ওদের মাঝখানে ফুটফুটে এক মেয়ে অনীতা এসে দখল নিয়েছে জবার। প্রথম দিকে দিলীপ একটু খুঁত খুঁত করলেও পরে বুঝেছে নিজে নিজেই। অযথা জবার ওপর রাগ দেখায় নি,নিজের অধিকারবোধ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে নি। এভাবে সব কিছু ঠিকঠাক চলতে চলতেই অঘটন। শুরু হয়েছে যন্ত্রণার দিন। তরপর সময়ের সাথে সাথে সব কিছু একসময় ভুলেও গেছে। পুরোপুরি ভুলে গেছে তা নয়,ঐ একরকম করে নিজের মনকে মানিয়ে নিয়েছে বলা যায়।
আজকাল খেলা দেখাতে দেখাতে মেয়েটা পড়ে গিয়ে হাত – পা ভাঙলে ওদের সবার মাথায় ছাদ ভেঙে পড়বে এমনতর চিন্তায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে দিলীপ। ভয় শুধু যে দুর্ঘটনার তাও তো নয়! দেয়ালে পিঠ মানুষটা আর কোনো উপায়ও খুঁজে পায় না। শুধু সতর্ক থাকে যাতে ডুগ ডুগির লয় ওর নিজের অন্যমনস্কতার সুযোগে হঠাৎ কমে বা বেড়ে না যায়। খুব শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিল অনীতা – আদর করে ডাকত নীতা। ছোট থেকেই বাপের খুব ন্যাওটা ছিল মেয়েটা। দিলীপ খেলা দেখানোর সময় ডুগ ডুগি বাজাত ওর গুরু রঘুবীর। আর সেই শব্দ শুনলেই ঘরের ভেতর থেকে হামা টেনে টেনে বেরিয়ে আসত নীতা। প্রথম প্রথম রেগে যেত রঘুবীর – যদি আনমনা হয়ে পড়ে দিলীপ! যদি ড়ুগ ডুগির তালে ভুল হয়ে যায় ওর নিজের! মেয়ে অবশ্য হামা টেনে অঘটন ঘটায়নি কোনও। একমনে শুধু তাকিয়ে থাকত বাবার দিকে। আর এক একটা খেলার শেষে দর্শকরা সবাই যখন হাততালি দিত তখন বুঝে অথবা না বুঝেই নীতাও তালি দিতে দিতে হাসিতে ভেঙে পড়ত। সবই অদৃষ্ট!
গতকাল নীতার রোজকার প্রাক্টিসের সময় খুব একচোট হয়ে গেছে ওদের স্বামী – স্ত্রীতে। খেলা দেখানোর জন্য নতুন যে ঘাঘরা – চোলির সেটটা পাড়ার দর্জির কাছ থেকে বানিয়ে এনেছে ওর বউ, তার কাট ছাঁট বড় বেশি আধুনিক। শহর বাজারে সাজ পোশাকে ওর চেয়ে অনেক বেশি আধুনিকারা ঘুরে বেড়ালেও কেউ খুব একটা মন দেয় না। কিন্তু ওদের গাঁ ঘর কিংবা এখন যেখানে আছে সেই আধা মফঃস্বলে এসবের নিন্দে হয় প্রচুর। চোখের সামনে কলাগাছের মত ঝটপটিয়ে বেড়ে উঠল কচি মেয়েটা। নতুন পোশাকটা পরে ঘর থেকে বাইরে আসতেই চমকে ওঠে দিলীপ। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে কষ্ট হয় ওর। একটা বিষাক্ত পোকা যেন সরসর করে হেঁটে চলে যায় ওর ডান গাল বেয়ে। ওড়না ছাড়া চোলির সামনেটা বেপরোয়া মুখ ভেংচাচ্ছে। দরোজা যতটা বন্ধ,খোলাও বোধহয় ততটাই। মেজাজ বেশ খানিকটা চড়ে যায় দিলীপের। মেয়েকে ঘরের ভেতরে যেতে বলে ওর মাকে ডেকে পাঠায় দিলীপ। তর্কাতর্কির শুরুও তখন থেকেই।
– ওটা কী পরিয়েছিস্ মেয়েকে ? লজ্জা শরম সব মাথায় উঠে গেল যে রে।
– তোমার যেমন চোখ,বলি এখনই তো রোজগারের সময়। চারপাশে লোক ভিড় করে কি তোমার ঐ ডুগডুগির বাজনা শুনতে ?
– কেন,খেলার সাথে সাথে বাজনা না বাজালে কি চলে ? ডুগডুগির বাজনা শুনে তবে তো মেয়ে হাঁটবে দড়ির ওপর। বাজনা ছাড়া ব্যালেন্স রাখবে কী করে ?
– তোমার মাথা। বাড়ন্ত মেয়ে তোমার। এখন মল্লিকা কিংবা রাখীর মত পোশাক না পরলে লোকের ভারী বয়েই গেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার ঐ শুকনো দড়ি ডুগির খেলা দেখতে।
– কী বলছিস কী ?
– ঠিকই বলছি,বলে হেলেনের মত কেউ ছবিতে নামার চেষ্টা করলে বাড়তি খরচ ভেবে তাকেই দূর দূর করে ফুটিয়ে দেবে এখন। কবে থেকে বলছি ,একটা ভাল দেখে পুরোনো মোবাইল কেন,আর তাতে এখনকার কিছু হিট গান লোড করিয়ে নাও,সঙ্গে একটা অ্যাম্প্লি বক্স।
– তোর মনে আছে,আমি একবার খেলার সঙ্গে গান বাজাবো বলে ঠিক করে কী বিপদে পড়ে ছিলাম ওস্তাদের কাছে ?
– বলি তোমার আমার যুগ আর নেই গো ভালো মানুষের পো। এখন লোকে পুরো থুথু দিয়ে রোখড়া গুণে নেয়। বুঝলে না, ঠিকঠাক বললে বলতে হয় এখন লোকে জাঙিয়ারও পিক পকেট খোঁজে। বদল চাই গো বদল।
– তুই আজকাল পার্টি ফার্টি করছিস নাকি,মনে হচ্ছে সামনের বার ভোটেও দাঁড়িয়ে যাবি ?
– খোঁটা দিচ্ছ, দাও দাও। ওরম বসে বসে ল্যাজ নাড়ালে অনেক কথাই বলা যায়। তোমাদের যুগের খেলা আজ আর কেউ দেখবে ?
– রাখ্ তো, খেলা খেলাই। আমাদের তোমাদের আবার কী ?
– তবে আর বলছি কী, দেখ না মাইকে সেদিন বলতে বলতে যাচ্ছিল – একটা কিনলে আর একটা ফ্রি! কিছু না কিছু ফাউ দিতেই হবে,তা সে যাই হোক।
জানালায় ঝোলানো তেলচিটে পর্দা পিছলে চলে আসা শব্দগুলো কেটে কেটে বসে যাচ্ছিল নীতার কানের ভেতর। খুব গোপনে লুকিয়ে রাখা একটা পুরোনো ছেঁড়া সিনেমার পত্রিকা বার করে আনে নীতা। নাম না জানা এক দক্ষিণী অভিনেত্রীর ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত লাস্যময়ী ছবি বার করে এনে আয়নার সামনে মেলে ধরে। একবার নিজেকে আর একবার ছবির দিকে তাকিয়ে দেখে। নিজের রুখু – শুখু চেহারার সঙ্গে হাতে ধরা ছবির তেমন কিছু মিল খুঁজে না পেয়ে চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়ে। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখত – বড় হয়ে বাবার চেয়েও বড় খেলোয়াড় হবে। দড়ির ওপর যত রকম খেলা দেখানো যায় এক এক করে সব খেলা শিখে নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে একেবারে। কিন্তু এখন মাথাটা গুলিয়ে ওঠে ওর। মা চাইছে এই ছবির বড় মেয়ে মানুষের মত শরীর,যাতে খেলা ততটা না জানলেও চলবে কিন্তু লোকের নজর যেন ওর ওপর থেকে না সরে। আর বাবা চাইছে জাত খেলোয়াড়ের মেয়ের খেলা দেখে সব লোকের যেন তাক লেগে যায়। সংসারে বাবার অবস্থা অনেকটা এখন হাল ভাঙা নৌকোর মত। একা একা ভেসে থাকে জলে কিন্তু এগোনোর ক্ষমতা নেই তার। ইচ্ছেমত তাতে হাল জুড়ে নেয় ওর মা, নৌকোটাকে এগোতে চায় এক নির্দিষ্ট পথে যে দিকে সংসারে একটু রসদের জোগান বাড়বে। এমনিতে যে দিকে তাকায় সেদিকেই অভাবের ঘূর্ণীর মাঝে পড়ে দৃষ্টি অসচ্ছ হয়ে আসে। আর এ দুয়ের মাঝ থেকে কিশোরী নীতা পড়ে যায় মহা ফাঁপড়ে – মাটিতে বিছানো চাদর খুচরো অথবা নোটে কীভাবে ভরবে তা ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। একবার হাতে ধরে থাকা ছেঁড়া ছবি আর আলনায় ভাঁজ করে রাখা পুরোনো চাদরটার দিকে তাকায় নীতা। বেশ বুঝতে পারে একবেলা কোনোরকমে দুটি ফেনা ভাত আর এক বেলা একবাটি মুড়ি কিংবা পান্তাভাতে আর যাই হোক দক্ষিণী মেয়ের স্বাস্থ্য ছোঁওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে ঘরের একমাত্র চৌকিটাকে আশ্রয় করে সান্ত্বনা খোঁজে।
নিজের বউয়ের কথায় বেশ একটা ধাক্কা খায় দিলীপ। ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না নিজের কানকে। বাইরের কেউ নয়,তার নিজের বউ বলছে এই কথা! জবা কি পাল্টে গেছে খুব!নাকি ও নিজেই ঘরের সামনে বসে থাকতে বাইরের পৃথিবীটাকে চিনতে পারছে না!এতকাল ধরে তার নিজের আর মেয়ের চর্চা – সবই বৃথা হয়ে গেল তবে! আসলে এখন আর খেলা কেউ দেখতে আসে না,সবাই আসে তার মেয়ের বেয়াড়া যৌবনের টানে। ওস্তাদের কাছে খেলা শেখার সময় কখনও তো মনে হয়নি মানুষ ওর খেলা ছেড়ে অন্য কিছু দেখতে চেয়েছে। বেশ মনে পড়ে,একবার দড়ির খেলায় চমক আনার জন্য ওদেরই বস্তির এক ঘর থেকে একটা ভাঙা টেপ জোগাড় করে এনেছিল। ইচ্ছে – খেলা চলার সময় বাজবে হিন্দি সিনেমার গান। ওস্তাদ রঘুবীর এমন চোখে ওর দিকে তাকিয়েছিল যে সে টেপ আর চালু করতে হয়নি দিলীপকে। অথচ এখন নাচতে গেলে টেপ চাই,সিনেমার গান চাই, ছোটপারা বুক – পেট খামচে ধরা কিংবা আধখোলা কাঁচুলি চাই! কলিজা নিঙড়ানো কসরৎ চাইনা,ব্যালেন্সের মেহনৎ চাইনা – এর নাম দুনিয়া। হাঁটুর নীচের দিকটা কেমন জেলির মত থকথকে ভারী লাগে দিলীপের। চারপাশের মানুষগুলো টিভি – সিনেমার পোকা হয়ে গেছে যেন। কত নতুন নতুন খেল রগড় সেখানে। নাচ গানের কত রকমারি কম্পিটিশান,মন কেমন করা সিরিয়াল – সিনেমার যুগলবন্দি! সেসব ছেড়ে সত্যি সত্যি কেউ বাঁশ দড়ির পুরোনো এই খেলা দেখতে আসবে কি? দিন কয়েক আগে ওদের কলোনীর এক প্রতিবেশী দালাল বলেছিল দিলীপকে –ওসব খেল কুঁদ দিয়ে নাফা কিছু হবে না,বুঝলিরে বুদ্ধুরাম! তার চেয়ে মন চাইলে মেয়েটাকে রেডি রাখিস,আজ – কাল যেদিন বলবি,পরের দিনই খুব ভোরে এসে নিয়ে যাব মালিকের কাছে। ঠিক ঠিক বশ করতে পারলে বদলে যা মিলবে,বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবি মিয়া বিবিতে। হাঃ,মিয়া বিবি! বউয়ের লোভী চোখগুলো এখনই কেমন ভয় ধরায় দিলীপকে। শুধু কি বউ? ওর মেয়েটাই যদি কারও সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া করে,যদি তার সাথেই পালায়! নিজেকে প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ির নীচে তোবড়ানো একটা বাটি নিয়ে বসে থাকতে দেখে দম বন্ধ হয়ে আসে দিলীপের। অভাব বড় বালাই,বুঝতে পারে দিলীপ। তার ওপর নিজের এই খোঁড়া – নুলো অবস্থা,অঘটন যে আজও ঘটেনি – এ তার অনেক জন্মের পূণ্য বইকি!
নিজের চারপাশে বস্তির কাঁচা নর্দমার গন্ধ টের পায় দিলীপ,অথচ এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনও আঢাকা নর্দমা চোখে পড়ে না ওর।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..